তিন

 ইউরোপের ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের অসামঞ্জস্য ও স্ববিরোধিতা, সাম্রাজ্যভোগী ও সাম্রাজ্যলোভীর সংগ্রামকে আসন্ন করিয়া তুলিল। বিভিন্ন রাষ্ট্র সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়া যে বৈপ্লবিক গণশক্তি আন্তর্জাতিক মহারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিতেছিল— নেতাদের দুর্ব্বলতায় সে স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গেল। জাতির বিরুদ্ধে জাতির জিঘাংসাপ্রবৃত্তি রণোন্মাদনায় রক্তপিপাসু হইয়া উঠিল। ১৯১৪ খৃষ্টাব্দের ১লা আগষ্ট জার্ম্মান সম্রাট রুশিয়ার বিরুদ্ধে, ৩রা আগষ্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে, ৪ঠা আগষ্ট বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। ৪ঠা আগষ্ঠ ইংলণ্ড জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল। ৬ই আগষ্ট অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল; ১১ই আগষ্ট ফ্রান্স ও ইংলণ্ড অষ্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, রাশিয়া ও পশ্চিম ইউরোপের সুবিধাবাদী সমাজতন্ত্রী দলগুলি স্বদেশপ্রেমের নামে স্ব স্ব দেশের গভর্ণমেণ্টকে সমর্থন করিতে লাগিল।

 এই সময়ে লেনিন গ্যালিসিয়ায় পোরোনিনো গ্রামে অবস্থান করিতে ছিলেন। স্থানীয় অস্ট্রিয়ান কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে রুশ গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেপ্তার করিল। অস্ট্রিয়ার কয়েকজন প্রতিপত্তিশালী সমাজতন্ত্রী গভর্ণমেণ্টকে বুঝাইলেন যে লেনিন একজন আন্তর্জাতিক বিপ্লবী এবং রাশিয়ার জারতন্ত্রের চিরশত্রু। তিনি কখনও রুশ সাম্রাজ্যবাদীদের চর হইতে পারেন না! দুই সপ্তাহ কারাদণ্ড ভোগ করিয়া তিনি মুক্তি লাভ করিলেন এবং সুইজারল্যাণ্ডে যাইবার অনুমতি লাভ করিলেন। ৫ই সেপ্টেম্বর হইতে ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাস পর্য্যন্ত দেড় বৎসর কাল তিনি সুইজারল্যাণ্ডের বার্ণে গ্রামে ছিলেন। তাহার পর তিনি ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত জুরিকে ছিলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হইবার পর লেনিন প্রথম হইতেই মার্কসীয় বিপ্লববাদের দিক হইতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচার কার্য্য করিতে লাগিলেন। ১৯১৪ সালের পহেলা নভেম্বর লেনিন কেন্দ্রীয় বলশেভিকদের পক্ষ হইতে “যুদ্ধ ও রুশীয় সোশ্যাল ডেমোক্রেসী” নামক এক ঘোষণাপত্র প্রচার করেন। যুদ্ধের প্রারম্ভেই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সঙ্ঘে সমাজতন্ত্রিগণ অধিকাংশের ভোটে সিদ্ধান্ত করেন যে, জাতীয় আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধে যোগ দিতে হইবে। ধনিকশ্রেণী ও জাতীয় সাম্রাজ্যবাদের সহিত শ্রমজীবিদের ঐক্যের প্রয়োজন। ইউরোপের মহাযুদ্ধের উন্মাদনায় সমাজতন্ত্রিগণ যখন আন্তর্জ্জাতিক নীতি বিসর্জ্জন দিয়া স্ব স্ব দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টার সহিত যোগ দিলেন, তখন মুষ্টিমেয় বলশেভিক বিপন্ন হইয়া পড়িলেন, আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাস রক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠিল। লেনিন বহুমতের স্রোতে গা ঢালিয়া দিতে অস্বীকার করিলেন। সমগ্র মানব জাতির মুক্তির স্বপ্নে বিভোর মুষ্টিমেয় সহকর্ম্মী লইয়া তিনি পূর্ব্বোক্ত ঘোষণাপত্রে প্রচার করিলেন, “সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সূচনাতেই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ ভাঙ্গিয়া পড়িল, মার্কস‍্পন্থী বিপ্লবীরা দলের আদর্শ বিসর্জ্জন দিয়া বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর সহিত যোগ দিয়াছে। এই বিচ্ছেদকে সম্পূর্ণভাবে আমাদের স্বীকার করিতে হইবে। সুবিধাবাদী ও যুদ্ধরত সমাজতন্ত্রীদের বাদ দিয়া আমাদিগকে এক নূতন বৈপ্লবিক আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ গড়িতে, হইবে।” সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত কর এবং জারতন্ত্রের পরাজয় কামনা কর, এই বাণী তিনি রাশিয়ার সর্ব্বত্র প্রচার করিলেন এবং বলিলেন, এক মাত্র বলশেভিকেরাই খাঁটী সমাজতন্ত্রী এবং তাহারাই সংশয় সন্দেহে অথবা প্রলোভনে আত্মহারা না হইয়া বর্ত্তমান যুদ্ধকে মার্কসীয় বিপ্লবীর দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা বিচার করিতেছে। “দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মৃত, সুবিধাবাদীদের দ্বারা নিহত। সুবিধাবাদ ভুলুণ্ঠিত হউক। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের পতাকা উত্তোলিত হউক,”—১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসের এই ঘোষণার সাড়ে চারি বৎসর পরে লেনিনের প্রতিভাপ্রসূত তৃতীয় আন্তর্জ্জাতিক বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করে।

 প্রতিক্রিয়াশীল জার গভর্ণমেণ্টের এবং অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও বলশেভিকদল ধীরে ধীরে রাশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করিতে লাগিল। কিন্তু সুপরিচিত বলশেভিক নেতারা প্রায় সকলেই সাইবেরিয়ায় নির্ব্বাসিত হইলেন। লেনিন তাঁহার নির্ব্বাসিত সহকর্ম্মীদের লইয়া ইউরোপ হইতে প্রচার কার্য চালাইতে লাগিলেন। জার্ম্মান সোশ্যালিষ্ট প্রতিপত্তিশালী নেতা কাউট্‌স্কি পোল-জার্ম্মান নেতা রোজা লুক্সেম‍্বার্গ প্রভৃতি দ্বিতীয় আন্তর্জ্জাতিকের নেতাগণ সমাজতন্ত্রবাদের সহিত জাতীয়তাবাদ মিশাইয়া মার্কসবাদ বিরোধী প্রচাবকার্য্যে রত হইলেন। ১৯১৬ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কিন্থলে সমাজতন্ত্রী সম্মেলনে লেনিন দেখিলেন, অধিকাংশ ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রবাদী প্রতি-বিপ্লবী হইয়া দাঁড়াইয়াছেন। রাশিয়ান দলের কেন্দ্রীয় সমিতির নামে লেনিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করিলেন, তিনি মার্কস্-এঙ্গেল প্রদর্শিত পন্থা হইতে ভ্রষ্ট হইবেন না। গত বিশ বৎসর ধরিয়া তিনি যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিতেছেন রাশিয়ার জনসাধারণ তাহাকে বাস্তবে রূপ দিবে। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলিতে জনসাধারণ গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিবে এইরূপ আশাও তিনি পোষণ করিতেন। অন্ততঃ তিনি বিশ্বাস করিতেন, রাশিয়ার জনসাধারণ যদি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধন করিতে পারে তাহার প্রতিক্রিয়া এশিয়া ও ইউরোপে সুদূর প্রসারী হইবে।

 সমগ্র ইউরোপ যখন রণহিংসায় উন্মত্ত, পর-জাতিবিদ্বেয়ে অন্ধ, তখন একমাত্র বলশেভিক পার্টি লেনিনের নেতৃত্বে আন্তর্জ্জাতিকতার রক্তপতাকা ঊর্দ্ধে তুলিয়া রাখিলেন। সুদূর সাইবেরিয়ায় নির্ব্বাসিত ষ্ট্যালিন নিষিদ্ধ উপায়ে লেনিনকে সমর্থন করিলেন, পার্টির অভ্যন্তরস্থ সুবিধাবাদীদিগের কার্য্যকলাপের তীব্র নিন্দা করিতে লাগিলেন। এইকালে তাঁহার রচিত প্রবন্ধগুলি ছদ্মনামে পার্টির পত্রিকায় প্রকাশিত হইত।

 মহাযুদ্ধের আঘাতে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার অর্থনৈতিক দৌর্ব্বল্য সাংঘাতিক হইয়া দেখা দিল। যন্ত্রশিল্প এবং যুদ্ধ পরিচালনায় জার গভর্ণমেণ্টের অক্ষমতা দিকে দিকে আত্মপ্রকাশ করিল। দৃঢ়তা ও বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করিয়াও রুশসৈন্য বারম্বার পরাজিত হইতে লাগিল। দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা সমরবিভাগের পক্ষে বিপজ্জনক হইয়া উঠিল, সৈন্যরা উপযুক্ত রসদ ও গুলী বারুদ পাইল না। কেবল বলশেভিক পার্টি নহে, মধ্যশ্রেণীর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও বলিতে লাগিলেন, জার গভর্ণমেণ্ট দেউলিয়া হইয়া পড়িয়াছে। খাদ্যের অভাবে শ্রমিকদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিল। ধর্ম্মঘট বিস্তার লাভ করিল, পুলিশ গুলী চালাইয়া ধর্ম্মঘট বন্ধ করিতে অক্ষম হইল।

 অভিজাত শ্রেণীর পরামর্শ অগ্রাহ্য করিয়া জার দমননীতিতে অটুট রহিলেন। এই স্ত্রৈণ কাপুরুষ নির্ব্বোধ লোকটির দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না। “যদি অর্দ্ধেক রাশিয়াকে ফাঁসী কাষ্ঠে লট্‌কাইতে হয়, তাহা হইলেও আমি অটল থাকিব”—এই কথা বলার দুইদিন পরই রুশজাতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা পদত্যাগ করিলেন। ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারী মাসের বিপ্লবের স্রোতে প্রাচীন ব্যবস্থা ভাসিয়া গেল। এই বিপ্লবে অভিজাতবংশীয় গ্রাণ্ড ডিউক হইতে মধ্যশ্রেণীর বুদ্ধিজীবিরা মিলিয়া একটা নূতন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করিলেন। প্রিন্স লোভফ অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট স্থাপন করিলেন, কিন্তু আসলে যুবক ব্যবহারজীবী কেরেনেস্কীই হইলেন এই গভর্ণমেণ্টের কর্ণধার। ইহার বাগ্মিতা ছিল অসাধারণ; রাজনৈতিক চিন্তায় বৈপ্লবিক হইয়াও ইঁহার কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। রাষ্ট্রের কর্ত্তৃত্ব গ্রহণ করিয়া ইনি ঘোষণা করিলেন—“আমি রাশিয়াকে ইউরোপের মধ্যে স্বাধীনতম রাষ্ট্রে পরিণত করিতে চাহি।” কেরেনেস্কী গভর্ণমেণ্ট সর্ব্ববিধ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিবার আদেশ দিলেন।

 মুক্তি পাইবামাত্র ষ্ট্যালিন পেট্রোগ্রাডে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে সহরের বলশেভিক শ্রমিক পার্টির বৈপ্লবিক কর্ম্মধারা পরিচালনা করিতে লাগিলেন। ১৮ই মার্চ্চ পুনরায় “প্রাভ‍্দা” পত্রিকা প্রকাশিত হইল। ষ্ট্যালিন সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লিখিলেন,—

 “পুরাতন শক্তিকে ধ্বংস করিতে বিদ্রোহী শ্রমিক ও সৈনিকের সাময়িক ঐক্যই যথেষ্ট; কেননা, সৈনিকের পোষাক পরিহিত রাশিয়ান শ্রমিক ও কৃষকের ঐক্যই যে রুশ-বিপ্লবের ভিত্তি ইহা স্বতঃসিদ্ধ।

 “কিন্তু শ্রমিক এবং সৈনিকের অস্থায়ী মৈত্রী অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা অথবা বিপ্লবকে অধিকতর পরিণতির দিকে অগ্রসর করিবার পক্ষে আদৌ পর্য্যাপ্ত নহে।

 “ইহার জন্য প্রয়োজন—এই মৈত্রীকে সচেতন, নিরাপদ, স্থায়ী এবং দৃঢ় করিতে হইবে। এমন দৃঢ় করিতে হইবে যাহা প্রতিবিপ্লবীদের প্ররোচনাতেও অটল থাকিবে। ইহ। সকলের সম্মুখেই স্পষ্ট যে, রাশিয়ান বিপ্লবকে চরম জয়যুক্ত করিতে হইলে বিপ্লবী শ্রমিক ও বিপ্লবী সৈনিকদের ঐক্যকে দৃঢ়তর করা প্রয়োজন।

 “এই ঐকোর প্রতিভূ হইল শ্রমিকদের সোভিয়েট এবং সৈনিকদের ডেপুটিগণ।

 “এই সোভিয়েটগুলিকে দৃঢ় ভিত্তিতে সংহত ও সঙ্ঘবদ্ধ করিতে হইবে। বৈপ্লবিক জনগণের বৈপ্লবিক শক্তির ইহারা হইল প্রতীক এবং প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে বর্ম্মস্বরূপ।

 “বৈপ্লবিক সোশ্যাল ডেমোক্রাটগণ সোভিয়েটগুলিকে সঙ্ঘবদ্ধ, ব্যাপক, সার্ব্বজনীন করিবার কাজে নিশ্চয়ই আত্মনিয়োগ করিবে। জনসাধারণের বৈপ্লবিক শক্তির প্রতিষ্ঠান শ্রমিক ও দৈনিক ডেপুটিগণের কেন্দ্রীয় সোভিয়েটের সহিত ঐগুলিকে যুক্ত করিতে হইবে।”

 সুইজারল্যাণ্ড হইতে লেনিন রাশিয়ার ঘটনাবলীর প্রতি নিষ্পলকে চাহিয়াছিলেন। সুইডেন ও ফিনল্যাণ্ডের বিপ্লবীদের মারফতে তিনি রাশিয়ার বলশেভিক কর্ম্মীদের সহিত যোগ রক্ষা করিয়া আবশ্যক মত নির্দ্দেশ দিতেন। মধ্যশ্রেণীর বিদ্রোহের জন্য ১৯১৬ সালের শেষভাগেই তিনি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। জারতন্ত্র যে ভাঙ্গিয়া পড়িবে সে সম্বন্ধে তাঁহার মনে কোন সংশয় ছিল না। তিনি নির্দ্দেশ দিলেন, বলশেভিক পার্টিকে মেনশেভিকদলের সহিত সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করিতে হইবে এবং ট্রট‍্স্কীর মত যাহারা বুঝিতে পারে না যে এখন পুনর্মিলন বা ঐক্যের প্রস্তাব লইয়া ভাববিলাসের সময় নহে তাহাদের কথায়ও কর্ণপাত করা হইবে না; সমাজতন্ত্রের অনুকূলে বৈপ্লবিক সংঘর্ষ পরিচালনা করিতে হইলে যাহাদের কথা ও কাজ এক নহে এমন সব সুবিধাবাদীকে নির্ম্মম হস্তে উদ্ঘাটিত করিতে হইবে।

 ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের সংবাদ পাইয়া লেনিন রাশিয়ায় ফিরিবার জন্য উদ্গ্রীব হইলেন। বৃটিশ ও ফরাসী কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক রাশিয়ান বিপ্লবীদের প্রত্যাবর্ত্তনের পথ দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। রাশিয়ার অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টণ্টও প্রবাসী “জরাজীর্ণ” বলশেভিকদের রাশিয়ায় প্রবেশ করিতে দিতে আগ্রহশীল ছিলেন না। এদিকে পেট্রোগ্রাড হইতে আহ্বান আসিতে লাগিল, লেনিনের উপস্থিতি অবিলম্বে প্রয়োজন। লেনিন জার্ম্মান গভর্ণমেণ্টের সহিত সুইস সোশ্যাল ডেমোক্রাট ফ্লিটজ প্ল্যাটেনের মারফং কথাবার্ত্তা চালাইতে লাগিলেন। অবশেষে সুইজারল্যাণ্ডের জার্ম্মান রাষ্ট্রদূত ও প্ল্যাটেনের মধ্যে চুক্তি হইল—(১) যুদ্ধ সম্বন্ধে যাহার যে মতই হউক না কেন, সমস্ত প্রবাসী রাশিয়ানকে যাইবার অনুমতি দেওয়া হইবে; (২) যে রেলগাড়ীতে ইহারা যাইবে প্ল্যাটেনের অনুমতি ব্যতীত সেই গাড়ীতে আর কাহাকেও ভ্রমণ করিতে দেওয়া হইবে না। ছাড়পত্র বা লাগেজ পরীক্ষা করা হইবে না; (৩) যাত্রীরা রাশিয়ায় গিয়া নির্দ্দিষ্টসংখ্যক জার্মান বন্দীর মুক্তির জন্য আন্দোলন করিবে।

 চুক্তি স্বাক্ষরিত হইবামাত্র লেনিন সন্ত্রীক, জিনোভিফ্, রাডেক প্রভৃতি ৩০ জন সঙ্গীসহ যাত্রা করিলেন। বার্লিন হইয়া লেনিন সদলবলে সুইডেনের ষ্টক্হলমে উপস্থিত হইলেন। ফিনল্যাণ্ডের মধ্য দিয়া ১৬ই এপ্রিল লেনিন পেট্রোগ্রাডে প্রবেশ করিলেন। সহস্র সহস্র শ্রমিক, সৈনিক, নাবিক ষ্টেশনে লেনিনকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা করিল। জনসমুদ্রবেষ্টিত লেনিন অভ্যর্থনার উত্তরে বলিয়া উঠিলেন—“জগদ্ব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক।”

 পেট্রোগ্রাডে বলশেভিক সম্মেলনে লেনিন তাঁহার কার্য্যক্রম ঘোষণা করিলেন। ২০শে এপ্রিল উহা ‘প্রাভ‍্দায়’ প্রকাশিত হইল। মধ্যশ্রেণীর বিপ্লবকে কৃষক-শ্রমিক বিপ্লবে পরিণত করিয়া এখনই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে এই প্রস্তাবে তুমুল তর্কের তুফান উঠিল। সকলের মুখেই এক প্রশ্ন—বিপ্লব কি এইখানেই শেষ হইবে! পিটার দি গ্রেটের বংশধরগণ তাঁহাদের স্বৈরাচারের ঐতিহাসিক খেলা শেষ করিয়া চিরনিদ্রায় অভিভূত। মধ্যশ্রেণীর মেনশেভিক, লিবারেল, সোশ্যাল রেভল্যুশ্যনারী প্রভৃতি দল বলশেভিক প্রাধান্যে ভীত হইয়া কেরেনেস্কী গভর্ণমেণ্টকে সমর্থন এবং গণ-পরিষদ আহ্বান করিয়া গণতান্ত্রিক গভর্ণমেণ্ট গঠনের প্রতিশ্রুতি দিতে লাগিলেন। তাঁহাদের মুখে গণতন্ত্রের বুলি, কিন্তু কাজ তাঁহাদের গণতন্ত্র বিরোধী। তাঁহারা সম্রাটের পরিবর্ত্তে আনিলেন সভাপতি এবং সিংহাসন সরাইয়া বসাইলেন আভরণহীন কাষ্ঠাসন। শাসনবিধিতে যে সকল পরিবর্ত্তন ঘোষণা করা হইল তাহা জনসাধারণের দাসত্বকে কায়েম করিবার এ্যাংলো-আমেরিকান ব্যবস্থার অনুকরণমাত্র।

 বলশেভিক পার্টির মধ্যেও বিক্ষোভ দেখা দিল। লেনিনের অনুসরণ করিয়া ষ্ট্যালিন বলিলেন—“মধ্যশ্রেণী ক্ষমতা অধিকার করিয়া তাহাদের স্বার্থের অনুকূল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করিবে; আমরা চাহি গণবিপ্লব দ্বারা সমাজতন্ত্রসম্মত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করিতে; মধ্যশ্রেণীর বিপ্লব রক্ষণশীল, অর্দ্ধবিপ্লব কার্য্যতঃ প্রতিবিপ্লব।” বিপ্লব সম্পর্কে লেনিনের নূতন কর্ম্মতালিকার সাফল্য সম্বন্ধে সন্দিহান দুর্ব্বলচিত্ত কামেনফ্, জিনোভিফ্, রয়কফ, বুখারিন প্রভৃতির সুবিধাবাদসুলভ মনোভাব হইতে পার্টিকে রক্ষা করার জন্য ষ্ট্যালিন সরাসরি অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে বহু শোভাযাত্রা এবং সভা-সমিতি হইল। সৈনিকদিগের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী প্রচারকার্য্য পূর্ণোদ্যমে চলিতে লাগিল। ১লা জুলাই-এর স্মরণীয় মিছিল ও জনবিক্ষোভ প্রদর্শন উপলক্ষে পেট্রোগ্রাভ পার্টির পক্ষ হইতে ষ্ট্যালিন ঘোষণাপত্র প্রচার করিলেন—

 “স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের শত্রুদিগকে বিষণ্ণ করিয়া তোমাদের জয় পতাকা উর্দ্ধে আন্দোলিত হউক।

 “...তোমাদের আহ্বান—বিপ্লবের সৈনিকদিগের আহ্বান সমগ্র জগতে প্রতিধ্বনিত হইয়া নিপীড়িত ও শৃঙ্খলিত জনগণকে আনন্দিত করুক।

 “শ্রমিক! সৈনিক! বাহুতে বাহু বাঁধিয়া সমাজতন্ত্রের পতাকা উড়াইয়া যাত্রা কর।”

 মধ্যশ্রেণীর গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে রাজধানীতে ইহাই সর্ব্বপ্রথম সঙ্ঘবদ্ধ রাজনৈতিক বিক্ষোভ। লক্ষ লক্ষ নরনারী রক্তপতাকা হস্তে রাজপথ মুখরিত করিয়া সমুচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগিল,—“ধনিক শ্রেণীর দশজন মন্ত্রীর নিপাত হউক;” “সমস্ত ক্ষমতা শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের ডেপুটি দ্বারা গঠিত সোভিয়েটের হাতে আসুক।”

 কেন্দ্রীয় পার্টি শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদলে পার্টির আদর্শ প্রচার করিতে লাগিলেন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধক্ষেত্র হইতে সৈন্যদিগকে ফিরাইয়া আনিয়া নূতন সৈন্যদল গঠনের কাজ বলশেভিকদের পক্ষে সহজ ছিল না। বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের লোক লইয়া গঠিত সৈন্যদলের মধ্যে খাঁটি রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে অনেক বিক্ষোভ ছিল। বলশেভিক পার্টির নেতারা পার্টির সমরবিভাগের এক সম্মেলন আহ্বান করিলেন। সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতিগুলির দ্বারা গঠিত সৈন্যদলের মধ্যে ঐক্য স্থাপনকল্পে ষ্ট্যালিনের নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি সর্ব্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হইল—

 “এই সম্মেলনের সুদৃঢ় বিশ্বাস এই যে, বিভিন্ন জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্থায়িভাবে স্বীকার—কেবল বাক্য দ্বারা নহে কার্য্য দ্বারা অঙ্গীকার করিয়াই রাশিয়ার বিভিন্ন জাতিগুলির মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা হইতে পারে এবং এই পথেই, বলপূর্ব্বক নহে, স্বতঃপ্রবৃত্ত ঐক্যের পথ প্রশস্ত হইবে এবং একটি অবিভাজ্য রাষ্ট্র গঠিত হইবে।”

 জনগণের প্রতিবাদ, সৈন্যদলের অসন্তোষ সত্ত্বেও কেরেনেস্কী গভর্ণমেণ্ট সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চালাইয়া যাইতে লাগিল। প্রথমদিকে ইহারা বলশেভিকদলের বিরোধিতা করেন নাই, কিন্তু বলশেভিকদলের ক্রমবর্দ্ধিত শক্তি ও প্রভাব দেখিয়া দমননীতি অবলম্বিত হইল। পেট্রোগ্রাডে শোভাযাত্রার উপর গুলি চলিল। '‘প্রাভদা' ও অন্যান্য পত্রিকা নিষিদ্ধ হইল। জেনারেল কর্ণিলফ‍্কে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করিয়া কেরেনেস্কী সৈনাদলে শৃঙ্খলা স্থাপন করিতে লাগিলেন। রণক্ষেত্রে কঠোর দণ্ড এমনকি মৃত্যুদণ্ড দিবার ব্যবস্থা হইল। বিপ্লবী বলশেভিক পার্টির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন সৈন্যদিগকে পেট্রোগ্রাড হইতে বদলী করার চেষ্টা চলিল। পার্টি প্রায় বে-আইনী ঘোষিত হইল। কিন্তু তৎসত্ত্বেও পার্টির সদস্য সংখ্যা তিনমাসে দ্বিগুণ হইল।

 আগষ্ট মাসে বলশেভিক পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস আহূত হইল। গোপনে অধিবেশন হইল। লেনিন এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। কেরেনেস্কীর চরেরা তখন তাঁহার সন্ধান করিতেছিল। পার্টির পরামর্শে তিনি তখন ফিনল্যাণ্ডে আত্মগোপন করিয়াছিলেন। লেনিনের নির্দ্দেশানুযায়ী ষ্ট্যালিন কংগ্রেসের কার্য্য পরিচালনা করিলেন। এই কংগ্রেসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রচুর, কেননা এই কংগ্রেসেই বলশেভিক পার্টি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ হইতে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সমালোচনা প্রসঙ্গে ষ্ট্যালিন বলিলেন—“কেন্দ্রীয় কমিটির গত আড়াই মাসের কার্যপ্রণালী আলোচনার পূর্ব্বে আমি মনে করি, যে মূলনীতি লইয়া আমরা কাজ করিতেছি তাহা উল্লেখ করা আবশ্যক। আমাদের বিপ্লব বিকাশ ও পরিপুষ্টির পথে এই প্রশ্নগুলির সম্মুখীন হইয়াছে—(১) অর্থনীতিক্ষেত্রে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ, (২) কৃষকদিগকে জমির মালিকানা স্বত্ব দান, (৩) মধ্যশ্রেণীর হস্ত হইতে ক্ষমতা শ্রমিক ও সৈনিকদের সোভিয়েটের হস্তে আনয়ন। আমাদের বিপ্লবের উপর এই প্রশ্নগুলির প্রভাব দূরপ্রসারী। শ্রমিকের বিপ্লব সমাজতান্ত্রিকরূপ পরিগ্রহ করিতেছে।”

 রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আলোচনায় ষ্ট্যালিন বলিলেন—“জুলাই মাস হইতে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার বহু পরিবর্ত্তন হইয়াছে; সোভিয়েটের আধিপত্য লোপ করিবার জন্য লেনিনের বিরুদ্ধে গ্রেফ‍্তারী পরোয়ানা এবং বলশেভিকদের বিরুদ্ধে জরুরী আইন প্রয়োগ করা হইয়াছে; পেট্রোগ্রাডের বৈপ্লবিক সৈন্যদল ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং ‘রেড গার্ড’ দল বে-আইনী ঘোষণা করা হইয়াছে। অতএব শান্তিপূর্ণ ও বৈধ উপায়ে জনসাধারণের হস্তে ক্ষমতা গ্রহণের অধ্যায় শেষ হইয়াছে।”

 ষ্ট্যালিন দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন— “৩রা জুলাই-এর পূর্ব্বে শান্তিপূর্ণ জয়, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সোভিয়েটের ক্ষমতা গ্রহণের সম্ভাবনা ছিল। যদি সোভিয়েট কংগ্রেস ক্ষমতা গ্রহণের সিদ্ধান্ত করিত তাহা হইলে সৈন্যগণ সোভিয়েটের বিরুদ্ধে কার্য্য করিতে সাহস পাইত না, কেননা তাহা ব্যর্থ হইত। কিন্তু এখন প্রতিবিপ্লবীরা সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া শক্তিসঞ্চয় করিয়াছে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সোভিয়েট ক্ষমতা গ্রহণ করিতে পারে এখন একথা বলা মূঢ়তা মাত্র। বিপ্লবের শাস্তিপূর্ণ অধ্যায় শেষ এবং অশান্তিপূর্ণ অধ্যায় আরম্ভ হইয়াছে—সংঘর্ষ অনিবার্য্য ও আসন্ন।”

 ট্রট‍্স্কীপন্থীরা প্রতিবাদের গুঞ্জন তুলিলেন। তাঁহাদের প্রতিনিধি প্রেয়োব্রাজেনস্কী বলিলেন পশ্চিম ইউরোপে গণবিপ্লব না হইলে একমাত্র রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র স্থাপন করা যাইবে না। বিশ্ববিপ্লব ব্যতীত একটি রাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ স্থাপন সম্ভবপর নহে, ট্রট‍্স্কীর এই মতবাদের দৌর্ব্বল্য ও অযৌক্তিকতা দেখাইয়া ষ্ট্যালিন বলিলেন—“রাশিয়াই সর্ব্বপ্রথম সমাজতন্ত্রবাদের পথ প্রস্তুত করিবে, তাহার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রহিয়াছে। কোন দেশে বর্তমানে রাশিয়ার মত স্বাধীনতা নাই, কোন দেশে উৎপাদন-ব্যবস্থা শ্রমিকশ্রেণীর দ্বারা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয় নাই। অধিকন্তু পশ্চিম ইউরোপ অপেক্ষাও আমাদের বিপ্লবের ভিত্তি প্রশস্ততর। সেখানে প্রোলেটারিয়েট শ্রমিকরা একক বুর্জোয়া শ্রেণীর সম্মুখীন। এখানে শ্রমিকদের পশ্চাতে দরিদ্র কৃষক শ্রেণী রহিয়াছে ***। একমাত্র ইউরোপই আমাদের পথ দেখাইতে পারে এই প্রাচীন ধারণা ত্যাগ করিতে হইবে। দুই রকম মার্ক্সবাদ আছে—একটি গোঁড়া পুঁথিঘেষা, আর একটি সৃজনীশক্তিসম্পন্ন। আমি শেষোক্তটির সমর্থক।”

 বুখারিন ট্রট্‌স্কীপন্থীদের সমর্থন করিয়া আপত্তি তুলিলেন— কৃষকরা দেশরক্ষার যুদ্ধের পক্ষপাতী, তাহারা বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর অনুরক্ত, তাহারা কিছুতেই শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব মানিবে না। ষ্ট্যালিন বলিলেন—ধনী কৃষকেরা সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের সমর্থক, কিন্তু দরিদ্র কৃষকেরা শ্রমিক শ্রেণীর সহিত ঐক্যবদ্ধ হইয়াছে এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে বিজয়ী করিবার সংঘর্ষে যোগ দিয়াছে। প্রেয়োব্রাজেনস্কী, বুখারিন ও অন্যান্য সুবিধাবাদীদের সংশোধনী প্রস্তাব পরিত্যক্ত হইল। কংগ্রেস বিপুল ভোটাধিক্যে ষ্ট্যালিনের প্রস্তাব গ্রহণ করিল। লেনিনের নির্দেশানুসারে ষ্ট্যালিন পার্টি কংগ্রেসকে মূল লক্ষ্যে সংহত করিলেন— বুর্জ্জোয়া গভর্ণমেণ্টের উৎখাত এবং কৃষক-শ্রমিকের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

 আবহাওয়া বিপ্লবের সম্ভাবনায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। মস্কৌ পেট্রোগাডের শ্রমিক সোভিয়েটগুলি এবং সৈন্যদলের প্রতিনিধিরা অধিক সংখ্যায় বলশেভিক পার্টির আনুগত্য স্বীকার করিতে লাগিল। যুদ্ধের ব্যর্থতায় এবং উৎকোচগ্রাহী ও অপদার্থ শাসকগণের আভ্যন্তরীণ শান্তি, শৃঙ্খলা ও সরবরাহ ব্যবস্থা রক্ষার অক্ষমতায় জনসাধারণ অসন্তুষ্ট হইয়া উঠিল। খাদ্যাভাবে দলে দলে কৃষক নরনারী সহরে আসিয়া বলশেভিক বিপ্লবের বাণী শুনিতে লাগিল। বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে তাহারা মিছিল করিয়া দাবী করিতে লাগিল— “যুদ্ধ নিপাত যাউক, কৃষক ভূমির মালিক হউক, আমরা অন্ন চাই, খাদ্য জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত হউক।”

 কেরেনেস্কী সংশয়সঙ্কুল ভীরুতা লইয়া ডিক্টেটরী ভঙ্গীতে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বলশেভিক বিপ্লবীদের ঠেকাইবার জন্য তিনি তিনটি পথ অবলম্বন করিলেন— (১) আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থার কিছু সংস্কার, (২) জার্ম্মানীর সহিত যুদ্ধ চালাইবার ঠাট্ বজায় রাখিয়া এ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ সহায়তা লাভের চেষ্টা, (৩) বলশেভিকদের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য্য বুর্জ্জোয়া সংবাদপত্রগুলিতে প্রচারিত হইতে লাগিল —লেনিন জার্ম্মানীর গুপ্তচর, বার্লিন হইতে স্বর্ণমুদ্রা আনিয়া তিনি জার্ম্মানীর নিকট রাশিয়াকে বিক্রয় করিবার ষড়যন্ত্র করিতেছেন। কিন্তু তখন জমিদার, মহাজন, শিল্পপতি এবং কেরেনেস্কীর সমর্থকদের উপর জনসাধারণের কোন আস্থা ছিল না। প্রতিবিপ্লবীদের দমননীতি এবং প্রচারকার্য্য ব্যর্থ করিয়া দলে দলে দৈনিক বলশেভিক দলে যোগ দিতে লাগিল। মস্কৌ-এ ৪ লক্ষ শ্রমিক কেরেনেস্কী গভর্ণমেণ্টের দমননীতির প্রতিবাদে ধর্ম্মঘট ঘোষণা করিল।

 একদিকে বলশেভিক পার্টির ক্রমবর্ধমান প্রভাব, অন্যদিকে কেরেনেস্কীর দুর্ব্বলতায় সেনাপতি কর্ণিলভ বিদ্রোহ করিলেন। প্রতিবিপ্লবী সেনাপতিদের বিদ্রোহের ফলে গৃহযুদ্ধে বিপ্লবের সমূহ ক্ষতি হইবে মনে করিয়া বলশেভিক পার্টি ইহার প্রতিরোধ করিতে প্রস্তুত হইল। “আমাদের দাবী” শীর্ষক ঘোষণাপত্রে ষ্ট্যালিন প্রচার করিলেন—

 “বর্ত্তমান কোয়ালিশান গভর্ণমেণ্টের সহিত কর্ণিলভ দলের যে সংগ্রাম তাহা বিপ্লবের সহিত প্রতিবিপ্রবের সংগ্রাম নহে। উহা প্রতিবিপ্লবের দুইটি পৃথক উপায় মাত্র। কর্ণিলভ দল বিপ্লবের শত্রু এবং রীগা শত্রু-হস্তে অর্পণ করিয়া ইহারা পেট্রোগ্রাডে আসিতেছে পুরাতন শাসনবাবস্থা ফিরাইয়া আনিবার জন্য।”

 ষ্টালিনের আবেদনে বৈপ্লবিক শ্রমিকশক্তি কর্ণিলভকে বাধা দিবার জন্য প্রস্তুত হইল। ২৫শে আগষ্ট কর্ণিলভ অভিযান শুরু করিলেন। পেট্রোগ্রাড ও ভাইবর্গের শ্রমিকেরা নগর রক্ষায় রুখিয়া দাঁড়াইল। বলশেভিক প্রচারকেরা কর্ণিলভের অগ্রগামী সৈন্যদলকে ছত্রভঙ্গ করিয়া বিপ্লবীদের পক্ষে যোগদান করাইল। যুদ্ধই হইল না। কর্ণিলভ-বিদ্রোহ দমন শ্রমিকশক্তির প্রথম বাস্তব সাফল্যের অভিজ্ঞতা। উৎসাহিত হইয়া বলশেভিক পার্টি সৈনিক, শ্রমিক এবং দরিদ্র কৃষকদিগকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত করিতে লাগিল। লেনিন কেন্দ্রীয় কমিটিকে নির্দেশ দিলেন—যখন পেট্রোগ্রাড ও মস্কৌ-র সোভিয়েটগুলিতে আমাদের পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ তখন গভর্ণমেণ্টের শাসনরশ্মি কাড়িয়া লইতে আমরা সক্ষম এবং তাহাই কর্ত্তব্য।

 ১০ই অক্টোবর লেনিন পেট্রোগ্রাডে ফিরিয়া আসিলেন। ২৩শে অক্টোবর পার্টির কেন্দ্রীয় সমিতির চিরস্মরণীয় সভায় তিনি যোগ দিলেন। এই সভায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তাব গৃহীত হইল। লেনিন, ষ্ট্যালিন, ট্রট‍্স্কী সহ দশজন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেন। জিনোভিফ্ ও কামেনফ্ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। লেনিন ইহা কখনও বিস্মৃত হন নাই। তিনি বলশেভিক দলের প্রতি তাঁহার চরমপত্রে এই কলঙ্ক লিপিবব্ধ করিতে গিয়া বলিয়াছেন, উহারা বলশেভিক কখনও ছিল না। আমাদের দলে থাকিলেও উহারা বলশেভিক নহে। ট্রট‍্স্কীর দৌর্ব্বল্য লেনিন জানিতেন। তথাপি প্রতিভাশালী, ক্ষমতালোলুপ, আড়ম্বরপ্রিয়, বাগ্মী ট্রট্‌স্কীকে পেট্রোগ্রাড সোভিয়েটের সভাপতি নির্ব্বাচিত করিয়া সৈন্যদলকে বিদ্রোহী করিবার ভার অর্পণ করা হইল। ট্রট‍্স্কী তাঁহার অনন্যসাধারণ বাগ্মিতায় জনসাধারণের মধ্যে অপূর্ব্ব উন্মাদনার সৃষ্টি করিলেন।

 ২৯শে অক্টোবর পেট্রোগ্রাডের বিভিন্ন বলশেভিক পার্টির কার্য্যকরী সমিতিগুলির এবং কেন্দ্রীয় সমিতির যুক্ত অধিবেশন হইল! পেট্রোগ্রাড সোভিয়েট এবং সৈনিকসঙ্ঘের অধিবেশন হইল। এই দুই অধিবেশনেই জিনোভিফ্, ও কামেনফ্ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিলেন। ষ্ট্যালিন লেনিনকে সমর্থন করিয়া বলিলেন—“জিনোভিফ্-কামেনফের প্রস্তাব কার্য্যক্ষেত্রে প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্ঘবদ্ধ হইবার সুযোগ দিবে; আমরা ক্রমাগত পিছু হটিব এবং সশস্ত্র বিপ্লব ব্যর্থ হইয়া যাইবে। আমাদের সম্মুখে দুটি পথ—এক ইউরোপের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া বিপ্লবকে বিজয়ী করিয়া তোলা, অন্যটি বিপ্লবে বিশ্বাস না করা এবং সরকারবিরোধী দলরূপে সময়ক্ষেপ করা। পেট্রোগ্রাড সোভিয়েট সৈন্যদল অপসারিত করিতে অস্বীকার করিয়া গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করিবার প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে। নৌবহর আমাদের পার্টিতে যোগ দিয়া কেরেনেস্কীর বিরুদ্ধে গিয়াছে।” ২৯শে তারিখেই কেন্দ্রীয় সমিতির এক গোপন ঘরোয়া বৈঠকে ষ্ট্যালিনের নেতৃত্বে বৈপ্লাবক সামরিক সমিতি সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা প্রস্তুত করিলেন।

 সশস্ত্র বিদ্রোহের আসন্ন মুহূর্ত্তে (৬ই নভেম্বর) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের নিকট এক পত্রে লেনিন লিখিলেন—“গণবিপ্লবের উত্থানকে আজ সংযমের সহিত পরিচালনা করা মৃত্যুরই নামান্তর। চরম মুহূর্ত্ত উপস্থিত।......কোন অবস্থাতেই কেরেনেস্কী ও তাহার দলের হাতে সামান্য ক্ষমতাও রাখা উচিত নহে। আজ সন্ধ্য। এবং রাত্রির মধ্যেই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইবে!”

 ঐদিনই দলের পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ষ্ট্যালিন আবেদন করিলেন—“আর বিলম্ব করিলে তাহা বিপ্লবের পক্ষে মারাত্মক হইবে। জমিদার ও পু’জীপতিদের গভর্ণমেণ্টের স্থলে কৃষক ও শ্রমিকের গভর্ণমেণ্ট স্থাপন করিতে হইবে।.....ক্ষমতা শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের ডেপুটিগণ লইয়া গঠিত সোভিয়েটের হাতে আনিতে হইবে। নূতন গভর্ণমেণ্ট সোভিয়েট কর্ত্তৃক গঠিত হইবে, তাহা সোভিয়েটের নিকট দায়ী থাকিবে এবং একমাত্র সোভিয়েটই তাহা অপসারণ করিতে পারিবে।”

 অন্যদিকে কেরেনেস্কী বলশেভিক পার্টিকে বে-আইনী ঘোষণা করিয়া প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলির সহায়তায় সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিতেছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যদলের মিলিত অভ্যুত্থানের দুর্জ্জয় শক্তি দেখিয়া তাঁহার চমক ভাঙ্গিল; সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার ও অভিজাতবর্গ তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া গা-ঢাকা দিল; তাহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া কেরেনেস্কীও পলায়ন করিলেন। ২৫শে অক্টোবর অপরাহ্ণে সামরিক বৈপ্লবিক কাউন্সিল সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েটের হস্তে অর্পণ করিলেন। তৎক্ষণাং নিখিল রুশীয় সোভিয়েট কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন হইল। বিপুল ভোটাধিক্যে লেনিনের নেতৃত্বে নূতন কৃষক-শ্রমিকের রাষ্ট্র গঠিত হইল। গণসচিবসঙ্ঘের সভাপতি হইলেন লেনিন এবং সচিব-সঙ্ঘ বা “পলিটব্যুরা|”র সপ্তরথী হইলেন লেনিন, ষ্ট্যালিন, ট্রট্‌স্কী, কামেনফ্, জিনোভিফ্, সোকলনিকফ্, ও বিট্রবফ্। ঝেরঝিনিস্কি ও উরিট্‌স্কি সামরিক সমিতির অতিরিক্ত সদস্য নির্ব্বাচিত হইলেন। ষ্ট্যালিন সমগ্র রুশিয়ার বিভিন্ন জাতিগুলির সামঞ্জস্য বিধানের দপ্তর গ্রহণ করিলেন।

 রাশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিপর্য্যস্ত, সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় সমাজব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে; বিপ্লববিরোধী দলগুলি অসন্তোষকে নূতন উপায়ে জাগাইয়া তুলিবার জন্য গোপন আন্দোলনে রত; দুর্ভিক্ষ তাহার করাল ছায়া বিস্তার করিতেছে। এমন সময় জার শাসনের বন্ধনমুক্ত জনতা নূতন ক্ষমতার মদিরা পানে উন্মত্ত হইয়া কারাদ্বার খুলিয়া দিল; দলে দলে বন্দী বাহির হইয়া আসিল। দেশময় একটা বিশৃঙ্খল স্বেচ্ছাচারকেই সকলে স্বাধীনতা মনে করিতে লাগিল। এই অবস্থার মধ্যে বলশেভিক নেতারা দেখিলেন, প্রথমে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সমস্যা সমাধান করিতে হইবে। জার্ম্মানী ও অস্ট্রিয়ার সহিত শাস্তিস্থাপন সর্ব্বাগ্রে আবশ্যক। তাঁহারা জার্ম্মানীর সহিত যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে কথা চালাইবার জন্য অধীর হইলেন এবং রাশিয়ার পক্ষ হইতে যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টিত হইলেন। ষ্ট্যালিন এই ব্যাপারে প্রধান অংশ গ্রহণ করিলেন। তিনি লিখিয়াছেন—“লেনিন, ক্রাইলেঙ্কো (ভাবী প্রধান সেনাপতি) এবং আমি যখন পেট্রোগ্রাডের প্রধান সামরিক কার্য্যালয়ে উপস্থিত হইয়া বিশেষ ব্যবস্থায় তারযোগে প্রধান সেনাপতি দুখনিনের সহিত কথা বলিবার জন্য উপস্থিত হইলাম সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি আমার এখনও মনে আছে।···দুখনিন এবং সমরবিভাগের কর্ম্মচারীরা ‘পিপ‍্ল‍্স্ কমিশার্স’দের আদেশ পালন করিতে সরাসরি অস্বীকার করিল। সেনানায়কগণ সম্পূর্ণরূপে সামরিক কেন্দ্রীয় কমিটির করায়ত্ত। সৈন্যগণ কি বলিবে তাহা কেহই জানিত না। বলশেভিকদলভুক্ত সৈন্যদল ব্যতীত অন্যান্য সকলেই সোভিয়েট ক্ষমতালাভের বিরোধী। আমরা জানিতাম যে অসন্তুষ্ট সামরিক শ্রেণী পেট্রোগ্রাডে অভ্যুত্থানের জন্য পরামর্শ করিতেছে এবং কেরেনেস্কী রাজধানী আক্রমণ করিবার জন্য অগ্রসর হইতেছে।... আমার মনে আছে টেলিফোনের সম্মুখে দাড়াইয়া লেনিন কিয়ংকালের জন্য নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। সহসা তাঁহার মুখ এক অভূতপূর্ব্ব দীপ্তিতে জ্বলিয়া উঠিল। বোঝা গেল তিনি একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসিয়াছেন। তিনি বলিলেন, ‘চল আমরা বেতার ঘাঁটিতে যাই, উহাতেই আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে। আমরা বিশেষ আদেশ দিয়া জেনারেল দুখনিন‍্কে তাঁহার কর্তব্য হইতে অব্যাহতি দিব এবং তাঁহার স্থানে কমরেড্ ক্রাইলেঙ্কোকে প্রধান সেনাপতি পদে নিযুক্ত করিব এবং সমরনায়কদের না জানাইয়াই সৈন্যদলের নিকট আবেদন করিব তাহারা যেন তাহাদের সেনানায়কদিগকে গ্রেপ্তার করে এবং সর্ব্ববিধ সামরিক কার্য্য হইতে বিরত হয়, অষ্ট্রোজার্ম্মান সৈন্যদের প্রতি ভ্রাতার মত ব্যবহার করে এবং শান্তি স্থাপনের দায়িত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করে।” লেনিনের নির্দ্দেশ ও আদেশ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হইল। ট্রট্‌স্কী সোভিয়েটের প্রতিনিধিরূপে সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করিলেন। এই ব্যাপারে লেনিন সর্ব্বদাই ষ্ট্যালিনের পরামর্শ গ্রহণ করিতেন। একদিন কোন একটা বিশেষ ব্যাপারে ট্রট্‌স্কি ব্রেষ্টলিটোভঙ্ক্ হইতে লেনিনের পরামর্শ চাহিলেন। লেনিন উত্তর দিলেন, ‘অপেক্ষ। কর, আমি ষ্ট্যালিনের মতামত জানিয়া লই।’

 যাহা হউক, যুদ্ধবিরতি ও সন্ধির সংবাদ দাবানলের মত সমস্ত রাশিয়ায় ছড়াইয়া পড়িল। লক্ষ লক্ষ রক্তপতাকা দুলিতে লাগিল। ছত্রভঙ্গ সৈন্যদল লইয়া ট্রট্‌স্কি নূতন লাল পণ্টন গড়িতে লাগিলেন। ট্রট্‌স্কি পুরোভাগে থাকিলেও তাঁহার উপর লেনিনের সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল না। প্রকৃত প্রস্তাবে ষ্ট্যালিনই ঝেরঝিনিস্কির সহিত মিলিত হইয়া রণক্ষেত্র হইতে প্রত্যাগত ভীতিবিহ্বল ছত্রভঙ্গ সৈন্যদলকে পুনরায় নূতন করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ করিতে লাগিলেন।

 ঐতিহাসিকগণ বলিয়াছেন এই বিপ্লবে ষ্ট্যালিন কখনও দৃশ্যমান নেতৃত্বের ভূমিকায় অভিনয় করেন নাই। নির্ব্বাসন হইতে প্রত্যাবৃত্ত বলশেভিক নেতারা ষ্ট্যালিনকে খুব বেশী গণনার মধ্যে আনিতেন না, কেননা বিতর্কমূলক সকল প্রশ্নেই ষ্ট্যালিন লেনিনের মতে সায় দিতেন। তাঁহার বাগ্‌বিস্তারের লোভ ছিল না, ক্ষমতার পদে অধিষ্ঠিত হইবার লোভ ছিল না। দৃঢ়কায় ষ্ট্যালিন একটা পুরাতন খাকির জামা পরিয়া (তাহারও দুই একটা বোতাম থাকিত না) চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতেন। ট্রট্‌স্কির মত তাঁহার নিজস্ব মোটরকার ছিল না এবং ভূতপূর্ব্ব ধনীদের বিলাসভবনেও তিনি বাস করিতেন না। দলের সাধারণ সদস্যদের সহিত একত্র হইয়া তিনি সাধারণভাবে বাস করিতেন। বাহিরের চাকচিক্য না থাকিলেও ষ্ট্যালিনের ছিল অদম্য কর্ম্মশক্তি, অদ্ভুত ক্ষিপ্রকারিতা এবং সঙ্ঘগঠনে অপরিসীম দক্ষতা।

 নভেম্বর-বিপ্লবে লেনিনের দক্ষিণহস্তরূপে ষ্ট্যালিন যে ভূমিকায় অভিনয় করিয়াছিলেন দীর্ঘকাল পরে ১৯২৬-এ টিফ‍্লিসে রেলওয়ে শ্রমিকদের এক সভায় বক্তৃতামুখে তাহা বর্ণনা করিতে গিয়া ষ্ট্যালিন বলিয়াছেন —“১৯১৭-র কথা মনে পড়ে। যখন আমি কারাগৃহ এবং বিভিন্ন স্থানে নির্ব্বাসনের মধ্যে কাল কাটাইতেছিলাম তখন পার্টির নির্দ্দেশে আমি লেনিনগ্রাডে উপস্থিত হইলাম। এইখানে রাশিয়ার শ্রমিক-সমাজের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয়, সর্ব্বদেশের সর্ব্বহারাদের মহান আচার্য্য লেনিনের সহিত প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, বুর্জোয়া ও জনসাধারণের সংঘর্ষের তুমুল ঝটিকার মধ্যে—সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মধ্যে—আমি প্রথম শিক্ষা লাভ করিলাম, শ্রমিকশ্রেণীর মহান পার্টির অন্যতম নেতা হওয়ার অর্থ কি? নিপীড়িত জাতিগুলির মুক্তিবিধায়ক এবং গণমুক্তিসংগ্রামের অগ্রদূত রাশিয়ার শ্রমিক-সমাজের নিকট আমি তৃতীয় বার বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করিয়াছি—সেইখানে লেনিনের দ্বারা পরিচালিত হইয়া আমি বিপ্লবের নিয়ন্তার পদ লাভ করিয়াছি।”