এক

 সোভিয়েট রাশিয়ার ‘লৌহ মানব’ ষ্ট্যালিন আজ পৃথিবীর পরম বিস্ময়। সমসাময়িক ইউরোপ ও এশিয়ার সমস্ত দেশের রাষ্ট্রবীরগণের মধ্যে তাঁহার শির সমধিক গৌরবে উন্নত। ইনি একদিকে নির্ম্মমহস্তে অতীত ব্যবস্থাকে ভাঙ্গিয়াছেন, অন্যদিকে কল্যাণ-স্নিগ্ধ হস্তে নবীন রাষ্ট্র ও সমাজ-ব্যবস্থা গঠন করিয়াছেন। রাশিয়ার কৃষক-শ্রমিক বিপ্লবের ইতিহাস তাঁহার জীবন চরিতের একটা প্রধান অংশ। এই মনুষ্যটির অনন্যসাধারণ কর্ম্মজীবন যুগযুগান্ত ব্যাপিয়া যে প্রভাব, যে প্রতিপত্তি, যে আলোক ও উত্তাপ বর্ত্তমান ও পরবত্তীকালে রাখিয়া যাইবে তাহা জানিবার ও বুঝিবার আগ্রহ স্বাভাবিক।

 সোভিয়েট রাশিয়ার শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমস্ত পৃথিবীর ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। একলক্ষ বর্গ মাইল ব্যাপী এই বিশাল রাষ্ট্রের বিশ কোটী নরনারীর নেতা ষ্ট্যালিন। দেশ কালের ব্যবধানে গান্ধিজী ভারতের লক্ষকোটী নরনারীর যেভাবে শ্রদ্ধার পাত্র, রাশিয়ার নরনারীরা ষ্ট্যালিনকে ঠিক সেই দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকে। তাহারা তাঁহাকে ভালবাসে, বিশ্বাস করে। রাশিয়ার বাহিরেও পৃথিবীর সর্ব্বত্র মানব-মুক্তিকামীরা রাষ্ট্রক্ষেত্রে এই নবযুগ-প্রবর্ত্তককে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করিয়া থাকেন। এমন যে জীবন তাহা যথাযথভাবে আলোচনা করা আমার সাধ্যায়ত্ত নহে। তথাপি শত্রুপক্ষের নিন্দা ও মিত্রপক্ষের স্তুতিবাদের আবর্জ্জনারাশি যথাসাধ্য পরিহার করিয়া এই মহৎ জীবনের কিঞ্চিৎ পরিচয় দিতে চেষ্টা করিব।

 পশ্চিম এশিয়ার জর্জিয়া একটি ক্ষুদ্র প্রদেশ। এক সাহসী, পরিশ্রমী, সুগঠিতদেহ নরনারী-অধ্যুষিত এই দেশের দুই হাজার বৎসরের ইতিহাস—রাজ্য ও সাম্রাজ্য গড়ার ইতিহাস। সম্রাট সেকেন্দর শাহ, চেঙ্গিস্ খাঁ, তৈমুর লঙ্গ প্রভৃতি দিগ্বিজয়ী সম্রাটগণের চতুরঙ্গবাহিনী এই ক্ষুদ্র দেশের উপর ধ্বংস ও হত্যার স্মৃতিচিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে। তথাপি এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের আর্য্যবংশসম্ভূত অধিবাসীরা কোন প্রকারে তাহাদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষা করিয়াছে। বহু পরিবর্ত্তনের পর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে জর্জিয়া রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় ইহারা বিদ্রোহ করিয়া স্বাধীনতা উদ্ধারের চেষ্টা করে, কিন্তু সে বিদ্রোহ জার গভর্ণমেণ্ট সহজেই দমন করিয়া ফেলেন। স্বদেশের স্বাধীনতা লাভের অনির্ব্বাণ অনলশিখা একেবারে নিভিয়া না গেলেও জর্জিয়ার অধিবাসীরা জারের শাসনদণ্ডের নিকট মস্তক অবনত করিয়াছিল। জারীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল কোন সঙ্ঘবদ্ধ বিদ্রোহ হয় নাই। এই পরাধীন আত্মবিশ্বত জাতির মধ্য হইতেই ষ্ট্যালিনের আবির্ভাব।

 জর্জিয়ার এক ক্ষুদ্র সহর গোরীতে ১৮৭৯ সালে এক কৃষক পরিবারে ষ্ট্যালিন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা ভিসারিয়ান যুগাশ‍্ভিলি ছিলেন দারিদ্র্য-পীড়িত কৃষক। কৃষিকার্য্যে উদরান্নের সংস্থান হওয়া অসম্ভব দেখিয়া তিনি ঐ সহরে আসিয়া চর্ম্মকার বৃত্তি অবলম্বন করেন। পরে টিফ‍্ লিস্ সহরে এক জুতার কারখানায় যোগ দেন। তাঁহার মাতার নাম ক্যাথারিন। এই কঠোর পরিশ্রমী ধর্ম্মভীরু দম্পতির অভাবগ্রস্ত ক্ষুদ্র সংসারে শিশু ‘সোসো’র বাল্যজীবন কাটিয়াছে। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই পিতামাতা শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে চিন্তিত হইলেন এবং পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন যে ‘সোসো’ ধর্ম্মযাজক হইবে। সাত বৎসর বয়সে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিয়া ষ্ট্যালিন জর্জিয়ান ও রাশিয়ান ভাষা শিক্ষা করিতে লাগিলেন। লেনিনের মতই ষ্ট্যালিন পরিশ্রমী ও উৎসাহী ছাত্র ছিলেন এবং প্রত্যেক পরীক্ষায় সর্ব্বোচ্চ নম্বর পাইতেন। পাঠশালার শেষ পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হইয়া সার্টিফিকেট পাইয়াছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর, মাতাব সহিত টিফ‍্লিসে আসিয়া ১৪ বৎসর বয়সে (১৮৯৪) তিনি খৃষ্টান পাদ্রীদের স্কুলে ভর্ত্তি হইলেন। টিফ‍্লিস সহরে ইউরোপীয় শিক্ষা সংস্কৃতির প্রভাব সুপরিস্ফুট, ধর্ম্ম-পুস্তকের মধ্যেই তাঁহার চিত্ত. ও চিন্তা আবদ্ধ রহিল না; নব্য ইউরোপের নব নব চিন্তাধারা তাঁহাকে আকর্ষণ করিল। সংবাদপত্র, বিভিন্ন পুস্তিকা এবং শিক্ষিত যুবকগণের সহিত আলোচনার ফলে তিনি জর্জীয় জাতীয়তাবাদ ও বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হইলেন। ডারুইন ও মার্ক্সের চিন্তাধারা তাঁহার মনে গভীর রেখাপাত করিল। ষ্ট্যালিন নিজে বলিয়াছেন, “পনর বৎসর বয়সেই আমি বৈপ্লবিক আন্দোলনে যোগদান করি এবং ট্রান্স-ককেসিয়ার রুশীয় মার্কসপন্থী গুপ্তদলগুলির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়া পড়ি। এই দলগুলি আমার উপর অসামান্য প্রভাব বিস্তার করে এবং তাহার ফলে আমি নিষিদ্ধ সাহিত্য পাঠে অভ্যস্ত হইয়া উঠি।”

 টিফ‍্লিস্ বিদ্যালয়ে ধর্ম্মপুস্তক ছাড়াও তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তক পাঠ করিতেন। বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে নিষিদ্ধ পুস্তিকা ও ইস্তাহারাদি প্রবেশ করিতেছে সংবাদ পাইয়া ধর্ম্মযাজকগণ শঙ্কিত হইলেন। মাঝে মাঝে পুলিশ আসিয়া খানাতল্লাসী করিতে লাগিল। প্রথম যখন সমাজতন্ত্রী ও বৈপ্লবিক ইস্তাহারাদি বিলি হইতে থাকে তখন পুলিশ নূতন বিপদকে তেমন গ্রাহ্যের মধ্যে আনে নাই। কিন্তু সহসা পুলিসের পদ্ধতি পরিবর্ত্তত হইল; খানাতল্লাস, ধরপাকড় ও গ্রেপ্তার নবোদ্যমে চলিতে লাগিল। খৃষ্টান সাধুদের দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয়ে পুলিশের দৃষ্টি পড়িল। প্রথমে কেহই জোসেফ‍্কে সন্দেহ করে নাই। চারি বৎসরকাল ছাত্রাবাসে থাকিয়া তিনি ভবিষ্যতে পাদ্রী হইবার সাধনায় অধ্যয়নরত আছেন ইহাই সকলে মনে করিত। একদিন পুলিশ আসিয়া ছাত্রাবাস হইতে দুইজন ছাত্রকে বিপ্লবী সন্দেহে গ্রেপ্তার করিল। তাহাদের গৃহ হইতে বৈপ্লবিক পুস্তিকা পাওয়া গেল, ছাত্র মহলে একটা ক্ষুব্ধ রোষের সঞ্চার হইল। ষ্ট্যালিন গুপ্ত-সমিতির কাজ চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। মার্কসের “ক্যাপিটালের” মাত্র এক খণ্ড বই তাঁহাদের হাতে ছিল। উৎসাহী ছাত্ররা উহা নকল করিয়া নব নব পাঠচক্রে উহা আলোচনা করিতে লাগিল। ষ্ট্যালিন প্রবল পাঠানুরাগ লইয়া ইতিহাস ও সাহিত্যগ্রন্থ পাঠ করিতে লাগিলেন। সেক্সপীয়রের নাটকগুলির সহিত পরিচিত হইয়া ষ্ট্যালিন কাব্যচর্চ্চায় মজিলেন। স্থানীয় সাময়িক পত্রিকায় এই সময় তাঁহার কয়েকটি কবিতাও প্রকাশিত হয়। ১৮৯৮-এ ছাত্ররা নিজেদের হাতে লেখা সাময়িকপত্র বাহির করিল। এই কাজ করিতে গিয়াই প্রথম ষ্ট্যালিন সুদূর সেণ্ট পিটার্সবার্গে অবস্থিত লেনিনের লেখার সহিত প্রথম পরিচিত হন। যে দুই প্রতিভার মিলনে পরবর্ত্তীকালে পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ ভূমিতে অভূতপূর্ব্ব পরিবর্ত্তন হইয়াছিল—ইহাই তাহার সূচনা। ক্রমে কর্ত্তৃপক্ষ আবিষ্কার করিলেন, জোসেফের নেতৃত্বে ও পরিচালনায় ছাত্রদের মধ্যে বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদ প্রসারলাভ করিতেছে। ভিক্টর হুগোর উপন্যাস পড়িবার এবং ভ্রাম্যমান পাঠাগার হইতে পুস্তক লইবার অপরাধে ইতিপূর্ব্বেও তিনি দণ্ডিত হইয়াছিলেন। অবশেষে একদিন তাঁহারা ‘রাজনৈতিক কারণে’ তাঁহাকে ছাত্রাবাস হইতে তাড়াইয়া দিলেন। সমুন্নত শিরে জোসেফ্ সোজাসুজি শ্রমজীবিদের সহিত গিয়া মিলিত হইলেন, পশ্চাতে ফিরিয়াও চাহিলেন না। ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে তিনি রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স দলের টিফ‍্লিস্ শাখায় যোগদান করিলেন। এই বৎসরই রাশিয়ায় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের শাখা-সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জারীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র রাশিয়ায় যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় তাহা জার্জয়ান যুবকদিগকেও আলোড়িত করিয়াছিল এবং কেন্দ্রীয় গভর্ণমেণ্ট সর্ব্ববিধ উপায়ে, বিশেষভাবে নিষ্ঠুর অত্যাচার দ্বারা জাতীয়তাবাদ ও প্রজা বিদ্রোহ দমনে প্রবৃত্ত ছিলেন। স্বকীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা হইতে বঞ্চিত করিয়া পরাধীন জাতিগুলিকে বৈদেশিক সংস্কৃতি, সভ্যতার প্রভাবে অভিভূত করিবার কৌশল রুশ গভর্ণমেণ্ট অবলম্বন করিয়াছিলেন। “ককেসিয়ান্ জনসাধারণের আদালতে অভিযুক্ত হইবার অধিকার ছাড়া আর কোন অধিকার নাই”—ইহাই লোকে বলাবলি করিত। অবশ্য অস্ফূট আর্ত্তনাদ করিবার এবং মৃদু আপত্তি করিবার অধিকার তাহাদের ছিল; কিন্তু তাহা করিতে হইলে কেবলমাত্র রাশিয়ান্ ভাষায়ই তাহা করিতে হইত। এই অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই একটা জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ হইল। কিন্তু তাহার বাধা প্রচুর। ট্রান্স-ককেসিয়ায় (জর্জিয়া আর্ম্মেনিয়া এবং আজারবাইজান্) বহু বিভিন্ন গোষ্ঠির অস্তিত্ব ছিল। জর্জিয়ান্, আর্ম্মেনিয়ান, তুর্কী, ইহুদি, কুর্দ্দ এবং অন্যান্য পার্বত্য গোষ্ঠিগুলির মধ্যে এক রাশিয়ান্ পীড়নের ও দাসত্বের সার্ব্বজনিক চাপ ছাড়া আর কোন ঐক্য ছিল না। নিজেদের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, কলহের অন্ত ছিল না। এই সমস্ত বিভিন্ন গোষ্ঠিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া একদিকে যেমন জাতীয়দল গঠন করিবার চেষ্টা চলিতেছিল অন্যদিকে তাহার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনেরও সূচনা হইয়াছিল।

 ১৮৫৪-৫৬ সালের ক্রিমিয়ান্ যুদ্ধে রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয়ের পর জাতীয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দেশে একটা তীব্র প্রতিবাদ দেখা দিয়াছিল। প্রত্যেক যুদ্ধেই জনসাধারণের চিত্ত গভীরভাবে আলোড়িত হয়। পশ্চিম ইউরোপীয় প্রধান জাতিগুলির ক্ষিপ্র উন্নতি ও বিস্তারের তুলনায় জার-শাসিত রাশিয়া বর্ব্বরতা অজ্ঞতা ও ধর্মান্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। ফ্রান্স ও ইংলণ্ডের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার অনুকরণ প্রয়াসী রাশিয়ান্ শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর মধ্যে সংস্কার আন্দোলন দেখা দিল। এই সংস্কারপ্রয়াসী মধ্যশ্রেণীকে খুসী করিবার জন্য ১৮৬০ হইতে ১৮৬৯ সালের মধ্যে রুশ গভর্ণমেণ্ট কতকগুলি সংস্কার প্রবর্ত্তিত করিলেন। কৃষিক্ষেত্রে দাসপ্রথা লুপ্ত হইল, মিউনিসিপ্যাল স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হইল, বিচার বিভাগেরও কিছু সংস্কার সাধিত হইল। যদিও ঐ সকল সংস্কারে দেশময় একট! হৈ চৈ পড়িল, তথাপি দেখা গেল প্রচলিত ব্যবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয় নাই। দৃষ্টান্তস্বরূপ কৃষিক্ষেত্রে দাসপ্রথা লোপের কথাই ধরা যাউক। উহার পশ্চাতে দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্যের প্রতিকারের মনোবৃত্তি ছিল না। প্রথম উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক লাভ, দ্বিতীয় উদ্দেশ্য বড় বড় জোত্দার জমীদারের স্বার্থ, তৃতীয়তঃ রাজনৈতিক কারণ। স্বয়ং জার পর্য্যন্ত বলিয়াছিলেন, উপর হইতে কৃষকদিগকে মুক্তি দিবার কারণ এই যে তাহারা যেন নীচের দিক হইতে মুক্তির দাবী করিয়া আন্দোলনের সাফল্যের গর্ব্বে অহঙ্কত না হইয়া উঠে। রাষ্ট্রের সংস্কারের এই ব্যর্থতা হইতে “পপুলিষ্ট” আন্দোলনের সূচনা হয়। পশ্চিমে ইউরোপের নকল না করিয়া রাশিয়ান্ ঐতিহ্য ও পারম্পর্য্যের অনুসরণে পল্লী সমিতি ও শ্রমজীবি-সঙ্ঘ গঠিত হইল—এই পথে রাশিয়ার জনসাধারণ “ধনতন্ত্রের বেদনাময় পথে পরিভ্রমণ না করিয়াও” সমাজতন্ত্রবাদে উত্তীর্ণ হইবে। ১৮৭০ হইতে ১৮৮১ সাল পর্যন্ত ‘জমি ও স্বাধীনতা’, ‘জনসাধারণের স্বাধীনতা’ প্রভৃতি দাবীর ভিত্তিতে “পপুলিষ্ট” আন্দোলন বোমা এবং সন্ত্রাসবাদ দ্বারা রাশিয়ার সম্রাট, প্রাসাদ ও রাজশক্তিকে বিচলিত করিয়া তোলে। রাশিয়ার বাহিরে এই আন্দোলনকারীরা ‘নিহিলিষ্ট’ বলিয়া পরিচিত হন। ১৮৮১ সালে রুশ সম্রাট দ্বিতীয় আলেক‍্জাণ্ডারের হত্যাকাণ্ডের পর রুশ গভর্ণমেণ্ট ‘পপুলিষ্ট’ সঙ্ঘগুলি ধ্বংস করিয়া ফেলিল এবং ফলে সাহিত্যিকদের কল্পনায় ছাড়া উহার আর কোন অস্তিত্ব রহিল না।

 তরুণ বয়সে লেনিন ‘পপুলিষ্ট’ মহলে মেলামেশা করিতেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আলেকজাণ্ডার উলিয়ানফ্ ‘জনসাধারণের স্বাধীনতা’ আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই অপরাধে ১৮৮৭ সালে তিনি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। লেনিনের ভগ্নী মারিয়া উলিয়ানফ্ বলেন, যখন এই দুঃসংবাদ আসিল তখন সপ্তদশবর্ষীয় বালক ভ্লাডিমির ইলিচ (লেনিন) দূর দিগ‍্বলয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া অস্ফুট স্বরে বলিয়াছিলেন, “না, আমাদিগকে স্বতন্ত্র পথ বাছিয়া লইতে হইবে; এপথ আমাদের নহে।”

 এই স্বতন্ত্র পথ হইতেছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ। রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রাচীন আদর্শ, বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্যায় অধিকার কাড়িয়া লওয়া, সাম্য এবং সার্ব্বজনীন ভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি মতবাদের সংস্কার ও সামঞ্জস্য বিধান করিয়া কার্ল মার্কস্ ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সমাজতন্ত্রবাদকে এক নব রূপান্তর দান করেন। মার্কস‍্বাদের অভিনবত্ব হইল প্রাচীন সমাজতন্ত্রবাদের অযৌক্তিক আকাশকুসুম কল্পনা এবং ক্রম সংস্কার-মূলক ভীরু মৃদুমন্দ পদ বিক্ষেপের পরিবর্ত্তে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে রাজনীতি ও অর্থনীতির সমন্বয় এবং সমাজতন্ত্রবাদকে শ্রমিক আন্দোলনের সহিত মিলিত করিয়া দেওয়া। সমাজতন্ত্রবাদের এই অভিনব পরিবর্ত্তন পরবর্তীকালের রাজনৈতিক শ্রমিক আন্দোলনে বহু বাদ প্রতিবাদের পর সমাজতন্ত্রিগণ কর্ত্তৃক গৃহীত হইয়াছিল।

 সমাজতন্ত্রবাদ প্রথম হইতেই আন্তর্জাতিক আন্দোলন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম আন্তর্জাতিক মার্কস্ ও এঙ্গেলস্-এর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে স্থাপিত হয়। ইহা ‘সর্ব্বহারাদের সংঘর্ষের মূল ভিত্তিস্বরূপ একটা সুনিশ্চিত মতবাদের’ প্রতিষ্ঠা করে। ইহার উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকও প্রথম দিকে শ্রমিক আন্দোলনের পরিপুষ্টি ও বিকাশের সর্ব্বাঙ্গীন ও দূরপ্রসারী পথ প্রস্তুত করে। মার্কসীয় সমাজতন্ত্রীরা প্রথম হইতেই সন্ত্রাসপন্থী সমাজতন্ত্রীদের বিরোধী। তাঁহারা সন্ত্রাসবাদ বা গুপ্তহত্যামূলক ভীতি প্রদর্শনে বিশ্বাস করিতেন না। ব্যক্তিগত অন্ধ হিংসা আবেগের প্রাচুর্য্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং সর্ব্বদাই ভুল করিয়া বসে। এই নিষ্ফল পথের পরিবর্ত্তে মার্কসীয় সমাজতন্ত্রিগণ ঘোষণা করিলেন, শোষিত নির্য্যাতিতদের সঙ্ঘবদ্ধ করিতে হইবে, তাহাদের আত্মস্বার্থবোধ জাগ্রত করিতে হইবে। শৃঙ্খলার প্রতি অনুরাগ এবং বাস্তব কর্ম্মনীতির প্রতি শ্রদ্ধা দ্বারাই ইহা সম্ভব।

 মার্কস‍্বাদ রাশিয়ায় দ্রুত বিস্তার লাভ করিল, কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রাশিয়ায় একদিকে যেমন কলকারখানা গড়িয়া উঠিতেছিল অন্যদিকে তেমনি নিষ্ঠুরতা ও হিংসার ভারে সন্ত্রাসবাদীদলও আত্মদৌর্ব্বল্যে শতধা বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। লেনিন এই আন্দোলনে ঝাঁপ দিলেন। তিনি মার্কসবাদের অনুকূলে প্রচারকার্য্য করিতে গিয়া দেখাইলেন বিশৃঙ্খল চমকপ্রদ সন্ত্রাসবাদের মধ্যে একটা মোহময় আকর্ষণ থাকিলেও আসলে উহা প্রতিক্রিয়াশীলদের দুঃস্বপ্ন মাত্র। প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে আমরা শুনিয়াছি, ১৮৯৩ সালের মস্কোর এক গুপ্ত বৈঠকে ২৩ বৎসর বয়স্ক লেনিন মার্কসবাদীদের মুখপাত্ররূপে উপস্থিত থাকিয়া ‘পপুলিষ্ট’ সন্ত্রাসবাদীদলের তত্ত্ব-বিশ্লেষণকারী নেতা ভোরণ‍্শফের সহিত বাদে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন এবং জয়যুক্ত হইয়াছিলেন।

 ১৮৮৪ সালেই রাশিয়ায় সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল গঠিত হয়। ১৮৯১ সালের দুর্ভিক্ষের সময় এই দলের অগ্রগামী চিন্তানায়কগণ (প্লেখানফ্, এক্সেলরড্ প্রভৃতি) শ্রমজীবি শ্রেণীর সংস্পর্শে আসেন এবং অনেক সঙ্ঘ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৮ সালে মিন‍্স্ক কংগ্রেসে এই দলগুলি হইতে কেন্দ্রীয় সমিতি গঠিত হয়, কিন্তু এই দলের অধিকাংশ সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ায় কংগ্রেসের প্রস্তাব অনুযায়ী কার্য্য হইতে পারে নাই।

 লেনিন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলকে সঙ্ঘবদ্ধ করিবার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। ইহার নিয়মতন্ত্র ও গঠনতন্ত্র তিনি স্বহস্তে প্রস্তুত করিলেন। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তাঁহাকে যে কি কঠোর পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল তাহা বর্ণনাতীত। রুশীয় সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল অভিজাত শ্রেণীর প্রবল প্রতাপে মেষবৎ ভীরু দাসভাবাপন্ন রুশীয় জনসাধারণ অধঃপতনের চরমে পৌঁছিয়াছে। রোমানভ্ বংশের পাশবিক শাসনে সমগ্র রাশিয়া সন্ত্রস্ত। আরামে ও আয়েসে থাকিয়া যাঁহারা রাজনীতির বিলাস করেন তাঁহারা অধিকাংশই প্রতারক ও প্রবঞ্চক। মধ্যশ্রেণীর কি নেতা কি কর্ম্মী সকলেই জনসাধারণের প্রদত্ত চাঁদা লুঠ করিতে ব্যস্ত। সোণার ঘড়ি চেন দুলাইয়া তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা রুশ সরকারের অধীনে ক্ষমতার পদ পাইবার জন্য লোলুপ। এই অবস্থার মধ্যে যখন মার্কসবাদ আসিয়া রাশিয়ায় উপস্থিত হইল, সেই সময় ১৮৯৭ সাল হইতে জোসেফ্ ষ্ট্যালিন সেই সুরে তাঁহার জীবনের সুর মিলাইয়া লইলেন; এই বুদ্ধিমান সুগঠিত দেহ সৌম্যকাস্তি কৃষক-যুবক বিপ্লবীর জীবন বরণ করিলেন। টিফ‍্লিসের রেলওয়ে শ্রমজীবি, তামাকের কারখানার, জুতার কারখানার শ্রমজীবিদের মধ্যে তিনি বিচরণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অপেক্ষা দশ বৎসর বয়সে বড় লেনিন তখন রাশিয়ার মর্ম্মকেন্দ্রে বসিয়া বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিতেছিলেন। অতীতের বিপুল ধ্বংসস্তুপ বিপ্লবের চিতা চূল্লীতে দগ্ধ করিয়া রাশিয়া নবজন্ম লাভ করিবে এই চিন্তা ছাড়া তাঁহার কোন চিন্তা ছিল না। এই সময় শ্রমজীবিদের বন্ধু “সোসো” লেনিনের নাম শুনিয়াছিলেন এবং তাঁহার রচনা পাঠ করিয়াছিলেন; কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরস্পরের সহিত পরিচিত হন নাই।

 রাশিয়ার ইতিহাসের এই দুঃসময়ে কোন দিকেই আশার চিহ্ন ছিল না এবং রাজনৈতিক কার্য্যক্ষেত্র অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। সশস্ত্র বিদ্রোহ তখন কল্পনার অভীত বিষয়; বে-আইনী পুস্তিকা ও বিবৃতি গোপন ছাপাখানায় মুদ্রণ, শ্রমজীবিদের মধ্যে তাহা বিতরণ, নূতন সদস্য সংগ্রহ এবং এই সকল কাজের জন্য ধৃত ও বিচারাধীন সদস্যদের আদালতে পক্ষ সমর্থনের জন্য অর্থ সংগ্রহ—ইহার মধ্যেই দলের কার্য্য আবদ্ধ ছিল। রুশ গভর্ণমেণ্ট সর্ব্ববিধ ব্যক্তি-স্বাধীনতা দমন করিয়াছিলেন, সংবাদপত্রে সরকারী অনুমোদিত সংবাদমাত্র প্রকাশিত হইতে পারিত। প্রকাশ্যভাবে কোন দলের বা মতের প্রচার কার্য্য সংবাদপত্রে চলিত না। এই কালে ষ্ট্যালিনের সহকর্ম্মী ওরাখেলাস‍্ভিলি লিখিয়াছেন, “তাঁহার (ষ্ট্যালিন) সহিত একত্র হইয়া আমরা এক প্রচারক দল গড়িয়াছিলাম। আমাদের মগজে ছিল পুঁথিগত বিদ্যা এবং তাহার বাঁধাবুলি, যখন আমরা কৃষক বা শ্রমিকদের মধ্যে বক্তৃতা করিতাম তখন ঐ সকল দুর্ব্বোধ্য বাঁধা বুলির মোহ কিছুতেই কাটাইয়া উঠিতে পারিতাম না; কিন্তু ষ্ট্যালিনের বক্তৃতা প্রণালী ছিল স্বতন্ত্র। তিনি ঠিক বিপরীত দিক হইতে অর্থাৎ বাস্তব জীবনের দিক হইতে বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করিতেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে তিনি তুলনামূলক বিচারকালে দেখাইতেন, মধ্যশ্রেণীর গণতন্ত্রবাদ জারতন্ত্র হইতে উত্কৃষ্ট হইলেও কেন তাহা সমাজতন্ত্রবাদের তুলনায় মন্দ। শ্রোতাগণ সকলেই বুঝিত যে, গণতন্ত্রের আদর্শ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস করিতে সমর্থ হইলেও ইহা একদিন সমাজতন্ত্রবাদের বিরুদ্ধে প্রকাণ্ড বাধা স্বরূপ হইয়া দাঁড়াইবে এবং উহাকেও ধ্বংস করিতে হইবে। তিনি কখনও প্রতিপক্ষকে গালাগালি করিতেন না। আমরা বক্তৃতা বা আলোচনাকালে মেনশেভিকদিগকে তীব্র ভাষায় প্রত্যক্ষভাবে আক্রমণ করিয়া বসিতাম। ষ্ট্যালিন ইহার পক্ষপাতী ছিলেন না। উগ্র ও হিংস্র ভাষা তিনি পরিহার করিয়া চলিতেন। ধীরভাবে যুক্তি দ্বারাই তিনি প্রতিপক্ষকে নিরস্ত ও নিরুত্তর করিতেন।”

 গুপ্ত প্রচারকের যে জীবন তিনি সহকর্মীদের সহিত গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা বিঘ্নসঙ্কুল ইহা বলাই বাহুল্য। গোয়েন্দা পুলিশ সর্ব্বদা পিছনে লাগিয়া আছে, জার শাসনযন্ত্র পিষিয়া মারিবার জন্য সর্ব্বদা প্রস্তুত। কারাগার, ফাঁসিকাষ্ঠ এবং সাইবেরিয়ার অরণ্যে নির্ধ্বাসন সর্ব্বদাই সূত্র-বিলম্বিত তরবারির মত মাথার উপর ঝুলিতেছে। এই অবস্থায় কাজ করিতে হইলে যে নিটোল স্বাস্থ্য, ধৈর্য্য, কঠিন সাহস এবং ক্ষিপ্রকারিতার প্রয়োজন হয় ষ্ট্যালিনের তাহা ছিল। আহার নিদ্রার কোন নির্দ্দিষ্ট সময় তাঁহার ছিলনা। নৈরাশ্যের সহিত, পরাজয়ের সহিত সর্ব্বদাই তাঁহাকে যুদ্ধ করিতে হইত। অস্ত্রবল-সহায় বিপুল জার সাম্রাজ্যের শক্তির সম্মুখে মুষ্টিমেয় যুবক বিপ্লবী কি করিবে? কিন্তু ষ্ট্যালিন মার্কসবাদের নির্ম্মল বারি অঞ্জলি ভরিয়া পান করিয়াছিলেন। ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়া যে বিরুদ্ধতা সমাজ ও রাষ্ট্র বহন করিতেছে সেই অসামঞ্জস্যের পরিসমাপ্তি অবশ্যম্ভাবী। মার্কসবাদ তাঁহার নিকট কোন জটিল তত্ত্ব ছিলনা, তিনি ইহাকে একটী সরল কার্যপ্রণালীরূপে বিশ্বাস করিতেন— যাহা আপন বলে পথ কাটিয়া মানবের মুক্তি আনয়ন করিবে। মার্কসবাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক অতীন্দ্রিয় রহস্য অথবা ভাবুকের কল্প-স্বর্গ বলিয়া কিছু নাই। মার্কসীয় পদ্ধতি ঐতিহাসিক কার্য্য-কারণ-শৃঙ্খলা অনুসন্ধান করিয়া সত্য ও বাস্তবের দৃষ্টিতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যার মীমাংসার চেষ্টা করে। এই কারণেই মার্কসবাদীদের পরিকল্পনা বৈজ্ঞানিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁহারা কখনও বিরক্ত বা সংশষাকুল হন না। এখানে তথাকথিত অন্ধ বিশ্বাসের স্থান নাই। অতীতের অন্যান্য বিপ্লবীদলের সহিত মার্কসবাদীদের ইহাই পার্থক্য। তাঁহারা ব্যক্তিগত আক্রোশ, অসূয়া বা ভাবাবেগের দ্বারা চালিত হন না। ব্যক্তিগতভাবে কোন ধনী সম্রাট বা শাসনকর্ত্তা কি করিলেন, কি বলিলেন তাহা তাঁহাদের চিত্তে অতি অল্প প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে। সমালোচকের নিরপেক্ষ দৃষ্টি লইয়া তাঁহারা সামাজিক শক্তিগুলিকে বিচার করেন এবং এই বিচারের সিদ্ধান্ত তাঁহাদিগকে বিপ্লবী করে। ইহার মধ্যে ঘৃণা উত্তেজনা এবং ঔদার্য্যের স্থান নাই। সামাজিক অবিচার স্বাভাবিকভাবেই তাঁহাদের নিকট অসহনীয় বোধ হয়। মানুষের মন দুর্জ্ঞেয় ও দুরবগাহ, সাধারণভাবে তাহা অন্যায়, অবিচার, পীড়নের প্রতি বীতরাগ হইলেও একপ্রকার সামঞ্জস্য করিয়া লয়; কিন্তু মার্কস‍্পন্থী এই সামঞ্জস্যমূলক প্রতীক্ষায় বিশ্বাসী নহে। সে ভাঙ্গিতে চায়, গড়িতে চায়, মানব জাতির কল্যাণময় পরিণাম সম্বন্ধে তাহার যথেষ্ট ভাবাবেগ থাকিলেও সে কখনই বিচার-বুদ্ধিকে আবেগ দ্বারা আচ্ছন্ন করে না। সাধারণতঃ অনেকের ধারণা যে মানুষ অত্যাচার-পীড়িত হইয়া বিপ্লবী হয়; কিন্তু ষ্ট্যালিনের জীবনে ইহা মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে।

 বিখ্যাত জার্ম্মাণ সাহিত্যিক এমিল লুড‍্উইক্ কয়েক বৎসর পূর্ব্বে ষ্ট্যালিনকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “সম্ভবতঃ আপনি বাল্যকালে পিতামাতার নিকট অত্যন্ত দুর্ব্যবহার পাইয়াছিলেন বলিয়। এরূপ বিপ্লবী হইয়াছেন।” এমিল লুড‍্উইক্ শ্রেণীর অমায়িক ভদ্রলোকেরা সকল দেশেই এইরূপ তথ্য আবিষ্কার করিবার চেষ্টা করেন। বিপ্লবীর জীবন ভাগ্যবিড়ম্বনায় তিক্ত অথবা কিশোর বয়সে নির্দ্দয় পিতামাতা কর্ত্তৃক পীড়িত হওয়া আবশ্যক এই শ্রেণীর দুর্ব্বল যুক্তি প্রতিবাদের অযোগ্য। অবশ্য ব্যক্তি ও জাতি সময় সময় দুর্ভাগ্য ও পীড়নে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়াছে; কিন্তু যে বিপ্লবী সর্ব্বমানবের উন্নতির সুনিশ্চিত বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার সন্ধান পাইয়াছে, সে কখনও ব্যক্তিগত অসন্তোষ দ্বারা চালিত হয় না। লুড‍্উইকের প্রশ্নে ষ্ট্যালিন শান্তভাবে উত্তর দিয়াছিলেন, “আপনার ধারণা ভুল, আমার পিতামাতা কখনও অসদ্ব্যবহার করেন নাই। আমি যে বিপ্লবী হইয়াছিলাম তাহার কারণ অতি সরল, আমার মনে হইয়াছিল মার্কসপন্থীরাই ঠিক পথ বাছিয়া লইয়াছে।”

 এই সময় লেনিনের সহকর্ত্রী এবং ট্রান্স-ককেসিয়ায় তাঁহার মতবাদ প্রচারকারী কুরনাটভোস্কির দ্বারা ষ্ট্যালিন প্রভাবান্বিত হন। ইহার নিকট ষ্ট্যালিন লেনিনের পরিচয় পান এবং বুঝিতে পারেন যে লেনিনই মার্কসবাদ ঠিক ঠিক প্রচার করিতেছেন এবং তদনুযায়ী কার্য্য করিতেছেন। এই সময় ষ্ট্যালিন সম্পূর্ণরূপে নিঃস্ব ছিলেন। ১৯০০ খৃষ্টাব্দে আমরা দেখি অন্নবস্ত্রের অভাব সহকর্মীদের সাহায্যে পূরণ করিয়া ষ্ট্যালিন টিফ‍্ লিসে শ্রমিকদের মধ্যে কার্য্য করিতেছেন। প্রতি সন্ধ্যায় তাঁহাকে ৭৷৮টী গুপ্ত বৈঠকে যোগদান করিতে হইত। তিনি সভায় সহসা উপস্থিত হইতেন, চুপ করিয়া বসিয়া সকলের কথা শুনিতেন এবং সকলের কথা শুনিবার পর নিজের যাহা বলিবার বলিতেন। তাঁহার পশ্চাতে তখন গোয়েন্দা লাগিয়াছে, কাজেই দুই তিন জন সহকর্ম্মী লইয়া তাঁহাকে সাবধানে বিচরণ করিতে হইত। স্থানীয় জনৈক সঙ্গতিপন্ন রাজভক্তের এক প্রকাণ্ড পুস্তকালয় ছিল, সেইখানে যুবক বিপ্লবীরা পড়িবার ভাণ করিয়া সম্মিলিত হইতেন এবং নিষিদ্ধ সংবাদাদি আদান প্রদান করিতেন। এইখানে বসিয়াই ষ্ট্যালিন জাল পাসপোর্ট দিয়া দুইজন সহকর্ম্মীর পলায়নের সহায়তা করেন এবং তাঁহারা পুলিশের দৃষ্টি এড়াইয়া পলায়ন করিতে সমর্থ হন। কিন্তু তিনি সব সময় পলাইয়া বেড়াইতেন না, প্রয়োজন হইলে তিনি প্রকাশ্য রাজপথে আসিয়া দাঁড়াইতেন। ১৯০১ সালে ককেসাসে প্রথম ‘মে ডে’ অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনি তাহাতে যোগ দেন। ১৯০০-০১ সালে কতকগুলি বড় বড় ধর্ম্মঘট হয়, ষ্ট্যালিন এই সকল ধর্ম্মঘটের পশ্চাতে ছিলেন। টিফ‍্লিস রেলওয়ে ধর্ম্মঘটীদের বিরাট শোভাযাত্রার অগ্রভাগে তিনি ছিলেন; পুলিশ কর্ম্মচারী আসিয়া যখন হুকুম দিলেন যে এই মুহূর্ত্তেই তাহাদের ছত্রভঙ্গ হইতে হইবে তখন ধর্ম্মঘটীদের নেতারূপে ষ্ট্যালিন উত্তর দিলেন, “আমাদিগকে ভয় দেখাইও না, আমাদের দাবী পূর্ণ হইলেই আমরা ছত্রভঙ্গ হইব।” বলাবাহুল্য পুলিশ শোভাযাত্রার উপর চড়াও হইল এবং মার খাইয়া নিরস্ত্র জনতা ছত্রভঙ্গ হইয়া গেল। কর্তৃপক্ষ কঠোর দমননীতি অবলম্বন করিলেন, টিফ‍্লিসের সোস্যাল ডেমোক্রেটিক কমিটি বে-আইনী বলিয়া ঘোষিত হইল এবং শ্রমিক আন্দোলন সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপারই নিষিদ্ধ হইয়া গেল।

 ষ্ট্যালিন দক্ষিণ জর্জিয়ার বাটুম্ আজারীস্থান প্রভৃতি অঞ্চলে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন এবং প্রত্যেক স্থানে কমিটি গঠন করিতে লাগিলেন। পুলিশ তাঁহার পিছু লইল এবং তাঁহার সহিত ভ্রাম্যমাণ গুপ্ত ছাপাখানাটী খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। একদিন এক মিছিলের পুরোভাগে ষ্ট্যালিনকে দেখা গেল। পুলিশ সংবাদ পাইয়া জনতার গতিরোধ করিয়া গুলি চালাইল, ১৪ জন নিহত ৪৯ জন আহত এবং ১৫০ জন গ্রেপ্তার হইল। ষ্ট্যালিন তাঁহার গুপ্ত ছাপাখানা লইয়া সরিয়া পড়িলেন। নিকটবর্ত্তী এক মুসলমান কবরখানায় তিনি এবং তাঁহার সহকর্ম্মীরা সমবেত হইতেন ও গুপ্ত পরামর্শ করিতেন। একদিন কসাক্ সৈন্য সহ তাঁহার অনুসন্ধানরত পুলিশের হাতে ষ্ট্যালিনের ধরা পড়িবার উপক্রম হইয়াছিল। সৌভাগ্যক্রমে পার্শ্বে এক ভুট্টার ক্ষেত ছিল, তাহার মধ্যে প্রবেশ করিয়া ষ্ট্যালিন কোনমতে বাঁচিয়া যান। এই সময় কাসিম নামক জনৈক সরলহৃদয় মুসলমান কৃষকের সহিত তাঁহার পরিচয় হয়। এই বৃদ্ধ কৃষক এবং তাহার পুত্র ক্ষুদ্র ছাপাখানাটী ও কয়েক ভাঁড় সিসার অক্ষর তাহাদের বাড়ীতে লইয়া আসিলেন এবং ষ্ট্যালিনকে আশ্রয় দিলেন। ক্রমে বোর্খা পরিহিত কয়েকজন মুসলমান মহিলা গ্রামে দেখা দিলেন। ইহারা আসলে স্ত্রীলোক নহেন, স্ত্রীলোকের বেশে ছাপাখানায় কাজ করিতেন। কাসিম ক্রমে ষ্ট্যালিনের ভক্ত হইয়া পড়িলেন। তিনি বলিতেন, “আমি তোমাকে চিনিয়াছি, তুমি বীর, বজ্র ও বিদ্যুতের সহযোগে তোমার জন্ম। তুমি যেমন হৃদয়বান তেমনি কর্মী।” ইহার পরেই দেখা গেল কাসিম সকাল বেলায় পাগড়িটা পরিয়া বাহির হইয়া যান, তাঁহার মাথা শাক‍্সব্জী ও ফলের ঝুড়ি। ঝুড়ির ভিতর ফলের নীচেই থাকিত গুপ্ত ইস্তাহার এবং প্রচার পুস্তিকা। তিনি সহরের কারখানার দরজায় গিয়া ফল ও সব্জী বিক্রয় করেন এবং বাছা বাছা লোকের হাতে নিষিদ্ধ কাগজে মোড়া ফল তুলিয়া দেন। কাসিমের বাড়ীর যে ঘরে ছাপাখানা চলিত তাহার শব্দ ক্রমে গ্রাম্য কৃষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল কাসিমের ঘরে বসিয়া সোসো টাকা জাল করিতেছে। জাল টাকা তৈয়ারী করা অত্যন্ত কঠিন কাজ, সহজেই কৃষকেরা চমৎকৃত হইল। একদিন সন্ধ্যায় তাহারা আসিয়া ষ্ট্যালিনকে বলিল, “তুমি জাল টাকা তৈয়ারি করিতেছ, অবশ্য আমাদের মত গরীবের পক্ষে কাজটা একেবারে মন্দ নহে। ইহাতে আমাদেরও কোন বিপদের সম্ভাবনা নাই; কিন্তু তুমি টাকা চালাইবার কি ব্যবস্থা করিতেছ?”

 ষ্ট্যালিন উত্তর দিলেন, “আমি জাল টাকা তৈয়ারি করি না, একটা ছোট ছাপাখানায় তোমাদেরই দুঃখ দুর্দশার কথা লেখা বই ছাপাই।”

 কৃষকেরা আনন্দিত হইয়া বলিল, “বড় আনন্দের সংবাদ, টাকা তৈয়ারীর ব্যাপারে আমরা তোমাকে কোন সাহায্যই করিতে পারিতাম না, আমরা উহা জানিও না, কিন্তু আমাদের দুঃখের কথা আমরা বুঝি। আমরা তোমাকে কৃতজ্ঞতার সহিত সাহায্য করিব।”

 এইখানে ১৯১৭ সালের একটা কথা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। কাসিম তাহার বাগানে সেই গুপ্ত ছাপাখানাটি পুঁতিয়া রাখিয়াছিল। ১৯১৭ নভেম্বর বিপ্লব অবসানে সে যখন গৃহে ফিরিয়া আসিল, তখন দেখিল যে সৈনিকেরা তাহার গৃহ অধিকার করিয়াছিল তাহারা ছাপাখানাটী বাহির করিয়া ইতস্ততঃ ছড়াইয়া রাখিয়া গিয়াছে। কাসিম সযত্নে খণ্ডগুলি একত্র করিয়া সগর্ব্বে তাঁহার পুত্রকে দেখাইয়া বলিয়াছিলেন, “দেখ বাবা এই ছোট যন্ত্রটা দিয়াই প্রথম বিপ্লব আরম্ভ হয়।”

 এইবার ১৯০২ সালের এপ্রিল মাসে ফিরিয়া আসা যাউক। একদিন ষ্ট্যালিন এক বন্ধুর আলয়ে বসিষা ধূমপান করিতেছেন এমন সময় পুলিস বাড়ী ঘিরিয়া ফেলিল। ষ্ট্যালিন প্রশান্ত চিত্তে বসিয়া ধূমপান করিতে লাগিলেন। আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। ষ্ট্যালিন গ্রেপ্তার হইয়া বাটুমে কারারুদ্ধ হইলেন। পরে তাঁহাকে কুটাইস জেলে বদলী করা হয়। এই জেলে কয়েদীদের ধর্ম্মঘটের নেতৃত্ব করায় ষ্ট্যালিন সাইবেরিয়ার ইরখুটস্ক প্রদেশে নির্ব্বাসিত হইলেন। জারতন্ত্র সাইবেরিয়ার জনবিরল সুবিস্তীর্ণ গিরি-অরণ্য, নদী-কান্তারে দুর্গম প্রদেশের অর্থ নৈতিক উন্নতির কোন চেষ্টা করে নাই, স্থানে স্থানে শুধু বন্দীশালা এবং কয়েদীদের উপনিবেশ (আন্দামানের মত) স্থাপন করিয়াছিল। এখানে জারীয় পুলিস ও কারারক্ষীরা বন্দীদের প্রতি অমানুষিক অত্যাচার করিত। বন্দীশিবির হইতে পলায়ন এবং মৃত্যুবরণ একই কথা ছিল।

 তথাপি একদিন দেখা গেল সৈনিকের পোষাক পরিহিত এক যুবক বাটুমে উপস্থিত হইয়াছেন। পুলিসের পাহারা এড়াইয়া মধ্য এশিয়ার দুর্গম গিরি অরণ্য অতিক্রম করিয়া যিনি আসিয়াছেন তিনি আর কেহ নহেন—ষ্ট্যালিনষ্ট্যালিনের চিরশত্রু “বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রী” সাইমম্ ভেরেশচাক ১৯০৩ খৃষ্টব্দে লিখিয়াছেন—তিনি ১৯০৩ সালে ষ্ট্যালিনের সহিত বাকু জেলে ছিলেন। চারিশত কয়েদীর জন্য তৈয়ারী ঐ জেলে পনরশত কয়েদীকে খোঁয়াড়ের পশুর মত আটকাইয়া রাখা হইয়াছিল। একদিন বলশেভিকদের জন্য নির্দ্দিষ্ট সেলে একটী নূতন মুখ দেখা গেল। সকলেই বলাবলি করিতে লাগিল কোবা আসিয়াছে। ষ্ট্যালিন জেলে আসিয়াই কতকগুলি পাঠ-চক্র স্থাপন করিলেন এবং কয়েদীদিগকে মার্কসিজ‍্ম্ শিক্ষা দিতে লাগিলেন। বক্তৃতা করা অপেক্ষা ব্যক্তিগত আলোচনাই ষ্ট্যালিন পছন্দ করিতেন। “বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রীর।” প্রায়ই তর্কে প্রবৃত্ত হইয়া হাতাহাতি করিয়া বসিত। ইহাদের পারস্পরিক কলহ ভঞ্জন করিতে গিয়া ষ্ট্যালিন যুক্তিতর্ক দ্বারা অনেককে বলশেভিক দলে ভিড়াইতে সক্ষম হইয়াছিলেন। জেলে অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং কঠোর ব্যবস্থার ফলে বহু রাজনৈতিক বন্দী পীড়িত হইয়া পড়েন। ষ্ট্যালিনের সুগঠিত দেহে ক্ষয়রোগের লক্ষণ দেখা দিল। এই ক্ষয়রোগ হইতে তিনি আশ্চর্য্যরূপে আরোগ্য লাভ করেন। তিনি যখন সাইবেরিয়ায়, তখন মুক্ত প্রান্তরে একদিন অকস্মাৎ তুষার ঝটিকা আরম্ভ হইল। এইরূপ ঝটিকা আরম্ভ হইলে লোকে আত্মরক্ষার জন্য শুইয়া পড়িয়া বরফের নীচে আশ্রয় লয়। কিন্তু ষ্ট্যালিন এক জমাট নদীর উপর দিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। দুই মাইল পথ অতিক্রম করিয়া নিকটতম কুটীরে আসিতে তাঁহার কয়েক ঘণ্টা সময় লাগিয়াছিল। অবশেষে তিনি যখন কুটীরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন তখন লোকেরা সেই তুষারাবৃত দেহ দেখিয়। তাঁহাকে মনুষ্যেতর জীব বলিয়া ভ্রম করিল। অবশেষে তাহারা যখন বুঝিল যে জন্তুটী মানুষ তখন হাত পা মুখ হইতে বরফ ঝাড়িয়া ফেলিয়া তাঁহার পরিচর্য্যা করিল। ক্লান্ত ষ্ট্যালিন অচৈতন্য হইয়া পড়িয়া গেলেন এবং একাদিক্রমে আঠার ঘণ্টা কাল নিদ্রিত রহিলেন। তাঁহার এই দুঃসাহসের ফলে তিনি চিরতরে ক্ষয়রোগ হইতে আরোগ্য লাভ করিলেন। সাইবেরিয়ার রীতিই এই। সাইবেরিয়ার দুরন্ত শীতে যদি কোনক্রমে ক্ষয়রোগীর মৃত্যু না হয় তাহা হইলে সে চিরদিনের মত আরোগ্য লাভ করে। ইহার মাঝামাঝি কিছু নাই। শীত হয় রোগ, নয় রোগীকে শেষ করে।

 ১৯০৩ সালে কারাগারে ষ্ট্যালিন শুনিতে পাইলেন যে সোশাল ডেমোক্রেটিক দলে দলাদলি দেখা দিয়াছে। লেনিনের নেতৃত্বে চালিত বলশেভিক দল হইতে মেনশেভিক দল স্বতন্ত্র হইয়া গিয়াছে। বলশেভিকেরা ছিল চরমপন্থী—আপোষহীন শ্রেণী সংগ্রামের তাহারা ছিল অপরাহত যোদ্ধা। পক্ষান্তরে মেনশেভিকরা সংস্কারপন্থী, সামঞ্জস্য স্থাপনে উন্মুখ এবং অন্যান্য দলের সহিত আপোষ করিয়া চলিতে ওস্তাদ। মেনশেভিকরা বলশেভিকদের ক্রমবর্দ্ধিত দাবীর বিরোধিতা করিতে লাগিলেন; ফলে ভেদ বৃদ্ধি পাইয়া অবশেষে দুই দল বিচ্ছিন্ন হইল। জারের ক্ষমতা তখন অপ্রতিহত। রাজনৈতিক আন্দোলন দমন ও কর্ম্মীদের নির্য্যাতন, নির্ব্বাসন, বহিষ্কার পূর্ণ প্রতাপে চলিতেছে। কলকারখানার মালিকেরা নিরুপায় শ্রমিকদিগের খাটাইয়া প্রভূত বিত্ত সঞ্চয় করিতেছে—এই সময় আদর্শের নামে বিরোধ ও ভেদ দেখিয়া অনেক বাস্তববাদী বিলাপ করিতে লাগিলেন; কিন্তু লেনিন টলিলেন না এবং ষ্ট্যালিনও সংশয়রহিত চিত্তে লেনিনের নেতৃত্বের উপর বিশ্বাস অটুট রাখিলেন। কারাগারে সত্য সংবাদ পাওয়া কঠিন। গুজব এবং অতিরঞ্জিত যে সব কাহিনী শোনা যায় বিষণ্ণ বন্দীজীবনের উপর তাহার প্রতিক্রিয়া যে কি দুর্ব্বিষহ ভুক্তভোগী ভিন্ন তাহা আর কেহই বুঝিতে পারিবেনা। এমনি চিন্তা সঙ্কটের মধ্যে পড়িয়া ষ্ট্যালিনের চিত্তে ঝড় উঠিল। তিনি বুঝিলেন তাঁহার কর্ম্মজীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য চিরদিনের মত স্থির করিবার দিন আসিয়াছে। ষ্ট্যালিন অনুকূল প্রতিকূল যুক্তিগুলি চিন্তা করিতে লাগিলেন। সংস্কার সহজেই মানুষের মনকে মুগ্ধ করে। ইহার মধ্যে বিজ্ঞজনোচিত সতর্ক সাবধানতা আছে এবং মনে হয় কিছু বিলম্ব হইলেও রক্তপাত ব্যতীতই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে। কিন্তু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি—যাঁহাদের সমাজ বিবর্তনের সহিত পরিচয় আছে, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা হইতে তাঁহারা জানেন যে পরনির্ভরশীল সুবিধাবাদ ও আত্মপ্রত্যয়হীন সংস্কারপন্থা মরীচিকা মাত্র। এই মায়াজালে আটকাইয়া অনেকেই রাজনীতিক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতক সাজিয়াছে এবং ধ্বংস হত্যাকাণ্ডের সহায়ক হইয়াছে। স্তরে স্তরে নিয়মতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হওয়ার মনোবৃত্তি প্রতিক্রিয়াশীল রক্ষণশীলতা ছাড়া কিছুই নহে। ষ্ট্যালিন তাঁহার পথ বাছিয়া লইলেন।

 ষ্ট্যালিনের পলায়নের পর পুলিসের গুপ্তচরগণ তাঁহাকে বেড়াজালে ঘিরিয়া ফেলিল। ইতিমধ্যে—তিনি অন্ততঃ ছয়বার ধরা পড়িয়া পুলিসের চোখে ধূলি দিয়া পলাইয়া যান। ষষ্ঠবার পলায়ন করিয়া তিনি জর্জিয়ান মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য্য শুরু করিলেন। ১৯০৪-০৫ এই সময় আমরা তাঁহাকে ককেসিয়ান্ বলশেভিক দলের নেতারূপে মেনশেভিক দলের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য্যে ব্যাপৃত দেখিতে পাই।

 একদিন একজন শ্রমিক তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কমরেড্ সোসো, তুমি যাই বল দলের মধ্যে মেনশেভিকরাই সংখ্যায় বেশী।” ষ্ট্যালিন উত্তর দিলেন, “সংখ্যায় বেশী? আয়তন অপেক্ষা গুণ অনেক বড়। কয়েক বৎসর অপেক্ষা কর, দেখিবে কাহারা ভুল পথে চলিয়াছে আর কাহারা সত্য পথ বাছিয়া লইয়াছে।”

 জনৈক ঐতিহাসিক লিখিয়াছেন, “রাশিয়ান বলশেভিকদের সৌভাগ্য যে পনর বৎসর কাল তাহারা এইভাবে নৈষ্ঠিক শৃঙ্খলা রক্ষা করিয়া মত ও পথ পরিবর্ত্তনকারীদের সহিত সংগ্রাম করিয়াছেন। তাঁহাদের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার সাফল্যের মর্ম্মকথা ইহাই।”

 বলশেভিকরা এনার্কিষ্ট, বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রী (সন্ত্রাসবাদী) এবং জাতীয়তাবাদী এই তিন দল এবং সঙ্গে সঙ্গে মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে সমানে প্রচার কার্য্য চালাইয়াছেন এবং সভা সমিতি সংবাদপত্রে ঐসকল দলের ভুল ও ত্রুটি উদ্ঘাটন করিয়া জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। এইকালে ষ্ট্যালিন ‘সর্ব্বহারার যুদ্ধ’ নামক একখানি বেআইনী পত্রিকার সম্পাদনা করিতেন এবং জর্জিয়ান ভাষায় কতকগুলি পুস্তিকা রচনা করেন। ষ্ট্যালিনের প্রভাবে শ্রমিক আন্দোলন নূতন পথ ধরিয়া চলিল। বলশেভিক মতবাদ দ্রুত প্রসার লাভ করিল, আবার সভা সমিতি মিছিল পূর্ণোদ্যমে চলিতে লাগিল। “গৃহহীন, পারিবারিক জীবনহীন” ষ্ট্যালিনের কেবল চিন্তা—ভাবী গণ-বিপ্লব।