সতী/২
এদিকে শিবের প্রতি দক্ষ-প্রজাপতির ক্রোধ ক্রমেই বাড়িয়া চলিল। ভাবিলেন, এত ভর্ৎসনা করিলাম, তাহার উত্তরে একটা কথা বলিল না, বেটার এরূপ অভিমান? দেবতারা বলে—ইহার নমস্য কেহ নাই। ইহাতেই মনে হয়, শিব অতি হীনকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছে; অমরগণের সুবৃহৎ পরিবার—ইহাতে কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠের প্রতি মর্য্যাদা-যুক্ত না হইলে সামাজিক শৃঙ্খলা থাকিবে কিসে? শিব ভুঁইফোড়, শ্বশুর পিতৃতুল্য, তাঁহাকে প্রণাম করিবে না। বৃহস্পতির সঙ্গে অনেক শাস্ত্র ঘাঁটিয়া দেখা গেল, এরূপ বিধি কোথাও নাই।
দক্ষের দল ক্রমেই পুষ্ট ও প্রবল হইয়া উঠিল। তাহার একবাক্যে বলিল, “শিবের আচার দেবসমাজের বিধিবহির্ভূত; আমরা তাহাকে দেব বলিয়া স্বীকার করিব না।”
তাহারা দক্ষের ক্রোধ ক্রমেই উদ্দীপিত করিয়া দিল। একে ত শিবের মৌন-উপেক্ষা-কল্পনায় দক্ষ অত্যন্ত চটিয়া গিয়াছিলেন, তাহার উপর বিকৃতানন নন্দীর রোষকষায়িত সঘৃণ দৃষ্টির কথা মনে পড়িয়া দক্ষ ক্রোধে উন্মত্তবৎ হইয়া উঠিলেন। তিনি অবশেষে প্রকাশ্য-ভাবে দেবসমাজে এই আদেশ প্রচার করিয়া দিলেন যে, শিবের সঙ্গে আর দেবসমাজ এক পংক্তিতে ভোজন করিবেন না। যজ্ঞের ভাগে শিবের কোন অধিকার থাকিবে না।
সুদীর্ঘ কুটিল শ্মশ্রুগুলি অঙ্গুলি দ্বারা মার্জ্জনা করিতে করিতে ভৃগু বলিলেন, “এবার ভাঙ্গড় জব্দ হইবে, এই ব্যবস্থা উৎকৃষ্ট হইল।” অষ্টদিক্পাল দক্ষ-প্রজাপতির এই আদেশ জগতে প্রচার করিলেন, মহাদেব যজ্ঞভাগ পাইবেন না।
সমস্ত জগৎ এই আদেশে ভীত-স্তব্ধ হইয়া গেল। শিবহীন যজ্ঞ কে করিবে? হৈহয়, যযাতি, মান্ধাতা প্রভৃতি রাজরাজেশ্বরগণ সর্ব্বদা যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেন, শিবহীন যজ্ঞ করিতে তাঁহারা সাহসী হইলেন না। যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণু ব্রহ্মার মুখের দিকে চাহিয়া এই আদেশের প্রতিবাদ করিতে পারিলেন না। অথচ শিবহীন যজ্ঞের ভাগ গ্রহণ করিতে তাঁহার কোনই উৎসাহ রহিল না। দেবগণ কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া নর-জগতে কোন উৎসাহ দিতে পারিলেন না, অথচ দক্ষের বিরুদ্ধাচরণ করিতেও ভরসা পাইলেন না।
যজ্ঞ বন্ধ হওয়াতে অনাবৃষ্টি হইল; পৃথিবীর বর্ণ প্রতপ্ত তাম্রখণ্ডবৎ ধূসর-রক্ত হইয়া উঠিল। শস্য দগ্ধ হইয়া গেল। কীট-পতঙ্গ, পশু-পক্ষী, মনুষ্য—লক্ষ লক্ষ মৃত্যুমুখে পতিত হইতে লাগিল। ঋষিগণ হোমকার্য্যে বিরত থাকিয়া তপোভ্রষ্ট হইয়া পড়িলেন। যোগিগণ অন্তশ্চর বায়ু নিরোধ করিতে কষ্ট বোধ করিতে লাগিলেন, যজ্ঞাগ্নিক ধূমে মরুৎ-পরিষ্কৃত না হওয়াতেও জীবের পক্ষে শ্বাসপ্রশ্বাসক্রিয়া যেন কতকটা আয়াস-সাধ্য হইয়া উঠিল।
রুদ্রের অপমানে পৃথিবীতে রৌদ্র প্রখর হইয়া উঠিল। ধরিত্রী জ্বালা বোধ করিতে লাগিলেন। দিগ্গজগণ ঘন ঘন আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল। বালখিল্য ঋষিরা বৃক্ষের আশ্রয়চ্যুত হইতে উদ্যত হইলেন। দিক্পালগণ কম্পিতকলেবর হইতে লাগিলেন, তাঁহাদের নেত্রস্পন্দনে মুহুর্মুহু বসুন্ধরা কম্পিত হইতে লাগিল।
শিব-হীন যজ্ঞে কে সাহস করিবে? পৃথিবী ক্রোধ ও বিদ্বেষের আগার হইয়া উঠিল। কারণ ধর্ম্ম শিবহীন। যাহার উদারান্ন সংস্থানের উপায় নাই, সে বিলাসী হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইতে লাগিল, কারণ তাহার লক্ষ্য শিবহীন। পরিধেয় ও ভূষণের বাহুল্য হইল—অথচ গৃহে শিশুগণ না খাইয়া মৃতপ্রায়, গৃহ-কর্ত্তার সেদিকে দৃষ্টি নাই কারণ তাহার দৃষ্টি শিবহীন। গৃহকর্ত্রীরা বিলাসিনী হইয়া উঠিল, কারণ শিবহীন গৃহে অন্নপূর্ণার সাধনা কে করিবে? স্বেচ্ছায় কিংবা পরার্থে কেহ কণ্টকের আঁচড় স্বশরীরে সহ করিতে প্রস্তুত নহে, অথচ আলস্যজড়িত নিশ্চেষ্ট দেহ পরকৃত সর্ব্বপ্রকার অত্যাচার সহ্য করিতে লাগিল। প্রতারক ধর্ম্ম-যাজকগণ তামসিক ভাবকে সত্য গুণ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে লাগিল। বিলাস ও মূঢ়তা চরিত্রকে অধিকার করিয়া বসিল—কারণ ত্যাগী এবং সত্যস্বরূপ শিবের আদর্শ জগৎ হইতে অপসৃত হইল।
ব্রহ্মার সৃষ্টি লুপ্ত হইতে চলিল। প্রশ্ন এই—“দক্ষ চাও না শিব চাও?” জগৎ এই দুয়ের অধিকার সহ্য করিতে অসন্মত। একদিকে দম্ভ, বল, স্বেচ্ছাচারিতা এবং প্রবল দণ্ড-শক্তি—অপর দিকে ত্যাগ, নিবৃত্তি ও ব্রহ্মানন্দ, কোন্টা চাই? দক্ষের কঠোর অনুশাসন পৃথিবীর অসহ্য হইল। ভীত, ত্রস্ত এবং মূক জগতের প্রাণ ফাটিয়া যাইতেছিল। তথাপি মনের কথাটি উচ্চারণ করিবার সাহস তাহার হইল না—সে কথাটি, “আমরা দক্ষকে চাই না, আমরা শিবকে শিরে ধারণ করিব।”