পঞ্চম সর্গ।

গীতি।

[রাগিণী বেহাগ-তাল কাওয়ালী।]
মধুর রজনী,
মধুর ধরণী,
মধুর চন্দ্রমা, মধুর সমীর!
ভাগীরথী-বুকে
ভাসি ভাসি মুখে
চলে ফুলময়ী তরী ধীর ধীর।
আলুথালু কেশ,
আলুথালু বেশ,
ঘুমায় কামিনী রূপসী রুচির!
অপরূপ হস
আননে বিকাশ,
অধরপল্লব অলপ অধীর।
জানি কেমন
দেখিছে স্বপন
মধুর-মধুর-মূরতি মদির!



বেলা ঠিক দ্বিপ্রহর।
দিনকর খরতর,
নিঝুম নীরব সব—গিরি, তরু, লতা।
কপােতী সুদূর বনে
ঘুঘুঘু করুণ সুনে
কাঁদিয়ে বলিছে যেন শশাকের বারতা।


তৃষায় ফাটিছে ছাতি,
জল খুঁজে পাতিপাতি
বেড়ায় মহিষ যুথ চারি দিকে ফিরে।
এলায়ে পড়িছে গা,
লটপট করে পা,
ধুকিয়ে হরিণগুলি চলে ধীরে ধীরে।


কিবে স্নিগ্ধ-দরশন,
তরু রাজি ঘনঘন,
অতল পাতালপুরী নিবিড় গহন!
যত দূর যায় দেখা
ঢেকে আছে উপত্যকা,
গভীর গম্ভীর স্থির মেঘের মতন।

8
কায়াহীন মহা ছায়া
বিশ্ব-বিমােহিনী মায়া
মেঘে শশী ঢাকা রাকা-রজনী রূপিণী,
অসীম কানন-তল
ব্যেপে আছে অবিরল ;
উপরে উজলে ভানু, ভূতলে যামিনী।


ঘাের ঘাের সমুদয়,
কি এক রহস্যময়,
শান্তিময়, তৃপ্তিময়, ভুলায় নয়ন ;
অনন্ত বরষাকালে
অনন্ত জলদ জালে
লুকায়ে রেখেছে যেন জ্বলন্ত তপন।


পত্র-র ধরি ধরি
কিরণের ঝরা ঝরি
মাণিক ছড়িয়ে যেন পড়েছে কাননে,
চিকণ শাল দলে
দীপ্ দীপ্ কোরে জ্বলে
তারকা ছড়ান যেন বিমল গগনে।


নভ-চুম্বী শৃঙ্গবরে
ও কি দপ দপ করে !
কুঞ্জে কুঞ্জে দবানল হইল আকুল ;
তরু থেকে তরুপরে,
বন হতে বনান্তরে
ছুটে, যেন ফুটে ওঠে শিমুলের ফুল-
রাশি রাশি শিমুলের ফুল।


অর্চ্চিপুঞ্জ লক লক,
ভ্বক ভ্বক, ধ্বক ধ্বক,
দাউ দাউ ধুধু ধুধু, ধায় দশ দিকে;
ঝল্কা ঝল্কা হল্কা ছোটে,
বোঁবোঁ বোঁবোঁ চর্ক্কি লোটে,
মাতাল ছুটেছে যেন মনের বেটিকে।


দেখিতে দেখিতে দেখ
কেবল অনল এক,
এক মাত্র মহাশিখা ওঠে নিরবধি ;
আগ্নেয় শিখর পরে
যেন ওঠে বেগভরে
ভীষণ গগন-মুখী আগুনের নদী।

১০
দিগঙ্গনা গণ যেন
আতঙ্কে আড়ষ্ট হেন,
অটল প্রশান্ত গিরি বিভ্রান্ত উদাস;
চতুর্দিকে লম্ফে ঝম্পে,
মও যেন রণদম্বে
তােলপাড় কোরে ধায় দারুণ বাতাস
উঃ! কি আগুনমাখা দারুণ বাতাস!


১১
ত্রিলােক তারিণী গঙ্গে,
তরল তরঙ্গ রঙ্গে
এ বিচিত্র উপত্যকা আলাে করি করি
চলেছ মা মহােল্লাসে !
তোমারি পুলিনে হাসে,
সুদূর সে কলিকাতা আনন্দ নগরী।

১২
আহা, স্নেহ-মাখা নাম,
আনন্দ-আনন্দ ধাম,
প্রিয় জন্মভূমি তুমি কোথায় এখন।
এ বিজন গিরি-দেশে
প্রকৃতি প্রশান্ত বেশে
যতই সান্ত্বনা করে, কেঁদে ওঠে মন ;
কেন মা! আমার তত কেঁদে ওঠে মন!

১৩
হে সারদে দাও দেখা ?
বাঁচিতে পারিনে একা,
কাতর হয়েছে প্রাণ, কাতর হৃদয় ;
কি বলেছি অভিমানে
শুনাে না শুনাে না কাণে,
বেদনা দিওনা প্রাণে ব্যথার সময়।

১৪
অহ, অহ, ওহহ, ওহহ,
কি মহা সমারোেহ !
ঘাের-ঘটা মহাছটা কেমন উদার !
নিসর্গ মহান মূর্তি
চতুর্দিকে পায় ঘূর্ত্তি,
চতুর্দিকে যেন মহা সমুদ্র অপার।

১৫
অনন্ত তরঙ্গ মালা
করিতে করিতে খেলা
কোথায় চলিয়া গেছে, চলেনা নজর ;
দৃষ্টিপথ-প্রান্তভাগে
মায়ায় মিশিয়া জাগে
উদার পদার্থরাজি সাজি থরেথর।

১৬
উদার-উদারতর
দাড়ায়ে শিখর-পর
এই যে হৃদয়-রাণী ত্রিদিব-সুষমা !
এ নিসর্গ-রঙ্গভূমি,
মনােরমা নটী তুমি,
শােভার সাগরে এক শােভা নিরুপমা !

১৭
আননে বচন নাই,
নয়নে পলক নাই,
কাণ নাই মন নাই আমার কথায় ;
মুখখানি হাসহাস,
আলুথালু বেশ বাস,
আলুথালু কেশপাশ বাতাসে লুটায়।

১৮
না জানি কি অভিনব
খুলিয়ে গিয়েছে ভব
আজি ও বিহ্বল মত্ত প্রফুল্ল নয়নে।
আদরিণী, পাগলিনী,
এ নহে শশি-যামিনী;
ঘুমাইয়ে একাকিনী কি দেখ স্বপনে।

১৯
আহা কি ফুটিল হাসি।
বড় আমি ভালবাসি
ওই হাসিমুখখানি প্রেয়সী তােমার,
বিষাদের আবরণে
বিমুক্ত ও চন্দ্রাননে
দেখিবার আশা আর ছিল না আমার।

দরিদ্র ইন্দ্রত্ব লাভে
কতটুকু সুখ পাবে,
আমার সুখের সিন্ধু অনন্ত উদার;
কবির সুখের সিন্ধু অনন্ত উদার!


২০
ও বিধু-বদন-হাসি
গােলাপ-কুসুম-রাশি,
ফুটে আছে যে জনার নেশার নয়নে ;
সে যেন কি হয়ে যায়,
সে যেন কি নিধি পায়,
বিহ্বল পাগল প্রায়, বেড়ায় কি বােকেবােকে আপনার মনে,
এস বােন, এস ভাই,
হেসেখেলে চলে যাই
আনন্দে আনন্দ করি আনন্দ কাননে।
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে।


২১
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে।
হে প্রশান্ত গিরি-ভূমি,
জীবন জুড়ালে তুমি
জীবন্ত করিয়ে মম জীবনের ধনে।
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে!

২২
প্রিয়ে সঞ্জীবনী লতা,
কত যে পেয়েছি ব্যথা
হেরে সে বিষাদময়ী মুরতি তােমার !
হেরে কত দুঃস্বপন।
পাগল হয়েছে মন,
কতই কেঁদেছি আমি কোরে হাহাকার !

২৩
আজি সে সকলি মম
মায়ার লহরী সম
আনন্দ সাগর মাজে খেলিয়া বেড়ায়।
দাঁড়াও হৃদয়েশ্বরী,
ত্রিভুবন আলাে করি,
দুনয়ন ভরি ভরি দেখিব তোমায় !

২৪
দেখিয়ে মেটে না সাধ,
কি জানি কি আছে স্বাদ,
কি জানি কি মাখা আছে ও শুভ আননে!
কি এক বিমল ভাতি,
প্রভাত করেছে রাতি ;
হাসিছে অমরাবতী নয়ন-কিরণে!

২৫
এমন সাধের ধনে
প্রতিবাদী জনে জনে,
দয়া মায়া নাই মনে, কেমন কঠোর।
আদরে গেথেছে বালা
হৃদয়-কুম-মালা,
কৃপাণে কাটিবে কে রে সেই ফুলডাের।

২৬
পুন কেন অশ্রুজল !
বহ তুমি অবিরল !
চরণ কমল আহা ধুয়াও দেবীর ।
মানস-সরসী-কোলে
সােণার নলিনী দোলে,
আনিয়ে পরাও গলে সমীর সুধীর।

বিহঙ্গম! খুলে প্রাণ
ধর রে পঞ্চম তান!
সারদামঙ্গল গান গাও কুতুহলে !




ইতি।