শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত

শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত

শিক্ষিতা

পতিতার আত্ম-চরিত

কুমারী―শ্রীমতী মানদা দেবী প্রণীত

চতুর্থ সংস্করণ


দেড় টাকা।

Publisher

R. CHAKRAVARTTY
Kumaruli.

Mymensingh.

প্রথম সংস্করণ—আশ্বিন—১৩৩৬
দ্বিতীয় সংস্করণ—কার্ত্তিক—১৩৩৬
তৃতীয় সংস্করণ–অগ্রহায়ণ—১৩৩৬
চতুর্থ সংস্করণ—পৌষ—১৩৩৬

হিন্দি সংস্করণ—১॥০
ইংরেজী সংস্করণ—২৲

PRINTER—
S. DAS
SINGHA PRINTING WORKS.

34-1B. Badur Bagan Street, Calcutta.

আমার কৈফিয়ৎ

 পুস্তকের নাম দেখিয়া অনেকেই হয়ত মনে করিবেন যে এই প্রকার জীবনী লিখিবার উদ্দেশ্য কি! মহৎ জীবনীর উদ্দেশ্য মহৎ হইলেও তাহা সমাজের পূর্ণ চিত্র নহে। আমার জীবন মোটেই মহৎ নহে, অধিকন্তু ঠিক তাহার বিপরীত; কিন্তু পুস্তকের উদ্দেশ্য মহৎ। আমি পাপী, কলঙ্কিনী, যশের প্রার্থী নহি―সুতরাং আমার জীবনের খাঁটি কথাগুলি আমি যেমন অকপটে বলিতে পারিব, কোন মহৎই তাঁহার জীবনের ঘটনা তেমন অকপটে বলেন নাই। বলিতে পারেন না। পাপের স্বরূপ চিনিয়া রাখা প্রয়োজন। পাপ জিনিষটা যে কি কৈশোরে তাহা বুঝিতে পারি নাই বলিয়াই আজ আমি―আমি কেন―আমার মত সহস্র সহস্র নারী পতিতা।

 বারবনিতা-জীবনে যে দুঃখ কষ্ট এবং অনুতাপ ভোগ করিয়াছি তাহারই স্মৃতি লইয়া এই পুস্তক রচিত হইয়াছে। যাঁহারা আমাদের জীবনকে সুখময় মনে করেন―আমাদের সংস্পর্শে আসিতে আগ্রহান্বিত তাঁহারা বুঝবেন এ পৃথিবীতে যদি নরক থাকে তবে তাহা আমাদের জীবন।

 আমি সমাজের ঘৃণীতা, অস্পৃশ্যা―সমাজে আমার স্থান নাই, স্থান থাকাও উচিত নহে, কিন্তু যে সকল সাধু-বেশী লম্পট আমাদের সংস্পর্শে থাকিয়াও সমাজের উচ্চস্থান অধিকার করিয়া আছেন, আমার জীবনীতে তাহাদেরও কতিপয় চিত্র দেখিয়া সমাজটাকে চিনিয়া রাখিতে পারিবেন। এই ভণ্ডের দল কি প্রকারে অবোধ বালিকার সর্বনাশ করে, তাহার চিত্র দেখিয়া স্তম্ভিত হইবেন।

 আমার এই আত্ম জীবনীতে ৺শিবনাথ শাস্ত্রী, ৺স্যার সুরেন্দ্র নাথ, ৺দেশবন্ধু দাশ, ৺ব্যোমকেশ চক্রবর্ত্তী, ৺অশ্বিনীকুমার দত্ত, পূজনীয়া শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী, সন্তোষ কুমারী গুপ্তা, উর্ম্মিলা দেবী, সুনিতী দেবী, মোহিনী দেবী, সরলা দেবী, হেমপ্রভা মজুমদার, বগলা সোম, লেডী অবলা বসু, কামিনী রায়, জ্যোতির্ম্ময়ী গাঙ্গুলী, মিসেস্ বি, এল, চৌধুরী, রমলা গুপ্তা, লীলাবতী দাশ,

 শ্রীযুক্ত হেরম্ব চন্দ্র মৈত্র, কৃষ্ণকুমার মিত্র, মহেশচন্দ্র আতর্থী; কাজি নজরুল ইছলাম ও তৎপত্নী, মতিলাল নেহরু ও তৎকন্যা এবং সৈয়দ হুসেন, কুমার গোপীকারমণ রায়, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, আক্রাম খাঁ, আবদুল রহিম, ডাঃ বিমলচন্দ্র ঘোষ, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বীরেন শাসমল, জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত সরকার, প্রতাপ গুহরায়,

 ৺বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়, ৺অমৃতলাল বসু, দীনবন্ধু মিত্র, দ্বিজেন্দ্র লাল, শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ডাঃ নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত,

 স্বামী সত্যানন্দ, স্বামী বিশ্বানন্দ, স্বামী সচ্চিদানন্দ, তারকেশ্বরের মোহান্ত প্রভৃতি মহোদয় ও মহোদয়ার নাম প্রয়োজন বশতঃ উল্লিখিত হইয়াছে। আমার মত নূতন লেখিকার অক্ষমতার দোষে যদি তাঁহাদের সুনামের কোন হানি হইয়া থাকে এজন্য তাঁহাদের প্রত্যেকের নিকট এবং মৃত ব্যক্তিদিগের আত্মার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি।

 এই জীবনীতে আমার ফটো চিত্র দিতে ইচ্ছা করিয়া বিজ্ঞাপন দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু আমার ভূতপূর্ব্ব শিক্ষক মুকুলচন্দ্র বানার্জ্জি, উকিল মহাশয়ের বিশেষ অনুরোধে তাহা দেওয়া হইল না।

বিনিতা
শ্রীমতী মানদা দেবী

দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপন

 বিশ্বনাথের কৃপায় কয়েক দিনের মধ্যে পুস্তকের দ্বিতীয়বার মুদ্রনের প্রয়োজন হইল। এই সংস্করণে সামান্য পরিবর্ত্তন ও পরিবর্দ্ধন হইয়াছে।

 আমার এই জীবনীতে ইঞ্জিনীয়ার কন্যা সুরুচীর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা আছে। সুরুচীর ভ্রাতা এজন্য পুস্তকের প্রকাশক এবং আমার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ আনয়নের উদ্দেশ্যে, উকিল দ্বারা এক নোটীশ দিয়াছেন। নোটীশে বলা হইয়াছে―“সুরুচী পতিতা নহে, সে আমার বাড়ী যাইত না, আমি ভদ্রলোকের কন্যা জানিয়া গৃহস্থ হইয়াও সে আমাকে তাহার বাড়ীতে যাইয়া তাহার সঙ্গে মিশিবার সুযোগ দিয়াছিল। সুরুচী কৃষ্ণকুমার বাবুর জামাতার ঘড়ি চুরি করে নাই ইত্যাদি ইত্যাদি।”

 নোটীশের কোন জবাব আমি দেই নাই এবং দিব না, মোকদ্দমার প্রতীক্ষায় রহিলাম, যদি মোকদ্দমা হয় তবে পতিতা সমাজের এমন ঘটনা বাহির হইবে যাহাতে দেশের মঙ্গল হইতে পারে।

 আমার এই জীবনী আমার নিজের লেখা কি অন্য পুরুষের লেখা, তাহা লইয়া একদল লোক মাথা ঘামাইতেছেন শুনিতেছি। নারী সম্বন্ধে পুরুষের নানা প্রকার হীন ধারণার জন্যই নারী আজ বিশ্বে সমানাধিকার দাবী না করিয়া পারিতেছেন না। যদি তাঁহারা কেবল ইহাই ভাবিয়া থাকেন যে―পতিতার কি বই লিখিবার ক্ষমতা আছে―ইহার উত্তরে বলা যাইতে পারে যে―পতিতগণ যদি বই লিখিতে বা পত্রিকা সম্পাদন করিতে পারেন, তবে পতিতাগণ পারিবে না কেন? বিশেষতঃ পতিতাগণের লিখিত পুস্তকের যথেষ্ট আদর আছে শুনিতে পাওয়া যায়।

 প্রতিভার পরিমাপ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ডিগ্রি দ্বারা হয় না। পূজনীয়া শ্রীযুক্তা অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবীর কোন ডিগ্রি নাই, ইঁহারা হিন্দু ঘরের সেকেলে মেয়ে, রিয়েলিষ্টিক্ আর্টেরও কোন ধার ধারেন না, কিন্তু ইঁহাদের লেখনী হইতে যেমন লেখা বাহির হইয়াছে এ পর্যন্ত কোন উপাধিধারিনী তেমন সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর পুস্তক যে লিখিতে পারেন নাই; তাহা সর্ব্ববাদী সম্মত।

 ‘ভোটে পতিতার স্থান’ নামক একটি অধ্যায় এই পুস্তকের জন্য লিখিত হইয়াছিল কিন্তু তাহা কোন বিশিষ্ট রাজনৈতিকের মতামত গ্রহণ না করিতে পারায় এবারেও মুদ্রিত হইল না। * * *

 আমার জীবনীতে যাঁহাদের প্রতি সামান্য ইঙ্গিত আছে তাঁহাদের নিকট আমি ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। কাহারও প্রাণে ব্যাথা দিবার জন্য এ পুস্তক লিখিত হয় নাই। বর্তমান সমাজের খাঁটি চিত্র দেখাইয়া সমাজপতিগণের মনোযোগ আকর্ষণই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। আমার পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে—সমাজে সাড়া পড়িয়াছে।

 নারী পতিতা হইলে তাহার নাকি কোন মূল্যই থাকে না। তাহাকে অপমান করিলেও আইন অনুসারে ‘মান হানীর’ দাবী চলে না, কিন্তু ‘পতিত’ পুরুষের বেলায় এই আইনই কার্যকারী―কারণ, আইন প্রণেতা পুরুষ। আমার উকিল বলেন―আইনের এই ত্রুটির জন্যই, সুরুচী পতিতা নহে―এই মিথ্যা কথা বলিতে বাধ্য হইয়াছে। কংগ্রেস কাউন্সিলে যাঁহারা নারী পুরুষের সমানাধিকার দাবী করেন তাঁহারা কি আইন সভায় ইহার প্রতিকার প্রার্থী হইতে পারেন না? প্রকাশ্যে পতিতাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাইলে নিন্দার কোন নূতন কারণ উপস্থিত হইবে না। কারণ কংগ্রেস ও কাউন্সিলের এই সকল মার্কামারা সদস্যদিগকে দেশের লোক ভাল করিয়াই জানে। যদি আগামী কংগ্রেস ও কাউন্সিলে আমাদের এই দাবী কেহ উপস্থিত না করেন তবে মনে করিব যাহারা সমানাধিকারের জন্য চিৎকার করেন তাঁহারা নিছক মিথ্যাবাদী। হয় আমাদের দাবী পূরণ কর―না হয় ‘পতিত’ দিগকে ও কংগ্রেস কাউন্সিল অথবা অন্য কোন কার্য্য হইতে বহিষ্কৃত করিবার জন্য আইন কর।


চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা

 অযাচিত অনুকূল ও প্রতিকূল সমালোচনার ফলে একমাস মধ্যে তৃতীয় সংস্করণের চারি হাজার পুস্তক নিঃশেষিত হওয়ায় চতুর্থ সংস্করণ মুদ্রিত হইল। এ সংস্করণেও সামান্য পরিবর্তন হইয়াছে।

 কয়েকটী সুনীতিবাদী কাগজ এই পুস্তকে অশ্লীলতার গন্ধ পাইয়াছেন এবং তদনুরূপ সমালোচনাও করিয়াছেন; পক্ষান্তরে দেশ বরেণ্য ও শ্রদ্ধেয় বহু সমাজনেতা ও সাহিত্য-রথী এই পুস্তক সম্বন্ধে উক্ত সুনীতিবাদিগণের বিরুদ্ধ মত সমালোচনা করিয়াছেন ও আমাদিগকে জানাইয়াছেন। তাহা হইতে কয়েকখানি পুস্তকের সঙ্গে মুদ্রিত হইল।

 প্রভুপাদ অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয় পুস্তক সম্বন্ধে লিখিয়াছেন “জননীর স্তন হইতে শিশু দুগ্ধই গ্রহণ করে কিন্তু জলৌকা বা জোঁক সেই স্তন হইতেই রুধির ভিন্ন আর কিছুই বাহির করিতে পারে না।”

 উপরোক্ত সুনীতি বাগীশদিগের সম্বন্ধে আমাকে কয়েকটী কথা বলিতে হইতেছে।

 “ছোট বউর বাঁট দুখানির আস্বাদন” যে খবরের কাগজ ভদ্রসমাজে পরিবেশন করিয়াছেন এবং যে শ্রেণীর সাধুবেশী লম্পট এবং ‘ম’ কারের উপাসক নারীকে প্রগতি প্রাপ্তা করাইতে অঙ্গহীন হইয়াছেন তাঁহারাই মাত্র গন্ধ পাইয়াছেন। দুঃখ হয় এই ভাবিয়া যে এঁরা বিশ্ব-সাহিত্য ত দূরের কথা সংস্কৃত কুমারসম্ভব খানিও যেন পড়েন নাই। পড়িলে ‘কুমার সম্ভব’ আজ বি, এ, ক্লাসের পাঠ্যতালিকায় স্থান না পাইয়া ইহাদের মানবহিতকর উপদেশে গবর্ণমেণ্ট কর্ত্তৃ ‘প্রোষ্ক্রাইবড্‌’ পুস্তক শ্রেণীর অঙ্গীভূত হইত।

 ছাগ মনস্তত্ব বিশ্লেষণের অত্যুগ্র পলাণ্ডু গন্ধী গো-শূকর মাংস যে সকল সাহিত্যরথিগণের অনায়াসে হজম হইয়াছে হরিণ মাংসে তাঁহাদের সহসা এবম্প্রকার অরুচি কি করিয়া সম্ভব হইল তৎসম্বন্ধে কোন লব্ধপ্রতিষ্ঠ কাগজ লিখিয়াছেন···পুস্তকে অনেক অপ্রিয় সত্য আলোচিত হইয়াছে।... যাঁহাদের হাঁড়ি আজিও হাটে ফাটে নাই, তাঁহারাও বুঝিবা এই ফাটে ভয়ে চিৎকার করিতেছেন।”

 সুরুচির একনিষ্ঠ উপাসক, লব্ধপ্রতিষ্ঠ কোন এক মাসিকের পৌষ সংখ্যায় শ্লীলতার পরাকাষ্ঠার এক চিত্র বাহির হইয়াছে। উহাতে আছে তিন জোড়া যুবতীর স্তনের ছড়াছড়ি মাত্র। সুরুচি বাগীশ সম্পাদক মহাশয় শ্লীলতার মাপ কাঠি খানি কোথায় লাভ করিয়াছেন জানিতে কৌতুহল হয়। ইতিহাসের দোহাই দিয়া হয়ত সম্পাদক মহাশয় আত্মরক্ষা করিতে চাহিবেন; কিন্তু চিত্রে ইতিহাস টিকিবে কি?

 রাজাও নহেন ঋষিও নহেন এমন কোন ৺সমাজ সংস্কারক (?) যৎকালে যবন উপপত্নীর সঙ্গে উভয়ে উলঙ্গ অবস্থায় মদ্য পানে রত, ইহাদের তৎকালীন চিত্র সম্ভবতঃ উপরি উক্ত সম্পাদক মহাশয়ের চক্ষে অশ্লীল দেখাইবে; কিন্তু কেহ ত আজি পর্যন্ত তৎসম্বন্ধে কোন চিত্র প্রকাশ করিয়া ঐতিহাসিক তত্ত্ব আবিষ্কার অথবা রুচি জ্ঞানের পরিচয় দেন নাই।

 যে সমাজের সিদ্ধ মহাপুরুষকে এরূপ অবমাননাকর চিত্রে অঙ্কিত করা হইয়াছে বাঙ্গালায় তাঁহাদের লোক সংখ্যা অতি নগন্য। নতুবা এই স্পর্দ্ধা সম্ভব হইত কি? পতিতার পক্ষেও কথা বলিবার কেহ নাই বলিয়াই কি সুরুচিবাগীশের দল অমন লম্বা চওড়া স্পীচ্ ঝাড়িতে শুরু করিয়াছেন? এ চাল বাজিতে দেশের লোক আর ভুলিবে বলিয়া মনে হইতেছে না।

 দৈনিক বঙ্গবাণী ইঙ্গিত করিয়াছেন যে পণ্ডিত শ্যাম সুন্দর চক্রবর্ত্তী এই পুস্তকের লেখক এবং মনস্বী জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় পুস্তকের লভ্যাংশ পাইয়া থাকেন। পতিতা সমাজে যদি ইচ্ছাপূর্ব্বক কাহারও উপর মিথ্যা দোষারোপ করে―তাহার বিচার হয় সন্মার্জ্জনী দ্বারা―এই লেখক মহাশয় ‘পতিত’ কিনা না জানায় তাঁহাদের দলপতির উপর এই মিথ্যা উক্তির বিচারের ভার অর্পণ করিলাম।

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

 পুস্তকের শত শত অভিমত মধ্যে কয়েকখানি প্রদত্ত হইল।

 গৌড়িয় বৈষ্ণব সম্মীলনীর সভাপতি হিন্দু সমাজের অন্যতম প্রধান নেতা প্রভুপাদ শ্রীযুক্ত অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয় লিখিয়াছেন—পতিতার আত্মচরিত পাঠ করিলাম।......ঠিক সময় বুঝিয়া গ্রন্থখানি প্রকাশ করা হইয়াচে।......জননীর স্তন হইতে শিশু সন্তান দুগ্ধই গ্রহণ করিয়া থাকে কিন্তু জলৌকা বা জোঁক সেই স্তন হইতেই রুধির ভিন্ন আর কিছুই বাহির করিতে পারে না। এই আত্ম চরিত হইতেও লইতে পারিলে—লইবার মত অনেক জিনিস আছে; কিন্তু তাহা কি সকলে পারিবে?

 বঙ্গের অদ্বিতীয় পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত পার্ব্বতীচরণ তর্কতীর্থ মহাশয় বলেন—পতিতার আত্মচরিত পুস্তকথানা পাঠ করিয়া সন্তুষ্ট হইলাম। আধুনিক ধর্ম্ম বিপ্লব কালে এইরূপ পুস্তক দ্বারা হিন্দু সমাজের পক্ষে বিশেষ উপকার হইবে সন্দেহ নাই। সর্ব্বান্তকরণে উক্ত মানদাকে ধন্যবাদ দিতেছি। * * *

ঢাকার ‘শান্তি’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ও বৈষ্ণব সমাজের অন্যতম নেতা সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক ও সমালোচক শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র দাস অগ্রহায়ণের শান্তি পত্রিকায় লিখিয়াছেন—

 ......বইখানির প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, মাথার উপর অভিভাবক না থাকিলে এবং সুযোগ ও সুবিধা পাইলে অ বিদ্যার মেয়েরা চলচ্চিত্রাদির মত তরল আমোদের দ্বারা এবং তরুণজাতীয় নাটক, নভেলের আলোচনা দ্বারা যে কি শোচনীয় পরিণাম ঘটিতে পারে তাহাই সত্যিকার জীবনের অভিজ্ঞতার দ্বারা আঁকিয়া দেখান।......বইখানার বিশেষত্ব এই যে, ইহাতে পাপকে attractive করিবার artistic প্রয়াস নাই। পতিতার জীবনের অনেক সুশোভন কার্য্যই ইহাতে খোলাখুলি বর্ণনা আছে সত্য, কিন্তু “মোপাশার” মত খামখা অশ্লীল চিত্রকে রঙ্গিন করিয়া তুলিবার প্রয়াস নাই......বিচার করিতে লইলে লেখিকার সংযত ভাষার প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। আলোচিত বইখানির সুর যে বর্ত্তমান তরুণ কথা সাহিত্যের অনেক বই হইতে স্বাস্থ্যকর, তাহা বোধ করি সাহস করিয়া বলা যায়। তাই আমরা সমাজের রুচিবাগীশ দিগকেও বইখানা নিরপেক্ষভাবে পাঠ করিয়া দেখিতে অনুরোধ করি।

 ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’―২৪শে নভেম্বর―It may be anticipated that the reading of the book may have a moral effect on the readers. It contains nothing but some relveations of some evils which is persistent in the modern Hindu society at present―

 কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্ট গ্রাজুয়েট বিভাগের অধ্যাপক মি. সৌগত সুগতকান্তি বলেন―It's each and every chapter contains good lessons for our young generations. I hope to see it translated in to all the Indian Vernacular as soon as possible—

 বঙ্গীয় ব্রাহ্মণ সভার ভূতপূর্ব্ব সম্পাদক, যাদবপুর বেঙ্গল টেকনিকেল ইন্‌স্‌টিটিউটের অধ্যাপক ও Religious Instructor―

শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এম, এ, বি এল মহাশয় বলেন—

 বর্ত্তমানে ছাগ-তান্ত্রিক সাহিত্যের প্রাবল্যের দিনে এ জাতীয় পুস্তকে না জানি কি বিভৎস দৃশ্যই চক্ষুতে পড়িবে, এই ভয় হইতেছিল। কিন্তু আশ্চয্যের বিষয় তাহার স্থলে সর্ব্বত্রই এক একটা করুণ ছবি দেখিতে পাইয়া একটা স্বস্তি অনুভব করিলাম; এবং গ্রন্থকর্ত্রী যে অতি সুকৌশলে এই সকল দৃশ্য সাধারণের সম্মুখে উদ্ঘাটিত করিয়া সাধারণের হৃদয়ে একটা সাবধানতার ভাব জাগরিত করিয়া দিয়াছেন তজ্জন্য তাঁহাকে অশেষ ধন্যবাদ দিতেছি।

 আজ যে আমাদের কি আধ্যাত্মিক কি শিক্ষা-নৈতিক কি রাজনৈতিক সকলদিকে নানারূপ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোন সুফল ফলিতেছে না এই গ্রন্থে তাহার অনেকটা সমাধান করা হইয়াছে।

 সিদ্ধি সত্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। দেশ ভণ্ডামির দ্বারা প্রতারিত হইয়া শ্রান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। খুব আশা করা যায় যে এই গ্রন্থপাঠে অনেক ভণ্ড আপনাদের স্বরূপ দর্শন করিয়া স্বীয় স্বীয় উপযুক্ত স্থান গ্রহণ করিবেন এবং জনসাধারণও নিজেদের ও আপন আপন আত্মীয়গণের পরিচালক নির্ব্বাচন করিবার পূর্ব্বে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করিবেন।

 এই পুস্তক দেশের লোকের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিও করিয়া দিয়া যে সমাজের কতদূর মহোপকার করিয়াছে তাহা বলা যায় না। এই গ্রন্থের বহুল প্রচার একান্ত প্রার্থনীয়।

 কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক মি. বি, এন, চক্রবর্ত্তী ডি, এস, সি; পি, আর, এস্‌ মহাশয় বলেন―

 ‘পতিতার আত্ম-চরিত’ নামক পুস্তুকখানি পড়িলাম। সম্পূর্ণ গ্রন্থখানি পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলাম ইহাতে সাধারণের নৈতিক অবনতিজনক কিছুই নাই। ‘নোবেল’ পুরষ্কার প্রাপ্ত আনাতোল ফ্রান্স, নুটহাম্ সুন্ প্রভৃতি পাশ্চাত্য সাহিত্যরথীগণের শত শত পুস্তকের মত ইহাতে অশ্লীলতা জ্ঞাপক কিছুই নাই। জনরব যে পুস্তকখানির প্রচলন বন্ধ করিবার চেষ্টা হইতেছে, কিন্তু নৈতিক জ্ঞান বলিতে আমরা যাহা বুঝি তাহাতে বলিতে পারি ইহার প্রচলন বন্ধ করিবার কিছুমাত্র হেতু নাই।

 বাংলার অন্যতম জননায়ক, অধ্যাপক মনস্বী শ্রীযুক্ত জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এম, এল, সি মহাশয় বলেন—

 ‘পতিতার আত্ম-চরিত’এর সাহিত্যিক সম্পদ এবং ইহাতে যে সকল গূঢ় রহস্য প্রকাশ করা হইয়াছে তাহার মর্ম্ম না বুঝিয়াই পুস্তক খানিকে বাজেয়াপ্ত করাইবার জন্য কোন এক দল বিশেষ উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন।

 আমি বলিতে পারি বাজেয়াপ্ত করিবার বা সেরূপ কোন প্রকার গুরুতর প্রণালী অবলম্বন করিবার মত কিছুই এই পুস্তকে নাই, পক্ষান্তরে পুস্তকখানি অত্যন্ত সংযত ভাবে লেখা হইয়াছে এবং ইহা সম্পূর্ণরূপে অশ্লীলতা বর্জ্জিত।

 ঘোরতর রুচি বিগর্হিত এবং চিত্ত চাঞ্চল্যকর কত পুস্তক যে প্রতিদিন ভারতবর্ষ এবং ইউরোপ হইতে প্রকাশিত হইতেছে কেহ তাহার খোজও রাখে না, অথচ কেন যে সাহিত্যের আসর হইতে এই বই খানিকেই সরাইয়া দিবার চেষ্টা হইতেছে তাহা বুঝিতে পারিলাম না।

 কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্ট গ্রাজুয়েট বিভাগের তৃতপূর্ব্ব অধ্যাপক, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার ভূতপূর্ব্ব সদস্য শ্রীযুক্ত হেমন্তকুমার সরকার এম, এ, মহাশয় বলেন—

 শ্রীমতী মানদা দেবীর ‘পতিতার আত্ম-চরিত’ নামক গ্রন্থখানি পড়িয়া সুখী হইলাম। বাস্তবিক সত্য ঘটনা যে উপন্যাসের কাহিনী অপেক্ষাও অদ্ভুত তাহা এই গ্রন্থ পাঠে উপলব্ধি হয়। আমাদের সমাজে নারীর অপরাধের ক্ষমা নাই, কিন্তু সমাজের নেতা পুরুষগণ লক্ষ পাপ করিয়াও নিজেরা মান সম্মানের সহিত অবাধে চলা ফেরা করিতেছেন। এই বৈষ্যম্যর প্রতিকার অবিলম্বে হওয়া বাঞ্ছনীয়। অশ্লীলতা বর্জ্জন করিয়া এবং ব্যক্তিগত পরিচয় গোপন রাখিয়া যে সমস্ত বড় বড় লোকের কীর্ত্তি-কাহিনী প্রকাশ করা হইয়াছে, আশা করি তাহাতে সকলের চক্ষু ফুটিবে ও সমাজের মঙ্গল সাধিত হইবে।

 গুরুকুল বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিভিন্ন কলেজের ভুতপূর্ব্ব অধ্যাপক এবং ‘ভারতের সাধনা’ পত্রিকার সম্পাদক, সমাজ হিতৈষী শ্রীযুক্ত বিধুভূষণ দত্ত, এম, এ, মহাশয় বলেন— বাংলা সাহিত্যে ইদানিং অনেক কিছু প্রবেশ কবিয়াছে যাহা ‘আর্ট এর দোহাই দিয়া সাহিতের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছে,— অনেক মহারথী ইহার চালক।......সমাজের বাস্তব চিত্র দর্শনে লোক শিক্ষার নিমিত্তই এই শ্রেণীর সাহিত্যের উপযোগীতা থাকিতে পারে। উপস্থিত পুস্তকে ‘আর্টে’এর সেরূপ দোহাই নাই, সমাজের অতি শোচনীয় কতকগুলি প্রশ্নের সাক্ষাৎ দিগদর্শাইয়া প্রতিবিধানের চেষ্টা রহিয়াছে।...সমাজ শিক্ষার উপযোগীতা আছে।

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কপিরাইট আইন, ২০০০ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ, ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।