সাত

 ১৯৩৫ খৃষ্টাব্দে দেখা গেল যে ইউরোপীয় জাতিগুলি একদিকে ফাশিজম্-এর দিকে অগ্রসর হইতেছে, অন্যদিকে আর একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতেছে। যুদ্ধোপকরণ নির্মাণের বিপুল আয়োজনে অর্থনৈতিক সঙ্কট কিয়ং পরিমাণে দূরীভূত হইলেই অদূর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা ইউরোপের বুকে দুঃস্বপ্নের মত চাপিয়া বসিল। কিরূপে এই অনিবার্য্য ও জটিল সমস্যার উদ্ভব হইল তাহা বিচার ও বিশ্লেষণ করা খুব কঠিন নহে।

 ঊনবিংশ শতাব্দীতে অতীতের সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হইয়া গেল তখন নবজাগ্রত মনুষ্য সমাজে রাজনীতিক্ষেত্রে মোটামুটি দুইটি দল লক্ষ্য করা গেল—রক্ষণশীল এবং বিপ্লববাদী। একদল চাহিল ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর প্রাচীন সমাজ-সংহতি রক্ষা করিতে, অন্যদল উহার পরিবর্ত্তন করিয়া চাহিল অধিকতর সামাজিক সুবিচার। সকল দেশেই এই দুই বিরুদ্ধ শক্তির সংঘর্ষ সংঘাত নানা আকারে প্রকাশ পাইতে লাগিল ক্রমে দেখা গেল আংশিক ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণী (ট্রেড ইউনিয়ম ও রাজনৈতিক মতবাদ) আন্তর্জ্জাতিক দৃটিভঙ্গি লইয়া সকল দেশেই একদল সহানুভূতিশীল ব্যক্তির সমর্থন লাভ করিতেছে, অন্যদিকে ফরাসী বিপ্লবের বংশধর মধ্যশ্রেণীর শাসকগণ তাহাদের রাষ্ট্রের শক্তি এবং বুদ্ধিজীবি সমর্থকদের লইয়া স্বাভাবিক উন্নতির নামে বিপ্লব প্রতিহত করিতেছে। এই দুই বাম ও দক্ষিণ পন্থার মধ্যে মধ্যপন্থী একটা দল শেওলার মত সর্ব্বদা ভাসিয়াছে। তবে এই তৃতীয় পস্থার কোন বাস্তব অস্তিত্ব কোন দিনই ছিল না। আপোষ কখনও হয় নাই। যাহা বিপ্লবের ঘোতক নহে তাহাই রক্ষণশীলতা। নিরপেক্ষ ও উদাসীন জনসঙ্ঘের পাষাণ-ভার মধ্যপন্থী সংস্কারকদিগকে ক্রমে অকর্ম্মণ্য করিয়া ফেলিয়াছে। বিপ্লবমুখী চিন্তাধারা সংস্কারকদের ক্রমোন্নতি বা ক্রমপ্রাপ্তির আশ্বাসে কর্ণপাত করে নাই। যদি সমস্ত না পাওয়া তাহা হইলে কিছুই পাওয়া হইল না; ইহাই হইল বিপ্লবের মর্ম্মকথা!

 এই দুইয়ের মধ্যস্থলে মধ্যশ্রেণীর উদারনীতি একদল লোককে মোহাবিষ্ট করিতে লাগিল। এই মধ্যপন্থার বাণী হইল “প্রতিক্রিয়াশীলতাও নহে, রক্ষণশীলতাও নহে।” সামাজিক শক্তিগুলির গতিপ্রকৃতির ইহা অপব্যাখ্যা মাত্র। আসলে এই উদারনীতিও রক্ষণশীলতা —কেননা উদারনৈতিক দলও ধনতন্ত্রের কায়েমী স্বার্থকে সমর্থন করিয়াছে। ব্যক্তি ও জাতীয় স্বাধীনতার নামে সামাজিক অবিচার, শোষণ, দুর্নীতি এবং যুদ্ধকে সমর্থন করিয়াছে। উৎকট জাতীয়তাবাদ এবং পীড়ন ও শোষণমূলক সাম্রাজ্যবাদকে ইহারা মধ্যশ্রেণীর চাতুরি ও ধুর্ত্ততা লইয়া সমর্থন করিয়াছে।

 কিন্তু সমাজতন্ত্রবাদ আনিল নূতন বাণী। সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত কিংবা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির সমষ্টিগত লাভ দূর করিতে হইবে, সমস্ত লাভ পাইবে উৎপাদকেরা (শারীরিক ও মানসিক শ্রমিকেরা) এবং জাতিভেদ মনুষ্য সমাজের শেষ কথা নহে। জাতীয়তাবাদ হইতে অগ্রসর হইয়া আন্তর্জ্জাতিক উন্নতিতে উত্তীর্ণ হইতে হইবে এবং সমস্ত পৃথিবীর অধিবাসীদের ঐক্যের মধ্যে সামাজিক সমুন্নতিকে লইয়া যাইতে হইবে।

 ঊনবিংশ শতাব্দীর মানুষের এই দুই বিপরীত চিন্তাধারা আজ পর্যন্ত্য তাহার মূল বৈশিষ্ট্য বজায় রাখিয়া চলিয়া আসিতেছে। ইতিহাসের গতিপথে পথ ও উপায়ের কিছু পরিবর্ত্তন হইয়াছে মাত্র। কত যুদ্ধ ও বিপ্লব ব্যর্থ হইয়াছে, অকারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়াছে। মানুষের শ্রমার্জ্জিত কত ধন-সম্পদ ধ্বংস হইয়া গিয়াছে অথচ সভ্য মানব এই ধ্বংসকে, এই পণ্ড শ্রমকে পরিহার করিবার সম্যক পন্থা গ্রহণ করে নাই। বিগত মহাযুদ্ধের পরও ইউরোপে রাষ্ট্র ও সমাজের পরিবর্ত্তন আমরা দেখিয়াছি। বহু খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত বিপ্লবের শোচনীয় অবসানও দেখিয়াছি। একমাত্র মার্কসবাদী বিপ্লবীরাই জয়ী হইয়া এক বিশাল ভূখণ্ডে নবীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিল। ফলে আন্তর্জ্জাতিক সমাজতন্ত্রবাদ সুতীক্ষ্ণ অস্ত্রের মত ধনতন্ত্রের চক্ষুর সম্মুখে বিভীষিকার সৃষ্টি করিতে লাগিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ অতিক্রম করিয়া যখন ধনতন্ত্রবাদ জগদ্ব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হইল তখন ধনতন্ত্রের বুদ্ধিমান দালালেরা প্রচার করিতে লাগিল মাঝে মাঝে সাময়িক ভাবে এরূপ সঙ্কট দেখা দিবেই। অতীতেও কয়েকবার ধনতন্ত্রবাদ এইরূপ সঙ্কটের সম্মুখীন হইয়াছে এবং তাহা অতিক্রম করিয়াছে। কিন্তু সত্য আবৃত রহিল না, স্পষ্টই বোঝা গেল ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়াছে। তাহার কাণ্ডে, শাখাপ্রশাখায় জরা ও বার্দ্ধক্যের ছায়া পড়িয়াছে, মূল শুকাইয়া আসিতেছে। প্রাচীন উপায়ে পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা অচল হইবার উপক্রম হইয়াছে। রব উঠিল—হাল ছাড়িও না, পণ্য উৎপাদন করিতে থাক। বিক্রয়ের বাজারে হুলুস্থুল বাধাও। কিন্তু ক্রেতা1-বিক্রেতার মধ্যে সর্ব্বাঙ্গীন সামঞ্জস্য বিধান অসম্ভব হইয়া উঠিল; পণ্য গুদামজাত হইয়া পণ্যউৎপাদনকারী দেশগুলির শ্বাসরোধ করিতে লাগিল। আন্তর্জ্জাতিক ব্যবসায় মুমূর্ষু হইয়া উঠিল। ধনতান্ত্রিক নীতির ইহা স্বাভাবিক পরিণাম। ইহা অতিরিক্ত পণ্য-উৎপাদনের ফল বলিয়া ব্যবসায়ীরা দেশে দেশে চীৎকার করিতে লাগিলেন, কিন্তু বর্ত্তমান জগতের উৎপন্ন পণ্য আসলে সমস্ত মনুষ্য জাতির ব্যবহারের পক্ষে প্রচুর নহে। দোষ উৎপাদনের নহে, দোষ বণ্টন-ব্যবস্থার, দোষ জাতীয় অর্থনৈতিক সঙ্কীর্ণতার এবং এই বড় বড় কলকারখানা ও শিল্প-বাণিজ্যের পশ্চাতে যে শান্তি-শঙ্কাহীন চৌর্য্য বৃত্তি রহিয়াছে তাহাও ইহার জন্য কম দায়ী নহে। অথচ ধনতন্ত্রবাদ তাহার চিরাচরিত কৌশলের পরিবর্ত্তন না করিয়াই যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে চাহিল। ধনতান্ত্রিক জগতের এই শোচনীয় মনোভাব দেখিয়া একদা ষ্ট্যালিন ব্যঙ্গ করিয়া বলিয়াছিলেন, অর্থ-সঙ্কট হইতে ধনতন্ত্রবাদ হয়ত বাহির হইয়া আসিবে কিন্তু সে আর উন্নত মস্তকে ফিরিয়া আসিতে পারিবে না, তাহাকে হামাগুড়ি দিয়া বাহির হইতে হইবে।

 সমাজতন্ত্রবাদের প্রসার, ক্ষয়িষ্ণু ধনতন্ত্রবাদের গতি দেখিয়া মধ্যশ্রেণী অতিদ্রুত নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবাদ মিটাইয়া ফেলিল এবং বড় বড় বুলির মুখোস পরিয়া সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভগ্নদশা তাহারা আবৃত করিল। এই ছলনার আবরণই ফাশিজম্, মধ্যশ্রেণীর ক্ষমতা বজায় রাখিবার অপরিহার্য্য অস্ত্র। ধনতন্ত্রের অঙ্গে তাহারা নূতন বসন পরাইয়া দিল। শ্রমিক শ্রেণী ও সমাজতন্ত্রবাদকে তাহারা পশ্চাৎ হইতে ছুরিকাঘাত করিল। সমাজতান্ত্রিক বুলির মোড়কে মুড়িয়া তাহারা ফাশিজম্ চালাইতে লাগিল। অন্যদিকে পার্লামেণ্টারী পদ্ধতির গণতন্ত্র তাহারা বিলুপ্ত করিল, ব্যক্তি-স্বাধীনতার লেশমাত্র চিহ্নও তাহার। রাখিল না। ধনিক শ্রেণীকেও তাহারা একটা নূতন ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য করিল এবং জনসাধারণকে এই বলিয়া ধাপ্পা দিল যে, বণিকদের মুনাফার লোভ সংযত করিয়া তাহারা সকলের জন্য অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করিবে। পার্লামেণ্টারী পদ্ধতির পরিবর্ত্তে ডিক্টেটর-চালিত গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করিবার আর কোন উপায় ছিল না। কাশিষ্ট দেশগুলিতে শ্রমিক আন্দোলন নিষিদ্ধ হইল। কৃষক ও নিম্ন মধ্যশ্রেণীকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হইল। সরকারী কর্মচারীদিগকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে লেলাইয়া দেওয়া হইল এবং তাহার প্রতিক্রিয়ায় সকলেই সরকারী কর্ম্মচারী ও গভর্ণমেণ্টের বিরোধী হইয়া উঠিল। করদাতা ও ভূতপূর্ব্ব সৈনিকদিগকে দলে ভিড়াইবার চেষ্টা সফল হইল; বিশেষভাবে যুবক সমাজ এই নূতন প্রচণ্ডতার জাঁকজমকে বিমোহিত হইল। সমাজের যে অংশ সঙ্ঘবদ্ধ নহে, শিথিল ভাবে ভাসমান, ফাশিষ্টরা সেই অংশকে অভিভূত করিয়া প্রচার করিতে লাগিল যে পার্লামেণ্টারী পদ্ধতি এবং সমাজতন্ত্রবাদ জাতির শক্তি ও অভ্যুদয়কে ধ্বংস করিতে উদ্যত হইয়াছিল। “সমাজতন্ত্রীরা ইংলণ্ড ও জার্ম্মানীতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হাতে পাইয়াছিল অথচ তাহারা কিছুই করিতে পারে নাই।”

 এই কৌশলপূর্ণ প্রচারকার্য্য জনসাধারণকে সহজেই মোহিত করিল। অনেকেই ভাবিয়া দেখিল না যে উহারা নামে মাত্র সমাজতন্ত্রী ছিল এবং কি ইংলণ্ড কি জার্ম্মানীতে উহারা কখনও সমাজতন্ত্রবাদের নীতি প্রয়োগ করিবার চেষ্টা করে নাই। জার্ম্মানীর সোশাল ডেমোক্রেটিক নেতারা এবং ইংলণ্ডের মিঃ ম্যাকডোনাল্ড-শ্রেণীর শ্রমিকনেতারা তাহাদের আচরণ দ্বারা সমাজতন্ত্রবাদকেই উপহাস ও পরিহাসের বস্তু করিয়া তুলিয়াছিলেন।

 এই নূতন প্রতিক্রিয়াশীলতা শ্রমিক সঙ্ঘগুলিকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করিল। মুসোলিনী ও হিটলার যাহা করিলেন তাহার প্রতিধ্বনি করিয়া ফরাসী রাষ্ট্রনেতা মঃ তরেদু পর্য্যন্ত বলিয়াছিলেন, “জগদ্ব্যাপী অর্থসঙ্কট দূর করিতে হইলে শ্রমিক-সঙ্ঘগুলিকে কঠোর ভাবে আয়ত্বের মধ্যে রাখা প্রয়োজন।” ইতালী ও জার্ম্মানীর রাষ্ট্রনীতি প্রকাশ্যে এবং ফ্রান্সে গোপনে উপরোক্ত ব্যবস্থার উপর আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। কিন্তু সমাজতন্ত্রবাদের বিরুদ্ধে ফাশিজম্-এর প্রধান অস্ত্র হইল জাতীয়তাবাদ।

 জার্ম্মানীতে উৎকট হিংস্র নব জাতীয়তাবাদের প্রচার কার্য্য চলিল। জার্ম্মান জাতির রক্তের বিশুদ্ধি রক্ষা করিবার জন্য “অ-জার্ম্মানী বিদেশীদিগকে” দলন-নীতি প্রবর্ত্তিত হইল। ইহুদি বিদ্বেষ প্রচার দ্বারা কৌশলে জার্ম্মান জাতিকে আন্তর্জ্জাতিকতার বিরুদ্ধে বিমুখ করিয়া তোলা হইল, ইহুদি-পীড়নের আবরণে সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীদেরও দমন কার্য্য চলিতে লাগিল। ফাশিজম্-এর এই সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ জার্ম্মানীর ধনিক সমাজের আশ্রয় স্থল হইয়া উঠিল। জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় মর্যাদার উদ্দীপনাময় হিংস্র বাণীর মদিরা জার্ম্মান জাতিকে উন্মত্ত করিয়া তুলিল। অনভিজ্ঞ জার্ম্মান যুবকগণ হিটলারের রহস্যময় জীবন এবং জ্বালাময়ী বক্তৃতায় মোহিত হইয়া নির্ব্বোধের মত বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখিতে লাগিল। “কেবল আমরা, জার্ম্মানীরা পৃথিবীতে আধিপতা করিবার জন্য জন্মিয়াছি। ইহার প্রতিবাদী যে কোন মতবাদ এবং যে কোন ব্যবস্থাকে দলিত করিতে হইবে।” ফাশিজমের এই বাণী কেবল জার্ম্মানী বা ইতালীতেই আবদ্ধ রহিল না। ইউরোপের ক্ষমতার আসনে প্রতিষ্ঠিত শাসকশ্রেণীও ঐরূপ মনোভাব সম্পন্ন হইয়া উঠিতে লাগিলেন। গণতন্ত্রের ঠাট্ বজায় রাখিয়াও জাতীয় স্বার্থের দিক হইতে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা দেখা দিল এবং ফাশিজম্ সংক্রামক ব্যাধির মত হাঙ্গেরী, পোলাও, বলকান উপদ্বীপ, পর্ত্তুগাল, অষ্ট্রিয়া, স্পেনে ছড়াইয়া পড়িল। জার্ম্মানী ইতালীর নূতন সমাজে দেখা গেল একজনের সর্ব্বনাশ না করিয়া অপরে ধনী হইতে পারেনা এবং বাঁচিবার জন্য অপরকে হত্যা করিতে হইবে এই নীতি প্রবল। ধনী বণিক ও মধ্যশ্রেণীর নির্ব্বোধ ব্যক্তিরা জনসাধারণকে রুদ্ধকণ্ঠ করিয়া তাহাদের সহস্র শিরের উপর হিটলার ও মুসোলিনীর বংশীধ্বনির তালে তালে নৃত্য করিতে লাগিল। স্বাধীন চিন্তাবীরদিগকে নির্ব্বাসিত করা হইল, দুর্ব্বলকে লুণ্ঠন করা চলিতে লাগিল। গভর্ণমেণ্ট জনসাধারণের শত্রু হইয়া উঠিল। বল্টিক হইতে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ধ্বংসোন্মুখ ও ক্ষয়িষ্ণু ধনতন্ত্রের ভাড়াটিয়া গুণ্ডারা একের পর আর একটা জাতিকে ক্রীতদাসে পরিণত করিয়া ফেলিল। ইতালীতে ইহার প্রথম সূচনা। যে ভাবে শ্রমিক ও বিপ্লবী দিগকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হইয়াছিল এবং নিষ্ঠুর পীড়ন করা হইয়াছিল তাহা মানুষের কল্পনায় আসেনা। মধ্যযুগীয় বর্ব্বরতার ইতিহাস ইতালীর ফাশিষ্ট দলের ভীতির রাজত্বের নিকট ম্লান হইয়া গেল। কারাগার ও বন্দীশালায় সহস্র সহস্র শিক্ষিত স্বাধীনচেতা যুবক রোগে অপমানে ও অসহ্য দৈহিক পীড়নে মৃত্যুমুখে পতিত হইল। তাহাদের আর্ত্ত ক্রন্দন মুসোলিনীর বজ্র নির্ঘোষে ডুবিয়া গেল। মনুষ্যত্ব ও সমাজের প্রতি কৃতঘ্নতার উপর প্রতিষ্ঠিত ইতালীর ফাশিষ্ট রাজত্বের মহিমা তথাকথিত গণতন্ত্রনিষ্ঠ লেখকেরাও রটাইতে কলুর করিলেন না। জার্ম্মানীতেও স্বস্তিক পতাকাবাহী গুণ্ডার দল অনুরূপ উপায়ে ভীতির রাজত্ব স্থাপন করিল। দুইজন পুরাতন রাজনৈতিক পাপীর—হিণ্ডেনবুর্গ ও ক্লেমাশো—শাঠ্য ও ষড়যন্ত্রে এবং ভার্সাই সন্ধির প্রতিহিংসার প্রতিক্রিয়ায় হত্যাব্যবসায়ী হিটলার জার্ম্মানীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হইল। ধনতন্ত্রীদের এই ভাড়াটিয়া গোলাম হাজার হাজার লোককে বন্দীশালায় পাঠাইল, প্রত্যেকটী রাত্রি হত্যার বিভীষিকায় আতঙ্কজনক করিয়া তুলিল। ১৯৩৪ সালের ৩০শে জুনের রাত্রিতে হিটলারের পরম বান্ধব রোয়েম ও তাহার অন্যান্য সহকারীরা অতর্কিতে নিহত হইলেন। লক্ষ লক্ষ পুস্তক দগ্ধ করিয়া হিটলার পার্লামেণ্টগৃহ পোড়াইয়া দিলেন এবং এখন তিনি সমগ্র ইউরোপ দগ্ধ করিতেছেন।

 ইউরোপে এই বিস্ময়কর গুণ্ডামীর গণতন্ত্রী গবর্ণমেণ্টগুলি কোন প্রতিবাদ করিল না—প্রতীকার করা ত দূরের কথা। বল্কানে অস্ট্রিয়ায় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দলবদ্ধ গুণ্ডামি নানা চমকপ্রদ বিয়োগান্ত ঘটনার অভিনয় করিতে লাগিল।

 ইউরোপের পাশবিকতার এই তাণ্ডবের মধ্যে চারিদিকে অন্ধকারের মধ্যে একমাত্র সোভিয়েট রাশিয়া শান্তি ও উন্নতির আলোকবর্ত্তিকা তুলিয়া ধরিল। লক্ষ লক্ষ পীড়িত নরনারী দেখিল এই রাশিয়ার নূতন মানুষেরা অকাতর শ্রমে ভবিষ্যৎ মানবের কল্যান সম্পদ গড়িয়া তুলিতেছে। ভবিষ্যতের মুক্তি কোন পথে——ফাশিজম্ অথবা কম্যুনিজম্? ভবিষ্যৎ কাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে?

 ফাশিজম্-এর অর্থ প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদী দল মাত্রেই পরস্পরের প্রতিযোগী এবং একে অন্যকে প্রতিহত বা পরাভূত না করিলে প্রবল হইতে পারে না। বর্ত্তমান জগতের রাষ্ট্রক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে অন্ততঃ ৮০টী জাতীয়তাবাদী দল রহিয়াছে। যন্ত্র বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির ফলে ইহারা হয় পরস্পরকে ভয় করিয়া চলিবে নয় একটা সাধারণ ধ্বংস ডাকিয়া আনিবে। ইহাদের পরস্পরের মধ্যে পরজাতিবিদ্বেষ ও লাভের লোভ ব্যতীত আর কোন প্রকার ঐক্যই সম্ভব নহে। মনুষ্য জাতিকে সব দিক দিয়া পদানত করিবার এমন বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা পূর্ব্বে আর কুত্রাপি হয় নাই। অন্যদিকে সোভিয়েট পরিকল্পনা সর্ব্বমানবের কল্যাণকে লক্ষ্য করিয়া বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করিতেছে। বর্ত্তমান আন্তর্জ্জাতিক সঙ্কটের ইহাই একমাত্র সম্ভবপর সমাধান। সোভিয়েট সমাজে প্রত্যেকে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল অথচ নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতামূলক জীবন যাত্রায় তাহাদের শ্রম ও শক্তির অপচয় হয় না। সেখানে মানুষের উপর প্রভু নাই, সম্পত্তিশালী লোক নাই, পরশ্রম নির্ভর, পরবিত্তাপহারী দালাল এবং ধনতান্ত্রিক প্রতারকগণ নাই। প্রাচীন ব্যবস্থার জরাজীর্ণ দুর্নীতি এখানে নাই। অধিকাংশ মানুষের অসন্তোষপুর্ণ জীবনের গ্লানি যে সকল দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সর্ব্বদা শঙ্কাতুর করিয়া রাখে, সেখানে সমাজতন্ত্রবাদের প্রতিষ্ঠা ব্যতীত আর কোন উপায়েই সমাজের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব পর নহে। এই কারণেই বৈপ্লবিক শক্তিগুলি ক্রমেই বর্দ্ধিত হইতেছে এবং সমাজতান্ত্রিক সংঘর্ষের মধ্যে সম্মিলিত হইয়া সার্থকতার পথ অন্বেষণ করিতেছে। শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী দলগুলি এবং কৃষক ও নিম্ন মধ্যশ্রেণীর সত্ত্ব স্বামিত্বহীন জনসমষ্টি ক্রমে ঐদিকেই ঝুকিয়া পড়িতেছে।

 যুদ্ধ ও ফাশিজমের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য্য সকল দেশেই বামপন্থীরা আশু কর্ত্তব্য হিসাবে নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন। ১৯৩২ সালের এমাষ্টার্ডম কংগ্রেস এবং ১৯৩৩-এ পারী কংগ্রেসে এই আন্তর্জ্জতিক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বাণী স্পষ্টরূপে ঘোষিত হইয়াছিল। তাহার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধকে সম্ভব হইতে না দেওয়া এবং ফাশিজম‍্কে দমন করা। সর্ব্বদেশের শোষিত ও নির্য্যাতিত জনসাধারণকে ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উৎসাহ দেওয়া। সর্ব্বদেশের অগ্রগামী রাজনৈতিক দলগুলি এই আদর্শবাদে অনুপ্রাণিত হইয়া আন্দোলন আরম্ভ করিল। অন্যদিকে ফাশিষ্টপন্থী প্রতিবিপ্লবীরা সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের ভয় দেখাইয়া মধ্যশ্রেণীর শ্রুতিসুখকর প্রচার কার্য্য করিতে লাগিল। সংবাদপত্রে, বেতারে, পুঁথি পুস্তকে কম্যুনিষ্টদের বিরুদ্ধে অতি জঘন্য মিথ্যা ফাশিষ্ট দেশগুলি হইতে প্রচারিত হইতে লাগিল। গণতন্ত্রী দেশগুলিতেও ফাশিষ্ট চরেরা বৃহৎ কারবারের মালিকদের পক্ষপাতপুষ্ট হইয়া সাম্যবাদ দলনের প্রচার কার্য্য করিতে লাগিল এবং ইহা আংশিক ভাবে সকল দেশেই প্রবর্ত্তত হইল।

 সকল মানুষের বুদ্ধি ও হৃদয় একই ছাঁচে ঢালা। কাজেই ভালমন্দ বুঝিবার কিছু তারতম্য থাকিলেও মোটামুটি ভাবে মানুষ শান্তিতে থাকিতে চায়। বর্ত্তমান জগতে মানুষ পরস্পরের সহিত মিলিত হইয়া থাকিবে, না সংগ্রামশীল হিংস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত আদিম যুগে ফিরিয়া যাইবে ইহাই সমস্যা। রাশিয়ায় জনসাধারণ এই সমস্যা সমাধানের ভার বহুপূর্ব্বেই গ্রহণ করিয়াছিল এবং অল্পদিনের মধ্যে সমাজতন্ত্রবাদ যে বিস্ময়কর উন্নতি করিয়াছে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্যের পর সে সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ রহিল না।

 সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি কেবল যে মানবের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিয়াছে তাহা নহে, লোক ব্যবহারে বহু সৎনীতির প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধীর সংখ্যা কমিয়াছে। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির সুবিধার অভাবে জালিয়াত, প্রবঞ্চক, মিথ্যাভাষীদের সংখ্যা হ্রাস পাইয়াছে। মুসোলিনী শাসিত ইতালী অথবা নাৎসী পদদলিত জার্ম্মানীর জনসাধারণের সহিত সোভিয়েট রাশিয়ার জনসাধারণের তুলনা করিলে দেখা যাইবে যে মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদার প্রকৃত মূল্য কি। অতীতে বর্ত্তমানে কোন ধর্ম্ম বা কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থা যাহা সম্ভব করিতে পারে নাই সেই চারিত্রিক উন্নতি বিধান একমাত্র সোভিয়েট রাশিয়াতেই সম্ভবপর হইয়াছে।