দ্বিতীয়

কৈশোরে

 ক্রমশঃ উৎসবের কোলাহল থামিল। দিন দিন আমিও প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করিতে লাগিলাম। পিসিমার থাকিবার আর প্রয়োজন রহিল না। নব বধূকে সংসার ধর্ম্ম বুঝাইয়া দিয়া তিনি ছয় সাত মাস পরে চলিয়া গেলেন। আমি তখন হইতে পিসিমার ঘরে একাকিনী শয়ন করিতাম।

 বিমাতা বয়সে আমার অপেক্ষা এক বৎসরের বড় ছিলেন। আমার দেহের গঠন পরিপুষ্ট এবং বলিষ্ঠ হওয়ায় আমাকেই বড় দেখাইত। তিনি সুন্দরী ছিলেন―গৃহকার্য্য ও লেখাপড়া সামান্যরূপ জানিতেন। তাঁহার সহিত আমার বনিবনাও না হইবার কোন কারণ ছিল না, কারণ আমি অধিকাংশ সময় আমার পড়াশুনা লইয়াই ব্যস্ত থাকিতাম।

 বাবা অন্তঃপুরে আসিলে, বিমাতা প্রায়ই কোন কার্য্য ছলে তাঁহার কাছে থাকিতেন। বিশেষ কোন প্রয়োজন ব্যতীত পিতার সহিত এখন আমার সাক্ষাৎ হইত না। পূর্ব্বে তিনি আমাকে স্কুলের পড়ার কথা জিজ্ঞাসা করিতেন―কাছে বসিয়া আমার গান শুনিতেন, এখন আর তাহা নাই। বাবা যেদিন বিমাতাকে লইয়া থিয়েটারে যাইতেন, আমাকে নিতেন না, সে-দিন নন্দদাদার সঙ্গে আমি বায়স্কোপে যাইতাম।

 কি কারণে জানি না, আমার পুরাতন গৃহ-শিক্ষককে ছাড়াইয়া দেওয়া হইল। বাবা আমাকে বলিলেন “তুমি এখন উপরের ক্লাসে পড়্‌ছ, পুরাণো মাষ্টারের বিদ্যা ত বেশী নয়; আজ কালকার স্কুল কলেজের শিক্ষাপ্রণালীর সহিত পরিচিত লোক না হলে চলেনা।” কয়েকদিন পরে আমার জন্য নূতন মাষ্টার আসিলেন। ইহার একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক।

 প্রথম যেদিন তিনি পড়াইতে আসিলেন, সেইদিনই তাঁহার আকৃতি প্রকৃতি ও পরিচ্ছদে আমি একটু আকৃষ্ট হইলাম। তাঁহার লম্বা লম্বা চুল কপাল হইতে উল্টা দিকে আঁচড়ান এবং ঘাড়ের কাছে ঝাঁক্‌ড়া ঝাঁক্‌ড়া বাবড়ী পাকান―তাঁহার বয়স আন্দাজ বাইশ তেইশ―দাড়ী গোঁপ উঠে নাই―না পরিস্কার কামানো তাহা বুঝিতে পারিলাম না। কাপড় ঢিলা মালকোঁচা দিয়া পরিয়াছেন, মনে হয় যেন কাবুলীদের পা-জামা। গায়ে একটা পরিষ্কার ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী জামা―তখনও খদ্দরের চলন হয় নাই। তাঁহার সূক্ষ্মাগ্র উন্নত নাসিকা―চোখ দুটী সুন্দর―কিন্তু একজোড়া সোণার ফ্রেমে বাঁধান চশমা সেই সৌন্দর্য্যকে অন্য রূপ দিয়াছে। পায়ে নকল জরীর কাজ করা নাগরা জুতা। তাঁহার বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম―দেহ অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ। তাঁহার কথায় যেন বাঁশী বাজে। তিনি সম্প্রতি বি, এ পাশ করিয়া কোন স্কুলে শিক্ষকের কার্য্য করিতেছেন। মাষ্টার মহাশয় অবিবাহিত।

 তাঁহার নিকট আমার পড়াশুনা ভালই হইতে লাগিল। তিনি গণিত শাস্ত্র বিশেষ জানিতেন না―তবে সাহিত্য, ইতিহাস বিশেষতঃ কাব্য তিনি অতি চমৎকার পড়াইতেন। সকালে বিকালে দুইবেলাই তিনি আসিতেন। আমি চতুর্থ শ্রেণী হইতে প্রমোশন পাইয়া তৃতীয় শ্রেণীতে উঠিলাম।

 নন্দদাদা আমার দুই ক্লাশ উপরে পড়িত। এবার তার এণ্ট্রান্স্‌ ক্লাসে উঠিবার কথা। কিন্তু লেখাপড়ায় বিশেষ মনোযোগ না থাকায় সে বার্ষিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হইল। সুতরাং দ্বিতীয় শ্রেণীতেই রহিয়া গেল। নন্দ দাদা ও আমি একই মাষ্টার মহাশয়ের নিকট পড়িতাম।

 দুই চারি দিনের পরিচয়ের পর একদিন মাষ্টার মহাশয় আমাকে বলিলেন “মানু, তুমি আমাকে ‘মাষ্টার মশাই’ বলোনা― এ ডাকটা আমি ভারী অপছন্দ করি। আমাকে আমার নাম ধরে, ডাক্‌তে পার।” আমি কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হইয়া বলিলাম―আপনি যেমন ‘মশাই' কথাটা পছন্দ করেন না―আমিও তেমনি নামের শেষে ‘বাবু’ যোগ করা ভালবাসিনা। দেখেন নি―আজকাল ‘বাবু’ উঠে গিয়ে ‘শ্রীযুতের, প্রচলন হয়েছে?”

 মাষ্টার মহাশয় হাসিয়া বলিলেন, “তা বেশ, তুমি আমাকে ‘মুকুল দাদা’ বলে ডাক্‌তে পার। তুমি ত জান আমার নাম মুকুল বন্দ্যোপাধ্যায়।” এইরূপে মাষ্টার মহাশয়ের সহিত আমার ঘনিষ্ঠতা জন্মিতে লাগিল। আমি সেইদিন হইতে তাঁহাকে দাদা বলিয়া সম্বোধন করি।

 একদিন বাবা আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “খুকু, তোমার মাষ্টার মহাশয়ের সকালে বিকালে চা খাওয়ার অভ্যাস আছে। ওঁর চায়ের ব্যবস্থাটা এখানেই করে’ দিও। তাহ’লে তিনি আরও একটু আগে আসতে পারেন।”

 আমাদের বাড়ীতে দু’বেলাই চা তৈরী হইত। পূর্ব্বে বাবার সঙ্গে বসিয়া চা খাওয়া আমার নিয়ম ছিল। আজকাল বাবার চায়ের পেয়ালা বিমাতা হাতে করিয়া নিতেন। বাবাও আমাকে কখন ডাকেন নাই; আমিও আর সেদিকে যাইতাম না। আমি মাষ্টার মহাশয় আসিবার পূর্ব্বেই আমার পড়িবার ঘরে একলা বসিয়া চা খাওয়া শেষ করিতাম।

 এখন মাষ্টার মহাশয় আমার চা পানের সঙ্গী হইলেন। সেই সময় আমাদের মধ্যে সামাজিক ও রাজনীতিক নানা কথাবার্ত্তা হইত। তখন দেশ-নেতাদের মহলে ‘আত্মশক্তির’ কথা উঠিয়াছে। মাষ্টার মহাশয় বলিলেন “মানু, আমাদের দেশের শাস্ত্রকারেরা সুখ দুঃখের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন ‘সর্ব্বং আত্মবশং সুখং সর্ব্বং পরবশং দুঃখং।’ অন্নবস্ত্র ত দূরের কথা, সামান্য বিষয়ের জন্যও আমাদিগকে পরের উপর নির্ভর করতে হয়। এই দেখনা কেন, চাকর চা তৈয়ারী করিয়া না দিলে আমাদের চা খাওয়া হয়না; অথচ ইহা দুই মিনিটের কাজ। আমাদের সমাজে ও পরিবারে বিলাসিতা এত বেড়ে উঠেছে।”

 বাবাকে বলিয়া আমি একটী ছোট ইলেক্‌ট্রীক হিটার কিনিলাম। আমার পড়িবার ঘরে বিজ্‌লী বাতির প্লাগ্ ছিল। তাহার সাহায্যে আমি সহজে জল গরম করিবার ব্যবস্থা করিলাম। পরদিন মাষ্টার মহাশয় আসিলে যখন স্বহস্তে চা তৈয়ারী করিয়া তাঁহার সম্মুখে পেয়ালা ও প্লেট ধরিলাম, তখন তিনি আনন্দে হাত বাড়াইয়া বলিলেন “বাঃ, উপযুক্ত ক্ষেত্রে পড়্‌লে উপদেশের বীজ এমনি ফলপ্রদ বৃক্ষে পরিণত হয়।” আমি তখন লক্ষ্য করি নাই, আমার ঐ সোনার চুড়ী-পরা হাতখানির ছায়া পেয়ালার মধ্যস্থিত তপ্ত তরল পদার্থে পড়িবার পূর্ব্বে মাষ্টার মহাশয়ের হৃদয়ে অঙ্কিত হইয়াছিল।

 পূজার সময় হাইকোর্টের দীর্ঘ অবকাশ। বাবা বিমাতাকে লইয়া পশ্চিমে বেড়াইতে গেলেন। তাঁহাদের সঙ্গে দুইজন ভৃত্য ব্যতীত আর কেহ ছিলনা। আমার যাইবার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মুখ ফুটিয়া বাবাকে কিছু বলিতে পারি নাই। কারণ, আমাকে সঙ্গে নেওয়া যে তাঁহার অভিপ্রায় নয়, তাহা আমি পূর্ব্বেই বুঝিয়াছিলাম। আমার হৃদয়ে দারুণ আঘাত পাইলাম। বিদেশে যাইয়া পিতা অথবা বিমাতা কেহই আমার নিকট চিঠিপত্র লেখেন নাই। পিসিমা আসিয়া বাড়ীতে ছিলেন। তিনি মধ্যে মধ্যে দুই একখানি চিঠি পাইতেন―আর টাকা পাঠাইবার জন্য সরকার মহাশয়ের নিকট চিঠি আসিত।

 একদিন নন্দ দাদা আমাকে বলিল “মানী, আজ মিনার্ভা থিয়েটারে যাবে?―চল―শিরীফরহাদ্ প্লে―খুব সুন্দর অপেরা। একেবারে অফুরন্ত নাচগান। সে একখানি বিজ্ঞাপন দেখাইল। পিসিমার কাছে অনুমতি চাহিলে তিনি বলিলেন “তোরা দু’জনই ছেলে মানুষ, মাষ্টার মশাইকে সঙ্গে নিয়ে গেলে ভাল হয়।” বলা বাহুল্য, মাষ্টার মহাশয় আপত্তি করিলেন না।

 আমরা তিনজনে একটা বক্স্‌ রিজার্ভ করিয়া বসিয়াছিলাম। অভিনয় দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইলাম। বিশেষতঃ নৃত্যগীত আমাকে অতিশয় প্রীত করিয়াছিল। মাষ্টার মহাশয় প্রতিদৃশ্যের ঘটনাবলী ও চরিত্র সমূহ বিশ্লেষণ করিয়া আমাকে বুঝাইয়া দিলেন। ফর্‌হাদের অপূর্ব্ব প্রেম ও শিরীর আত্মবিসর্জ্জন “আমার হৃদয়কে উল্লসিত করিয়া তুলিল। আমি অনুভব করিলাম, আমার বুকের মধ্যে যেন কোন সুষুপ্ত পশুর ঘুম ভাঙ্গিতেছে।

 মাষ্টার মহাশয় প্রায়ই আমাদের সঙ্গে থিয়েটারে ও সিনেমায় যাইতেন। তিনি না গেলে আমার আমোদ উপভোগ সম্পূর্ণ হইত না। কারণ তিনি সমস্ত বিষয়টী পরিষ্কার রূপে বুঝাইয়া দিতেন। যে দিন বিল্বমঙ্গল, শঙ্করাচার্য কিম্বা ধর্ম্মমূলক অভিনয় হইত, সে দিন পিসিমাও আমাদের সঙ্গে যাইতেন। ভক্তি ও ধর্ম্মভাবের নাটকগুলি তাঁহার বড় প্রিয় ছিল।

 আমার পিতা তখনও বিদেশে। আমি জ্বরে শয্যাগত। পিসিমা চিন্তাকুল। মাষ্টার মহাশয় দিবারাত্রি আমার শয্যাপার্শ্বে থাকিয়া আমার সেবা শুশ্রূষা করিতেছেন। ডাক্তার ডাকা, ঔষধ আনা, পথ্য তৈয়ারী, আমার কাছে বসা, প্রায় সমস্ত কাজ মাষ্টার মহাশয় করিতেন। তাঁহার স্কুল কামাই হইতে লাগিল। বেদনায় অস্থির হইলে তিনি আমার গা টিপিয়া দিতেন—মাথায় হাত বুলাইয়া আমাকে ঘুম পাড়াইতেন; আঙ্গুর, বেদানা, নাসপাতি একটু একটু করিয়া আমার মুখে পুরিয়া দিতেন। পিসিমা ইহাতে একটু আশ্বস্ত হইতেন।

 যন্ত্রণায় কাতর হইয়া আমি যখন মা—মা বলিয়া কাঁদিতাম, তখন আমি লক্ষ্য করিয়াছি, মাষ্টার মহাশয় আমার সমবেদনায় চক্ষুর জল ফেলিয়াছেন। তিনি জানিতেন আমি মাতৃহীনা―পিতার অনাদৃতা কন্যা। একমাস পরে একটু সুস্থ হইয়া আমি ক্ষীণকণ্ঠে বলিলাম “মুকুলদা, আপনিই আমাকে এবার বাঁচিয়েছেন।” মাষ্টার মহাশয় বলিলেন “মানু, ভগবান তোমায় রক্ষা করেছেন।” আমি তাঁহার হাতখানি ধরিয়া আবেগে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলিলাম―মুকুল-দা আপনার স্নেহের ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।”

 সেই হইতে অন্যের অসাক্ষাতে মাষ্টার মহাশয়কে ‘তুমি’ সম্বোধন আরম্ভ। আমাদের হৃদয় যেন পরস্পর অধিকতর নিকটবর্ত্তী হইল। একদিন তিনি একখানি সুন্দর বাঁধান ক্ষুদ্র কবিতা পুস্তক আমার হাতে দিয়া বলিলেন “মানু, আমার ‘ঝরণা’ ছাপা হয়েছে। তোমার সেবা করবার যে সুযোগ পেয়েছি, তাহাকে চিরস্মরণীয় করবার জন্য আমার এই প্রথম গীতিকাব্য তোমারই নামে উৎসর্গ করেছি।” আমি ঈষৎ লজ্জিতভাবে পুস্তকখানি লইয়া বলিলাম “মুকুলদা তুমি তোমার কবিতা ছাপাতে দিয়েছ, এ কথাত আমাকে কখনো বলনি! মাষ্টার মহাশয় হাসিয়া বলিলেন “ঐটী অপরাধ হয়েছে।”

 আমাকে ইংরাজী সাহিত্য পড়াইবার সময় মাষ্টার মহাশয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতা সমূহ বাংলা পদ্যে অনুবাদ করিয়া দিতেন। তিনি যে কবি ও ভাবুক তাহার পরিচয় পূর্ব্বে পাইয়াছিলাম। ‘ঝরণার’ অনেক কবিতা আমার সম্মুখেই লেখা হইয়াছিল। আজ পুস্তক আকারে গ্রথিত হওয়াতে উহার মধ্যে যেন নূতন ভাব দেখিতে পাইলাম।

 দিল্লী, আগরা, মথুরা, বৃন্দাবন, বোম্বাই, লাহোর, প্রয়াগ, কাশী, গয়া প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করিয়া বাবা পাঁচ মাস পরে কলিকাতায় ফিরিলেন। হাইকোর্ট খুলিবার পরেও দুইমাস তাঁহার কামাই হইল। ওকালতী ব্যবসা করিবার আর তেমন ইচ্ছা তাঁহার ছিলনা। এখন তিনি নিজের বিষয়―কর্ম্ম দেখিতে অধিক মন দিলেন।

 আমার এক দূর সম্পর্কীয় জ্ঞাতি ভ্রাতা চাকুরীর চেষ্টায় এক দিন আমাদের বাড়ীতে পিতার নিকট আসেন। তাঁহাকে আমি পূর্ব্বে কখনও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। তিনি কিন্তু আমার সঙ্গে নিতান্ত পরিচিতের মত জিজ্ঞাসা করিলেন “কিরে মানু কেমন আছিস্‌―কোন্ ক্লাসে পড়িস্? কে তোকে বাড়ীতে পড়াচ্ছে,” আমি বলিলাম―“এখন বেথুনে সেকেণ্ড ক্লাসে পড়্‌ছি। মুকুল বাবু আমার প্রাইভেট টিউটার।”

 তিনি আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন “ও―আমাদের ‘ঝরণার’ কবি মুকুল বাড়ুয্যে?―সে যে আমার ক্লাসফ্রেণ্ড্‌, একসঙ্গে স্কটীস্‌চার্চ্চ কলেজে পড়েছি।” সন্ধ্যা বেলায় মাষ্টার মহাশয় আসিলেন, তাঁহাকে দেখিয়া তিনি বলিলেন “কি ভাই মুকুল, শুন্‌লুম তুমি মানুকে পড়াচ্ছ―বেশ। তারপর―কাব্য চর্চ্চা ছাড়া আর কি কাজ কর্ম্ম হচ্ছে?”

 মাষ্টার মহাশয় তাঁহার সঙ্গে অনেকক্ষণ নানা কথা বার্ত্তা কহিলেন। আমাকে বলিলেন “রমেশ বাবু যে তোমাদের আত্মীয় এ-কথাত মানু তুমি কখনও আমায় বলনি।” আমি বলিলাম, “আমিত জানিতাম না। বাবা সেদিন এঁর পরিচয় দিলেন।” রমেশ দাদা বলিলেন “আমি প্রায় দশবৎসর পূর্ব্বে একবার এ-বাড়ীতে এসেছিলাম। তখন মানদার বয়স ৩।৪ বৎসর হবে। তখন আমি সবে মাত্র এণ্ট্রান্স দিয়েছি; স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হ’ল, পড়াশুনা ছেড়ে কয়েক বৎসর খুব হৈ চৈ করা গেল। তারপর আবার কলেজে ভর্তি হলুম। গত বৎসর এম্ এ পাশ করে এতদিন বসে আছি।”

 আমার পিতার চেষ্টায় রমেশ দাদার একটা ভাল চাকুরী হইল―কোন লিমিটেড কোম্পানীর অফিসের বড় বাবু, বেতন মাসিক দুইশত টাকা। তিনি প্রথম প্রায় একমাস আমাদের বাড়ীতেই রহিলেন। পরে কোন বোর্ডিংএ একটা ভাল কামরা ভাড়া করিয়া থাকিলেন। বাবার নিকট বলিলেন “হাতে কিছু টাকা জমাইয়া বাড়ী ভাড়া করিব―তখন মা, স্ত্রী ও ছোট ভাই বোনদের এখানে লইয়া আসিব।” সেই বৎসরই রমেশ দাদার বিবাহ হইয়াছিল।

 পিসিমা চলিয়া গিয়াছেন। আমার মায়ের মৃত্যুর পর হইতে বামুন ঠাকুরই রান্না করিত। দুইটী ঝি ও তিনটী চাকর আমাদের রাড়ীতে ছিল। দেহ-সুখের নিত্য প্রয়োজনীয় কোন জিনিসের অভাব আমার হয় নাই। সুস্বাদু খাদ্য পানীয়―বিচিত্র বসন-ভূষণ প্রচুর পরিমাণে আসিয়াছে। আমার পড়িবার ঘর ও শয়ন গৃহের সজ্জা অতুলনীয়, আরামের ব্যবস্থা একেবারে নিখুঁত। তথাপি আমার প্রাণের ক্ষুধা মিটিত না। পিতার অনাদর, অবজ্ঞা এই ক্ষুধাকে নিত্য সতেজ রাখিত। রাস্তা দিয়া যাইবার সময় যখন দেখিতাম কুলী-মজুরেরা তাহাদের ছেলেমেয়েকে কোলে লইয়া আদর করিতেছে, তখন আমি আমার সকল ঐশ্বর্য্যকে মনে মনে ধিক্কার দিতাম। আমি বুঝিয়াছিলাম, দৈহিক অভাব মোচনই আদর নহে―অন্নবস্ত্র প্রদানই আদর নহে―আদর প্রাণের জিনিস―প্রাণকেই উহা স্পর্শ করে―ভাবেই উহার প্রকাশ।

 আমার ত্রয়োদশ জন্মতিথির পূর্ব্ব দিন বাবা আমাকে ডাকিয়া বলিলেন “খুকু, তোমার মাষ্টার মহাশয় ও রমেশদাকে নিমন্ত্রণ করো।” জন্মদিনের উৎসব করিতে আমার আর ভাল লাগিত না। তথাপি কোন প্রকারে দিনটা চলিয়া গেল। বিমাতা আমাকে একছড়া সোণার হার উপহার দিলেন। রমেশ দাদার নিকট হইতে একটা রূপার সুদৃশ্য পাউডার কৌটা উপহার আসিল। মাষ্টার মহাশয় বোধ হয় দিয়াছিলেন একখানা রবীন্দ্রনাথের কাব্য।

 আমি ছোটগল্প ও কবিতা লিখিতে শিখিয়াছিলাম। রমেশ দাদা তাহা পড়িয়া খুব প্রশংসা করিলেন। তিনি বলিলেন “মুকুলকে দিয়ে মাসিক কাগজে এগুলো ছাপিয়ে দাও।―এ ত বেশ সুন্দর হয়েছে। আজকাল মেয়েদের কি রাবিস্ লেখা বের হয়!”

 আজকাল রমেশ দাদাও আমাদের সঙ্গে থিয়েটারে যাইতেন। নন্দদাদা এখন ফুটবল ও ক্রিকেট খেলায় মাতিয়াছিল, সে আর বড় একটা যাইত না। বিশেষতঃ সে বেচারা নাটকের সাহিত্যের দিকটা কিছুই বুঝিত না এবং অভিনয়ের মধ্যে যে আর্ট আছে, তাহাও তার উপলব্ধি হইত না। ষ্টেজের উপরে যুদ্ধ-বিগ্রহ, নাচ-গান—সাজপোষাক এসব জমকালো রকমের হইলেই সে খুসী হইত।

 তখন থিয়েটারে একটা পরিবর্তন আসিতেছিল। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভদ্র যুবকেরা থিয়েটারে যোগ দিয়া তাহার মধ্যে শিল্প-কলার বিকাশ করিতে অগ্রসর হইলেন। রমেশ-দা ও মুমুল-দা এই অভিনব আর্টিষ্টদের মর্য্যাদা বুঝিতেন এবং তাহাদের খুব প্রশংসা করিতেন। রমেশদার নিকট অনেক অভিনেতা, অভিনেত্রীদের নাম ও পরিচয় আমি জানিলাম। এমন কি তাহাদের ভিতরের জীবন কাহিনীও তিনি আমাকে কিছু কিছু শুনাইলেন―যাহা মুকুলদারও অজ্ঞাত ছিল।

 দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করিবার দুই বৎসর পরে আমার পিতার একটী পুত্র সন্তান হয়। ইতিমধ্যে তিনি ওকালতী ব্যবসায় সম্পূর্ণরূণে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। এই বৈমাত্রেয় ভাইটীকে আমি অতিশয় স্নেহ করিতাম; কিন্তু তাহার জন্য পৃথক আয়া ও দাসী নিযুক্ত হওয়ায় আমি তাহাকে সর্ব্বদা কোলে নিতে পারিতাম না। সন্তান প্রসবের পর বিমাতার শরীর অসুস্থ হইয়া পড়িল। বাবা তাঁহাকে লইয়া বিব্রত হইলেন। বড় বড় ডাক্তার-কবিরাজ নিত্য আসিতে লাগিল। আট নয় মাস পরে বিমাতা একটু সুস্থ হইলেন বটে, কিন্তু শরীরের দুর্ব্বলতা দূর হইল না।

 আমার পিতার কোন কোন বন্ধু এবং আমার পিসিমা অনেকবার বাবার নিকট আমার বিবাহের কথা উত্থাপন করিয়াছিলেন, আমার কাণে তাহা আসিয়াছে। বাবা বলিলেন “এত অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিব না। ম্যাট্রিক্ পাশ করুক। তার পর দেখা যাবে।” পিসিমা ও পিতার বন্ধুগণ ইহার উত্তরে যাহা বলিয়াছিলেন, সে সমস্ত এখানে উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। আজকাল খবরের কাগজে এ বিষয়ে নানা বাদ প্রতিবাদ ও তর্কবিতর্ক আপনারা পাঠ করিয়া থাকেন।

 আমার যৌবনোদ্ভব হইয়াছিল। অভিভাবকের অসাবধানতায় ও অনুকূল পবনে যথাসময়ে আমার হৃদয়ের মধ্যে প্রবৃত্তির অনল জ্বলিয়া উঠিল―তাহা আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম। বিবাহের জন্য মনে মনে আমার আকাঙ্ক্ষাও হইত।