শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত/অভিনব পন্থা

দশম

অভিনব পন্থা

সােনাগাছীতে আসিবার পর আমার উপার্জ্জন অনেক কমিয়া যায়। শরীরও নানা রােগাক্রমনের ফলে ক্রমশঃ ক্ষীণ ও দুর্ব্বল হইতে থাকে, ঘরভাড়া, খাওয়া পরা ঠাকুর, চাকর, ঔষধাঙ্গি বাবদে বহু টাকা আমার খরচ হইত। পূজা-পার্ব্বণও কিছু করিতাম, বিশেষতঃ সরস্বতী পূজা আমার কখনও বাদ যাইত না, আমার রােজগারে আর কুলাইয়া উঠিত না।

 একজন উকীল ও একজন ব্যারিষ্টার আমার ঘরে আসিত, ইহারা আইন ব্যবসায়ে যেমন পরস্পর সহযােগী ছিল,—আমার কাছেও সেই ভাবেই, যাওয়া আসা করিত। আমাদের পতিতা-নারী সমাজের একটা রীতি এখানে উল্লেখ করিতেছি। বাবুর বন্ধু বা পরিচিত ব্যক্তির সহিত কুভাবে আসক্ত হওয়া পতিতা-নারীর পক্ষে নিন্দার বিষয়; অবশ্য প্রলোভনের বশীভূত হইয়া অনেক বেশ্যা গােপনে এই নিয়ম পদ দলিত করিয়া থাকে কিন্তু পতিতা সমাজে তাহার দুর্ণাম রটে। ভদ্র সমাজে অনেক সময় যে সকল বন্ধু বিচ্ছেদ দেখা যায় তাহার কতক এই বেশ্যাপল্লীর বাবু ও বন্ধু লইয়া ঘটে, এমন কি ইহার ফলে মারামারি খুনোখুনি পর্য্যন্ত হইয়া যায়।

 আমি অভাবে পড়িয়া অর্থলােভে এই দুই বন্ধুকে প্রণয়ীরূপে গ্রহণ করিয়াছিলাম। তাহাদের মধ্যেও কোন প্রতিদ্বন্দিতার ভাব দেখি নাই।

 আমার এ প্রকার কার্য্যের জন্য পতিতারা অনেকে আমায় নিন্দা করিত, আমি ভাবিতাম সমুদ্রে যার শয়ন, শিশির বিন্দুতে তার কি ভয়?—পতিতাই যখন হইয়াছি তখন কলঙ্কের পসরা ত মাথায় নিয়াছি। 'বলিদান' নাটকের পাগ্‌লীর সেই গানটী মনে পড়ে,

কলঙ্ক যার মাথার মণি,

লুকান প্রেম তারই সাজে,

 নরকে যখন ডুবিয়াছি তখন একেবারে ইহার গভীর তলায় যাইয়া—দেখি পরতে পরতে কত রকমের স্রোত প্রবাহিত হইতেছে।

 ক্রমশঃ দেখিলাম, এই উকীল ব্যারিষ্টার বাবুদের পরিচয়ে দুই একজন উঁচু দরের লােক আমার ঘরে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের নিকট অনেক টাকা পাইলাম। আমার মাথায় এক নূতন ফন্দি আসিল। আমি জানিতাম, কলিকাতায় অনেক বড় বড় লােকের কাছে এই উকীল ব্যারিষ্টারদের যাতায়াত ও আলাপ পরিচয় আছে। সেই সকল বড় লােককে আমার ঘরে আনিবার জন্য আমি ইহাদিগকে নিযুক্ত করিলাম, কথা রহিল, টাকার অর্দ্ধেক তাহারা দুইজনে পাইবে।

 আমি এবারে খাঁটী বেশ্যা হইলাম। রামবাগানে থাকিতে নিম্নশ্রেণীর লােকেরা রাস্তা হইতে দুই একটী বাবুকে ফুসলাইয়া আমার ঘরে আনিত। পুলিশ কমিশনার টেগার্ট সাহেবের শাসনে তাহাও বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। কলিকাতা সহরে ভদ্রলােকও বেশ্যার দালালী করে তাহা জানিতাম। কোন কোন পতিতা নারীর নিকট আমি ভদ্রলোক দালাল রাখিবার পরামর্শ পাইয়াছিলাম, কিন্তু তখনও আমার বিবেক ও নীতিজ্ঞান একটু ছিল বলিয়া তাহা পারি নাই। আজ পাপ পথের শেষ সীমায় আসিয়া হৃদয়ের অবশিষ্ট সদ্ভাবটুকুকে পদদলিত করিতে আমি আর ইতস্ততঃ করিলাম না।

 আমার উকীল ও ব্যারিষ্টার দালাল দুইটা বেশ চতুর ও বুদ্ধিমান দালালী কার্য্যে তাহারা খুব পটু। দিনের পর দিন তাহাৱা আমার ঘরে বড় বড় লােক আনিতে লাগিল। কেহ, উচ্চশিক্ষিত জমিদার-পুত্র, কেহ রাজনীতিক নেতা, কেহ খ্যাতনামা চিকিৎসক, কেহ সমাজ সংস্কারক,—কেহ ধনী-ব্যবসায়ী। ইহাদের মধ্যে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধের সংখ্যাই অধিক। বাংলাদেশের বাহিরের লোকও শাসিতে লাগল।

 চারি পাঁচ মাসের মধ্যে আমার হাতে কিছু টাকা জমল। আমার দালালরাও প্রচুর অর্থ পাইল। আমি আমার মনের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, আমি কতক্ষুদ্র, কত হীন হইয়াছি, নিত্য মিথ্যাচার, প্রতিদিন প্রতারণা—কেবল অর্থগৃরতা— ইহার ফলে আমার হৃদয় যেন স্বাপদ সঙ্কুল অরণ্যের মত হইয়া উঠিল। দর্পণে মুখ দেখিয়া বুঝিলাম আমার সে লাবণ্য নাই—সে কান্তি নাই, নরকের ঘৃণিত ছবি যেন ফুটিয়া বাহির হইয়াছে।