সতী
জিজ্ঞাসা
১৩৩এ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। কলিকাতা ২৯
৩৩ কলেজ রো। কলিকাতা ৯
মুদ্রক শ্রীমণীন্দ্রকুমার সরকার
উৎসর্গ
বঙ্গের উজ্জ্বল-রত্ন,
দেশহিতে অক্লান্তকর্ম্মা
সুধীকুলাগ্রগণ্য
মাননীয় বিচারপতি
শ্রীযুক্ত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
এম, এ, ডি, এল, মহোদয়ের
শ্রীকরকমলে
এই ক্ষুদ্র গ্রন্থখানি
অশেষ ভক্তির নিদর্শনস্বরূপ
প্রদত্ত হইল।
গ্রন্থকার
দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহ-ত্যাগের উপাখ্যান সকলেই অবগত আছেন, সেই উপাখ্যানটি গল্পচ্ছলে এই পুস্তকে লিখিত হইয়াছে। “বেহুলা” ও “ফুল্লরা” লিখিতে যাইয়া প্রাচীন সাহিত্যের যেরূপ অজস্র উপকরণ দ্বারা আমি সহায়বান্ হইয়াছিলাম, দাক্ষায়ণী সতীর বৃত্তান্ত লিখিতে আমি তদ্রূপ সাহায্য অতি সামান্যই পাইয়াছি। মাধবাচার্য্য, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র ও জয়নারায়ণ প্রভৃতি বহুসংখ্যক প্রাচীন বঙ্গীয় কবি এ সম্বন্ধে যে কিছু বিবরণ দিয়াছেন তাহা অতি সামান্য, আমি তাহা হইতে আহরণ করিবার উপযোগী উপকরণ অতি অল্পই পাইয়াছি। ভারতচন্দ্রের বর্ণিত শিবের ক্রোধ ও দক্ষযজ্ঞ-নাশ—ছন্দের ঐশ্বর্য্য ও ভাষাসম্পদে উক্ত কবির অমর কীর্ত্তিস্বরূপ প্রাচীন কাব্যসাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। কিন্তু ভুজঙ্গপ্রয়াতছন্দ ভাঙিয়া কথাগুলি গদ্যে পরিণত করিলে কবির অপূর্ব্ব শব্দমন্ত্রের মোহিনী শক্তি নষ্ট হয়, সুতরাং অন্নদামঙ্গল হইতে আমি উপকরণ সংগ্রহের তাদৃশ সুবিধা প্রাপ্ত হই নাই। অপরাপর বঙ্গীয় কবিগণকৃত এই বিষয়ের বর্ণনা অতি সংক্ষিপ্ত, এমন কি উল্লেখযোগ্যই নহে। শ্রীমদ্ভাগবতে দক্ষযজ্ঞের বর্ণনা কতকটা সবিস্তর, আমি তাহাই কথঞ্চিৎ অবলম্বনপূর্ব্বক এই গল্পটি লিখিয়াছি।
এই উপাখ্যানসংক্রাস্ত একটি কৈফিয়ৎ আমাকে দিতে হইবে। এ দেশের লোকের প্রচলিত বিশ্বাস যে, মহাদেব যখন সতীকে দক্ষালয়ে যাইতে নিষেধ করিয়া ছিলেন, তখন সতী দশমহাবিদ্যার বিচিত্ররূপ ধারণপূর্বক স্বামীকে ভয় দেখাইয়াছিলেন। আমি এই অংশ হইতে বর্জ্জন করিয়াছি। সংস্কৃত পুরাণ ও তন্ত্র আলোচনা করিলে দেখা যাইবে, একমাত্র মহাভাগবতপুরাণে দশমহাবিদ্যার আবির্ভাব সম্বন্ধে উক্তপ্রকার আখ্যায়িকা পরিদৃষ্ট হয়, অন্য কোন প্রাচীন গ্রন্থে তাহা নাই। কুব্জিকাতন্ত্র, স্বতন্ত্র তন্ত্র, নারদপঞ্চরাত্র প্রভৃতি বহুসংখ্যক প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে দশমহাবিদ্যার আবির্ভাবের কারণ ভিন্নরূপ নির্দিষ্ট হইয়াছে। এই সকল গ্রন্থের অনেক স্থলেই দৃষ্ট হয় বিশেষ বিশেষ অসুর নিধনকালে কিংবা অপর কোন প্রকার ঘটনায় পড়িয়া দেবী দশমহাবিদ্যার ভিন্ন ভিন্ন নাম পরিগ্রহ করিয়াছিলেন—দক্ষালয়ে যাওয়ার উপলক্ষে তাঁহার দশমূর্ত্তির কল্পনা একমাত্র পূর্ব্বকথিত মহাভাগবতপুরাণেই দৃষ্ট হয়; দক্ষযজ্ঞের সম্বন্ধে শিবপুরাণ ও শ্রীমদ্ভাগবতের আখ্যায়িকাই বিশেষরূপ উল্লেখযোগ্য, তাহাতে দশমহাবিদ্যার কল্পনা নাই। শুদ্ধ মহাভাগবত-পুরাণের উপর নির্ভর করিয়া ভারতচন্দ্র প্রভৃতি প্রাচীন বঙ্গীয় কবিগণ দশমহাবিদ্যার বৃত্তান্ত সঙ্কলন করিয়া গিয়াছেন এবং তজ্জন্যই এ দেশে সেই ধারণাটি বদ্ধমূল হইয়াছে।
আশা করা যায়, একমাত্র সংস্কৃত পুরাণের নজির গ্রহণ না করার অপরাধে গল্পলেখককে বিশেষরূপে দোষী সাব্যস্ত করা হইবে না। কবিবর হেমচন্দ্র তাঁহার দশমহাবিদ্যানামক কাব্যে দশমহাবিদ্যার আবির্ভাব সতীর দেহত্যাগের পরবর্ত্তী বলিয়া কল্পনা করিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণরূপে তাঁহার কল্পনায় সৃষ্টি। আমি সতীর চিত্র যে ভাবে চিত্রণ করিতে চেষ্টা পাইয়াছি, তাহাতে দশমহাবিদ্যার সঙ্গতি রক্ষণ করা আমার পক্ষে কঠিন হইত, এজন্যই আমি উহা বর্জ্জন করিয়াছি এবং এ সম্বন্ধে প্রায় সমস্ত সংস্কৃত গ্রন্থোক্ত বিবরণ যখন আমার অনুকুলে, তখন আমি লিখিতে যাইয়া স্বয়ং কোনরূপ দ্বিধা বোধ করি নাই।
প্রাচীনকালে স্বামীর প্রেম ও রমণীর পাতিব্রত্যের যে আদর্শ বঙ্গীয়সমাজের সম্মুখে ছিল, এই গল্পে যদি তাহার আভাস দিতে সমর্থ হইয়া থাকি, তবেই শ্রম সার্থক জ্ঞান করিব। আমাদের সর্ব্ববিষয়ে প্রাচীন আদর্শ কি ছিল, তৎসঙ্গে শিক্ষিতসম্প্রদায়ের পরিচয় স্থাপন করা উচিত—তাহা হইলেই আমরা বর্ত্তমানের উপযোগী সমাজ গঠনের সদৃঢ় ভিত্তিভূমি পাইব, নতুবা পাদ্রীর বক্তৃতা শুনিয়া কাফ্রি বা সাঁওতালের ন্যায় একবারে নিজস্ব হারাইয়া—নব্য-সভ্যতার গ্রাসে পতিত হওয়া শ্লাঘার বিষয় নহে। সেই পরিচয়স্থাপনের চেষ্টা কি সাহিত্য, কি সমাজ, কি শিল্প, সকল দিক দিয়াই প্রত্যেক স্বদেশভক্তের প্রযত্নের বিষয় হওয়া উচিত। সাহিত্যক্ষেত্রে এই লক্ষ্যই আমার সামান্য লেখনীকে প্রেরণা দান করিয়াছে।
সূচীপত্র
এই লেখাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত কারণ এটি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারির পূর্বে প্রকাশিত।
লেখক ১৯৩৯ সালে মারা গেছেন, তাই এই লেখাটি সেই সমস্ত দেশে পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত যেখানে কপিরাইট লেখকের মৃত্যুর ৮০ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এই রচনাটি সেই সমস্ত দেশেও পাবলিক ডোমেইনে অন্তর্গত হতে পারে যেখানে নিজ দেশে প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রলম্বিত কপিরাইট থাকলেও বিদেশী রচনার জন্য স্বল্প সময়ের নিয়ম প্রযোজ্য হয়।