ছয়

 সোভিয়েট রাশিয়া নবীন সভ্যতার অগ্রদূত। ধ্বংসোন্মুখ ধনিক সমাজের পরিবেষ্টনীর মধ্যে রাশিয়ায় গড়িয়া উঠিয়াছে এক নূতন সমাজ— যে সমাজে সর্ব্বপ্রকার শোষণের অবসান ঘটাইয়া সর্ব্বমানবের কল্যাণ ও উন্নতিকল্পে এক নবগঠিত-সম্মিলিত মহাজাতি আত্মনিয়োগ করিয়াছে—যে সমাজে জগতের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতির মহাবাণীকে প্রতি মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌছাইয়া দিবার ব্যবস্থা হইয়াছে—যে সমাজে দারিদ্র্য ও বেকারসমস্যা চিরতরে লুপ্ত হইয়াছে। বিনা আয়াসে এই বিরাট কার্য্য সম্পন্ন হয় নাই। জনসাধারণের সমর্থনে এবং বিপ্লবী-শ্রেষ্ঠ লেনিন ও তাঁহার যোগ্য শিষ্য ও সাথী ষ্ট্যালিনের নেতৃত্বে কমিউনিষ্ট পার্টি কঠোর শ্রম ও কঠিন অধ্যবসায়ের দ্বারা আজিকার সোভিয়েট রাশিয়াকে রূপ দিয়াছেন। ষ্ট্যালিনের নেতৃত্বে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অচিন্ত্যনীয় সাফল্যই সোভিয়েট রাশিয়ার নূতন সমাজ ও সভ্যতাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে।

 সোভিয়েট রাশিয়ার ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ১৯২৮ সালের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। ইহার সহিত ষ্ট্যালিনের শক্তি, অধ্যবসায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তরুণ কম্যুনিষ্টদের নেতা ষ্ট্যালিন সমগ্র রাশিয়ায় উৎসাহের এক বিদ্যুৎগতি সঞ্চার করিলেন। ব্যক্তিগত মুনাফার লোভহীন সর্ব্বমানবের কল্যাণ ও উন্নতিতে বিশ্বাসী এক মহাজাতি জড় বস্তুপুঞ্জকে বশে আনিবার জন্য আক্রমণ করিল। প্রকৃতিকে বশে আনিতে হইবে, প্রাকৃতিক সম্পদ মানুষের প্রয়োজনে লাগাইতে হইবে। লেনিনের উৎসাহ ও নির্দ্দেশে বৈদ্যুতিক শক্তি প্রবাহ-সৃষ্টির যে সকল কেন্দ্র স্থাপিত হইয়াছিল তাহাকে কলকারখানার উন্নতির কাজে লাগান হইল। যন্ত্রশক্তিতে অনগ্রসর রাশিয়া তাহার নেতা ষ্ট্যালিনের কণ্ঠে শুনিল, “আমরা পশ্চাৎপদ রাশিয়াকে যন্ত্রশক্তিতে সমুন্নত আধুনিক দেশে পরিণত করিতে চাই, কোন পণ্যের জন্য আমরা ধনতান্ত্রিক দেশগুলির মুখাপেক্ষী হইব না। সোভিয়েটের শক্তিকে এমন ভাবে সংহত করিতে হইবে যাহাতে সমাজতন্ত্রবাদ বিজয়ী হয়। জোতদার (কুলাক) শ্রেণীকে বিলুপ্ত করিতে হইবে, ব্যক্তিগত কৃষিক্ষেত্রের পরিবর্ত্তে সমষ্টি-চালিত কৃষিকার্য্যের ব্যবস্থা করিতে হইবে” এবং এই বৃহৎ ও বিরাট নির্ম্মাণ-কার্য্য বৈদেশিক মূলধনের সহায়তা ব্যতীতই সম্ভবপর হইয়াছিল। ১৯৩২ সালে যখন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য ঘোষিত হইল, তখন ইংলণ্ড, আমেরিকা, ইতালী প্রভৃতি দেশের কাগজে ঘোষিত হইতে লাগিল—পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইয়াছে, সোভিয়েট অর্থনীতি দেউলিয়া হইয়াছে। পরাজিত কম্যুনিষ্ট পার্টি আর অধিকদিন রাশিয়ার কর্তৃ্তত্ব করিতে পারিবে না। সমস্ত শাসনব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িবার দিন নিকটবর্ত্তী। এই সকল বিরুদ্ধ. প্রচারকার্য্য স্বাভাবিক, কেননা ঐ সকল দেশের শ্রমিক-শ্রেণীকে রাশিয়ার উন্নতির সত্য সংবাদ না জানিতে দেওয়ার মধ্যে পুঁজিবাদীদের স্বার্থ জড়িত।

 ১৯২৮-র পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চার বৎসরেই গড়পড়তা ৯৩ ভাগ সাফল্য অর্জ্জন করিল। জাতীয় উৎপন্ন পণ্য ১৯২৮ হইতে ১৯৩৪-এ তিনগুণ হইল। মহাযুদ্ধের পূর্ব্ববর্ত্তী অঙ্কের সহিত তুলনায় ১৯৩৩-র উৎপাদন চতুর্গুণ হইল। ১৯২৮-এ শ্রমিক-সংখ্যা ছিল ৯৫ লক্ষ, ১৯৩২-এ আসিয়া দাঁড়াইল ১ কোটী ৩৮ লক্ষে। ইহার মধ্যে প্রধান প্রধান কলকারখানায় ১৮ লক্ষ, কৃষিকার্য্যে ১১ লক্ষ এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলিতে ৪ ১/২ লক্ষ লোক নূতন কাজ পাইল। ফলে বেকার-সমস্যা সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হইল। বিভিন্ন কলকারখানায় উৎপন্ন দ্রব্যের সহিত কৃষিকার্য্যে উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ প্রায় ২ গুণ বৃদ্ধি পাইল। জাতীয় রাজস্ব এই চার বৎসরে শতকরা ৮৫ ভাগ বাড়িল এবং শ্রমিকদের বেতন ৮০০ কোটী রুবল হইতে ৩০০০ হাজার কোটী রুবলে গিয়া পৌঁছিল। অশিক্ষিত ও নিরক্ষর রাশিয়ায় ১৯৩০ খৃষ্টাব্দের শেষে শতকরা ৬০ জন এবং ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দের শেষে শতকরা ৯০ জন লিখিতে পড়িতে শিথিল। নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে এত বড় অভিযান ও তাহার এত দ্রুত সাফল্য পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনও হয় নাই এবং ইহাকেই পুঁজিবাদীদের দালালেরা দেশ-বিদেশে কম্যুনিষ্ট পার্টির ব্যর্থতা বলিয়া প্রচার করিয়াছিল।

 শত শত কলকারখানা নবীনভাবে পুনর্গঠিত হইল। অবিশ্বাসী ও সংশয়াতুর শ্রমিক ও কৃষকেরা প্রথমতঃ বিরুদ্ধতা দেখাইলেও ক্রমে ইতিহাস-স্মরণীয় নব-নির্ম্মাণ কার্য্যে যোগ দিল। চার বৎসরে প্রায় ৫০টী নূতন সহর গড়িয়া উঠিল এবং ইহার প্রত্যেকটীর অধিবাসী-সংখ্যা ৫০ হাজার হইতে ২ লক্ষের মধ্যে। এই সকল নূতন সহরে আলো, হাওয়া ও স্বাস্থ্যরক্ষার অতি আধুনিক ব্যবস্থা সমন্বিত গৃহে শ্রমিকেরা বাস করিতে লাগিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থ নৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার জনসংখ্যা প্রতি তিন বৎসরে এক কোটী করিয়া বাড়িতে লাগিল। কেবল শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি নহে, সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলায় নূতন বিকাশ দেখা গেল। সাহিত্যিক ও লেখকগণ নূতন ভাব ও আদর্শের প্রচারক হইলেন। শিক্ষা জাতীয় হিংস্র লোভ ও প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থা রক্ষার জন্য যে ভাবে ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহার ধারা সম্পূর্ণ বদলাইয়। গেল। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শাসক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রভৃতি ধনতান্ত্রিক দেশে যে ভাবে মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর ক্রীতদাসে পরিণত হয়, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় তাহার প্রয়োজন না থাকায় তাহারা স্বাধীনভাবে জনসেবায় প্রবৃত্ত হইল।

 পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার এই অভূতপূর্ব্ব সাফল্যে রাশিয়ার প্রধান সমস্যা কৃষক ও কৃষিকার্য্যের সমস্যা সম্পূর্ণরূপে সমাধান হইয়াছিল একথা বলা যায় না। শ্রমিক-সমস্যা ও কৃষক-সমস্যা এক বস্তু নহে। বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন, রক্ষণশীল ও আত্মকেন্দ্রিক কৃষক সমাজের নিকট হইতে প্রবল বাধা পাইতে লাগিল। লেনিন বহু পূর্ব্বেই বলিয়াছিলেন, সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের প্রধান বাধা এই যে, রাশিয়া মুখ্যতঃ কৃষিপ্রধান দেশ এবং জমির মালিক ছোট ছোট কৃষকেরা সমাজতন্ত্রবাদ অপেক্ষা ধনতন্ত্রবাদেরই পক্ষপাতী। এই বাধা দূর করিবার জন্য ষ্ট্যালিন অগ্রসর হইলেন। বড় বড় জমিদারী বাজেয়াপ্ত করিয়া লইতে কিছুই অসুবিধা হইল না, কেননা জমিদার ও বৃহৎ কৃষিক্ষেত্রের অধিকারী বুর্জোয়া শ্রেণীর মালিকানাসত্ব বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গেই লোপ পাইয়াছিল এবং কালের গতি বুঝিয়া তাঁহারাও নূতন ব্যবস্থার সহিত সামঞ্জস্য করিয়া জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ডের অধিকারী লক্ষ লক্ষ কৃষক তাহাদের পুরুষানুক্রমিক মমত্ব লইয়া স্ব স্ব জমি আঁকড়িয়া পড়িয়া রহিল এবং কিছুতেই সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করিতে সম্মত হইল না। কিছু বলপ্রয়োগ হইল, তাহার ফল হইল বিপরীত। অতিরিক্ত উৎসাহী সাম্যবাদীরা গ্রামে গ্রামে গিয়া নূতন ব্যবস্থা প্রবর্ত্তনের চেষ্টায় কৃষকগণকে প্রায় ক্ষেপাইয়া তুলিল। ষ্ট্যালিন পিছু হটিলেন। ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধা এবং লাভ সম্পর্কে কৃষকদের মগজে নূতন তত্ত্ব ঢুকান কঠিন। কিন্তু এই কঠিন কার্য্য ষ্ট্যালিনের নিকট কঠিন মনে হইল না। তিনি বলিলেন যে, কৃষকদিগকে সমাজতন্ত্রের অধীনে আনিতে হইলে তাহাদের বুঝাইয়া দিতে হইবে যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই তাহাদের আর্থিক উন্নতি সম্ভবপর। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ড বিলুপ্ত করিয়া বৃহৎ কৃষিক্ষেত্রে কলের লাঙ্গলে চাষের ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করিতে হইবে। জমিদারদের বড় বড় কৃষিক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত হইল। কৃষকেরা দেখিল তাহাদের প্রাচীন পন্থা অপেক্ষা এই অভিনব পন্থায় বহুগুণ অধিক শস্য উৎপন্ন হইতেছে। যাহারা ভূমিহীন ক্ষেত মজুর, যাহাদের নাই বলিতে কিছুই নাই তাহারা কপাল ঠুকিয়া সার্ব্বজনীন কৃষিক্ষেত্রে যোগদান করিল। মধ্যশ্রেণী ও শোষক-শ্রেণী বিলুপ্ত হওয়ায় কৃষক ভূস্বামীরা কিছু সচ্ছলতার সন্ধান পাইয়াছিল। কাজেই তাহারা প্রথমতঃ নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি সার্ব্বজনিক কৃষিক্ষেত্রে বিসর্জ্জন দিতে রাজী হইল না, কিন্তু ক্রমে তাহাদের সন্দেহ দূর হইল। ১৯২৯ সালে শতকরা ৪ ভাগ, ১৯৩০ সালে ২৩ ভাগ, ১৯৩১ সালে ৫২ ভাগ, ১৯৩২ সালে ৬১ ভাগ ও ১৯৩৩ সালে ৬৫ ভাগ, কৃষক সার্ব্বজনিক কৃষিক্ষেত্রে এবং সমবায় পদ্ধতিতে কৃষিকার্য্যের সরিক হইল। ১৯৩৪ সালের শেষ ভাগে কৃষির উন্নতি এমন একটা অবস্থায় গিয়া পৌঁছিল যে, সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট রুটি ও আটার বাঁধা বরাদ্দ বাতিল করিয়া দিলেন। কৃষিকার্য্যের উন্নতির সুবিস্তৃত ইতিহাস আলোচনা এখানে হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হইবে, কিন্তু এই বৃহৎ সাফল্যই ষ্ট্যালিন এবং তাঁহার সহকর্ম্মিগণের গঠনমূলক প্রতিভার প্রকৃষ্ট পরিচয়। বলা বাহুল্য ইহা নিব্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় নাই।

 দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৩২—৩৭) লইয়া কার্য্য আরম্ভ হইল। ষ্ট্যালিন দেখিলেন সার্ব্বজনিক কৃষিক্ষেত্র ও ব্যক্তিগত কৃষিক্ষেত্র পাশাপাশি চলিতে পারে না। কম্যুনিষ্ট পার্টি নূতন উৎসাহে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন এবং ১৯৩৫ সালে জানুয়ারী মাসেই দেখা গেল শতকরা ৮০ ভাগ জমি সার্ব্বজনীক কৃষিক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে এবং দেশে খাদ্যশষ্য ও কলকারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচা মালেরও প্রায় অভাব নাই।

 একদিকে যেমন জনসাধারণের জীবনযাত্রাপ্রণালী উন্নত হইতে লাগিল, অন্যদিকে কলকারখানায় কৃষিযন্ত্র, কলের লাঙ্গল এবং অন্যান্য সাজসরঞ্জাম প্রস্তুত হইতে লাগিল। কয়লা, তেল, লোহা, তামা এবং রাসায়নিক দ্রব্যের খনিগুলিতে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ চলিতে লাগিল। কয়েক বৎসরেই কলের লাঙ্গলের উৎপাদন পাঁচগুণ এবং মোটর গাড়ীর উৎপাদন আটগুণ বাড়িল। নূতন পরিকল্পনায় মোটের উপর উৎপন্ন পণ্যের সংখ্যা শতকরা ২৬৯ ভাগ বাড়িল। সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রে কমরেড ষ্ট্যালিন চালিত কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতৃত্ব দশ বৎসরে যে অসামান্য সাফল্য লাভ করিল, তাহার মধ্যে যে দুশ্চিন্তার অবকাশ ছিল না এমন নহে।

 মহাযুদ্ধের পর সমষ্টিগত নিরাপত্তার নামে যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রবর্ত্তন হইল তাহা শান্তিরক্ষা অপেক্ষা অশান্তির দিকেই ঝুঁকিয়া পড়িল। ভার্সাই সন্ধির অসামঞ্জস্যে ইউরোপে নানা আকারে অশান্তি দেখা দিতে লাগিল, জার্ম্মানী দস্যুবৃত্তির জন্য গোপনে, বল সঞ্চয় করিতে লাগিল, জাপান এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারের অভিযানে বহির্গত হইল। ফাশিষ্ট দল লইয়া মুসোলিনী আফ্রিকায় “রোম সাম্রাজ্য বিস্তার করিতে লাগিলেন। নব অত্যুত্থিত নাৎসীনায়ক হিটলারকে সম্মুখে রাখিয়া জার্ম্মানীর বণিক, জমীদার ও সামরিক অভিজাতবর্গ পুনরায় পৃথিবীতে আধিপত্য করিবার দুঃস্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন।

 সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের বিস্ময়কর উন্নতি দেখিয়া ধনতান্ত্রিকগণ চমকিত হইলেন। সমাজতন্ত্রবাদের এই আগ্নেয়গিরির পাশে নিশ্চিন্তে বাস করা তাঁহাদের পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিল। অন্যদিকে সোভিয়েটের নেতারাও দেখিলেন, পরস্পর প্রতিবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া জগতের শাস্তির বিঘ্ন ঘটাইতে পারে। এই কারণে তাঁহারা আন্তর্জ্জাতিক ব্যাপারে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মধ্য দিয়া অংশ গ্রহণে প্রস্তুত হইলেন। অনেক বিবেচনা করিয়া ইউরোপের বড় কর্ত্তারা রাষ্ট্রসঙ্ঘে সোভিয়েট-প্রতিনিধি গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হইলেন। সোভিয়েট-প্রতিনিধি লিটভিনফ নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে যোগ দিলেন এবং প্রথমে সম্পূর্ণরূপে নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনায়কগণ অতটা অগ্রসর হইবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁহাদের ভণ্ডামির ফলে নিরস্ত্রীকরণ বৈঠক ব্যর্থ হইল। কিন্তু সোভিয়েট রাশিয়া তাহার শান্তিনীতিতে অটল রহিলেন। প্রথমে চিচেরণ এবং পরে লিটভিনর্ফ কর্ত্তৃক সোভিয়েটের পররাষ্ট্রনীতি সাফল্যের সহিত পরিচালিত হইয়াছে। সপ্তদশ কংগ্রেসে ষ্ট্যালিন বলিলেন, “আমরা জগতে শান্তি রক্ষার একটা প্রধান অংশ; কিন্তু আমাদের চারিদিকে এমন কতকগুলি রাষ্ট্র একত্রিত হইয়াছে যাহারা পুনরায় যুদ্ধ বাধাইয়া তুলিতে চাহিতেছে এবং এই ষড়যন্ত্র ও শাঠ্যের উপর আমাদের কোন হাত নাই।” অর্থাৎ আর একটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ যে ঘনাইয়া আসিতেছে সে সম্বন্ধে সোভিয়েট নেতারা নিঃসন্দেহ হইলেন। পূর্ব্বদিকে জাপান এবং পশ্চিমে জার্ম্মানী দুশ্চিন্তার স্থল হইয়া উঠিল। মাঞ্চুরিয়ার জিহোল গ্রাস করিয়া জাপান পূর্ব্ব এশিয়ায় সোভিয়েট-সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করিল। এই সময় ষ্ট্যালিন ঘোষণা করিলেন, “আমরা অন্য কোন দেশের এক হাত জমিও চাহি না, কিন্তু আমাদের দেশের এক যব পরিমিত ভূমিও কাহাকেও দিব না।” ইউরোপের পররাষ্ট্র নীতিতে দুর্য্যোগ ঘনাইয়া উঠিতে লাগিল। সোভিয়েটনেতারা বুঝিলেন, আত্মরক্ষার্থ প্রস্তুত হইবার দিন আসিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সর্ব্বব্যাপী হইয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে বৈপ্লবিক গৃহযুদ্ধ নানা দিক দিয়া আত্মপ্রকাশ করিবে। শান্তিবাদী হইয়াও সাম্যবাদী দল দেখিলেন ঐতিহাসিক নিয়তির এই অনিবার্য্য সম্ভাবনার উপর তাঁহাদের কোন হাত নাই। বিগত মহাযুদ্ধে বিদ্রোহে বিপ্লবে ইউরোপে যেমন ভাবে ভাঙ্গাগড়া হইয়াছে, ভাবী যুদ্ধে তাহা অধিকতর ব্যাপক ও দূরপ্রসারী হইয়া দেখা দিবে। যাহারা সাম্যবাদ-বিরোধিতার নামে মানবের উন্নতির পথ রুদ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছে তাহারাই অগ্রগতিকে অধিকতর দ্রুত করিবে।

 ১৯৩০-৩৩-এর জগদ্ব্যাপী অর্থসঙ্কটের দিনে শিল্প বাণিজ্যে অতি অগ্রসর দেশগুলিতে যে সঙ্কট দেখা দিল, তাহাতে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ১৯২৯ খৃষ্টাব্দের সহিত তুলনায় আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ৬৫ ভাগ, গ্রেটবৃটেনে শতকরা ৮৬ ভাগ, জার্মানীতে ৬৬ ভাগ এবং ফ্রান্সে ৭৭ ভাগ কমিয়া গেল। পক্ষান্তরে ১৯২৯-এর তুলনায় সোভিয়েট রাশিয়ায় পণ্যউৎপাদন ক্রমে বাড়িয়া ১৯৩৩-এ শতকরা ২০১ ভাগ বাড়িল। ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অপেক্ষা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে অধিকতর বৈজ্ঞানিক ও উন্নততর তাহা যেমন বুঝা গেল, তেমনি দেখা গেল জগদ্ব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার উপর কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারিল না। পূর্ব্বকথিত দেশগুলিতে শ্রমিক বেকারের সংখ্যা দাঁড়াইল প্রায় আড়াই কোটী। ক্ষুধা, দারিদ্র্য-দুঃখে তাহারা জর্জ্জরিত হইল এবং ইহার ফলে কোটী কোটী কৃষকের কি দুর্দ্দশা হইল, তাহা সহজেই অনুমেয়।

 এই অর্থ নৈতিক সঙ্কটে সাম্রাজ্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক দেশ এবং পরাধীন দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক স্ববিরোধিতা প্রবল হইয়া উঠিল, কলকারখানার মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে অশান্তি অসন্তোষ নানা আকারে দেখা দিতে লাগিল।

 কম্যুনিষ্ট পার্টির ষোড়শ কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় সমিতির পক্ষ হইতে ষ্ট্যালিন বলিলেন যে, এই অর্থ নৈতিক সঙ্কট হইতে পরিত্রাণ পাইবার জন্য বুর্জ্জোয়া শ্রেণী একদিকে ফাশিষ্ট ডিক্টেটরশিপ প্রতিষ্ঠা করিয়া শ্রমিক সংহতি দলন করিবে, অন্যদিকে অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল হিংস্র এবং সাম্রাজ্যবাদী ধনতান্ত্রিকেরা যুদ্ধ বাধাইয়া উপনিবেশ ও পরাধীন দেশগুলি অধিকার করিবার চেষ্টা করিবে অথবা দুর্ব্বল জাতিগুলির উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া অর্থনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করিবে। ষ্ট্যালিনের এই ভবিষ্যৎবাণী বর্ণে বর্ণে ফলিয়াছিল।

 ১৯৩২ সালে যখন ইউরোপের শক্তিগুলি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ঘরোয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটে অত্যন্ত বিব্রত ছিল, তখন জাপ সাম্রাজ্যবাদীরা সেই সুযোগ গ্রহণ করিয়া সামরিক শক্তিতে দুর্ব্বল চীনের উপর চাপ দিতে লাগিল এবং প্রভুত্ব বিস্তারে প্রয়াসী হইল। তথাকথিত ‘স্থানীয় ঘটনার ছল’ ধরিয়। জাপ সাম্রাজ্যবাদীরা ন্যায়-নীতি পদদলিত করিয়া দস্যুর মত চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করিয়াই মাঞ্চুরিয়ায় সৈন্য চালনা করিল। জাপ-বাহিনী মাঞ্চুরিয়া দখল করিয়া সমগ্র উত্তর চীন জয় এবং সোভিয়েট রাশিয়াকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হইল। জাপান স্বাধীনভাবে লুণ্ঠন-নীতি চালাইবার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের বাহিরে চলিয়া গেল।

 এই ঘটনায় উচ্চকিত হইয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং ফ্রান্স পূর্ব্ব এশিয়ায় তাহাদের নৌ-ঘাঁটিগুলি দৃঢ় ও অস্ত্রসজ্জিত করিতে লাগিল। চীন হইতে ইউরোপ ও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে বিতাড়িত করাই যে জাপানের অভিপ্রায়, ইহা গোপন রহিল না। জাপান ঐ শক্তিগুলির সহিত প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে প্রবৃত্ত না হইয়া সোভিয়েট রাশিয়ার প্রাচ্য ভুখণ্ডের প্রতি দৃষ্টিপাত করিল। কিন্তু সোভিয়েট রাশিয়া অতি দ্রুত সৈন্য সমাবেশ এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলি শক্তিশালী করায় জাপান মাঞ্চুরিয়ার উত্তরে দৃষ্টিপাত করিতে সাহস পাইল না।

 অর্থসঙ্কটে কেবল পূর্ব্ব এশিয়ার মত ইউরোপেও ধনতান্ত্রিক স্ববিরোধিতা তীব্র হইয়া উঠিল। দীর্ঘস্থায়ী কলকারখানা ও কৃষি ব্যবস্থার সঙ্কট, বিপুল বেকারসমস্যা এবং দরিদ্র শ্রেণীর ক্রমবর্দ্ধিত দুরবস্থা শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষের বহ্নি প্রধুমিত করিল। শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর মধ্যে বৈপ্লবিক মনোভাব লক্ষ্য করা গেল। বিগত মহাযুদ্ধে ক্লান্ত-শ্রান্ত জার্ম্মানীতেই এই অবস্থা উগ্র হইয়া উঠিল। এংলো-ফরাসী বিজেতার যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ জোগাইতে হৃতসর্ব্বস্ব জার্মানী অর্থনৈতিক সঙ্কটে অধিকতর বিপন্ন হইয়া পড়িল। শ্রমিক শ্রেণী স্বদেশের শাসক ও শোষক এবং বৃটিশ ও ফরাসী বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর দাবী—এই দুই চাপে পড়িয়া অস্থির হইয়া উঠিল। ইহার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ দেখা গেল ১৯৩২ সালে জার্ম্মান জনসাধারণ রাইকৃষ্ট্যাগের নির্ব্বাচনে জার্ম্মান কম্যুনিষ্ট পার্টিকে ৬০ লক্ষ ভোট দিয়াছিল। জার্ম্মান বুর্জোয়া শ্রেণী এই ঘটনায় বুঝিলেন যে, বিপদের দিন ঘনাইয়া আসিয়াছে। জার্ম্মানীর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল স্থির করিলেন শ্রমিক শ্রেণীর স্বাধীনতা খর্ব্ব করিতে হইবে। অন্যথায় তাহারা বৈপ্লবিক শক্তিগুলির সহিত যোগ দিয়া যে কোন মুহূর্ত্তে অনর্থ ঘটাইতে পারে। অন্য দিকে জার্ম্মানীর ধনিক ও সামরিক অভিজাত শ্রেণী তথাকথিত পার্লামেণ্টারি গণতন্ত্রের উপর বীতশ্রদ্ধ হইয়া উঠিলেন এবং জনসাধারণের রাষ্ট্রীয় অধিকার হরণ করিয়া বুর্জ্জোয়া জাতীয়তাবাদী ডিক্টেটরশিপ স্থাপন করিতে প্রয়াসী হইলেন। এইরূপ একটা ভীতিমূলক শাসন ব্যতীত শ্রমিক শ্রেণীর অসন্তোষ দমিত হইবার নহে। জার্ম্মান ধনিক শ্রেণীর আর একটা সুবিধা ছিল শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর চিত্তে মহাযুদ্ধের পরাজয়ের অপমান-বেদনা এবং তাহার প্রতিশোধ স্পৃহা। ভার্সাই সন্ধির বিরুদ্ধে আক্রোশ এবং তাহার সংশোধনের দাবী লইয়া ফাশিষ্ট বা নাৎসী দল প্রবল হইয়া উঠিতেছিল। জনসাধারণকে ধাপ্পা দিবার জন্য এই দল “জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল” এই নাম গ্রহণ করিল। এই দলকে প্রবল করিয়া তুলিবার জন্য শ্রমিক শ্রেণীর শত্রু ও বিরোধী জার্ম্মান ধনিক ও অভিজাত সামরিক শ্রেণী মুক্ত হস্তে অর্থব্যয় করিতে লাগিলেন। জাতীয় গৌরব-বুদ্ধি লইয়া জাগ্রত শিক্ষিত নিম্ন মধ্যশ্রেণীর উপর এই দল প্রভাব বিস্তার করিল। যাহাদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ছিল সেই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতাগণ শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে কৃতঘ্নতা করিয়া গোপনে নাৎসী দলের সহিত আপোষ করিতে লাগিলেন। ১৯৩৩ সালে জার্ম্মান নাৎসী দলের সাফল্যের কারণ এই।

 জার্ম্মানীর ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করিয়া সপ্তদশ কংগ্রেসের বিবৃতিদান প্রসঙ্গে ষ্ট্যালিন বলিয়াছিলেন, “জার্ম্মানীতে ফাশিজম্-এর সাফল্যের কারণ কি? কেবল শ্রমিক শ্রেণীর দুর্ব্বলতা নয়। সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক দল কর্ত্তৃক শ্রমিকদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়, যদিও ঐ দল ফাশিজম্ এর পথ প্রস্তুত করিয়াছে। আসল কারণ বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর মৌলিক দুর্ব্বলতা। পার্লামেণ্টারি পদ্ধতির পুরাতন উপায়ে বুর্জ্জোয়া শ্রেণী শাসনকার্য্য পরিচালনা করিতে পারিতেছিল না এবং বুর্জ্জোয়া গণতন্ত্র এই অক্ষমতা ঢাকিবার জন্য আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সন্ত্রাসবাদী উপায় অবলম্বন করিয়াছিল।”

 এই সন্ত্রাসবাদের সূত্র ধরিয়াই জার্ম্মান নাৎসীরা তাহাদের ঝটিকাবাহিনী লইয়া দেশময় ভীতির বিভীষিকা সৃষ্টি করিল। গুপ্তহত্যা, ভদ্রব্যক্তিদের অতর্কিত লাঞ্ছনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া উঠিল। পুলিশ এই অরাজক অত্যাচার দমন করিবার কোন উৎসাহ দেখাইল না। সাহস পাইয়া নাৎসীরা রাইক‍্ষ্ট্যাগ গৃহ দগ্ধ করিল, শ্রমিক সঙ্ঘগুলি দমন করিবার জন্য বর্ব্বর অত্যাচার শুরু করিল, অবশেষে বুর্জ্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যক্তিস্বাধীনতা বিলুপ্ত করিল। পররাষ্ট্রনীতিতে তাহারা রাষ্ট্রসঙ্ঘ পরিত্যাগ করিল এবং প্রকাশ্য ভাবে ভার্সাই সন্ধি বাতিল করিবার জন্য এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির ভৌগলিক সীমা জার্ম্মানীর সুবিধামত রদবদল করিবার জন্য যুদ্ধায়োজনে প্রবৃত্ত হইল। এইভাবে ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বীজ রোপিত হইল এবং অতিবিস্ময়কর দ্রুততার সহিত উহা ফলে পুষ্পে সুশোভিত হইল।

 স্বাভাবিকরূপেই সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনায় সতর্ক সাবধানতা অবলম্বন করিল এবং পশ্চিম ইউরোপের ঘটনাবলীর প্রতি তীব্র দৃষ্টি রাখিয়া পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত করিতে অগ্রসর হইল।

 পশ্চিম ইউরোপের তথাকথিত শান্তি ঘোষণা স্বাভাবিকরূপেই সোভিয়েট নেতাগণ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহারা পররাষ্ট্র নীতিতে শাস্তির পথ ধরিয়াই চলিলেন। যদি যুদ্ধ আরম্ভ হয় তাহা হইলে তাহা কোন দেশকে অব্যাহতি দিবে না, ইহা বুঝিয়াই সোভিয়েট গভর্নমেণ্ট সমরসজ্জায় মনোনিবেশ করিলেন। যুদ্ধ যেখানে যাইবে ঐতিহাসিক অনিবার্য্য নিয়তির মত বিপ্লবও সেখানে যাইবে— মহাযুদ্ধের মধ্যে ও পরে ইহাই দেখা গিয়াছে। জার্ম্মান সমর-নায়কগণ মানব সভ্যতার অগ্রগতি রোধ করিতে গিয়া উহাকে অধিকতর অগ্রসর করিয়া দিয়াছেন।

 সোভিয়েট রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রবাদের বিজয় অভিযানের সাফল্যে কম্যুনিষ্ট পার্টি আত্মহারা হইলেন না। কেননা রাশিয়ার অভ্যন্তরে সম্পত্তিহীন ধনী সমাজের বংশধরগণ পূর্ব্বাধিকার ফিরিয়া পাইবার সঙ্কল্প ত্যাগ করেন নাই। ইহাদিগকে ঘিরিয়া তথাকথিত ভদ্রসমাজ সোভিয়েট গভর্ণমেণ্টের দোষ ত্রুটি উদ্ঘাটন করিয়া অসন্তোষ প্রচার করিতে লাগিলেন। বলা বাহুল্য এই গোপন ষড়যন্ত্রকারীরা রাশিয়ার বাহিরে সাম্যবাদের শত্রু নাৎসী ফাশিষ্টদের সহায়তা প্রত্যাশা করিতে লাগিলেন। অথচ মুখে কম্যুনিষ্ট পার্টির অপরিমিত প্রশংসা ইহারা সর্ব্বদাই করিতেন।

 সপ্তদশ কংগ্রেসে বুখারিন, রয়কফ্, টোমস্কি অনুতাপপূর্ণ বক্তৃতা করিয়া সাম্যবাদী দলের প্রশংসায় গগন বিদীর্ণ করিলেন। কিন্তু কংগ্রেস তাঁহাদের আন্তরিকতাহীন বক্তৃতাগুলির চাতুরি ধরিয়া ফেলিল। দলের সাফল্যে অতিরিক্ত গুণকীর্ত্তন অপেক্ষা সমাজতন্ত্রবাদের অগ্রগতিতে আত্মনিয়োগই সাম্যবাদীদের কর্তব্য! কংগ্রেসে ট্রট্‌স্কি-পন্থী জিনোভিফ, কামেনফ অতীতের ভুলের জন্য নিজেদের ধিক্কার দিলেন এবং দলের সমুচ্চ প্রশংসা করিলেন। এই সকল নেতার বিরক্তিকর আত্মনিন্দা এবং দলের কৃত্রিম প্রশংসার অন্তরালে মলিন ও ভয়ব্যাকুল বিবেককে ঢাকিবার প্রয়াস প্রচ্ছন্ন রহিল না। তবে সাম্যবাদী দল তখনও বুঝিতে পারে নাই যে যাঁহারা কংগ্রেসে আসিয়া এইরূপ বিনয়পূর্ণ বক্তৃতা করিতেছেন তাঁহারাই কমরেড কিরোভকে হত্যা করিবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন।

 ১৯৩৪ সালের ১লা ডিসেম্বর কমরেড কিরোভ আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। আততায়ী হাতে হাতে ধরা পড়ে। অনুসন্ধানে জানা গেল যে জিনোভিফ-চালিত লেনিনগ্রাডের সোভিয়েট-বিরোধী গুপ্ত ষড়যন্ত্রকারী দলের সদস্য এক যুবক প্ররোচিত হইয়া এই কার্য্য করিয়াছে। কিরোভ দলের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন এবং লেনিনগ্রাডের শ্রমিক শ্রেণী তাঁহাকে শ্রদ্ধা করিত। কিরোভের হত্যাকাণ্ডে রাশিয়ার জনসাধারণের মধ্যে তীব্র রোষের সৃষ্টি হইল। সোভিয়েট পুলিশ ঘটনার সূত্র ধরিয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেন, ১৯৩৩ সাল হইতেই প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী দল সাম্যবাদী নেতাদিগকে হত্যার ষড়যন্ত্র করিতেছে। কেবল তাহাই নহে এই দল বৈদেশিক ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হইতে রীতিমত অর্থসাহায্য পাইতেছে। অথচ এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের নেতারা নিরীহ ভালমানুষ সাজিয়া কম্যুনিষ্ট পার্টির মধ্যেই রহিয়াছেন। সোভিয়েট রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ আদালতে এই সকল সদস্যের প্রকাশ্য বিচার হইল এবং তাহারা চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইল।

 এই ঘটনার অল্পদিন পরেই “মস্কো কেন্দ্রের প্রতি-বিপ্লবী দলের গুপ্ত প্রতিষ্ঠান” আবিষ্কৃত হইল। প্রাথমিক তদন্ত এবং প্রকাশ্য বিচারে দেখা গেল যে জিনোভিফ, কামেনফ, জেফ‍্ডোকিমফ্ প্রভৃতি নেতারা তাঁহাদের অনুচরদিগকে কি ভাবে সন্ত্রাসবাদে দীক্ষা দিয়াছিলেন এবং পার্টির কেন্দ্রীয় সমিতির সদস্যদিগকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। অথচ কিরোভের হত্যাকাণ্ডের পর এই জিনোভিফ, কামেনফই বিলাপে পঞ্চমুখ হইয়াছিলেন এবং তীব্র ভাষায় প্রতিশোধ দাবী করিয়াছিলেন।

 আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া জিনোভিফ, কামেনফ তাঁহাদের অপরাধ স্বীকার করিলেন, কিন্তু ট্রট্‌স্কির সহিত তাঁহাদের যোগাযোগ স্বীকার করিলেন না এবং তাঁহারা যে ফাশিষ্ট দলের গুপ্তকার্য্য করিতেছেন ইহাও গোপন রাখিলেন। কিরোভের হত্যাকাণ্ডের পর এই সকল বিশ্বাসঘাতক নেতার ষড়যন্ত্র আবিষ্কার ও জনসাধারণের নিকট তাহা প্রমাণ করিতে এক বৎসর সময় লাগিয়াছিল। আদালতে যখন প্রামাণ্য দলিলাদি উপস্থিত করা হইল তখন দেখা গেল যে এই ষড়যন্ত্র নেতৃবৃন্দকে হত্যা করিয়া ক্ষমতা অধিকারেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্ষমতার লোলুপতা ইহাদিগকে বৈদেশিক গভর্ণমেণ্টর গুপ্তচরে পরিণত করিয়াছিল। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা ও কৃতঘ্নতা কোন গভর্ণমেণ্টই ক্ষমা বা উপেক্ষা করিতে পারেন না। ১৯৩৬ সালে মস্কো সহরে এই ইতিহাস-স্মরণীয় ষড়যন্ত্র মামলার বিচার হইল। বিচারে প্রমাণ হইল যে উহারা জাপান এবং জার্ম্মান সাম্রাজ্যবাদীদের সহিত গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইলেই তাহারা নাংসী ফাশিষ্টদের সহিত যোগ দিয়া সোভিয়েট গভর্ণমেণ্টের পরাজয়ের সহায়তা করিবে।

 ষড়যন্ত্রের ব্যাপকতায় ও গভীরতায় কম্যুনিষ্ট পার্টির চমক ভাঙ্গিল। কেন্দ্রীয় কমিটি দলের সমস্ত সঙ্ঘের নিকট কিরোভের হত্যাকাণ্ডের পর এক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করিলেন।

 (১) “সুবিধাবাদীর মুঢ় সন্তোষ লইয়া যদি আমাদের মধ্যে এইরূপ ভ্রান্ত ধারণা হইয়া থাকে যে আমরা যতই শক্তিশালী হইতেছি আমাদের শত্রুরা ততই নিরীহ ভালমানুষ হইতেছে তাহা হইলে উহা অবিলম্বে পরিহার করা কর্ত্তব্য। এই মতবাদ ভ্রান্ত। আমাদের শত্রুরা ক্রমে ক্রমে সমাজতন্ত্রবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হইবে এবং পরিণামে খাটি সমাজতন্ত্রবাদী হইবে এরূপ প্রত্যাশা করা বামপন্থী বৈপ্লবিকদের পক্ষে অন্যায়। বলশেভিকদের সাফল্যের গর্ব্বে আত্মহারা হইয়া সুখ-শয্যায় নিদ্রা যাওয়া উচিত নহে। আমাদের সন্তোষের পরিবর্ত্তে সাবধান হইতে হইবে। বলশেভিক বিপ্লবীর চরিত্রগত সতর্কতা সজাগ রাখিতে হইবে। ইহা কখনও বিশ্বত হওয়া উচিত নয় যে শত্রুরা যতই নিরাশ হইবে ততই মরিয়া হইয়া তাহারা সোভিয়েটশক্তিকে ধ্বংস করিবার জন্য চরম পন্থা অবলম্বন করিবে। অতএব আমাদের চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত!

 (২) পার্টির সদস্যদিগকে পার্টির অতীত ইতিহাস শিক্ষা দিতে হইবে এবং আমাদের পার্টির বিরোধী ক্ষুদ্র বৃহৎ দলগুলির অতীত কার্য্যকলাপ উত্তমরূপে প্রত্যেককে জানিতে হইবে। তাহাদের আক্রমণ পদ্ধতি তাহাদের কৌশল কিরূপ ছিল এবং কি উপায়ে আমাদের পার্টি ঐসকল কৌশল ব্যর্থ করিয়াছে এবং প্রতি-বিপ্লবী দলকে আমরা কি ভাবে পরাজিত করিয়াছি তাহার খুঁটিনাটি তথ্য প্রত্যেক সদস্যকে জানিতে ও জানাইতে হইবে। অতীতের প্রতি-বিপ্লবী দলগুলি এবং বর্ত্তমানে সাম্যবাদবিরোধী যে সকল দল রাশিয়ায় আছে তাহাদের ইতিহাস ও কার্য্যপ্রণালী সম্পর্কে সমস্ত খবর রাখিতে হইবে। এক কথায় আমাদের পার্টির প্রত্যেক সদস্য দলের ইতিহাস নিপুণভাবে পাঠ ও আলোচনা করিবেন।”

 এই সময় হইতে সাম্যবাদীদলের পুনর্গঠন শুরু হইল। অবিশ্বাসী দিগকে দল হইতে বহিষ্কৃত করা হইল। ১৯৩৫-এর ২৫শে ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টির সদস্য হইবার ও সদস্য থাকিবার কঠোর নিয়মকানুন প্রবর্ত্তন করিলেন। যাহাকে তাহাকে সদস্য করা নিষিদ্ধ হইল। কৃষক এবং বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে যাহারা প্রত্যক্ষভাবে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত তাহাদের মধ্য হইতে বাছিয়া বাছিয়া সদস্য সংগ্রহ চলিতে লাগিল। পার্টির মধ্যে বিশ্বাসঘাতক প্রতি-বিপ্লবীরা প্রবেশ করিতে না পারে এবং যাহারা লক্ষ্যভ্রষ্ট তাহারা যাহাতে উপযুক্ত শাস্তিলাভ করে সে জন্য কম্যুনিষ্ট পার্টি সতর্ক ব্যবস্থা অবলম্বন করিলেন।