শেষ সপ্তক/চল্লিশ
চল্লিশ
পরিভাষা পৃথিবী সদ্য আয়ম
উপাতিষ্ঠে প্রথমজামৃতস্য।
ঋষি কবি বলেছেন,
ঘুরলেন তিনি আকাশ পৃথিবী,
শেষকালে এসে দাঁড়ালেন
প্রথমজাত অমৃতের সম্মুখে
কে এই প্রথমজাত অমৃত,
কী নাম দেব তাকে।
তাকেই বলি নবীন,
সে নিত্যকালের।
কত জরা, কত মৃত্যু
বারে বারে ঘিরল তাকে চার দিকে।
সেই কুয়াশার মধ্যে থেকে
বারে বারে সে বেরিয়ে এল;
প্রতিদিন ভােরবেলার আলােতে
ধবনিত হল তার বাণী,
‘এই আমি, প্রথমজাত অমৃত।'
দিন এগােতে থাকে,
তপ্ত হয়ে ওঠে বাতাস,
আকাশ আবিল হয়ে ওঠে ধুলােয়,
বৃদ্ধ সংসারের কর্কশ কোলাহল
আবর্তিত হতে থাকে
দূর হতে দূরে।
কখন দিন আসে আপন শেষপ্রান্তে,
থেমে যায় তাপ,
নেমে যায় ধুলাে,
শান্ত হয় কর্কশ কণ্ঠের পরিণামহীন বচসা,
আলোের যবনিকা সরে যায়
দিক্সীমার অন্তরালে।
অন্তহীন নক্ষত্রলােকে
ম্লানিহীন অন্ধকারে
জেগে ওঠে বাণী,
'এই আমি, প্রথমজাত অমৃত।'
শতাব্দীর পর শতাব্দী
আপনাকে ঘােষণা করে
মানুষের তপস্যায়।
সে তপস্যা
ক্লান্ত হয়,
হােমাগ্নি যায় নিবে,
মন্ত্র হয় অর্থহীন,
জীর্ণ সাধনার শতছিদ্র মলিন আচ্ছাদন
ম্রিয়মাণ শতাব্দীকে ফেলে ঢেকে
অবশেষে কখন
শেষ সূর্যাস্তের তােরণদ্বারে
নিঃশব্দচরণে আসে
যুগান্তের রাত্রি,
অন্ধকারে জপ করে শান্তিমন্ত্র
শবাসনে সাধকের মতাে।
বহুবর্ষব্যাপী প্রহর যায় চ'লে,
নবযুগের প্রভাত
শুভ্র শঙ্খ হাতে
দাঁড়ায় উদয়াচলের স্বর্ণশিখরে,
দেখা যায়-
তিমিরধারায় ক্ষালন করেছে কে
ধুলিশায়ী শতাব্দীর আবর্জনা;
ব্যাপ্ত হয়েছে অপরিসীম ক্ষমা
অন্তর্হিত অপরাধের
কলঙ্কচিহ্নের 'পরে;
পেতেছে শান্ত জ্যোতির আসন
প্রথমজাত অমৃত।
বালক ছিলেম,
নবীনকে তখন দেখেছি আনন্দিত চোখে
ধরণীর সবুজে,
আকাশের নীলিমায়।
দিন এগােলাে।
চলল জীবনযাত্রার রথ
এ পথে, ও পথে।
ক্ষুব্ধ অন্তুরের তাপতপ্ত নিশ্বাস
শুকনাে পাতা ওড়ালাে দিগন্তে।
চাকার বেগে
বাতাস ধুলায় হল নিবিড়।
আকাশচর কল্পনা
উড়ে গেল মেঘের পথে,
ক্ষুধাতুর কামনা
মধ্যাহ্নের রৌদ্রে
যরে বেড়ালাে ধরাতলে
ফলের বাগানে, ফসলের খেতে,
আহুত অনাহূত।
আকাশে পৃথিবীতে
এ জশের প্রমণ হল সারা
পথে বিপথে।
আজ এসে দাড়ালেম
প্রথমজাত অমৃতের সম্মুখে
শান্তিনিকেতন
১ বৈশাখ ১৩৪২