(পৃ. ৪৭-৪৯)
◄  
১০  ►

 সতী বিদায় লইয়া যাওয়ার পরে শিব বিচলিত হইয়া পড়িলেন। প্রসন্ন শিবমুখে বিষাদের রেখা পড়িল। যাইবার সময় আগ্রহাতিশয়ে সতী তাঁহাকে প্রণাম করিয়া যান নাই—এরূপ ভ্রম উাহার কেন হইল? শিব মনে মনে তাঁহাকে আশিস্‌ করিতে লাগিলেন, আশীর্ব্বাণী আকাশের উর্দ্ধস্তরে ঠেকিয়া ফিরিয়া আসিল, শিব দেবীর অমঙ্গলাশঙ্কায় বিচলিত হইয়া উঠিলেন।

 সতী যে স্থানে স্নান করিতেন, সেখানে অলকানন্দা ও মন্দা নাম্নী নদীদ্বয় গঙ্গাধারার সঙ্গে মিশিয়াছে। তাহার পার্শ্বে সৌগন্ধিক নামক বন, সেই বনে নানাবর্ণের স্থলপদ্ম ও পুন্নাগবৃক্ষ। শিব সেই স্থানে বিচরণ করিতে লাগিলেন, তাঁহার জটাবন্ধন খুলিল, কটিতে শার্দ্দূলচর্ম্ম এলাইয়া গেল, কর্ণের ধুস্তূর ফুল খসিয়া পড়িল। মন্দানদীতে গন্ধর্ব্বরমণীগণের স্নানকালে তাহাদের গাত্রভ্রষ্ট নবকুঙ্কুমে জল পীতবর্ণ হয়, তিনি মনে করেন, সতীর পদ-শোভন অলক্তক প্রক্ষালিত করিয়া মন্দা রক্তবর্ণবিশিষ্টা হইয়াছে, অমনই জটা এলাইয়া নদীসলিলে তাহা সিক্ত করেন।

 সতীর অঙ্গজ্যোতিঃ সৌরকিরণে অনুভব করিয়া তিনি অস্তচূড়াবলম্বী সূর্য্যের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া থাকেন। সেই কিরণে জটা পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করে। মহাদেব ভাবেন, দেবীর অঙ্গপ্রভায় তাঁহার মস্তক জ্যোতিষ্মান্‌ হইয়াছে।

 কখনও কখনও দক্ষের আলয় লক্ষ্য করিয়া ত্রিনেত্র অশ্রুপূর্ণ হয়। ভোলানাথ সকল ভুলিয়াও সতীকে ভুলিতে পারেন নাই। তাঁহার বিহ্বলাবস্থা দর্শনে কৈলাসের শোভা মন্দীভূত হইল; মল্লিকা সুবাস হারাইয়া বসিল; বিল্বদল তরুশাখায় বিশুষ্ক হইল; চম্পক, পাটল ও দেবীর প্রিয় কণিকার পুষ্প স্ব স্ব বিচিত্র বর্ণচ্যুত হইল। সুরধুনী কুলকুল স্বরে বিষাদের গান গাইয়া কৈলাসপুরীকে মুখরিত করিয়া ছুটিতে লাগিল। কখনও বিল্বমুলে কখনও দেবদারু—দ্রুমনিম্নে শিব উন্মত্তের ন্যায় বসিয়া থাকিতেন। এক রাত্রি একদিন চক্ষের পলক পড়ে নাই—ভোলানাথের কেবলই ভুল হইতে লাগিল!

 সহসা সঘন নিশ্বাসপাতে কৈলাসের শৃঙ্গ কম্পিত হইয়া উঠিল। কোন দারুণ মনোবেদনার স্বর কৈলাসের প্রস্তরে প্রস্তরে প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল! এ কে আসিতেছে—যাহার অসংযত পাদবিক্ষেপে কৈলাসের পুষ্পোদ্যান বিধ্বস্ত হইয়া যাইতেছে? কাহার হস্ত-সঞ্চালনে করকাঘাতের ন্যায় বৃক্ষশাখা ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে? এই অসংযত, সম্ভ্রমহীন, নির্ভীক ব্যক্তি কে যে, রুদ্রের আবাসে এরূপ অসতর্ক, এরূপ উদ্ধতবেশে উপস্থিত হইতে সাহসী? বিল্বমূলাসীন শিব নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ত্রিনেত্র স্থির করিয়া অভ্যাগতের পন্থার দিকে বন্ধলক্ষ্য হইলেন।

 এ কে? এই অসংযত জটাকলাপ, শূল-বিচ্যুত নন্দী আসিতেছে। মা’ মা’ রবে কাঁদিয়া সে দিঙ্‌মণ্ডল বিদীর্ণ করিয়া ফেলিতেছে। তাহারই উন্মত্ত, শোকার্ত্ত বিদ্রুতগতিতে কৈলাসগিরির প্রকম্পন হইতেছে; ছিন্ন শালবৃক্ষ কিংবা ভগ্ন ইন্দ্রধ্বজ, অথবা ব্যোমচ্যুত ধূমকেতুর ন্যায় হাহাকার করিয়া নন্দিকেশ্বর শিবের পাদমূলে পতিত হইল।

 শিবের কিছুই বুঝিতে বাকি রহিল না। শান্ত সমুদ্রের ন্যায় শিব প্রলয়কালে বিশ্ব-বিনাশ করিয়া থাকেন। যখন দেবদারু-মূলে প্রফুল্ল কমলসদৃশ করদ্বয় অঙ্কে স্থাপন করিয়া ইনি ধ্যানস্থ থাকেন, তখন কে বুঝিতে পারে, প্রলয় কালে এই শিবের প্রশান্ত জটাজুট ব্যোমের সমস্ত দিকে উত্তপ্ত লৌহশলাকার ন্যায় বিকীর্ণ হইয় পড়ে? তখন কে বুঝিতে পারে, ইঁহার করধৃত শূলাগ্রে দিগ্‌হস্তিগণ বিদ্ধ হইয়া উৎক্ষিপ্ত হয় এবং ইঁহার উচ্চ ও কঠোর হাস্যধ্বনিতে মেঘ সকল বিদীর্ণ হইয়া যায় এবং তাঁহার রৌদ্র-তাণ্ডবে নক্ষত্রগণ কক্ষচ্যুত হয়?

 আজ সেই প্রলয়কালীন বিষাণ সহসা বাজাইয়া মহাদেব তাণ্ডব নৃত্য করিতে লাগিলেন। তাঁহার জট জ্বলন্ত হুতাশনের ন্যায় জ্বলিতে লাগিল, অট্টহাস্য করিয়া তিনি একগাছি জটা ভূতলে নিক্ষেপ করিলেন।

 সেই জটা-পতনে ভয়ঙ্কর বীরভদ্র বীর সমুত্থিত হইল, তাহার মস্তকের কৃষ্ণ মেঘোপম মুকুট গগনাবলম্বী হইয়া রহিল এবং হস্তের শূল কৃতান্তনাশক তীক্ষ্ণতা প্রাপ্ত হইয়া হত্যাকার্য্যের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।