সারদামঙ্গল/চতুর্থ সর্গ
[রাগিণী ভৈরবী—তাল ঠুংরি।]
কোথাগাে প্রকৃতি সতী সে রূপ তােমার!
যে রূপে নয়ন মন ভুলাতে আমার।
সেই সুরধুনী-কুলে
ফুলময় ফুলে ফুলে,
বেড়াইতে বনবালা পরি ফুলহার।
নবীন-নীরদ-কোলে
সােণার যে দোলা দোলে,
ক্ষণেক দুলিতে, ক্ষণে পালাতে আবার।
সুধাংশুমণ্ডলে বসি
খেলিতে লইয়ে শশী,
হাসিয়ে ছড়িয়ে দিতে তারকারতন;-
হাসি দিগঙ্গনা গণে
ধরি ধরি সে রতনে
খেলিত কন্দুক-খেলা, হাসিত সংসার।
এ তমান্ধ তলাতলে
কি বিষম জ্বালা জ্বলে,
কেবল জলিয়ে মরি ঘােচেনা আঁধার।
চল দেবী লয়ে চল,
যথা লাগে হিমাচল,
উমার সে রূপরাশি দেখি একবার!
১
অসীম নীরদ নয়;
ও-ই গিরি হিমালয়।
উথুলে উঠেছে যেন অনন্ত জলধি;
ব্যপে দিগ দিগন্ত,
তরঙ্গিয়া ঘােরর,
প্লবিয়া গগনাঙ্গন জাগে নিরবধি।
২
বিশ্ব যেন ফেলে পাছে
কি এক দাড়ায়ে আছে!
কি এক প্রকাণ্ড কাণ্ড মহান ব্যাপার।
কি এক মহান মুর্তি,
কি এক মহান স্মৃত্তি,
মহান উদার সৃষ্টি প্রকৃতি তােমার।
৩
পদে পৃথী, শিরে ব্যোম,
তুচ্ছ তারা সূর্য্য সােম
নক্ষত্র, নখাগ্রে যেন গণিবারে পারে;
সমুখে সাগরাম্ব
ছড়িয়ে রয়েছে ধরা,
কটাক্ষে কখন যেন দেখিছে তাহারে।
কত শত অত্যুদয়,
কতই বিলয় লয়,
চক্ষের উপর যেন ঘটে ক্ষণে ক্ষণে;
হরহর হরহর
সুর নর থরথর
প্রলয়-পিণাকরাব বাজেনা শ্রবণে।
ঝটিকা দুরন্ত মেয়ে,
বুকে খেলা করে ধেয়ে
ধরিত্রী গ্রাসিয়া সিন্ধু লােটে পদতলে।
জ্বলন্ত-অনলছবি
ধ্বক ধ্বক জ্বলে রবি,
কিরণ-জ্বলন-জ্বালা মালা শােভে গলে।
কালের করাল হাসি
দলকে দামিনী রাশি,
কক্কড়্, দন্তে দন্তে ভীষণ ঘর্ষণ;
ত্রিজগত ত্রাহি ত্রাহি;
কিছুই জাক্ষেপ নাহি
কে যােগেন্দ্র ব্যোমকেশ যােগে নিমগন।
ওই মেরু উপহাসি
অনন্ত বরফ রাশি
যুবন্ তপন করে ঝক্ ঝক্ করে!
উপরে বিচিত্র রেখা,
চারু ইন্দ্রধনু লেখা,
অলকা অমরাবতী রয়েছে ভিতরে–
লুকান লুকান যেন রয়েছে ভিতরে॥
ওই কিবে ধবধব
তুঙ্গ তুঙ্গ শৃঙ্গ সব
ঊর্দ্ধমুখে ধেয়ে গেছে ফুঁড়িয়া অম্বর।
দাঁড়াইয়ে পাদদেশে
ললিত হরিত বেশে
নধর নিকুঞ্জ-রাজি সাজে থরে থর।
সানু আলিঙ্গিয়ে করে
শূন্যে যেন বাজি করে
বপ্র-কেলি-কুতূহলে মত্ত করিগণ;
নবীন নীরদমালা
সঙ্গে সঙ্গে করে খেলা,
দশন বিজলী-ঝলা বিলসে কেমন!
ওই গণ্ডশৈল-শিরে
গুল্মরাজি চিরে চিরে
বিকাশে গৈরিক-ঘটা ছটা রক্তময়।
তৃণ তরু লতাজাল,
অপরূপ লালে লাল;
মেঘের আড়ালে যেন অরুণ উদয়।
কাছে কাছে স্থানে স্থালে
নীচ-মুখে উচ-কানে
চরিয়া বেড়ায় সব চমর চমরী,
সুচিকণ শুভ্র কায়
মাছি পিছলিয়া যায়,
অনিলে চামর চলে চন্দ্রিমা-লহরী॥
কিবে ওই মনোহারী
দেবদারু সারি সারি
দেদার চলিয়া গেছে কাতারে কাতার!
দূর দূর আলবালে,
কোলাকুলি ডালে ডালে,
পাতার মন্দির গাঁথা মাথায় সবার।
তলে তৃণ লতা পাতা
সবুজ বিছানা পাতা;
ঘােট ঘােট কুঞ্জবন হেথায় হােথায়।
কেমন পাকম ধরি,
কেকার করি করি,
ময়ূর ময়ুরী সব নাচিয়া বেড়ায়।
মধ্যমে ফোয়ারা ছােটে,
যেন ধূমকেতু ওঠে,
ফরফর তুপড়ি ফোটে, কেটে পড়ে ফুল;
কত রকমের পাখী
কলরবে ডাকি ডাকি
সঙ্গে সঙ্গে ওঠে পড়ে, আহ্লাদে আকুল।
জলধারা বরঝর,
সমীরণ সরসর,
চমকি চরন্ত মৃগ চায় চারি দিকে;-
চমকি আকাশ-ময়
ফুটে ওঠে কুলয়,
চমকি বিদ্যুল্লতা মিলায় নিমিখে।
একি স্থান অভিনব!
বিচিত্র শিখর সব
চৌদিকে আঁড়ায়ে আছে বেরিয়ে আমায়;
গায়ে তরু লতা পাতা
খােললা খােলদা ফুল গাঁথা,
বরফের-হীরকের টোপর মাথায়।
তলভূমি সমুদয়
ফুলে ফুলে ফুলময়,
শিরােপরে লম্বমান মেঘের বিতান;
আকাশ পড়েছে ঢাকা,
আর নাহি যায় দেখা
তপনের সুবর্ণের তরল নিশান,
কেবল বিজলী-মালা
বেড়ায় করিয়ে খেলা;
কেন গাে, বিমানে আজি অমরী অমর।
তােমরা কি সারদারে
দেখেছ, এনেছ তারে
ভূষিতে এ প্রকৃতির প্রাসাদ সুন্দর!
হা দেবী, কোথায় তুমি!
শূন্য গিরি-ফুলভূমি!
কোথায় কোথায়—হায়-সারদা-সারদা!
আর কেন হাস্য-মুখে!
হানাে উগ্র বজ্র বুকে!
কি ঘাের তামসী নিশি!―** ** **
আহা স্নিগ্ধ সমীরণ!
বুঝিলে তুমি বেদন!
বুঝিল না সুলােচনা সারদা আমার!
হা মানিনী! মানভরে
গেছ কোন লােকান্তরে!
বল দেব, বল বল কুশল তাহার!
অয়ি, ফুলময়ী সতী
গিরি-ভূমি ভাগ্যবতী!
অভাগার তরে তব হয় নি সৃজন;
দেখা যদি পাই তার,
দেখা হবে পুনর্ব্বার;
হলেম তোমার কাছে বিদায় এখন॥
ওই ওই ভূভূমে,
আচ্ছন্ন তুহিন ধূমে
রয়েছে আকাশে মিশে অপরূপ স্থান!
আবছা আবছা দেখা যায়
গুহা গোমুখের প্রায়,
পাতাল ভেদিয়া তায় ধায় যেন বান।
ফেনিল সলিলরাশি
বেগভরে পড়ে আসি,
চন্দ্রলােক ভেঙে যেন পড়ে পৃথিবীতে।
সুধাংশু-প্রবাহ পারা
শত শত ধায় ধারা,
ঠিকরে অসংখ্য তারা ছােটে চারি ভিতে!
অসংখ্য শীকর শিলা ছােটে চারি ভিতে।
শৃঙ্গে শৃঙ্গে ঠেকে ঠেকে,
লক্ষে লক্ষ্যে বেঁকে বেঁকে,
জেলের জালের মত হয়ে ছাত্রাকার,
ঘুরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
ফেনার আরশি ওড়ে,
উড়েছে মরাল যেন হাজার হাজার।
২৫
আবরিয়ে কলেবর
ঝরিছে সহস্র ঝর,
ভৃগুভূমি মনােহর সেজেছে কেমন?
যেন ভৈরবের গায়
আাদে উথুলে ধায়
ফণা তুলে চুলে ফণী অগণন।
২৬
নেমে নেমে ধারাগুলি,
করি করি কোলাকুলি,
একবেণী হয়ে হয়ে নদী বয়ে যায়;
ঝরঝর কলকল
ঘাের রাবে ভাঙে জল,
পশু পক্ষী কোলাহল করিয়ে বেড়ায়।
২৭
সিংহ দুটি শুয়ে তটে
আনন আবরি জটে,
মগন রয়েছে যেন আপনার ধ্যানে;
আলসে তুলিছে হাই,
কা’কেও দৃপাত নাই,
গ্রীবাভঙ্গে কদাচিৎ চায় নদী পানে।
২৮
কিবে ভূগু-পাদমূলে
উথুলে উথুলে দুলে
ট’লে ঢ’লে চলেছেন দেবী সুরধনী।
কবির, যােগীর ধ্যান,
ভােলা মহেশের প্রাণ,
ভারত-সুরভি-গাভী, পতিত-পাবনী।
পুণ্যতােয়া গিরিবালা!
জুড়াও প্রাণের জ্বালা!
জুড়ায় ত্রিতাপ-জ্বালা মা তােমার জলে।