শেষ সপ্তক/মর্মবাণী
মর্মবাণী
শিল্পীর ছবিতে যাহা মূর্তিমতী,
গানে যাহা ঝরে ঝরনায়,
সে বাণী হারায় কেন জ্যোতি,
কেন তা আচ্ছন্ন হয়ে যায়
মুখের কথায়
সংসারের মাঝে
'নিরন্তর প্রয়ােজনে জনতার কাজে?
কেন আজ পরিপূর্ণ ভাষা দিয়ে
পৃথিবীর কানে কানে বলিতে পারি নে ‘প্রিয়ে
ভালােবাসি’?
কেন আজ সুরহারা হাসি,
যেন সে কুয়াশা-মেলা
হেমন্তের বেলা?
অনন্ত অম্বর
অপ্রয়ােজনের সেথা অখণ্ড প্রকাণ্ড অবসর,
তারি মাঝে এক তারা অন্য তারকারে
জানাইতে পারে
আপনার কানে কানে কথা।
তপস্বিনী নীরবতা
আসন বিস্তীর্ণ যার অসংখ্য যােজন দূর ব্যেপে
অন্তরে অন্তরে উঠে কেঁপে
আলােকের নিগূঢ় সংগীতে।
খণ্ড খণ্ড দণ্ডে পলে ভারাকীর্ণ চিতে
নাই সেই অসীমের অবসর;
তাই অবরুদ্ধ তার স্বর,
ক্ষীণসত্য ভাষা তার।
প্রত্যহের অভ্যস্ত কথার
মূল্য যায় ঘুচে,
অর্থ যায় মুছে।
তাই কানে কানে
বলিতে সে নাহি জানে
সহজে প্রকাশি
‘ভালােবাসি'।
আপন হারানাে বাণী খুঁজিবারে,
বনস্পতি, আসি তব দ্বারে।
তােমার পল্লবপুঞ্জ শাখাব্যুহভার
অনায়াসে হয়ে পার
আপনার চতুর্দিকে মেলেছে নিস্তব্ধ অবকাশ।
সেথা তব নিঃশব্দ উচ্ছ্বাস
সূর্যোদয়মহিমার পানে
আপনারে মিলাইতে জানে
অজানা সাগরপার হতে
দক্ষিণের বায়ুস্রোতে
অনাদি প্রাণের যে বারতা
তব নব কিশলয়ে রেখে যায় কানে কানে কথা,
তােমার অন্তরতম,
সে কথা জাগুক প্রাণে মম,
আমার ভাবনা ভরি উঠুক বিকাশি—
‘ভালােবাসি'।
তােমার ছায়ায় ব'সে বিপুল বিরহ মােরে ঘেরে;
বর্তমান মুহূর্তেরে
অবলুপ্ত করি দেয় কালহীনতায়।
জন্মান্তর হতে যেন লােকান্তরগত আঁখি চায়
মাের মুখে।
নিষ্কারণ দুখে
পাঠাইয়া দেয় মাের চেতনারে
সকল সীমার পারে।
দীর্ঘ অভিসারপথে সংগীতের সুর
তাহারে বহিয়া চলে দূর হতে দূর।
কোথায় পাথেয় পাবে তার
ক্ষুধা-পিপাসার,
এ সত্য বাণীর তরে তাই সে উদাসী-
‘ভালােবাসি'।
ভাের হয়েছিল যবে যুগান্তের রাতি
আলােকের রশ্মিগুলি খুঁজি সাথি
এ আদিম বাণী
করেছিল কানাকানি
গগনে গগনে।
নবসৃষ্টি-যুগের লগনে
মহাপ্রাণসমুদ্রের কূল হতে কূলে
তরঙ্গ দিয়েছে তুলে
এ মন্ত্রবচন।
এই বাণী করেছে রচন
সুবর্ণকিরণ বর্ণে স্বপনপ্রতিমা
আমার বিরহাকাশে যেথা অস্তশিখরের সীমা।
অবসাদগােধূলির ধূলিজাল তারে
ঢাকিতে কি পারে?
নিবিড়সংহত করি এ জন্মের সকল ভাবনা
সকল বেদনা
দিনান্তের অন্ধকারে মম
সন্ধ্যাতারা-সম
শেষবাণী উঠুক উদ্ভাসি-
‘ভালােবাসি'
ছাব্বিশ-সংখ্যক কবিতা তুলনীয়
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |