শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত/দেহ বিক্রয়

ষষ্ঠ
দেহ বিক্রয়

 যে সকল স্ত্রীলোক পাপ পথ ছাড়িয়া সদ্ভাবে জীবন যাপন করিতে ইচ্ছুক, তাহারা এই উদ্ধার আশ্রমে স্থান পাইত। কোন প্রকার শিল্প কার্য্যাদির দ্বারা জীবিকা অর্জ্জনের উপায় তাহারা অবলম্বন করিত। আবার এমন স্ত্রীলোকও সেখানে ছিল যাহারা নিতান্ত দায়ে পড়িয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছে। উহারা আমার মত এইরূপ ঘটনা চক্রে জড়িত— সমাজ অথবা পরিবারে তাহারা যাইতে পারে না। তাহাদের জীবনের গতি অস্থির। উদ্ধার আশ্রমে খাওয়া-পরা পাইয়াই যে তাহারা সুখী, আমার তাহা বোধ হইল না। ইহাদের সকলেই কিশোরী বা যুবতী। আমি যখন সেখানে গিয়াছিলাম, তখন প্রায় ১৩/১৪ জন স্ত্রীলোক ছিল, তন্মধ্যে জন পাঁচেক প্রৌঢ়া বিধবা ব্যতীত আর সকলেই এই শ্রেণীর।

 আমি ক্রমশঃ বুঝিতে পারিয়াছিলাম, যে সকল স্ত্রীলোক স্বেচ্ছায় অথবা কু-লোকের প্ররোচনায় ঘরের বাহির হইয়া আসে— অন্নবস্ত্রের অভাবই তাহাদের প্রধান বিপদ নহে। ‘কি খাইব’— এই চিন্তা অপেক্ষা ‘কি রূপে থাকিব’ এই ভাবনাই তাহাদের বেশী করিতে হয়। কলিকাতা সহরে স্ত্রীলোকেরা নানাপ্রকার ব্যবসায় ও চাকুরীতে নিযুক্ত হইতে পারে। তাহাতে গ্রাসাচ্ছাদনের উপযুক্ত অর্থ উপার্জ্জন করা যায়। কিন্তু আমি দেখিয়াছি ঐ সকল ব্যবসায় ও চাকুরী যে সকল স্ত্রীলোক অবলম্বন করিয়াছে তাহাদের মধ্যেও অনেকে প্রায় পতিতা নারীর পথে চলিতেছে। ইহার কারণ, তাহারা কখনও বিবাহিত জীবনের সংযমের মধ্য দিয়া ক্লাসে নাই। পানওয়ালী, মেস্ বোর্ডিং হোটেলের বা গৃহস্থ বাড়ীর ঝি চাকরাণী, বাজারের মাছ তরকারী ফল মূল প্রভৃতি বিক্রয়কারিণী, রাঁধুনি, কারখানার মজুরাণী, মশলা ঝাড়াই বাছাইওয়ালী, থিয়েটারের অভিনেত্রী, কীর্ত্তনওয়ালী, শুশ্রূষাকারিণী, সঙ্গীত-শিক্ষয়িত্রী, প্রসবকারিণী দাই, মেয়ে ডাক্তার, রেলের টিকিট আফিসে ও টেলিফোনের মেয়ে কেরাণী——ইহারা সকলেই স্বীয় জীবিকা নির্ব্বাহের উপযুক্ত অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারে এবং ইচ্ছা করিলে পবিত্র জীবন যাপন করিতে পারে; কিন্তু তাহা সকল সময়ে হয় না। বহুদিনের অভিজ্ঞতায় আমি একথা বলিতেছি।

 উদ্ধার আশ্রমের কর্ত্তীপক্ষদের নিকট আমি পিতার পরিচয় ও বাড়ীর ঠিকানা সমস্তই গোপন করিয়াছিলাম। তাঁহারা শুধু এইমাত্র জানিলেন, আমি উচ্চ বংশীয় ব্রাহ্মণের মেয়ে। কুমারী অবস্থায় কোন দুষ্ট লোক আমাকে ঘরের বাহির করিয়া নিয়াছিল। সে গর্ভাবস্থায় আমাকে ছাড়িয়া পলাইয়াছে। রমেশদার নামও আমি প্রকাশ করিলাম না। আমি লেখাপড়া কিছু জানি, ইহা প্রকাশ হইল।

 বৃন্দাবন হইতে কলিকাতা আসিতে আমার খুব আগ্রহ জন্মিয়াছিল। তাহার কারণ, আমি আশা করিয়াছিলাম, আর যাহাই হউক অন্ততঃ মুকুলদা ও কমলাকে দেখিতে পাইব। অকুল সমুদ্রে এই দুইটী বন্ধু আমার তৃণ-স্বরূপ। কিন্তু উদ্ধার আশ্রমে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, তাহাদের খবর পাওয়া সহজ ব্যাপার নহে।

 শীঘ্রই কয়েকটা সমবয়সী মেয়ের সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা জন্মিল। ইহাদের মধ্যে রাজবালা ও কালীদাসী এই দুইজন ছিল প্রধান। ইহাদের কথা এই পুস্তকের স্থানে স্থানে আরও কয়েক বার উল্লেখ করা হইবে। সুতরাং ইহাদের একটু পরিচয় দিতেছি। রাজবালা সোণার-বেণের মেয়ে। বাপের বাড়ী কলিকাতায়, অল্পবয়সে তাহার বিবাহ হইয়াছিল। পিতা ও শ্বশুর উভয় পরিবারই সঙ্গতিপন্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিবাহের এ বৎসর পরেই হতভাগিনী বিধবা হয়। তৎপরে পিতার প্রতিবেশী এক পূর্ব্ববঙ্গবাসী কায়স্থ যুবকের সহিত তাহার গুপ্ত প্রণয় জন্মে বাজবালার এক জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃবধূ এই ব্যাপারে তাহাকে গোপনে সাহায্য করিত। যুবকটী স্বদেশী আন্দোলনের সময় খুব “বন্দে মাতরম্” করিয়া বেড়াইত। তিন বৎসর ধরিয়া এই গুপ্ত প্রেমলীলা চলিতে থাকে। অবশেষে রাজবালার সন্তান-সম্ভাবনা হওয়ায় প্রেমিক যুবক পলায়ন করে। রাজবালা ঝিয়ের সহিত গঙ্গাস্নানের অছিলায় বাড়ীর বাহির হইয়া আসে। আর সে ফিরিয়া যায় নাই। তারপর নানা দুঃখ দুর্দ্দশার আবর্ত্তে ঘুরপাক খাইতে খাইতে এই উদ্ধার আশ্রমে উপস্থিত হইয়াছে।

 কালীদাসী সধবা, কামারের মেয়ে। সে রূপসী ছিল। বর্দ্ধমান জেলার কোন পল্লীগ্রামে তাহার শ্বশুর ঘর। স্বামীর নিকট হইতে দুর্ব্বৃত্তেরা তাহাকে বলপূর্বক অপহরণ করে। তাহারা এক বৎসর ধরিয়া তাহাকে নানাস্থানে ঘুরাইয়া বেড়ায়। ইহা লইয়া মামলা মোকদ্দমা হইয়াছিল। কিন্তু মোকদ্দমার পরে কালাদাসীর স্বামী তাহাকে গ্রহণ করিল না। তাহার এক আত্মীয়ের পরামর্শে সে পতিতাবৃত্তি অবলম্বন করিতে যাইতেছিল। বর্দ্ধমান সহরের কোন উকীল জানিতে পারিয়া তাহাকে এইখানে পাঠাইয়া দেন।

 ক্রমশঃ বুঝিতে পারিলাম, উদ্ধার আশ্রমটী আমাদের পক্ষে নিরাপদ স্থান নহে। অন্নবন্ত্রের কোন ক্লেশ নাই। আমাদের মধ্যে যাহারা রূপযৌবন সম্পন্না, তাহাদের প্রতি কর্ত্তৃপক্ষের মধ্যে কাহারও কাহারও একটু বিশেষ দৃষ্টি। আমার উপর তাঁহাদের শীঘ্রই অনুগ্রহ পড়িল। আমাকে কাজ কর্ম্ম করিতে হইত না। আমার থাকিবার ঘর বিবিধ আসবাব পত্রে সজ্জিত হইল। আমি অতিশয় প্রীত হইলাম। আমার ভাল কাপড় চোপড়, দামী জামা সেমিজ, পরিপাটী বিছানা। অন্যান্য মেয়েরা কেহ কেহ আমাকে এজন্য ঈর্ষা করিত। রাজবালা ও কালীদাসী আমাকে দেখিলেই মুচকি হাসিয়া বলিত, “এবার তোর ভাই কপাল ফিরেছে।”

 কর্ত্তৃপক্ষদের মধ্যে একজন আমার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হইলেন। আমিও ধরা দিলাম। তিনি আমার ঘরে মাঝে মাঝে রাত্রি যাপন করিতেন। জানিলাম, আমার মেয়ে-বন্ধুদের গৃহেও কর্ত্তৃপক্ষদের অপর কেহ কেহ গোপনে যাতায়াত করিয়া থাকেন। এইরূপে কিছুদিন অতীত হইল।

 একদিন আমি আমার গুপ্ত প্রণয়ীর নিকট বিবাহের প্রস্তাব করিলাম। কিন্তু তিনি সম্মত হইলেন না। আমার সমবয়সী মেয়েরা মিলিয়া মাঝে মাঝে আমাদের গুপ্ত প্রণয়ের কথা তুলিয়া হাস্য পরিহাস করিত। রাজবালা ও কালীদাসীর সহিত প্রাণের কথা হইত। আমার পরামর্শে উহারা দু’জনেও বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছিল। কিন্তু কোন ফল হইল না। আমি বলিলাম “ভাই, যদি রূপ, যৌবন বেচতে হয়, তবে লুকিয়ে চোরের মত কেন— একেবারে বাজারে নেমে দর যাচাই করে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রয় করব।” রাজবালা ও কালীদাসী সেইদিন হইতে তাহাদের প্রণয়ীদিগকে আর ঘরে প্রবেশ করিতে দিল না। আমিও তাহাই করিলাম। আমাদের উপর নানা উৎপীড়ন ও অত্যাচার আরম্ভ হইল। আমরা স্থির করিলাম, উদ্ধার আশ্রমে আর থাকিব না, কিন্তু আমরা নিরাশ্রয়-নিঃসহায়, কোথায় যাই।

 তখন ইউরোপে মহাযুদ্ধ ভীষণভাবে চলিতেছে। ভারতবর্ষ হইতে বহু সংখ্যক শুশ্রূষাকারিণী নারী আহত সৈন্যদের সবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়াছে। সেই জন্য কলিকাতা বোম্বাই প্রভৃতি বড় বড় সহরের হাসপাতাল গুলিতে নার্সের কাজ করিবার লোকের অভাব ঘটিয়াছে। আমাদের আশ্রমে সংবাদ পত্র আসিত। আমি বাংলা খবরের কাগজ হইতে পড়িয়া অন্যান্য মেয়েদের শুনাইতাম।

 রাজবালার মাথায় কি এক মতলব আসিল। সে একদিন আমাকে বলিল “আয় ভাই, আমরা নার্সের কাজ শিখি।” আমি বলিলাম “আশ্রমের কর্ত্তৃপক্ষ সে ব্যবস্থা না করিলে ত হয় না।” শ্রীযুত—দাস মহাশয় একদিন আশ্রম পরিদর্শন করিতে আসিলে রাজবালা তাঁহাকে এই সকল বিষয়ে কথা বলিল। তিনি শুনিয়া সন্তুষ্ট হইলেন এবং আমাদিগকে প্রাথমিক কিছু শিক্ষা দিবার নিমিত্ত একজন ডাক্তার নিযুক্ত করিলেন। কালীদাসী লেখাপড়া জানিত না। তাহাকে শিখাইয়া লইবার ভার আমার উপর পড়িল। তিন মাসের মধ্যেই সে খুব উন্নতি দেখাইল। মাঝে মাঝে আমাদিগকে হাসপাতালে লইয়া যাওয়া হইত। সেখানে আমরা ডাক্তারী নানাবিধ যন্ত্র ও ঔষধাদির নাম শিখিতাম।

 গুপ্ত প্রণয়ীরা আমাদিগকে তখনও ছাড়ে নাই। তাহাদের অত্যাচারে একেবারে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলাম। একটা মেয়ের উপর একদিন পাশবিক অত্যাচারের উপক্রম করায় সে নিজেকে বাঁচাইবার জন্য পাশের বাড়ীতে লাফাইয়া পড়ায় তাহার পা ভাঙ্গিয়া যায়,এ জন্য মোকদ্দমাও হইয়াছিল, কিন্তু তাহার ফলাফল শুনি নাই। একদিন সন্ধ্যার পরে আমি, রাজবালা, কালীদাসী ও আর একটী মেয়ে (তাহার নাম এখন আমার মনে নাই— বোধ হয় খেঁদি বা এমন কিছু হইবে) এই চারিজন একখানি ঘোড়ার গাড়ী ভাড়া করিয়া ঢালীগঞ্জে আসিলাম। সেখান হইতে ট্রামে আমরা কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীটে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা মন্দিরে উপস্থিত হইলাম।

 এই স্থানটী আমার পরিচিত ছিল। বাল্যকালে পিতার সহিত এই উপাসনা মন্দিরে অনেকবার আসিয়াছি। আজ সেই কথা মনে পড়িয়া চক্ষে জল আসিল। উপাসনা শেষ হইয়াছে। সমবেত উপাসকগণ প্রায় সকলেই চলিয়া গিয়াছেন। কেবল কয়েকজন বিশিষ্ট লোক অপেক্ষা করিতেছিলেন। আমাদের ব্রাহ্ম মহিলার মত কাপড় পড়া ছিল; পায়ে জুতাও ছিল, আমরা অগ্রসর হইয়া গেলাম।

 ব্রহ্ম সমাজে আসিবার ষড়যন্ত্র আমরা অনেক দিন হইতেই করিতেছিলাম। রাজবালাই ইহার মূল কারণ। সে বলিয়াছিল ব্রাহ্ম সমাজ সকলকেই গ্রহণ করে, ব্রাহ্ম ধর্ম্ম অবলম্বন করিলে বিবাহ করা সহজ হইবে। কিন্তু শেষে আমরা দেখিলাম, সেখানেও বাধা আছে।

 সম্মুখে একজন পঙ্ক-কেশ-শ্মশ্রু বিশিষ্ট দীর্ঘাকৃতি বলিষ্ঠদেহ বৃদ্ধকে দেখিয়া রাজবালা আমার কানে কানে বলিল “এই বুঝি কৃষ্ণ কুমার মিত্র— প্রণাম কর।” আমরা চারি জনেই পাদষ্পর্শ করিয়া প্রণাম করিলাম। তিনি স্নেহপূর্ণ স্বরে আমাদের আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে, আমরা তাঁহাকে একপাশে ডাকিয়া নিয়া সকল কথা বলিলাম, এবং আমাদের রক্ষার উপায় করিতে অনুরোধ করিলাম। উদ্ধার আশ্রমের কর্ত্তৃপক্ষদের দুর্ব্ব্যবহার ও আমাদের ব্রাহ্ম ধর্ম্ম গ্রহণের অভিলাষ তাঁহাকে জানাইলাম।

 তিনি বলিলেন “আপনাদের রক্ষার উপায় একাকী আমার দ্বারা সম্ভবপর হয় না। সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিগণকে জিজ্ঞাসা করাও প্রয়োজন।” তৎপরে তিনি একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোককে নিকটে ডাকিলেন। তাঁহার নিকট সমস্ত ঘটনা বলা হইলে তিনি বিশেষ ঘৃণার সহিত আপত্তি জানাইয়া কহিলেন— “না তা কিরূপে হয়? ইহাদের পূর্ব্বজীবন কলুষিত। ব্রাহ্ম সমাজে কি পাপ প্রবেশ করিবে?” আমরা নিরাশ হইয়া চলিয়া আসিলাম। বিদায় লইবার সময় পুনঃ প্রণাম করিতে গেলে শ্রীযুত কৃষ্ণ কুমার মিত্র মহাশয় আমাদের প্রণাম গ্রহণ করিলেন; কিন্তু অপর লোকটী, পরে শুনিয়াছিলাম তাঁহার নাম হেরম্ব বাবু— “না— না” বলিয়া সরিয়া গেলেন। এই ভদ্র লোকটীর সহিত পরে আমার আর একবার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তাহা বলিলে তিনি দুঃখিত হইতে পারেন মনে করিয়া বলিলাম না।

 আমরা ভাবিতে লাগিলাম এখন কোথায় যাই। উদ্ধার আশ্রমে আর আমাদিগকে নেবেনা। সেখানে ফিরিয়া যাওয়াও আমাদের ইচ্ছা ছিলনা। হঠাৎ আমার কমলার কথা মনে হইল। তাহার বাড়ীর ঠিকানা আমি জানিতাম। অন্ততঃ দুই একদিন সেখানে থাকিতে পারিব, এইরূপ ভরসা হইল। একখানা ঘোড়ার গাড়ী ভাড়া করিয়া আমরা চারিজনেই বাগবাজারে কমলার বাড়ীর দিকে রওনা হইলাম।

 কিন্তু সেখানে যাইয়া দেখি, কমলা তাহার মাতার সহিত কোথায় চলিয়া গিয়াছে। তাহারা সে বাড়ীতে নাই। অন্যলোক ভাড়াটে রহিয়াছে। তাহারা কমলাদের কোন সন্ধান দিতে পারিল না; আমি যেন একেবারে বজ্রাহত হইলাম। দীর্ঘকাল পরে নানা দুঃখ ভোগের পর বাল্যকালের প্রিয়বন্ধু কমলাকে দেখিব বলিয়া মনে বড়ই আনন্দ হইয়াছিল— কিন্তু সে আশা যে এরূপভাবে বিনষ্ট হইবে, তাহা কখনও মনে করি নাই। আমি মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে লাগিলাম।

 মুকুলদার ঠিকানা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। কমলার সন্ধান তাঁহার কাছে পাওয়া সম্ভব ছিল। আর কি উপায় আছে? রাজবালা বলিল “ভাই আজ রাত্রির মত আমি তোমাদিগকে একটা পরিচিত জায়গায় রাখিতে পারি। তারপর কাল সকালে যাহা হয় করা যাইবে।” আমরা অগত্যা সম্মত হইলাম। তখন রাত্রি অনেক হইয়াছে।

 সেই ঘোড়ার গাড়ীতে আরও বেশী ভাড়া দিয়া আমরা চাঁপাতলায় হাড়কাটা গলিতে এক পতিতা নারীর গৃহে আশ্রয় লইলাম। এই স্ত্রীলোকটী রাজবালার পূর্ব্ব জীবনের পরিচিতা। সে সমস্ত বাড়ীটা নিজে ভাড়া লইয়া তাহাতে ভিন্ন ভিন্ন ঘরে বেশ্যা ভাড়াটে বসাইয়াছিল। তাহাতে তাহার কিছু লাভ হইত। এতদ্ভিন্ন পাপ ব্যবসায়ে উপার্জ্জন ছিল। এই প্রকার স্ত্রীলোককে পতিতা নারী সমাজে ‘বাড়ীওয়ালী’ নামে অভিহিত করা হয়। ইহাকে সকলে রাণী বাড়ীওয়ালী বলিয়া ডাকিত।

 রাজবালাকে অনেকদিন পরে পাইয়া, বিশেষতঃ তাহার সঙ্গে আমাদের তিনজনকে দেখিয়া বাড়ীওয়ালী অতিশয় আনন্দিত হইল। সে পরম যত্নের সহিত আমাদের সকলকে একটী ঘরে থাকিতে দিল, তাহাতে বিছানা পত্রেরও অভাব ছিল না। আমাদের কিছু খাবার ব্যবস্থাও হইল। রাজবালার সহিত বাড়ীওয়ালী নানা কথাবার্ত্তা বলিতে আরম্ভ করিল।

দুশ্চিন্তায় আমার মনে শান্তি নাই। জীবনে এই প্রথম আমি ব্যবসাদার খাটা বেশ্যার ঘরে প্রবেশ করি। আমার কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হইতেছিল। নীচের তলায় এক কোণে ঘর—আলো বাতাস নাই। চারিদিকে একটা নূতন রকমের দুর্গন্ধ। কোথাও মাতালের বমি, কোথাও গান বাজ্না—কোথাও হৈ হৈ চীৎকার, কোথাও গালাগালি, ঝগড়া, এই সব দেখিয়া শুনিয়া আমার হৃদয় দমিয়া গেল; অথচ এখান হইতে পলাইয়া কোথায় যাইব তাহাও জানিনা।

 পরদিন সকালে খেঁদি বলিল, বেলিয়াঘাটায় তার এক মাসীর বাড়ী আছে, সে সেখানে যাইবে। আমরা আপত্তি করিলাম না। সে চলিয়া গেল। আমরা আরও তিন চারি দিন সেই বাড়ীতে রহিলাম। ইতিমধ্যে বাড়ীওয়ালী আমাকে ও কালীদাসীকে নানা প্রকারে বুঝাইয়া বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিতে মত লওয়াইল। সেই চতুরা নারীর সঙ্গে আমি তর্কে পারিলাম না। সে যে সকল যুক্তি দেখাইল তাহার সার মর্ম্ম এই—বেশ্যারা স্বাধীন; ভগবান তাহাদিগকে রূপ দিয়াছেন—পুরুষকে ভুলাইবার কৌশল দিয়াছেন কিসের জন্য?—তাহা দ্বারা জীবিকা উপার্জন করিতে। উকীল তাহার বুদ্ধি বিক্রয় করে—পণ্ডিত তাহার বিদ্যা বিক্রয় করে—এনন কি দীক্ষাগুরুও মন্ত্র বিক্রয় করেব; তবে রূপনতী কেন দেহ বিক্রয় করিবে না? বিপদ ভয় সকল ব্যবসায়েরই আছে। দেশের বড় বড় লোক সমস্ত বেশ্যাদের পায়ে বাঁধা। ধনী লোকদের টাকা বেশ্যাদের ঘরে উড়িয়া আসিয়া পরে। তাহাদের একটা কটাক্ষের মূল্য সহস্র টাকা।

 আমি ভূলিলাম। বাড়ীওয়ালী আমার জন্য ঘর দেখিতে লাগিল, কালীদাসী সেই বাড়ীতেই ঘর নিল। আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটের উপরে যেখানে এখন সিটিকলেজের বাড়ী তৈয়ারী হইয়াছে, তাহার নিকটে এক বস্তীতে আমি ও রাজবালা দুইখানি খোলার ঘর ভাড়া লইলাম। রাণী বাড়ীওয়ালী আমাদের দুই-জনকেই কিছু টাকা ধার দিয়া জিনিষপত্র ও কাপড়-চোপড় সমস্ত জোগার করিয়া দিল।

 কুসঙ্গে কিরূপ অধঃপতন হয়, আর এক দিক দিয়া তাহা দেখিতে পাইলাম। আমার স্কুলে পড়া বিদ্যা সমস্ত ভুলিয়া যাইবার গতিক হইল। মুকুলদার কাছে কত নূতন বিষয় শিখিয়াছিলাম—সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতি এখন সব চাপা পড়িয়া গেল। আমি যাহাদের সঙ্গে ছিলাম তাহারা কেহ লেখাপড়ার চর্চ্চা করিত না। কেবল কা'র কয়টা লোক জুটিয়াছে—কার প্রণয়ীর সঙ্গে কি আলাপ হইল—আর যত সব অশ্লীল ব্যাপার, ইহাই ছিল প্রধান আলোচনার বিষয়। তারপর নিজেদের রান্না ও ঘরের কাজ সমস্ত করিতে হইত। আমরা লজ্জায় বাজারে যাইতাম না। অন্য কাহাকেও দিয়া বাজার করাইতাম।

 লম্পট প্রণয়ীকে পতিতা সমাজে 'বাবু' বলা হয়। এখন হইতে আমি এই শব্দটী মাঝে মাঝে ব্যবহার করিব। এই 'বাবু' লইয়া খুব গোলযোগ হইত। কোন পতিতার প্রণয়ী অন্য নারীর ঘরে প্রবেশ করিলে তাহা লইয়া তুমুল ঝগড়া বিবাদ বাঁধিয়া উঠিত। সকলেই তাহাতে যোগ দিত। আমিও বাদ যাইতাম না। আর যত রকমের অশ্লীল অশ্রাব্য কথা শুনিতে শুনিতে আমার সহিয়া গিয়াছিল। বুঝিলাম স্কুলের পড়া হইতে যে অল্পবিদ্যা পাইয়াছি তাহা আমার অহঙ্কার বাড়াইয়া সর্ব্বনাশ করিয়াছে—কিন্তু আমাকে পাপের আক্রমণ হইতে বাঁচাইতে পারে নাই।

 আমরা সন্ধ্যার পরে সাজিয়া গুজিয়া আরতি দেখিবার ছলে নিকটবর্ত্তী ঠনঠনিয়া কালিবাড়ীতে যাইতাম। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া যখন দেখিতাম আমরা কোন ভদ্রবেশধারীর নজরে পড়িয়াছি, তখন বাড়ীর দিকে যাত্রা করিতাম। সেই ভদ্রবেশধারী ব্যক্তিও আমাদের সঙ্গ লইত। এইরূপে শিকার ধরিবার কৌশল রাণী বাড়ীওয়ালী আমাদিগকে শিখাইয়াছিল।

 আমি প্রথমে যাইতে আপত্তি করিতাম। আমার ভয় ছিল যদি বাপের বাড়ীর কাহারও সাঙ্গ দেখা হয়। যদি নন্দদাদা, সেই হরিমতি ঝি, অথবা বাবার মোটর ড্রাইভার, এমন কি বাবা নিজেই যদি দেখিয়া ফেলেন! রাজবালা আমাকে সাহস দিয়া বলিল “তোমাদের বাড়ী এ পাড়ায় নয়—সেত এখান হইতে অনেক দূরে; কলিকাতার মত সহরে কে কার খবর নেয়। এ পাড়ার লোক ও পাড়ায় যায় না।” আমিও বুঝিলাম তাহাই; অবশেষে আমি সাবধানে রাজবালার সহিত বাহিরে যাইতাম। আমার আর একটা আশা ছিল, যদি মুকুলদাকে কখনও রাস্তায় দেখি। কারণ আমার মনে পরে তাঁহার বাড়ী এ পাড়াতেই ছিল।

 একদিন শীতের রাত্রিতে ঠনঠনিয়া কালিবাড়ী হইতে ফিরিবার সময় দেখিলাম একজন ভদ্রলোক মাথায় র‍্যাপার জড়াইয়া আমাদের পিছু পিছু আসিতেছেন। আমাদের বাড়ী পর্যন্ত আসিয়া তিনি রাজবালার ঘরে গেলেন। পরদিন রাজবালা আমাকে ডাকিয়া বলিল কাল রাত্রিতে যে লোকটী আমার ধরে এসেছিল তিনি কে জানিস্? —বৈঠকখানার বাজারের কাছে কি একটা কলেজ আছে সেই কলেজের তিনি বড় প্রফেসার, তাঁহার নাম শ্রী......। তিনি আরও দুই তিন দিন আমার ঘরে এসেছিলেন।” আমিত নাম শুনিয়া অবাক। এঁর কথা মুকুলদার মুখে কতবার শুনিয়াছি। ইনি খুব ভাল পড়ান। আমি ভাবিলাম এই প্রফেসারের নিকট হইতে মুকুলদার কোন খবর পাওয়া যায় কিনা দেখিব।

 রাণী বাড়ীওয়ালী আমাদের বাড়ীতে মাঝে মাঝে আসিত; আমরা তাহকে রাণীমাসী বলিয়া ডাকিতাম। ক্রমে আমার ভয় দূরে গেল। আমি দেখিলাম অন্য সকল স্ত্রীলোক আমোদ-প্রমোদে মত্ত থাকে—নিঃসঙ্কোচে চলাফেরা করে— গঙ্গাস্না, কালীঘাটে, যেখানে সেখানে নির্ভয়ে যায়। তাহারা আমাকে বুঝাইল এখন আর ভয় করিস কাকে? গবর্ণমেণ্টের কাছে যখন একবার নাম রেজেষ্টারী করিয়েছিস— যখন একবার বলেছিল যে স্বেচ্ছায় এই বৃত্তি নিয়েছি, তখন আর কে তোকে কি বলবে? নাচতে নেমে লজ্জা করলে চলবে কেন?

 রাণীমাসী বলিল তোমার পিতা যখন মনে করেন তুমি মরিয়াছ, তিনি যখন তোমার আর ঘরে নিবেন না, তুমিও তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কচ্ছনা, তবে আর পিতাকেই বা ভয় কিসের? আমি বলিলাম, তবু পিতা যদি দেখেন তাঁর কন্যা তাঁর সম্মুখে পাপ ব্যবসা করছে, তাঁর মনে দুংখ হয় না?” রাণীমাসী কহিল, তিনি কন্যাকে ঘরে নিয়া অনায়াসে সেই দুংখ থেকে রক্ষা পেতে পারেন। মা, এ পথে যখন এসেছ, তখন অনেক নূতন চিত্র তোমার চোখে পরবে। দেখবে সত্যই পিতার সম্মুখে কন্যা বেশ্যাবৃত্তি করছে— দেখবে সত্যই গর্ভধারিণী মাতা আপন কন্যাকে বেশ্যাবৃত্তি করবার জন্য নিত্য সাজিয়ে গুজিয়ে দিচ্ছে— দেখবে সত্যই ভ্রাতা, ভগ্নী, আত্মীয়স্বজন বেশ্যার উপার্জিত অর্থে আত্মপোষণ করছে। পতিতা শুধু আমরা নই— প্রায় সমস্ত সমাজই অধঃপতিত হয়েছে।”

 আমি ও রাজবালা কোন উত্তর না দিয়া নীরবে শুনিতেছিলাম। রাণী-মাসী পুনরায় বলিতে লাগিল, “মানী, কোন দিন হয়ত দেখবে তোমার নন্দদাদাই তোমার ঘরে উপস্থিত হয়েছে। তোমার মুকুলদাও আসতে পারে। মনে কিছু করো না মা, আমি স্বরূপ কথা বল্‌ছি, কোন দিন হয়ত আমার ঘরেই তোমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ হওয়া অসম্ভব নহে।

 আমি লজ্জায় জিভ কাটিলাম। রাজবালা মাথা নীচু করিল, রাণীমাসী বলিতে লাগিল, “আর কি বলব মা, সে দিন যে একটি স্ত্রীলোক রামবাগান থেকে আমার বাড়ীতে এসেছিল, তাকেত তোমরা দেখেছ। তার ইতিহাস শুনবে? তার পিতা...... ভট্টাচার্য; কলিকাতার কোন কলেজের খুব বড় অধ্যাপকের কাজ করতেন। বেশী বয়সে কাজ ছেড়ে দিয়ে এখন রামবাগানে আপন রক্ষিতার গর্ভজাত কন্যার সহিত অবৈধ প্রণয়ে আসক্ত হয়ে শেষকালটা কাটাচ্ছেন— এই ত অবস্থা। আমি অনেক দেখেছি অনেক শুনেছি, তোমরাও দেখবে।

 আমরা যে বাড়ীতে ছিলাম, সেই বাড়ীতে একটি স্ত্রীলোকের ঘরে একদিন দেখি সে একদিন একটা ছবিকে ফুলের মালা দিয়া সাজাইতেছে। স্ত্রীলোকটার বয়স কিছু বেশী— সৌন্দর্য্য তখনও রহিয়াছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ছবিখানি কার? সেই স্ত্রীলোকটী বলিল, উহা শিবনাথ শাস্ত্রীর ছবি। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের একজন প্রধান আচার্য্য ছিলেন। আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম “ওহো— সেই শিবনাথ শাস্ত্রী, যাঁর 'নিমাই সন্নাস' কবিতা আমরা স্কুলে কত মুখস্থ করেছি— না—

আজ শচীমাতা কেন চমকিলে,
ঘুমাতে ঘুমাতে উঠিয়া বসিলে?
লুণ্ঠিত অঞ্চলে ‘নিমু’ ‘নিমু’ বলে
দ্বার খুলি মাতা কেন বাহিরিলে?—

বাবার মুখেও এঁর নাম মাঝে মাঝে শুনতাম। তার পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “শিবনাথ শাস্ত্রীর ছবি তুমি তোমার ঘরে রেখেছ কেন?” সে বলিল “আমি যখন ১৭/১৮ বৎসরের মেয়ে তখন এক প্রৌঢ়া পতিতা নারী আমাকে আশ্রয় দেয়। তাহার ছোট দুইটী ছেলে ছিল। তাহার প্রণয়ী বাবু তাহাকে একখানি বাড়ী দান করেন। রূপ-যৌবন বিক্রয় লব্ধ অর্থে আত্মপরিপোষণ করবার জন্যই সেই স্ত্রীলোকটি আমায় এনেছিল। সে চাঁপাতলার কোন ছুতারের মেয়ে, ৭ বৎসর বয়সে বিধবা হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় শিবনাথ শাস্ত্রী তাহার পুনঃবিবাহ দিতে চেয়েছিলেন। নানা কারণে তাহা হয়নি। শিবনাথ শাস্ত্রীকে সে বাল্যকালে দাদা বলে ডাকত। অবশেষে ঘটনা চক্রে সে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করল। আমি তাহার আশ্রয়ে আবার পর একদিন শিবনাথ শাস্ত্রী সেই বাড়ীতে আসেন এবং তাহাকে বেশ্যাবৃত্তি পরিত্যাগ করবার জন্য অনেক উপদেশ দেন। কিন্তু তাহাতে ফল হয় নাই। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্ব্বে সেই স্ত্রীলেকটীর হৃদয়ে অনুতাপ জন্মে। তখন আমি তাহার বাড়ীতে ছিলাম। আমি তাহাকে মা বলে ডাকতাম। সে শিবনাথ শস্ত্রীর এই ছবিখানা তখন কিনে আনে। প্রতিদিন সে ইহাকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে পূজা করত। মরবার সময়ে সে আমাকে এই ছবিখানা দিয়ে গেছে এবং যত দিন বাঁচি এমনি করে ফুল দিয়ে সাজাতে বলেছে। তার মৃত্যুর পর সেই দুই ছেলে বাড়ী দখল নিয়ে আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি এখন এইভাবে আছি।”

 আমি বলিলাম “শিবনাথ শাস্ত্রী এত বড় উদার-চরিত্র, পাপীকে উদ্ধার করবার জন্য বেশ্যালয়ে আসূতে ঘৃণা বোধ করেন নি?” স্ত্রীলোকটী ছবিখানিকে প্রণাম করিয়া বলিল, তিনি অনেক পতিতাকে সৎপথে এনেছেন। ঢাকার এক পতিতা নারীর কন্যা লক্ষ্মীমণিকে তিনি উদ্ধার করে এক ব্রাহ্ম যুবকের সহিত বিবাহ দিয়েছিলেন, সে গল্পও আমি শুনেছি।” আমি বলিলাম “আর এখন ব্রাহ্ম সমাজ কি হয়েছে! আমরা সেদিন স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে আশ্রয় নিতে গেলুম, তারা আমাদের নিলে না। হেরম্ব বাবু নামে একজন, (পরে শুনেছি তিনি হেরম্বচন্দ্র মৈত্র) আমরা ‘পাপী বলে’ আমাদের প্রণাম পর্যন্ত গ্রহণ করলেন না। বোধ হয় আজ শিবনাথ শাস্ত্রী বেঁচে থাকলে আমাদের এ দশা হ’ত না।”

 এই অস্বাস্থ্যকর খোলার ঘরে থাকিবার ফলে আমার শরীর দিন দিন খারাপ হইতে লাগিল। রণী-মাসীর পরামর্শে গর্ভসঞ্চার নিরোধ করিবার জন্য একটা ঔষধ খাইয়াছিলাম— তারপর হইতে আমার নানা রোগ দেখা দিল। রাজবালাও সেই ঔষধ খাইয়াছিল, কিন্তু তার কোন অসুখ হইল না। আমি অতিশয় ক্ষীণ ও দুর্ব্বল হইয়া পড়িলাম। সমস্ত শরীরে বেদনা। হাত পায়ের তলায় বিশ্রী দাগ— মুখে গায়ে ফুস্কুরীর মত হইয়া যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত উৎপন্ন হইল। রাণী-মাসী দেখিয়া বলিল, হাসপাতালে না গেলে আর রক্ষা নাই।

 আমি জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়াছিলাম। বিছানায় পড়িয়া দিবারাত্রি অবিরত কাঁদিতাম। চক্ষের জলে বালিশ ভিজয়া যাইত। সেইবার রোগে ভুগিয়া বুঝিয়া ছিলাম, মরণে বোধ হয় সুখ আছে। আত্মীয় বন্ধু কেহ নাই। বাড়ীর অন্য স্ত্রীলোক সকলে নিজ নিজ কার্য্যে ব্যস্ত। সন্ধ্যার পর সকলকেই ব্যবসায়ের খাতিরে দরজায় দাঁড়াইতে হয়। তারপর সারা রাত্রি অনিদ্রায় মদ্যপানে অথবা নানা প্রকার উত্তেজনায় কাটাইয়া তাহারা বেলে ৮ টা ৯ টায় ঘুম হইতে উঠে। আমাকে কে দেখবে? চারিদিকে একটা বিভৎস ব্যপার আমার চক্ষে পড়িল। আমরা যেন শূকরীর দল— কাদায় গড়াগড়ি দিতেছি। বুঝিলাম এবার আমার মৃত্যু নিশ্চয়।

 রাণী-মাসী ও রাজবালা দুজনে মিলিয়া আমাকে হাসপাতালে দিয়া আসিল। তিন মাস পরে সুস্থ হইয়া আমি বাড়ী ফিরিলাম। তখন আমার হাতে একটী পয়সাও নাই।