শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত/সমাজ চিত্র

সপ্তম
সমাজ চিত্র

 বৃন্দাবনে সেই মোহন্তঙ্গী আমায় বলিয়াছিলেন, “অন্নবস্ত্রের দয়া তুমি অনেক পাবে।” তাঁহার কথাটী যে সত্য, এই প্রমাণ আমি জীবনে বার বার পাইয়াছি। দারিদ্র্য হইতে রক্ষা পাওয়া কঠিন নহে— কিন্তু প্রবৃত্তির আক্রমণ হইতে কেহ বাঁচাইতে পারে না। অধিকন্তু সেই রাক্ষসীর গ্রাসে ঠেলিয়া দিবার লোক অনেক আছে।

 রাণী-মাসী এবার আমাকে তাহার নিজের বাড়ীতে লইয়া গেল। সেখানে দোতলায় একখানা ভাল ঘর খালি হইয়াছিল। আমি তখন বুঝি নাই, এই প্রকার দয়ার কার্য্যই আমাদিগকে সর্ব্বনাশের পথে টানিয়া নেয়।

 আমার যে বিদ্যা ছিল, তাহাতে আমি কাহারও বাড়ীতে ছোট ছেলে মেয়েদের পড়াইতে পারিতাম, টেলিফোন আফিসে কাজ করিতে পারিতাম— নার্সের কাজ করিতে— গান শিখাইতে পারিতাম, কিন্তু এই সকল সৎপথে অর্থ উপার্জ্জন করিবার প্রবৃত্তি এবং সুযোগ কেহ আমাকে দেয় নাই। কেবল রূপযৌবনের পসরা লইয়া বাজারে ঘুরিবার দুর্ম্মতি রাণী-মাসী আমার হৃদয়ে জাগাইয়া দিতে লাগিল।

 আমি বলিলাম, “রাণী-মাসী, আমার দেহকান্তি মলিন হয়েছে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষীণ, বিশুষ্ক। মাথার চুলের আর সে পূর্ব্বের শোভা নাই। আমার দ্বারা এই পথে আর কি উপার্জ্জন হবে?” রাণী-মাসী আমাকে বুঝাইল; “পতিতার রূপই প্রধান সম্পত্তি নহে। লম্পটেরা রূপ দেখিয়া মোহিত হয় না। দেখবে অতি কুরূপা বেশ্যা, সুন্দরীদের অপেক্ষা অধিক অর্থ উপার্জ্জন কচ্ছে। এই জন্যে বলে যার সঙ্গে যার মজে মন। পুরুষগুলি যখন সন্ধ্যাবেলা বেশ্যা পল্লীতে ঘুরে বেড়ায় তখন কন্দর্পঠাকুর তাদের চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দেন।”

 রাণী-মাসী আমাকে কতকগুলি কৌশল শিখাইল। কাপড় পড়িবার ফাশান, দাঁড়াবার ভঙ্গী, কথা বলিবার কায়দা, চলিবার রীতি, এসব কিরূপ হইলে লোক আকৃষ্ট হয় সে তাহা দেখাইয়া দিল। মনে দারুণ দুঃখ ও অপ্রীতির কারণ থাকিলেও আগন্তুক পুরুষের সঙ্গে হাসিয়া কথা কহিতে হইবে। এমন ভালবাসা দেখাইবে— তাহা যে কপট, তাহা কেহ যেন ধরিতে না পারে। প্রণয়ী মদ্যপানাসক্ত হইলে তাহার মন রক্ষার জন্য কিরূপে মদের গ্লাস ঠোঁটের কাছে ধরিয়া ম্যপানের ভাণ করিতে হয় তাহা দেখিয়া লইলাম। লম্পটদের মধ্যে যে ব্যক্তি যে প্রকারের আমোদ চায় তাহাকে তাহাই দিতে হয়। এই প্রকার প্রতারণা শিক্ষা করিতে করিতে আমার বোধ হইল, যেন আমার হৃদয়ের মধ্যে একটী নূতন মানদাম সৃষ্টি হইতেছে।

 আমি ভাল গাহিতে পারিতাম। গলার স্বরও আমার বেশ সুমিষ্ট ছিল, একথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। এ বিদ্যাটী পতিতার জীবনে খুব কাজে লাগে। রাণী মাসী অনেকে গান শিখাইবার জন্য একজন ভাল ওস্তাদ রাখিল। সে বলিল, “তোমার ব্রহ্ম সঙ্গীত অথবা স্বদেশী গান ত এখানে চলবে না। লপেটা, হিন্দি গজল অথবা উচ্চ অঙ্গের খেয়াল ঠুংরা এসব হ’ল বেশ্যা মহলের রেওয়াজ। কীর্ত্তনও শিখিতে পার।” আমি তিন চারি মাসের মধ্যেই সঙ্গীত শিক্ষায় উন্নতি দেখাইলাম। কীর্ত্তন শিখিতে কিছু দেরী হইল।

 ছলনা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে লোক চিনিবার বিদ্যাও শিখিতে হইয়াছিল। কে চুরির মতলবে আসিয়াছে— কে কুৎসিত রোগাক্রান্ত— কে দুষ্ট প্রকৃতির লোক, কে ভালমনুষ ও সরলচিত্ত, এ সকল আমাদিগকে মুখ দেখিয়া ধরিতে হয়। অনেক সময়ে বিপদেও পড়িয়াছি। একদল লোক আছে, তাহারা বেশ্যা বাড়ীতে ডাকাতি করিয়া বেড়ায়। কখনও কখনও বেশ্যাকে হত্যাও করিয়া থাকে। এমনিভাবে প্রাণটী হাতে লইয়া পতিতা নারীকে ব্যবসা করিতে হয়। দু-পাঁচ টাকার জন্য কোন নারী একেবারে অপরিচিত পুরুষকে গ্রহণ করে— হয়ত সেই বিশ্বাসঘাতক স্ত্রীলোকটীর বুকে ছুরি বসাইয়া তাহার গহনাপত্র লইয়া পলায়ন করিল। হতভাগিনী আর চক্ষু মেলিল না। পতিতারা পাপের শাস্তি এইরূপেও হাতে হাতে পায়।

 আমার ঘরে একটী ভদ্রলোক আসিতেন। তিনি কলিকাতার একজন ভাল চিকিৎসক। আজ পর্য্যন্ত তিনি নাকি বিবাহ করেন নাই। তাঁহার নিকট আমি অনেক উপকার পাইয়াছি। আমার শরীর যাহাতে শীঘ্র সারে, সেইজন্য তিনি খুব ভাল ভাল ঔষধ আমাকে দিয়াছিলেন। চিকিৎসাতেও তাঁহার অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল। তাঁহার মত একজন চিকিৎসককে এত বেশী টাকা দর্শনী দিয়া আনন আমার পক্ষে অসম্ভব। তিনি যেদিন দুই তিন ঘণ্টা আমার ঘরে বসিতেন, সে দিন আমাকে দশ বিশ টাকা দিতেন। কখনও কখনও সন্ধ্যার পরে আমাকে মোটরে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইতেন— গ্রাণ্ড হোটেল, গঙ্গার ধারে অথবা ইডেন গার্ডেনে বেড়াইয়া আমরা অধিক রাত্রিতে বাড়ী ফিরিতাম, সেদিন আমি ৫০ টাকা পাইতাম। তাঁহার অনুগ্রহে আমার মাসে প্রায় দুইশত টাকা উপার্জ্জন হইত।

 রাণী-মাসী আমাকে সাবধান করিয়া বলিল “মা, রোজগার যা পার এইবেলা করে নাও। শেষ বয়সের কথা মনে রেখো। এখন থেকে কিছু না জমাতে পারলে ভবিষ্যৎ জীবনে কষ্ট পাবে। দেখছে ত-এপথে বন্ধু-বান্ধব কেহই নাই। একমাত্র টাকাই সব।” আমি এই চিকিৎসক মহাশয়ের অনুগ্রহ পাইয়া অন্যদিকে রোজগারে একটু ঢিলা দিয়াছিলাম। রাণীমাসী বুঝিয়াছিল, এই বাবু চিরদিন থাকিবেন না। তার অনুমান মিথ্যা হয় নাই।

 সেই বৎসর আশ্বিন মাসে পূর্ব্ববঙ্গে ভীষণ ঝড় তুফান হয়! তাহাতে বহুলোকের প্রাণনাশ ঘটে। লোকের ঘর বাড়ী, বাগান শস্যক্ষেত্র সমস্ত নষ্ট হইয়া যায়। তাহাদের দুর্দ্দশা মোচনের জন্য কলিকাতায় এক সাহায্য ভাণ্ডার খোলা হয়। বিখ্যাত ব্যারিষ্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্ত্তী ও চিত্তরঞ্জন দাশ (উভয়েই এখন পরলোকে) এই সংকার্য্যে অগ্রণী হ’ন। তাঁহাদের চেষ্টায় বহু সহস্র টাকা সংগৃহীত হইতে থাকে। যুবকেরা রাস্তায় রাস্তায় গান গাহিয়া ভিক্ষা করিত। বেশ্যা-পল্লীতেও তাহারা আসিত। আমরাও সেই সাহায্য ভাণ্ডারে যথাসাধ্য অর্থ দিয়াছি।

 একদিন আমার সেই চিকিৎসক বাবু আমাকে বলিলেন “মানী, তোমারা পতিতা নারীরা মিলে যদি কিছু চাঁদা তুলে ঐ ইষ্টবেঙ্গল সাইক্লোন ফণ্ডে পাঠাও, মিঃ সি, আর, দাশ তা’হলে বিশেষ সন্তুষ্ট হ’বেন। তাঁর ইচ্ছা, এই সংকার্য্যের জন্য সমাজের সকল স্তরেই সাড়া পড়ুক। কি বল— পারবে?”

 আলি বলিলাম— “দেখুন, আমি ত এ পথে নূতন। সকলের সঙ্গে চেনাশুনা নাই। আপনি ভরসা দিলে আমার যতদূর সাধ্য করব।” তিনি বলিলেন, “রামবাগান, সোনাগাছি, ফুলবাগানে আমর জানাশুনা আরও কয়েকজন মেয়ে মানুষ আছে— থিয়েটারের অভিনেত্রীদেরও এর মধ্যে আনা যায়!”

 চিকিৎসক মহাশয়ের সঙ্গে নাকি মিঃ সি, আর, দাশের পরিচয় ছিল, তাঁহার ও কতিপয় বন্ধুর চেষ্টায় কলিকাতার বেশ্যা পল্লী হইতে কয়েক সহস্র টাকা চাঁদা উঠিল। জনসাধারণের কার্য্যে এই আমার প্রথম যোগদান। এই সুযোগে আমি মিঃ সি, আর, দাশকে প্রথম স্পর্শ করিয়াছিলাম। আমরা যখন প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ে টাকার তোড়া রাখিলাম, তখন আনন্দাশ্রুতে তাঁহার বক্ষ প্লাবিত হইল। তিনি আমাদের মস্তক স্পর্শ করিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন। বুঝিলাম তিনি সতাই দেশবন্ধু।

 রাজবালার সহিত একদিন দেখা করিতে গিয়া দেখি, তাহার ঘরে খুব ভাল দামী আসবাব পত্র আসিয়াছে। একখানা পালঙ্ক, দেওয়াল আয়না, বুক্‌‌কেস্‌ এই সব জিনিষে ঘর সাজান রহিয়াছে। বিছানার জন্য গদী তৈয়ার হইয়াছে। তাহার গায়ে কিছু নূতন গহনাও দেখিলাম। রাণী-মাসীর টাকা সে পরিশোধ করিয়াছে; তাহার নিজের হাতে কিছু নগদ টাকাও জমিয়াছে। খোলার ঘরে থাকিয়া বেশ্যাদের এত অর্থ উপার্জ্জন হয়, আমার পূর্ব্বে ধারণা ছিলনা। আমি ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে রাজবালা কহিল “নানাপ্রকার লোক বেশ্যালয়ে আসে। যাহারা ধনী জমিদারের ছেলে, তাহারা বন্ধুবান্ধব লইয়া প্রকাশ্যে বেশ্যাদের নিকটে যায়। লোক-লজ্জা, ভয় ইহাদের নাই। ইহারা মদ্যপান, গান-বাজনা প্রভৃতি আমোদ প্রমোদে লিপ্ত হয়। ছোটখাট খোলার ঘরে ইহাদের পদার্পণ হয়না। রামবাগান, সোনাগাছিই তাহাদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র। আর একদল লম্পট আছে, যাহারা সমাজের নিন্দার ভয় করে— যাহারা উচ্চপদস্থ ব্যক্তি বলিয়া সম্মানিত, তাহারা একাকী গোপনে বেশ্যাগৃহে আসে। কেবলমাত্র প্রবৃত্তির তাড়নাই ইহাদের আসিবার কারণ। গান বাজনা, বা অপর কোন আমোদ প্রমোদ ইহারা চাহেনা। লুকাইয়া লুকাইয়া ইহারা আসিয়া চলিয়া যায়— এদিকে লোক সমাজেও নিজেদের মান মর্যাদা ও সুনাম রক্ষা করে। কবি, সাহিত্যক, সমাজ সংস্কারক, নামজাদা উকিল— স্কুলের মাষ্টার, কলেজের প্রফেসার,— রাজনীতিক নেতা, উপনেতা, গবর্ণমেণ্ট আফিসের বড় কর্ম্মচারা, ব্রাহ্ম, মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত, বিঘাভূষণ, তর্কবাগীশ প্রভৃতি উপাধিধারী অধ্যাপক, পুরোহিত, মোহান্ত, গুরুগিরি ব্যবসায়ী এই সকল লোক এই শ্রেণীর। আমার ঘরে একজন হাইকোর্টের বিখ্যাত উকীল আসেন। তিনি অতি উচ্চবংশীয় ভদ্র সন্তান।

তাঁহার নাম শ্রী......। বয়স একটু বেশী। তিনি আমাকে অনেক টাকা দেন। আমি সেই বাবুকে একদিন ঠাট্টা করে’ বলেছিলাম, তুমি হাইকোর্টের উচ্চ আসনে প্রতিষ্টিত হ’বে। আমার সেই কথা ফলে গেছে। তিনি সত্যসত্যই হাইকোর্টে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি খুসী হ’য়ে আমায় এই সব জিনিষ পত্র কিনে দিয়েছেন। আমার এই দামী আংটীটা তাঁহারই উপহার।”

 রাজবালার সহিত কথা কহিতে কহিতে সন্ধ্যা অতীত হইল। আমি চলিয়া আসিব বলিয়া উঠিয়াছি এমন সময় একজন লোক রাজবালার ঘরে প্রবেশ করিল। রাজবালা সেই লোকটীকে আদর অভ্যর্থনা করিয়া বসাইল। আমি বাহিরে আসিয়া অম্ফট স্বরে রাজবালাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “ইনি কে?— এঁকে ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মত দেখাচ্ছে।” রাজবালা বলিল “ইনি আমার এক বাবু। খুব বড় অধ্যাপক। ইনি মহামহোপাধ্যায় উপাধিধারী পণ্ডিত। ইনি আজকাল আমায় নিয়ে খুব মজেছেন। তবে শুনেছি এঁর একটা দোষ আছে— নিত্য নূতন চাই। বেশ্যা মহলে ইনি সুপরিচিত। খোলার ঘরেই এঁর যাতয়াত বেশী। আমি যতদূর পারি ক’সে আদায় করে নিচ্ছি— কি জানি আবার কোন্‌দিন সরে পড়্‌বে।

 কিছুদিন পূর্ব্বে কালিদাসী হাড়কাটা গলির বাড়ী ছাড়িয়া রামবাগানে উঠিয়া গিয়াছে। সে একজন ধনবান ভাটিয়া সওদাগরের নজরে পড়িয়াছিল। একদিন কালীদাসীর নূতন বাড়ীতে যাইয়া দেখি তা’র অতুল ঐশ্বর্য্য হইয়াছে। তেতলায় দু’খানি বৃহৎ ঘর— একখানি বসবার, একখানি শোবার। ইলেক্‌ট্রীক্‌ লাইট, পাখা, পালঙ্ক, বুককেস্, বৃহৎ আয়না, ছবি, মার্ব্বেল পাথরের টেবিল, মেজেতে লিনোলিয়াম পাতা, শুভ্র ফরাস্ বিছানা কোমল তাকিয়ায় শোভিত— রূপার পানের থালা, এস্‌ট্রে। কৃষ্ণনগরের সুন্দর মাটীর পুতুলে আলমারি সাজান। তিন সেট জড়োয়া গহনা— দুই সেট তোলা,— একসেট গায়ে। দামী বেনারসী সাড়ী ও ব্লাউজ তাহার বেড়াইবার পোষাক; শান্তিপুর ফরাসডাঙ্গার দেশী সাড়ী তাহার আটপৌরে কাপড়। তাহার ভাটিয়া বাবু তাহাকে মাসিক ৩০০ টাকা নগদ দিত। এতদ্ব্যতীত ঘর ভাড়া ও খাওয়াপরার খরচ চালাইত।

 কালীদাসীর এই সৌভাগ্য আলাদিনের প্রদীপের মত দুই তিন মাসের মধ্যে হইয়াছে। আমি দেখিয়া একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। কি উজ্জ্বল আশার আলোক আমি সম্মুখে দেখিতে পাইলাম! কোন সয়তান আমার অন্তরের মধ্যে বার বার জাগিয়া বলিতে লাগিল, এমন সৌভাগ্য তোমারও হ’তে পারে। আমি সেই আলেয়ার পশ্চাতে ছুটিলাম।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি কালাদাসা রূপসী ছিল। এখন ভালভাবে থাকিবার ফলে তাহার সৌন্দর্য্য আরও ফুটিয়া বাহির হইল। পাড়াগাঁয়ের মেয়ে হলেও কালীদাসী গান জানিত। আমিও তাকে কিছু শিখাইয়াছিলাম। এ বাড়ীতে তাহার এক মা জুটিয়াছে। কালীদাস। বলিল এই স্ত্রীলোকটিই তাহাকে এ ভাটিয়া বাবু যোগাড় করিয়া দিয়া হাড়কাটা গলি হইতে রামবাগানে আনিয়াছে। কালীদাসী আমাকেও ঐ পাড়াতে যাইতে পরামর্শ দিল। আমি সুযোগ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম।

 রাণী-মাসীর পাওনা আমি প্রায় শোধ করিয়াছিলাম, আমার আর কোন ঋণ ছিলনা। ঘরের জিনিষপত্র চলনসই রকম হইয়াছে। এই সময়ে আমার সঙ্গে একজন ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। তিনি ব্রাহ্মণ যুবক, কোন ব্যাঙ্কের বিশিষ্ট কর্ম্মচারী ছিলেন। তাঁহার নাম শ্রী......পাধ্যায়। দুই তিন দিন আমার ঘরে আসিয়া তিনি আমার প্রতি আকৃষ্ট হইলেন। আমার গানেই তাঁহাকে বিশেষ রূপে মুগ্ধ করিল।

 তিনি আমাকে স্থানান্তরে লইয়া যাইবার প্রস্তাব করিলেন। তিনি বলিলেন “আমি তোমাকে একটু উঁচু ষ্টাইলে রাখতে চাই। হাড়কাটা গলিটা অতি অভদ্রের যায়গা— এখানে যত ছোট লোকের আমদানী।” আমি মনে মনে কহিলাম “হায়রে বেশ্যার আবার ভদ্রাভদ্র বিচার— পতিতার উচ্চ নীচ স্তর বিভাগ— এদেরও জাতিভেদ! এখনই অন্য স্থানে উঠিয়া গেলে আমার চিকিৎসক বাবুটিকে হারাইব এই ভাবিয়া আমি সন্মত হইলাম না। প্রকৃত কথা গোপন করিয়া বলিলাম, “আমার দেনাপত্র আছে— বাড়ীওয়ালীও কিছু টাকা পাবে, উঠতে হলে দু’চার মাস পরে উঠা যাবে।”

 এই ব্যাঙ্কের কর্মচারী মাঝে মাঝে আমার গৃহে রাত্রি যাপন করিতেন। তাঁহার সঙ্গে দুই একজন বন্ধুবান্ধাবও আসিত। সমান্য পরিমাণে মদ খাইতেন। তবে নিত্যান্ত মাতাল কেহ ছিলেন না। আমি কখনও কখনও লুচি, পরোটা, মাছ, মাংস প্রভৃতি সুখাদ্য প্রস্তুত করিয়া তাহাদিগকে খাওয়াইতাম। এইরূপে ক্রমে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাইল। আমার এই বাবুটীর খুব পান খাওয়া অভ্যাস ছিল। সোনালী রূপালী তবক দেওয়া দামী পান সর্ব্বদা তিনি খাইতেন। তিনি বড় সৌখীন পুরুষ ছিলেন। ব্যাঙ্কের বিশিষ্ঠ কর্ম্মচারী বলিয়া তিনি একখানি সুন্দর বৃহৎ মোটর গাড়ী পাইয়াছিলেন। তাহাতে চড়িয়া তিনি আমার গৃহে আসিতেন। আমরা তাঁহার মোটরে অনেকবার বেড়াইয়াছি।

 আমি কিছুদিন দুই দিক রক্ষা করিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তাহা হইয়া উঠিল না। আমার চিকিৎসক বাবু বুঝিতে পারিলেন যে, আমি অন্য প্রণয়ীর হাতে পরিয়াছি। তিনি ক্রমশঃ কম আসিতে লাগিলেন। শেষে আসা একদম বন্ধ করিলেন। আমার পাধ্যায় বাবু সর্ব্বদাই আমাকে এ পাড়া ছাড়িয়া যাইতে বলিতেন। আমার দেনাপত্র শোধ করিবার নাম করিয়া তাঁহার নিকট হইতে পাঁচশত টাকা নগদ আদায় করিলাম। আর নূতন বাড়ীতে যাইয়া বসিতে আরও অতিরিক্ত দুইশত টাকা লাগিবে, বলিলাম। তিনি সেই টাকাও দিলেন। আমি রামবাগানে কালীদাসীর বাড়ীর নিকটেই একটী বাড়ীতে দু’খানি ভাল ঘর ভাড়া লইলাম।

 আমার সেই চিকিৎসক বাবুটি এক্ষণে একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। পূর্ব্বেই বলিয়াছি তিনি তখন পর্য্যন্ত বিবাহ করেন নাই। পতিতার ব্যাবসায় প্রথম আরাম্ভ করিয়া আমি অবিবাহিত যুবকদিগকেই একটু বেশী পছন্দ করিতাম। আমার বিশ্বাস ছিল গৃহে তাহাদের পত্নীর আকর্ষণ না থাকাতে তাহারা পতিতার প্রতি বেশী আসক্ত হইবে। কিন্তু এই দীর্ঘ কালের অভিজ্ঞতায় আমার সেই ভ্রান্তি দূর হইয়াছে। আমি দেখিয়াছি, যাহারা নিজের স্ত্রীকে ভালবাসে তাহারা নিজের রক্ষিতা নারীকেও ভালবাসে। অবিবাহিত যুবকেরা প্রায়ই চঞ্চল চিত্ত এবং তাহারা কাহারও উপর নিজের মনকে স্থিরভাবে বসাইতে পারে না।

 আমার চিকিৎসক বাবুটী আমাকে ছাড়িয়া অনেক নারীর প্রতি আসক্ত হইয়াছেন— সে সংবাদও আমি শুনিয়াছি। এমন কি গৃহস্থের ঘরেও তিনি নাকি কেলেঙ্কারী ঘটাইয়াছেন। খবরের কাগজে সেই ইঙ্গিত দিয়াছে। সত্য মিথ্যা ভগবান জানেন।

 রামবাগানে আসিয়া আমার সুখে স্বচ্ছন্দে কাল কাটিতে লাগিল। কিন্তু আমার একটা দুঃখ মাঝে মাঝে প্রাণে জাগিয়া উঠিত। মুকুলদা অথবা কমলার কোন সংবাদ পাইতাম না। পিতা, মাতুল বা নন্দদাদা ইহাদের দেখা পাইতে আমার ভয় হইত; দেখা না হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু কমলা মুকুল-দা এই দুই জন ত আমার পাপ জীবনের গতির সূচনা জানে। সুতরাং তাহাদের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হইত। পতিতার জীবন কিরূপ বিপদগ্রস্ত তাহা এই অল্প সময়েই আমি বুঝিয়াছি। আর সকলে আমায় ঘৃণা করে করুক— পায়ে ঠেলিয়া ফেলে ফেলুক— মুকুল-দা ও কমলা কখনও আমায় পরিত্যাগ করিতে পারিবে না, এ বিশ্বাস আমার দৃঢ় ছিল।

 রামবাগানে আসিয়া আমি পড়াশুনায় মন দিলাম, বাবুকে বলিয়া পুস্তক রাখিবার জন্য একটী আলমারী কিনিলাম। বাংলা ইংরাজী সাহিত্য গ্রন্থাদি তাহাতে সাজাইলাম। বাবু আমার জ্ঞানপিপাসা দেখিয়া সন্তুষ্ট হইলেন। মাসিক সংবাদপত্র প্রবাসী ও ভারতবর্ষ তিনি আমায় কিনিয়া দিতেন। দৈনিক খবরের কাগজ তিনি আফিস হইতেই লইয়া আসিতেন। আমি তাহা পড়িতাম। গানে, পড়াশুনায়, বাবুর ভালবাসায় আমার মন একপ্রকার সাময়িক স্থিরতা লাভ করিল।

 এই সময়ে সাহিত্য ক্ষেত্রে একটা যুগান্তর আসিয়াছে— তাহার সহিত আমাদের পতিতা জীবনের নিকট সম্বন্ধ আছে বলিয়া এস্থলে তাহার কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব। কুলটার চরিত্র লইয়া বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় ও তাঁহার সমসাময়িক সাহিত্যিকগণ যে চিত্র আঁকিয়া গিয়াছেন, তাহাতে কুলটার প্রতি ঘৃণার ভাবই বদ্ধমূল হয়। কৃষ্ণকান্তের উইল, চন্দ্রশেখর প্রভৃতি উপন্যাসে কুলটার পরিণাম, ভীষণ শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্তই দেখিতে পাই। এতাবৎকাল পতিতা নারীর জীবনের এমন দিক দেখান হইয়াছিল, যাহা দেখিয়া লোক পতিতার নারীর সংস্পর্শে যাইতে ঘৃণা বোধ করে— লজ্জিত হয় ও ভয় পায়। অমৃতলাল বসুর তরুবালা নাটকেও তাহাই দেখান হইয়াছে। তারপর রবীন্দ্রনাথ তাঁহার কয়েকখানি উপন্যাসে কুলটার চরিত্রের অপর এক দিক দেখাইয়াছেন, যাহাতে তাহার প্রতি লোকের সহানুভূতি জন্মে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যাহা অস্পষ্ট রাখিয়াছেন, শরৎ চট্টোপাধ্যায় ও নরেশ সেনগুপ্ত এবং বহু তরুণ সাহিত্যিক তাহা খুলিয়া দিয়াছেন। তাঁহারা কুলটা ও পতিতা নারীর কোন কোন চরিত্র এমনভাবে দেখাইয়াছেন, যাহাতে লোক তাহাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাঁহারা বলেন “বেশ্যারা অসতী হইতে পারে— কিন্তু তাহারা মনুষ্যত্বের আদর্শে হীন নহে। পতিতা নারীও যখন সরল চিত্ত, ধর্ম্মপ্রাণ, ঈশ্বরভক্ত, দয়ার্দ্র হৃদয়, দানশীল হইয়া থাকে, তখন তাহারা ঘৃণার পাত্র হইবে কেন? দোষ সমাজের,— পতিতার নহে।”

 এই সকল উপন্যাস ও কথা-সাহিত্য তরুণ যুবক যুবতীদের প্রাণে এক অপূর্ব্ব চঞ্চলতা জাগাইয়া তুলিল। তাহারা ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’ পড়িয়া রাজলক্ষ্মীর মত পতিতা নারীর খোঁজ করিতে লাগিল,— শুভা পড়িয়া ‘শুভ সঙ্গিনীর’ মত অভিনেত্রীর সন্ধানে বাহির হইল। ‘পরপারে’ নাটকের সরযুকে পাইতে তাহারা পাগল হইল। আমার এই দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় বুঝিতে পারিয়াছি, বাঙ্গালার তরুণ যুবকের দল ক্রমশঃ অধিক সংখ্যায় কলুষ সংস্পর্শে আসিতেছে।

 পতিতা নারীর জীবনের এই চিত্রকে নব্য সাহিত্যিকের দল রিয়্যালিষ্টিক আর্টের অন্তর্গত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এই আর্টের দোহাই দিয়া আজকাল সমাজের মধ্যে এক সর্ব্বনাশী বিষ ছড়ান হইতেছে। কলেজের উচ্চশিক্ষিত যুবকগণ নটের ব্যবসায় অবলম্বন করিতেছেন— সম্ভ্রান্ত বংশীয় জমিদার পুত্র আপন স্ত্রী কন্যা লইয়া প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে সহস্র সহস্র দর্শকমণ্ডলীর সম্মুখে অভিনয় দেখাইতেছেন— পিতামাতা কন্যাদিগকে থিয়েটারের স্টেজে নাচিতে পাঠাইতেছেন। স্বামী স্বকর্ণে শুনিতেছেন, তাঁহার স্ত্রী অভিনয়চ্ছলে অপরের সহিত প্রেম সম্ভাষণ করিতেছেন— পিতা দেখিতেছেন, কুমারী কন্যা রঙ্গমঞ্চে প্রেমের ছল কলা শিখিতেছে। যিনি বিশ্বকবির উচ্চ আসন পাইয়াছেন, যাঁহার কাছে জগৎ মহৎ আদর্শের প্রত্যাশা করে, তিনি থিয়েটারে যাইয়া নটীদের গানের মহলা দেওয়াইতেছেন। যে ব্রাহ্ম সমাজের কাছে দেশ উচ্চ সুনীতির আদর্শ পাইতে চায়, তাহারাও আর্টের নেশায় মজিয়াছে। রবীন্দ্র ঠাকুর, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, লেডী অবলা বসু, শ্রীযুক্তা কামিনী রায়, মিসেস্ বি, এল, চৌধুরী, সরলা দেবী ইঁহাদের মত লোকও ভদ্র ঘরের যুবতীদের নৃত্যের সমর্থন করেন। ইহা লইয়া সাময়িক সংবাদ পত্রাদিতে বহু বাদ প্রতিবাদ হইয়া গিয়াছে, আমি তাহা পাঠ করিয়াছি, আর জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিয়াছি।

 আমার আত্মচরিত লিখিতে যাইয়া এত কথা বলিবার প্রয়োজন এই যে, আমাদের মত পতিতা নারীর জীবন যে অসংযম ও অসাবধানতার ফল, তাহা সমাজের প্রায় সকল স্তরে প্রবেশ করিতেছে। যাঁহারা সমাজের মঙ্গল চিন্তা করেন, তাঁহাদের দৃষ্টি এইদিকে আকৃষ্ট হউক, ইহা আমার অভিপ্রায় ও নিবেদন। যে অপরিনামদর্শী যুবকের কুহকে পড়িয়া আজ আমি পতিতা— এই প্রকার রাণী চুনীর প্রেমিক ও এই সকল নাচগানের কর্ণধার রূপে আছেন, তাহা কি অভিভাবকগণ খবর রাখেন? নিজে মজিয়াছে বটে কিন্তু সমাজকে মজিতে দেখিলে দুঃখ হয়। আমাদের চুনীর বাবু-শিল্পটি......‘সম্মিলনীর’ একজন বিশেষ পৃষ্ঠপোষক। চুনীর নিকট এই সম্মিলনার দুই একটা অপবাদ শুনিয়াছি। সত্য মিথ্যা ঠিক না জানায় উল্লেখ করিলাম না।

 নব্য সাহিত্যের এই রিয়্যালিস্টিক আর্টের ফল আরও একদিকে দেখা দিল। পূর্ব্বে পতিতা নারী সৎকার্য্যে অর্থদান করিতে চাহিলে অনেকস্থলে তাহা গৃহীত হইত না। এমন কি মফঃস্বলের ভূমাধিকারী পতিতার নিকট হইতে ভূমির করও নাকি গ্রহণ করিতেন না। ক্রমশঃ এই ভাব দূর হইতে লাগিল। এ বিষয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন অতি উদার হৃদয় ছিলেন। জন সাধারণের হিতকর কার্য্যে তিনি শুধু পতিতার দান গ্রহণ করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন না— পতিতাদিগকে তিনি দেশ-হিতকর কার্য্যে আহ্বান করিয়াছিলেন। তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ, কিন্তু আমাদের মত নীচ দ্বারা তাঁহার উদ্দেশ্য সাধিত হইল না। ১১৯৮ সালের পর হইতে তাঁহার হস্তে ক্রমশঃ দেশের নেতৃত্ব ভার আসিতে থাকে। এ দিকে নব্য সাহিত্যও পতিতাদিগের প্রতি সহানুভূতি-সম্পন্ন ছিল। সুতরাং আমরা প্রকাশ্যে ভদ্র সমাজে মিশিবার একটা সুযোগ পাইলাম। ইহার ফল কি হইল, তাহা যথাস্থানে বিবৃত করিব।

 জন সাধারণের হিতসাধন সম্বন্ধীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে প্রকাশ্যভাবে যোগদান করিবার বিষয় বলিবার পূর্ব্বে আমার জীবনের আর দুই একটী ঘটনা উল্লেখ করিয়া এই অধ্যায় শেষ করিতেছি।

 আমাদের বাড়ীতে একজন স্ত্রীলোক একখানি ঘর ভাড়া লইল। সে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। কিছুদিনের মধ্যে আমি তাহার অন্তরের সমস্ত কথা অবগত হইলাম। এই স্ত্রীলোকটী দরিদ্র কায়স্থ ঘরের বিধবা। তাহার গুরু শ্রী...... বিদ্যাভূষণ মহাশয় তাহার সর্ব্বনাশ করিয়াছেন। তিনি এখন আর কাছে ঘেঁসেন না। স্ত্রীলোকটী কলঙ্কের ভয়ে কোথাও আশ্রয় না পাইয়া বেশ্যা পল্লীতে আসিতে বাধ্য হইয়াছে। কারণ এই স্থান সকল কলঙ্ক ও পাপের ভাণ্ডার। আমি এই হতভাগিনীকে সাহায্য করিতে অগ্রসর হইলাম।

 আমার পরামর্শে স্ত্রীলোকটী বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের নিকট চিঠি লিখিল। সৌভাগ্যক্রমে কিছুদিন পরে বিদ্যাভূষণ মহাশয় আসিলেন। আমি নানা ছলে তাঁহার সহিত পরিচয় করিলাম। এ বিষয়ে আমার ব্যাঙ্কের বাবুটীর নিকট প্রয়োজন মত উপদেশ লইয়াছি। একদিন আমি বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের নিকট বিনয়ের সহিত অনুরোধ করিয়া বলিলাম, “দেখুন, এ বেচারী এখন দুঃসময়ে পড়েছে— আপনি যদি পরিত্যাগ করেন, এর উপায় কি হবে? কিন্তু তিনি আমার কথা উপেক্ষা করিলেন। তখন আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলিলাম “মহাশয়, আমরা পতিতা নারী— আপনাদের ঘৃণিতা, আর আপনি সমাজের কর্ত্তা, আজ আমার কাছ থেকে আপনি তিরস্কার শুনে যেতে চান কি? ছিঃ, ছিঃ, আপনার লজ্জা হয় না? গুরুগিরি করতে গিয়ে সরল হৃদয় বিধবা শিষ্যানীর সতীত্ব নষ্ট করেছেন, দরিদ্রকে কলঙ্কে ডুবিয়েছেন। আপনি না স্মৃতি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, আপনি না অধ্যাপনা করে থাকেন? আপনার পাণ্ডিত্যে ধিক্— আপনার শাস্ত্র জ্ঞানে শত ধিক। আমরা মহাপাপী বারবণিতা, আমবা নরকে যাব, ইহা সত্য— আপনারা নরকে যাবেন না কেন জানেন?— আপনাদের জন্য এত বড় নরক কুণ্ড এখনও তৈরী হয়নি।” আমার কথা শুনিয়া বিদ্যাভূষণ মহাশয় চুপ করিয়া রহিলেন। আমি না থামিয়া,— তাঁর মুখের কাছে তর্জ্জনি হেলাইয়া ক্রুদ্ধস্বরে বলিলাম, “আপনি যেতে চান চলে যান। কিন্তু জানবেন আমি একে দিয়ে আদালতে নালিশ করে আপনার কাছ থেকে খোরপোয আদায় করে ছাড়ব। জানি, আপনি অস্বীকার করতে পারেন! কিন্তু আমরা এ বাড়ীর সকলে সাক্ষ্য দিব যে আপনি এর ঘরে আসতেন, এবং আপনার দ্বারা এর গর্ভসঞ্চার হয়েছে। আমরাতো কতই মিথ্যা বলি— যাতে একজন নির্দেষ নারীর উপকার হয়—যাতে এক শঠ লম্পটের শাস্তি হয়, সেইরূপ মিথ্যা বলতে আমাদের জিহ্বায় আটকাবেন।

 বিদ্যাভূষণ মহাশয় বিশেষ কিছু না বলিয়া চলিয়া গেলেন, বুঝিলাম— তিনি ভয় পাইয়াছেন। কয়েক দিন পরে তিনি আসিয়া আমার হাতে একশত টাকা দিয়া বলিলেন “এর জন্য যা কিছু খরচ প্রয়োজন হয়, এই টাকা থেকে কর’বে”। আমি তাহা গ্রহণ করিলাম এবং স্ত্রীলোকটীর প্রয়োজনীয় জিনিষ-পত্র যোগাড় করিয়া দিলাম। যথাসময়ে ইহার প্রসব হইল। বিদ্যাভূষণ মহাশয় প্রসূতি ও সন্তানকে আমাদের বাড়ী হইতে সরাইয়া নিলেন। তারপর খবর লইয়া জানিয়াছিলাম, তিনি বিধবাটীকে বিশেষ অর্থ সাহায্য করেন নাই। এই লোকটার দুশ্চরিত্রের কথা অনেকেই জানিত। আরও কয়েকটী শিষ্যানীর সর্বনাশ তিনি করিয়াছিলেন। তামি তাঁহার চাকুরীস্থলে বেনামী চিঠিতে সমস্ত রহস্য প্রকাশ করিয়া দিয়াছিলাম। এমন সর্ব্বনেশে লোকের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। পরে শুনিয়াছিলাম, তাহার ভাল ভাল চাকুরী সব গিয়েছে। সংবাদ পাইলাম, তিনি নাকি বৃদ্ধ বয়সে এক ষোড়শী বালার পানি গ্রহণ করিয়া তাহার অন্তরের যৌবন ক্ষুধা মিটাইতেছেন। সমাজের যে অংশ ছাড়িয়া আসিয়াছি, তাহার এমন গলিত ক্ষত দেখিয়া, পতিতাদেরও ঘৃণায় নাক সিটকাইতে হয়।

 আমারদের বাড়ীর নিকটে সুশীলা নাম্নী এক বারবনিতা বাস করিত। সে এক নবাবের রক্ষিতা। তার বিপুল সম্পত্তি, অতুল ঐশ্যর্য্য। উহা আর বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই। নবাব বহু লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া তাঁহার রাজধানীতে বিরাট প্রাসাদ নির্ম্মাণ করিয়াছেন, কিন্তু তাহাতে তিনি থাকেন না। রাজধানী ছাড়িয়া কলিকাতায় এই রক্ষিতা বারনারীর নিকটেই অবস্থান করেন। এদিকে তাঁর সোনার পুরী শিয়াল কুকুরের আবাস স্থল হইতেছে, প্রজাগণের দুর্দ্দশার একশেষ— সুব্যবস্থা ও শাসনের অভাবে ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়িতেছে। গরীব প্রজার রক্ত শোষণ করিয়া তাহ। নটীর পূজায় ব্যয় করিতেছেন। নবাব বাদসার মত লোক পতিতার প্রেমে মজিবে, ইহাতে নূতনত্ব নাই। তবে এ কথা এখানে উল্লেখ করিলাম কেন! তাহার কারণ আছে; সুশীলার ঘরে যাইয়া প্রায়ই দেখিতাম নগবের রাজধানী হইতে বহুমূল্য আসবাব পত্র, ছবি, পর্দা, হীরা, জহরৎ, আয়না, গজদন্তের কারুকার্য খচিত দ্রব্য— এ সমস্ত আসিতেছে। ইহার কোন কোনটি বিক্রয় করা হইত— কোনটি বা সুশীলার ঘরেই শোভা পাইত। এই সকল দ্রব্য নবাবের পূর্ব্ব-পুরুষগণের কীর্ত্তি চিহ্ন স্বরূপ রাজধানীর পুরাতন প্রাসাদে সজ্জিত ছিল। ঐতিহাসিক কীর্ত্তিদর্শনার্থীরা তাহা দেখিয়া অতীত গৌরবের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিত। একটা তুচ্ছ বেশ্যার মনস্তুষ্টির জন্য এই কীর্ত্তিচিহ্নসমূহ কি মুর্খের মত ধ্বংস করা হইতেছে, তাহা ভাবিয়া আমি দুঃখ করিতাম। যাহারা পূর্ব্বপুরুষের প্রতি এমনি শ্রদ্ধাহীন, তাহারা পরাধীন হইবেনা ত হইবে কে?

 সুশীলার বেড়াইবার জন্য মোটর গাড়ী ক্রয় করা হইয়াছে। সুশীলা নবাবের প্রধানা বেগমের চেয়ে অধিক ঐশ্বর্য্য— অধিক আদর যত্নে আছে। নবাব ঋণ করিয়া, মনি-মুক্তাদি বন্ধক রাখিয়া সুশীলার একহাজার টাকা মাসোহারা জোগাইতেছেন। ঋণের দায়ে নবাব বাহাদুর মামলাতে জড়িত হইয়া কাঠগড়ায়ও দাঁড়াইতে বাধ্য হইয়াছিলেন; শৈলশৃঙ্গে বজ্রাঘাত পড়িল।

 আমি পতিতা নারী হইলেও রাজনৈতিক সংবাদ লইয়া থাকি। আজকাল যাঁহারা স্বাধীনতার কথা তুলিয়াছেন, তাঁহারা ভাবিয়া দেখুন, এদেশের নবাব বাদসার বংশধরেরা যদি স্বাধীনতার প্রিয়স্মৃতিচিহ্ন সমূহ এমনি নির্ম্মম হৃদয়ে পতিতার কলুষিত প্রেমানল শিখায় আহুতি দেয়; যদি পূর্ব্বপুরুষের হাতের জিনিসের চেয়ে, বেশ্যার বিলোল কটাক্ষের মূল্য বেশী হয়, তবে স্বাধীনতার আশা কোথায়? অপবিত্র আবর্জনার স্তুপে স্বাধীনতার বিশাল বেধিক্রমের জন্ম হয়না।