আট

 ১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সোভিয়েট সোশ্যালিষ্ট গণতন্ত্রগুলির সপ্তম কংগ্রেসে শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করিবার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯২৪ সালে সোভিয়েট রাশিয়ায় যে শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হইয়াছিল অবস্থার পরিবর্ত্তনে তাহা নূতন করিয়া ঢালিয়া সাজিবার প্রয়োজন হয়। এই দশ বৎসরে বিভিন্ন শ্রেণীর জনসাধারণের মধ্যে এক আমূল পরিবর্ত্তন সাধিত হইয়াছে। এক অভিনব সমাজতান্ত্রিক শিল্প বাণিজ্য গড়িয়া উঠিয়াছে। জোতদার শ্রেণীর (কুলাক) সঙ্গতিপন্ন কৃষক নিশ্চিহ্ন হইয়াছে। সম্মিলিত কৃষিক্ষেত্র প্রবর্ত্তনের ব্যবস্থা জয়ী হইয়াছে। সোভিয়েট সমাজের মূলভিত্তি স্বরূপ সর্ব্ববিধ উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সমাজতন্ত্রের এই সাফল্যে জনসাধারণের ভোটাধিকার প্রসারিত করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়িল।

 ষ্ট্যালিনের সভাপতিত্বে একটী নিয়মতন্ত্র কমিশন নিযুক্ত হইল এবং সোভিয়েটের নূতন শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনার ভার এই কমিটির উপর অর্পিত হইল। ঘোষণা করা হইল যে এই খসড়ার অংশবিশেষ মাঝে মাঝে প্রকাশিত হইবে এবং সংবাদপত্রে ও সভা সমিতিতে জনসাধারণ স্বাধীনভাবে ইহার অবাধ সমালোচনা করিতে পারিবে। সম্পূর্ণ খসড়া প্রকাশিত হইবার পর সাড়ে পাঁচ মাস কাল সমগ্র দেশে আলোচনা হইল। তাহার পর উহা সোভিয়েটের অষ্টম কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে পেশ করা হইল।

 নূতন শাসনতন্ত্র আলোচনার জন্য ১৯৩৬-এর নভেম্বর মাসে কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশন হইল। ১৯২৪-এর শাসনতন্ত্রকে প্রস্তাবিত নূতন শাসনতন্ত্র কোন্ কোন্ অংশে সংস্কার ও পরিবর্ত্তন করিয়াছে ষ্ট্যালিন তাহা একের পর আর বিশ্লেষণ করিয়া প্রতিনিধিবর্গকে বুঝাইয়া দিলেন। সোভিয়েটতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সূচনায় নূতন অর্থনৈতিক নীতির দিকে লক্ষ্য রাখিয়া ১৯২৪-এর শাসনতন্ত্র প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল। তখন সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট সমাজতান্ত্রিক উন্নতির পাশাপাশি সীমাবদ্ধভাবে ব্যক্তিগত মূলধন খাটাইবার অনুমতিও দিয়াছিলেন। সোভিয়েট গভর্ণমেণ্টের পরিকল্পনা ছিল যে ঐ দুইটী পদ্ধতি পাশাপাশি চলিবে এবং ক্রমে অর্থনীতি ক্ষেত্রে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা জয়ী হইবে। অবশ্য জয় পরাজয়ের এই প্রশ্ন তখনও মীমাংসা হয় নাই। কারখানাগুলি পুরাতন ও অপ্রচুর সরঞ্জামাদি লইয়া তখনও অনেক পশ্চাতে পড়িয়া ছিল। কৃষিব্যবস্থা আরও শোচনীয় ছিল। ব্যক্তিগত কৃষিক্ষেত্রের বিরাট সমুদ্রের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক কৃষিক্ষেত্রগুলি ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের মত। তখন কুলাক বা জোতদার শ্রেণীকে সংযত রাখাই ছিল লক্ষ্য, উচ্ছেদ করা নহে। সমগ্র দেশের বাণিজ্যের শতকরা ৫০ ভাগ মাত্র তখন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আয়ত্বে আসিয়াছিল।

 ১৯৩৬ সালে সোভিয়েট রাশিয়ায় এক সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তিত চিত্র উদ্ঘাটিত হইল। এই সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক জীবনে এক আমূল পরিবর্ত্তন সাধিত হইয়াছে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সমস্ত বিভাগে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা জয়ী হইয়াছে। শক্তিশালী নূতন সোভিয়েট কলকারখানা ও শিল্পকেন্দ্রগুলিতে মহাযুদ্ধের পূর্ব্ববর্ত্তী অবস্থার তুলনায় প্রায় সাত গুণ অধিক পণ্য উৎপন্ন হইতেছে। ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে চালিত কারখানা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়াছে। উন্নততর যন্ত্রপাতির সাহায্যে সমাজতান্ত্রিক বৃহৎ কৃষিক্ষেত্রগুলি পৃথিবীতে সমবায় পদ্ধতির কৃষিকার্য্যের অভূতপূর্ব সাফল্যের নিদর্শনে পরিণত হইয়াছে। ১৯৩৬ সালে জোতদার শ্রেণী সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়াছিল এবং ব্যক্তিবিশেষ কৃষকের অর্থনৈতিক জীবনে উহাদের কোন প্রভাব ছিল না বললেই চলে। ব্যবসা বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্র ও সমবায় বিভাগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একজনের শ্রমের ফল অপরে বুদ্ধি কৌশলে ভোগ করিবে এই ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হইয়াছিল। পণ্য উৎপাদনের সমস্ত ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক উপায়ে জনসাধারণের করায়ত্ত। নূতন সমাজতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক সঙ্কট, দারিদ্র্য, বেকার সমস্যা চিরদিনের মত অন্তর্হিত হইয়াছে। সোভিয়েট সমাজের প্রত্যেক নরনারী শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐশ্বর্য্যের সাধারণ সরিক।

 ষ্ট্যালিন তাঁহার রিপোর্টে বলিলেন, এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েট রাষ্ট্রের জনসাধারণের বিভিন্ন শ্রেণীগুলিরও পরিবর্ত্তন হইয়াছে। গৃহযুদ্ধের সময় জমিদার শ্রেণী এবং সাম্রাজ্যবাদের আওতায় পরিপুষ্ট বুর্জ্জোয়া শ্রেণী বিলুপ্ত হইয়াছিল এবং এই কয় বৎসরের সমাজ তান্ত্রিক পুনর্গঠনে সমস্ত শোষক শ্রেণী—পুজিবাদী, ব্যবসায়ী, জোতদার এবং মুনাফাশিকারী—বিলুপ্ত হইয়াছে। শোষক শ্রেণীর যে সামান্য অংশ এখনও কায়ক্লেশে টিকিয়া আছে,অল্পদিনের মধ্যে তাহাদের কোন অস্তিত্ব থাকিবে না।

 সোভিয়েট রাশিয়ায় শ্রমিক জনসাধারণ, কলকারখানার মজুর, কৃষক এবং বুদ্ধিজীবিরা সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনে এক নব জীবন লাভ করিয়াছে।

 ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকগণের জন্য উৎপাদনের কারখানাগুলির উপর কোন অধিকার ছিলনা এবং তাহাদের শ্রম কেবল ধনীর মুনাফা সৃষ্টির কাজে লাগিত। পুঁজিবাদী শ্রেণীর বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পণ্য উৎপাদনের কারখানাগুলি জনসাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত হইয়াছে। সোভিয়েট রাশিয়ার জনসাধারণ রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করিয়া শোষক ও শোষিতের ভেদ দূর করার ফলে এক শ্রেণীহীন নৃতন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। রাশিয়ার এইরূপ শ্রেণীহীন অথচ বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত শ্রমিকশ্রেণী মনুষ্য জাতির ইতিহাসে ইতিপূর্ব্বে কুত্রাপি সম্ভব হয় নাই।

 অতীতে রাশিয়ায় ২০ লক্ষ কৃষক পরিবার সমগ্র দেশে ছড়াইয়া ছিল। ইহারা জরাজীর্ণ কুটীরে বাস করিত। আদিম কালের যন্ত্রপাতি দিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ড চাষ করিত এবং বংশানুক্রমিক ভাবে জমিদার মহাজন ব্যবসায়ী জোতদার ধর্ম্মযাজক প্রভৃতি শ্রেণীর দ্বারা শোষিত হইত। এখন নূতন কৃষক শ্রেণীর উপর স্তরে স্তরে শোষকশ্রেণী নাই। অধিকাংশ কৃষক সম্মিলিত কৃষিক্ষেত্রে যোগদান করিয়াছে। তাহারা একত্রে বাস করে, একত্রে শ্রমার্জিত সম্পদ ভোগ করে এবং একত্রে সমবায় নীতিতে আধুনিক যন্ত্রশক্তিদ্বারা চাষ করে। তাহারা শিক্ষিত, তাহারা রোগে চিকিৎসা ও শুশ্রূষা পায়; তাহাদের বসন ভূষণ মলিন ও জীর্ণ নহে। শিক্ষা সংস্কৃতি, খেলা-ধূলা, আমোদ-প্রমোদের আধুনিক যুগের সর্ব্ববিধ সুবিধাই তাহারা পাইয়া থাকে। এমন প্রসন্ন ও সুখী কৃষকশ্রেণী মানবের ইতিহাসে ইতিপূর্ব্বে কোথায়ও দেখা যায় নাই।

 তারপর সোভিয়েট রাশিয়ার বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়। শিক্ষা প্রণালীর আমুল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এক নূতন বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইয়াছে। ইহাদের অধিকাংশ‍ই কৃষক ও শ্রমিক পরিবার হইতে আসিয়াছে। অতীতের বুদ্ধিজীবিদের মত ইহারা ধনতন্ত্রের ক্রীতদাস নহে। ইহারা সমাজতন্ত্রের সেবক। ইহারা তথাকথিত ভদ্রলোক নহে; ইহারা সমাজতান্ত্রিক, সমাজের অন্যান্য শ্রমিকশ্রেণীর মতই সমান সুবিধাভোগী। ইহারা কৃষক শ্রমিকদের সহিত মিলিত হইয়া নূতন সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টি করিতেছে। এই নূতন শ্রেণীর বুদ্ধিজীবি দল শোষক শ্রেণীর পীড়ন হইতে মুক্ত হইয়া জনসাধারণের সেবকরূপে জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন করিতেছে। মনুষ্য জাতির ইতিহাসে ইহাও এক অভিনব ব্যাপার।

 এই পরিবর্ত্তন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্ববিরোধিতাহীন নূতন সমাজ, স্বভাবতঃই শাসনতন্ত্রকে নূতন করিয়া গড়িতে চাহিল। যাহাতে সমাজতান্ত্রিক সাফল্য নূতন শাসনতন্ত্রে প্রতিবিম্বিত হয় তাহার জন্যই নূতন শাসনতন্ত্রের খসড়া। নূতন শাসনতন্ত্র অনুসারে সোভিয়েট সমাজে শ্রমিক ও কৃষক এই দুইটী পরস্পর বন্ধুভাবাপন্ন শ্রেণীকে মানিয়া লওয়া হইল। ঠিক ঠিক শ্রেণীহীন সমাজ ইহা নহে।

 সোভিয়েট রাষ্ট্র মুখ্যতঃ কৃষক ও শ্রমিকের রাষ্ট্র। সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা পল্লী ও সহরের শ্রমিকদের এবং তাহাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই জিলা বা প্রাদেশিক সোভিয়েটগুলি পরিচালন করিয়া থাকে। তাহার উপরে আছে সম্মিলিত সোভিয়েটের সর্ব্বোচ্চ আইন সভা। এই আইন সভা দুইটী এবং দুইটী আইন সভারই অধিকার, দায়িত্ব, কর্ত্তব্য সমান। সার্বভৌম অধিকারে প্রতিষ্ঠিত স্বায়ত্তশাসনশীল বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ লইয়া সর্বোচ্চ 'রাষ্ট্র' পরিষদ দুইটি গঠিত। প্রাপ্ত বয়স্কগণ সকলেই ভোট দিবার অধিকারী এবং “তাহারা গোপন ব্যালটৃ ভোটে প্রত্যক্ষভাবে এই দুই আইন সভার প্রতিনিধিদিগকে নির্ব্বাচিত করে। প্রতিনিধিরা চারি বৎসরের জন্য নিযুক্ত হন। নিম্নতম আইন পরিষদ হইতে উচ্চতম আইন পরিষদ পর্য্যন্ত সর্ব্বত্রই শ্রমিকরা প্রত্যক্ষভাবে প্রতিনিধি নির্ব্বাচন করে। ১৮ বৎসরের অধিক বয়স্ক প্রত্যেক ব্যক্তি, তাহার জাতি, ধর্ম্ম, শিক্ষা, সামাজিক মর্য্যাদা, ধনসম্পত্তি এবং অতীত কার্য্যকলাপ যাহাই হউক না কেন, ভোট দিবার অধিকারী। কেবল পাগল এবং দুর্নীতিমূলক অপরাধে আদালতে দণ্ডিত এবং যাহার ভোটাধিকার আদালত বাতিল করিয়া দিয়াছেন তাহারা ভোট দিতে পারে না।

 সোভিয়েটের ডেপুটি বা প্রতিনিধিগণ প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। তাহার অর্থ এই যে পল্লী বা সহরের ছোট ছোট সোভিয়েটের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্রমোচ্চ পরিষদের ডেপুটি নির্বাচন করিতে পারেন না। নিম্নতম পরিষদ হইতে উচ্চতম পরিষদ পর্যন্ত সমস্ত সোভিয়েট প্রতিনিধিগণই ভোটাধিকার প্রাপ্ত অধিবাসীদের দ্বারা প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ব্বাচিত হন।

 সর্ব্বোচ্চ সোভিয়েট পরিষদদ্বয় একত্র হইয়া 'প্রেসিডিয়ম' বা কয়েকজন সভাপতি নির্বাচন করেন এবং “কাউন্সিল অব পিপলস্ কমিশার্স” বা বিভিন্ন বিভাগীয় কার্য্য পরিচালনের প্রধান কর্ম্ম সচিবও তাঁহারা নির্ব্বাচন করেন।

 সোভিয়েট রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। “প্রত্যেকে তাহার যোগ্যতা ও শক্তি অনুযায়ী কাজ করিবে এবং প্রত্যেকে তাহার কার্য্যের উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাইবে।” বুদ্ধি ও শক্তির তারতম্য অনুসারে মানুষের উৎপন্ন করার ক্ষমতার ইতর বিশেষ হয়, কিন্তু শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার জন্য অশন বসনের প্রয়োজন সকলের পক্ষে সমান। তাই সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় নিয়ম এই যে, প্রত্যেক নাগরিকের কাজ পাইবার, বিশ্রাম ও আরাম উপভোগ করিবার, শিক্ষালাভ করিবার, বৃদ্ধ বয়সে এবং রোগ বা অন্যকারণে অশক্ত হইয়া পড়িলে ভাতা পাইবার অধিকার আছে। নারীরাও জীবনের সমস্ত বিভাগে পুরুষের সহিত সমান অধিকার ভোগ করিয়া থাকে। সোভিয়েট রাশিয়ার প্রজারা যে কোন জাতি বা গোষ্ঠিভুক্ত হউক না কেন সকলে সমান অধিকার ভোগ করিবে এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয় না। বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্ম্মাচরণ এবং ধর্ম্মের বিরুদ্ধে প্রচার সর্ব্ববিধ অধিকারই সকলের সমান।

 সমাজতান্ত্রিক সমাজকে শক্তিশালী করিবার জন্য নূতন শাসনতন্ত্রে সভাসমিতি বক্তৃতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়া হইয়াছে। সাধারণ প্রতিষ্ঠানগুলিতে সকলেই যোগ দিতে পারে, ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর এবং বসবাস করিবার স্বাধীনতার উপর কোন হস্তক্ষেপ চলিবে না। ব্যক্তিগত চিঠি পত্রের গোপনতা সুরক্ষিত থাকিবে। যে সকল বিদেশী শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করিতে গিয়া অথবা বৈজ্ঞানিক কার্য্যের জন্য অথবা জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নির্য্যাতিত ও নির্ব্বাসিত তাহারা সোভিয়েট রাশিয়ায় আশ্রয় পাইবার অধিকার দাবী করিতে পারিবে।

 এ'ত গেল অধিকারের কথা। সোভিয়েট শাসনতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের কর্ত্তব্য কঠোরভাবে নির্দ্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রত্যেককে আইন মানিয়া চলিতে হইবে কার্য্যের শৃঙ্খলা রক্ষা করিতে হইবে, সততার সহিত জনসাধারণের প্রতি কর্তব্য পালন করিতে হইবে, সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিধি নিষেধ মানিতে হইবে, সার্ব্বজনীন সম্পত্তি, কলকারখানা রক্ষা করিতে হইবে, সর্ব্বোপরি সমাজতান্ত্রিক পিতৃভূমিকে শত্রুর আক্রমণ হইতে রক্ষা করিতে হইবে। “সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রুর আক্রমণ হইতে রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র কর্ত্তব্য।”

 “শ্রমিক শ্রেণী এবং এই শ্রেণীর বিভিন্ন স্তরের মধ্যে যাহারা সর্ব্বাধিক কর্ম্মকুশল এবং যাহাদের রাজনৈতিক চেতনা আছে তাহারা সোভিয়েট রাষ্ট্রের সাম্যবাদী বা বলশেভিক দলে একত্রিত হইবে এবং তাহারাই হইবে কৃষক শ্রমিকের রাষ্ট্রের অগ্রগামী দল। কি জনহিতকর কার্য্যে, কি ব্যাপার নির্ব্বাহে তাহারা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিস্তার ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করিবে।”

 সোভিয়েটের অষ্টম কংগ্রেসে এই নূতন শাসনতন্ত্রের খসড়া সর্ব্ববাদী সম্মতিক্রমে গৃহীত হইল। কৃষক শ্রমিকের এই অভিনব গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূলে ও শাখায় সমাজতন্ত্রেরই জয় বিঘোষিত হইল। সোভিয়েট রাষ্ট্র বহু বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া এক নূতন স্তরে আসিয়া দাঁড়াইল এবং ধীরে অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে প্রকৃত সাম্যবাদী সমাজের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। যাহার সর্ব্বোচ্চ লক্ষ্য হইল এই যে, “প্রত্যেকে তাহার শক্তি ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করিবে এবং প্রত্যেকে তাহার প্রয়োজনমত শরীর ও মনের খাদ্য পাইবে।”

 ১৯৩৭-এর ৭ই ডিসেম্বর সোভিয়েট রাশিয়ার সর্ব্বত্র ছুটীর দিন ঘোষিত হইল এবং ঐ দিন নূতন শাসনতন্ত্রানুযায়ী প্রতিনিধি নির্ব্বাচনের দিন স্থির হইল। বলশেভিক দল, তরুণ সাম্যবাদী দল এবং যাহারা কোন দলভুক্ত নহেন এমন বহু ব্যক্তি নির্ব্বাচন প্রার্থী হইলেন। সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় সমিতি সমস্ত সাম্যবাদী ও সাম্যবাদের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন নাগরিককে অনুরোধ করিলেন যে, সাম্যবাদী প্রার্থীকে তাঁহারা যে ভাবে ভোট দিবেন স্বতন্ত্র সদস্যদিগকেও তাঁহারা ইচ্ছামত সেই ভাবে ভোট দিতে পারিবেন। যে সকল নির্ব্বাচক সাম্যবাদী দলভুক্ত নহেন তাঁহারা স্বাধীনভাবে ভোট প্রদান করিতে পারিবেন। ১২ই ডিসেম্বর প্রত্যেক ভোটার নির্বাচনকেন্দ্রে উপস্থিত হইয়া সর্ব্বোচ্চ সোভিয়েটের প্রতিনিধি নির্ব্বাচনে তাহার ভোট প্রদানের সম্মানজনক অধিকারের মর্য্যাদা রক্ষা করিবেন।

 নির্ব্বাচনের পূর্ব্ব মুহূর্ত্তে ১১ই ডিসেম্বর কম্যুনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ষ্ট্যালিন ঘোষণা করিলেন, “করদাতা এবং জনসাধারণ তাঁহাদের তিনিধিগণের নিকট দাবী করিবেন, যে কর্ত্তব্যভার তাঁহারা গ্রহণ করিতেছেন তাহা যেন যোগ্যতার সহিত নিষ্পন্ন করিতে পারেন। কাজ করিতে যাইয়া তাহারা যেন পরস্পরের সহিত কলহকারী পেশাদার রাজনীতিকে পরিণত না হন। স্ব স্ব পদে তাঁহারা লেনিন-পন্থী রাজনীতিকরূপে প্রতিষ্ঠিত থাকিবেন। জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে তাঁহারা হইবেন লেনিনের মত স্পষ্ট, সরল এবং দৃঢ়নিশ্চিত। সংগ্রাম ক্ষেত্রে তাঁহারা হইবেন নির্ভীক এবং জনসাধারণের শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁহারা হইবেন দয়াহীন। লেনিন এইরূপ ছিলেন। তাঁহারা ভীতিবিহ্বল হইবেন না। যখন কোন সমস্যা জটিল হইবে কিম্বা দিকচক্রবাল রেখায় কোন বিপদের মেঘ দেখা দিবে তখন লেনিনের মতই দৃঢ়ভাবে তাঁহারা অটল থাকিবেন। তাঁহারা লেনিনের মতই ভালমন্দ সব দিক বিচার বিবেচনা করিয়া সমস্ত জটিল সমস্যা সমাধান করিবেন। তাঁহারা লেনিনের মতই ন্যায়নিষ্ঠ এবং সাধুতার সহিত কাজ করিবেন এবং তাঁহাদের উচিত জনসাধারণকে লেনিন যে ভাবে ভালবাসিতেন সেইভাবে ভালবাসা।”

 বিপুল আড়ম্বর ও উৎসাহের মধ্যে নির্ব্বাচন সমাধা হইল। ইহা কেবল নির্ব্বাচন নহে। ইহা বিশ বৎসরের সাধনায় নবসৃষ্টির বিজয়োৎসব, ইহা সোভিয়েট রাশিয়ার জনসাধারণের পারস্পরিক প্রগাঢ় প্রীতির বার্ত্তা ঘোষণা। ৯ কোটী ৪০ লক্ষ ভোটদাতার মধ্যে ৯ কোটী ১০ লক্ষ, অর্থাৎ শতকরা ৯৬ জনেরও অধিক ব্যক্তি ভোট প্রদান করিল। কম্যুনিষ্ট দল এবং স্বতন্ত্র দলের প্রতিনিধিরা শতকরা ৯৮ টীরও অধিক ভোট পাইলেন। মাত্র ৬ লক্ষ ৩২ হাজার ব্যক্তি সাম্যবাদী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়াছিল। তৎসত্ত্বেও সাম্যবাদী দলের প্রত্যেক নির্ধ্বাচনপ্রার্থী নির্ব্বাচনে জয়ী হইয়াছিলেন। ৯ কোটী লোকের ঐক্যমত সমাজতন্ত্রের এবং বলশেভিক দলের বিজয়কে স্বীকার ও সমর্থন করিল।

 বলশেভিক দলের অর্থাৎ মার্কস্-লেনিন-পন্থী দলের ইতিহাস বিস্ময়কর। এই দল প্রথম হইতেই সমাজ বিপ্লবের পতাকাবাহী এবং জনসাধারণকে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল করিয়া তুলিবার দল। সোভিয়েট রাষ্ট্রের বলশেভিক পার্টি সম্পর্কে ষ্ট্যালিন তাঁহার লেনিনিজম্ নামক পুস্তকে লিখিয়াছেন,—“প্রাক-বিপ্লব যুগে অল্পবিস্তর শান্তির সহিতই দল অগ্রসর হইয়াছে। যখন শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে দ্বিতীয় আন্তর্জ্জাতিকের প্রাধান্য ছিল তখন প্রধানতঃ আইনসভায় নিয়মতান্ত্রিক সংঘর্ষই মুখ্য কাজ বলিয়া বিবেচিত হইত বিপ্লবের সংগ্রামে দলের যে দৃঢ়তা ও লক্ষ্য সম্বন্ধে সুনির্দ্দিষ্টত। প্রকাশ পায় পূর্ব্বে তাহার অভাব ছিল। দ্বিতীয় আন্তর্জ্জাতিকের বিরুদ্ধে আক্রমনের প্রতিবাদ করিতে যাইয়া কাউট্‌স্কি (জার্ম্মান সাম্যবাদী কিন্তু মহাযুদ্ধের পর দলত্যাগী) বলিয়াছিলেন, “দ্বিতীয় আন্তর্জ্জাতিকের অধীনস্থ দলগুলির লক্ষ্য শান্তি, যুদ্ধ নহে।” এই কারণেই মহাযুদ্ধের সময় তাহারা কোন অগ্রগামী পদক্ষেপ করিতে পারে নাই এবং জনসাধারণের বিপ্লবমূলক কার্য্যে নেতৃত্ব করিতে পারে নাই। ইহা দুঃখজনক কিন্তু এইরূপই হইয়াছিল। কারণ দ্বিতীয় আন্তর্জ্জাতিকের অন্তর্ভূক্ত দলগুলির জনসাধারণের বৈপ্লবিক সংগ্রাম পরিচালিত করিবার কোন যোগ্যতা ছিল না। তাহারা জনসাধারণের সংগ্রামশীল দল ছিল না। তাহারা শ্রমিকদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া শক্তি অর্জ্জনের প্রেরণা দিয়াছিল কিন্তু আসলে তাহাদের শ্রমিক সঙ্ঘগুলি ছিল এক একটী নির্ব্বাচন কেন্দ্র; পার্লামেণ্টারী নির্ব্বাচন এবং পার্লামেণ্টারী নিয়মতান্ত্রিক সংঘর্ষ পরিচালনের যন্ত্র। এই কারণেই দ্বিতীয় আন্তর্জ্জাতিক যখন প্রবল হইল এবং তাহাদের সম্মুখে যখন সুযোগ উপস্থিত হইল তখন দেখা গেল ইহা ঠিক ঠিক একটা দল নহে, কতকগুলি পার্লামেণ্টবিহারী ব্যক্তির সমষ্টি মাত্র এবং ইহাই ছিল জনসাধারণের প্রধান রাজনৈতিক সঙ্ঘ। সেই সময় আরও বোঝা গেল যে ঐ পার্লামেণ্টারী দলের দালাল ও প্রত্যঙ্গ ছাড়া দ্বিতীয় আন্তর্জ্জাতিক আর কিছুই নহে। এই শ্রেণীর দল হাল ধরিলে জনসাধারণকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতের প্রশ্নই উঠেন। ইহা বলা বাহুল্য।

 “কিন্তু নবযুগের আরম্ভে ঘটনাবলীর পরিবর্ত্তন হইল। শ্রেণী সংগ্রাম শ্রমজীবিদের বিপ্লব এবং এই উদ্দেশ্যে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিয়া সাম্রাজ্যবাদের উৎসাদন এবং জনসাধারণের পক্ষ হইতে ক্ষমতা অধিকার—ইহাই হইল নূতন যুগের আদর্শ। নূতন কর্ত্তব্য আসিল। দলকে নূতনভাবে বৈপ্লবিক পন্থায় কাজ করিবার জন্য পুনর্গঠন করিতে হইবে; শ্রমিকদিগকে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য বৈপ্লবিক কার্য্য পরিচালনা শিক্ষা দিতে হইবে; সংগ্রামশীল অংশের পশ্চাতে অন্যান্য সর্ব্বহারা শ্রেণীকে প্রস্তুত করিতে হইবে; প্রতিবেশী দেশগুলির জনসাধারণের সহিত দৃঢ় সংযোগ ও পরাধীন দেশগুলিতে স্বাধীনতার আন্দোলন জাগ্রত করিতে হইবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অভিনব দায়িত্ব পালন প্রাচীন-পন্থী এবং শান্তিপূর্ণ পারিপার্শ্বিকের মধ্যে পার্লামেণ্টারী কার্য্যে অভ্যস্ত সোশ্যাল ডেমোক্রাট দলের দ্বারা সম্ভবপর মনে করা আর অনিবার্য্য পরাজয় বরণ করা একই কথা। পুরাতন দলের নেতৃত্বে চালিত হইয়া যদি শ্রমিকেরা সংঘর্ষ আরম্ভ করিত তাহা হইলে তাহাদের রক্ষার কোন উপায় থাকিত না এবং জনসাধারণ যে এইরূপ ব্যবস্থায় সম্মত হইতে পারে না তাহা বলাই বাহুল্য।

 “এই কারণেই প্রয়োজন হইল নূতন দলের যাহা সংগ্রামশীল ও বৈপ্লবিক, যাহা সাহসের সহিত কৃষক শ্রমিককে রাজনৈতিক অধিকার লাভের সংঘর্ষে পরিচালিত করিবার স্পর্দ্ধা রাখে, যে দলের বৈপ্লবিক পরিস্থিতির জটিল অবস্থাকে সবদিক হইতে দেখিয়া কাজ চালাইবার মত অভিজ্ঞতা আছে এবং যে দল বিপ্লবতরণীকে চোরা পাহাড়ের আঘাত বাঁচাইয়া নিদ্দিষ্ট বন্দরে লইয়া যাইতে সক্ষম—এইরূপ দল ব্যতীত সাম্রাজ্যবাদকে সিংহাসন ভ্রষ্ট করা এবং কৃষক শ্রমিকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র। লেলিনবাদী দলই হইল নূতন দল।”

 ১৯২৯-৩০-এর জগদ্ব্যাপী অর্থ সঙ্কটের কথা আমরা পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি। ১৯৩৩-এ আশঙ্কা যদিও একটু কাটিয়া গেল, শিল্প-বাণিজ্যের কিছু উন্নতি লক্ষ্য করা গেল কিন্তু তথাপি পৃথিবীর ধনতান্ত্রিক শিল্প বাণিজ্য—১৯২৯-এর সংখ্যায় পৌঁছিতে পারিল না। তবে ফাশিষ্ট যুদ্ধের দরুণ রণসম্ভার নির্ম্মাণের কারখানাগুলির কথঞ্চিৎ উন্নতি হওয়ায় ১৯৩৭ সালে ১৯২৯-এর তুলনায় উৎপাদন শতকরা ৯৫ ভাগে আসিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু ১৯৩৭-এর মধ্যভাগে আবার এক দ্বিতীয় সঙ্কট দেখা দিল। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে এই বৎসরের শেষভাগে বেকারের সংখ্যা দাঁড়াইল এক কোটি। গ্রেটবৃটেনেও বেকারের সংখ্যা দ্রুত বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। ১৯২৯-এর ফাঁড়া কাটাইয়া উঠিতে না উঠিতেই ধনতান্ত্রিক দেশগুলি আবার এক নূতন অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হইল। এইভাবে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি যখন আভ্যন্তরীণ স্ববিরোধিতায় বিপন্ন, বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থ সংঘাতের সামঞ্জস্য বিধানে অক্ষম, ঠিক সেই সময়ে আক্রমণশীল রাষ্ট্রগুলি উহার সুবিধা লইয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটের ক্ষতি পূরণে অগ্রসর হইল এবং দুর্ব্বল দেশগুলির উপর অর্থ নৈতিক আধিপত্য অস্ত্রবলে স্থাপন করিতে লাগিল। এই লোভের ভিত্তির উপর জার্ম্মানী ও জাপানের সহিত যোগ দিল ইতালী।

 ১৯৩৫-এ ফাশিষ্ট ইতালী কোন কারণ না দেখাইয়া এবং আন্তর্জ্জাতিক আইন পদদলিত করিয়া আবিসিনিয়া দখল করিয়া লইল। যুদ্ধ ঘোষণা না করিয়াও এই উলঙ্গ দস্যুবৃত্তি ফাশিষ্ট রাষ্ট্রগুলির মধ্যে রেওয়াজ হইয়া উঠিল। যাহাহউক ইহা কেবল আবিসিনিয়ার স্বাধীনতা হরণ নহে, গ্রেটবৃটেনের উপর ইহার প্রত্যক্ষ আঘাত আসিল; ইউরোপ হইতে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার সমুদ্রপথ বিঘ্ন-সঙ্কুল হইল। গ্রেটবৃটেন ইতালীর আবিসিনিয়া দখলে বাধা দিতে গিয়া ব্যর্থকাম হইলেন। ইতালী রাষ্ট্রসঙ্ঘের বাহিরে গিয়া স্বাধীনভাবে অজস্র সমরোপকরণ নির্ম্মাণ কার্য্য সুরু করিল।

 নাৎসী জার্ম্মানী ভার্সাই সন্ধিপত্র ছিড়িয়া ফেলিল এবং অস্ত্রবলে ইউরোপের মানচিত্র পরিবর্ত্তন করিবার পরিকল্পনা দম্ভভরে ঘোষণা করিতে লাগিল। জার্ম্মান নাৎসীরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি অধীন, অন্ততপক্ষে জার্ম্মান জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি দখল করিবার অভিপ্রায় প্রায় প্রকাশ্যভাবে ব্যক্ত করিতে লাগিল। এই পরিকল্পনা অনুসারে তাহারা প্রথমে অস্ট্রিয়া অধিকার করিল, তারপর চেকোশ্লোভাকিয়াকে আঘাত করিল। তারপর পোলাণ্ড আক্রমণ এবং মহাযুদ্ধের সূচনা।

 ১৯৩৭-এর গ্রীষ্মকালে জার্ম্মানী ও ইতালী মিলিতভাবে স্পেন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিল। স্পেনিশ ফাশিষ্টদিগকে সাহায্যের অছিলায় নাৎসী ফাশিষ্ট বাহিনী স্পেনে অবতরণ করিল। দক্ষিণ বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ, জিব্রাল্টার পশ্চিমে আত‍্লাণ্টিক সাগর এবং উত্তরে বিশ্বে উপসাগরে নাৎসী ফাশিষ্ট রণতরিগুলি আড্ডা গাড়িল। ১৯৩৮-এর প্রারম্ভে জার্ম্মান নাৎসীরা অষ্ট্রিয়া দখল করিয়া দানিয়ুব নদীর কেন্দ্রস্থল অধিকার করিয়া দক্ষিণ ইউরোপে দৃষ্টি প্রসারিত করিল।

 স্পেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করিয়া ইতালী ও জার্ম্মানী ঘোষণা করিল যে সাম্যবাদীদিগকে দলন করা ছাড়া তাহাদের আর কোন উদ্দেশ্য নাই। কিন্তু এই স্থূল ধাপ্পবাজি কেবল নির্ব্বোধদিগকে প্রতারণা করিবার জন্য, আসলে ইহার উদ্দেশ্য ছিল গ্রেটবৃটেনের ও ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তলদেশ হইতে খনন করিবার চেষ্টা। অস্ট্রিয়া দখল করাটা ভার্সাই সন্ধির বিরুদ্ধে যুদ্ধও নহে এবং বিগত মহাযুদ্ধে হস্তাচ্যুত রাজ্যখণ্ড পুনরুদ্ধারের চেষ্টাও নহে। ইহা বলপূর্ব্বক সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা। ইহা পশ্চিম ইউরোপে জার্ম্মানীর আধিপত্য বিস্তারের দুরাকাঙ্খা এবং সর্ব্বোপরি ইহা গ্রেটবৃটেন ও ফ্রান্সের মর্যাদায় আঘাত।

 ১৯৩৭-এ জাপ-ফাশিষ্টরা পিপিং অধিকার করিল, মধ্যচীনে অভিযান করিল এবং সাংহাই বন্দর দখল করিয়া লইল। এখানেও সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হয় নাই। জাপানীদের নিজেরই সৃষ্ট “স্থানীয় ঘটনার” অছিলায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের কৌশল দেখা গেল। তিয়েনসিন, সাংহাই-এর ঘাঁটি দখল করিয়া জাপান মহাচীনের বিপুল বাণিজ্য হস্তগত করিল এবং গ্রেটবৃটেন ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বহুল পরিমাণে ক্ষুণ্ণ করিল, অন্যদিকে চীনের জনসাধারণ আক্রমণকারী জাপ বাহিনীর সম্মুখীন হইল এবং চীনে এক অভূতপূর্ব্ব জাতীয় জাগরণ লক্ষ্য করা গেল। চীনের জাতীয় গভর্ণমেণ্ট অদ্যাবধি পরমাশ্চর্য্য শৌর্য্য বীর্য্যের সহিত জাপ সাম্রাজ্যবাদকে ঠেকাইয়া রাখিয়াছে। পরিণামে ইহার ফল কি হইবে বলা যায় না কিন্তু সাময়িকভাবে জাপান চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বাণিজ্য হস্তগত করিয়াছে এবং প্রশান্ত মহাসাগরে বৃটেন ও আমেরিকার বাণিজ্য স্বার্থ ও নৌ-শক্তির আধিপত্য বহুল পরিমাণে ক্ষুন্ন করিয়াছে।

 এই সকল ঘটনা পরম্পরায় বোঝা গেল দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বাস্তবে পরিণত হইতে চলিয়াছে। যুদ্ধ ঘোষণা না করিয়াও অন্ধকারে নিঃশব্দসঞ্চারী দস্যুর মত সাম্রাজ্য লোভী যুদ্ধ জগতের উপর ঝাপাইয়া পড়িল। রাষ্ট্র ও জাতিগুলি অজ্ঞাতসারেই এই দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের জটিল জালে জড়াইয়া পাড়ল। জার্ম্মানী ইতালী ও জাপানের ফাশিষ্ট শাসকগণই এই যুদ্ধকে একরূপ অবাধে জিব্রাল্টার হইতে সাংহাই পর্য্যন্ত বিস্তার করিল। ক্রমে দেখা গেল যে এই যুদ্ধ গ্রেটবৃটেন ফ্রান্স ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ধনতান্ত্রিক স্বার্থের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী অভিযান।

 যুদ্ধের সূচনায় গ্রেটবৃটেন প্রভৃতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি এইরূপ একটা ভান করিলেন যেন ইহার সহিত তাঁহাদের বিশেষ কোন সম্পর্ক নাই। তাঁহারা অতি মাত্রায় শান্তিবাদী হইয়া উঠিলেন এবং আক্রমণশীল ফাশিষ্টদের মুরুব্বীর মত ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন। একের পর আর স্তরে স্তরে নিজভূমি পরিত্যাগ করিয়াও তাঁহারা দেখাইতে লাগিলেন যে কার্য্যতঃ তাঁহারা ইহাকে বাধা প্রদান করিতেছেন। অথচ কোন উপায়েই আবিসিনিয়া স্পেন ও চীনকে রক্ষা করা গেল না। তথাকথিত গণতন্ত্রগুলির যে সামরিক বা অর্থ-নৈতিক দুর্ব্বলতা বশতঃই এইরূপ একতরফা যুদ্ধ সম্ভব হইয়াছে ইহা মনে করিলে ভুল করা হইবে। ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রগুলি নিশ্চয়ই ফাশিষ্ট রাষ্ট্রগুলি অপেক্ষা শক্তিশালী ছিল; কিন্তু তাহারা ঐক্যবদ্ধ হইয়া একই উদ্দেশ্যে মিলিত হইতে পারে। যদিও তাহারা ফাশিষ্ট রাষ্ট্রগুলির অতিবৃদ্ধি দেখিযা শঙ্কিত হইতেছিল তথাপি তাহাদের অধিক আশঙ্কার কারণ ছিল ইউরোপের অসন্তুষ্ট শ্রমিক সম্প্রদায় এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন সমাজতন্ত্রবাদের প্রসার।

 অন্যদিকে সাম্যবাদের শত্রু ফাশিজমের প্রতিও তাহাদের মনের অবচেতন কোনে একটা প্রশ্রয়ের ভাব ছিল এবং এই সকল কারণে ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের বিশেষভাবে বৃটিশ রক্ষণশীল শাসকশ্রেণী তোষণনীতি অবলম্বন করিয়া ক্ষুধিত ফাশিষ্টদিগকে বুঝাইতে লাগিলেন যে চরম পন্থা অবলম্বন না করিলেও ক্রমে ও ধীরে ফাশিষ্ট রাষ্ট্রগুলির বাণিজ্য বিস্তারের দাবী পূরণ করা সম্ভবপর হইবে। গ্রেটবৃটেনের শাসকশ্রেণী এবং তাঁহাদের ফ্রান্স ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরা যখন বুঝিলেন যে তাঁহাদের তোষণ-নীতি এবং কূটনীতি দুইই ব্যর্থ হইল তখন তাঁহারা অনন্যোপায় হইয়া পোলাণ্ডের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা সমর্থন করিলেন।

 সোভিয়েট রাশিয়া এই সকল. ঘটনাবলী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিতেছিল। আন্তর্জ্জাতিক পরিস্থিতির জটিল ও অমঙ্গল সম্ভাবনাপূর্ণ ঘটনাবলী যখন ঘনাইয়া আসিল তখন আত্মরক্ষার্থ সোভিয়েট রাশিয়া প্রস্তুত হইল। যে কোন যুদ্ধ, তাহা যতই ক্ষুদ্র হউক না কেন, সর্ব্বদাই শান্তিকামী রাষ্ট্রগুলির পক্ষে দুশ্চিন্তার স্থল। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ নিঃশব্দ পদসঞ্চারে জাতির পর জাতিকে অভিভূত করিয়া ফেলিল এবং সূচনাতেই পাঁচ কোটি নরনারীর ভাগ্য তাহার সহিত জড়াইয়া পড়িল। এই সংঘর্ষের স্ফুলিঙ্গ যে দেশে দেশে ছড়াইয়া পড়িবে, পড়িবে কি পড়িতেছে, এ সম্বন্ধে কাহারও মনে সংশয় রহিল না।

 ১৯৩১-৩২ হইতেই এই আসন্ন বিপদ সোভিয়েট রাশিয়ার অজ্ঞাত ছিল না। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিবেষ্টিত একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আত্মরক্ষার দায়িত্ব তুলনায় অনেক বেশী। আন্তর্জ্জাতিক রাজনীতিতে কূটনীতি যুদ্ধ কিছুদিন ঠেকাইয়া রাখিলেও সামরিক শক্তিই নিরাপত্তার একমাত্র ভরসা। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চার বৎসরের মধ্যে সমাপ্ত করিয়া সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সামরিকভাবে প্রস্তুত হইবার ব্যবস্থা অবলম্বন করিল।

 পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সমাপ্তির পর ১৯৩৩-এর জানুয়ারী মাসে কেন্দ্রীয় পরিষদে রিপোর্ট দাখিল করিয়া ষ্ট্যালিন বলিয়াছেন, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল, কৃষিপ্রধান দুর্ব্বল ধনতান্ত্রিক দেশগুলির খেয়ালখুসীর উপর নির্ভরশীল সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক ধনতন্ত্রের খেয়ালখুসী হইতে মুক্ত করিয়া একটা শক্তিশালী শিল্পপ্রধান রাষ্ট্রে পরিণত করা।

 “অবশ্য আমাদের সঙ্কল্পের শতকরা ছয়ভাগ আমরা পূর্ণ করিতে পারি নাই। তাহার কারণ, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি আমাদের সহিত অনাক্রমণ চুক্তি করিতে অস্বীকার করিয়াছে এবং পূর্ব্ব এশিয়ার অবস্থা জটিল হইয়া উঠিয়াছে। ফলে আমাদের কতকগুলি কারখানা পণ্য উৎপাদনের পরিবর্ত্তে সমরোপকরণ নির্মাণে নিয়োজিত করিতে হইয়াছে। জাতীয় আত্মরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করিবার জন্য ইহার প্রয়োজন রহিয়াছে। এই পরিবর্ত্তনের ফলে আমরা চারমাস কাল ঐ সকল কারখানায় পণ্য উৎপাদন করিতে পারি নাই। কিন্তু উহা দ্বারা আমরা রক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করিয়াছি।

 “যদি আমরা উহা না করিতাম তাহা হইলে আত্মরক্ষার আধুনিকতম সরঞ্জাম সংগ্রহ করিতে পারিতাম না। ইহা ব্যতীত দেশের জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না; ইহা না করিলে আমরা বহিঃশত্রুর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হইয়াই থাকিতাম। তাহা হইলে আমাদের অবস্থা অল্পাধিক বর্তমান চীনের মত হইত। চীনের নিজস্ব বৃহৎ কলকারখানা নাই, নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্র নির্ম্মাণের ব্যবস্থা নাই, ফলে যে কেহ খুসী মত তাহাকে পীড়ন করে। আমাদের উপর কেহ চীনের মত ব্যবহার করিলে আমরা সশস্ত্র প্রতিরোধ করিতাম, কিন্তু সেই ভয়াবহ অসম যুদ্ধে আমরা আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত আক্রমণের সম্মুখে প্রায় নিরস্ত্র হইয়া অগ্রসর হইতাম।”

 ১৯৩৩-এ হিটলারের অভ্যুত্থানের পর হইতে লাল পণ্টনকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করিবার বিপুল ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়। ষ্ট্যালিন একদিকে সামরিক বল সঞ্চয় করিতে লাগিলেন, অন্যদিকে শান্তিরক্ষার দিক হইতে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করিতে লাগিলেন। ১৯৩৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সোভিয়েট রাশিয়া লীগ-অফ-নেশনসে যোগদান করে। সোভিয়েটের বিশ্বাস ছিল, রাষ্ট্রসঙ্ঘের দুর্ব্বলতা সত্ত্বেও এই কেন্দ্র হইতে আক্রমণশীল রাষ্ট্রগুলির দুর্ব্বলতা উদ্ঘাটন করা যাইতে পারে এবং যুদ্ধকে ঠেকাইবার চেষ্টা করা যাইতে পারে। জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখল এবং হিটলারের তরবারী আস্ফালনে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সমষ্টিগত নিরাপত্তার কোন গুরুত্ব অবশ্য ছিল না। সোভিয়েট প্রতিনিধি লিটভিনফ জেনেভায় ইংলণ্ড ও ফ্রান্সকে সমষ্টিগত নিরাপত্তার আদর্শ প্রয়োগ করিবার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করিয়াছেন। লিটভিফ, সম্মিলিত সামরিক নেতৃত্বের বৈঠক আহ্বান করিবার প্রস্তাব করিলে, চেম্বারলেন ও বৃটিশ গভর্নমেণ্ট সরাসরি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিয়া, সোভিযেটকে বাদ দিয়াই হিটলারকে তুষ্ট করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। অস্ট্রিয়ার পর চেকোশ্লোভাকিয়ার পালা আসিল। হিটলার সুদেতেন দাবী করিলেন। কিন্তু বৃটেনের প্রভাবে ফ্রান্স প্রতিশ্রুতিপালনে অস্বীকৃত হইল। সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট চেক গভর্ণমেণ্টকে জানাইলেন, বৃটেন ফ্রান্স অগ্রসর না হইলেও আমরা সন্ধির সর্ত্তানুযায়ী চেক রাষ্ট্ররক্ষায় অগ্রসর হইব। কিন্তু মিঃ বেনেস বৃটেনের চাপে পড়িয়া রাশিয়ার সাহায্য গ্রহণ করিতে পারিলেন না। মিউনিক বৈঠকে ইতালী, জার্ম্মানী, ফ্রান্স ও বৃটেন, সোভিয়েট রাশিয়াকে বাদ দিয়া চেকোশ্লোভাকিয়াকে বলি দিলেন। চেম্বারলেন “জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠাতা” রূপে নির্ব্বোধ ও ভণ্ডদের দ্বারা অভিনন্দিত হইলেন। হিটলার ১৯৩৯-এর মার্চ মাসে বিজয়গর্ব্বে সমগ্র চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করিলেন।

 এই সময় ১০ই মার্চ্চ সোভিয়েট ইউনিয়নের কম্যুনিষ্ট পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির ষড়যন্ত্র এবং প্রকারান্তরে জার্ম্মানীকে ইউক্রেণ অধিকার করিবার জন্য উৎসাহদানের প্রচেষ্টার সমালোচনা করিয়া ষ্ট্যালিন বক্তৃতামুখে বলিয়াছিলেন,—

 “সাংহাই হইতে জিব্রাল্টার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের ৫০ কোটি নরনারীর ভাগ্য যে যুদ্ধে জড়িত হইয়াছে, সেই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করিয়াছে। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মানচিত্র বলপূর্ব্বক পরিবর্ত্তিত হইতেছে। যুদ্ধোত্তর সমগ্র ব্যবস্থা, তথাকথিত শান্তির রাজত্বের ভিত্তি আজ বিচলিত। পক্ষান্তরে এই কালের মধ্যে সোভিয়েট ইউনিয়ন সমৃদ্ধিশালী হইয়াছে, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিলাভ করিয়াছে, রাজনীতি ও সমরনীতির দিক দিয়া শক্তিশালী হইয়াছে এবং জগতে শান্তিরক্ষার জন্য চেষ্টা করিয়াছে।

 “তিনটি আক্রমণশীল রাষ্ট্র এই অভিনব সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রবর্ত্তক। জাপান নয়টি রাষ্ট্রের সম্মিলিত সন্ধিপত্র (পূর্ব্ব এশিয়ায় শান্তিরক্ষার চুক্তি) ছিন্ন করিয়াছে, জার্ম্মানী ও ইতালী ভার্সাই সন্ধি পদদলিত করিয়াছে, স্বাধীনভাবে কাজ করিবার জন্য ইহারা রাষ্ট্রসঙ্ঘ ত্যাগ করিয়াছে। নূতন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আজ বাস্তব ঘটনা। আজকাল সন্ধিপত্র ও জনমত অগ্রাহ্য করিয়া সহসা যুদ্ধঘোষণা সহজ নয়। বুর্জ্জোয়া রাজনীতিকেরা এবং ফাশিষ্ট শাসকগণ ইহা ভাল করিয়াই জানে। এই কারণে ফাশিষ্ট শাসকেরা, যুদ্ধ·আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে, অনুকুল জনমত গঠন করিবার চেষ্টা করিয়াছে, অর্থাৎ জনমতকে বিভ্রান্ত ও প্রতারণা করিবার চেষ্টা করিয়াছে।[১]

 “ইউরোপে ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের স্বার্থের বিরুদ্ধে জার্ম্মানী ও ইতালীর সামরিক ব্লক? কি পরিতাপের কথা ইহাকে তোমরা ব্লক বল? “আমাদের” কোন সামরিক ব্লক নাই। আমাদের আছে কেবল অতি নিরীহ ‘রোম বার্লিন অক্ষ’ ইহা অক্ষের একটা জ্যামিতিক সংজ্ঞা মাত্র (হাস্যধ্বনি)

 “পূর্ব্ব এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের স্বার্থের বিরুদ্ধে জার্ম্মানী, ইতালী এবং জাপানের মিলিত সামরিক ব্লক? একেবারেই ভুয়া কথা। আমাদের কোন মিলিটারী ব্লক নাই। আমাদের একটী নির্দ্দোষ রোম, বার্লিন, টোকিয়ে| ত্রিভূজ আছে, ইহাও একটা| জ্যামিতিক ব্যাপার। (হাস্যধ্বনি)

“ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে যুদ্ধ? অর্থহীন প্রলাপ! আমরা আন্তর্জ্জাতিক কম্যুনিষ্ট সঙ্ঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছি, কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নহে। যদি তোমরা ইহা বিশ্বাস না কর, তাহা হইলে জাপান, জার্ম্মান ও ইতালীর “এণ্টি কমিণ্টার্ণ প্যাক্ট” পড়িয়া দেখ।

 “এইভাবে পররাষ্ট্রলোভী আক্রমণকারীরা জনমত গঠন করিতেছে। এই স্থূল ধাপ্পাবাজীর চাতুরী বুঝা বেশী কঠিন নহে।’

 “কিন্তু যুদ্ধ বাস্তব ঘটনা। ইহাকে কোন ছলনাতেই আবৃত করা কঠিন। কোন ‘অক্ষ্’ ‘ত্রিভূজ’ বা ‘এণ্টি কমিণ্টার্ণ প্যাক্টই’ এই বাস্তব ঘটনা আবৃত করিতে পারে নাই যে, এই কালের মধ্যে জাপান চীনের বৃহৎ ভূখণ্ড কুক্ষিগত করিয়াছে, ইতালী আবিসিনিয়া দখল করিয়াছে, জার্ম্মানী অস্ট্রিয়া ও সুদেতানল্যাণ্ড গ্রাস করিয়াছে এবং জার্ম্মানী ও ইতালী একযোগে স্পেনের উপর অধিপত্য বিস্তার করিয়াছে এবং ইহা অনাক্রমণশীল রাষ্ট্রগুলির স্বার্থকে উপেক্ষা করিয়াই করা হইয়াছে। যুদ্ধ যুদ্ধই আছে, পররাষ্ট্রগ্রাসী মিলিটারী ব্লক ঠিকই আছে এবং সাম্রাজ্যলোভীর সাম্রাজ্যলোভীই রহিয়াছে। এই অভিনব সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের একটা প্রধান লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে ইহা এখনও সমস্ত জগতে ছড়াইয়া পড়ে নাই। পররাষ্ট্রলোভী রাষ্ট্রগুলি পদে পদে ইংলণ্ড, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি রাষ্ট্রের স্বার্থ হানি করিতেছে, কিন্তু ইহারা ক্রমাগত পিছু হটিয়া আক্রমণকারীদের সুবিধার পর সুবিধা দিতেছে। জগত ভাগাভাগি করিয়া লইবার এই চেষ্টায় বাধা ত দেওয়া হইতেছেই না, বরং একটা প্রশ্রয়ের ভাব দেখা যাইতেছে।

 “অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্য। নূতন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের এই বিস্ময়কর একতরফা ব্যাপারের আমরা কি কারণ নির্দ্দেশ করিতে পারি? বিপুল সুবিধার অধিকারী এই সকল রাষ্ট্র এত সহজে, কিছুমাত্র বাধা না দিয়া কেন নিজেদের স্থান ছাড়িয়া দিতেছে এবং সন্ধির প্রতিশ্রুতি পালন না করিয়া আক্রমণকারীদিগকে তুষ্ট করিতেছে? ইহা কি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির দুর্ব্বলতার পরিচায়ক? নিশ্চয়ই নহে। ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি ফাশিষ্ট রাষ্ট্রগুলি অপেক্ষা অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়া নিঃসন্দেহে বহু শক্তিশালী। তথাপি এই রাষ্ট্রগুলি নিয়মিতভাবে কেন আক্রমণকারীদের সুবিধা দিতেছে?

 “দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে, যে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি যদি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় এবং যুদ্ধ সমস্ত পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়ে, তাহা হইলে একটা বিপ্লব ঘটিবার আশঙ্কা আছে। বুর্জ্জোয়া রাজনীতিকেরা জানে যে প্রথম মহাযুদ্ধে একটা বিশাল দেশে বিপ্লব জয়যুক্ত হইয়াছিল। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে এক বা একাধিক দেশে বিপ্লব বিজয়ী হইতে পারে, তাহাদের এ আশঙ্কা আছে। কিন্তু বর্ত্তমানে ইহাই একমাত্র বা প্রধান কারণ নহে। আসল কথা অধিকাংশ অনাক্রমণশীল রাষ্ট্র বিশেষভাবে ইংলণ্ড ও ফ্রান্স, সমষ্টিগত নিরাপত্তার নীতি এবং আক্রমণকারীদের প্রতিরোধনীতি ত্যাগ করিয়া “নিরপেক্ষ”তার ভূমিতে গিয়া দাঁড়াইয়াছে।

 “সাধারণভাবে বলিতে গেলে নিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা এইরূপ দাঁড়ায়— “প্রত্যেক দেশ সাধ্যমত আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করুক——উহা আমাদের কিছুই নহে। আমরা আক্রমণকারী ও আক্রান্ত দুই পক্ষের সহিত বাণিজ্য করিব।” কিন্তু কার্য্যতঃ এই নিরপেক্ষতার নীতি, আক্রমণকারীদের পরোক্ষভাবে উৎসাহদান, যুদ্ধের পথ মুক্ত করিয়া দেওয়া, যাহার ফলে এই যুদ্ধ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধে পরিণত হইবে। নিরপেক্ষতার নীতির মধ্যে আমরা দেখিতেছি, আক্রমণকারীদের নিন্দনীয় কাজে বাধা না দিবার আগ্রহ। জাপান চীনে জড়াইয়া পড়ুক, সোভয়েটের সহিত বাধিয়া উঠিলে আরও ভাল হয়, জার্ম্মানী ইউরোপে হুলুস্থুল বাধাইয়া সোভিয়েট ইউনিয়নের সহিত যুদ্ধে জড়াইয়া পড়ুক, আক্রমণকারীরা মহাযুদ্ধের রুধির কর্দ্দমে গভীরভাবে ডুবিয়া যাউক, সুকৌশলে উৎসাহ দিয়া পরস্পরকে দুর্ব্বল ও ক্লান্ত করিবার সুবিধা দেওয়া হউক, এবং যখন তাহারা একেবারে দুর্ব্বল হইয়া পড়িবে, তখন সমস্ত নূতন শক্তি লইয়া, “শান্তির জন্য” রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হইয়া হতবল যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলিকে সর্ত্ত দিবার সুবিধা হইবে।

 অতি সহজ ও সুলভ পথ!

 * * * *

 “জার্ম্মানীর দৃষ্টান্ত দেখ। অস্ট্রিয়ার স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও ইহারা জার্ম্মানীকে অস্ট্রিয়া দখল করিতে দিল; চেকোশ্লোভাকিয়াকে পরিত্যাগ করিল, কোন আন্তর্জ্জাতিক কর্তব্যের মর্যাদা রাখিল না। ইহার পর তাহারা সংবাদপত্রে “রাশিয়ান সৈন্যের দুর্ব্বলতা” “রুশ বিমানবহরের অধঃপতন” লইয়া মিথ্যা কোলাহল তুলিয়াছে। সোভিয়েট ইউনিয়নে দাঙ্গা হাঙ্গামা চলিতেছে, এই শ্রেণীর প্রচারকার্য্যের উদ্দেশ্য জার্ম্মানীকে পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হইবার উৎসাহ দান এবং সহজেই কার্য্য সিদ্ধি হইবার ভরসা দিয়া বলা হইতেছে, “বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া দাও, সব ঠিক হইয়া যাইবে।” ইহাও আক্রমণকারীদের উৎসাহ দিবার মতই দেখাইতেছে।”

 এই ইতিহাস স্মরণীয় বক্তৃতায় ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির রাজনীতিক ও সংবাদপত্রগুলির ভণ্ডামী, কাপট্য ও সোভিয়েট বিদ্বেষের বিশ্লেষণ করিয়া সোভিয়েট ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি ষ্ট্যালিন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করিলেন, —তাহার মধ্যে উল্লেখযোগ্য,—

 (১) যে সকল জাতি আক্রান্ত হইয়া স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করিবে, আমরা তাহাদের সাহায্য করিব।

 (২) আমরা আক্রমণের আশঙ্কায় ভীত নহি। যুদ্ধে প্ররোচনা দিয়া যাহারা সোভিয়েট সীমান্ত পরিবর্ত্তন করিতে চাহে, তাহাদিগকে একটি আঘাতের পরিবর্ত্তে দুইটি আঘাত করিবার জন্য আমরা প্রস্তুত!

 (৩) যাহারা চিরদিন পরকে দিয়া আগুন হইতে বাদাম তুলিয়া লইতে অভ্যস্ত, তাহাদের প্ররোচনায় আমরা আমাদের দেশকে যুদ্ধে লিপ্ত হইতে দিব না।

 হিটলার ইউরোপগ্রাসী দুরাশা লইয়া যুদ্ধায়োজন করিতেছেন, ইহা নিশ্চিতরূপে বুঝিয়াও বৃটেন ও ফ্রান্স সোভিয়েটের সহিত একযোগে শান্তি রক্ষার এবং প্রয়োজন হইলে সশস্ত্র প্রতিরোধ করিবার ব্যবস্থা করিলেন না। বৃটিশ জনমতের চাপে চেম্বারলেন-গভর্ণমেণ্ট সোভিয়েটের সহিত আলোচনার ভান করিতে লাগিলেন এবং পোলাণ্ডের স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পোলাণ্ড আক্রান্ত হইলে বৃটেন কি ভাবে কোন পথে সাহায্য করিবে, সে সম্বন্ধে কোন উচ্চবাচ্য হইল না। নাৎসী জার্ম্মানী বারম্বার সোভিয়েটের সহিত অনাক্রমণ চুক্তির জন্য চেষ্টা করিতেছিল। আগষ্ট মাসে ফন রেবেনট্রপ মস্কো গিয়া দশ বৎসরের অনাক্রমণ চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করিলেন। সমগ্র জগৎ চমৎকৃত হইল। বুর্জ্জোয়া সংবাদপত্রগুলি প্রচার করিতে লাগিল, রাশিয়া নাৎসী-পক্ষে যোগ দিয়াছে। পক্ষান্তরে বৃটিশ রাজনীতিকেরা জার্ম্মানীর উপর ক্রুদ্ধ হইলেন। তাহারা প্রত্যাশা করিয়াছিলেন, জার্ম্মানী তাঁহাদের সহিতই অনাক্রমণ চুক্তি করিবে। লর্ড হ্যালিফাক্স প্রকাশ্যে জার্ম্মানীর কাজটাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলিয়া বর্ণনা করিলেন। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকা কঠিন। অখ্যাত ব্যক্তিদের লইয়া গঠিত এক সামরিক মিশন মস্কো প্রেরিত হইল। সোভিয়েট পোলাণ্ড রক্ষার জন্য সর্ব্ববিধ সামরিক সাহায্য করিবার প্রতিশ্রুতি দিল। কিন্তু পোল-গভর্ণমেণ্ট সোভিয়েট সৈন্যকে পোলাণ্ডে প্রবেশ করিতে দিতে অস্বীকার করিলেন। বৃটিশ মিশন পোলগভর্ণমেণ্টকে সমর্থন করিয়া বলিলেন,—অস্ত্র শস্ত্র দিয়া সাহায্য করিলেই চলিবে। পোল-গভর্ণমেণ্টের অস্বীকৃতির জন্যই হিটলার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। ১৯৩৯-এর ১লা সেপ্টেম্বর হিটলার বাহিনী পোলাণ্ডে প্রবেশ করিল। বৃটেন ও ফ্রান্স ৩রা সেপ্টেম্বর, জার্ম্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল।

 নাৎসী বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পোল সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হইয়া গেল। পোলাণ্ডের অর্দ্ধ-ফাশিষ্ট শাসকশ্রেণীর জমিদার বাবুরা ধনরত্ন লইয়া পলায়ন করিলেন। পূর্ব্ব পোলাণ্ডকে হত্যা ও ধ্বংসের বিভীষিকা হইতে রক্ষা করিবার জন্য সোভিয়েট গভর্ণমেণ্টের আদেশে লাল পণ্টন অগ্রসর হইল। পোলাণ্ডের রাজধানীর দ্বারদেশে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হইয়া দাঁড়াইল। ৫৫ ডিভিসন নাৎসী বাহিনী ১০২ ডিভিসন লাল পল্টনের সম্মুখীন—অতএব শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা হইয়া গেল। আরও কারণ এই যে, ১৯২০-এ বলপূর্ব্বক পোলাণ্ড, ইউক্রেন ও বাইলো রাশিয়ার অংশ বিশেষ অধিকার করিলেও, অধিবাসীরা পোলগভর্ণমেণ্টের বরাবর বিরোধী ছিল, তাহারা স্বেচ্ছায় সোভিয়েটের অন্তর্ভূক্ত হইল। সামরিক গুরুত্বের দিক হইতে কার্পেথিয়ান পর্ব্বতমালা পর্য্যস্ত সোভিয়েট সীমান্ত প্রসারিত করার প্রয়োজন ছিল। ইংলণ্ডের সংবাদপত্রগুলি “লাল-সাম্রাজ্যবাদের” ধুয়া তুলিয়া কোলাহল শুরু করিল। কিন্তু মিঃ চার্চ্চিল বলিলেন, ১৯১৯ সালে নির্দ্দিষ্ট (পোলাণ্ড সোভিয়েট রাশিয়া আক্রমণ করিবার পূর্ব্বে) “কার্জ্জন লাইন” পর্য্যন্ত অগ্রসর হইবার বৈধ অধিকার সোভিয়েটের আছে।

 জার্ম্মানীর সাম্রাজ্যবিস্তারে ভীত লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়ার অধিবাসীরা ১৯৪০-এর নূতন নির্ব্বাচনে সোভিয়েট রাষ্ট্রসঙ্ঘে যোগ দিবার অনুকূলে শতকরা ৯৫টি ভোট দিল। পূর্ব্বাতন গভর্ণমেণ্টের ফাশিষ্ট জার্ম্মানবংশীয় জমীদারগণ জার্ম্মানীতে পালাইয়া গেলেন। জার্ম্মান গভর্ণমেণ্টের মধ্যস্থতায় সোভিয়েট জার্ম্মান অধিবাসীদের স্বদেশে ফিরিবার অনুমতি দিলেন। লাল নৌ-বহর রীগা, তাল্লিনের ঘাঁটি সুরক্ষিত করিল।

 ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির ষড়যন্ত্রে ফিনল্যাণ্ডের সীমান্ত লেলিনগ্রাড হইতে মাত্র ২১ মাইল দূরে বিখ্যাত “ম্যানারহাইম লাইন” নির্ম্মিত হইয়াছিল। এই দুর্ভেদ্য দুর্গমালা হইতে ভারী কামানের গোলা বর্ষিত হইলে লেলিনগ্রাডের ধ্বংস অনিবার্য্য। সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট বহুগুণে অধিক ভূমি ফিনল্যাণ্ডকে দিয়া মাত্র সামরিক গুরুত্বপূর্ণ কেরোলিন যোজক হইতে কিছু ভূমি চাহিলেন। কিন্তু ফিন-গভর্ণমেণ্ট এই সৌহার্দ্দ্যপূর্ণ প্রস্তাব প্রত্যাখান করিল। ফিন-নেতারা সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে পড়িয়া নির্ব্বোধের মত যুদ্ধে লিপ্ত হইল। তিন মাসের মধ্যেই বিশাল দুর্ভেদ্য দুর্গ ম্যানারহাইম লাইন ভাঙ্গিয়া পড়িল। বাহির হইতে সাহায্য না পাইয়া ফিন-গভর্ণমেণ্ট ১৯৪০-এর ১৬ই মার্চ্চ সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিল। কিন্তু সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট সামরিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক হাত জমীও লইলেন না। ভাইবর্গসহ একখণ্ড ভূমি, যাহা লেনিনগ্রাড রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক, তাহাই মাত্র লইলেন, এবং বার্ষিক ৪ লক্ষ টাকা বৃত্তি দিয়া সামরিক নৌ-ঘাঁটি হ্যাঙ্গো ইজারা লইলেন।

 ১৯৪০-এর জুলাই মাসে সোভিয়েট রুমানিয়ার নিকট বেসারাবিয়া দাবী করিল। ১৯১৯ সালে এই প্রদেশটি ফিরাইয়া দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াও রুমানিয়ান গভর্ণমেণ্ট তাহা পালন করেন নাই। সোভিয়েট সীমান্ত সুদৃঢ় করিবার জন্য ইহার প্রয়োজন ছিল। রুমানিয়া বেসারাবিয়া ও বুকোভিনা ছাড়িয়া দিল। জার্ম্মান সমরনায়কগণ তীব্র প্রতিবাদ করিলেন। পরবর্তীকালে নাৎসী “ব্লীৎস‍্ক্রীগ্” ঠেকাইতে ইহার সামরিক গুরুত্ব বোঝা গিয়াছিল।

 বাহিরের জগৎ যখন ধনতন্ত্রীদের দালাল সংবাদপত্রগুলির প্রচার কার্য্যে বিভ্রান্ত হইয়া ভাবিতেছিল, জার্ম্মানীর সহিত মিলিয়া সোভিয়েটও যুদ্ধের সুযোগে রাজ্য জয় করিতেছে, তখন সোভিয়েট নেতারা জানিতেন যে, জার্ম্মানীর আসল লক্ষ্য সমাজতন্ত্রবাদের দুর্গ সোভিয়েটকে ধ্বংস করা এবং যে জন্য তাঁহারা প্রস্তুত হইবার জন্যই সীমান্ত সুদৃঢ় করার কার্য্য আরম্ভ করিয়াছিলেন। আক্রমণ করিব না, আক্রান্ত হইলে আত্মরক্ষা করিব ইহাই ছিল সোভিয়েটের নীতি।

 ফ্রান্স পর্যু্যদস্ত পদানত— নরওয়ে হইতে ক্রীট হিটলারের করতলগত। হিটলার সামরিক সাফল্যের সর্ব্বোচ্চ শিখরে। নাৎসী বাহিনী এইবার মিশর ও ইংলণ্ডে অভিযান করিবে—সমগ্র জগত রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষমান। এমন সময় সহসা ১৯৪১-এর ২২শে জুন প্রায়ান্ধকার প্রভাতে বিশ্বাসঘাতক ও কৃতঘ্ন হিটলার, কোন ঘোষণা না করিয়া সোভিয়েট ভূমি আক্রমণ করিল। জার্ম্মান সমরনায়কগণ “পৃথিবীর ইতিহাসে অভিনব বিশাল শক্তিশালী বাহিনীর” সম্মুখীন না হইবার জন্য হিটলারকে পরামর্শ দিয়াছিলেন; কিন্তু হিটলার সম্মোহিত জার্ম্মানী জাতিকে শুনাইলেন, দশ সপ্তাহের মধ্যে লাল পণ্টন ভাঙ্গিয়া পড়িবে এবং ইউক্রেনের উর্ধ্বর ভূমির মালিক হইবে জার্ম্মানরা।

 সমগ্র জগতে এই সংবাদ ছড়াইয়া পড়িল। পররাষ্ট্রসচীব মলোটভ মধ্যাহ্নে বেতারযোগে ঘোষণা করিলেন,—সোভিয়েট ভূমির অধিবাসীবৃন্দ, আমাদের মহান নেতা কমরেড ষ্ট্যালিন আমাকে নিম্নোক্ত ঘোষণা কারবার অনুমতি দিয়াছেন—

 “অদ্য প্রভাত ৪ টার সময়, সোভিয়েট ইউনিয়নের নিকট কোন দাবী না করিয়া এবং যুদ্ধ ঘোষণা না করিষা জার্ম্মান সৈন্য আমাদের দেশ আক্রমণ করিয়াছে। এরূপ অশ্রুতপূর্ব্ব আক্রমণের তুলনা সমগ্র সভ্যজাতিগুলির ইতিহাসে নাই। জার্ম্মানীর সহিত সোভিয়েট রাশিয়ার অনাক্রমণের চুক্তি রহিয়াছে এবং সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট বিশ্বস্তভাবে সেই চুক্তির মর্য্যাদা রক্ষা করিয়াছে। এ পর্য্যন্ত চুক্তির সর্ত্ত সম্পর্কে জার্ম্মান গভর্ণমেণ্ট একটিও অভিযোগ উত্থাপন করে নাই। কৃতঘ্ন দস্যুর মত সোভিয়েট ইউনিয়নের উপর এই আক্রমণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব জার্ম্মানীর ফাশিষ্ট শাসকগণের।

 “প্রভাত সাড়ে পাঁচটায় যুদ্ধ আরম্ভ হইবার পর জার্ম্মান রাষ্ট্রদূত আমাকে জানাইলেন যে, জার্ম্মানীর পূর্ব্ব সীমান্তে সোভিয়েট সৈন্য সমাবেশ করায় জার্ম্মান গভর্ণমেণ্ট আক্রমণ করিবার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। উত্তরে আমি বলিলাম, জার্ম্মান গভর্ণমেণ্ট শেষ মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত কোন দাবী উপস্থিত করেন নাই। সোভিয়েট শান্তির ঐকান্তিক আগ্রহে কৃতসঙ্কল্প ছিল, অতএব ফাশিষ্ট জার্ম্মানীই আক্রমণকারী।”

 যুদ্ধ আরম্ভ হইবার পর সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট সোভিয়েটের সর্ব্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা ষ্ট্যালিনকে প্রধান মন্ত্রী নির্ব্বাচিত করিলেন।

 ৩রা জুলাই বেতারযোগে সোভিয়েট রাশিয়ার জনগণকে লক্ষ্য করিয়া ষ্ট্যালিন মহাযুদ্ধ বিশ্লেষণ করিয়া এক বক্তৃতা করিলেন। তাঁহার বক্তৃতায় উত্তেজনা ও উন্মাদনা নাই,— আছে ধীর স্থির বীরের অকুতোভয় সাহস ও শৌর্য্য; আছে শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবি ও লাল পণ্টনের শক্তি ও ঐক্যের উপর দৃঢ় বিশ্বাস। যখন নাৎসী ঝটিকাবাহিনীর দ্রুত অগ্রগতিতে সমগ্র জগৎ চমৎকত, যখন সোভিয়েট রণনীতির কৌশল সম্পর্কে বাহিরের লোকের কোন ধারণাই নাই, তখন ষ্ট্যালিন বলিলেন,— আমাদের কীর্ত্তিমান লাল পণ্টন আমাদের কতিপয় সহর ও জিলা ফাশিষ্ট শত্রুসৈন্যের হাতে সমর্পণ করিল ইহা কিরূপে সম্ভবপর হইল? মিথ্যাবাদী ফাশিষ্ট প্রচারকেরা অবিরত ভেরীনিনাদে ঘোষণা করিতেছে যে জার্ম্মান ফাশিষ্টবাহিনী অজেয় ও দুর্ভেদ্য, ইহা কি সত্য?

 “নিশ্চয়ই নহে। ইতিহাস বলে জগতে কখনও কোন অজেয় বাহিনী নাই, কখনও ছিলও না। নেপোলিয়নের বাহিনী লোকে অজেয় বলিয়া বিশ্বাস করিত; কিন্তু রাশিয়া ইংলণ্ড ও জার্ম্মান বাহিনীর নিকট তাহা পরাজিত হয়। প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে কাইজারের জার্ম্মান সৈন্য লোকে অজেয় বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছিল, কিন্তু উহা রাশিয়া ও ইঙ্গ-ফরাসী বাহিনীর নিকট বারম্বার পরাজিত হয় এবং পরিণামে ইঙ্গ-ফরাসী বাহিনীর আঘাতে ভাঙ্গিয়া পড়ে। অ্দ্যকার হিটলারের বাহিনীরও সেই দশাই হইবে। এই বাহিনী ইউরোপে কোন প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় নাই। সবে মাত্র আমাদের ভূমিতেই উহা তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছে। ইতিমধ্যেই লাল পণ্টনের সম্মুখে হিটলারের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বাহিনীর কয়েকবার পরাজয় ঘটিয়াছে। ইহার অর্থ এই যে, ইহাকেও ধ্বংস করা যাইতে পারে এবং তাহাই করা হইবে।”

 সোভিয়েট জনগণ এবং জগতের প্রগতিশীল স্বাধীনতাকামী অগণিত নরনারী, উৎকর্ণ হইয়া ষ্ট্যালিনের অকম্পিত কণ্ঠ হইতে শুনিল,—“ফাশিষ্ট জার্ম্মানীর সহিত যুদ্ধ সাধারণ যুদ্ধ নহে। ইহা কেবল দুইটি সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধ নহে। ইহা ফাশিষ্ট জার্ম্মান বাহিনীর সহিত সমগ্র সোভিয়েট জনগণের সংগ্রাম। আমাদের স্বদেশ রক্ষার জন্য এই জাতীয় যুদ্ধের লক্ষ্য কেবল আমাদের দেশকেই মুক্ত করা নহে; জার্ম্মান ফাশিষ্ট প্রভুত্বে নিপীড়িত জনগণকে মুক্ত হইতেও আমরা সাহায্য করিব। এই স্বাধীনতার যুদ্ধে আমরা একক নহি। হিটলারের কুশাসনে ক্রীতদাসে পরিণত জার্ম্মান জনগণসহ ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণ আমাদের মিত্র। আমাদের এই যুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির মুক্তি ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপান্তরিত হইবে।”

 এই মহাযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনা করিবার সময় এখনও আসে নাই। ষ্ট্যালিন প্রথমে প্রধান মন্ত্রী পরে সর্ব্বপ্রধান সেনাপতি নির্ব্বাচিত হইয়া মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ যুদ্ধ আশ্চর্য্য সাফল্য ও কৃতীত্বের সহিত পরিচালনা করিতেছেন। ১৯৪২-এর নভেম্বর বিপ্লবের স্মৃতি দিবসের অনুষ্ঠানে বিজয়ী লাল পণ্টনকে অভিনন্দিত করিয়া ষ্ট্যালিন বলিয়াছিলেন, “সমগ্র জগং আজ দুইটি পৃথক শিবিরে বিভক্ত। অক্ষশক্তির কার্য্যক্রম হইল জাতিগত বিদ্বেষ, বিধাতা মনোনীত জাতিদের আধিপত্য এবং সমস্ত সম্প্রদায় ও উপজাতির দাসত্ব, সমস্ত জাতির অর্থ নৈতিক দাসত্ব ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ। আমাদের কার্যক্রম হইল, পৃথিবীর সমস্ত জাতি ও উপজাতির সমান অধিকার এবং সমস্ত পরাধীন জাতির মুক্তি, জাতিগত বিদ্বেষ ও বৈষম্য বিলোপ; অনগ্রসর জাতিগুলিকে অন্যান্য জাতির অর্থনৈতিক সাহায্য দিবার অধিকার এবং পারস্পরিক মঙ্গলের জন্য সহযোগিতা এবং হিটলারী ফাশিষ্ট ব্যবস্থা ধ্বংস।”

 জার্ম্মান বাহিনীর বিজয়োদ্ধত আক্রমণের পৈশাচিক বর্ব্বরতার বিরুদ্ধে লাল পণ্টন অটলোন্নত শিরে মানবমুক্তির সংগ্রামক্ষেত্রে দণ্ডায়মান হইল। উত্তর হিমমণ্ডল হইতে কৃষ্ণ সাগর পর্য্যন্ত সুদীর্ঘ রণাঙ্গনে, অন্ধকারের সহিত আলোকের, শৃঙ্খলের সহিত মুক্তির, বর্ব্বরতার সহিত মানবতার মহাযুদ্ধে, সমগ্র জগতের নরনারী বিস্ফারিত নেত্রে দেখিল, সোভিয়েট রাশিয়ায় ষ্ট্যালিন ও তাঁহার সহকর্ম্মীদের রণনৈপুন্য। লাল পণ্টনের আঘাত ও প্রতিঘাত করিবার প্রচণ্ড শক্তি মহাসমরের রক্তাক্ত বহ্নিশিখায় দীপ্যমান হইয়া উঠিল। আজ ক্ষণিক সাফল্যের মরু-মরীচিকায় প্রতারিত হিটলারবাহিনী ধ্বংসের মহাশ্মশানে সমাধি রচনা করিতেছে। রাশিয়ার শৌর্যবীর্য্য, রণনৈপুণ্য এবং সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়। ইংলণ্ড ও আমেরিকার আভিজাত্যগর্ব্বী সম্রাজ্যবাদীরা বর্ত্তমান মহাযুদ্ধে রাশিয়াকেই নেতৃত্বপদে বরণ করিয়াছেন। স্বদেশকে শত্রুকবল হইতে মুক্ত করিবার মৃত্যুপণ সঙ্কল্প আজ সফল হইতে চলিয়াছে। দুর্য্যোগময়ী রজনীর অন্ধকার পট বিদীর্ণ করিয়া উদয়াচলের অরুণচ্ছটায় পূর্ব্ব দিগন্ত উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতে বিলম্ব নাই। কার্ল মার্কসের সহকর্মী কম্যুনিজম্-এর অন্যতম প্রবর্ত্তক এঙ্গেলস্ ১৮৪৫ সালে যে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, এক শতাব্দীর ব্যবধানে হিটলার তাহা মর্ম্মে মর্ম্মে উপলব্ধি করিতেছেন,—“যুদ্ধের সময় কম্যুনিষ্ট সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি প্রকৃত পিতৃভূমি, প্রকৃত স্বদেশ রক্ষা করিবার ভার পাইবে; অতএব সে এমন বীরত্ব, ধৈর্য্য, উৎসাহ ও সাহসের সহিত যুদ্ধ করিবে, যাহার সম্মুখে, যে কোন আধুনিক যন্ত্রবৎ পরিচালিত সৈন্যদশ তূলারাশির মত উড়িয়া যাইবে।” আমরাও দেখিতেছি, দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ হিংস্র পশুর মত কাতারে কাতারে যে সৈন্যদল নাৎসী নরমেধ যজ্ঞে আত্মাহুতি দিতেছে, তাহারা জানেনা যে, এই যুদ্ধের লক্ষ্য কি, উদ্দেশ্য কি? পক্ষান্তরে রাশিয়ার সেনাপতি ও সৈনিক হইতে কৃষক, মজুর, বুদ্ধিজীবি সকলেই জানে যে, তাহাদের এই যুদ্ধ কেবল স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ নহে, পৃথিবীর নিপীড়িত মানবের মুক্তির যুদ্ধ; তাহারা আরও জানে যে দেশে দেশে লক্ষ কোটি নরনারী, তাহাদের বিজয়ের মধ্যেই মানব-ধর্ম্মের চরম বিজয় প্রত্যাশা করিতেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ব্ববৃহৎ যুদ্ধের পরিচালক ষ্ট্যালিন আজ কেবল সোভিয়েট রাশিয়ার নেতা নহেন, স্বাধীনতার যুদ্ধে রত সমগ্র জগতের নেতা।

  1. ষ্ট্যালিন ১৯৩৬-এর ২৫শে নভেম্বর বার্লিনে “এণ্টি কমিনটার্ণ প্যাক্ট” বা আন্তর্জ্জাতিক সাম্যবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের সন্ধির প্রতি ইঙ্গিত করিয়াছেন। ইতালী, জার্ম্মানী ও জাপান এই তিনটি রাষ্ট্র পৃথিবীর সভ্যতাকে বলশেভিক প্লাবন হইতে রক্ষার মহান ব্রত ঘোষণা করিতে লাগিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনীতিক ও সংবাদপত্রগুলি ফাশিষ্ট বংশীধ্বনির তালে তালে ফণা নাচাইয়া সোভিয়েট ব্যবস্থাকে দংশন করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। নাৎসী ফাশিষ্ট প্রচারকার্য্য অভূতপূর্ব্ব সাফল্যলাভ করিল। চেম্বারলেন-গভর্ণমেণ্ট তোষণনীতি অবলম্বন করিয়া, সোভিয়েটের প্রতি প্রকাশ্য বিরাগ দেখাইতে লাগিলেন।

     ঐ চুক্তির পর বার্লিনস্থ জাপ-বাষ্ট্রদূত ভাইকাউণ্ট মুসাকোজী লিখিয়াছিলেন, “মনুষ্য জাতি বলশেভিজম্ দ্বারা যে বিপদের সম্মুখীন হইয়াছে, তাহা বর্ণনা করিবার মত কঠিন ভাষা আমি খুঁজিয়া পাইতেছি না। ইহাদের উদ্দেশ্য হইল প্রচার ও প্ররোচনা দিয়া সর্ব্বত্র অশান্তি সৃষ্টি করা এবং অবশেষে সমস্ত জগতকে তাহাদের নিম্নস্তরে টানিয়া লওয়া। বলশেভিজম্-এর গভীর ষড়যন্ত্রে যে জগতের শান্তি বিপন্ন (!!) তাহা জাপান পূর্ব্ব এশিয়ায় ভাল করিয়াই বুঝিয়াছে এবং পশ্চিমে জার্ম্মান জাতির দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন নেতাও বুঝিয়াছেন। অতএব এই দুই মহান জাতি সাধারণ বিপদ হইতে মনুষ্য জাতিকে রক্ষা করিবার জন্য যে চুক্তিতে আবদ্ধ হইবে ইহা স্বাভাবিক।”
     কাপট্য, ক্রুরতা ও অপভাষণের জন্য অধুনা বিখ্যাত ফন রেবেনট্রপ (হিটলারের কূটনৈতিক পরামর্শদাতা) লিখিয়াছিলেন, “আন্তর্জ্জাতিক কম্যুনিষ্ট সঙ্ঘের বিরুদ্ধে জাপান ও জার্ম্মানের চুক্তি একটা যুগান্তকারী ঘটনা। সংস্কৃতি ও শৃঙ্খলাপ্রিয় জাতিগুলির ধ্বংসমূলক শক্তির বিরুদ্ধে সংঘর্ষের ইহা এক অভিনব অধ্যায়। আমাদের নেতা (হিটলার) এবং জাপ-সম্রাট এই চুক্তি করিয়া এক ঐতিহাসিক কীর্ত্তি অর্জন করিলেন, ভবিষ্যদ্বংশধরেরা ইহার উপযুক্ত মূল্য বুঝিতে পারিবে।
     “দুইটি জাতির সম্মিলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা আন্তর্জ্জাতিক কম্যুনিষ্ট সঙ্ঘের আমাদের দেশে হস্তক্ষেপের প্রত্যেকটি চেষ্টা ব্যর্থ করিবে। জাপান কখনই পূর্ব্ব এশিয়ায় বলশেভিজম্-এর প্রসার হইতে দিবে না। জার্ম্মানী এই সংক্রমক ব্যাধির আক্রমণ হইতে ইউরোপকে রক্ষা করিবার দুর্ভেদ্য বর্ম্ম। এবং দুচে (মুসোলিনী) সমগ্র জগতে ঘোষণা করিয়াছেন যে, ইতালী দক্ষিণে বলশেভিকবিরোধী পতাকা উত্তোলিত রাখিবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে সকল জাতি এখনও বলশেভিজম্-এর বিপদ সম্পর্কে সম্যক সচেতন নহে, তাহারা একদিন আমাদের নেতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিবে; কেননা তিনিই প্রথম পৃথিবীর এই একমাত্র বিপদের প্রতি যথাসময়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। আমাদের এই চুক্তিতে যোগ দিবার জন্য অন্যান্য দেশগুলিকেও সুবিধা দিবার ব্যবস্থা আছে। অন্যান্য সভ্য জাতিগুলিও, আন্তর্জ্জাতিক কম্যুনিষ্ট সঙ্ঘের বিরোধিতার ভিত্তিতে যোগ দিবে আমার এ ভরসা আছে। কেননা, একমাত্র এই উপায়েই আমরা পৃথিবীর শত্রুকে দলন করিতে পারিব এবং দেশবিদেশে শান্তি এবং আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি রক্ষা করিতে পারিব।”