(পৃ. ১১-১৫)
  ►


 ভৃগু-প্রজাপতির গৃহে মহাযজ্ঞ—অঙ্গিরা, মরীচি প্রভৃতি দেবর্ষিগণ মন্ত্রপাঠ করিতেছেন। রাত্রিকালে চন্দ্র ও দিবসে সুর্য্য পর্য্যায়-ক্রমে দ্বারদর্শীদ পদ গ্রহণ করিয়াছেন। দেবসভায় বিষ্ণু মাল্য-চন্দন পাইয়া যজ্ঞের কার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিতেছেন, এবং দেবরাজ ইন্দ্র কর্ম্মকর্তৃরূপে অভ্যাগতদিগকে আদরে আপ্যায়িত করিতেছেন। স্বয়ং ব্রহ্মা সপ্তর্ষিমণ্ডল ও বৃহস্পতির সঙ্গে শাস্ত্র-বিচার জুড়িয়া দিয়াছেন; ঊনকোটি তাহার হস্তে আলো রক্ষার ব্যবস্থা হইয়াছে। তাঁহারা বিশেষ করিয়া রন্ধনশালা পর্য্যবেক্ষণ করিতেছেন, বরুণ ভৃঙ্গারহস্তে নবাগত দেবগণের পদ-প্রক্ষালন করিতেছেন। কপিলাগাভী অজস্রধারায় দুগ্ধ প্রদান করিতেছে এবং বিষ্ণুদূতগণ সেই দুগ্ধ হইতে সদ্যঃ হব্য প্রস্তুত করিতেছে। সেই হব্যে পুষ্ট হইয়া হোমাগ্নি জ্বলিতেছে।

 যমরাজের সঙ্গে অশ্বিনী-কুমারদ্বয় আয়ুর্ব্বেদ সম্বন্ধে তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন। যমরাজ মাণিক্য-মণ্ডিত একটা নস্যাধার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া অনেক কথা শুনিয়া দুই একটি উত্তর দিতেছেন। তাঁহার রথবাহক স্বর্ণ-শৃঙ্গ কৃষ্ণকায় মহিমপ্রবর ব্রহ্মার অঙ্গের রক্তজ্যোতিঃ দেখিয়া ক্রোধে রোমাঞ্চিত হইতেছে। শূলপাণি সভার একটু দূরে ঊর্দ্ধনেত্র হইয়া বসিয়া আছেন—যেন প্রশান্ত রজতগিরি। সেই শ্বেতকান্তি সৌম্যমূর্ত্তি বেষ্টন করিয়া যে রক্তচক্ষু সর্পরাজ চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছিল, সহসা সে বিষ্ণুরথবাহী গরুড়কে দেখিয়া ভয়ে মহাদেবের সিদ্ধির থলিয়ার ভিতর মাথাটা গুঁজিয়া দিতেছে। মহাদেবের পার্শ্বে বৃষভবর অর্দ্ধনিমীলিত-চক্ষে স্বীয় প্রভুকে দর্শন করিতেছে। বৃষের মূর্ত্তি কতকটা শিবের ন্যায়ই শান্ত।

 রন্ধনশালায় মূর্ত্তিমতী শ্রী। শত শত অম্লমেরু; ঘৃত, মধু, দুগ্ধ, দধির সরোবর। “ভূজ্যতাং দীয়তাং” শব্দ আকাশ ভেদ করিয়া উঠিয়াছে। যজ্ঞশালা স্রুক্‌, স্রুব, দণ্ডাদির সংঘট্ট-শব্দ এবং অগ্নিহোত্রী ও ঋত্বীক্‌গণের মন্ত্রপাঠে মুখরিত। সমিধ্‌ ও কুশ শকটে শকটে আহৃত হইতেছে। অষ্টবসু বস্ত্র ও ধন দান করিয়া তিলমাত্র অবসর পাইতেছেন না।

 দেব-যজ্ঞ এই ভাবে নির্ব্বাহিত হইতেছে। এমন সময়ে ব্রহ্মার জ্যেষ্ঠ পুত্র দক্ষ প্রজাপতি সেই সভাগৃহে উপস্থিত হইলেন।

 দক্ষ দাম্ভিক-প্রকৃতি, উন্নত-তেজপুঞ্জ বপুঃ। ব্রহ্মার আদরে তিনি জগৎকে নগণ্য মনে করেন। দেবগণের অতিমাত্র বশ্যতা ও নম্র ব্যবহারে তাঁহার দাম্ভিকতা বিশেষরূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে। তিনি গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র দৌহিত্র সুর্য্য ও ইন্দ্র, এবং জামাতা ধর্ম্ম, অগ্নি, চন্দ্র প্রভৃতি দেববৃন্দ তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন; সকলেই উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দক্ষ সমাগত দেববৃন্দকে সহাস্যবদনে শিরো সঞ্চালনপূর্ব্বক কথঞ্চিৎ প্রীতিপ্রফুল্লনেত্রে অভ্যর্থনা করিলেন। তিনি ইঙ্গিতে দেবগণকে বসিতে অনুমতি প্রদান করিলে তাঁহারা কৃতার্থ হইয়া উপবেশন করিলেন। তিনজন তাঁহাকে দেখিয়া উত্থান করেন নাই। ব্রহ্মা—দক্ষের পিতা, বিষ্ণু-পিতৃসখা, ইঁহারা দক্ষের নমস্য। কিন্তু শিব দক্ষদুহিতা সতীকে বিবাহ করিয়াছেন। তিনি জামাতা, তিনি শ্বশুরকে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়ান নাই, বা প্রণাম করেন নাই। জামাতার এই ব্যবহারে দক্ষের মুখমণ্ডল রোষ-দীপ্ত হইল, তাঁহার ললাট হইতে স্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বালা নিঃসৃত হইতে লাগিল। তিনি বিরূপাক্ষের দিকে সঘৃণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, “শিব, তোমার এত বড় আস্পর্দ্ধা! আমার কন্যাকে বিবাহ করিয়া তুমি দেবসমাজে স্থান পাইয়াছ। নতুবা তুমি যে প্রকৃতির লোক, তোমায় দেবতাসমাজে অপাংক্তেয় হইয়া থাকিতে হইতে। তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ, তাহা কেহ জানে না, তোমার গোত্র ও কুলের পরিচয় নাই। তোমার আচার ব্যবহার জঘন্য, তুমি শ্মশানে থাক, ঘৃণিত ভিক্ষাবৃত্তি তোমার ব্যবসায়, একটা ষাঁড়ের উপরে চাপিয়া তুমি সাপ লইয়া খেলাও। কোন্‌ পার্ব্বত্য সাপুড়ে দেশ হইতে তুমি আসিয়াছ, তাহা জানি না। বসন-ভূষণ নাই—দিগম্বর, সময়ে সময়ে দুর্গন্ধ বাঘছাল পরিয়া থাক। এই ঘৃণিত আচরণ দেবসমাজে অতি নিন্দিত। আমার দিকে চাহিয়া তাঁহারা তোমায় কেহ কিছু বলেন না। দেখ, আমার জামাতা চন্দ্রকে দেখ—যেমন মধুর প্রকৃতি, তেমনি বিনয়ী—যেমন রূপবান্‌, তেমনি গুণশীল। তাঁহার রূপের গুণে দেব-সভা উজ্জ্বল, বিশ্ব উজ্জ্বল। অগ্নি ও ধর্ম্ম ইহারাও জামাতা, ইঁহারা ত্রিদিব উজ্জ্বল করিয়া আছেন। আর তাঁহাদের পার্শ্বে জাতিহীন, কুলহীন, বৃষবাহন, নগ্নকায়, ক্ষিপ্ত ভিক্ষুককে জামাতা বলিয়া পরিচয় দিতেও ঘৃণা হয়। তোমার অহঙ্কারের মাত্রা পূর্ণ হইয়াছে, তাহা একেবারে আমি চূর্ণ করিব।”

 এই উক্তিতে বিষ্ণু, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ লজ্জিত হইলেন। কিন্তু দক্ষ ব্রহ্মার অতি প্রিয়, এই জন্য সকলেই কেবল মাথা হেঁট করিয়া রহিলেন। স্বয়ং ব্রহ্মা অতিমাত্র পুত্রবাৎসল্যে প্রতিবাদ করিতে কুণ্ঠিত হইলেন।

 দক্ষ যখন শিবের নিন্দাবাদ করিতেছিলেন, তখন ভৃগুর মুখে উল্লাসের চিহ্ন দেখা যাইতেছিল। ভৃগুর গৃহেই যজ্ঞ—গৃহপতি দক্ষের কথায় সায় দিলেন। তৎসঙ্গে পূষা প্রভৃতি ঋষিগণও মহাদেবের নিন্দায় বেশ আমোদ অনুভব করিতে লাগিলেন। তাঁহারা শিবনিন্দা শুনিয়া অনুকূল ভাবে ঘাড় নাড়িতে লাগিলেন। উৎসাহিত হইয়া দক্ষ মহাদেবের প্রতি যথেষ্ট কটুক্তিবর্ষণ করিলেন।

 বৃষভের পার্শ্বে শূলহস্তে নন্দী দাঁড়াইয়াছিল। তাহার সর্ব্বদেহ ক্রোধে কম্পিত হইতে লাগিল। ক্রোধে তাহার দুইটি চক্ষের তারা ছুটিয়া যাইবার মত হইয়াছিল। সে বিক্ষুব্ধ বারিধির ন্যায় অস্ফুট-গর্জ্জন মাত্র করিতেছিল, মহাদেবের ইঙ্গিতে কোন কথা স্পষ্ট করিয়া বলিতে সাহস পায় নাই। বৃষটিও যেন শিবনিন্দায় ব্যথিত হইয়া দুই চক্ষু হইতে অশ্রু ত্যাগ করিতেছিল।

 শিব কোন কথাই বলেন নাই, তিনি একবার ঊর্দ্ধচক্ষু নত করিয়া দক্ষের প্রতি দৃষ্টি করিয়াছিলেন। সে দৃষ্টিতে ক্রোধ ছিল না, ক্ষমা ছিল।—ব্যথার চিহ্নমাত্র ছিল না, করুণার স্নিগ্ধতা ছিল। দাম্ভিক দক্ষ ভাবিলেন, শিবের এই ভাব—ঘৃণার ছদ্মবেশমাত্র। তিনি ক্রোধে আরও জ্বলিয়া উঠিলেন।

 যজ্ঞ শেষ হইয়া গেল। যাঁহার ভস্ম ও চন্দনে সমজ্ঞান, এমন মহাদেবের নিকট আদর ও ঘৃণার তারতম্য কি?

 জগতের হলাহল একমাত্র শিবই পান করিতে সমর্থ এবং হলাহলসিন্ধু-মন্থন করিয়া যে অমৃতের উৎপত্তি হয়, একমাত্র শিবই তাহার ভোক্তা। দেবসভা হইতে যে ঘৃণা ও কটূক্তির বর্ষণ হইল, তাহা মর্ম্মরপ্রস্তরের উপর বারিবর্ষণের ন্যায় তাঁহার চিত্তে কোন রেখা আঁকিয়া গেল না। তাঁহার বিশাল জটাজুটে গঙ্গার যে মৃদু-মধুর কলরব হইতেছিল, আনন্দময়ের তাহাতেই পরমানন্দ জাগিয়া উঠিল। তিনি তাঁহার কর-ধৃত বিষাণ বাদনপূর্ব্বক আনন্দধ্বনিতে আকাশ কম্পিত করিয়া কৈলাসপু্রীতে প্রত্যাগত হইলেন। সমুদ্রমন্থনকালে দেবগণ অমৃতের ভাগ পাইয়াছিলেন, শিব বিষ পান করিয়া আসিয়াছিলেন। এবারও তাহাই হইল, ভৃগু সমস্ত দেবগণকে অমৃত তুল্য আদরে আপ্যায়িত করিলেন। অপমানের তীব্র বিষ শিবের প্রতি বর্ষিত হল। কিন্তু শিব-মুখের অর্দ্ধেন্দু-উজ্জ্বল প্রসন্নতা দেখিয়া কে তাহা জানিতে পারিবে?

 শুধু নন্দীর মনে সেই তীব্রজ্বালা জ্বলিতে লাগিল। সপ্তাহ পর্য্যন্ত নন্দী আহার করে নাই। রাত্রিতে নিদ্রা যায় নাই, সিদ্ধি ঘুটিতে ঘুটিতে অতিমাত্র ক্রোধে নন্দী কষ্টি পাথরের আধারগুলি ভাঙিয়া ফেলিয়াছে। সতী বলিতেন, “নন্দী, তুই সমস্ত অসুরের বল পাত্রগুলির উপর প্রয়োগ করিলে তাহা উহারা সহিতে পারিবে কেন?”