শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত/ভুল ভাঙ্গিল
চতুর্থ
ভুল ভাঙ্গিল
আমি ঘর ছাড়িলাম কেন?―এই প্রশ্নের উত্তর খুব স্পষ্টভাবেই দিব। প্রবৃত্তির উত্তেজনায় মোহাচ্ছন্ন ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া আমি গৃহ পরিত্যাগ করিয়াছি। শরীর-ধর্ম্মের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে যে বয়সে আমাদের যৌবন চাঞ্চল্য দেখা দেয়, তখন বিবাহ সংস্কারের দ্বারা তাহাকে সংযত করিবার ব্যবস্থা সমাজে আছে। বালক বালিকাদিগকে সুশিক্ষায় নিরত এবং সর্ব্বদা সৎসঙ্গে রাখিলে এই যৌবন চাঞ্চল্য অল্প বয়সে আসিতে পারে না। কিন্তু আমাদের সমাজে বর্ত্তমান সময়ে সুশিক্ষা ও সৎসঙ্গরই অভাব। তাহার ফলে তরুণ হৃদয়ে অকালে যৌবন সম্মেলনের উদ্যাম কামনা জাগ্রত হইয়া উঠে।
আমি সুশিক্ষা ও সৎসঙ্গ কিছুই পাই নাই। স্কুলে শিক্ষার ফলে কাব্য কবিতা গল্প উপন্যাস প্রভৃতি তরল সাহিত্যই পড়িতে শিখিয়াছি। তাহাতে আমার হৃদয়ে কল্পনার উত্তেজনায় দুস্প্রবৃত্তিই সকলের আগে মাথা তুলিয়া উঠিয়াছে। সদ্গ্রন্থ কখনও পড়ি নাই―যাহাতে সংযম শিক্ষা হয়, যাহাতে ধর্ম্মভাবের উদয় হয় এমন কোন পুস্তক কেহ আমার হাতে দেয় নাই। আমোদ প্রমোদ যাহা ভোগ করিয়াছি, তাহা সমস্তই অতি নিম্ন স্তরের। থিয়েটারে নাচ গান, সিনেমার চিত্র কখনও হৃদয়ে সদ্ভাব জাগ্রত করে নাই। অল্প বয়স্কদের পক্ষে তাহা হইতে শিক্ষা লাভের চেষ্টা বিপদ্জনক। দুই একটা দাঁত উঠিলেই যদি শিশুকে মাছ খাইতে দেওয়া যায়, তবে সে যেমন গলায় কাঁটা বিঁধিয়া মৃত্যু মুখে পতিত হয়; থিয়েটার দেখায় ও নভেল পাঠেও দেশের তরুণ তরুণীদের সেই মরণদশা ঘটিতেছে। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা হইতে এই কথা বলিতেছি। আমার মত যাহারা আছে তাহারাও ইহার সমর্থনে সাক্ষ্য দিবে।
বেথুন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণী পর্য্যন্ত পড়িয়াই আমার মনে হইয়াছিল আমি খুব জানি। তরুণ সাহিত্যিকদের গল্প উপন্যাস যথেষ্ট পড়িয়াছিলাম; বিশেষতঃ মুকুলদার অনুগ্রহে সেলী, বায়রণ, সেক্সপীয়ার, বিদ্যাপতি, ভারতচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, দীনবন্ধু, গিরিশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির পুস্তক ও কিছু কিছু অধ্যয়ন করিয়াছিলাম। সুতরাং অহঙ্কার যে আমাকে ফুলাইয়া তুলিবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি!
যাহারা কেবল কল্পনাময় রাজ্যে বিচরণ করে, সংসারের কঠোর সত্য সম্বন্ধে তাহাদের কোন জ্ঞান জন্মে না। কবি ও সাহিত্যিকেরা এই রকম ধরণের লোক। তাঁহারা শুধু চিন্তা লইয়া খেলা করেন, কর্ম্মের ধারেও ঘেঁসেন না। মুকুলদার শিক্ষায় আমার এই দশা হইয়াছিল। কাব্য কবিতা ও নাটক নভেলের মধ্য দিয়া সংসারকে কল্পনার চক্ষে যেমন দেখিয়াছি, প্রকৃত কর্ম্মক্ষেত্রে আসিয়া দেখিলাম সে সমস্তই মিথ্যা।
আমি যখন গৃহত্যাগ করি তখন আমার বয়স পনর বৎসর। এই বয়সে যদি আমি আমাকে নিঃসহায় ও বুদ্ধিহীনা মনে করিতাম, যদি ভাবিতাম যে আমি ত সংসারের কিছুই জানিনা—যদি পদে পদে ভয় হইত, তবে আমি কখনই এমনভাবে বাহির হইতাম না। কিন্তু একটা মিথ্যা গর্ব্ব আমাকে দুঃসাহসী ও দূরদৃষ্টিহীন করিয়া তুলিল। আজ মনে হয়, আমি যদি উপযুক্ত অভিভাবকের অধীন থাকিতাম, তবে আমার ভাল হইত। স্বাধীনতার মধ্যেও যে পরাধীনতার প্রয়োজন আছে, তাহা এখন বুঝিয়াছি।
ভাবিয়াছিলাম, ঘরের বাহির হইলেই বুঝি সকল বাধা দূর হইয়া যাইবে— প্রবৃত্তির ভোগ একেবারে পূর্ণমাত্রায় চালাইতে পারিব। কিন্তু দিল্লীতে পেঁৗছিয়া দেখিলাম, ব্যাপার বড় গুরুতর। পুলিশের ভয়— আমাদিগকে লুকাইয়া থাকিতে হইবে। বিদেশে, লোকজন সমস্তই অচেনা। আমরা বাঙ্গালী, কোথায় যাই কোথায় থাকি, কি খাই। রমেশ-দা বাহিরে গেলে আমি একাকী কিরূপে ঘরে থাকিব! নানারকম সমস্যা—বহুপ্রকারের অসুবিধা। বাড়ীতে যে ইহা অপেক্ষা ছিল। ভাল সেখানেত আরও স্বাধীন ছিলাম—এমন কি রমেশ-দার সহিত গুপ্ত প্রণয়ের সুযোগও ছিল বেশী।
অবশ্য টাকার জোরে সকল অসুবিধাই অতিক্রম করা যায়। কিন্তু রমেশদার কি এত টাকা আছে। আমি ত প্রায় এক বস্ত্রে বাহির হইয়া আসিয়াছি। রমেশ-দা আড়াই হাজার টাকা সঙ্গে আনিয়াছেন। বসিয়া বসিয়া খাইলে ইহাতে কতদিন চলিবে? পশ্চিম ভারতের যে কোন সহরেই থাকি, খুব উঁচু ষ্টাইলে ভাল হোটেলে থাকিতে হইবে। আমার কাপড় চোপড় ও কিছু গহনাপত্র চাই। একটা ছোকরা চাকরের দরকার। আমরা শাকভাত, ডালরুটি খাইয়া সন্ন্যাসীর মত গাছ তলায় থাকিতে নিশ্চয়ই আসি নাই। আমাদের জীবন ভোগের পূজা, তাহার প্রধান উপকরণ কাঞ্চন।
দিল্লীতে এক সপ্তাহ কাটিয়া গেল; মুকুলদার পত্রে জানিলাম বাবা আমার জন্য খুব অনুসন্ধান করিতেছেন; কিন্তু পুলিশে এজেহার দেন নাই। রমেশ-দার উপর ঘোরতর সন্দেহ হইয়াছে। তাঁহার আফিসে ও বাড়ীতে খবর লওয়া হইতেছে। কমলা অতিশয় দুঃখিত। দিল্লী হইতে লাহোরে গেলাম।
রমেশ-দা পূরা এক বৎসরও চাকুরী করেন নাই। এরই মধ্যে তিনি কিরূপে চারিমাসের ছুটী পাইলেন, একথা কখনও আমার মনে হয় নাই।
কতদিন কাজ করিলে কতদিন ছুটী মিলে—কোন্ আফিসের কি রকম দস্তুর, ইহার খোঁজ খবর কাব্য উপন্যাসে পাওয়া যায় না। আমি ভাবিয়াছিলাম আফিসের কেরাণীরা চাহিলেই ছুটী পায়।
আমরা রেলপথে সেকেণ্ড ক্লাসে ভ্রমণ করি। বর্দ্ধমানে গাড়ীতে উঠিয়া রমেশ-দা সুটকেস্ খুলিলেন। আমার সম্মুখে পাঁচ তাড়া নোট্ রাখিয়া বলিলেন “মানু, এই আমাদের সম্বল”। আমি গুণিয়া দেখিলাম প্রত্যেক তাড়ায় ১০০ খানি পাঁচ টাকার নোট্। এই আড়াই হাজার টাকা রমেশ-দা কোথায় পাইলেন তখন ভাবি নাই। মাসিক ২০০ টাকা হিসাবে এক বৎসরের বেতনও আড়াই হাজার হয় না। রমেশ-দা বোধ হয় বড়লোকের ছেলে——বাপের টাকা উড়াইতেছেন। তাওত নয়। আমার পিতার কাছে রমেশ দা চাকুরী প্রার্থী হইয়াছিলেন। অর্থাভাবে মাসাবধি তিনি আমাদের গৃহে অন্ন গ্রহণ করিয়াছিলেন।
এত কথা তখন আমার মনে আসে নাই। কারণ ভোগলালসা যা’র সৃষ্টি, সেই সয়তান সমস্ত ভুলাইয়া রাখে। সুখের স্বপ্নে বিভোর গন্ধর্বব দম্পতী অথবা কিন্নর মিথুনের মত আকাশের মধ্য দিয়া চলিয়াছি—মাটীতে আর পা পড়িতেছে না।
লাহোর হইতে আমরা অমৃতসরে যাই। সেখানে তিনদিন থাকিয়া কাশ্মীর যাত্রা করি। শ্রীনগরে আমরা প্রায় একমাস থাকি। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অতিশয় মনোরম তাহা সকলেই জানেন। আমাদের নূতন প্রেমের বন্যা এখানে খুব উছলিয়া উঠিল।
বোম্বাই আসিলাম। আমার ভয় ক্রমশঃ কাটিয়া গেল। প্রথমে যে সকল বিপদের সম্ভাবনা দেখিয়াছিল, এখন তাহ! দূর হইল! পুলিশের ভয় নাই। রমেশ-দা খুব চতুর ও হুসিয়ার লোক। যদিও মুকুলদার চিঠিতে জানিয়াছিলাম, বাবা পুলিশে এজেহার দেন নাই, তথাপি তিনি যেখানেই যাইতেন, সেইখানে প্রথম থানার পুলিশ কর্ম্মচারীদের সহিত আলাপ পরিচয় করিতেন। গ্রেপ্তারী পরওয়ানার কোন গন্ধ পাইলে সময় থাকিতে সরিয়া পড়িবেন, এই তাঁহার মতলব ছিল।
স্কুলে, নীচের ক্লাসে পড়িতেই আমি ইংরাজীতে বেশ কথা কহিতে পারিতাম। মুকুলদার শিক্ষায় ও রমেশ-দার সঙ্গে থাকিয়া এই বিষয়ে আমার আরও উন্নতি হইয়াছিল।
হোটেলে আমরা সাহেবী ষ্টাইলে থাকিতাম। আমি পার্শী মেয়েদের ধরণে কাপড় পড়িতাম। সকলের সঙ্গে মেলামেশা করিতে আমার ইংরাজী কথা বিশেষ সহায় হইয়াছিল। বিদেশের খাওয়া-দাওয়া, চাল-চলন আমি অল্প সময়ের মধ্যেই শিখিয়া লইলাম। প্রথম প্রথম আমি এসব লইয়া অত্যন্ত বিব্রত হইয়া পড়িয়াছিলাম। রমেশ-দা আমাকে বলেন “হাঁরে মানু, তোরা বাংলা দেশের মেয়ে যদি পঞ্জাবে এসে মনে করিস্, ওরে বাবা— এ কোথায় এলাম——বোম্বাইয়ের লোক যদি বাংলায় যেয়ে খাওয়া দাওয়া চলাফেরা নিয়ে মুস্কিলে পরে, মাদ্রাজীরা যদি অযোধ্যাকে ভাবে বিদেশ, তবে বল্ দেখি সমগ্র ভারতে জাতীয়তা গড়ে উঠবে কি করে?”
আমি বলিলাম, “ভারতবর্ষ এক বৃহৎ দেশ, এর মধ্যে ভাষার, ধর্ম্মের, সামাজিক রীতিনীতির এত বৈচিত্র, ও বৈষম্য যে এখানে একজাতি গড়ে উঠা অসম্ভব মনে হয়।” রমেশ-দা জোরের সহিত বলেন “এই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে।” রমেশদার এই একটা গুণ দেখিয়াছি, তিনি যেখানেই গিয়াছেন, তাহাকে নিতান্ত পরিচিত স্বদেশ বলিয়া মনে করিতেন— শুধু চিন্তায় নহে, কার্য্যেও।
দিল্লী, লাহোর, শ্রীনগর, বোম্বাই এই সকল সহরে থাকিবার সময় ইতিহাস প্রসিদ্ধ ও তীর্থস্থান সমুহ দর্শন করিয়াছিলাম। ইহাতে আমার মানসিক বিকৃতি কিয়ৎ পরিমাণে দূর হইল। চঞ্চলতার পরিবর্ত্তে হৃয়য়ে শান্তভাব আসিল। বিমর্ষতার স্থলে আনন্দের ঔজ্জ্বল্য দেখা দিল; রমেশদা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিলেন।
শ্রীনগর হইতে বোম্বাই যাইবার পথে আমরা দ্বারকা ও রাজপুতনা হইয়া গিয়াছিলাম। পুষ্কর, ভরতপুর, জয়পুর, চিতোর প্রভৃতি স্থান দর্শন করিয়া আমার প্রাণে এক অপূর্ব্ব প্রশান্ত ভাবের উদয় হইল। আমি বাড়ীর কথা, বাবার কথা, সমস্ত ভুলিয়া গেলাম। একবার বাবার সঙ্গে এদিকে বেড়াইতে আসিতে চাহিয়াছিলাম। তিনি বিমাতার পক্ষপাতী হইয়া আমাকে লইয়া আসেন নাই। আজ রমেশদার অনুগ্রহে আমার সেই সাধ পূর্ণ হইল। আমি হাঁটিবার সময় রমেশদার হাত ধরিয়া চলিতাম— মোটরে চড়িয়া যাইবার সময় রমেশদার গলা জড়াইয়া বসিতাম। পশ্চিম ভারতের সেই উঁচু নীচু রাস্তায় মোটরে চলিবার সময় স্প্রিংএর মৃদু দোলায় নাচিয়া নাচিয়া আমাদের পরস্পর আনন্দিত বক্ষে কি পুলকের তরঙ্গ উঠিত! রমেশদার প্রতি শুধু প্রেমে নহে— কৃতজ্ঞতায়ও আমার হৃদয় ভরিয়া গেল।
হলদিঘাট দেখাইয়া রমেশ-দা বলিলেন “এই আমাদের ভারতের খার্ম্মোপলি—যেখানে পনর হাজার রাজপুত দেশের জন্য প্রাণ দিয়াছিল। এ বীরত্ব গৌরব আজ আমরা ভুলে গেছি। রমেশদা একটী দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়। চুরুটের ধোঁয়া ছাড়িলেন। আমি ডি, এল, রায়ের রাণা-প্রতাপ নাটকের অভিনয় দেখিয়াছিলাম। আমি বলিলাম “এমন কঠোর ব্রত—এমন তীব্র বৈরাগ্য—স্বদেশের দাসত্ব মোচনের জন্য এমন অপূর্ব্ব স্বার্থত্যাগ আর কে করতে পারে? “এতবড় উচ্চ আদর্শ। দের কল্পনায়ও আসেনা।”
পদ্মিনীর জহর-ব্রতের স্থান দেখিলাম। দর্শনার্থিরা সকলে প্রণাম করিতেছে। তাহাদের দেখাদেখি আমিও মাথা নোয়াইলাম, আমার বুক কাঁপিতেছিল। হাত দুখানি অবশ হইয়া আসিল, আমি পড়িয়া যাইতেছিলাম। পার্শ্বে দণ্ডায়মান রমেশদাকে ধরিয়া বলিলাম, “চল এখান থেকে যাই।”
সেই সতীরাণী স্বর্গ হইতে আমায় কি আশীর্ব্বাদ করিয়াছিলেন জানিনা। আজ মনে হয়, যদি ভারতে পদ্মিনীর মত সতীর আদর্শ না থাকিত, তবে মানব সমাজের পথ প্রদর্শক এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসিয়া পড়িত। পুরাণে শুনিয়াছি, দক্ষযজ্ঞে এক সতীর অনল প্রবেশ— আর এই দেখিলাম বহু সতীর আত্মত্যাগের মহিমাময় তীর্থক্ষেত্র। বুঝিলাম, জহর ব্রতের তিমির গহ্বরের অগ্নিশিখা পদ্মিনীর দেহ দগ্ধ করে নাই, পাপীর ভোগ লালসাকেই পুড়িয়া ছাই করিয়া দিয়াছে।
একদিন সন্ধ্যায় আমরা বোম্বাই নগরীর অন্তর্গত মালবার শৈল পল্লীতে বায়ু সেবনার্থ ভ্রমণ করিতেছিলাম। ট্যাক্সী বিদায় দিয়া আমরা ধীরে ধীরে পদব্রজে চলিতেছিলাম, সেদিন আমার মন বড় খারাপ ছিল। কেন, তাহা পরে বলিতেছি। দুপুরবেলা আমি ঘুমাইয়া কাটাইয়াছি। রমেশ-দা খবরের কাগজ পড়িতেছিলেন। তাঁহার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা হয় নাই। আমার বিমর্ষ ভাব লক্ষ্য করিয়া তিনি আমাকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইলেন। চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখিয়া আমার কিঞ্চিৎ প্রফুল্লতা আসিল। রমেশদা বলিলেন “হারে মানু, তোর এই মলিনমুখ খিবার জন্যই কি ঘর বাড়ী, পরিবার পরিজন ছেড়ে এসেছি? ব্যাপার কি বল্ দেখি?” এই বলিয়া তিনি আমাকে বা ঁহাতে জড়াইয়া ধরিয়া খুব একবার ঝাঁকিয়া দিলেন। আমি তাঁর বুকে মাথা রাখিয়া মুখ নীচু করিয়া রহিলাম। আমার কান্না পাইল। তিনি আমার চিবুক ধরিয়া আমার দিকে চাহিলেন। অস্পষ্ট। আলোকে আমার ছল ছল চক্ষুতে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। তিনি পকেট হহতে রুমাল বাহির করিয়া আমার চক্ষের জলবিন্দু মুছাইয়া দিলেন। এসেন্সের মৃদু সুবাস আমাকে পুলকিত করিয়া চারিধারে ছড়াইল। আমরা নিকটবর্ত্তী একখানা বেঞ্চির উপরে বসিলাম।
তিনি বলিলেন “মানু, তোমার জন্য সমস্ত ছাড়িয়া আসিলাম। নিজের স্ত্রী, বিধবা মা, ছোট ভাইবোন সকলের কথা আজ তোমারই জন্য ভুলেছি। শেষে তুমিও আমায় পরিত্যাগ করবে? তোমায় নিয়ে কি বিপদের সম্মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, তা দেখেই বুঝতে পার তোমায় কত ভালবাসি।” রমেশ-দা আবার আমাকে বুকে চাপিয়া ধরিলেন। আজ আমার এ সকল আদর সোহাগ যেন ভাল লাগিতেছিল না। সম্মুখের অস্পষ্ট অন্ধকারের দিকে আমি স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলাম। আমার হাত দুখানি কোলের উপরে অঞ্জলিবদ্ধ ছিল। রমেশ-দা আমার ডান হাতখানি তুলিয়া তাঁহার নিজের কাঁধের উপর নিয়া রাখিলেন। আমি রমেশ-দাকে অনাদর করিয়াছি ভাবিয়া লজ্জিত হইলাম।
চারিদিক নিস্তব্ধ। পার্শ্ববর্ত্তী প্রশস্ত পথ দিয়া শৈলবিহারী সৌখীন লোকদের দুই একখানি মোটর গাড়ী মাঝে মাঝে মৃদুশব্দে চলিয়া যাইতেছে। রমেশদা বলিলেন ‘চুপ করে আছিস্ কেন—কি হয়েছে?” আমি বলিলাম “না কিছু হয়নি। আজ কমলার চিঠি এসেছে, তুমিত দেখেছ”। আমি ডান হাত দিয়া ভাল করিয়া রমেশদার গলা জড়াইয়া ধরিলাম।
একটা সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে তিনি বলিলেন “ওঃ——বাড়ীর কথা মনে পড়েছে বুঝি— আরে তুই একেবারেই কচি খুকিটি!” একগাল ধোঁয়া ছাড়িয়া তিনি পুনরায় বলিলেন, “আচ্ছা মানু, বাড়ীতে তোমার কি আকর্ষণ আছে বল দেখি।— মনে কিছু ক’রোনা; আমি স্বরূপ কথাই বলছি। তোমার মা নাই—ভাই বোন নাই। পিতা দ্বিতীয় পক্ষের ষোড়শী পত্নীকে নিয়ে আমোদ করে বেড়াচ্ছেন—মেয়ের দিকে ফিরেও চাননা, শোবার ঘর থেকে কৌশল করে তোমায় সরিয়েছেন—তোমার মায়ের ছবিখানিকেও দূর করে দিয়েছেন। সেখানে তোমার কি সুখ আছে বল!”
আজ রমেশ-দা অমন কথা বলিলে তার উত্তর আমি অন্যরূপ দিতাম্। কিন্তু তখন আমি ভাবিয়াছিলাম সত্যই “রমেশদা, আমি মরুভূমি থেকে ছুটে এসে শীতল জলধারার সন্ধান পেয়েছি— আমায় ক্ষমা কর। তুমি আমার জন্য কি ছেড়ে এসেছ, তা দেখবার আমার প্রয়োজন নাই, আমার সম্মুখে তুমি যে প্রেমের নৈবেদ্য সাজিয়ে এনেছ, আমি শুধু তাই দেখছি।”
সেখান হইতে একটা টাক্সি ভাড়া করিয়া আমরা সিনেমায় গেলাম। আমার হৃদয়ের প্রফুল্লতা ফিরিয়া আসিল। আমি মনে করিলাম, কেন বৃথা দুশ্চিন্তার ভার বৃদ্ধি করিতেছি। যখন সুধার পাত্র সম্মুখে রহিয়াছে, তখন কোন মূর্খ তাহা গ্রহণ না করিয়া মুখ ফিরাইয়া চলিয়া যায়?
কমলার যে পত্রের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি তাহাতে সে আমাকে লিখিয়াছিল যে সে আমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছে। তিনি আমার জন্য খুব মনকষ্ট পাইতেছেন। পুলিশকে তিনি জানাইবেন না—অথবা কোন মামলা মোকদ্দমাও করিবেন না। বিমাতা আমার কথা মনে করিয়া কাঁদেন। হরিমতি তাহার ভবিষ্যৎ বাক্য সফল হওয়াতে খুব আনন্দিত। সে পাড়ায় পাড়ায় ঘুড়িয়া বলেছে “সে আমি আগেই জানি”। নন্দদাদা স্কুল ছাড়িয়া দিয়াছে। সে নাকি বলিতেছে আমি যেরূপে পারি মানুকে খুঁজে আনব।” মুকুলদার সহিত কমলার বিবাহের প্রস্তাবে কমলার মা সম্মতি দিয়াছেন। রমেশদার বাড়ীর খবর কিছুই পাওয়া যায় নাই।”
এই পত্র পড়িয়া আমার প্রাণে বড় দুঃখ হইয়াছিল। বিমাতা বেচারি বড় ভাল ছিলেন। তিনি আমাকে ভাল বাসিতেন, কিন্তু কখনও তাহা প্রকাশ করিতে পারেন নাই। তিনি চতুরা নারীর মত স্বামীর মন ভুলাইতে কপটতার আশ্রয় নিতেন না। তাঁহার সরল প্রাণ পিতার ইচ্ছা অনুসারে চলিত। তাঁহার জন্য আমার কষ্ট হইল। আর কষ্ট হইল, নন্দদাদার কথা ভাবিয়া, তাহার অসাবধনতার জন্যই আমি পলায়ন করিতে পারিয়াছি। বোধ হয় এজন্য সে হতভাগ্য বাবার কাছে বকুনী খাইয়াছে। তাই বুঝি সে লেখাপড়া ছাড়িয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, আমাকে খুঁজিয়া বাহির করিবে। এক একবার মনে হইত, ধরা দিয়া এমন সাহসী বীরের মর্য্যাদা রাখি।
বোম্বাই হইতে নাগপুর হইয়া আমরা মান্দ্রাজে আসিলাম। সেখানে কিছুদিন থাকিয়া ভিজগাপত্তন ও তৎপরে ওয়ালটেয়ারে উপস্থিত হইলাম। এখানকার সমুদ্র-তীর আমার বিশেষ প্রীতিজনক বোধ হওয়ায় প্রায় দুই মাস তথায় অবস্থান করি। তারপর পুরী হইয়া কাশী যাই। কাশীতে বাঙ্গালীর সংখ্যা নিতান্ত কম নহে। বেড়াইতে বাহির হইলে প্রায়ই বাঙ্গালীর সহিত সাক্ষাৎ হইত। আমার কেবলি ভয় হয়, কখন পরিচিত ব্যক্তির সহিত দেখ। হয়— আর ধরা পড়িয়া যাই।
আমি একদিন রমেশদাকে বলিলাম, চল এখান থেকে যাই। চারিদিকে বাঙ্গালী——ফস্ করে কবে চেনা পরিচিত কেউ দেখে ফেল্বে, তখনই মুস্কিল”। রমেশদা ইজি চেয়ারে লম্বা হাতলের উপর পা তুলিয়া নিশ্চিন্ত মনে চুরুট টানিতে টানিতে বলিলেন— মেয়েলি বুদ্ধি নিয়ে কি শর্ম্মারাম কাজ করে? জানিস্ এই কাশীতে যত বাঙ্গালী আছে তার অধিকাংশই তোর রমেশ-দার দলের। কেহবা কারো ঘরের বউ বের করে এনেছেন—কেউ বা বিধবা পোয়াতি খালাস করতে এসেছেন—কেহ আপন রক্ষিতা নারীর হাওয়া বদলাচ্ছেন—আবার এমন কেহ আছেন যাহারা নিজের আত্মীয়া দ্বারা পাপ ব্যবসায় করাচ্ছেন। বাঙ্গালার কলঙ্কের এই তিনটী স্থান—নবদ্বীপ, কাশী ও বৃন্দাবন। ভয় কচ্ছিস্ কাকে? কে কাকে নিন্দা করবে? এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। পথের জনসঙ্ঘ কর্তৃক লাঞ্ছিতা এক পতিতা নারী প্রভু যীশুখৃষ্টের আশ্রয় নিয়াছিল। যীশুখ্রীষ্ট সমবেত জন-মণ্ডলীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, তোমাদের মধ্যে যে নিষ্পাপ সে প্রথমে এই নারীর প্রতি লোষ্ট্র নিক্ষেপ কর। তখন কেহই অগ্রসর হইল না। বাইবেলে এই কথা আছে—মনে আছে? আমি বলিলাম “হাঁ, আছে। তুমি যেমন লোক, কাশী বৃন্দাবন নবদ্বীপকে সেই ভাবেই দেখছ। পুণ্যের দিক তোমার চোখে পড়বে কেন? তা যাই হউক, তবু চল। এখানে বেশীদিন থেকে কাজ নেই।”
আমরা এলাহাবাদ ও আগরা হইয়া মথুরায় গেলাম। প্রয়াগে গঙ্গাযমুনা সঙ্গমে স্নান করিলাম। তাজমহল, আগরাফোর্ট ও সেকেন্দ্রায় আকবরের সমাধি প্রভৃতি দেখিবার জন্য পাঁচদিন আগরায় বিলম্ব হইল। প্রায় পাঁচ মাস ঘুরিয়া আষাঢ় মাসের প্রথম ভাগে আমরা মথুরায় পৌঁছিলাম। এখানে কিছু বেশীদিন থাকিবার ইচ্ছা। এত সহর থাকিতে মথুরার উপর রমেশদার এত মন পড়িল কেন, তাহা তখন বুঝিতে পারি নাই।
স্বামীঘাটের নিকটে একেবারে যমুনার ধারে অল্প ভাড়ায় একটী ভাল বাড়ী পাওয়া গেল।
ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে ইউরোপীয় ধরণের হোটেল একটী আছে বটে, কিন্তু সেখানে থাকা রমেশদার মত হইল না। টাকা ফুরাইয়া আসিয়াছিল, সাহেবী ষ্টাইল আর ত চলেনা। রমেশদ। বলিলেন “মথুরায় দেশীয় ভাবে থাকাই সুবিধাজনক।” তিনি কোট প্যাণ্টুলন, টাই টুপি ছাড়িলেন। আমার পোষাকে বিদেশীয় ভাব তেমন কিছুই ছিল না। গোড়ালী উঁচু জুতার বদলে আমি নাগরাই জুতা পরিলাম। রান্না করিবার জন্য বামুন ঠাকুর রাখা হইল। একটী চাকরও পাওয়া গেল—সে বাজার করিত, জল তুলিত, থালা বাসন মাজিত।
একদিন দেখিলাম রমেশদা গোঁফ কামাইয়া ফেলিয়াছেন। আমি বলিলাম “ওকি রমেশদা, তোমায় ভাল দেখাচ্ছে না।” রমেশদা বলিলেন “ভাবনা কি—আবার গজাবে।”
কথাটা পরিহাসের বাতাসে উড়িয়া গেল। কিন্তু ব্যাপার এইখানে শেষ হইল না— আর একদিন দেখিলাম, রমেশদা এক নাপিত ডাকাইয়া মস্তক মুণ্ডিত করিলেন, মধ্যস্থলে এক গোছা চুল শিখার মত রাখিলেন। আমার সন্দেহ হইল— ইহার মধ্যে কোন মতলব আছে। তার পর যখন ললাটে, নাসিকায় চন্দনের তিলক ছাপ দিয়া, কাছা শূন্য কাপড় ও মাদ্রাজী জুতা পড়িয়া রমেশদা একেবারে দ্রাবিড়ী পণ্ডিত সাজিলেন, তখন আমার আর বুঝিতে বাকি রহিল না যে রমেশ-দা আত্মগোপনের চেষ্টা করিতেছেন। কিন্তু আমি মুখ ফুটিয়া কিছু বলিলাম না। সমস্ত ঘটনাটী হাসি ঠাট্টার উপর দিয়াই শেষ হইল।
রমেশদা এক সময়ে রেঙ্গুনে থাকিতে মাদ্রাজী কথা শিখিয়াছিলেন। বৃন্দাবনে রঙ্গজীর মন্দিরে যাইয়া তিনি যখন স্বামীজি মহারাজের সঙ্গে আলাপ করিলেন, আমি আশ্চর্য্য হইয়া গেলাম। রামস্বরূপ আয়ার এই নামে রমেশদার চিঠি আসিত। অবশ্য অন্য সহরেও আমরা এযাবৎ ছদ্মনামে বাস করিয়াছি। কিন্তু এবারে রমেশদা যেন একটু বেশী সাবধান হইতেছেন। আমাকে এ সম্বন্ধে তিনি কিছুই বলেন নাই।
কলিকাতায় থাকিতেই রমেশদা বন্ধুদের সহিত মিশিয়া মদ্যপান অভ্যাস করিয়াছিলেন। আমি তাহা জানিতাম না। বাহিরে আসিয়া হোটেলে ইউরোপীয়ান ষ্টাইলে থাকার সময় মদ্যপানের মাত্রা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইল। আমাকেও একটু আধটু খাইতে তিনি অনুরোধ করিয়াছিলেন। আপত্তি করিয়া বলিলাম “না —বিষেশতঃ দেহের এই অবস্থায়।” রমেশদা বলিলেন “সে এখনও ছয়মাস দেরী, তা’বলে কি স্ফূর্ত্তি মাটী করতে হয়? —আর তোমাদের আঁতুর ঘরে যা খাওয়ান হয়, সে “ভাইনাম গ্যালিসিয়াটা” কি? সেত খাঁটী এক্স নম্বর ওয়ান।” রমেশদার রোজই দু এক গ্লাস চলিত। গন্ধটা আমার সহিয়া গিয়াছিল। কখনও কখনও বোতল হইতে আমিও ঢালিয়া দিতে বাধ্য হইতাম।
ইউরোপে তখন মহাযুদ্ধ। মথুরার ক্যাণ্টনমেণ্টে অনেক গোরা পল্টন আসিয়াছে। চারিদিক হইতে সৈন্য সংগ্রহ ও রসদ জোগাইবার ব্যবস্থা। রমেশদা বলিলেন “মানু, আমি একটু ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে যাচ্ছি, দেখি—যদি ভাল এক বোতল জোগাড় করতে পারি। এই সহরে কিছু পাওয়ার যো নাই। এরা কেবল সিদ্ধি ভাং নিয়েই ব্যস্ত।” রমেশদা বাহির হইয়া গেলেন। আমি বাড়ীতে একাকী।
চাকর একখানি ডাকের চিঠি দিয়া গেল। খুলিয়া দেখিলাম কমলা লিখিয়াছে। চিঠিখানা পড়িয়া আমি বজ্রাহত হইলাম। রমেশদা যে আফিসে চাকুরী করিত, তাহার তহবিল হইতে তিন হাজার টাকা চুরি করিয়াছে। চারি মাসের ছুটী লওয়ার কথা মিথ্যা। রমেশদার বিরুদ্ধে সেই কোম্পানী পুলিশের নিকট অভিযোগ করিয়াছে। গ্রেপ্তারী পরওয়ানা বাহির হইয়াছে। আমাকে অপহরণ করার অভিযোগ আমার পিতা না করিলেও আমার মামা (নন্দদাদার পিতা) পুলিশকে জানাইয়াছেন। এই উপলক্ষে পুলিশ আমাদের বাড়ী, মুকুলদার বাসা, কমলাদের বাড়ী, রমেশদার বোর্ডিং এবং রমেশদার বাড়ী অনুসন্ধান করিয়াছে। কমলার এবং মুকুলদার নিকট হইতে পুলিশ রমেশদার বোম্বাই ও কাশীর ঠিকানা পাইয়াছে। গোয়েন্দা পুলিশ রমেশদার পিছু লইয়াছে।
আমার শরীর ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। তারপর রমেশদার উপর আমার অমানুষিক ক্রোধ ও ঘৃণার উদয় হইল। আমি কিছু বুঝিনা বলিয়া আমার সহিত এত প্রতারণা—আমি প্রাণ দিয়া ভাল বাসিয়াছি, বিশ্বাস করিয়াছি, তার প্রতিদান বুঝি এই জঘন্য ব্যবহার। আমি স্তব্ধ হইয়া রহিলাম।
সন্ধ্যার পরে রমেশ-দা আসিলেন। অতিরিক্ত মদ্যপানে তিনি মত্ত হইয়াছেন—চোখ দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম। আমি কঠোর স্বরে কহিলাম “রমেশদা, তুমি যে চা’রমাসের ছুটী নিয়েছিলে, তার উপর আরও একমাস হয়ে গেল, অথচ”— আমার কথা শেষ না হইতেই রমেশ-দা জড়িত কণ্ঠে কহিল “সে কৈফিয়ৎ কি তোর কাছে দিতে হবে নাকি? —তুই কি আমার মনিব?” আমি বলিলাম, কৈফিয়ৎ চাহিনা, কারণ-ত আমার বলতে পার!
রমেশ। —আমি আরও তিন মাসের ছুটীর দরখাস্ত করেছি। এইবার সন্দেহ মিটেছে?
আমি। —সন্দেহ নয় রমেশদা, তুমি জান, হাতের টাকা সব ফুরিয়ে গেছে। আর এক সপ্তাহও চল্বে না। যদি তুমি এখন কলকাতায় ফিরে না যাও, তবে অন্ততঃ ছুটীর মাসের বেতনটাও আনাতে পার। সেওত আটশত টাকা হবে।
রমেশ। —সে ভাবনা তোমায় করতে হবে না। সিগারেটের প্যাকেট আর দেশালাইটা দাও ত।
আমি হুকুম তামিল করিয়া বলিলাম “রমশদা, দেখছ ত আমার দেহের গতিক। এমন অবস্থায় কোন ভাল সহরে— যেখানে ভাল ডাক্তার অথবা প্রসূতি হাসপাতাল আছে—এমন স্থানে না থাকিলে আমার ভয় হয়। তাতেও অনেক টাকা খরচ হবে।
রমেশদা টলিতে টলিতে খাটীয়ার উপর শুইয়া পড়িলেন। সিগারেট টানিতে টানিতে বলিলেন “টাকার আর ভাবনা কি মানু। দেখছিস্ ত এক থোকে আড়াই হাজার টাকা।” রমেশদা কাশিতে কাশিতে ‘ওয়াক্ ওয়াক্’ করিতে লাগিলেন। আমি একটা বাটী সম্মুখে রাখিয়া বলিলাম, “আড়াই হাজার কেন, তিন হাজার বল।” রমেশদা চক্ষু বিস্ফারিত করিলেন তাঁহার বর্মির ভাব চলিয়া গেল।
আমি বলিলাম “রমেশদা, তুমি তিন হাজার যে ভাবে পেয়েছ তা আমি জানি। সেই রকম রোজগারের আর এক কানাকড়িও আমি চাহি না। যদি ক্ষমতা থাকে, সৎপথে থেকে উপার্জ্জন করে আমায় রাখ— চুরি জোচ্চুরির পথে গিয়ে নিজে মজোনা— আমায়ও মজিও না।”
রমেশদা নেশার ঘোরে বলিতে লাগিলেন “মানু, তোকে নিয়ে আমি সর্ব্বত্যাগী হলুম, আর তুই আমায় চোর বল্ছিস? আমি কার জন্যে চুরি করেছি?— কার জন্য স্ত্রীকে ছেড়েছি, মাকে ছেড়েছি?— কার জন্য জেলে পা বাড়িয়েছি? যাঃ—চ্চলে, এই দুনিয়ায় দরদী কেউ নেই— প্রেমের মর্যাদা কেউ বুঝলে না। ওরে, চোর না হলে কেউ প্রেমিক হয় না। এই মথুরা তার সাক্ষ্য দিবে। বেশ, তুমি তবে সাধুসজ্জন নিয়ে থাক— আমি এই মূহুর্ত্তে চল্লুম।
রমেশদা উঠিয়া টলিতে টলিতে জুতা পরিলেন, জামা গায়ে দিলেন। একি, সত্যই তিনি চলিলেন। অমি ছুটিয়া যাইয়া তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিলাম, “রমেশদা আমায় ছেড়ে যেওনা, আমার অপরাধ হয়েছে, ক্ষমা কর— আমার অকূল সমুদ্রে ভাসিও না।”
রমেশদা এক লাথি মারিয়া আমাকে দূরে ফেলিয়া ক্রোধোন্মত্ত স্বরে চীৎকার করিয়া কহিলেন, “চুপ রও সয়তানী,— আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না। তোমার ধর্ম্মজ্ঞান নিয়ে তুমি থাক।” নেশার ঘোরে তিনিও পড়িয়া যইেতেছিলেন। আমি তাড়াতাড়ি তাঁহাকে বিছানায় শোয়াইয়া মাথায় জল দিয়া বাতাস করিতে লাগিলাম।
কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁর খুব বমি হইতে লাগিল। বিছানা মেজে সব ভাসিয়া গেল। দুর্গন্ধে ঘর ভরিয়া উঠিল। বামুন ঠাকুর অথবা চাকর হইারা কেহ কাছে আসিল না। আমি নিজেই বাল্তি করিয়া জল আনিয়া সমস্ত পরিষ্কার করিলাম। রাত্রিতে আমাদের কাহারও আহার হইল না। আমি তাঁহাকে বাতাস করিতে লাগিলাম। শেষ রাত্রিতে তাঁর খুব ঘাম হইয়া দেহ একেবারে হিম হইয়া গেল। আমার বড় ভয় হইল। মানসিক উদ্বেগে দুশ্চিন্তায় সারা রাত্রি আমার ঘুম হইল না।
পরদিন বেলা নয়টার সময় রমেশদার চৈতন্য হইল। তাঁহাকে স্নান করাইয়া একট গরম দুধ দিয়া কোকো তৈয়ারী করিয়া খাইতে দিলাম। কমলার চিঠিখানি তিনি আদ্যন্ত পড়িলেন। বুঝিলেন ব্যাপার গুরুতর হইয়া উঠিয়াছে।
আমাদের প্রণয়ের নির্ম্মল আকাশে মেঘের সঞ্চার হইল। বিশ্বাসের স্থলে সন্দেহ আসিল। রমেশদাকে এক নূতন চক্ষে আমি দেখিতে লাগিলাম। তাঁহার চরিত্রের নানাদিক আমার সম্মুখে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল— লম্পট, চোর, বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যাবাদী, মাতাল!