শ্মশানের ফুল/ফুলশয্যা
এসেছো কি এই খানে, আসিতে যেমন
তুমি নিজ পিত্রালয়ে, উৎসবের দিনে
অথবা এখানে বুঝি আছে নিমন্ত্রণ?
তাই কি এসেছ হেথা এমন অদিনে?
অঙ্কিত অতীতালেখ্য ত্রিদিব তোরণে
প্রবেশ পদবী মাত্র রয়েছে যেথায়
নিষ্ক্রমণ পদচিহ্ন পড়েনা নয়নে;
রঞ্জিত যে চারিভিতে ‘বিদায়’ ‘বিদায়’।
থাকো সখি থাকো সুখে অবনীর সাথে—
পেলে কোলে নিয়ে যে ও আমারে পশ্চাতে।—
বুঝি ইচ্ছা দেখাতে তা অভাগা পতিরে
যে চারু অজ্ঞাত পুরী দেখেছ সেখানে,
সেথা হ’তে কেহ, পারেনি আসিতে ফিরে
কহিতে সে গুপ্ত কথা মানবের কাণে।—
কে পায়ে ঠেলিতে চায় সিদ্ধ মনোরথ?
লভিতে অভীষ্ট ফল অসাধ কাহার?
নিজ হিতকর কার্য্যে, যে জন বিরত
হয় মূর্খ সেই, নয় তা অসাধ্য তার
পতির জীবন তব ফাটিছে বিষাদে
থাকো একা হবে দেখা দিন দুই বাদে।—
পড়িয়া শ্মশানে ছিন্ন কমলের হার,
না খুলে পল্লব তার অরুণ আভায়
না লুঠে ভ্রমর আজি মকরন্দ তার
বহেনা সুবাস তার বাতাসে মিশায়।—
শুষ্ক কমলের শোভা কৌমুদীর রাশ
ছিন্ন বল্লরীর শোভা বিকসিত ফুল
হাসিতে যে মাধুরীর লাবণ্য বিকাশ
কাঁদিলে সহস্রগুণ ভূতলে অতুল।—
উপরক্ত শশী যদি এত সমুজ্জ্বল
জানি না প্রসন্ন শশী কেমন নির্ম্মল?
বুঝি জীবনের এই শেষ অভিনয়
এই দেখা, শেষ দেখা, জনম মতন
শেষ লীলা শেষ হাসি শেষ সমুদয়
তবে কেন বাকী থাকে শেষ আকিঞ্চন।
আজি সাজাইব তোরে মনের মতনে
বিবিধ ভূষণে, আর কুসুম নিচয়ে
সোহাগ আদর আর স্নেহ আলিঙ্গণে
দিব উপহার আজি বিষণ্ণ হৃদয়ে
সঞ্চিত করেছি যাহা বহু যাতনায়
যদিও তা কলুষিত নয়ন ধারায়।—
করিয়াছ স্নান কত নদ নদী জলে
কর স্নান একবার নয়ন আসারে
তব সুত যুগলের, বাঁধিয়াছ গলে
কত রত্ন আভরণ, পর এইবারে
বিনি সূতে গাঁথা মালা নয়নের ধার
আনিয়াছি কবরীতে করিতে বন্ধন
স্মৃতির ভাণ্ডার হ’তে মাধুরীর হার।
করুক শোকের শ্বাস চামর বীজন।
আর কি দিবরে তোরে কোথা কি পাইব
এখনি ভিখারী সেজে পথে দাঁড়াইব।—
লুঠায়েছি বিলায়েছি স্নেহের ভাণ্ডার
সম্বল কেবল আজি নয়নের জল
প্রণয়ের প্রতিদানে দিতে উপহার
হৃদয় সরসে আছে শুষ্ক শতদল।—
স্নেহের মেখলা খানি তুলিয়া যতনে
পর কটিদেশে কর স্নেহ মণিময়,
যতনে মণ্ডিত কায় রঞ্জিত রতনে
ভালবাসা মণিময় নাও এ বলয়।—
আদর মমতা মায়া সিঞ্চিত সোহাগ
চরণ যুগলে মাখ অলক্তের রাগ।—
কনকের চাঁপা ফুল হীরার বকুল
রজত রজনীগন্ধা অযুত অযুত
কেমন আমোদ ভরা ভূতলে অতুল
কণ্টকে মণ্ডিত কায়া কেতকী অদ্ভুত।
কেন না কুসুম ফুটে মলয়ে চন্দন?
কেন তারকারা হায়! কুসুমের মত
ফুটে না ধরণী তলে, এ কথা কেমন?
তাহ’লে যে তুলিতাম অভিলাষ যত।
ঢাল হে নিসর্গ আজি কুসুম নিচয়
হোক শ্মশানেতে ফুলশয্যা অভিনয়।
এস নিশা তারাময়ী মলিন বদনে
দেখি কি ফুটেছে ফুল তোমার বাগানে?
হের দেখ হাসিতেছে সরসী জীবনে
কুমুদ কহ্লার হেলা এখানে ওখানে।—
নিশিগন্ধা গন্ধে যার রজনী বিভোর
হের সে প্রফুল্লমুখী মল্লিকা মালতী,
সেফালিকা বালিকার নয়ন চকোর
জাতি যুথি গাঁদা মতি বেলা রসবতী,
দোপাটি কলিকা কুন্দ বাঁধুলি চামেলি
গোলাপ বকুল চাপা ভ্রমরের কেলি।
প্রকৃতির হাসি দেখি হাসিল নলিনী,
অভিমানে সূর্য্যমুখী হেরিল সে হাসি;
পাছে মনে করে কিছু দু’টি সোহাগিনী
তোষে দুজনারে রবি সাদরে সম্ভাষি।
ফুটিল করবী জবা অশোক কাঞ্চন
পলাশ অপরাজিতা নীল নাগেশ্বর;
কামিনী যে কামিনীর কবরী ভূষণ—
কেতকী, যে যুবতীর বিবাহ বাসর।
ফুটিল সে গন্ধরাজ শিরিষ আতস
কৃষ্ণকলি অলি যার সোহাগে অলস।
গিরি উপত্যকা তরু গুল্ম লতা বন
নাহি কি কুসুম তোর হে দিবী রজনি!
মাখে নাকি ফুল শশি! কৌমুদী কিরণ
নাহি কিহে রবি ফুল! প্রেম ভিখারিণী?
হয় না কি দেখা বায়ু ফুলদল সাথে
নাহি কি জাহ্ণবি! তোর পূজা উপচার?
কি হবে সে ফুলে আর কি কাজ তাহাতে
থাকে যদি ঢালো আনি কুমুমের ধার
কি কলিকা বিকসিত ললিত মধুর
কি কালের অকালের উদ্যান মরুর।
গেল দিন ফিরে দিন আসিল আবার
উঠিল ঊষার রবি পূরব গগনে
জগতে হইল পুনঃ জীবন সঞ্চার
ভাসিল তাহার ছায়া একটী জীবনে
আবার আসিল সন্ধ্যা ‘প্রকৃতির স্নেহ’
তারকা খচিত যেন নীলাম্বরী তলে
দিবার কিরণ বিভা আবরিল দেহ।
ঢাকিল পৃথিবী মুখ মলিন অঞ্চলে।—
এ বিশ্বজগৎ কিন্তু ঠিক তাই আছে
নূতন নূতন কেন ঠেকে মোর কাছে।—
রাজধানী রাজপথে প্রশস্ত নগরে
দু’ধারের লোক যেন দু’ধারে পলায়
বলে জানি সব কথা ছুঁস্নেকো মোরে।—
ঐ ভাগীরথী দেখ নির্ম্মল ধারায়
ধাইছে সাগর আশে, চাহেনা এ ধারে
পাছে কলুষিত হয় পবিত্র সলিল
তার আমার পরশে; দেখ বারে বারে
পিছায় আমাকে হেরি চমকি অনিল।
তরু লতা উপবন বায়ু গলে দুলি—
বলে জানি মাথা খাস্ ছুঁস্নেকো ভুলি—
কি জ্ঞাত অপরিজ্ঞাত মানব মণ্ডলী—
চাহে না হেরিতে যেন আমার আনন।—
মেঘ হ’তে মেঘান্তরে যেনরে বিজলী—
বলে বার্ত্তা কলঙ্কের; হিমাংশু তপন
মেঘ কোলে রাহু গ্রাসে হইয়া পতিত
এড়াইতে চাহে যেন আমার নয়ন
জলদ জলের দান করেছে রহিত
লুকায়েছে অন্ধকারে নক্ষত্র রতন।—
কে জানিত মহাপাপ বিষাদ এমন
তাহলে কে করিতরে তার নিমন্ত্রণ?
আজি যাহা রাজপুরী আলয় রাজার
কে জানে যে ছিল না সে কালিকে বিজন?
আজি যেই ভিখারীর দিনপাত ভার
পারে নাকি পেতে কালি রাজসিংহাসন?
কালি যে বালিকা ছিল আজি সে যুবতী
আজি যেই খানে ছিল শৈল দৃঢ়কায়
হ’তে পারে কালি সেথা নদী স্রোতস্বতী
দ্রুত শৈলে মহাদেশ গঠিছে কোথায়?
ভবিষ্য তিমির গর্ভে চির অন্ধকারে
কি নিহিত আছে তাহ কে বলিতে পারে?
সমস্ত জগৎ চলে—নিয়মের বলে
বিশ্বপাতা বিশ্বত্রাতা তার মধ্যস্থলে।