নয়

 বাস্তববাদী ষ্ট্যালিনের চরিত্র ও জীবন নবীন রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের সহিত অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। পর্ব্বত প্রমাণ বাধাকে অতিক্রম করিয়া যে জীবন বহু সাফল্যে মণ্ডিত তাহার সমগ্র চিত্র আজ জগতের সম্মুখে উদ্ঘাটিত; ইহার মধ্যে রহস্যময় বা গোপন কিছু নাই। ঈর্ষা-কাতর শত্রুদের সমস্ত মিথ্যা প্রচার কার্য্য ব্যর্থ করিয়া ষ্ট্যালিন আজ স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁহার বয়স ৬৪ বৎসর অতিক্রম করিয়াছে কিন্তু এখনও তিনি নবীন যুবকের মত উৎসাহী ও নিরলস কর্ম্মা। জনৈক তরুণ সাম্যবাদী বলিয়াছেন, “প্রবীণ বলশেভিকদিগকে আমরা শ্রদ্ধা করিয়া থাকি তাহার কারণ তাঁহারা বয়সে প্রবীণ বলিয়া নহে, বয়স তাঁহাদিগকে বৃদ্ধ করিতে পারে নাই বলিয়া তাঁহারা শ্রদ্ধাভাজন।”

 ১৯১৭ সাল হইতে প্রত্যেক বৎসরে ষ্ট্যালিন যে সকল কাজ স্বীয় অনন্যসাধারণ কর্ম্মশক্তি বলে অবলীলাক্রমে সম্পন্ন করিয়াছেন সমসাময়িক জগতে তাহার দৃষ্টান্ত বিরল; অথচ তিনি সাফল্যের গর্ব্বে কখনও আত্মহারা হন না। কেহ তাঁহার সম্মুখে ঐ সকল প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, “আমরা যাহা করিতে যাইতেছি তাহার তুলনায় ইহা কিছুই নহে।” রুশীয় ভাষায় ষ্ট্যালিন শব্দের অর্থ ‘ইস্পাত’। তাঁহার চরিত্র ইস্পাতের মতই কঠিন এবং সহজ-নমনীয়। তীক্ষ্ণবুদ্ধি, জ্ঞানের গভীরতা, তাঁহার চিন্তাপ্রণালীর আশ্চর্য্য শৃঙ্খলা এবং অগ্রগতির অদম্য স্পৃহা তাঁহাকে কখনও অলস থাকিতে দেয় না। দ্রুত সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার এবং ততোধিক ক্ষিপ্রতার সহিত তাহা কার্য্যে পরিণত করিবার শক্তি তাঁহাকে নেতার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখিয়াছে। মানুষ চিনিতে তাঁহার কখনও ভুল হয় না। বিশাল কম্যুনিষ্ট পার্টির অধিকাংশ সদস্যই তাঁহার স্নুপরিচিত; সহকর্ম্মী ও দলের সাধারণ সদস্যদের মধ্যে তিনি কোন পার্থক্য রাখেন না। দূরে সরিয়া থাকিয়া এক রহস্যময় জীবনের মোহজাল দ্বারা জনমণ্ডলীকে আচ্ছন্ন করিবার মত ডিক্টেটরী মনোবৃত্তি তাঁহার কোন কালে ছিল না। রাশিয়ার আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই তিনি সকলের সহিত মিলিয়া মিশিয়া অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন।

 লেনিন ও ষ্ট্যালিন এই দুইটী নাম রাশিয়ার বিপ্লব ও পুনর্গঠনের ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য। এই দুই ইতিহাস-স্মরণীয় চরিত্রের তুলনামূলক বিচার আমরা করিব না। কিন্তু ইতিহাস পথে আমরা দেখিয়াছি এই দুই চরিত্রে পার্থক্য থাকিলেও সাদৃশ্যও প্রচুর, মার্কসবাদ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং বাস্তববাদীর দৃষ্টিভঙ্গী ও অদম্য দৃঢ়তায় উভয়েই সমান, পার্থক্য এই যে, লেনিন জননায়ক, ষ্ট্যালিন ঘটনাবলীর নিয়ামক; লেনিন মহান, ষ্ট্যালিন শক্তিমান। বলিলে আরও বলা যায় যে লেনিনের জীবন মতবাদ প্রচারেই অতিবাহিত হইয়াছে, নূতন বিধি ব্যবস্থাকে পরিচালন করিবার অবসর তিনি পান নাই। তাঁহার পর ষ্ট্যালিন কম্যুনিষ্ট পার্টিকে অধিকতর সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া বৈপ্লবিক ও গঠনমূলক কার্য্য যুগপৎ পরিচালনা করিয়াছেন। ক্রমে ষ্ট্যালিনের মধ্যেও পরিবর্ত্তন আমরা দেখিয়াছি। সঙ্কটের মুহূর্ত্তে তিনি ধৈর্য্যের সহিত সময়ের অপেক্ষা করিয়াছেন, প্রয়োজনের মুহূর্ত্তে দ্রুতপদ বিক্ষেপকে সংযত করিয়াছেন। অনেক সময় তাঁহার ধৈর্য্যে উৎসাহী সদস্যদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিয়াছে কিন্তু পরে তাঁহারা ষ্ট্যালিনের দূরদর্শিতার প্রশংসা করিয়াছেন, শিল্প ও কৃষি ব্যবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক ভত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করিবার উদ্যম ও প্রচেষ্টায় প্রতিপদক্ষেপে ষ্ট্যালিন গভীর ভাবে চিন্তা করিয়াছেন, সকল দিক তুলমূল করিয়া বিচার করিয়াছেন। সহজ বিশ্বাসীর লঘু উৎসাহ লইয়া তিনি কখনও মাতিয়া উঠিতেন না। একদিন কথাপ্রসঙ্গে তিনি তাঁহার কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলিয়াছিলেন, “সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া কাজ করিবার পক্ষে কিছু পরিমাণে যুক্তি সঙ্গত অবিশ্বাস মনে থাকা ভাল!” সিংহ যেমন সকল দিক পর্যবেক্ষণ করিয়া অবশেষে অব্যর্থ সন্ধানে শিকারের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে, ষ্ট্যালিনের চরিত্রে আমরা সেইরূপ সাবধানতার সহিত সমগ্র বল প্রয়োগ করিবার কৌশল দেখিতে পাই।

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি ষ্ট্যালিন অতি সাধারণ জীবন যাপন করিয়া থাকেন। আলাপ আলোচনায় তিনি সদালাপী, পরিহাস রসিক। কোন বিষয় আলোচনা কালে তিনি যখন মাতিয়া উঠেন অথবা কোন ভ্রান্ত যুক্তি খণ্ডন করেন তখন তাঁহার বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্যে প্রত্যেকটি কথা শাণিত তরবারির মত ঝলসিয়া উঠে। তবে তাঁহার সাক্ষাৎ পাওয়া কঠিন।

 ভূতপূর্ধ্ব রুশ সম্রাটগণের বিরাট প্রাসাদ ক্রেমলিনের খ্যাতি জগৎবিশ্রুত। কত সুসজ্জিত হর্ম্ম্য কত মনোহর গির্জায় এই রাজপ্রাসাদ সুশোভিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী রুশ সম্রাটগণের ঐশ্বর্য্য এই প্রাসাদকে সৃষ্টি করিয়াছে। এই প্রাসাদে জারের ভৃত্যগণের জন্য নির্ম্মিত ভবনে একটী সামান্য অংশে সমগ্র রাশিয়ার রাষ্ট্রগুরু ষ্ট্যালিন বাস করেন। দোতলায় তিনটী ঘর, জানালায় অতি সাধারণ শাদা পর্দ্দা; আসবাব পত্রের কোন বাহুল্য নাই। ইহারই একটী ঘরে ডিম্বাক্বতি একটী ছোট টেবিলে, ষ্ট্যালিন আহার করেন। একজন পরিচারিকা নিকটস্থ একটী সাধারণ হোটেল হইতে তাঁহার খাদ্য আনিয়া দেয়। ক্রেমলিনে যাঁহারা তাঁহার সহিত দেখা করিতে গিয়াছেন তাঁহারা কখনও সিড়িতে বা ঘরে তিন চারি জনের বেশী লোক দেখিতে পান নাই। তাঁহার এই সরল জীবনের মধ্যে ফাশিষ্ট-সুলভ কোন অভিনেতার ভাব নাই। জার্ম্মানীর ডিক্টেটর হিটলারের নিরামিষ আহার এবং তিনি ধূমপান ও মদ্যপান করেন না বলিয়া ঢক্কানিনাদে যে প্রচার কার্য করা হয়, ষ্ট্যালিনের অনুরক্তগণ কখনও সেরূপ প্রচার কার্য্য করেন না। তাঁহার লয়েড জর্জের মত ৩২ জন সেক্রেটারী নাই। কমরেড প্রোস‍্ক্রো বিশেফ্ একাই তাঁহার সেক্রেটারীর কাজ করেন। ষ্ট্যালিন কখনও অপরের লেখায় স্বাক্ষর করেন না। অপরের সংগৃহীত উপাদান লইয়া নিজেই স্বহস্তে সমস্তই রচনা করেন। সকল পত্র এবং সরকারী কাগজ তিনি নিজে পড়েন এবং স্বহস্তে উত্তর দেন। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর তিনি কিয়ৎকাল ধূমপান সংবাদপত্র পাঠ এবং অভ্যাগতদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করেন। তাঁহার ভোজন কক্ষ রাত্রে পুত্র কন্যার শয়ন কক্ষে রূপান্তরিত হয়। আমাদের দেশের অতি সাধারণ কর্মচারীও ষ্ট্যালিন অপেক্ষা অধিকতর আরাম আয়েসে থাকে। ষ্ট্যালিনের বিবিধ প্রকার ফটোগ্রাফে যে পোষাক দেখা যায় তিনি সব সময়েই ঐ পোষাক পরিধান করিয়া থাকেন। উহা দেখিতে সামরিক পরিচ্ছদের মত হইলেও আসলে উহা রাশিয়ার শ্রমিকদের সাধারণ পোষাক। তাঁহার মুখে সর্ব্বদাই হাসি লাগিয়া আছে এবং এই বয়সেও তিনি বালকের ন্যায় উচ্চহা্স্য করেন।

 বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক গোর্কীর জুবিলী উৎসবে মস্কোর প্রাচীন গ্রাণ্ড অপেরা হাউস জনপূর্ণ; নৃত্য, গীত, অভিনয় চলিতেছে। বিরতির সময় ভূতপূর্ব্ব সম্রাট পরিবারের নির্দ্দিষ্ট আসনের সন্নিকটস্থ একটী কক্ষে রাশিয়ার বড় বড় সরকারী কর্মচারীরা একত্র হইয়াছেন। তুমুল কোলাহল ও বিপুল হাস্যধ্বনিতে কক্ষ পরিপূর্ণ। অন্যান্য অনেকের সহিত সেখানে আছেন ষ্ট্যালিন, অরজোনেকিজ, রয়কফ, লুডনফ, মলোটভ, ভরোশিলভ, কেগানোভিচ এবং পিয়াটিন্‌স্কি। ইহারা গৃহযুদ্ধের স্মৃতিকথা ও ছোট ছোট কাহিনী লইয়া কৌতুকে প্রমত্ত ছিলেন। একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি যে ঘোড়া হইতে পড়িয়া গিয়াছিলে সে কথা মনে আছে?’...‘তুমি সেই নোংরা পশুটার কথা বলিতেছ? ওটা যে আমাকে কেন ফেলিয়া দিয়াছিল এখন পর্যন্ত আমি জানি না’...ইত্যাদি বলিতে বলিতে ষ্ট্যালিনের উচ্চহাস্য যৌবনের আবেগে উছলিত হইয়া উঠিল। আনন্দহীন কঠোর কর্ম্মজীবনের মধ্যে ক্ষণিক অবসরে বন্ধু সমাগমে ষ্ট্যালিন আনন্দে উচ্ছ্বসিত। একদিন যাহা ছিল ভয়ঙ্কর জীবন মরণ সমস্যা আজ সেই অতীত লইয়া তিনি অনায়াসে হাস্য পরিহাস করিলেন। লেনিনও এমনি উচ্চহাস্য করিতে পারিতেন। গোর্কী লিখিয়াছেন, “ভ্লাডিমির ঈলিচ (লেনিন) হাস্যকে সংক্রামক করিয়া তুলিতে পারে, এমন লোক আমি আর দেখি নাই। ইহা আশ্চর্য্য, কেননা যে অতি কঠোর বাস্তববাদী, যে মানুষ বৃহৎ সামাজিক বিয়োগাস্ত দুর্ঘটনাগুলি প্রত্যক্ষ ভাবে দেখিয়াছে এবং গভীর ভাবে অনুভব করিয়াছে, ধনতান্ত্রিক জগতের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণায় যে মানুষের চিত্ত ভরপুর, সেই মানুষ এমন করিয়া হাসিতে পারে, হাসিতে হাসিতে তাঁহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসে ইহা সত্যই অদ্ভুত।” এবং গোর্কী উপসংহারে বলিয়াছেন, “পরিপূর্ণ ও সবল মানসিক স্বাস্থ্য না থাকিলে এমন করিয়া মানুষ হাসিতে পারে না।”

 যে শিশুর মত হাসিতে পারে, সে শিশুবৎসল ও সন্তানবৎসল না হইয়া পারে না। ষ্ট্যালিন তিনটি সন্তানের জনক। তাঁহার পত্নী নাদেজা এল‍্লিলুইভার মৃত্যুর পর (১৯৩২) তিনি স্বয়ং সন্তানদিগকে লালনপালন করিয়া থাকেন। এতদ্ব্যতীত ১৯২১ সালে এক দুর্ঘটনায় মৃত জনৈক শ্রমিকের পুত্র আর্টিয়ম শেরগুয়েফ তাঁহার গৃহে পুত্রবং প্রতিপালিত হইতেছে। ইহা ছাড়া বাকুতে বৃটিশ সৈন্যের গুলিতে নিহত জনৈক শ্রমিকের দুই কন্যাকেও তিনি পিতৃস্নেহ দিয়া লালনপালন করিতেছেন। আরও বহু বালক বালিকা তাঁহার স্নেহ ও আদর-যত্ন পাইয়া থাকে, বালকদের প্রতি তাঁহার অনুরাগের একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করিতেছি। আর্ণল্ড ক্যাপ‍্লিন ও বোরিস গোল্ডষ্টিন নামক দুইটি বালক যথাক্রমে পিয়ানো ও বেহালা বাজনায় খ্যাতিমান হইয়া উঠিয়াছিল। একদিন ষ্ট্যালিন তাহাদের বাদননৈপুণ্য দেখিয়া মুগ্ধ হন এবং প্রত্যেককে তিন হাজার রুবল মুদ্রা পুরস্কার প্রদান করিয়া বলেন, “এখন তোমরা ক্যাপিট্যালিষ্ট হইয়া পড়িলে, আমাকে কি রাস্তায় দেখিয়া চিনিতে পারিবে?” এইরূপ রসিকতার একটি গল্প ডামিয়াম বিভ‍্ন বলিয়াছেন; “১৯১৭ সালের জুলাই মাসে আমি ও ষ্ট্যালিন প্রাভ‍্দা সংবাদপত্র সম্পাদন কার্য্যে ব্যাপৃত আছি, এমন সময় টেলিফোনের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। ক্রোন‍্সটাড নাবিকেরা ষ্ট্যালিনকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আজিকার মিছিলে কি আমরা রাইফেল হাতে করিয়া যাইব?’ আমি উত্তর শুনিবার জন্য কৌতূহলী হইলাম। ষ্ট্যালিন বলিলেন, ‘রাইফেল? তোমরা যাহা ভাল বোঝ তাহাই করিবে। আমরা লেখক, আমাদের সঙ্গে সর্ব্বদাই পেন্সিল থাকে।’ মিছিলে দেখিলাম যে নাবিকেরা সকলেই পকেটে পেন্সিল লইয়া আসিয়াছে।”

 সে. যাহা হউক, প্রয়োজনমত তিনি ধীর ও শান্ত হইয়াও পড়েন। যখন বিখ্যাত লেখক এমিল্ লুডউইক তাঁহার মন্তব্য শুনিয়া বলিয়াছিলেন, “আপনি যে কত সঙ্গত কথা বলিলেন, সে সম্বন্ধে আপনার কোন ধারণা নাই।” ষ্ট্যালিন সহজ স্বরে বলিলেন, “কে জানে! সম্ভবতঃ আমার মন্তব্য সঙ্গত নহে।” আবার যখন উক্ত লেখক তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি মনে করেন যে, আপনাকে পিটার দি গ্রেটের সহিত তুলনা করা যায়?” তখন ষ্ট্যালিন অবিচলিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “ঐতিহাসিক তুলনামূলক বিচার সব সময়ই বিপজ্জনক কিন্তু আপনার তুলনাটি একেবারেই ভিত্তিহীন।” এখানে দেখা গেল উচ্চহাস্য করিবার সুযোগ পাইয়াও ষ্ট্যালিন গম্ভীর। তাঁহার চরিত্রের এক বিশেষ বিশেষত্ব এই যে, তিনি কখনও নিজেকে প্রকাশ করিবার চেষ্টা করেন না এবং সর্ব্বদাই সংযত হইয়া সাধারণভাবে থাকিবার চেষ্টা করেন।

 ষ্ট্যালিন বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। তাঁহার কয়েকখানি পুস্তক মার্কসীয় সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করিয়াছে, অথচ তাঁহার রচনাভঙ্গী অন্যান্য রাশিয়ান বিপ্লবীদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা হইতে পৃথক। অন্যান্য খ্যাতনামা লেখকগণ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস উত্তমরূপে যে পাঠ করিয়াছেন তাহা তাঁহাদের রচনা হইতেই বুঝা যায়। মার্কস্ হইতে আরম্ভ করিয়া বহু সমাজতন্ত্রীর উদ্ধৃত বচনে তাঁহাদের রচনা কণ্টকিত। ফরাসী বিপ্লব হইতে শ্রমিক বিপ্লব পর্য্যন্ত বহু বিপ্লবের ঐতিহাসিক ঘটনা তাঁহাদের রচনার প্রধান উপাদান। কিন্তু ষ্ট্যালিনের রচনার মধ্যে ঐ শ্রেণীর উদ্ধৃত বাক্য নাই বলিলেই হয়। যদি স্বীয় মত সমর্থনকল্পে কোন লেখকের মত তিনি উদ্ধৃত করিয়া থাকেন তবে লেনিন ব্যতীত আর কাহারও মত নহে এবং জিজ্ঞাসিত হইয়া বহুবার তিনি উত্তর দিয়াছেন, “আমি লেনিনের একজন শিষ্য মাত্র এবং আমার জীবনের একমাত্র দুরাশা যে আমি তাঁহার বিশ্বস্ত শিষ্য থাকিব।”

 শিষ্য শব্দটি আমাদের দেশে যে অর্থে প্রযুক্ত হয় ষ্ট্যালিন অবশ্যই সে অর্থে শিষা শব্দ ব্যবহার করেন নাই। বুদ্ধি বিবেচনা বিবেক সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করিয়া অন্ধভাবে অনুগমন করিবার মত লঘুচিত্ত ব্যক্তি ষ্ট্যালিন নহেন। একই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত দুইটি মানুষের জীবন একই কর্ম্মধারার অনুসরণ করিয়াছে। বিশ্বাস জ্ঞানের উপর, বিশ্বাস চরম সামাজিক সুবিচারের উপর, বিশ্বাস সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর, বিশ্বাস জনসাধারণের সৃজনীশক্তির উপর—যে বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হইয়া একদিন লেনিন বলিয়াছিলেন, “আমরা আমাদের কম্যুনিষ্ট পার্টির উপর নির্ভর করিব।” ইহার মধ্যে আমরা দেখিতেছি, কর্ম্মের প্রেরণা, মানুষের মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা ও ধ্রুব বিশ্বাস। ঠিক অনুরূপ বিশ্বাসের সহিতই ষ্ট্যালিন বলিয়াছেন, “শুধু মাত্র ইচ্ছা করিলেই কম্যুনিষ্ট পার্টির অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায় না, কেননা প্রত্যেকেই পরিশ্রম এবং তাহার সমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করিতে পারে না।”

 জনসাধারণের উপর ষ্ট্যালিনের বিশ্বাসই জনসাধারণকে অনুরূপ বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত করিয়াছে। রাশিয়ার নূতন কলকারখানার মধ্য দিয়া এই বিশ্বাসের উৎসাহ ও আনন্দ নবসৃষ্টিকে প্রাচুর্য্যে ভরিয়া তুলিতেছে। রাশিয়ার বিপ্লবকে এবং সাম্যবাদী সমাজকে ষ্ট্যালিন অতীতে যেভাবে রক্ষা করিয়াছেন, ভবিষ্যতেও তিনি তাহাই করিবেন কেননা তিনি বিশ্বাস করেন, “মহামানবরা যখন ইতিহাসের গতি নিয়ন্ত্রন করিতেন সে যুগ চিরদিনের জন্য শেষ হইয়াছে।”

 ষ্ট্যালিনের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আমরা অতি অল্পই আলোচনা করিয়াছি। যিনি যৌবনে বিপ্লবী হইয়া কারাগারে নির্ব্বাসনে এবং গুপ্তভাবে থাকিয়া অশ্রান্ত অশান্ত জীবন যাপন করিয়াছেন তাঁহার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আমরা অতি অল্পই জানি। নরনারীর প্রেম সম্পর্কিত ব্যাপারে অতি কৌতূহলী ইউরোপীয় লেখকগণ বহু রহস্যময় ও রোমাঞ্চকর কাহিনীর দ্বারা ষ্ট্যালিনের জীবনের ফাঁকগুলি ভরিয়া দিয়াছেন। যৌবনে ষ্ট্যালিন প্রথম বিবাহ করিয়াছিলেন কিন্তু সে বিবাহিত জীবনের সুখশান্তি তিনি ভোগ করিতে পারেন নাই। যখন ষ্ট্যালিন উত্তর মেরু সাগরের তীরে নির্ব্বাসনে দিন কাটাইতেছিলেন, যখন রুশ বিপ্লবের আলোড়ন মাত্র শুরু হইয়াছে ঠিক সেই সময় ১৯১৭ সালে তাঁহার প্রথমা পত্নীর মৃত্যু হয়। এই দুর্ভাগা নারী বিবাহিত জীবনের কোন সুখ স্বাচ্ছন্দ্যই পান নাই। তাঁহার স্বামী পুলিশ ও গোয়েন্দার সতর্ক দৃষ্টি এড়াইবার জন্য কখনও অধিক দিন এক স্থানে থাকিতেন না। কখনও বা দলের নির্দ্দেশে তাঁহাকে দীর্ঘকাল আত্মগোপন করিয়া থাকিতে হইত। নির্ব্বাসনে চারি বৎসর ষ্ট্যালিন তাঁহার পত্নীর কোন সংবাদ পান নাই। অবশেষে একদিন জার গভর্ণমেণ্টের অনুগ্রহে ষ্ট্যালিন তারযোগে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ পাইলেন যে তাঁহার পত্নীর মৃত্যু হইয়াছে। এই সংবাদে বিপ্লবী ষ্ট্যালিনের চিত্তে কিরূপ প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হইয়াছিল তাহা তিনি কখনও খুলিয়া বলেন নাই। চারি বৎসর নিঃসঙ্গ একক নির্ব্বাসিত জীবন যাপনের পর এরূপ মর্মান্তিক দুঃসংবাদ মানুষের চিত্তে কি বিমর্ষ ভাবাবেগ উদ্বেলিত করে তাহা আমরা অনুমান করিতে পারি মাত্র।

 ১৯১৭-র বসন্তকালে বিপ্লব আরম্ভ হইবামাত্র ষ্ট্যালিন নির্ব্বাসন হইতে পলায়ন করিয়া সেণ্টপিটার্সবার্গে উপস্থিত হইলেন এবং সাম্যবাদী দলের বিশ্বস্ত সদস্য কারখানার মিস্ত্রি এলিউলেভের গৃহে আশ্রয় লইলেন। তিনি প্রভাতে বাহির হইয়া যাইতেন এবং গভীর রাত্রে ফিরিতেন। ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়া সাফল্য লাভ করিল। অক্টোবর মাসে বিজয়ী সাম্যবাদী দল রাষ্ট্রের শক্তি করায়ত্ত করিল। তখনও ষ্ট্যালিন দরিদ্র শ্রমজীবির কুটীরেই রহিয়া গেলেন। অথচ তখন তিনি বিপ্লবী গভর্ণমেণ্টের শাসন পরিষদের সদস্য। ষ্ট্যালিনের বয়স তখন ৩৮ বৎসর। এই সময়ে একদিন দেখা গেল যে শ্রমজীবি এলিউলেভের অষ্টাদশ বর্ষীয়া কন্যা নাদিজা এলিলুভলার সহিত ষ্ট্যালিন বিবাহ-রেজিষ্ট্রারের অফিসে উপস্থিত হইলেন এবং সোভিয়েট আইনানুসারে উভয়ের বিবাহ বিধিবদ্ধ করিলেন। বিবাহের পর ষ্ট্যালিনপত্নীকে আর বাহিরের কাজ-কর্ম্মে দেখা গেল না। কোন ভোজ বা উৎসবে ষ্ট্যালিনের পার্শ্বে মাঝে মাঝে তাঁহার পরমা সুন্দরী পত্নীকে দেখা যাইত। অনেকে ষ্ট্যালিনের বিবাহের বিষয় জানিতই না।

 ষ্ট্যালিনেব বিবাহিত জীবন সুখী হইয়াছিল। বিবাহের পর তৃতীয় বর্ষে তাঁহাদের পুত্র জন্মগ্রহণ করে এবং তাহার পাঁচ বৎসর পরে ষ্ট্যালিন একটী কন্যা লাভ করেন। ইহার পর ষ্ট্যালিনপত্নী সাধারণে আত্মপ্রকাশ করিলেন। গুজব রটিল যে যেভাবে মলোটভ পত্নী রুশিয়ার প্রধানতম গন্ধদ্রব্য প্রস্তুতের কারখানার প্রধানা পরিচালিকা হইয়াছেন, ষ্ট্যালিনপত্নীও সেইরূপ কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ শীঘ্রই গ্রহণ করিবেন। ১৯২৯ সালে মিসেস্ ষ্ট্যালিন এক রসায়নাগারে ছাত্রীরূপে যোগ দিলেন এবং ক্বত্রিম রেশম প্রস্তুত বিদ্যা শিক্ষা করিতে লাগিলেন। সকলে জানিত যে তিনিই ষ্ট্যালিন-পত্নী। তিন বৎসর তিনি নিয়মিতরূপে ক্লাসে যোগ দিয়া বক্তৃতা শুনিছেন। কি অধ্যাপকগণ, কি মিসেস্ ষ্ট্যালিন উভয় পক্ষই কোন বিশেষ সুবিধা দেওয়া বা নেওয়ার বিরোধী ছিলেন। অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সহিত তাঁহার কোন পার্থক্য ছিলনা। একই প্রকার ধূসর বর্ণের পরিচ্ছদ পরিয়া তিনি অন্যান্যের সহিত মিলিত হইয়া কলে শ্রমিকের কাজ করিতেন এবং একই বেঞ্চে বসিয়া ছাত্রদের সহিত অধ্যাপকদের বক্তৃতা শুনিতেন।

 ১৯৩২ সালের ৮ই নভেম্বর সংবাদ প্রচারিত হইল যে মিসেস্ ষ্ট্যালিন মৃত। তাঁহার বয়স মাত্র ৩৮ বৎসর হইয়াছিল এবং ইতিপূর্ব্বে তাঁহার কোন রোগের সংবাদ প্রচারিত হয় নাই। রাশিয়ার বাহিরে ইউরোপের সোভিয়েট বিদ্বেষীরা এই সংবাদ লইয়া মাতিয়া উঠিল এবং আজগুবি কাহিনী প্রচার করিয়া এই মৃত্যুকে হত্যা বা আত্মহত্যার সামিল করিয়া তুলিল। বিবাহিত জীবনে ষ্ট্যালিনপত্নী সুখী ছিলেন না, বহুবর্ষ ধরিয়া তিনি অত্যাচার সহ্য করিয়াছেন এবং অবশেষে গভীর নৈরাশ্যে আত্মহত্যা করিয়াছেন ইত্যাদি। কিন্তু এই সকল কুৎসা রটনাকারী যুক্তি বা প্রমাণের কোন ধার ধারে না। কার্যতঃ ষ্ট্যালিনপত্নী বিবাহিত জীবনের প্রথম ১০ বৎসর গৃহকর্ম্ম লইয়া ব্যাপৃত ছিলেন এবং তাঁহার পুত্র কন্যারা বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্য্যন্ত তিনি বাহিরের কোন কাজে যোগ দিতেন না। ষ্ট্যালিনের সহকর্ম্মীরা জানেন যে ষ্ট্যালিন সময় পাইলেই তাঁহাদের সহরতলীর ক্ষুদ্র বাড়ীতে গিয়া পত্নীর সহিত মিলিত হইতেন। ষ্ট্যালিনপত্নী মৃদু স্বভাবা এবং নিরভিমানী ছিলেন। স্বামী ও সন্তানসন্ততিগণের সেবাই ছিল তাঁহার আনন্দ। তিনি কখনও নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা বলিয়া স্বামীকে বিব্রত করিতেন না। কথিত আছে যে তিনি জটিল স্ত্রীরোগে ভুগিতেছিলেন এবং সে কথা দীর্ঘকাল স্বামীর নিকট গোপন রাখিয়াছিলেন এবং অবশেষে রোগ যখন ধরা পড়িল তখন চিকিৎসকেরা আসিয়া দেখিলেন, চিকিৎসার সময় অতীত হইয়াছে। পত্নীর মৃত্যুর পর বোঝা গেল যে ষ্ট্যালিন তাঁহার জীবন-সঙ্গিনীকে কত গভীর ভাবে ভালবাসিতেন। আধুনিক রাশিয়ায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কোন আড়ম্বর হয় না। সাধারণতঃ আত্মীয় স্বজনের মৃতদেহ শ্মশানে চিতা-চুল্লিতে ভস্ম করা হয়। কেবল প্রাচীন পন্থীরাই খৃষ্টানী মতে শোভাযাত্রা করিয়া শব সমাধিস্থ করিয়া থাকেন। কিন্তু ষ্ট্যালিন তাঁহার স্ত্রীর মৃত দেহ শ্মশানে দাহ করিবার জন্য পাঠাইলেন না। এক প্রাচীন মঠে তিনি পত্নীর মৃতদেহ সমাধিস্থ করিলেন। অতি সাধারণ সমাধির উপর পুষ্পস্তবক ছাড়া দর্শকগণ আর কিছুই দেখিতে পান না।

 ষ্ট্যালিন বাস্তববাদী। তিনি যখন রাষ্ট্রীয় কোন গুরুতর ব্যাপারে কোন বক্তৃতা বা বিবৃতি দান করেন তখন ফেনায়িত ভাষা ব্যবহার করেন না, অত্যুক্তি বর্জ্জিত সত্য কথাই কহেন। নূতন শাসনতন্ত্রানুযায়ী প্রথম নির্ব্বাচনের প্রাক্কালে মস্কৌর এক বৃহৎ নাট্যশালায় ষ্ট্যালিন বক্ততা করেন। তিনি স্বয়ং নির্ব্বাচন প্রার্থী ছিলেন। বিশাল জনতার মধ্যে ষ্ট্যালিন যখন বক্তৃতা করিবার জন্য দণ্ডায়মান হইলেন তখন মুহুর্মূহু জয়ধ্বনিতে প্রেক্ষাগৃহ মুখরিত হইয়া উঠিল। ষ্ট্যালিন জলদ-গম্ভীর স্বরে ঘোষণা করিলেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে কোন গণতন্ত্রী দেশে এমন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে ভোটদাতাদের ভোট দিবার অধিকার দেওয়া হয় নাই। ইতিহাসে এই দৃষ্টান্তের তুলনা নাই। ভোটদাতারা গোপনে ভোট দিবেন, নিরপেক্ষ ভাবে স্বাধীন চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করিবেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে অবাধে স্বীয় মনোমত ব্যক্তিকে ভোট দিবেন ইহাই বড় কথা নহে, আসল কথা হইল যে এই সার্ব্বজনীন ভোটাধিকার নির্ব্বাচন কেন্দ্রে কোন প্রকার অনুরোধ উপরোধ বা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা দ্বারা খর্ব্ব হইবে না। গণতন্ত্রের এরূপ চরম অধিকার এ পর্য্যস্ত কোন দেশই দিতে পারে নাই।” ষ্ট্যালিনের বলিবার ভঙ্গী এইরূপ সরল ও স্পষ্ট। তিনি নিজের জন্য কোন আবেদন না করিয়া সোভিয়েট শাসনতন্ত্রের প্রশংসা করিলেন। তিনি জানেন কি ভাবে জনসাধারণকে উৎসাহে অনুপ্রাণিত করিতে হয় কিন্তু শুধুমাত্র ভাবাবেগের উপর তাঁহার কোন আস্থা নাই। তিনি মানুষকে উত্তেজিত করিবার পরিবর্ত্তে যুক্তির দ্বারা তাহার শুভবুদ্ধি উদ্বোধন করিবার চেষ্টা করিয়া থাকেন।

 অতীত ও ভবিষ্যৎ জগতের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া এই অনন্যসাধারণ প্রতিভাশালী পুরুষ একটা নূতন জাতি ও নূতন সমাজ ব্যবস্থা তাঁহার সহকর্ম্মীদের সহিত নিয়ন্ত্রণ করিতেছেন। এই নিয়ন্ত্রণের অর্থ নূতন কিছু সৃষ্টি নহে, গতিশীল মনুষ্য সমাজের অন্তর্নিহিত প্রয়োজনকে আবিষ্কার। যাঁহারা এইটী বুঝেন না তাঁহারা ফ্যাশিষ্ট আদর্শের সহিত সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পার্থক্য কোন কালেই বুঝিবেন না এবং এই কারণেই ষ্ট্যালিন ও নবীন রাশিয়া তাঁহাদের নিকট বিস্ময় ও বিদ্বেষের বস্তু।

 ষ্ট্যালিনকে ক্ষুদ্র ও খর্ব্ব করিয়া দেখিবার দেখাইবার বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ষ্ট্যালিন আজ লক্ষ কোটি নরনারীর হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনে উপবিষ্ট। আমরা বহু দূরবর্ত্তী দেশের লোক হইলেও অপরিচয়ের ব্যবধান থাকিলেও তাঁহার চরিত্র ও জীবন আলোচনা করিলাম এবং এই আলোচনায় যথাসাধ্য নিরপেক্ষ দৃষ্টি লইয়াই অগ্রসর হইয়াছি। অতি সাধারণ পরিবার হইতে যে কৃষক যুবক একদিন সর্ব্বমানবের মুক্তি কামনায় অধীর হইয়া গৃহ পরিজন ত্যাগ করিয়াছিল, কে জানিত যে এক বিশাল দেশের বিপুল জন সমষ্টির নেতা, গুরু ও পথপ্রদর্শকরূপে তিনি সমসাময়িক ইতিহাসে এমন চিরস্মরণীয় কীর্ত্তি স্থাপন করিবেন। ইতিহাসে কেবল ঘটনাই ঘটে না, অঘটন ঘটে এবং সেই অঘটন আবার এক রূপান্তরিত নবীন ঘটনাপুঞ্জের মধ্য দিয়া অগ্রসর হয়। ইতিহাসের সেই পরম রহস্যময় গতিকে যাহারা বুঝিতে পারেন এবং তাহাকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারেন ষ্ট্যালিন তাঁহাদেরই অন্যতম। তাই দেশ কালের ব্যবধান অতিক্রম করিয়াও এই নরকেশরীর চরিত্র আজ সমগ্র সভ্য জগতের আলোচনার বিষয়। আধুনিক জড়বিজ্ঞান ও যন্ত্রের বিকৃত প্রয়োগে পীড়িত পৃথিবীকে বন্ধন ও দাসত্ব মোচনের পথ প্রদর্শকরূপে লেনিনের সহিত ষ্ট্যালিনের নামও চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে তাহাতে সন্দেহ নাই।