শ্মশান।

অই কি শ্মশান হায়! সে নির্ম্মম স্থান
অগ্নি জ্বলে মনে দেহে; হয় অবসান
চির জীবনের যত সঞ্চিত বাসনা
কামনা বেদনা ক্ষমা লাঞ্ছনা গঞ্জনা—
ভস্মে হয় পরিণত। অনন্ত নির্ব্বাণ—
মুক্তি পায় জীবগণ; নশ্বর পরাণ—
অবিনশ্বরের সাথে—নিমগ্ন লীলায়।—

এত নহে লীলাভূমি? যাতনা জ্বালায়
নিভাইতে মানসের প্রধূমিত শিখা
পশে প্রজ্বলিতাগ্নিতে; অনল পরিখা
নিভায় যন্ত্রণা জ্বালা।—রহে অবিরাম
অনন্ত নিদার কোলে; অনন্ত বিশ্রাম—
আলিঙ্গন করে তারে।—

এখানে কি হায়!
বাঁধিয়া পাষাণ বুকে জ্বলি বেদনায়
অধীর শরীরে সঁপে অনলের কোলে
প্রাণের পুতুল নর। নয়নের জলে
ভাসি ফিরে শূন্য হৃদে!
বন্ধু পরিজন!
আনন্দ নিদ্রায় সুপ্ত হেথা কি এখন?
করিছ কি পুণ্যতর পদরেণুকায়
পবিত্র শ্মশান ভূমি ভস্ম মৃত্তিকায়?
দেখিয়াছি ঝটিকান্তে শান্তি জলধির
যুদ্ধাস্তে সমরক্ষেত্র, কিংবা প্রকৃতির
দেখিয়াছি প্রলয়ান্তে মুর্ত্তি ভয়ঙ্কর।
বিশৃঙ্খল অন্ধকারে বিশ্বচরাচর
আপনি করেছে গ্রাস আপন জীবন।
দেখিয়াছি দেখি নাই সে দৃশ্য ভীষণ—
ষে দৃশ্য দেখালে আজি ওহে ভগবান্‌
অসাধ্য সে ভোলা। যতক্ষণ দেহ প্রাণ
সম্বন্ধ আমার ভুলিব না ততক্ষণ—।
মরণের রঙ্গভূমি জীবন্ত মরণ।
লোকে বলে মানবের উন্নতির স্থান
এই সে শ্মশান! কিন্তু হয় অনুমান
নরমেধ যজ্ঞস্থান—। কৃতান্ত কৃপাণে
লক্ষ বলিদানে হীনে মানবের প্রাণে।—

বিস্তৃত শ্মশান ভূমে যে গৈরিক রাশ
বিদলিত পদতলে; এই ছাই পাশ
দেবের দুর্লভ বস্তু অবনীর মাঝে।—
মর্ম্মব্যথা মানবের প্রাণে নাহি বাজে!
যে জনক জননীর ক্রোড়েতে পালিত
কিংবা যেই তরুতলে আশ্রয় লভিত
নিদাঘের ঘোর গ্রীষ্মে; গ্রীষ্ম অবসানে
কুঠার আঘাতি মূলে ছিন্ন করি প্রাণে
দূরে ফেলাইয়া স্থান করে পরিষ্কার।
ঘোরতর স্বার্থপর—করে আবিষ্কার
আপনার গন্তব্যের পথ—সুবিশাল।—
রচিছে সোপান শ্রেণী—মানব কঙ্কাল
হইতেছে ভিন্ন ভিন্ন তার পাদ-পীঠ।—
মথিয়া নরক যেন নরকের কীট
করে শত আস্ফালন। অঙ্কুশের ঘায়
ডুবায় পুরীষ কুণ্ডে মুণ্ড পুনরায়।—
কুটুম্বের কলেবরে রাখি পদভর
নিষ্কলঙ্ক চিতে চিন্তে স্বার্থপর নর
কোথায় সে লক্ষ্যমণি হায় কতদূর
কত ঊৰ্দ্ধে অবস্থিত; বাসনা নিঠুর
লয়ে যায় ফেলে দেয় নরকের দ্বারে।
যদি কেহ ফিরাইতে চাহে আপনারে

পড়ে আসি ঘোরতর জীবন বিগ্রহে
সম্মুখীন হয় রণে; যেন গ্রহে গ্রহে
ঠেলাঠেলি; বিসম্বাদ তারায় তারায়;
আপনার ছায়া রশ্মি মাখি আপনায়
সন্ধ্যায় উঠিয়া পুনঃ প্রভাতে মিলায়
আলোকের উল্কাপাতে।

কি করিয়া হায়!
মানব চরণতলে দলিস্‌ এ ছাই?
নাহি কি তোদের মনে মমতার ঠাঁই?
নহে শুধু ইন্ধনের দগ্ধ অবসান
এই ছাই পাশ। ইহাতেও আছে প্রাণ
ইহাদের এককালে ছিল যে জীবন
ছিল প্রেম ভালবাসা প্রণয় রতন;
যৌবন কুসুম দাম দুলিতরে গলে
হাসিতরে সুখে তারা; কাঁদি অশ্রুজলে
ঘুচাইত ধরণীর কলঙ্ক কালিমা।
শারদ গগনে যবে উঠিত পূর্ণিমা
শুভ্রালোকে তাহাদের শুভ্র চিন্তা কত
বিকসিত হত; জল বুদবুদের মত
হৃদয়ে ভাসিয়া পুনঃ মিশাত হিয়ায়।
এই সমীরণ সলিল আলোক ছায়

তুষিতরে তাহাদের তুষিছে যেমন
নিত্য তারা আমাদের কর্ত্তব্য মতন।
বাসনা আকাঙ্ক্ষা বাঞ্ছা যুড়ি বক্ষময়
ফুটিত তাদের—ফুটে যথা কিসলয়
বসন্ত ঊষায়; মলয় পবনে তারা
আমাদেরি মত হইত যে আত্মহারা;
তাহাদেরো ছিল ভ্রাতা ভগ্নী সুত দারা
হারালে নয়ন-তারা পাগলের পারা
খুঁজিত এ বিশ্ব মাঝ; করিত কামনা
আছে স্থান জুড়াইতে হৃদয় বেদনা।
দেখে যারা ধরা খানি ক্ষুদ্র সরামত
কিংবা যে হাসিছে কিংবা কান্না অবিরত
করেছে যে ব্রত জীবনের; যাতনার
বৃশ্চিক দংশনে বহির্গত প্রায় যার
প্রাণ; একে একে একে রাখিবে হেথায়
দেহভার, অঙ্কিত হইবে মৃত্তিকায়।
চিহ্ণ রহিবেক খালি—অহঙ্কার, হাসি,
অশ্রু, মদ, গৌরবের মুষ্টি ভস্মরাশি।
এ প্রাঙ্গণে—কত মহাত্মার না হইতে
মাহাত্ম্য প্রকাশ; সুন্দরীর না হইতে
সৌন্দর্য্য বিকাশ; না ফুটিতে অঙ্কুরিত
বীজ প্রণয়ের, প্রণয়ীর আর্দ্রচিত,

কত কিছু না ধরিতে পূর্ণ আয়তন
মিশিয়াছে ছাই পাঁশে বিগত জীবন।
যদি কোন দেবশিশু ব্রহ্মলোক হ’তে
অমৃতকুণ্ডের জল আনি বিধি মতে
করিত সিঞ্চন, এই শ্মশান ঊষরে
কিংবা চিরতমোময় সমাধিমন্দিরে,
পরশিলে স্নিগ্ধ-বারি ভস্ম মৃত্তিকায়
উঠিত সজীব নর; লভিয়া স্বকায়
যাইত আপনা বাসে শান্তির আলয়ে
ভাঙ্গিত তাদের স্বপ্ন, দেখিত বিস্ময়ে
অচিন্ত্য ঘটনাবস্থা; করিত কামনা
পুনর্ব্বার মরিবার। তারা থাকিত না
তিলার্দ্ধ হেথায়; কে পারে দেখিতে চক্ষে
প্রাণসমা প্রিয়তমা শোভিতেছে বক্ষে
অপরের? অপহরি পিতৃসিংহাসন
বসেছে তনয় তায়; করেনা যতন
জনকে পুনরাগত; চিনে চিনিতনা
আগন্তুকে, বসিবার আসন দিতনা।
প্রেত বলি রাম রাম করি উচ্চারণ
পুনরায় নিজকার্য্যে নিবেশিত মন।
তাই বুঝি ধরামাঝে করিতে বিচার
সৃজিলেন বিধি মৃত্যু। গেলে পুনর্ব্বার

আসেনা দেখিতে সে যে কি ঘটে হেথায়
কে যে কি করিছে স্নেহ, মায়া মমতায়
নিমগ্ন কাহার কায় কেহ যে হরষে
গাহিছে জীবন গাথা কেহ ভ্রমবশে
করিছে আপন লীলা সাঙ্গ আচম্বিতে।
না রহিত যদি মৃত্যু এই ধরণীতে
তা হ’লে কি ভয়ানক হইত এ স্থান
থাকিতনা সুখ; হইত না অবসান
জ্বালা যাতনার; মৃত্যু তরে কতলোক
কাঁদিয়া কাঁদিয়া পাশরিত সব শোক!
নরের উন্নতি, হিত সাধন ধরার
জানিতনা মানবেরা তাহা কি প্রকার
থাকিতনা মানসের বল প্রদায়িনী
দুর্ব্বলের প্রাণ আশা চিত্তবিনোদিনী।
মৃত্যু যদি স্বেচ্ছাধীন হইত নরের
সংসার হইত স্বর্গ; স্বর্গ নরকের
না রহিত বিভিন্নতা; কে চাহিত যেতে
কল্পনাকুসুম সম অমরাবতীতে?
শ্মশানে কৃতান্ত করে উন্মুক্ত কৃপাণ
ডাক দিয়া বলে নিত্য, দাও বলিদান

মানবের শান্তি সুখ, যা কিছু যা আছে
শ্মশানের বেদিমুলে দেবী মূর্ত্তি কাছে।
দিবরে আহুতি আজি জ্বলন্ত চিতায়
ছিন্ন মুণ্ড শান্তিসুখ সর্ব্বস্ব; জিহ্বায়
শিখার, করিবে ভস্ম ত্বরা আচম্বিতে।—
অশান্তির কারামুক্তি আজি ধরণীতে
বিষাদের অভ্যর্থনা শোকের আহ্বান
নিরাশার অভ্যুত্থান, সৌখ্য বলিদান,
রোদনের শতধারা, যাতনার জ্বালা
হৃদয়ের শেল, স্মৃতির কণ্টক মালা।—
মমতার হার—দৃঢ় মায়ার বন্ধন—
খসিবে, দহিবে নিত্য স্বকায়ে জীবন
প্রজ্বলিত চিতাগ্নিতে সজীব পরাণ।
কে বলে নির্জীব খালি দহেরে শ্মশান
কে জানিত অনল যে শীতল এমন
জুড়ায় মনের জ্বালা মনের বেদন
পশিলে ও অনলের ক্ষুদ্র সমাধিতে
আপনি জুড়ায়ে যায় আঁখি পালটিতে
থাকে না যে কিছু চিহ্ন।—

ঐ দেখ্ দেখ্
ধক্ ধক করি জ্বলে চিতা; শিখা এক

চুমিল বদন বক্ষ কর শায়িতার
এককালে শত শিখা বেড়িল তাহার
নিশ্চল নিশ্চেষ্ট দেহ আক্রমে যেমন
মধুচক্রে মধুপায়ী ষট্‌পদগণ
মধু পীয়ে কিন্তু করে গরল উদ্গা‌র।
ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও কিছুক্ষণে আর
হবে সাঙ্গ লীলা খেলা—নিভিবে অনল!
জ্বলিছে সে জ্বালা বক্ষে, করি বক্ষস্থল
ভস্মময়, আপনাতে হইতে নির্ব্বাণ।—
ফিরে দে ফিরে দে মোরে ফিরে দে শ্মশান
সোণার পুতুল মোর ভিখারীর প্রাণ—
ইভিখারীর কাচ(ই) মণি তুল্য মূল্যবান।
দিবি না দিবি না ফিরে রাখরে যতনে
রাখ তবে চিরকাল তরে। আজীবনে
যেইজন লভে নাই সুখ, জানে নাই
শান্তি কি প্রকার; পার যদি সুখ সেই
চাহি না চাহি না তারে লইতে ফিরায়ে
অনন্ত শান্তির কোলে থাকুক শুইয়ে।—
শ্মশান আরক্ত নেত্রে নির্দ্দয় হৃদয়ে
বলিল বুলাও হাত, আপনার গায়ে
কিংবা বিশ্ব জগতের; পরশিলে গায়
ক্ষত বিক্ষতের চিহ্ন দেখিবে সেথায়

কান্না আছে হাসি চাপা আঁধার আলোকে
পাপ আছে পুণ্য ঢাকা সুখ শত শোকে।
এই কালি কালিমায় কলুষিত দেহ।
ভাঙ্গিল আমার স্বপ্ন বাড়িল সন্দেহ।

—:০০:—