তৃতীয়

পলায়ন

 বেথুনে পড়িবার সময় আমার তিনটী অন্তরঙ্গ বালিকা বন্ধু লাভ ঘটিয়াছিল। তন্মধ্যে কমলার পরিচয় একটু বিশেষভাবে দিব। কারণ তাহার জীবনের সহিত আমার জীবন এক অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে জড়িত। বাল্যকালের কোন বন্ধুর সহিত এখন আর দেখা হয় না। অনেককেই ভুলিয়া গিয়াছি। কিন্তু কমলাকে এখনও ভুলিতে পারি নাই। সেও আমাকে হয়ত ভুলে নাই। আজ এই আত্মচরিত লিখিবার সময়ে তাহার কথা প্রতিমুহুর্তে আমার মনে হয়―অতীত জীবনের সুখ দুঃখের কত কথা আজ মনে হইতেছে।

 কমলা পরমা সুন্দরী ছিল―ছিল কেন, এখনও বোধ হয় আছে। নারীর সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে পুরুষেরা বলিয়া থাকে,―“স্ত্রীলোক কুড়ি পার হইলেই বুড়ি।” একথা সকলের সম্বন্ধে খাটেনা। কুড়ির পর আরও কুড়ি বৎসর চলিয়া গিয়াছে, তবু এমন নারী হিন্দুসমাজে যথেষ্ট আছে, যাহাদের সৌন্দর্য ভাদ্রের ভরানদীর মত ঢল ঢল, শরতের জ্যোৎস্নার ন্যায় অনাবিল, তাহাতে মলিনতার লেশ মাত্র নাই। আমি নিজে নারী হইয়া নারীর রূপে আকৃষ্ট হইয়াছি, শুনিয়া হয়ত আপনারা হাসিবেন।

শুধু রূপে নহে, গুণেও কমলা আমার চিত্তকে মুগ্ধ করিয়াছিল। তাহার ভালবাসা ও সহানুভূতি আমি চিরদিন সমভাবে পাইয়াছি। আমোদ-প্রমোদে, গান-বাজনায়, হাস্য-পরিহাসে, খেলা-ধূলায়, লেখা-পড়ায় সকল বিষয়ে তাহার সমান অধিকার ছিল। স্কুলের প্রাইজ্‌ ডিষ্ট্রীবিউসন (পুরস্কার বিতরণ) অথবা অন্য কোন উৎসবের আয়োজনে কমলার সাহায্য না লইলে চলিত না। সে মেয়েদের গান ও অভিনয় শিখাইত।

 একবার কোন বালিকা বিদ্যালয়ের গৃহ নির্ম্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ চেষ্টায় ইউনিভারসিটি ইন্‌ষ্টিটিউটে নানাবিধ আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা হয়। আমার রমেশ-দা তাহাতে একজন প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। সেই উপলক্ষে বোধ হয় বেথুন, ডায়োসিসান, প্রভৃতি বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা মিলিয়া নবীন সেনের ‘কুরুক্ষেত্র' কাব্য হইতে নির্ব্বাচিত দৃশ্যের অভিনয় করে। তাহাতে আমি ‘শৈলজার’ অংশ লইয়াছিলাম, কমলা নিজে ‘জরুৎকার’ সাজিয়াছিল। আমাদের অভিনয় দেখিয়া দর্শকগণ চমৎকৃত হইয়াছিলেন। শৈলজার দু’টী গান আমার মাষ্টার মহাশয় রচনা করিয়া দিয়াছিলেন। কমলা তাহাতে সুর যোজনা করিয়া আমাকে শিখাইয়াছিল। অর্জ্জুনের প্রেমলাভে নিরাশ শৈলজার অন্তরের ব্যাথা সেই গানে ফুটিয়া বাহির হইয়াছিল। সেই গান এখনও মাঝে মাঝে গাহিয়া আমি শান্তি পাই।

 কমলা বৈদ্য বংশের মেয়ে। কলিকাতায় বাগ্‌বাজারে একখানা সাধারণ দোতালা বাড়ীতে সে তাহার মাতার সহিত বাস করিত। কমলার পিতা কার্য্যোপলক্ষে নানাস্থানে ঘুড়িয়া বেড়াইতেন। মাঝে মাঝে দুই এক মাস বা দশ পনরদিন কলিকাতায় আসিয়া থাকিতেন। কমলার একটী ছোট ভাই স্কুলে পড়িত। সে কমলার অপেক্ষা ছয় বৎসরের ছোট ছিল।

 বাড়ীখানা কমলাদের নিজের। সুতরাং তাহার পিতা মাসিক যে দুইশত টাকা পাইতেন, তাহাতে তাহাদের জীবিকা নির্ব্বাহ স্বচ্ছন্দে হইয়া যাইত।

 আমি কমলাদের বাড়ী অনেকবার গিয়াছি। তাহার মাতা অতি শান্ত-স্বভাবা ও স্নেহশীলা। তিনি আমাকে আদরের সহিত কত সুমিষ্ট খাদ্য আহার করাইতেন। আমি মাতৃস্নেহে বঞ্চিত ছিলাম বলিয়া সহজেই কমলার মায়ের বিশেষ অনুগত হইয়া পড়িলাম। তিনি সর্ব্বদাই আমাকে বলিতেন “তুমি আমার কমলার ছোটবোন।” কমলা বয়সে আমার দুই বৎসরের বড় ছিল।

 কাশীতে কমলার পিতার এক বন্ধু বাস করিতেন। তাঁহার চেষ্টায় এক যুবকের সহিত কমলার বিবাহ হয়। উহা দুই বৎসর পূর্ব্বের কথা। কমলা তখন আমাদের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। যুবকটী কাশীতেই চাক্‌রি করিত―তাহার পিতামাতাও সেখানে থাকিতেন। গ্রীষ্মের ও পূজার ছুটীতে কমলা কাশীতে স্বামীর কাছে যাইত। কমলা ও তাহার স্বামীর মধ্যে যে সকল চিঠীপত্র চলিয়াছে, তাহা সমস্তই আমি দেখিয়াছি। আমরা দুইজনে গোপনে বসিয়া তাহাদের কত অর্থ বিশ্লেষণ করিতাম।

 আমাদের সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে এই সব চিঠি লইয়া কত হাস্য পরিহাস চলিত। আমার আরও দুই তিনটী বিবাহিতা বন্ধু ছিলেন। তাহাদের স্বামী-প্রেমের ভিতরের রহস্যও আমি জানিতাম। প্রথম প্রণয়-সম্ভাষণ, বাসর রজনী যাপন, মানঅভিমানের অভিনয়, পুরুষের ব্যবহার প্রভৃতি বিষয় লইয়া আমাদের মেয়ে মহলে নিত্য আলোচনা হইত। এই সকলের মধ্যে আমি আমার ছোট গল্পের প্লট্ ও কবিতার উপাদান পাইতাম। তাই মুকুলদা আমাকে বলিতেন “মানু, তোমার গল্পে ও কবিতায় আমি রিয়্যালিষ্টিক আর্টের গন্ধ পাচ্ছি।”

 প্রায় আট নয় মাস হইল, কমলার সহিত তাহার স্বামীর বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে। ইহার কারণ বড় ভয়ানক। কমলার শ্বশুর কিরূপে শুনিয়াছেন, কমলার মাতা কমলার পিতার বিবাহিতা পত্নী নহে―রক্ষিতা মাত্র। সুতরাং জানিয়া শুনিয়া পতিতা নারীর কন্যাকে তিনি পুত্রবধূ রূপে গৃহে রাখিতে পারেন না। তিনি লিখিয়া জানাইয়াছেন―কমলাকে আর তিনি গ্রহণ করিবেন না।―পুত্রের পুনর্ব্বার বিবাহ দিবেন। তিনি আরও ভয় দেখাইয়াছেন, যদি কমলা ভরণ-পোষণের দাবী করে, তবে আদালতে তিনি সমস্ত কলঙ্কের কথা প্রকাশ করিয়া দিবেন, এবং প্রতারণার অভিযোগ করিয়া কমলার পিতার বিরুদ্ধে পাল্টা মোকদ্দমা আনিবেন।

 এই ব্যাপার উপলক্ষে কমলার স্বামী যে কয়েকখানা পত্র তাহার নিকট লিখিয়াছিলেন তাহা বড়ই করুণ। তিনি কমলাকে অতিশয় ভালবাসিতেন। কমলাও তাহার স্বামীর প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিল। কে যেন দারুণ খড়্‌গাঘাতে ইহাদের প্রেমের বন্ধন ছিন্ন করিয়া দিল। কমলার স্বামী লিখিয়াছেন―“কি কর্‌ব―তোমার কোন অপরাধ নেই জানি কিন্তু আমি পিতার অবাধ্য হ’তে পারি নে। আমায় ক্ষমা কর কমল। ধর্ম্মসাক্ষী করে তোমায় পত্নীরূপে গ্রহণ করিয়াছিলাম―আবার ধর্ম্মের মুখ চেয়েই তোমায় পরিত্যাগ কর্‌ছি। অগ্নি পরীক্ষার পরও রামচন্দ্র কলঙ্কিত পত্নীকে নিয়ে গৃহধর্ম্ম পালন কর্‌তে পারেন নি। সীতার মত পত্নীকে বিসর্জ্জন কর্‌তে হয়েছিল। এখন বিদায়, আমার ভালবাসা তুমি চিরদিন পাবে―কিন্তু পত্নীরূপে নহে।”

 এই পত্রের উত্তর আমিই কমলাকে লিখিয়া দিয়াছিলাম। পত্রের উত্তর দিবার কমলার ইচ্ছা ছিল না। তার প্রাণে বড় আঘাত লাগিয়াছিল। বাহিরের আমোদ প্রমোদে সে তাহা ভুলিবার চেষ্টা করিত কিন্তু আমি তাহার হৃদয়ের অন্তস্থল পর্য্যন্ত দেখিতাম। আমার অনুরোধে ও উপদেশে কমলা শেষে এইরূপ লিখিল―“তুমি যাহা সিদ্ধান্ত করেছ, তাহা অটল থাকুক। তোমার পিতৃভক্তি যেন বিচলিত না হয়। তুমি ভারতের আদর্শ গৌরব দেখিয়ে যে দৃষ্টান্ত দিয়েছ, তাহার শেষ চিত্র তোমার চোখে পড়েনি। পরশুরামের প্রায়শ্চিত্ত―ভীষ্মের শরশয্যা রামচন্দ্রের বিলাপ তুমি ভুলে গিয়েছ। পিতৃভক্ত মাতৃঘাতী কুঠার হস্ত-মুক্ত করবার জন্য পরশুরামকে দীর্ঘকাল তীর্থ ভ্রমণ কর্‌তে হয়েছিল, পিতৃভক্তি তাকে রক্ষা কর্‌তে পারে নি। প্রেমে প্রত্যাখ্যাতা অম্বার তপস্যা ভীষ্মের ক্ষাত্রশক্তিকে নপুংসকের হস্তে পরাভুত করেছিল, পিতৃভক্তি তাহাকে রক্ষা করতে পারে নি। এ জগতে প্রত্যেক কর্ম্মের ফল পৃথক পৃথক ও স্বাধীন।”

 “একের দ্বারা অন্যের প্রতিরোধ হয় না। তোমায় উপদেশ দেওয়া আমার কর্ত্তব্য নহে। প্রগল্‌ভতা ক্ষমা করো। তুমি মহৎ―তাই আমায় পরিত্যাগ করেও চিরদিন ভালবাস্‌বে বলছ, কিন্তু আমি তোমার মত মহৎ নই―আমি ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র―স্রোতে ভাসিয়া চলিলাম, জানিনা কোথায়।”

 কমলার এই পত্রেরও উত্তর আসিয়াছিল। তাহাতে তাহার স্বামী লিখিয়াছিলেন “কমল আমার অপরাধ বুঝেছি। প্রায়শ্চিত্তের দিন এলে মাথা পেতে শাস্তি গ্রহণ করব। তখন যেখানেই থাক হতভাগ্যকে একবার মনে করো।” বুঝিলাম কমলার স্বামীর প্রাণ আছে। সে যথার্থ দরদী, কিন্তু অবস্থার দাস। সমাজের কৃত্রিমতার আঘাতে এমন কত হৃদয় স্বভাবের পথে পরিচালিত হইতে পারে না। সমাজ-বিধি এমনি করিয়া মানব জীবনের পরিস্ফূর্ত্তির পথে অন্তরায় হয়।

 কমলার মায়ের সম্বন্ধে যে কলঙ্কের কথা রটিয়াছিল, তাহা কতদূর সত্য আমি তাহার অনুসন্ধান করি নাই। পদ্মফুলের মূল থাকে কাদায়―সূর্য্য তাহার খোঁজ রাখে না। সে জলের উপরে ফুলটীকে ফুটাইয়া সুখী হয়―বাতাস তাহাকে দোলায়―ভ্রমর তার মধুপান করে।

 কমলা আমাদের বাড়ীতে প্রায়ই আসিত। আমার পিতাও তাহাকে স্নেহ করিতেন। মাষ্টার মহাশয়, আমি, কমলা ও রমেশ দাদা মাঝে মাঝে মোটরে বেড়াইতে যাইতাম। কমলাদের বাড়ীতে আমাদের চা-পার্টির নিমন্ত্রণ হইত। কমলার মাতা ধনীর গৃহিণী না হইলেও আমাদের আদর যত্নের ত্রুটী হইত না। তিনি স্বহস্তে সমস্ত খাবার প্রস্তুত করিতেন।

 আমি যে সকলের সঙ্গে এরূপ অবাধ মেলা মেশা করিতাম, ইহাতে পিতার কোন আপত্তি ছিলনা। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, তিনি সামাজিক ব্যাপারে উদার মত পোষণ করিতেন। আমাদের বাড়ীর পশ্চাতে খানিকটা মাঠের মত জায়গা ছিল। আমি বাবাকে বলিয়া সেখানে একটী টেনিস্-কোর্ট্‌ তৈয়ারী করাইলাম। নন্দ-দাদা এ-বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগী হইল। রমেশ-দা, মুকুল-দা, কমলা, আমি, নন্দলাল এবং আরও কয়েক জন বন্ধু বৈকালে এই মাঠে টেনিস্ খেলিতাম। মুকুল-দা খেলা কিছুই জানিতেন না―তাঁহাকে অনেক ধরিয়া বাঁধিয়া শিখাইয়া লইলাম। কমলা খেলায় খুব নিপুণ ছিল। সে সর্ব্বদাই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী থাকিত। রমেশ-দা ও মুকুল-দা কখনও আমার পক্ষে কখনও কমলার পক্ষে খেলা করিত।

 বিমাতা আমাদের সংসারে আসিবার সময় পিত্রালয় হইতে একটী দাসী আনিয়াছিলেন। তাহার নাম ছিল হরিমতি। তাহাকে ঝিয়ের কাজকর্ম কিছুই করিতে হইত না। সে ছিল অনেকটা আমার বিমাতার পার্সন্যাল এসিষ্ট্যাণ্ট বা প্রাইভেট্ সেক্রেটারী। তাহার বয়স প্রায় ৪৫।৪৬ হইবে। বোধ হয়, সে বিধবা―থান কাপড় পরিত, হাতে নোয়া ও সিঁথিতে সিন্দুর দিত না, তাহার গলায় একছড়া সরু বিছাহার ও হাতে চারিগাছি সোণার চূড়ি ছিল। সে একাদশীর উপবাস করিত, মাথায় গন্ধ তেল মাখিত ও চব্বিশ ঘণ্টা দোক্তা দেওয়া পান চিবাইত। চাকর বেচারেদের উপর যে তা’র কটাক্ষপাত না হইত এমন নহে।

 বাড়ীর এক নিভৃত কোণে হরিমতি তার শোবার ঘর ঠিক্ করিয়াছিল। উহা সে প্রয়োজন মত সাবধানে তালাচাবি দিয়া বন্ধ করিয়া রাখিত। দুপুর বেলা সে ঐ ঘরে যাইয়া ঘুমাইত। তার নিজের কোন নির্দ্দিষ্ট কাজ না থাকায় অপর সকলের কাজের উপর ওস্তাদি করিয়া বেড়াইত―আর খামাকা কথা তুলিয়া কেবলি গোলযোগ পাকাইত।

 আমার এই রকম চাল-চলন হরিমতি দুই চক্ষে দেখিতে পারিত না। সে প্রথমে বিমাতার নিকট আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিল। কিন্তু বিমাতা আমার প্রায় সম-বয়সী, বিশেষতঃ মায়ের মত গাম্ভীর্য্য ও শাসন করিবার ক্ষমতা তাঁহার ছিল না। তিনি রুক্ষভাষিণী ও কোপন স্বভাব নহেন। সুতরাং তিনি আমায় কিছুই বলিলেন না। বিফল মনোরথ হইয়া হরিমতি বাবার কাছে গেল; কিন্তু সেখানেও কোন সুবিধা হইল না।

 অবশেষে সে নিজেই আমাকে শাসন করিতে আরম্ভ করিল। একদিন হরিমতি আমাকে বলিল “আচ্ছা, খুকুমণি এসব কি বলত! পাড়াময় লোকে ছিছি কচ্ছে। জ্ঞাতি ভাই আছে―মাষ্টার আছে, বেশ তাদের সঙ্গে সভ্য ভব্য হয়ে কথা কও―হাস্‌তে হাস্‌তে পুরুষের গায়ে ঢলে পড়া―গলাগলি হ’য়ে বেড়ান! তুমি সোমত্ত মেয়ে―বিয়ে হ’লে এদ্দিনে ছেলের মা হ’তে।”

 হরিমতি যাহা বলিয়াছিল তাহা মিথ্যা নয়, এজন্য আমি কোন উত্তর দিলাম না। মাথা নীচু করিয়া রহিলাম। ঝগড়া করা আমার স্বভাব নহে। বিশেষতঃ এক্ষেত্রে বাদ প্রতিবাদ আমার পক্ষে সুবিধাজনক হইবে না, তাহা আমি জানিতাম। ঘটনা যে পাড়াময় ছড়াইয়াছে, একথা হরিমতি আমাকে ভয় দেখাইবার জন্য বলিয়াছিল। তবে ইহাও আমি জানিতাম, যদি আমার কখনও বদ্‌নাম রটে, তবে তাহা হরিমতি দ্বারাই হইবে।

 কিছুদিনের মধ্যেই আমার ধারণা সত্যে পরিণত হইল। হরিমতি যখন দেখিল মুখের কথায় শাসাইয়া আমাকে জব্দ করিতে পারিল না, তখন সে পাড়াময় আমার বদনাম রটাইতে লাগিল। কথা ক্রমশঃ বাবার কাণে উঠিল, তিনি বিশ্বাস করিলেন না। তিনি সংবাদ-দাতাকে বলিলেন, “আমাদের দেশের মেয়েরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করিলে অমনি সাধারণ লোক নানা মিথ্যা কলঙ্কের কথা রটায়। কারণ―এদেশে স্ত্রী-স্বাধীনতা চলিত নহে।”

 আমার জেদ বাড়িয়া উঠিল। মুকুল দাদা আমাকে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন, “প্রেমের পথে যতই বাধা বিঘ্ন আসে, ততই উহা প্রবল হয়।” ইহার প্রমাণ আমি আমার হৃদয়ের মধ্যে পাইতে লাগিলাম।

 আমার প্রথম যৌবনের উদ্দাম আকাঙ্খা প্রাণের মধ্যে জাগিয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখে দেখিলাম দুইটী যুবক―মুকুল ও রমেশ। প্রকৃতির নিয়মে ইহাদের দিকে প্রবৃত্তির প্রবাহ প্রবল বেগে ছুটিল। আমাকে টানিয়া রাখিবার জন্য শাসন, মাতৃস্নেহ, আদর-যত্ন ছিল না। আজ মনে হয়, আমার মা বাঁচিয়া থাকিলে হয়ত এ-পথে আসিতাম না। আমার বাবা যদি একদিনও একটু আদর করে আমার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিতেন, অথবা শাসন করিতেন তবে বোধ হয় এ জীবনের গতি ফিরিয়া যাইত।

 মুকুলদা একটু ভীরু স্বভাব। রমেশ-দা ছিল সাহসী ও বেপরোয়া। একদিন দুপুর বেলা বাবা বৈঠকখানা ঘরে বসিয়া পড়িতেছিলেন। আমাদের স্কুল ছুটি। আফিসও বন্ধ। রমেশ-দা আসিয়া বাবাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “কাকাবাবু, মানী কোথায়?” বাবা বলিলেন উপরে আছে―কেন?” রমেশদা বলিলেন “আজ আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে যাব, মানী যদি যায়, তবে কাকীমাকে শুদ্ধ নিয়ে যাব।” বাবা বলিলেন “যাও জিজ্ঞেস্ করে এস।”

 রমেশ-দা একবারে আমার শোবার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি, অর্দ্ধ শয়ান অবস্থায় গীতগোবিন্দের একটা কবিতা পড়িতেছিলাম। তিনি পালঙ্কের উপরে আমার পাশে বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মানী আজ বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবে?―চল।” আমি বলিলাম, “না রমেশদা, আজ শরীরটা ভাল নয়।” রমেশদা আমার কপালে হাত দিয়া কহিলেন “কৈ, কিছুইত নয়! দেখি হাত!” তিনি আমার বাম হাত খানি টানিয়া নাড়ী টিপিয়া বলিলেন “কিছুনা―তোমার সব চালাকী!” তিনি আমার আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে তাঁহার আঙ্গুলগুলি প্রবেশ করাইয়া পাঞ্জা ধরার মত আমার হাত টিপিতে লাগিলেন। আমার সমস্ত দেহে বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মত এক অপূর্ব্ব পুলকের সঞ্চার হইতেছিল।  আমি কাত হইয়া ফিরিয়া শুইলাম। একটু মুচ্‌কি হাসিয়া বলিলাম, “নাড়ী টিপিয়া আর কপালে হাত দিয়াই বুঝি সব ব্যারাম ধরা যায়।” রমেশ-দা এই পরিহাসের অর্থ বুঝিয়া বলিলেন “তবে আমাকে বিনা ষ্টেথিস্‌কোপেই পরীক্ষা কর্‌তে হয়।”

* * * * 

 কিছুক্ষণ পরে রমেশ-দা বাহির হইয়া গেলেন। হিংস্র ব্যাঘ্র যেমন রক্তের স্বাদে উন্মত্ত হয়, আমিও তেমনি হইলাম। আমার মনে কিছুমাত্র ভয় বা অনুতাপ আসিল না। বরং আশঙ্কা ও সঙ্কোচ কাটিয়া গেল। বুঝিলাম ইচ্ছা থাকিলে সুযোগের অভাব হয় না।

 ছয় সাত মাস চলিয়া যায়। আমি প্রবৃত্তির অনলে ইন্ধন দিতেছি। রমেশ-দা তখনও বোর্ডিংএ থাকেন। নানা অছিলা দেখাইয়া পরিবার আনেন নাই। মুকুলদা কমলার প্রতি আসক্ত হইয়াছিলেন। তিনি ব্রাহ্ম মতে কমলাকে বিবাহ করিতে সম্মত, এইরূপ ভাবও দেখাইয়াছেন। আমি তাহাতে সন্তুষ্ট হইলাম। কমলা কিন্তু তখনও দূরে দূরে―সে তার পূর্ব্বের স্বামীকে এত শীঘ্র ভুলিতে পারে নাই।

 একদিন রমেশ-দা আমার নিকট প্রস্তাব করিল, আর ত এ বাড়ীতে হ’তে পারে না। এমন স্থানে চল, যেখানে নিত্য তোমায় দেখ্‌ব―প্রতিমুহুর্ত্তে তোমায় প্রাণের কাছে রাখতে পারব। পাথরের পাহাড় চুরমার করে যখন নদীপ্রবাহ একবার বেরিয়েছে, তখন চল একবারে মুক্তপ্রান্তরে যেয়ে পড়ি। আমি কোন উত্তর না দিয়া রমেশ-দার গলা জড়াইয়া তাঁর বুকে মাথা লুকাইয়া কাঁদিয়া ফেলিলাম।

 আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা নিকটবর্ত্তী হইয়াছিল। বাড়ীতে সকালবেলা অধিকক্ষণ পড়িবার জন্য আমি বাবাকে বলিয়াছিলাম যে এখন স্কুলের গাড়ী প্রথম ট্রিপেই নয়টার সময় আমাকে নিতে আসে; অথচ ক্লাস বসে সাড়ে দশটায়। বহু সময় আমার বৃথা নষ্ট হয়। বাবা বলিলেন, “বাড়ীর মোটরত মেরামত কর্‌তে দেওয়া হয়েছে। যতদিন না আসে ততদিন ট্যাক্সি করে যেও। নন্দলাল আর তুমি এক সঙ্গে যাবে। আগে তোমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তারপর নন্দকে দিয়ে আসবে। পরদিন হইতে আমি ও নন্দ-দা টাক্সিতে স্কুলে যাইতাম। আসিবার সময় নন্দলাল আগে টাক্সি করিয়া আসিত। আমি তাহার জন্য স্কুলে অপেক্ষা করিতাম।

 দুই তিন দিন যাবৎ আমার মাঝে মাঝে বমি হইতেছে। মুখ দিয়া কেবল থুতু উঠে। রমেশদা শুনিয়া একটু স্তব্ধ হইলেন। পরদিন তিনি আসিয়া বলিলেন “মানী, আমি চার মাচের ছুটী নিয়েছি। চল পশ্চিমে যাই। আর বেশী দেরী করোনা। কাল স্কুলে যাবার সময় নন্দকে আগে নামিয়ে দিয়ে তুমি ট্যাক্সি নিয়ে একেবারে আমার বাসায় যেও। আমি সব জিনিষ পত্র গুছিয়ে ঠিক করে রাখব। যা যা কেনবার প্রয়োজন, মুকুলকে টাকা দিয়েছি।” আমার প্রাণ আনন্দে অধীর হইল।

 মুকুলদা নিয়মিত সময়ে পড়াইতে আসিতেন। আমার সহিত রমেশ-দার প্রণয়ের কথ। মুকুলদার নিকট গোপন ছিল না। এই উপলক্ষে তাঁর কত নূতন কবিতা রচিত হইয়া গেল——‘মাধুরী’ নামে আর একখানি কাব্যগ্রন্থ লেখা হইল

 পরদিন যথাসময়ে আমি ও নন্দ-দা ট্যাক্সি চড়িয়া স্কুলে রওয়ানা হইলাম। আমি পুস্তক অথবা খাতা কিছুই নিলাম না। নন্দদাকে বুঝাইলাম, “এখন পরীক্ষার জন্য আমাদের পুরানো পড়া রিভাইজ্ হচ্ছে, বই নিয়ে কি হবে!” গাড়ীতে উঠিয়া নন্দ-দা তাহার রিষ্ট ওয়াচের দিকে চাহিয়া বলিল, “ওঃ—মানু আমার বড্ড দেরী হয়ে গেছে।” আমি বলিলাম “তাহলে নন্দদা, তুমি আগে নেমে যাও, আমার একটু পরে গেলেও ক্ষতি নাই!” এমনি করিয়াই অপ্রত্যাশিত সুযোগ আসিয়া জোটে। আমি ভাবিতেছিলাম নন্দদাকে কি বলিয়া আগে নামাইবার ব্যবস্থা করি। সাধুর সৎকার্য্যের বুদ্ধি যিনি প্রেরণ করেন, চোরের মাথায় ফিকির ফন্দিও তিনিই যোগান।

 নন্দ-দাকে তাহার স্কুলে নামাইয়া দিয়া আমি একেবারে সোজাসুজি রমেশদার বাসায় উপস্থিত। দেখিলাম সেখানে মুকুল-দাও রয়েছেন। রমেশ-দা একটা সুটকেশ লইয়া আমার সহিত অন্য এক ট্যাক্সিতে উঠিলেন। মুকুল-দার নিকট এইখানেই বিদায় নিলাম। তাড়াতাড়িতে কমলাকে কিছুই জানান হয় নাই। মুকুল-দাকে বলিলাম, তিনি যেন কমলাকে সকল বিষয় খুলিয়া বলেন। ট্যাক্সী হাওড়া স্টেশনের দিকে অগ্রসর হইল। পশ্চাতে চাহিয়া দেখিলাম, মুকুল-দা রুমালে চক্ষুর জল মুছিতেছেন।

 বাড়ী হইতে বাহির হইবার পূর্ব্বে একবার মনে হইয়াছিল, যাইবার সময় মায়ের ছবিখানিকে প্রণাম করিয়া যাইব। কিন্তু মানসিক উদ্বেগে সে কথা ভুলিয়া গেলাম। ভালই হইয়াছে বলিতে হইবে, কারণ মায়ের ছবির প্রতি দৃষ্টি পড়িলে বোধ হয়, এতবড় জঘন্য দুঃসাহসের কার্য্য করিতে পারিতাম না।

 আমরা একটা লোকাল ট্রেণে বর্দ্ধমান যাইয়া কিছুক্ষণ থামিলাম। তার পর সন্ধ্যায় লাহোর এক্সপ্রেসে একেবারে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করিলাম।