সারদামঙ্গল/তৃতীয় সর্গ
[রাগিণী বিভাস,-তাল আড়াঠেকা।]
বিরাজ সারদে কেন এ স্নান কমলবনে।
আজো কিরে অভাগিনী ভালবাস মনে মনে!
মলিন নলিন বেশ,
মলিন চিকণ কেশ,
মলিন মধুর-মূর্তি, হাসি নাই চাননে!
মলিন কমল-মালা,
মলিন মৃণাল-বালা,
আর সে অমৃত-জ্যোতি এলেনাক বিলোচনে।
চির আদরিণী বীণা,
কেন, যেন দীনহীনা
ঘুমায়ে পায়ের কাছে পড়ে আছে অচেতনে!
জীবন-কিরণ-রেখা,
অস্তাচলে দিল দেখা,
এ হৃদি-কমল দেবী ফুটবেনা আর!
যাও বীণা বয়ে করে,
ব্রহ্মার মানস সরে,
রাজহংস কেলি করে সুবর্ণ-নলিনী মনে।
১
আজি এ বিষ বেশে
কেন দেখা দিলে এসে,
কাঁদিলে কাদালে দেবী জন্মের মতন!
পূর্ণিমা-প্রমােদ-আলল,
নয়নে লেগেছে ভাল;
মাঝেতে উথলে নদী, দুপারে দুজন-
চক্রবাক চক্রবাকী দুপারে দুজন।
২
নয়নে নয়নে মেলা,
মানসে মানসে খেলা,
অধরে প্রেমের হাসি বিষাদে মলিন;
হৃদয়-বীণার মাজে
ললিত রাগিণী বাজে,
মনের মধুর গান মনেই বিলীন।
৩
সেই আমি, সেই তুমি,
সেই এ স্বরগ-ভূমি,
সেই সব কল্পতরু, সেই কুঞ্জবন;
সেই প্রেম সেই স্নেহ,
সেই প্রাণ, সেই দেহ।
কেন মন্দাকিনী-তীরে দুপারে দুজন।
8
আকুল ব্যাকুল প্রাণ,
মিলিবারে ধাবমান;
কেন এসে অভিমান সমুখে উদয়!―
কান্তি-শান্তিময় তনু,
অপরূপ ইন্দ্রধনু,
তেজে যেন জ্বলে মন, অটল-হৃদয়,
৫
কাতর পরাণ পরে
চেয়ে আছে স্নেহভরে,
নয়ন-কিরণ যেন পীযুষ-লহরী;
এমন পদার্থে হেলি
যাবনা যাবনা ঠেলি,
উভয়-সঙ্কটে আজ মরি যদি, মরি।
৬
কেনগাে পরের করে
সুখের নির্ভর করে,
আপনা আপনি সুখী নহে কেন না!
সদাশিব সদানন্দ,
সতী বিনে নিরানন্দ,
শ্মশানে ভ্রমে ভােলা খেপা দিগম্বর।
৭
হৃদয়-প্রতিমা লয়ে
থাকি থাকি সুখী হয়ে,
অধিক সুখের আশা নিরাশা শ্মশান;
ভক্তিভাবে সদা স্মরি,
মনে মনে পূজা করি,
জীবন-কুসুমাঞ্জলি পদে করি দান।
৮
বাসনা বিচিত্র ব্যোমে
খেলা করে রবি সােমে
পরিয়ে নক্ষত্র তারা হীরকের হার,
প্রগাঢ় তিমির রাশি
ভুবন ভরেছে আসি
অন্তরে জ্বলিছে আলাে, নয়নে আঁধার।
৯
বিচিত্র এ মওদশা,
ভাবভরে যােগে বসা,
হৃদয়ে উদার জ্যোতি কি বিচিত্র জ্বলে!
কি বিচিত্র সুলতান
ভরপূর করে প্রাণ,
কে তুমি গাহিছ গান আকাশ মণ্ডলে!
১০
জ্যোতির প্রবাহ মাজে
বিশ্ববিমােহিনী রাজে!
কে তুমি লাবণ্য-লতা মুর্ত্তি মধুরিমা,
মৃদু মৃদু হাসি হাসি
বিলাও অমৃত রাশি,
আলােয়, করেছ আলাে প্রেমের প্রতিমা।
১১
ফুটে ফুটে অবিরল
হাসে সব শতদল,
অবিরল গুঞ্জরিয়ে ভ্রমর বেড়ায়।
সমীর সুরভিময়
মুখে ধীরে ধীরে বয়,
লুটায়ে চরণ তলে স্তুতিগান গায়।
১২
আচম্বিতে এ কি খেলা।
নিবিড় নীরদমালা!
হা হা রে, লাবণ্য-বালা লুকা’ল, সুকাল!
এমন ঘুমের ঘরে
জাগালে কে জোর কোরে,
সাধের স্বপন আহা ফুরা’ল, ফুরাল!
১৩
বসন্তের বনবালা
ঘুমের রূপের ডালা
মায়ার মােহিনী মেয়ে স্বপন সুন্দরী!
মনের মুকুর তলে
পশিয়ে ছায়ার ছলে
কর কত লীলাখেলা; কতই লহরী!
১৪
কোথা থেকে এস তারা,
মাখিয়ে সুধার ধারা,
জুড়াতে কাতর প্রাণ নিশান্ত সময়ে!
(লয়ে পশু পক্ষী প্রাণী
ঘুমায় ধরণী রাণী,)
কোথায় চলিয়ে যাও অরুণ উদয়ে।
১৫
ফের্ এ কি আল এল।
কই কই, কোথা গেল,
কেন এল, দেখা দিল, লুকাল আবার।
কে আমারে অবিরত
খেপায় খেপার মত,
জীবন-কুসুম-লতা কোথারে আমার।
৩৭
কোথা সে প্রাণের পাখী,
বাতাসে ভাসিয়ে থাকি
আর কেন গান কোরে ডাকেনা আমায়।
বল দেবী মন্দাকিনী!
ভেসে ভেসে একাকিনী
সােণামুখী তরীখানি গিয়েছে কোথায়?
১৭
এই না, তােমারি তীরে
দেখা আমি পেনু ফিরে,
তুলে কেন না রাখিনু বুকের ভিতরে।
হা ধিক্ রে অভিমান,
গেল গেল গেল প্রাণ,
করাল কালিমা ওই গ্রাসে চরাচরে।
১৮
হারায়ে নয়নতারা
হয়েছি জগত-হারা,
ক্ষণে ক্ষণে আপনারে হারাই হারাই;
ওহে ভাই দাও বােলে
কোন্ দিকে যাব চোলে,
ওকি ওঠে দোলে দোলে, কোথায় পালাই।
১৯
ওকি ও, দারুণ শব্দ,
আকাশ পাতাল স্তব্ধ;
দারুণ আগুন সুদু ধুধূ ধূধূ ধায়;
তুমুল তরঙ্গ ঘাের,
কি ঘাের ঝড়ের জোর,
পাঁজর ঝাঁঝর মাের দাড়াই কোথায়!
২০
তবে কি সকলি ভুল!
নাই কি প্রেমের মূল!
বিচিত্র গগন-ফুল কল্পনা লতার?
মন কেন রসে ভাসে
প্রাণ কেন ভালবাসে
আদরে পরিতে গলে সেই ফুলহার?
২১
শত শত নর নারী
দাড়ায়েছে সারি সারি,
নয়ন খুজিছে কেন সেই মুখখানি?
হেরে হারা-নিধি পায়,
হেরিলে প্রাণ যায়;
এমন সরল সত্য কি আছে না জানি।
২২
ফুটিলে প্রেমের ফুল
ঘুমে মন দুল দুল,
আপন সৌরভে প্রাণ আপনি পাগল;
সেই স্বর্গ-নুধা পানে
কত যে আনন্দ প্রাণে,
অমায়িক প্রেমিকে তা জানেন কেবল।
২৩
নন্দন-নিকুঞ্জবনে
বসি শ্বেত শিলাসনে
খােলা প্রাণে রতিকাম বিহরে কেমন!
আননে উদার হাসি,
নয়নে অমৃত রাশি;
অপরূপ আলাে এক উজলে ভুবন।
২৪
পারিজাত মালা করে,
চাহি চাহি স্নেহভরে
আদরে পরসপরে গলায় পরায়;
মেজা গিয়েছে খুলে,
বসেছে দুনিয়া ভুলে,
সুধার সাগর যেন সমুখে গড়ায়।
৪০
সারদামঙ্গল।
এক ভাবেতে ভাের,
কি যেন নেশার ঘাের,
টলিয়ে ঢলিয়ে পড়ে নয়নে নয়ন;
গলে গলে বাহুলতা,
জড়িমা-জড়িত কথা,
যােহাগে সােহগে রাগে গলগল মন।
২৬
করে কর থরথর,
টলমল কলেবর,
গুরুগুরু দুরুদুরু বুকের ভিতর;
তরুণ অরুণ ঘটা
আননে আরক্ত ছটা,
অধর কমল-দল কাঁপে থরথর।
২৭
প্রণয়-পবিত্র কাম,
সুখ-স্বর্গ-মােক্ষ-ধাম।
আজি কেন হেরি হেন মাতােয়ারা বেশ!
ফুলধনু ফুলছড়ি
দূরে যায় গড়াগড়ি;
রতির খুলিয়ে খোপা আলুথালু কেশ!
২৮
বিহ্বল পাগল প্রাণে
চেয়ে সতী পতি পানে,
গলিয়ে গড়িয়ে কোথা চলে গেছে মন;
মুগ্ধ মত্ত নেত্র দুটি,
আধ ইন্দীবর ফুটি,
দুলুদুলু ঢুলুঢুলু করিছে কেমন?
২৯
আলসে উঠিছে হাই,
ঘুম আছে, ঘুম নাই,
কি যেন স্বপন মত চলিয়াছে মনে;
সুখের সাগরে ভাসি
কিবে প্রাণখােলা হাসি।
কি এক লহরী খেলে নয়নে নয়নে।
৩০
উথুলে উথুলে প্রাণ
উঠিছে ললিত তান,
ঘুমায়ে ঘুমায়ে গান গায় দুই জন;
সুরে সুরে সম রাখি
ডেকে ডেকে ওঠে পাখী,
তালে তালে ঢ'লে ঢ'লে চলে সমীরণ।
৩১
কুঞ্জের আড়াল থেকে
চন্দ্রমা লুকায়ে দেখে,
প্রণয়ীর সুখে সদা সুখী সুধাকর;
সাজিয়ে মুকুল ফুলে
আহলাদেতে হেলে দুলে
চৌদিকে নিকুঞ্জ-লতা নাচে মনােহর।
সে আনন্দে আনন্দিনী,
উথলিয়ে মন্দাকিনী,
করি করি কলধ্বনি বহে কুতুহলে।
৩২
এ ভুল প্রাণের ভুল,
মর্মে বিজড়িত মুল,
জীবনের সঞ্জীবনী অমৃত-বল্লরী;
এ এক নেশার ভুল,
অন্তরাত্মা নিদ্রাকুল,
স্বপনে বিচিত্র-রূপা দেবী যােগেশ্বরী।
৩৩
কভু বরাভয় করে,
চাঁদে যেন সুধা ক্ষরে
করেন মধুর স্বরে অভয় প্রদান;
কখন গেরুয়া পরা,
ভীষণ ত্রিশূল ধরা,
পদভরে কাপে ধরা ভূধর অধীর;
দীপ্ত সূর্য্য হুতাশন
ধ্বক্ ধ্বক দুনয়ন,
হুঙ্কারে বিদরে ব্যোম, লুকায় মিহির;
ঘােরঘটু অট্ট হাসি
ঝলকে পাবক রাশি;
প্রলয়-সাগরে যেন উঠেছে তুফান।
৩৪
কভু আলুথালু কেশে
শ্মশানের প্রান্ত দেশে
জ্যোস্নায় আছেন বসি বিষম বদনে;
গঙ্গার তরঙ্গ মালা
সমুখে করিছে খেলা,
চাহিয়ে তাদের পানে উদাস নয়নে।
৩৫
পবন আকুল হয়ে
চিতা-ভস্মরজ লয়ে
শােকভরে ধীরে ধীরে শ্রীঅঙ্গে মাখায়,
শ্বেত করবীর বেলা,
চামেলি মালতী মেলা,
ছড়াইয়ে চারি দিকে কাঁদিয়ে বেড়ায়।
৩৬
হায় ফের বিষাদিনী।
কে সাজালে উদাসিনী।
সম্বর এ মূর্তি দেবী সম্বর সম্বর!
বটে এ শ্মশান মাজে
এলােকেশী কালী সাজে
দানব-রুধির-রঙ্গে নাচে ভয়ঙ্কর।
৩৭
আবার নয়নে জল!
ওই সেই হলাহল,
ওরি তরে জীর্ণজরা জীবন আমার;
গরজি গগন ভােরে
দাড়াও ত্রিশূল ধােরে!
সংহার-মূরতি অতি মধুর তােমার।
৩৮
আমার এ বজ্রবুক,
ত্রিশূলেররা তীক্ষ্ণ মুখ,
দাও দাও বইয়ে এই যন্ত্রণা!
সমুখে আরক্তমুখী,
মরণে পরম সুখী,
এ নহে প্রলয়ধ্বনি, বাঁশরী-বাজনা।
৩৯
অনন্ত নিদ্রার কোলে
অনন্ত মােহের ভােলে
অনন্ত শয্যায় গিয়ে করিব শয়ন,
আর আমি কাঁদিব না,
আর আমি কাঁদিব না,
নীরবে মিলিয়ে যাবে সাধের স্বপন।
৪০
তপন-তর্পণ-আল
অসীম যন্ত্রণা-জাল,
প্রশান্ত অনন্ত ছায়া অনন্ত যামিনী;
সে ছায়ে ঘুমাব সুখে,
বজ্র বাজিবে না বুকে,
নিস্তব্ধ ঝটিকা ঝঞা, নীরব মেদিনী।
৪১
ধাঁধ বুক, ত্যজ ভয়,
পুণ্য এ, পাতক নয়;
খুনে আর পরিত্রাণে অনেক অন্তর।
ভালবাসা তারি ভাল,
সহে যারে চির কাল;
বাঁচুক বাঁচুক তারা হউক অমর।
৪২
হবেনা হবে না আর,
হয়ে গেছে যা হবার,
ধধরো না থােরােনা, বৃথা রুধ না আমাকে।
এ পােড়া পিঞ্জর রাখি
উড়ক পরাণ পাখী,
দেখুক দেখুক যদি আর কিছু থাকে!
ছাড়! আন! যাও যাও!
বেগে বুকে বিঁধে দাও!
ওই সে ত্রিশূল দোলে গগন মণ্ডলে!