২১

যতির টেবিলে Young India পত্রিকা। গভর্নমেণ্ট স্কুলের ছাত্রাবাস থেকে মুখস্ত করে এসেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শিখে এসেছে স্বদেশি গান, আর গ্রামে গঞ্জে প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। কলিকাতা থেকে যামিনীর কিনে আনা ডোয়ার্কিন হারমোনিয়ম বাজিয়ে গানও গাইছে আজকাল। এস্রাজটি অবশ্য রপ্ত করা হচ্ছে না। সময় কোথা সময় নষ্ট করার? আজ উধারবন্দ, কাল ভাঙ্গারপার, পরদিন জেলা সদর। সঙ্গে জুটেছেন সনৎ দাস, কালিমোহন দেবের পুত্র সতী দেব, ইরমান মিঞাঁ বড়ভূঁইয়া। পেছনে কামিনীবাবু, শ্যামাচরণবাবু তো আছেনই।

 যতির পরণে এখন খাদির ধুতি, গায়ে খাদির ওয়েস্টকোট। আর নিত্য সঙ্গী সাইকেল তো আছেই। বড় ভাই হিসেবে তাঁর ভবিষ্যতের চিন্তা কিছুটা করতে হয় বটে। এদিকে ওদিকে কান ভারি করার মানুষেরও অভাব নেই। বিপিনচন্দ্রকে আজকাল মাসের অর্ধেক দিন লক্ষীপুর মৌজার কাছারি সংলগ্ন কুঠিতে থাকতে হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন না হঠাৎ কেন বনরাজ পরগনার দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হল। দশবছর এই পরগনার আদায় উশুল তো ভালই ছিল। তবে সাহেব কী চান? প্রজাদের উপর জবরদস্তি তো করতে তিনি পারবেন না, এমনকি তাঁর পদোন্নতি আটকে দিলেও না। তিনি ডেপুটি কমিশনার সাহেবকে চিঠি দিয়ে একটি সাক্ষাৎকার প্রার্থনাও করে রেখেছেন। এত সহজে হার মানতে রাজি নন তিনি। একটি পত্র দিয়ে বিষয়টি যতির নজরেও এনেছেন, যদিও জমিদারি, মৌজা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর আগ্রহ একেবারেই নেই। এত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে একটা উঁচু পদে বহাল করা গেল না।

 বিষয়চিন্তা মাথায় এলে অনেক পরিকল্পনার মধ্যে কোনটাকে অগ্রাধিকার দেবেন আর কোনটাকে পেছনে রাখবেন এ নিয়েও তিনি বিব্রত। এদিকে আবার পদ্মনাথ ভট্টাচার্যের কথাগুলো তাঁকে বিভ্রান্তির দিকে টেনে নেয়। তিনি নিজেকে বোঝান বিদ্যাবিনোদের পথ আর তাঁর পথ ভিন্ন। উনি হলেন জ্ঞানযোগী, আমার মতো জাগতিক বিষয় নিয়ে তাঁর ভাবার অবকাশ কোথায়? কিন্তু মোক্ষম সময়েই যে বিদ্যাবিনোদের কথাগুলো তাঁর মনের মধ্যে নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে, দেশের জমিদাররা যে ধান্য উৎপাদনের চেয়ে পাট কিংবা অন্য দ্রব্য উৎপাদনে উৎসাহী হচ্ছেন এটা বিদ্যাবিনোদের একেবারেই না-পছন্দ। এ পণ্ডিতমশাইয়ের পরামর্শ যে আবার বিপিনচন্দ্রের কাছে বেদবাক্যও, এটাও এক ধর্ম সংকট।

 ঘটনা হল রায়বাহাদুর ইতিমধ্যেই অ্যাগ্রিকালচার ইন্সপেক্টরের পরামর্শে খেসারি ডালের চাষ করার পরিকল্পনা করে রেখেছেন। অবশ্য এসব খবরের জন্য পদ্মনাথবাবু তো আর বসে নেই। পরিকল্পনাটিকে বাস্তবায়িত করতে হলে প্রয়োজন যতিকে। নতুন কিছুতেই তাঁর উৎসাহ বেশি। এই বিবেচনায় একটি বিকল্প চাষ পরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপন করলেন ভ্রাতার কাছে। চিঠিতে স্পষ্ট করে লিখলেন,

 —“আমাদের রায়ত বা পাইকাস্তের হাতে টাকা না থাকলে আমরা কিছুতেই খাজনা আদায় করিতে পারিব না। সুতরাং ইহারা যাহাতে টাকা পায় তাহা চিন্তা করাও আমাদের কর্তব্য। তুমি এখন বাড়ীতে আছ সুতরাং আমার উপদেশ মত মনোযোগের সহিত কার্য করিলে আমাদের রায়তদের এবং গ্রামবাসীর বিশেষ উপকার করিতে পারিব বলিয়া মনে করি।”

 কথাটি অবশ্য যতীন্দ্রর মনঃপুতই হল। আসলে তাঁর এ অগ্রজ যতই সাহেব ঘেঁষা হন না কেন, তাঁর বুকের ভেতরও রয়েছে এক গভীর স্বদেশানুরাগ। আর বৃহত্তর পরিবারের প্রত্যেকের দিকেও তাঁর নজর। খুড়া জেঠা, জেঠি খুড়িমা, ভগ্নি ভগ্নিপতিদের নিয়ে বিশাল পরিবারের যে-কোন প্রয়োজনে তিনি এগিয়ে আসতে সদাই প্রস্তুত। এতে পেছন থেকে কেউ কিছু বলার নেই। স্ত্রী প্রমীলাসুন্দরী অবশ্য কোনদিনই এসব কাজে বাঁধা দেন না।

 ইতিমধ্যে যতীন্দ্রমোহন লোক্যাল বোর্ডের সেক্রেটারি হয়ে গেছেন। এবার যদি একটু সংসারের দিকে মন ফেরে এ আশা অবশ্য বিপিনবাবুর রয়েছে, যদিও তিনি মনকে বুঝিয়েছেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা তাঁর নিজস্ব লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছে, এখন তাঁর পথ আগলে রাখা ঠিক হবে না।