সন্ধ্যা সঙ্গীত/পরাজয় সঙ্গীত

পরাজয় সঙ্গীত।

ভাল করে যুঝিলিনে, হল তােরি পরাজয়,
কি আর ভাবিতেছিস, ম্রিয়মাণ, হা হৃদয়!
কাঁদ তুই, কাঁদ, হেথা আয়,
একা বসে বিজনে বিদেশে!
জানিতাম জানিতাম হা-রে
এমনি ঘটিবে অবশেষে!

হৃদয়ের পানে চেয়ে কাঁদিয়াছি প্রতিদিন
বিধাতা, কেন গো তারে, সৃজিয়াছ দীন হীন?
হীন-বল, ক্ষীণ-তনু, টলমল পায়ে পায়,
একটু বহিলে বায়ু লুটায়ে পড়িতে চায়,
আশ্রয় চলিয়া গেলে,  আর সে আঁখি না মেলে,
অমনি ধূলায় পড়ে, অমনি মরিয়া যায়।
কত কি করিতে সাধ কিছু না করিতে পারে,
তরঙ্গে বায়ুতে মিলি খেলায়ে বেড়ায় তারে!
প্রাণের নিভৃতে পশি,  প্রতিদিন বসি, বসি,
মরমের অস্থি দিয়ে একেকটি আশা গড়ে
দুর্বল মনের আশা প্রতি দিন ভেঙ্গে পড়ে,


অতীত, শিয়রে বসি কাঁদিয়া শুনায় গান,
কত সুখ-স্বপনের আরম্ভ ও অবসান।
ফুটিতে পারিত ফুল, না ফুটিয়া ঝ'রে গেল,
গাহিতে পারিত পাখী, না গাহিয়া ম'রে গেল।
জলদ-মূরতিবৎ,  অতি দূরে ভবিষ্যৎ
ফুটন্ত আশার ফুল লইয়া দাঁড়ায়ে আছে,
বর্ত্তমান তারি পানে  ছুটিছে আকুল প্রাণে
যত যায়—যত যায় কিছুতে পায় না কাছে!
মন, কত দিন ধোরে  দেখিয়া আইনু তােরে
বুঝিলাম বিফল প্রয়াস।
সংসার-সমরে ঘাের  পরাজয় আছে তাের
অপমান আর উপহাস!

সংসারে যাহারা ছিল  সকলেই জয়ী হল
তােরি শুধু হল পরাজয়,
প্রতি রণে প্রতি পদে একে একে ছেড়ে দিলি
জীবনের রাজ্য সমুদয়।
যতবার প্রতিজ্ঞা করিলি
ততবার পড়িল টুটিয়া,
ছিন্ন আশা বাঁধিয়া তুলিলি


বার বার পড়িল লুটিয়া।
যাহা কিছু চাহিলি করিতে
করিতে নারিলি কিছু তার,
কাঁদিলিরে যাহাদের তরে
তারা না কাঁদিল একবার।
সান্ত্বনা সান্ত্বনা করি ফিরি
সান্ত্বনা কি মিলিল রে মন?
জুড়াইতে ক্ষত বক্ষঃস্থল
ছুরিরে করিলি আলিঙ্গন।
ইচ্ছা, সাধ, আশা যাহা ছিল
অদৃষ্ট সকলি লুটে নিল।

মনে হইতেছে আজি, জীবন হারায়ে গেছে
মরণ হারায়ে গেছে হয়,
কে জানে একি এ ভাব? শূন্য পানে চেয়ে আছি
মৃত্যুহীন মরণের প্রায়!
পরাজিত এ হৃদয়, জীবনের দুর্গ মম
মরণে করিল সমর্পণ
তাই আজ জীবনে মরণ!


হৃদয় রে, কি করিলি?  সব তুই ছেড়ে এলি
দেখিলিনে কে আছে কোথায়?
প্রিয়জন, পরিজন, শৈশবের সহচর,
ঘরে ঘরে আছে যে সেথায়!
সুখ দুঃখ আশা প্রেম, হাসি আর অশ্রুজল
কবিতা কল্পনা সেথা আছে!
তুই সব ছেড়ে দিলি,  তুই পলাইয়া এলি,
তাদের রাখিলি কার কাছে?


হৃদয়, হৃদয় মাের,  দেখ্‌রে সম্মুখে তাের
অনন্ত কিছু-না এক দাঁড়ায়ে রয়েছে ঘাের!
সেথা দাঁড়াবার ঠাঁই  এক তিল মাত্র নাই
পড়িবি তাহারাে নাই স্থান।
নেমে যাবি, নেমে যাবি,  দিন রাত্রি নেমে যাবি,
দিন-রাত্রি-হীন সেই আঁধার বিমান-
যত যাবি, তত যাবি, নাই পরিমাণ।
জাগ্‌, জাগ্‌, জাগ্‌, ওরে,  গ্রাসিতে এসেছে তােরে
নিদারুণ শূন্যতার ছায়া,
আকাশ-গরাসী তার কায়া!
গেল তাের চন্দ্র সূর্য্য, গেল তাের গ্রহ তারা,


গেল তাের আত্ম আর পর,
এইবেলা প্রাণপণ কর।
এই বেলা ফিরে দাঁড়া তুই,
স্রোতোমুখে ভাসিস্‌নে আর!
যাহা পাস্ আঁকড়িয়া ধর
সম্মুখে অসীম পারাবার।
সম্মুখেতে চির অমানিশি,
সম্মুখেতে মরণ বিনাশ।
গেল, গেল বুঝি নিয়ে গেল,
আবর্ত্ত করিল বুঝি গ্রাস।
ওই দেখ্ সুখ চলে গেল,
ওই দেখ্ দুঃখ চলে যায়,
ওই দেখ্ হাসি মিশাইল,
ওই দেখ্ অশ্রুও শুখায়।
কবিতা, এ হৃদয়ের প্রাণ,
সকলি ত্যজিনু যার লাগি
সকলে ত্যজিয়া গেল যদি,
সেও ওই যেতেছে তেয়াগি।
আর না, আর না রে হৃদয়,
আর ত বিলম্ব ভাল নয়!


কেমনে ভাবিব, ওরে,  কল্পনা ত্যেজেছে মােরে,
খুঁজিব সমস্ত হৃদি-ভাব নাই—কথা নাই-
কাঁদিতে ভুলিয়া যাব যতই কাঁদিতে চাই।
মরুময় হৃদয়েতে বহিব কি চির দিন
কঠোর, অচল স্তব্ধ দুঃখের তুষার ভার?
কল্পনা কিরণ দিয়া গলায়ে গলায়ে তারে
সঙ্গীত-নির্ঝর-স্রোতে ঢালিতে নারিব আর?
স্রোত হীন শব্দহীন কঠিন দুঃখের কায়,
কল্পনা করিতে গেলে হৃদয় ফাটিয়া যায়!
হৃদয়রে, ওঠ্ একবার,
সব যাক, সবু যাক আর,
কল্পনারে ডেকে আন্ মনে,
অশ্রু জল থাক্ দুনয়নে!
সেই শুধু শেষ অবশেষ
সুখ দুঃখ আশা ভরসার!
প্রাণপণে রাখ তাহা ধরে
সেও যেন হারাসনে আর!
কাঁদিবার রাখিস্ সম্বল
কল্পনা ও নয়নের জল।


সে যদি হারায়ে যায়,  হৃদয়রে হায় হায়
কে সহিবে দুঃখহারা দুখ,
কেমনে দেখিব বল  অশ্রুহীন নেত্র মেলি
হৃদি-হীন হৃদয়ের মুখ?
সে যদি হারায়ে যায়,  হৃদয় রে হায় হায়
আজ তবে কেঁদে নিই আয়,
শেষ অশ্রুবারি আজি  ঢালিরে প্রাণের সাধে,
গেয়ে নিই যত প্রাণ চায়!
বল্ “ওই যায় যায় -সুখ যায়, দুঃখ যায়,
হাসি যায়, অশ্রুজল যায়।”
বল্ “ওই দাঁড়াইয়া,  আলিঙ্গন বাড়াইয়া
শূন্যতা, আকাশব্যাপী কায়!”
বল্ “যাহা গেল, তাহা  চিরকাল তরে গেল,
পাধনা তা মুহূর্ত্তের তরে।
তবে আয়, অশ্রু আয়,  বিদায়ের শেষ দেখা
আর দেখা হবে না ত পরে!”