বাপদাদার মুখে শোনা কাহিনিতে মজে গেলেন মহামহোপাধ্যায়। বলে যাচ্ছেন রায়বাহাদুর। অতিথির কৌতূহল নিবারণ করতে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসতে হল পারিবারিক কথায়।

 মহারাজের মৃত্যুর দুই বছর পর এক বিশেষ দিনে কাছাড়ের বাজারে বাজারে কোম্পানির সিপাইসহ পঞ্চায়েতের পাইক ঢোলক বাজিয়ে জানান দিল: “আজি ১২৩৯ সাল, শ্রাবণ সংক্রান্তি হইতে ইংলেণ্ডেশ্বরীর প্রতিনিধি ভারতের মহামান্য গভন্নর বাহাদুরের আদেশ মোতাবেক মুলুক কাছাড়ের প্রজাসাধারণের মঙ্গলার্থে এবং দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এই রাজ্যকে কোম্পানির আওতায় আনিলেন।” খ্রিস্টানদের পঞ্জিকা মতে দিনটি ছিল ১৮৩২ এর ১৪ আগস্ট। তোড়জোড় শুরু হল সর্বত্র। অরণ্য জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়া মানুষ ফিরে আসতে শুরু করল। বার্তা পৌঁছে গেল সুরমা নদীর তীরে, দলে দলে শাহজালাল আর মহাপ্রভুর অনুগামীরা এদিকে পাড়ি জমাতে শুরু করলেন। জমির বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে দুধপাতিলস্থ কাপ্তান ফিশার সাহেবের কুঠি থেকে। যার যার সামর্থ অনুযায়ী সামান্য কিছু নজরানা নিয়ে মানুষ ছুটল দুধপাতিল অভিমুখে। নিজস্ব সনন্দখানা নিয়ে হাজির হলেন রায়বাদুরের কোনও এক পূর্বসুরি নতুন প্রশাসক সুপারিনটেণ্ডেণ্ট সমীপে। ছুটে গেলেন দেশমুখ্য, মজুমদার, বড়ভুইঞাঁ আর ছোটবড়ো মাঝারি জমিদার, মিরাশদারের দল। খবর পৌঁছে গেল সোনাপুর পরগনার সাতকরাকন্দিতে। ওখানকার জমিদার সোনামিঞাঁ চৌধুরি যারপরনাই আহত হলেন। এ কী দুর্মতি হল মহামান্য হেড়ম্ব রাজসভা পারিষদের।

 —এ আপনাদের অন্যায় কার্য। আমি তো জীয়ন্তে খ্রিস্টান মুলুকে সামিল হইতে পারি না। হুজুর! আপনাকে আমি পাঁচটি হাতি, দশটি ঘোড়া এবং তিনখানা বন্দুক দিব। নসিব ফিরিলে মূল্য দিবেন। সুদ ইসলামে হারাম, ইচ্ছা হইলে কেবল মূল দিবেন। এত সহজে খ্রিস্টান রাজত্ব মানিতে পারি না।

 সোনাই নদীপথে রওয়ানা দিয়ে জাটিঙ্গা পৌঁছোবার আগেই পত্রসহ তাঁর দূত ইংরেজ সিপাইর হাতে ধরা পড়ল। অভিসন্ধি ফাঁস হয়ে যাওয়াতে অপ্রস্তুত অবস্থায় কোম্পানির সিপাইর হাতে বন্দি হলেন প্রতাপশালী রাজা সোনামিঞাঁ চৌধুরি। জাটিঙ্গা পাড়ে এই প্রতিরোধী বার্তা আর পৌঁছোতে পারল না। সমতল কাছাড়ে স্বাধীন হেড়ম্ব রাজ্যের প্রদীপ জ্বালানোর অবশিষ্ট আর কেউ রইল না।

 ওদিকে মাহুর নদীর তীরে পার্বত্য কাছাড়ে বিদ্রোহী সেনাপতি তোলারাম রাজ্যের ভেতর লুটতরাজ চালিয়ে যেতে থাকল। ইংরেজশক্তি এই এলাকাকে স্বতন্ত্র এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে হেড়ম্ব মুলুক থেকে আলাদা করে দিল। তাঁদের দৃষ্টি এখন নব অধিকৃত কাছাড় রাজ্যে।

 কাছাড়ের শেষ নৃপতি গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন স্বভাব কবি, প্রশাসনে উদাসীন এবং ভোগবিলাসে মত্ত। সিংহাসনে বসে প্রথমেই তিনি বিধবা ভ্রাতৃবধূ মণিপুর রাজকন্যা ইন্দুপ্রভাকে বিবাহ করে প্রজা এবং পারিষদদের বিরাগভাজন হলেন।

 বিপিনচন্দ্র শৈশব থেকেই তাঁর জেঠিমা, কাকিমাদের মুখে শুনে আসছেন এ রানি ছিলেন রূপেগুণে অসামান্যা, নৃত্যগীতে পারদর্শিনী। অবশ্য এ রানি সম্বন্ধে বিদ্যাবিনোদ ইতিপূর্বে বন্ধু ভুবনমোহন বিদ্যার্ণব মহাশয়ের মুখেও কিছু কথা শুনেছেন। এক সাহিত্য সভায় ইতিহাস প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এ পণ্ডিতপ্রবর ইন্দুপ্রভাকে ‘কাছাড়ের ক্লিওপেট্রা’ বলেই অভিহিত করেছিলেন। প্রাচীনেরা বলতেন ‘তুমি যদি প্রভাতী সোনালী সূর্যের রক্তিম আভা দেখতে চাও, তবে বসন্ত বা শরতের অপেক্ষায় না থেকে রানি ইন্দুপ্রভার দিকেই তাকাও। আর যদি গ্রীষ্মকালীন পূর্ণিমায় চাঁদের কিরণে স্নাত হতে চাও, তবে তিথি নক্ষত্র গুণে আর বৃথা কালক্ষেপের প্রয়োজন নেই, রানি ইন্দুপ্রভার সান্নিধ্য প্রার্থনা কর।’

 এ হেন পরমাসুন্দরী, বৈষ্ণবী ইন্দুপ্রভার সংস্পর্শে এসে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত মহারাজের বিকাশ ঘটল কবিত্বশক্তির। পিতৃপুরুষের ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন পরম বৈষ্ণব। রাজ্যের অস্ত্রভাণ্ডারে জমে উঠল ধুলার আস্তরণ, কামারদের নিয়মিত অস্ত্র শান দেওয়ার শব্দ হল স্তব্ধ, সিপাইসাস্ত্রিদের নিয়মিত রাজ্যপরিক্রমণও বন্ধ। ঘোড়সওয়ার প্রতিরক্ষা কর্মীদের এখন অনন্ত বিশ্রাম। নীরব রণচণ্ডী মন্দিরে বাজে না বলির বাদ্য। রাজকীয় প্রমোদ উদ্যান থেকে এখন দূর দূরান্তে ভেসে যায় মৃদঙ্গের বোল প্রেমিক সম্রাটের কণ্ঠে উচ্চারিত হল সুললিত পদাবলি। মধুর প্রেমরসে মধুরার তীর হয়ে উঠল বৃন্দাবনের রাসস্থলী। লীলামৃত রসে বিভোর মহারাজ শ্রীগোবিন্দচন্দ্র রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা শীর্ণ জলধারাকেই স্রোতস্বিনী কলিন্দ্রী ভেবে এর তীরে আছড়ে পড়লেন:

কোথা বৃন্দাবন কোথা নিকুঞ্জ কুটির।
কোথা ব্রজাঙ্গনাগণ প্রিয় রাধা মোর॥
ব্রজধাম রাসস্থলী স্মরিয়া কাতর।
বাক্য নাহি স্মরে প্রভু ভাবে ঝর ঝর॥
শ্রীগৌরাঙ্গকৃষ্ণচন্দ্র লীলামৃত রসে।
শ্রীগোবিন্দচন্দ্র নৃপ কবে জানি ভাসে॥