ষ্ট্যালিন/দুই
দুই
লেনিন সমাজতন্ত্রবাদকে ঢালিয়া সাজিলেন। গণ-বিপ্লবের পতাকাবাহী লেনিন দলের মধ্যে মতভেদ ও বিরুদ্ধতা দেখিয়া শঙ্কিত হইলেন না। একদিকে জার শাসনতন্ত্রের পীড়ননীতি অন্যদিকে মেনশেভিক দলের জোড়াতালি-দেওয়া মিলন-প্রচেষ্টা এ দুইকেই সহ্য ও উপেক্ষা করিয়া লেনিন বলশেভিক দলকে সঙ্ঘবদ্ধ ও শক্তিশালী করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বাধা বিপত্তি প্রচুর, এমনকি সহকর্ম্মীরাও সংশয়সঙ্কুল। আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সহিত কর্ম্মপন্থার সামঞ্জস্য হইল রাজনৈতিক দলের মিলনের ভিত্তি। যেখানে উহার অভাব সেখানে একটা সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে কল্পিত ঐক্য লইয়া সকলের সহিত মিলিয়া মিশিয়া কাজ করিতে গেলে পরিণাম শুভ হয় না। লেনিনের এই সিদ্ধান্ত ষ্ট্যালিন অপ্রতিবাদে মানিয়া লইলেন। অবশ্য কখনও কোন ক্ষেত্রে লেনিনের সহিত ষ্ট্যালিনের মতভেদ ঘটে নাই। অন্যদিকে দলের মধ্যে একদল লোক লেনিনের প্রতিবাদী হইয়া দাঁড়াইলেন। বিশেষভাবে মেনশেভিক ট্রট্স্কি তাঁহার বাগ্মীতা ও অনমনীয় দৃঢ়তা লইয়া লেনিনকে বাধা এবং তাঁহার মতবাদ খণ্ডন করিতে লাগিলেন। ট্রট্স্কির যুক্তি ছিল এই যে মতবাদ ও কর্ম্মপদ্ধতির অতিনিদিষ্টতা বলশেভিকদের পঙ্গু ও বন্ধ্যা করিয়া তুলিবে। ট্রট্স্কির মতে লেনিন শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে ভেদ ও আত্মকলহের প্রশ্রয় দিতেছেন। কিন্তু অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিপ্লবী লেনিন কিছুতেই কোন আপাত: সুবিধার জন্য মার্ক্সবাদকে বিকৃত করিতে সম্মত হইলেন না। সমসাময়িক কালে লেনিন একমাত্র ব্যক্তি যিনি মার্ক্সবাদকে বাস্তব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রয়োগ করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলেন। সাম্যবাদ যে বিপ্লবে রূপান্তরিত হইয়া প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ইহা লেনিনের প্রতিভার এক অপূর্ব্ব দান। অবশ্য তিনি পূর্ব্ব-নির্দ্দিষ্ট কোন প্রণালীবদ্ধ কর্ম্মপদ্ধতি বলশেভিকদের গ্রহণ করিতে অনুরোধ করেন নাই। দলকে যন্ত্রবং পরিচালনা করিতে তিনি কখনই প্রয়াসী হন নাই। তবে রাজনীতিক্ষেত্রে তথাকথিত শিথিল উদারনীতি সযত্নে পরিহার করিয়া তিনি অবস্থানুযায়ী ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে লেনিন যেমন শ্রমজীবিশ্রেণীর বিপ্লব চিন্তা করিয়াছেন, তেমনি কৃষিপ্রধান রাশিয়ার আড়াই কোটী কৃষক পরিবারের অর্থ নৈতিক মুক্তিও তিনি ভোলেন নাই। ১৯০০ খৃষ্টাব্দে কৃষকদের পক্ষ হইতে লেনিন দাবী করিয়াছিলেন মধ্যযুগীয় নিয়ম কানুনের অবসান এবং কৃষকদিগকে অত্যধিক অর্থপ্রদানের জন্য পীড়নের নীতির পরিবর্ত্তন। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করিয়া কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে সহযোগিতা স্থাপন এবং এই মিলিত শক্তির সহায়ে বিপ্লবকে বাস্তবে পরিণত করার পরিকল্পনা লইয়াই লেনিন রাশিয়ার জনসাধারণকে মার্ক্সবাদের দিকে আকৃষ্ট করিয়াছিলেন। প্রথম হইতেই তিনি মধ্যশ্রেণীর বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন এবং মেনশেভিকদিগকে বারংবার বলিয়াছেন, সামন্ততান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী জারের ক্ষমতা মধ্যশ্রেণীর হাতে আসিলে জনসাধারণের অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন আসিবে না।
যখন এইভাবে আদর্শ ও কর্ম্মনীতির সংঘাত চলিতেছিল সেই সময় একদিন ষ্ট্যালিন লেনিনের সাক্ষাৎ লাভ করিলেন। ট্যালিন লিখিয়াছেন, “১৯০৩ সালে আমার সহিত প্রথম লেনিনের পরিচয় ঘটে। আমি তাঁহাকে না দেখিলেও আমাদের পরস্পরের মধ্যে পত্রালাপ হইত। লেনিনের প্রথম পত্র যেদিন আমার হাতে আসে সেই চিরস্মরণীয় ঘটনা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হইয়া রহিয়াছে। আমি তখন সাইবেরিয়ায় নির্ব্বাসিত। লেনিনের বৈপ্লবিক কার্য্য এবং তাহার মতবাদের সহিত আমার পরিচয় দীর্ঘকালের। ১৯০১ সাল হইতে আমি তাঁহার “ইস্স্ক্রা” সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠক ছিলাম। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছিল যে লেনিন সামান্য মানব নহেন। আমি তাঁহাকে কেবল দলের নেতা হিসাবে দেখিতাম না, দেখিতাম তাঁহার অসামান্য সৃজনী প্রতিভা; কেননা তিনিই আমাদের দলের আশু প্রয়োজন ও প্রকৃতি সর্ব্বদাই সম্যকরূপে উপলব্ধি করিতেন। দলের অন্যান্য নেতাদের সহিত লেনিনের তুলনা করিয়া আমি দেখিয়াছিলাম যে তাঁহার মস্তক সকলের উর্দ্ধে স্থাপিত; ইহাদের মধ্যে লেনিন যেন এক স্বতন্ত্র মানুষ, বহু সৈনিকের মধ্যে তিনি প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সেনাপতি,—পর্ব্বত চূড়ায় উপবিষ্ট বাজপাখী,—যিনি নির্ভীক যোদ্ধার মত আমাদের দলকে রাশিয়ার বিপ্লব আন্দোলনের এক নূতন পথে পরিচালিত করিতেছেন। এই ধারণা আমার মনে একেবারে বদ্ধমূল হইয়া যায় এবং এই সময় আমার এক বন্ধুর (তখন তিনি রাশিয়ার বাহিরে ছিলেন) নিকট আমার মনোভাব জ্ঞাপন করিয়া পত্র লিখি এবং লেনিন সম্বন্ধে তাঁহার মত জানিতে চাই। কিছুদিন পরে সাইবেরিয়ায় আমি বন্ধুর নিকট হইতে একখানি উৎসাহপূর্ণ পত্র পাই এবং ঠিক সেই সময়েই লেনিনের একখানি সরল অথচ গভীর ভাবপূর্ণ পত্র আমার হস্তগত হয়। আমি বুঝিলাম আমার বন্ধু পত্রখানি তাঁহাকে দেখাইয়াছিলেন! লেনিনের পত্র যদিও সংক্ষিপ্ত তথাপি তিনি উহাতে আমাদের দলের কার্য্য প্রণালী সূক্ষ্ম ও নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করিয়াছিলেন এবং আমাদের দলের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম পরিষ্কার করিয়া বর্ণনা করিয়াছিলেন।
“১৯০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ট্যামারফোর্সে (ফিন্ল্যাণ্ডে) বলশেভিক সম্মেলনে আমি প্রথম তাঁহার সাক্ষাৎলাভ করি। আমাদের দলের নভোচারী নেপক্ষী মহান্ নেতার সাক্ষাতের জন্য আমি উদগ্রীব। আমার মানসপটে তখন লেনিন কেবল মহান রাজনীতিক নহেন, বলিষ্ঠ দীর্ঘকায় সৌম্যকান্তি এক মহাপুরুষ। কিন্তু যখন দেখিলাম, আমার সম্মুখে একজন খর্ব্বকায় সাধারণ মানুষ দাঁড়াইয়া আছেন যাঁহার অবয়ব একান্ত বিশেষত্বহীন, তখন আমার বিস্ময়ের সীমা রহিল না।
“সাধারণতঃ নেতারা অনেক বিলম্ব করিয়া সভায় আসেন যাহাতে জনমণ্ডলী তাঁহার আগমনের আশায় অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া থাকে এবং তিনি আসিবামাত্র চারিদিক হইতে রব উঠে ‘আসিয়াছেন, তিনি আসিয়াছেন, চুপ করুন চুপ করুন’। কিন্তু আমি দেখিলাম লেনিন অনেকের আগেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন এবং এক কোণে একজন অতি সাধারণ প্রতিনিধির সহিত আলাপ করিতেছেন। নেতারা যে ভাবে সভায় গম্ভীরভাবে থাকেন তিনি নেতাসুলভ সেই সকল নিয়ম মোটেই মানিতেছেন না। লেনিনের এই সারল্য ও বিনয় দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইলাম এবং দেখিলাম তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার মত ভঙ্গী দেখাইতেছেন না অথবা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করিবার চেষ্টাও করিতেছেন না। নবীন মানব সমাজের তরুণ নেতার এই অনুপম অভিনবত্ব আমার দৃষ্টিতে মহান বলিয়া প্রতিভাত হইল।”
এইভাবে রাশিয়ার দক্ষিণ প্রান্তের এক যুবা বিপ্লবী উত্তর রাশিয়ার বহু বিস্তৃত কর্ম্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত নেতা লেনিনের সহিত প্রথম পরিচিত হইল। গুরু ও শিষ্যে প্রথম সাক্ষাৎ। বার বৎসর পরে যে দুই কর্মবীর ইউরোপের খণ্ডপ্রলয় হইতে মুমূর্ষু রাশিয়াকে উদ্ধার করিয়া নব সৃষ্টিতে সঞ্জীবিত করিয়াছেন তাঁহাদের প্রথম মিলন রাশিয়ার ইতিহাসে, এমন কি পৃথিবীর ইতিহাসেও এক চিরস্মরণীয় ঘটনা।
সর্ব্বদেশে যুদ্ধ বিপ্লবীদের নিকট এক সুযোগ। লেনিন বলিতেন, “লাঠি হাতে লইয়া কৃষকদের বিদ্রোহ জারের সিংহাসন ভাঙ্গিয়া ফেলিতে পারিবে না। প্রবন্ধ লিথিয়া এমন কি সার্ব্বজনীন ধর্ম্মঘট করিয়া সাফল্য লাভ করা যাইবে না। একদল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্যক্তি ক্ষমতা কাড়িয়া লইতে পারে।” তখন রুশ-জাপান যুদ্ধে লিপ্ত জার দ্বিতীয় নিকোলাসের নির্ব্বোধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে, মাঞ্চুরিয়া গ্রাস করিতে গিয়া জাপানের নিকট পরাজিত রুশ সাম্রাজ্যের গরিমা হতমান। সমগ্র রাশিয়ায় বিশেষভাবে যুবকেরা একটা বিপ্লবের প্রতীক্ষায় উদ্গ্রীব; ধর্ম্মঘট, অশান্তি, সৈন্যদলে বিদ্রোহ দেখা দিয়াছে; নিরুপায় জার বাধ্য হইয়া একটা শাসনতন্ত্র মঞ্জুর করিয়াছেন। অন্যদিকে কসাক সৈন্যদের দিয়া শাসকগণ জনসাধারণকে ভীত ও নিরস্ত করিবার জন্য অতি কঠোর দমননীতি অবলম্বন করিলেন। এই অকস্মাৎ জাগ্রত বিদ্রোহ, বিপ্লবের জন্য বলশেভিক দল প্রস্তুত ছিলেন না। যাঁহাদের হাতে প্রধান প্রধান শ্রমিক সঙ্ঘগুলি ছিল সেই মেনশেভিক নেতৃত্বের ভুল ত্রুটি ও ভীরুতার জন্য ১৯০৫ সালের বিদ্রোহ বিশৃঙ্খল ও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। জার গভর্ণমেণ্ট দেশব্যাপী ভীতির বিভীষিকা দ্বারা উহা দমন করিয়া ফেলিলেন। এই বিপ্লব এবং তাহার দমননীতি যে আতঙ্ক ও নৈরাশ্যের সৃষ্টি করিল তাহা হইতে বলশেভিক নেতারা অনেক শিক্ষালাভ করিলেন।
১৯০৫ খৃষ্টাব্দের ২২শে জানুয়ারী ফাদার গ্যাপন্ নামক একজন খৃষ্টান পাদ্রীর নেতৃত্বে সেণ্টপিটার্স্বার্গের শ্রমজীবিরা মিছিল করিয়া জারের উইণ্টার প্যালেসের সম্মুখে উপস্থিত হয়। তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল সাহায্যের জন্য জারের নিকট আবেদনপত্র প্রেরণ করা। কিন্তু সাহায্যের প্রত্যুত্তরে তাহারা পাইল জারীয় সৈন্যগণের রাইফেল-নিঃসৃত বুলেট। নিরস্ত্র জনতার উপর এই নির্মম গুলিবর্ষণের সংবাদে সমস্ত ইউরোপ শিহরিয়া উঠিল। ৩০শে জানুয়ারী পারীর জনসভায় বিখ্যাত সাহিত্যিক আনাতোল ফ্রান্স বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, “জার ক্ষুধিত নরনারীকে হত্যা করিয়াছেন, তাহারা চাহিয়াছিল খাদ্য, বিনিময়ে পাইয়াছে বুলেট; জার জারকেই হত্যা করিয়াছেন। যে নির্দ্দোষীর শোণিতে নাভা নদীর জল লোহিতবর্ণ হইয়াছে তাহার প্রতি শোণিত বিন্দু হইতে লক্ষ শির তুলিয়া মানুষ জাগিবে এবং এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোেধ লইবে। জার যে বিদ্রোহের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিলেন তাহা অত্যাচারীকে ধ্বংস করিবে। নিকোলাস আলেকজাণ্ডারের দিন ফুরাইয়াছে, জগতে তাহার স্মৃতি থাকিবে মাত্র। পাঁচ দিন ধরিয়া জারের গভর্ণমেণ্ট শ্রমিকদিগকে হত্যা করিতেছে এবং তাহাদের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী নেতাদিগকে কারাগারে নিক্ষেপ করিতেছে। আমরা দেখিতেছি, যে বিপ্লব আরম্ভ হইল তাহা আর থামিবে না। দুঃখ এই ইহার রক্তাক্ত পথ যে দীর্ঘ হইবে না তাহা কে বলিবে? এ দৃশ্য ভয়াল, চমকপ্রদ; স্কুল কলেজ হইতে ছাত্ররা শিক্ষক সহ বাহির হইয়া আসিয়া জনসাধারণের সহিত জয় অথবা মৃত্যুর পথে যাত্রা করিতেছে। একটা জাতির মর্ম্মক্রন্দন বিশাল সাম্রাজ্যের বিস্তার হইতে উঠিয়া আকাশে আঘাত করিতেছে। রুশিয়াবাসীদের সংযত সাহস, প্রশংসনীয় সারল্য এবং মজ্জাগত সততা আজ জারের নৃশংস পাশবিকতার সম্মুখীন।”
লেনিন নিশ্চয়ই নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। তিনি এই বিপ্লবকে গণবিপ্লবে পরিণত করিতে চাহিলেন। সেণ্টপিটার্স্বার্গ, মস্কোর শ্রমিক ও ছাত্র নেতাদের নিকট তিনি কোন সাড়া পাইলেন না। মধ্য শ্রেণীর বিপ্লবী নেতারা লেনিনের কথা শুনিল না। তৃতীয় বলশেভিক কংগ্রেসের নির্দ্দেশ তাহারা মানিল না। অতি অল্পসংখ্যক শ্রমিক ও নাবিক যখন সঙ্ঘবদ্ধ হইয়াছে, লেনিন যখন তাহাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছেন তখন বহু বিলম্ব হইয়া গিয়াছে। লেনিন সৈন্যদলকে বিদ্রোহ করিবার জন্য পরামর্শ দিলেন। কোন ফল হইল না। রেলওয়ে শ্রমিকরা ধর্ম্মঘট করিয়া সৈন্যদলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিল না। নূতন সৈন্যদল আসিয়া মস্কোর বিদ্রোহ সহজেই দমন করিয়া ফেলিল। ষ্ট্যালিন এই বিদ্রোহে বিশেষ কোন অংশ গ্রহণ করেন নাই। তিনি বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “ইহাই কি বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি? কথা, কথা, কেবল কথাই শুনিতেছি অথচ প্রয়োজন অস্ত্রশস্ত্রের এবং প্রয়োজন কাজের।” লেনিন প্রশান্তকণ্ঠে উত্তর দিলেন, “ভয় নাই; আমরা এক ভয়াবহ শিক্ষালাভ করিলাম। আবার যখন সুযোগ আসিবে তখন আমরা ভালভাবে কাজ করিব।” কিন্তু সে সুযোগ ১৯১৭ সালের মার্চ মাসের পূর্বে আর আসে নাই। মেনশেভিক দলের বিশ্বাসঘাতকতায় বিপ্লবীরা দীর্ঘ দ্বাদশবর্ষকাল নির্বাসনে গুপ্তভাবে থাকিয়া পুস্তিকা ও নিষিদ্ধ সংবাদপত্র প্রচার এবং সঙ্ঘ গঠনেই ব্যয় করিয়াছেন।
বিদ্রোহের অবসানে রুশিয়ায় জারশাসন অতি ভয়াবহ দমননীতি অবলম্বন করিল। ১৯০৫-১৯০৯ খৃষ্টাব্দের মধ্যে রাশিয়ার রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা পঁচাশী হাজার হইতে দুই লক্ষে পৌছিল। পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ ও সৈন্যদল ব্যতীত বিপ্লবের শত্রু একদল জারভক্তের আবির্ভাব হইল যাহারা কাল মুখোস পরিয়া অত্যাচারকে নিষ্ঠুর ও নির্মম করিয়া তুলিল। সঙ্গে সঙ্গে এক গণতন্ত্রের প্রহসন সুরু হইল। তথাকথিত শাসনতন্ত্র এক নকল পার্লামেণ্ট প্রতিষ্ঠা করিল। সঙ্গে সঙ্গে একদল উদারনৈতিক মডারেট রাশিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অভিনয় করিতে লাগিলেন। সাম্রাজ্ঞীর করধৃত পুত্তলিকা অজ্ঞ ও নির্ব্বোধ জার খৃষ্টীয় ধর্মযাজক এবং ঐ শ্রেণীর ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া ঘোষণা করিলেন কাহাকেও মুক্তি দেওয়া হইবে না, তাঁহার নিকট কেহ যেন মুক্তি ভিক্ষা করিতে না আসে। জারের মন্ত্রীরা সর্ব্ববিধ উপায়ে শ্রমিক ও কৃষকদের পীড়ন করিতে লাগিলেন যাহাতে কোন প্রকারে তাহাদের মধ্যে সঙ্ঘশক্তি ও আত্মচেতনা জাগ্রত না হয়।
ডিসেম্বর মাসে মস্কৌএর জনসাধারণের সশস্ত্র বিদ্রোহ দলিত হইবার পর বৈপ্লবিক শ্রমিক আন্দোলনে নৈরাশ্যের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। পিটার্সবার্গের ক্লান্ত শ্রমিকেরা ধর্ম্মঘট করিতে পারিল না। মস্কৌর বিদ্রোহীরা ইহাতে রুষ্ট হইল। লেনিন দেখিলেন, প্ররোচকগণ খণ্ড বিক্ষিপ্ত চেষ্টায় শ্রমিকদিগকে উত্তেজিত করিয়া জার সৈন্যদিগকে হত্যাকাণ্ডের সুযোগ দিতেছে। এই ত্রাসের বিভীষিকার মধ্যেও লেনিন নির্দ্দেশ দিলেন, বর্ত্তমানে, উত্তেজিত না হইয়া দ্বিতীয় বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতিই আমাদের কর্ত্তব্য। কিন্তু মেনশেভিকেরা গণ-বিদ্রোহের উপর আস্থা হারাইয়া ফেলিল। প্রচণ্ড দমন-নীতি যখন লোকের মনোবল ভাঙ্গিবার উপক্রম করিতেছে তখন সংস্কারপন্থী সমাজতন্ত্রী মেনশেভিকরা মার্কসের বুলি আওড়াইয়া নিয়মতান্ত্রিক সুবিধাবাদের পথে শ্রমিকসঙ্ঘগুলিকে আহ্বান করিতে লাগিল। ডিসেম্বর বিদ্রোহকে তাহারা “নৈরাশ্যের প্রতিক্রিয়া” এবং গুরুতর ভ্রম বলিয়া উল্লেখ করিয়া বলশেভিকদের নিন্দা করিতে লাগিল। সশস্ত্র বিদ্রোহের পথে অগ্রসর হওয়া উচিত নহে, ইহাই ছিল তাহাদের যুক্তি। লেনিন তখন নির্ব্বাসনে। ষ্ট্যালিন “সোশ্যাল ডেমোেক্রাট” কর্মীদের মনোবল রক্ষার জন্য অগ্রসর হইলেন এবং বলশেভিকদের মধ্যে প্রচার আরম্ভ করিলেন। টিফ্লিস্ হইতে তিনি প্রচার করিলেন, “মেনশেভিকরা বলিতেছে ‘প্রলেটারিয়েট’ পরাজিত, কিন্তু আমি দেখিতেছি, তাহাদের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং তাহারা শ্রেণীস্বার্থ-সচেতন। আমাদের আন্দোলন পশ্চাতে হটিয়া আসিয়াছে, নৃতন শক্তি সংগ্রহ করিয়া আর একবার অর্থাৎ সর্ব্বশেষবার জারের গভর্ণমেণ্টের উপর ঝাপাইয়া পড়িবার জন্য।”
কিন্তু মেনশেভিকদের প্রচারের ফলে সমস্ত রাশিয়া এবং ট্রান্সককেশিয়ার শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যরা দাবী করিতে লাগিল, বলশেভিক মেনশেভিক সকল শ্রেণীর ‘সোশ্যাল ডেমোক্রাট’ কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হউক। প্রতি-বিপ্লবী মেনশেভিকদের দিক হইতেই ঐক্যের দাবীটা বেশী রকম আসিতে লাগিল। বলশেভিকরা যদিও এরূপ শিথিল ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন না, তবুও তাঁহারা মনে করিলেন, এই ঐক্য প্রচেষ্টার সুযোগ লইয়া তর্ক ও আলোচনা দ্বারা তাঁহারা অনেক মেনশেভিক-পন্থীকে দলে আনিতে সক্ষম হইবেন। রাশিয়ার বিভিন্ন কেন্দ্রে এইরূপ কতকগুলি ঐক্য-সমিতির বৈঠক হইল। ট্রান্সককেশাসের বলশেভিকরা ষ্ট্যালিনের নেতৃত্বে ১৯০৫ সালের শেষভাগে মেনশেভিকদের সহিত ঐক্যের সম্ভাবনা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া এক প্রস্তাবে ঐক্যের অনুকূলে মত প্রকাশ করিলেন কিন্তু সর্ত্ত দিলেন, ‘সঙ্ঘ ও সমিতি গঠনে লেনিনের নীতি অনুসারেই কার্য্য করিতে হইবে।
১৯০৬-এর এপ্রিল মাসে সুইডেনের ষ্টকহলমে সোশ্যাল ডেমোক্রাট দলের চতুর্থ কংগ্রেসের অধিবেশন আহূত হইল। এই ‘ঐক্য’ কংগ্রেসে দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর এই প্রথম বলশেভিক ও মেনশেভিক প্রতিনিধিরা একত্রিত হইলেন। লেনিন এই কংগ্রেসে উপস্থিত করিবার প্রস্তাব সহ গোপনে পিটার্সবার্গে চলিয়া আসিলেন। যদিও মেনশেভিকদের মতামত জানাই ছিল, তথাপি তিনি আশা করিয়াছিলেন, বিপ্লবের নূতন সম্ভাবনা তাহাদিগকে উৎসাহ দিবে এবং তাহারা বলশেভিকদের সহিত মিলিত হইবে। টিফ্লিস্ বলশেভিক দলের প্রতিনিধিরূপে ষ্ট্যালিন “ঈভানোভিচ” এই ছদ্ম নামে ছাড়পত্র লইয়া কংগ্রেসে যোগ দিলেন। কিন্তু অধিবেশন আরম্ভ হইলে দেখা গেল, মেনশেভিক নেতারা প্রতি-বিপ্লবী প্রস্তাব লইয়া আসিয়াছেন। প্লেখানভ, এক্সেলরড্, মার্টভ প্রভৃতি প্রভাবশালী নেতাদের অপূর্ব্ব বাগ্মীতা সত্ত্বেও লেনিন ধীরভাবে বিশ্লেষণ করিয়া তাঁহাদের যুক্তির অসারতা প্রতিপন্ন করিলেন। লেনিনের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া ষ্ট্যালিন মেনশেভিকদের গণশক্তি বিরোধী সুবিধাবাদের নীতি নির্ম্মমভাবে উদ্ঘাটিত করিলেন।
ষ্ট্যালিন তাঁহার একটি বক্তৃতায় বলিলেন,—“বিপ্লব শক্তি সঞ্চয় করিয়া মাথা তুলিতেছে, আমাদের কর্ত্তব্য ইহাকে পূর্ণ পরিণতির দিকে অগ্রসর করিয়া দেওয়া। কিন্তু কি অবস্থার মধ্যে আমরা উহা করিতে পারিব অথবা করা উচিত হইবে—গণশক্তির আধিপত্য মানিয়া না মধ্যশ্রেণীর (বুর্জোয়া) গণতন্ত্রের বশ্যতা স্বীকার করিয়া? এইখানেই আমাদের মূলনীতির পার্থক্যের আরম্ভ। কমরেড্ মারটিওনভ (মেনশেভিক) তাহার “দুই একনায়কত্ব” প্রবন্ধে বলিয়াছেন, বর্ত্তমান মধ্যশ্রেণীর বিপ্লবে প্রলেটারিয়েট বা গণশক্তির সর্ব্বময় প্রস্তুত্ব বিপজ্জনক কল্পনা।’ গতকল্যের বক্তৃতায় তিনি এই কথাই বলিয়াছেন। এই বক্তৃতা শুনিয়া যে সকল প্রতিনিধি হর্ষধ্বনি করিয়াছেন, তাঁহারা ঐ মত পোষণ করেন ইহা আমি ধরিয়া লইতেছি। যদি তাহাই হয়, যদি আমাদের মেনশেভিক সহকর্মীদের এই মত হয় যে, গণশক্তির আধিপত্যের পরিবর্ত্তে গণতন্ত্রী মধ্যশ্রেণীর প্রভুত্বেরই আমাদের এখন প্রয়োজন, তাহা হইলে, তাহার সরল অর্থ এই যে, আমরা সশস্ত্র অভ্যূত্থানের আয়োজনে কোন প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশ গ্রহণ এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা হস্তগত করিবার চেষ্টা করিব না। ইহাই মেনশেভিকদের “কার্য্যক্রম”। অন্য দিকে প্রলেটারিয়েট যদি অনাগত বিপ্লবের পশ্চাতে না থাকিয়া সম্মুখের ভুমিকায় অভিনয় করে তাহা হইলে সে সশস্ত্র অভ্যূত্থানের আয়োজনের সক্রিয় দায়িত্ব এবং ক্ষমতা হস্তগত করার প্রচেষ্টা ত্যাগ করিতে পারে না। ইহাই বলশেভিকদের “কার্য্যক্রম”। গণশক্তির কর্ত্তৃত্ব স্থাপন না গণতন্ত্রী মধ্যশ্রেণীর আধিপত্য—দলের সম্মুখে ইহাই প্রশ্ন এবং এইখানেই আমাদের পার্থক্য।”
ষ্টকহলম কংগ্রেসে দেখা গেল, বলশেভিকদল সুসম্বদ্ধ এবং বিপ্লবের সাফল্যে বিশ্বাসী; পক্ষান্তরে মেনশেভিকদল নিয়মতান্ত্রিক সুবিধাবাদের পথে কালহরণের পক্ষপাতী। কিন্তু মেনশেভিকদলের সংখ্যাধিক্য হেতু লেনিনের প্রস্তাব গৃহীত হইল না। শ্রীমতী সেরাফিমা গোপ্নার নাম্নী জনৈকা মহিলা (যিনি রুশ বিপ্লবে একটা প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করিয়াছিলেন) লিখিয়াছেন,—“এই প্রথম আমি লেনিনকে পরাজিতের ভূমিকায় অভিনয় করিতে দেখিলাম। কিন্তু তিনি মোটেই দমিয়া যান নাই। ভবিষ্যতের জয়ের কথাই তিনি চিন্তা করিতেছিলেন। বলশেভিকরা একটু নিরুৎসাহ হইয়া পড়িয়াছিল। লেনিন তাহাদের উৎসাহ দিলেন,— ‘বিলাপ করিও না, একদিন আমরা জয়লাভ করিবই, কেননা আমাদের সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত। বুদ্ধিজীবিদের নৈরাশ্যগুঞ্জন ঘৃণা কর, আমাদের স্বকীয় শক্তির উপর বিশ্বাস রাখ, জয়াশা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হও।’ ঐ কথা বলিয়া লেনিন আমাদিগকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। আমরা সকলেই ভাবিলাম বলশেভিকদের এই ক্ষণিক পরাজয় পরিণামে সংশয়হীন জয়েরই সূচনা করিবে।”
ষ্টকহলম কংগ্রেসের পর ষ্ট্যালিন, বার্লিনে লেনিনের সহিত কয়েকদিন অবস্থান করিয়া ট্র্যান্সককেশিয়ায় ফিরিয়া আসিলেন। তিনি আসিয়াই মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ করিতে লাগিলেন। তিনি দেখাইলেন, উহারা বিপ্লব চায় না এখন উহারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির দিকে ঝুঁকিয়াছে। তাঁহার নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ বলশেভিক দল এক সর্ব্বদলীয় সম্মেলনের বিশেষ অধিবেশন দাবী করিল। ১৯০৬-এর নভেম্বরে নিখিল রুশিয়া সর্বাদল সম্মেলনের অধিবেশনে প্রস্তাব হইল—পঞ্চম কংগ্রেসের অধিবেশন আহ্বান করিতে হইবে। ইহার বিরুদ্ধে মেনশেভিকরা বলিতে লাগিল, একটি অদলীয় শ্রমিক কংগ্রেস আহ্বান করিয়া “উদারতর শ্রমিকদল” গঠন করা উচিত। গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি ভাঙ্গিয়া দিয়া, শ্রমিক প্রতিনিধিরা শান্তিপূর্ণ ও বৈধ উপায়ে পার্লামেণ্টি পদ্ধতিতে বর্ত্তমান “সঙ্কুচিত নিয়মতন্ত্রের” মধ্যে মধ্যশ্রেণীর সহিত মিলিত হইয়া কার্য্য করুক। ষ্ট্যালিন তীব্রভাবে ইহার প্রতিবাদ করিয়া গণশক্তির গুপ্ত বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করিতে লাগিলেন। প্রতি-বিপ্লবী মেনশেভিকদের শ্রমিক কংগ্রেস অহ্বানের চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গেল।
১৯০৭-এর মে লণ্ডনে পঞ্চম কংগ্রেসের অধিবেশনে ষ্ট্যালিন টিফ্লিস্ বলশেভিক দলের প্রতিনিধিরূপে যোগ দিলেন। এই কংগ্রেসে মেনশেভিক নেতাদের উগ্র আক্রমণ সত্ত্বেও বলশেভিক দলের প্রস্তাবই গৃহীত হইল। বৈপ্লবিক শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনে বলশেভিক দলের সাফল্য এই কংগ্রেসে স্বীকৃত হইল। শ্রীমতি গোপ্নার এই কংগ্রেসের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন,—“...এই প্রথম আমি লেনিনকে বিজয়ীর ভূমিকায় দেখিলাম। কিন্তু জয়গর্ব্বে উন্মত্ত হইবার মত নেতা তিনি নহেন। এই জয় তাঁহাকে অধিকতর সাবধানী সতর্ক করিয়া তুলিল। আমরা কতিপয় প্রতিনিধি যখন তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইলাম তখন তিনি বলিলেন, প্রথমতঃ, আমরা যেন বিজয়ী হইয়াছি বলিয়া চীৎকার না করি। দ্বিতীয়তঃ আমাদের শত্রুকে ধ্বংস করিতে হইবে। বলিলেন, ‘মনে রাখিও শত্রু পরাজিত হইয়াছে মাত্র, ধ্বংস হয় নাই।’ যে সমস্ত লঘুচিত্ত প্রতিনিধিরা বলিতেছিলেন এইবার আমরা মেনশেভিকদিগকে শেষ করিয়াছি তিনি তাহাদিগকে ভর্ৎসনা করিলেন—‘লক্ষ্যে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বে কাহারও গর্ব্ব করা উচিত নহে এবং লক্ষ্যে উপস্থিত হইলে গর্ব্ব করিবার কিছুই থাকে না।”
“পরাজয়ে বিলাপ করিওনা, জয়ী হইয়াও উৎসাহে চীৎকার করিওনা” লেনিনের এই দুই মহাবাণী ষ্ট্যালিন বিপ্লবী মহলে বারংবার ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত করিয়াছেন, সমাজতন্ত্রবাদের বিস্তৃতি ও বিকাশের পথে এবং সম্পূর্ণ নবীন সভ্যতা স্থাপনের সর্ব্বশেষ সংঘর্ষে এই দুই মহাবাণী প্রেরণা দিয়াছে।
লণ্ডনের পঞ্চম কংগ্রেসে বলশেভিক পার্টি কর্ত্তৃক ষ্ট্যালিন বাকুতে স্থায়ীভাবে কাজ করিবার জন্য আদিষ্ট হইলেন। পুলিশ ও গোয়েন্দার দৃষ্টি এড়াইয়া স্থায়ীভাবে কাজ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হইত.না— কিন্তু ষ্ট্যালিন ১৮ মাস বিনা বাধায় কাজ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, ইহা কম কৃতীত্বের পরিচয় নহে। রাজনৈতিক কারণেই পার্টি ষ্ট্যালিনকেই বাকুর কার্যভার অর্পণ করিয়াছিলেন। তখন বাকু রাশিয়ার এক প্রধান শিল্পকেন্দ্র—তৈলের খনি ছাড়াও এখানে বহু সংশ্লিষ্ট কারখানা ছিল। বাকুর শ্রমিকগণের মধ্যে রাশিয়ান, আজারবাইজান, জর্জিয়ান, আরমেনিয়ান, পারসীক প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির লোক ছিল— ধর্ম্মের দিক দিয়াও ইহারা খৃষ্টান, ইহুদী ও মুসলমান এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। সহরের বাহিরের পল্লী অঞ্চলের আজারবাইজান কৃষকেরা রুষ ঔপনিবেশিক ও আরমেনিয়ানদের ঘৃণা করিত। জার গভর্ণমেণ্টের কর্ম্মচারীরা এই সাম্প্রদায়িক ও জাতি বিদ্বেষে ইন্ধন জোগাইতেন। গভর্ণমেণ্টের ভেদ নীতির ফলে দাঙ্গাহাঙ্গাম। হত্যাকাণ্ড প্রায়ই অনুষ্ঠিত হইত। বাকুর তৈলের খনিগুলিতে আন্তর্জ্জাতিক মূলধন খাটিত। রথচাইল্ড, বৃটিশ, রাশিয়ান বিভিন্ন শ্রেণীর মূলধনীরা খনির মালিক—— বৈদেশিক মূলধনই অধিক। এমন বহু বিরুদ্ধ স্বার্থের কেন্দ্রে সুবিধাবাদী, জাতীয়তাবাদী, মেনশেভিক প্রভৃতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কর্ম্মীর অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী এবং ইহাদের অধিকাংশই বিদেশী ধনীদের গুপ্তচর।
এই অবস্থার মধ্যে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক শক্তিকে বৈপ্লবিক বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে আনয়নের দায়িত্ব লইয়া ষ্ট্যালিন কর্ম্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। মেনশেভিক ও সন্ত্রাসবাদী নেতাদের সুবিধাবাদীসুলভ কার্য্যকলাপ উদ্ঘাটন এবং শ্রমিকদিগকে সুস্পষ্ট বৈপ্লবিক মতবাদের ভিত্তিতে সঙ্ঘবদ্ধ করিবার জন্য পার্টির পক্ষ হইতে ষ্ট্যালিন বেআইনী সংবাদপত্র “বাকু প্রলেটারিয়েট” সম্পাদনা করিতে লাগিলেন। স্বয়ং গুপ্তভাবে বিভিন্ন শ্রমিক কেন্দ্রে অবস্থান করিয়া একের পর আর মেনশেভিক ঘাঁটিগুলি উচ্ছেদ করিতে লাগিলেন। দুই মাসের মধ্যেই বহু সোশ্যাল ডেমোক্রাট বাকুর বলশেভিক পার্টিতে যোগদান করিল। পার্টির নেতৃত্বে বাকুর শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে কতকগুলি আপোষ রফায় শ্রমিকদের অনেক দাবী পূরণ হওয়ায়, তাহারা বলশেভিক নেতাদের অনুরক্ত হইয়া উঠিল। ১৯০৭ সালের শেষভাগে যখন সমগ্র রাশিয়ায় রাজনৈতিক অবসাদ দেখা দিয়েছে, তখন বলশেভিক কর্ম্মীদের নেতৃত্বে খনির মজুরেরা কেবল যে তাহাদের কতকগুলি দাবী আদায় করিতে সক্ষম হইয়াছিল তাহা নহে,—বলশেভিক পার্টির সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক চিন্তা ও কর্ম্মধারার তাহারাই হইয়াছিল অগ্রদূত।
বাকুর শ্রমিককেন্দ্র, ভবিষ্যৎ রাশিয়ার কর্ণধার ষ্ট্যালিনের শিক্ষাগার। ১৯২৬ সালে টিফ্লিসের রেলওয়ে শ্রমিকদের সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে ষ্ট্যালিন বলিয়াছিলেন,— “তৈলের খনি মজুরদের মধ্যে দুই বৎসর বৈপ্লবিক কার্য্য আমাকে বাস্তববাদী যোদ্ধা ও নেতারূপে গঠন করিয়া, তুলিয়াছিল। একদিকে বাকুর প্রগতিশীল শ্রমিকদের সহিত ঘনিষ্ট পরিচয়, অন্যদিকে মালিকদের সহিত শ্রমিকদের সংঘর্ষ—এই দুই হইতে আমি শিক্ষালাভ করিয়াছিলাম কি ভাবে বৃহৎ শ্রমিক সঙ্ঘকে পরিচালনা করিতে হয়। বাকুতেই আমি দ্বিতীবার বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষালাভ করিয়াছিলাম। এইখানেই আমি বিপ্লবের পথের যাত্রী হইয়াছিলাম।”
জার-শাসনের স্বৈরাচার চরমে উঠিয়াছে, বৈধভাবে সংস্কারপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালন করাও কঠিন। সেই অবস্থার মধ্যে পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি এড়াইয়া বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতি গঠন এবং জার শাসনতন্ত্রকে চরম আঘাত হানিবার আয়োজন করিতে গিয়া, ষ্ট্যালিন সমসাময়িক অবস্থার সহিত সামঞ্জস্য বিধান করিয়া কখনও বৈধ কখনও বা গুপ্তভাবে—জনসাধারণকে মার্ক্স-লেনিনের বৈপ্লবিক মতবাদ শিক্ষা দিতে লাগিলেন। ১৯০৮ সালের মার্চ মাসে গোয়েন্দা পুলিশ ষ্ট্যালিনকে গ্রেফ্তার করিল। বাকুর বেইলভ জেলে তিনি ৮ মাস ছিলেন। কারাগারে থাকিয়াও তিনি কৌশলে পার্টির কাজের নির্দ্দেশ দিতেন এবং “বাকু প্রলেটারিয়েট” পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখিতেন। রাজনৈতিক বন্দীদের মধ্যে একমাত্র বলশেভিকরাই তাহাদের পার্টি সদস্যদের মারফৎ বাহিরের সহিত যোগাযোগ রক্ষায় সমর্থ হইতেন। বাকু জেল হইতে ষ্ট্যালিন দুই বৎসরের জন্য ভোলগদা প্রদেশে নির্ব্বাসিত হইলেন। কিন্তু ১৯০৯-এর গ্রীষ্মকালে তিনি পুলিশের চক্ষে ধূলা দিয়া বাকুতে ফিরিয়া আসিলেন এবং ট্রান্স ককেশিয়ায় বলশেভিক পার্টিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার কাজে আত্মনিয়োগ করিলেন। মেনশেভিকদিগের প্রতিবিপ্লবী কার্য্যকলাপ খর্ব্ব করিবার জন্য তিনি অক্টোবর মাসে টিফ্লিসে আসিলেন। তাঁহার প্রেরণায় স্থানীয় বলশেভিক পার্টি হইতে “টিফ্লিস্ প্রলেটারিয়েট” পত্রিকা প্রকাশিত হইল। প্রথম সংখ্যায় ষ্ট্যালিন সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লিখিলেন,—
“মহান রুশ বিপ্লব মরে নাই—ইহা জীবিত। ইহা সাময়িকভাবে পশ্চাদপসরণ করিয়াছে, এবং ভবিষ্যতের বিপুল উদ্যমের জন্য শক্তি সঞ্চয় করিতেছে।
“বিপ্লবের প্রধান অগ্রদূত শ্রমিক ও কৃষক সচেতন ও অক্ষত; তাহাদের মুখ্য দাবীগুলি তাহারা ত্যাগ করে নাই, করিতে পারে না......
“আমরা এক অভিনব আলোড়নের সম্মুখীন হইয়াছি। জারীয় শাসন উৎখাত করিবার পুরাতন সমস্যা, আমাদের সম্মুখে উপস্থিত।
“জনসাধারণের অধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আসন্ন গৌরবময় সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়া আমাদের এবং প্রগতিশীল শ্রমিকদের একমাত্র কর্ত্তব্য।
“১৯০৫ সালের মতই এবারও প্রগতিশীল শ্রমিক শক্তিই বিপ্লবকে সম্পূর্ণ জয়ের পথে পরিচালিত করিবে......
“আসন্ন সংগ্রামের জন্য জনসাধারণের মূল শক্তিগুলিকে প্রস্তুত করিয়া তুলিবার জন্য চাই শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ পার্টি...
“...অতএব কমরেড্ পাঠকগণ, আপনারা টিফ্লিসের গণশক্তিকে অনাগত চূড়ান্ত সংগ্রামে প্রস্তুত করিয়া তুলিবার জন্য প্রযত্নশীল হউন।”
যে সকল লোকদুর্ল্লভ চারিত্রিক গুণাবলী থাকিলে বহু সঙ্কটের মধ্য দিয়াও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়, ষ্ট্যালিনের মধ্যে এই কালে তাহার চরম বিকাশ ঘটিয়াছিল। আত্মঘোষণায় কুণ্ঠিত ষ্ট্যালিন নিজের অতীত জীবন সম্পর্কে ব্যক্তিগত কথা খুব কমই বলেন; যদি তিনি তাহা খুলিয়া বলিতেন, তাহা হইলে এই সময়ের কার্য্যাবলী হইতেই বুঝা যাইত —জনসাধারণ ও নেতার সুগভীর ঐক্যই ভবিষ্যত ইতিহাসকে কি ভাবে নিয়ন্ত্রিত করিয়াছে। ১৯১০-এর মার্চ মাসে তিনি পুনরায় গ্রেফ্তার হইয়া কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন। কয়েক মাস পরে তাঁহাকে মোলভিচেগোডস্কে নির্ব্বাসিত করা হইল।
১৯০৯-১১ সালে বলশেভিকদলকে বহু সঙ্কট অতিক্রম করিতে হইয়াছিল। দলের সদস্যেরা বিশাল সাম্রাজ্যের নানাস্থানে ছড়াইয়া ছিলেন এবং প্রধান নেতারা ছিলেন, রাশিয়ার বাহিরে। লেনিন বাহির হইতেই আন্দোলন পরিচালন করিতেন। গ্রেফ্তার, জেল, জরিমানার ভীতি ও উৎসাহহীনতা দলের শৃঙ্খলা নষ্ট করিবার উপক্রম করিয়াছে, প্রতি-বিপ্লবীদের প্রচার কার্য্যের ফলে অনেক কর্ম্মীর বিশ্বাস টলিতে লাগিল। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবিরা, এমন কি অনেক কর্মীর মনেও সংশয় দেখা দিল; মেনশেভিকদের ত কথাই নাই, বলশেভিকেরা পর্য্যন্ত বৈধ আন্দোলনের দিকে ঝুঁকিলেন, গোপন কার্য্য প্রণালীর পরিবর্ত্তে আইন সঙ্গত নিয়মতান্ত্রিকতা অনেকের নিকট ভাল মনে হইতে লাগিল। বলশেভিক নেতারা দেখিলেন, রাজনীতিক্ষেত্রে ইহা আত্মহত্যার নামান্তর মাত্র—এ যেন “জীবনধারণের উপায় পরিত্যাগ করিয়া জীবন রক্ষার চেষ্টা”। লেনিন দেখিলেন, কেবল জারের অত্যাচার হইতে নহে, আভ্যন্তরীন এই দৌর্ব্বল্য হইতে দলকে রক্ষা করিতে হইবে। কেন্দ্রীয় দলের মধ্যে যে কোন মূল্যে ঐক্য স্থাপনের যে আগ্রহ দেখা দিল লেনিন তাহার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে লেখনী চালনা করিতে লাগিলেন। এই সময় ট্রট্স্কি মেন্শেভিক ও বলশেভিক উভয় দলের মিলনের জন্য ভিয়েনা হইতে লেখনী চালনা করিতে লাগিলেন। তখন লেনিনের নেতৃত্ব ও অটল আদর্শ নিষ্ঠার পরিচয় জ্বলন্ত পাবকের মত প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। ১৯১০ সালের ১১ই এপ্রিল লেনিন গোর্কীর নিকট এক পত্রে লিখিয়াছিলেন, “.......এই সকল আত্মকলহ, কুংসা, বিলাপ অনুতাপের মধ্যে বসিয়া আমি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছি। কিন্তু মনোবিকারের নিকট আত্মসমর্পণ অন্যায়। বিপ্লবের পূর্ব্বে অপেক্ষা বর্ত্তমানে নির্ব্বাসন আমার পক্ষে শতগুণ অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। নির্ব্বসিতদের মধ্যে পরস্পর কলহ অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু আমি জানি এই শ্রেণীর কলহ দীর্ঘদিন থাকিবেনা। ......দলের উন্নতি এবং সোশাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলনের বিস্তার বর্ত্তমানের নারকীয় বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়াও অগ্রসর হইতেছে। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল হইতে বিপথগামী প্রতি-বিপ্লবী এবং তথাকথিত ঐক্যকামীদিগের বহিষ্কারের কাজ দ্রুত অগ্রসর হইতেছে। মতবাদের দিক দিয়া আমরা আমাদের স্বাতন্ত্র্যকে সমস্ত সংশয় অনিশ্চয়তা হইতে মুক্ত করিয়াছি। মেনশেভিকরা তাহাদের ঝুলির মধ্যে যে সাপ লুকাইয়া রাখিয়াছিল আমরা তাহা প্রকাশ্য দিবালোকে বাহির করিয়াছি—যাহাতে উহা সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। এখন আমরা উহাকে হত্যা করিব।” লেনিন দলের মধ্যে দৌর্ব্বল্য ও দ্বিধা প্রতিরোধ করিলেন। সংক্রামক ব্যাধির মত যে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ছড়াইয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছিল তাহা প্রতিষেধ করিতে লেনিনের মত প্রতিভাবান ক্ষমতাশালী নেতার প্রয়োজন যে কত অধিক তাহা বলশেভিক নেতারা বুঝিতে পারিলেন।
ষ্ট্যালিন তাঁহার অনুপম কৌশলে ১৯১১ সালে কারাগার হইতে পলায়ন করিয়া সেণ্টপিটার্সবার্গে উপস্থিত হইলেন। তিনি পুনরায় ধরা পড়িলেন, পুলিস তাঁহাকে ভোলক্দায় নির্ব্বাসিত করিল। নির্ব্বাসন হইতে তিনি পুনরায় সেণ্টপিটার্সবার্গে পলাইয়া আসিলেন এবং গুপ্তভাবে থাকিয়া মেনশেভিক এবং সন্ত্রাসবাদীদের অপচেষ্টা ব্যর্থ করিতে লাগিলেন। তিনি নানাস্থানে অবিশ্রান্ত ভ্রমণ করিতে লাগিলেন, দলের অনুগত সঙ্ঘগুলিকে শক্তিশালী করিতে লাগিলেন, একখানি সংবাদপত্র সম্পাদনা করিতে লাগিলেন। এইকালে রাশিয়ার বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘প্রাভ্দার’ তিনি অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। পুলিশ অবশেষে তাঁহাকে খুঁজিয়া বাহির করিল এবং পুনরায় নির্বাসনে পাঠাইয়া দিল। তিনি রক্ষী পুলিসদলকে বেকুব বানাইয়া পুনরায় সরিয়া পড়িলেন।
শরৎকালে তিনি রাশিয়ার বাহিরে গিয়া লেনিনের সহিত কয়েক দিন অবস্থান করিলেন। এই কালে রাশিয়া ও ফ্রান্সের সহিত কূটনীতিক পরামর্শ চলিতেছিল। এক দিকে পোঁয়্যাকারে, অন্যদিকে রাশিয়ার ‘নীতিহীন’ ঈস্ভলস্কি ষড়যন্ত্র করিতেছিলেন এবং এই ষড়যন্ত্রের কথা পরে প্রকাশ পাওয়ায় বুঝা গিয়াছিল যে মহাযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ এই ফ্রাঙ্কো-রাশিয়ান আঁতাৎ। রাশিয়ার অভ্যন্তরেও এই সময় বিপ্লব আন্দোলন নবীন প্রেরণা লাভ করিল। সাইবেরিয়ার লেনা সোণার খনির শ্রমিক প্রতিনিধিদের উপর এবং জনসাধারণের উপর গুলীবর্ষণ করিয়া পুলিশ পাঁচশত লোককে হত্যা করিল (১৯১২) এবং এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সমগ্র দেশে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিল বিপ্লবী বলশেভিকরা তাহাব সুযোগ পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করিলেন। লেনিন ও ষ্ট্যালিন বৈধ এবং অবৈধ উভয়পন্থার সুযোগ গ্রহণ করিলেন এবং মেনশেভিক দলের সহিত ঐক্যের আলেয়ার পশ্চাতে ধাবিত হইয়া অপঘাতের গহ্বরে অপমৃত্যু হইতে দলকে রক্ষা করিলেন। আজ অনেক কালের ব্যবধানে আমরা সুসংবদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনাবলী হইতে যেমন সহজে বুঝিতে পারি যে লেনিন তাঁহার দলকে সম্যক পথেই পরিচালিত করিয়াছিলেন কিন্তু সে দুর্দ্দিনে তাহা হৃদয়ঙ্গম করা এত সহজ ছিল না। লেনিন ও ষ্ট্যালিন বিপ্লবের সাফল্যে এত বেশী বিশ্বাসী হইয়া উঠিলেন যে তাঁহারা ভবিষ্যতের সোভিয়েট শাসনতন্ত্রের পরিকল্পনা প্রচার করিতে লাগিলেন। ষ্ট্যালিন সমাজতন্ত্রবাদ ও বিভিন্ন জাতিগুলির বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যের সমন্বয় কিরূপে সম্ভবপর সে সম্বন্ধে কতকগুলি গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধ লিখিলেন। বহু ভাষাভাষী এবং বহু জাতি অধ্যুষিত রুশ সাম্রাজ্যে সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে এই বৃহৎ সমস্যা সমাধান করিতে হইবে ষ্ট্যালিন ইহা বুঝিয়াছিলেন। তাঁহার এই প্রবন্ধগুলি পরবর্ত্তীকালে ‘মার্কসবাদ ও জাতীয়তার সমস্যা’ নামক পুস্তকে একত্র হইয়া প্রকাশিত হইয়াছে। জার গভর্ণমেণ্ট বিপ্লবীদের পুস্তিকা ও সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করিতে লাগিলেন। ‘প্রাভদা’ পত্রিকা বন্ধ হইয়া গেল। ষ্ট্যালিন ও মলোটভ ভিন্ন নাম দিয়া পর পর আরও দুইখানি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং গুপ্ত ছাপাখানা হইতে উহা গোপনভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করেন।
পার্টির কেন্দ্রীয় সমিতির নির্দ্দেশে ষ্ট্যালিন পিটার্সবার্গ মস্কৌ-এ শ্রমিক সমিতিগুলিকে মেনশেভিকদের প্রভাব হইতে মুক্ত করিবার কার্য্যে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার বাহিরে সোশ্যাল ডেমোক্রাট দলে মেনশেভিকরাই সংখ্যায় গরিষ্ঠ ছিল, তাহারা পদে পদে লেনিনকে বাধা দিতে লাগিলেন। কিন্তু রাশিয়ার অভ্যন্তরে সুবিধাবাদীদের ঐক্যের আন্দোলন বলশেভিক দলকে দুর্ব্বল করিতে পারিল না। কার্য্যতঃ ষ্ট্যালিন সমগ্র রাশিয়ার বলশেভিক দলের নেতারূপে লেনিনের নির্দ্দেশমত কার্য্য করিতে লাগিলেন। হুইজারল্যাণ্ডে তিনি নির্ব্বাসিত বলশেভিকদের এক সভা আহ্বান করিয়া ভবিষ্যৎ কার্য্যক্রম স্থির করিলেন। ১৯১২ সালের জানুয়ারী মাসে প্রাগে প্রথম পার্টি কনফারেন্স আহ্বত হইল। বিভিন্ন শ্রেণীর সমাজতন্ত্রী লইয়া গঠিত সোশ্যাল ডেমোক্রাট দলের তথাকথিত ঐক্যের মোহজাল ছিন্ন করিয়া এই সম্মেলনে বলশেভিক দল স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করিল। ১৯০৮ খৃষ্টাব্দের পর এই প্রথম রাশিয়ার বাহিরের সম্মেলনে রাশিয়া হইতে বহু প্রতিনিধি ছদ্ম পরিচয়ে সম্মেলনে যোগ দিয়াছিলেন। এই কনফারেন্সে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হইল; এই কমিটির নেতৃত্বে রাশিয়ায় বলশেভিক দলের কার্য্যপ্রণালী চলিতে লাগিল। বহুদিন পরে পার্টির পঞ্চদশ কংগ্রেসে ষ্ট্যালিন বলিয়াছিলেন, “প্রাগ কনফারেন্স আমাদের পার্টির ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় অধ্যায়। এইখানেই বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যে সীমারেখা নির্দ্দিষ্ট করিয়া লওয়া হয় এবং দেশের সমস্ত বলশেভিক সমিতিগুলি ঐক্যবদ্ধ বলশেভিক পার্টিরূপে সুগঠিত হয়।”
ষ্ট্যালিন প্রাগ কনফারেন্স-এ যোগ দিতে পারেন নাই; কিন্তু তাঁহাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা হইয়াছিল এবং কেন্দ্রীয় কমিটির রাশিয়ান শাখা পরিচালনের ভার তাঁহার উপরই অর্পণ করা হইয়াছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দ্দেশানুসারে তিনি প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলিতে গিয়া প্রাগ কনফারেন্সের প্রস্তাবগুলি কার্য্যে পরিণত করিবার ব্যবস্থা করিলেন। পুলিশের চক্ষে ধূলা দিয়া ষ্ট্যালিন রুশ পার্লামেণ্টের (ডুমা) নির্ব্বাচনে বলশেভিক প্রতিনিধিদের পক্ষে প্রচার কার্য্য করিতে লাগিলেন। ছয়টি প্রদেশের শ্রমিক নির্ব্বাচন মণ্ডলীতেই মেনশেভিকদের পরাজিত করিয়া বলশেভিকরা জয়লাভ করিলেন। ভোট গণনার পর দেখা গেল রাশিয়ার ৫ ভাগের ৪ ভাগ শ্রমিকই বলশেভিক পার্টির পক্ষে ভোট দিয়াছে।
১৯১২-র শেষভাগে ষ্ট্যালিনের অনুরোধে লেনিন ক্রাকোতে (পোলাণ্ড) বলশেভিক পার্টির এক সম্মেলন আহ্বান করিলেন। লেনিনের সভাপতিত্বে এই সম্মেলনে ষ্ট্যালিন পার্লামেণ্টে (ডুমা) বলশেভিক ডেপুটিদের কার্য্যকলাপ, দৈনিক ‘প্রাভ্দা’ পত্রিকা পরিচালনার বিশদ বিবরণ ব্যক্ত করিলেন। বৈপ্লবিক শ্রমিক আন্দোলনকে বলশেভিক পার্টির আদর্শে পরিচালনা করিবার ভার লইয়া ষ্ট্যালিন রাশিয়ায় ফিরিয়া আসিলেন।
১৯১৩ সালের জুলাই মাসে ষ্ট্যালিন পুনরায় ধরা পড়িলেন এবং সাইবেরিয়ার তুলুখানষ্ট্ জেলায় নির্ব্বাসিত হইলেন। “ভয়ঙ্কর ভিসারীয়নভচ্” যিনি বারংবার পুলিশের চক্ষে ধূলি দিয়া পলায়ন করিয়াছেন, আঙ্গুলের ফাঁক দিয়া পলাইয়া যাইবার খ্যাতি ও অখ্যাতি যাঁহাকে পুলিশের দৃষ্টিতে ভয়াবহ করিয়া তুলিয়াছে, সেই ষ্ট্যালিন ধরা পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাঁহাকে হাতে পায়ে বেড়ি লাগাইয়া সাবধানে উত্তর সাইবেরিয়ার হিমমণ্ডলের নিকটবর্ত্তী কুলিইকা লইয়া গেল। এই গ্রামে মাত্র দুই তিনটি বাড়ী ছিল এবং বৎসরের মধ্যে দুই তিন মাস ব্যতীত সর্ব্বসময় ইহা বরফে আচ্ছন্ন থাকে। তিনি প্রায় গল্পের রবিনসন্ ক্রুসোর মত এই গ্রামে বাস করিতে লাগিলেন। নিষ্কর্ম্মা বসিয়া না থাকিয়া তিনি মাছ ধরিবার ও শিকার করিবার যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও তৈয়ারী করিলেন এবং সমস্ত দিন ঐ কার্য্যেই অতিবাহিত করিতেন। স্বয়ং রন্ধন করিতেন এবং কুঠার লইয়া জ্বালানীকাঠ সংগ্রহ করিতেন। অবসর সময়ে তাঁহার কুটীরে বসিয়া মার্কসবাদ ও রাশিয়ার সমস্যা সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখিতেন এবং তাঁহার পাহারাদার পুলিশ নির্ব্বোধ দৃষ্টি মেলিয়া অবাক হইয়া দেখিত। তাঁহাকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এই নির্ব্বাসনে থাকিতে হয়। এই সময়ে একদিকে মহাযুদ্ধের হানাহানি পশ্চিম দিগন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন করিয়াছে, অন্যদিকে পূর্ব্ব দিগন্ত দ্বিতীয় রুশ বিপ্লবের অরুণচ্ছটায় উদ্ভাসিত।
গোয়েন্দা, গুপ্তচর, গ্রেফতার, কারাগার, পুনঃ পুনঃ পলায়ন এবং গুপ্তভাবে বৈপ্লবিক কার্য্য পরিচালনা ষ্ট্যালিনের জীবনের এই রহস্যময় ও কর্ম্মবহুল অধ্যায়ের বিবরণ অসম্পূর্ণ—কেননা তিনি ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে কোন কথাই বলেন নাই। যে সকল অবস্থার মধ্যে তিনি বাস করিয়াছেন, যে ভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর নরনারীর সম্পর্কে আসিয়াছেন, তাহা যদি তিনি লিপিবদ্ধ করিতেন, তাহা হইলে তাহা উপন্যাসের মতই রোমাঞ্চকর ঘটনায় পরিপূর্ণ হইত। সুগঠিত দেহ, ধীর মস্তিষ্ক, অদম্য ইচ্ছা শক্তি এবং অপরাহত শৌর্য্য্যবলেই ষ্ট্যালিন সমস্ত অত্যাচার ও পীড়ন সহ্য করিয়া রুশিয় গণবিপ্লবকে সাফল্যের পথে পরিচালিত করিয়াছেন। মার্কস্ লেনিনের আদর্শকে বাস্তব রূপ দিবার ঐতিহাসিক দায়িত্ব যে-ব্যক্তি গ্রহণ করিয়াছিলেন, আমরা দেখিয়াছি কিশোর বয়স হইতেই তিনি ঘৃণা করিয়াছেন প্রচলিত ব্যবস্থাকে, উদ্ধত নির্ব্বোধ শাসক সম্প্রদায়কে, জারীয় সাম্রাজ্যনীতি ও ধনতান্ত্রিক শোষণকে, আর ভালবাসিয়াছেন নিপীড়িত শোষিত শ্রমিক ও কৃষকদিগকে। ষ্ট্যালিন কখনও রাশিয়ার বাহিরে নির্ব্বাসিতের জীবন যাপন করেন নাই। সমাজের সর্ব্বশ্রেণীর নরনারীর সহিত মিশিয়া তিনি রাশিয়ার সমাজ জীবন সম্পর্কে গভীর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছিলেন। কেবল রাজনীতি ও অর্থনীতি নহে—কাব্য, সাহিত্য, শিল্পকলায় তাঁহার যে কি গভীর জ্ঞান ছিল, এই কালে তাঁহার রচিত প্রবন্ধগুলি তাহার প্রমাণ। বিপ্লবীর শুষ্ক ও নীরস কর্ম্মজীবনের আলোচনা করিতে গিয়া আমরা মাঝে মাঝে দেখিয়াছি, এই কঠোর মনুষ্যটির জীবনের একমাত্র পাথেয় ছিল,—সর্ব্বমানবের প্রতি সুগভীর প্রেম।