ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/৪
৪
‘ঋণাদান বিধি’ উদ্ধারের পর ‘সুবঙ্গ বিষয়া’ অভিযানে বিপিনচন্দ্র নিজেই বিদ্যাবিনোদের সঙ্গী হলেন। অনেকদিন প্রজাদের খবরাখবরও নেওয়া হয়নি, দেখাও হয়ে ওঠেনি জমিদারির উত্তর-পূর্ব। বিদ্যাবিনোদ একটি ‘রাসলীলা পুথি’র নামও শুনেছিলেন। বিপিনবাবু জানালেন ওই পুথির খণ্ডিত কয়েকটি পাতা তাঁকে দেখিয়েছিলেন বড়রামপুর নিবাসী জনৈক ডিমাসা ব্যক্তি।
ডলু নদীর তীরের গ্রামগুলোতে রয়েছে প্রাচীন ডিমাসা বসতি। মহাজন নন্দলাল বর্মনের বাড়িতে মহামূল্যবান ‘দণ্ডবিধি’ পুথির সন্ধান পাওয়া গেলেও তাঁর আতিথ্যের আতিশয্য এড়ানো এ নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণের কর্ম নয়। গাছের কলা আর চাঙ্গুয়া ছাগের দুধ গ্রহণ করতেই হল। বিদ্যাবিনোদ অবাক হয়ে দেখলেন এই খড় মাটি আর বাঁশ দিয়ে সাজানো বাড়ি, কলা আম জাম কাঁঠাল আর জারুলের গাছ। যে ছাগমাতার দুগ্ধ তাঁকে উৎসর্গ করা হল তাঁর অধিষ্ঠান অবশ্য শূন্যমার্গে। বাঁশের মাচাং বেঁধে উঁচুতে এই ছাগল রাখার ব্যবস্থা তাই এরা চাঙ্গুয়া, এ কথা বলে হাসিতে ফেটে পড়লেন গৃহস্বামী। ব্রাহ্মণ অতিথির পায়ে ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন,
—পুথিটি যথাসময়ে আপনার হাতে পৌঁছে যাবে।
রাজ পরিবারের সম্পকর্ধন্য এ বিশিষ্ট ব্যক্তির কথার যে কোনও নড়চড় হবে না তা বিপিনবাবু জানেন। নন্দলালবাবু এও জানালেন যে, মহারাজসুরদর্প নারায়ণের আমলে ভুবনেশ্বর বাচস্পতি বিরচিত ‘নারদীয় রসামৃত’ পুথির একখানা প্রতিলিপিও তিনি বিদ্যাবিনোদ মহোদয়ের হাতে তুলে দেবেন। এই কথা বলে স্মৃতি থেকেই উচ্চারণ করলেন কয়েকটি পঙক্তি:
হরিধ্বনি কর গ্রন্থ হইল সমাপন।
ষোল শত বাইশ শকেতে যে হৈল লিখন॥
তাম্রধ্বজ মহারাজ ছিলা মহাভাগ।
সর্বলোকে সদা যারে করে অনুরাগ॥
তান পুত্র রাজা শূরদর্প মহাশয়।
চন্দ্রপ্রভা নামে দেবী তান মাতা হয়॥
কবি বাচস্পতি তান বাক্য অনুসারে।
শ্রীনারদীরসামৃত রচিলা পয়ারে॥
—ছোটবেলায় গ্রামে এই পুথি পাঠ শুনে আমরা বড় হইয়াছি।
নন্দলাল মহাজনের কথা শুনে দুজনেই নির্বাক। ইতিহাসের একটি অজানা অধ্যায় চোখের সামনে উন্মোচিত হতে চলেছে। যথাযোগ্য সম্ভাষণ সমাপনান্তে মহাজনবাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতে করতে বিপিনচন্দ্রের মনে পড়ে গেল শৈশবে তিনিও এদিকে এসেছিলেন রাসযাত্রায়। মণিপুরি নাটমন্দিরে কাছারি-মণিপুরি মিলে করেছিলেন ওই রাসলীলা।
—আহা! কী সুন্দর ঝলমলে পোশাক! ময়ূর পুচ্ছের শিরস্ত্রাণ পরে রাধা-কৃষ্ণ। আর সেই সুললিত কীর্তনের সঙ্গে কী অপূর্ব খোল বাদন!
বিদ্যাবিনোদ বুঝতে পারছেন রায়বাহাদুর ফিরে গেছেন শৈশবের দিনগুলিতে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। দূরে নীল বড়াইল। এ পর্বত শ্রেণির ভিতর ছত্রিশটি সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়েই বিদ্যাবিনোদ এসেছেন এই ভূমিতে। মাত্র দশ বছরে সাহেবরা কী অভাবনীয় কাজই না করেছেন! নইলে এত সহজে তাঁর আজ এখানে আসা অকল্পনীয় হত।
এদিকে পত্তন হয়েছে চা বাগিচা। উঁচু ভূমিতে মাত্র কয়েক বছরের চেষ্টায় সাহেবেরা তৈরি করেছেন সুদৃশ্য এক জলাশয়, স্থানীয়রা বলেন তালাব। এরই মাঝে থরে থরে ফুটে আছে শ্বেতপদ্ম। পাড়ে ঢেউ খেলানো টিলার উপর সমান করে ছাঁটা চায়ের গাছ যেন ক্লান্ত পথিকের জন্য সুখশয্যা রচনা করে রেখেছে।
এ সুন্দর পরিবেশে বিদ্যাবিনোদের মনেও রং লেগেছে। তাঁর চোখের সামনে ভেসে এল রামায়ণের সেই দৃশ্য—সীতাহারা রাম অনুজ লক্ষ্মণের হাত ধরে উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতে করতে এসে উপনীত হয়েছেন পম্পা সরোবরের তীরে। পম্পার নিটোল কালো জলে ফুটে আছে অজস্র পদ্ম। দুইভাই এ অপরূপ শোভা দেখে মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বিস্মিত হয়ে গেলেন সীতাহরণের ঘটনা। এত বিরাট আঘাত, ক্ষণিক পূর্বে যা ছিল অসহনীয়। পদ্মকুমুদশোভিত মৎস্যসমাকুল পম্পা সরোবরের তীরে দাঁড়িয়ে রাম অনুজকে বলছেন, ‘এই জল বৈদূর্যমণির ন্যায় নির্মল, এর তীরবর্তী কানন অতি সুদৃশ্য।’ বিদ্যাবিনোদের মুখে উচ্চারিত হল আদিকবি বাল্মীকি রচিত শ্লোক। ভর দুপুরের নীরবতায় শব্দগুলো হাওয়ার সঙ্গে ভেসে গেল জলের ঢেউয়ে:পশ্য রূপানি সৌমিত্রে বনানাং পুষ্পশালিনাম।
সৃজাতাং পুষ্পবর্ষাণি বর্ষাণি বর্ষং তোয়মুচামিব॥
এবার তো ফিরতে হবে। ভট্টাচার্য মহাশয় যে ক্লান্ত। বাড়ির বাইরে কোথাও এক বিন্দু জলও গলায় ঢালবেন না। ছত্রবাহকের কাঁধে একপাত্র জল এবং কৌটো ভর্তি বাতাসা রয়েছে যদি তিনি গ্রহণ করেন।
জলাশয়ের দিকে পিছন ফিরতেই দেখেন সামনে ঘোড়া থেকে নামছেন টুপি পরা এক গোরা সাহেব।
—নমস্কার বাবু, গুড মর্নিং টু বোথ অব ইউ। আপনাকে আমি চিনিতে পারছি জমিন্দার বাবু, মিস্টার...।
রায়বাহাদুর বলে দিলেন,
—বিপিনচন্দ্র।
—ও ইয়েস, বিপিনচন্দর। কিন্তু দিস জেণ্টলম্যান এপিয়ার্স টু বি আ স্ট্রেঞ্জার। হাও ডু ইউ ডু স্যার? বান্দাকা নাম হ্যানরি মিলস।
পণ্ডিতমশাই একেবারে সাহেবি কেতায় সম্ভাষণ করে বললেন,
—আই এম প্রফেসর ভটচাজ, ফ্রম কটন কলেজ, গৌহাটি। গ্লেড টু মিট ইউ ইন দিস প্লেস।
—ও থ্যাঙ্ক ইউ। ইউ আর ওয়েলকাম টু মাই এস্টেট।
বিদেশের মাটিতে এত সুন্দর ইংরেজি বলছেন ধুতি পরা লোকটি। সাহেব তো তক্ষুনি এদের নিজ বাংলোতে নিয়ে যেতে চাইছেন। কী করে বিপিনচন্দ্র নাছোড়বান্দা এ সাহেবকে বোঝাবেন যে এই ব্রাহ্মণ সন্তানকে আপ্যায়ন করার অনেক হ্যাপা আছে? নিজে অবশ্য সাহেবের দেওয়া চুরুটটি ‘থ্যাঙ্কস’ বলে গ্রহণ করলেন। বিদ্যাবিনোদের দিকে সাহেবের হাত যাবার আগেই বিপিনচন্দ্র বলে উঠলেন সাহেব যদি পণ্ডিতমশাইয়ের জন্য একটি দেশি হুঁকোর বন্দোবস্ত করতে পারেন তবেই তিনি তৃপ্ত হবেন। জমিদার বাবুর এ প্রস্তাবে সবারই এক চোট হাসি।
—আই এম আফ্রেড বাবু, ইটস ইনডিড আ চ্যালেঞ্জ ফর মি।