সাহিত্যে প্রগতি/বাঙ্গলা সাহিত্যে প্রগতি

বাঙ্গলা সাহিত্যে প্রগতি

ইতিপূর্ব্বে বাঙ্গলাসাহিত্য বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা হইয়াছে, এক্ষণে এই স্থলে আমরা বাঙ্গলা সাহিত্যের আরও কিঞ্চিৎ সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করিব। বাঙ্গলা ভাষা মাগধী-প্রাকৃত প্রসূত; বাঙ্গলার পৌণ্ড্রবর্দ্ধনের ধ্বংসাবশেষ মধ্যে আবিষ্কৃত সর্ব্বপ্রাচীন খোদিত লিপি (Inscription) মৌর্য্য যুগে প্রদত্ত হয় এবং তাহা মাগধী প্রাকৃতে লিখিত হইয়াছে। ইহাতে “সামবঙ্গীয়দের” নেতা গলদনের নামোল্লেখ আছে। তৎপরের খোদিত লিপি সমূহ গুপ্তসম্রাটদের শাসনকালে অনুশাসনরূপে প্রদত্ত হয়। এইগুলি সংস্কৃত ভাষাতেই লিখিত হইয়াছে। এই সময় হইতে খৃঃ ত্রয়োদশ শতাব্দীর দেববংশীয় দনুজমাধব ‘দশরথ’ পর্য্যন্ত সকল অনুশাসনই সংস্কৃত ভাষায় প্রদত্ত। কাজেই মুসলমান যুগের প্রাক্কাল পর্য্যন্ত বাঙ্গলা ভাষার সঠিক স্বরূপ জানিবার উপায় নাই। নেপাল হইতে আবিষ্কৃত “বৌদ্ধ গান ও দোঁহা” নামক তিনখানি পুস্তক অপভ্রংশ ভাষায় অর্থাৎ মাগধী প্রাকৃত ভাঙ্গিয়া যে ভাষা বিবর্ত্তিত হয় তাহাতেই গানগুলি লিপিবদ্ধ হইয়াছে। ভাষাতত্ত্ববিদেরা বলেন, ইহা বাঙ্গলার পূর্ব্বরূপ। অন্যদিকে, “ডাকের বচন” প্রভৃতি ছড়া যাহা বাঙ্গলায় প্রচলিত ছিল তাহা আজকাল বাঙ্গালা-ভাষীর কাছে কতকটা দুর্ব্বোধ্য! এই জন্য কোন শতাব্দীতে বাঙ্গলাভাষা তাহার বর্ত্তমানরূপ পরিগ্রহণ করিয়াছে তাহা নির্ণয় করা দুরূহ। আবার, এই ভাষার মধ্যে কতকগুলি উপ-ভাষাও আছে।

যাহাই হউক মাগধীনিসৃত গৌড়-প্রাকৃত নানা অভিব্যক্তির মধ্য দিয়া বর্ত্তমানের বাঙ্গলা ভাষার আকার ধারণ করিয়াছে, এই জন্য সাহিত্যিকদের মতে বাঙ্গলাসাহিত্য অন্ততঃ প্রায় ১০০০ বৎসরের প্রাচীন। বাঙ্গলার স্বকীয় ব্যক্তিত্বের ইতিহাস ঐতিহাসিকদের মতে খৃঃ সপ্তম শতকে শশাঙ্ক নরপতি হইতে গণনা করা হয়। ইহার পর, নানা আবর্ত্তন ও “মাৎস-ন্যায়” দ্বারা জর্জ্জরিত হইয়া বাঙ্গলা “গোপাল” নামক একজন সামন্তকে রাজপদে বরণ করে। ইঁহার পুত্র ধর্ম্মপাল উত্তর-ভারত হইতে বিন্ধ্য পর্ব্বতমালা পর্য্যন্ত রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার অনুশাসন লিপিতে দাবী করা হইয়াছে। বিভিন্ন প্রদেশের রাজাদের খোদিত লিপিতে, ধর্ম্মপালকে “গৌড়েন্দ্র বঙ্গপতি” এবং প্রতিহার ভোজরাজের সাগরতাল লিপিতে বাঙ্গলার লোকদের “বঙ্গাণ” বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে, আর প্রতিহার বাউকার যোধপুর লিপিতে “গৌড়ান” শব্দ আছে। এই পাল সম্রাটেরা “পঞ্চ গৌড়েশ্বর” উপাধি পান। কিন্তু বাঙ্গলা সাহিত্যে এহেন প্রথম পালযুগের কোন নিদর্শন নাই। ব্রাহ্মণদের কুলুজী গ্রন্থসমূহে অবশ্য তাহাদের উল্লেখ আছে। কিন্তু বাঙ্গলা সাহিত্যে ইতিহাসরূপে পাল রাজত্ব সম্বন্ধে কোন বিবৃতি নাই; আমরা আজ তাহাদের বিষয় যাহা জানিতে পারিতেছি, তাহা বঙ্গ-মগধের এবং অন্যান্য প্রদেশের শিলা ও তাম্র-লিপিসমূহের পাঠোদ্ধারেই প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। কর্ণাটকাগত সেনরাজাদের শাসন কালে ব্রাহ্মণ্যাধিপত্য স্থাপিত হওয়ার ফলে, বৌদ্ধবাঙ্গলার শৌর্য্য-বীর্য্যের ও গুণগরিমার চিহ্ন সমূহ একেবারে নির্লোপ প্রাপ্ত হইয়াছে। এখন “ধান ভানতে মহীপালের গীত” এর পরিবর্ত্তে শিবের গীত গাওয়া হয়। বৈষ্ণব গ্রন্থে দুঃখের সহিত বলা হইয়াছে—

“যোগীপাল, গোপীপাল, মহীপাল গীত।
ইহা শুনিতে যে লোকে আনন্দিত॥"

(চৈতন্য ভাগবত অন্ত্য খণ্ড)।

এই উপায়ে বাঙ্গলার বৌদ্ধ কৃষ্টির সমস্ত চিহ্নই ব্রাহ্মণেরা বিলুপ্ত বা রূপান্তরিত করিয়াছে। এই প্রকারেই বারেন্দ্রের মহাপণ্ডিত চন্দ্রগোমিন বা গোস্বামী [ইঁহারই নামে চন্দ্রদ্বীপের নামকরণ হয়—বর্ত্তমান বাকরগঞ্জ জেলা] যে সংস্কৃত ব্যাকরণ লিখিয়াছিলেন তাহার অস্তিত্ব বাঙ্গলা হইতে বিলুপ্ত করা হইয়াছে। হাজার বৎসর পূর্ব্বে বাঙ্গলায় যে প্রবল বৌদ্ধ-রাষ্ট্র ছিল, তাহার কোন চিহ্ন আজ নাই। ইহা ধর্ম্মাকারে ভীষণ-শ্রেণীসংঘর্ষেরই পরিণাম। এই সময়ের সামাজিক ইতিহাস হইতে বৌদ্ধ দলনের নষ্টকুঠি উদ্ধার করা যায়। রাঢ়দেশের ‘শূর’ এবং পূর্ব্ব-বঙ্গের ‘বর্ম্মণ’ রাজবংশদ্বয় বিদেশাগত এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী। তাহারা বাঙ্গালীর গলায় দাসত্বশৃঙ্খল পরাইতে আরম্ভ করে। পরে কর্ণাটকাগত ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় সেনরা তাহা আরও দৃঢ়বদ্ধ করে। এই সময় হইতে একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদিগের অত্যাচার অন্যদিকে বৌদ্ধবাঙ্গালীদের অসন্তোষ এই উভয়াবস্থার সম্মিলনে মুসলমান-তুর্কিদের দ্বারা গৌড় বিজয় সহজ হয়। এই যুগের বাঙ্গলা সাহিত্যের যাহা কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়—“সূর্য্যের পাঁচালী”, “শূণ্যপুরাণ” ও “ধর্ম্মপুরাণ” ইত্যাদি, তাহাতে আমরা বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বীয় গণশ্রেণীর ও সেই সঙ্গে ধর্ম্মের তৎকালীন অবস্থার সংবাদ পাই। এই ধর্ম্মগ্রন্থে দেবনিরঞ্জনের মৃত দেহের দাহকালে মহামায়ার সহমৃতা হইবার সময়—

“ললাটে সিন্দুর দিল দেবী সীমন্তে সিন্দুর।

* * *

আগেপাছে যান সবে খৈ কড়ি ছাড়িয়া॥”

বর্ত্তমান আচারের সহিত সাদৃশ্য দৃষ্ট হয়। এই যুগের চিত্রই ধর্ম্মমঙ্গলে সন্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা বাঙ্গলা ভাষার Epic বলিয়া বিবেচিত হওয়া উচিত। ইহাতে ধর্ম্মঠাকুরের ভক্ত লাউসেনের যুদ্ধ বিবরণ আছে:

“নৃপতি কহেন বাপু প্রবল হইল রিপু মনদিল মনস্তাপ দূর।
কাঙুরে কর্পূরধল না দেয় ভূমের কর তায় তুমি কর দর্প চুর॥”

(মাণিক গাঙ্গুলীর ধর্ম্মমঙ্গল)

এই যুদ্ধে কাঙুর (কামরূপ) বিজয়ী লাউসেনের সেনাপতি ছিল কালু ডোম। এই মহাকাব্যে দৃষ্ট হয় যে, ডোম সেনাপতি, গৌড়ের সহর কোটাল ইন্দ্রমেটে (বাগ্দী জাতির একটী অংশ), একজন চণ্ডাল ঢেকুরের সহর কোটাল, আর ঢেকুরের সাম্ন্ত ইছাই ঘোষ সম্ভবতঃ গোয়ালা।

এই কাব্য বিষয়ে একটি সমালোচনা উঠিয়াছে যে ধর্ম্মমঙ্গল নামক কাব্যটি দুইশত বৎসর পূর্ব্বে বর্দ্ধমানের মহারাজার অনুরোধে রচিত হয়। ইহা প্রাচীন কালের পুস্তক নয়। ইহা সত্য বটে, এই পুস্তকের ভাষা আধুনিক এবং মোগল যুগের স্মৃতি ইহা বহন করিতেছে, আর লাউসেনের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রাচীন পঞ্জিকাতে কলিযুগের রাজাদের নামের সঙ্গে লাউসেনের নাম উল্লিখিত হইত, এবং তীব্বতের পণ্ডিত তারানাথের “ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম্মের ইতিহাস” নামক পুস্তকে লাউসেনের (লবসেনের) নাম বিশেষ ভাবে উল্লিখিত আছে। ইনি চন্দ্রবংশীয় এবং শেষ পালরাজার মন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু পরে তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া স্বয়ং রাজা হন। এই বংশ চারি পুরুষ পর্য্যন্ত বাঙ্গলায় রাজত্ব করে। এই বংশের রাজত্ব কালেই তুর্কি বক্তিয়ার খিলিজির আক্রমণ হয় এবং এই বংশ তাহাদের অধীন হয়। তারানাথ বলিয়াছেন তিনি তিনজন মাগধী বৌদ্ধ পণ্ডিত দ্বারা লিখিত ইতিহাস হইতে তথ্য-সমূহ সংগ্রহ করিয়া তাঁহার ইতিহাস পুস্তক রচনা করেন। তাঁহার পুস্তকে কর্ণাটকাগত ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় সেন বংশের নামোল্লেখ নাই। অন্য পক্ষে কামরূপের গৌহাটীর ডোম জাতীয় লোকেরা বলে তাহারা কালু ডোমের বংশধর এবং তাঁহার বীরত্বের গাথা তাহারা এখনও গান করে (N. N. Vasu “History of Kamarupa Vol. I. P 211)। পুনঃ, ঢেক্করীয় ঈশ্বর ঘোষ নামক সামন্তের তাম্র লিপিও প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। ইনি বৌদ্ধ ছিলেন কিন্তু জাতি অজ্ঞাত।

তারানাথের এবং ধর্ম্মমঙ্গলের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি বিচারসহ কি না তাহা ঐতিহাসিকেরা স্থির করিবেন (৺বসু বলিয়াছেন তাহা কতকটা বিচারসহ বটে; উক্ত পুস্তক দ্রষ্টব্য)। কিন্তু আমাদের ধারণা ইহা বৌদ্ধযুগের অতীত স্মৃতি বহন করিতেছে। বৌদ্ধ ধর্ম্মপূজা উপলক্ষ্য করিয়াই মাণিক গাঙ্গুলী এই কাব্য রচনা করেন। ইহাতে অতীত জনশ্রুতির ঘটনাবলীর সমাবেশ করা হইয়াছে। এইসব পুস্তকে ও জনশ্রুতিতে তৎকালীন সমাজের চিত্র প্রতিফলিত হইয়াছে।

আর্য্যমঞ্জুশ্রী কথিত পালরাজাদের জাতি (দাসজীবিনঃ) ও ধর্ম্মমঙ্গল সমূহে উল্লিখিত তাহাদের সামন্ত কর্ম্মচারীদের জাতি (দিব্বোক কৈবর্ত্ত জাতীয় ছিলেন) দেখিয়া তৎকালীন বাঙ্গলার সমাজের স্বরূপ কিঞ্চিৎ বোঝা যায়। আজ যাহারা অধঃপতিত সেই সময়ে তাহারাই উচ্চবর্ণের ও শাসক শ্রেণীর ছিলেন। পূর্ব্বে সামবঙ্গীয়দের কথা উল্লিখিত হইয়াছে, ভাঃ ভাণ্ডারকারের ব্যাখ্যানুসারে ইহা কতকগুলি কৌমের (Tribe) সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান, ইহার মধ্যে পৌণ্ড্রবর্দ্ধনের পৌণ্ড্রজাতিও ছিল। কিন্তু আজ যাঁহারা প্রাচীন পৌণ্ড্রদের বংশধর বলিয়া দাবী করেন এবং পদ্মরাজ, পোদ, পৌণ্ড্র ক্ষত্রিয় প্রভৃতি নামে নিজেদের পরিচিত করেন তাঁহারা আজ ব্রাহ্মণদের কাছে পতিত বলিয়া গণ্য! এই যে বাঙ্গলার সামাজিক পট সেনযুগ হইতে ক্রমশ: পরিবর্ত্তিত হইয়া বর্ত্তমান আকার ধারণ করিয়াছে, সেই নির্ম্মম পরিবর্ত্তনের কোন স্মৃতিই বাঙ্গলা সাহিত্যে নাই। তৎপরে ব্রাহ্মণাধিপত্যের যুগে আমরা উচ্চশ্রেণীর শৈবধর্ম্ম ও গণ শ্রেণীদের ধর্ম্মের সংগ্রাম ‘মনসার ভাসান’ পুস্তকে দেখিতে পাই।

ঐতিহাসিকদের মতে বাঙ্গলার পালরাজারা মহাযানী বৌদ্ধ ছিলেন, তাঁহারা বুদ্ধ ভট্টারকের নামে ব্রাহ্মণদের দান করিতেন (মদন পালদেবের মনহলি, লিপি), “আর ভগবান সিদ্ধার্থদেবের সিদ্ধি প্রজাবর্গের সর্ব্বোত্তম সিদ্ধি বিধান করুক” (ধম্মপালের খালিমপুর লিপি) বলিয়া অনুশাসন প্রদান করিতেন। এই মহাযানেরই একটী শাখার নাম ছিল “মন্ত্রযান”; এই সম্প্রদায়টি তান্ত্রিক নাগার্জ্জন, কাহ্নুপাদ, সরোরুহপাদ, শবরী ও তাঁহার দুই ডাকিনী (সিদ্ধ্যা যোগিনী, প্রকৃতি বা শক্তি) গুণি ও লোগী, মীননাথ, মচ্ছেন্দ্রনাথ, চৌরঙ্গীনাথ, গোরক্ষনাথ প্রভৃতি সিদ্ধেরা ভারতে সর্ব্বত্র তন্ত্রের প্রচার করিতেন ও আলকেমী দ্বারা পিত্তলকে সোনাকরা, পারাভস্ম দ্বারা ব্যাধি আরোগ্য করা, চক্ষুর ঔষধ আবিষ্কার করিয়া ব্যায়রাম আরোগ্য করান, অমৃতসিদ্ধি, আকাশে উড়িয়া যাওয়া প্রভৃতির অলৌকিকত্ব প্রদর্শন করিয়া নিজেদের সিদ্ধত্ব প্রদর্শন করিতেন এবং শেষে সশরীরে স্বর্গে অন্তর্ধান করিতেন। এই সব যোগীদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তীর্থিক তান্ত্রিকেরা (অ-বৌদ্ধ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদীয় তান্ত্রিকেরা)। ইহাদের সিদ্ধির তেজাপেক্ষা বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের সিদ্ধির তেজ বেশী ছিল বলিয়া বৌদ্ধেরা দাবী করিতেন। বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের ম্যাজিক (অলৌকিক ক্রিয়া) বেশী কার্য্যকরী হইত বলিয়া তাঁহারা গর্ব্ব করিতেন। কিন্তু এই সব দলের মতের কলহ বাঙ্গলা সাহিত্যে লিপিবদ্ধ হয় নাই। ব্রাহ্মণ্যবাদীয়েরা তাঁহাদের তন্ত্রমত সংস্কৃতে লিখিয়াছেন, বৌদ্ধেরাও তদ্রূপ হয় সংস্কৃত না হয় তৎকালের প্রাকৃতে লিখিয়াছেন।

এই সময়ে “সহজ যান’ নামে আর একটি শাখা মহাযান হইতে বিনির্গত হয়। তাঁহাদের মত যাহা তৎকালীন অপভ্রংশ ভাষায় লিখিত হয়, তাহাই ৺হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় দ্বারা “বৌদ্ধ গান ও দোঁহা” বলিয়া প্রকাশিত হয়। এই সব ধর্ম্ম কলহের কোন সংবাদ আমরা বাঙ্গালা সাহিত্যে পাই নাই। এই মন্ত্রযানী বৌদ্ধদের কার্য্যের সংবাদ তিব্বতের লামা তারানাথ (ইনি ত্রিপুরা জেলার শূদ্রবংশীয় সিদ্ধ জ্ঞান মিত্রের প্রশিষ্য) তাঁহার “মণিকের খণি”[] নামক পুস্তকে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। এইজন্য আমরা ইহাঁদের বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। কিন্তু হালে “গোরক্ষ বিজয়” ও “মীন চেতন” নামে পুস্তকসমূহ আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা বাঙ্গলা সাহিত্যের অন্তর্গত এবং মহাযানী বৌদ্ধদের কিঞ্চিৎ সংবাদ প্রদান করে। এই সব সংবাদে আমরা ‘হাড়ীপ্পা,’ ‘কানফা’ নামক নীচ বংশীয় সিদ্ধদের রাজবংশে গুরুগিরি করিতে দেখি। বৌদ্ধদের পুস্তক হইতে আমরা এই তথ্য সংগ্রহ করি যে এই সব সিদ্ধদের অনেকে নীচবংশীয় ও শূদ্রবর্ণের ছিলেন এবং প্রচলিত সামাজিক আচার ভঙ্গ করিয়া জীবন যাপন করিতেন। জনসাধারণের উপরে তাঁহাদের প্রভাব ছিল।

এই যুগের সামাজিক শ্রেণীসমূহের অবস্থা অনুসন্ধান করিলে আমরা নিম্নলিখিত সংবাদ পাই। বাঙ্গলার অভিজাতবর্গ হয় মহাযানী না হয় ব্রাহ্মণ্যবাদীয় তান্ত্রিক ছিল। আর গণ সমূহ হীনযান, সহজযান, নাম ধর্ম্ম ও অন্যান্য পন্থাবলম্বী ছিল। পরে, সেন রাজাদের সময়ে ব্রাহ্মণ্য শাসন প্রতিষ্ঠিত হইলে বাঙ্গলার ব্রাহ্মণদের, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মে বিশ্বাসী ও লোকের কদাচার দূরীভূত করিবার জন্য, রাজা লক্ষ্মণসেন ধর্ম্মাধ্যক্ষ হলায়ুধ দ্বারা “ব্রাহ্মণ সর্ব্বস্ব” ও পশুপতি দ্বারা “মৎসসূক্ত” প্রণয়ণ করান। অবশ্য এই দুই পুস্তক সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হয়। প্রথম পুস্তক হইতে আমরা এই সংবাদ পাই যে বাঙ্গলার বারেন্দ্র ও রাঢ়ীশ্রেণীর ব্রাহ্মণেরা বৈদিকাচার হইতে ভ্রষ্ট হইয়া তান্ত্রিকাচারে নিমজ্জিত হইয়াছিল; আর দ্বিতীয়টিতে আমরা এই সংবাদ পাই যে, বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের ব্যবহারিক আচার ও রীতি, কদাচার বলিয়া বর্ণাশ্রমীয়দের কাছে নিন্দনীয় হইত। এতদ্বারা ইহা স্পষ্টভাবে বোধগম্য হয় যে, বর্ণাশ্রমী এবং সনাতনী ব্রাহ্মণ্য শাসনাধীনে বাঙ্গলায় ধর্ম্মকলহের দুন্দুভী বাজিয়া উঠিয়াছে। অবশ্য এই ধর্ম্ম কলহের পশ্চাতে শ্রেণী সংঘর্ষ লুক্কাইত ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদীয় শাসনের প্রতিষ্ঠার সময়ে আমরা স্পষ্ট দেখি যে অভিজাতদের সহিত গণসাধারণের সংঘর্ষ হইতেছে।

বাঙ্গলা সাহিত্যে ধর্ম্ম সংঘর্ষের নজীর পূর্ব্বোক্ত ছড়ায় যেমন পাওয়া যায়, এই যুগের সাহিত্যেও এই প্রকারের ধর্ম্ম-সংগ্রামের দৃষ্টান্ত আছে। এই সময়ের আভিজাতেরা হয় শৈব নয় শাক্ত ছিলেন; তাই “মনসার ভাসান” গ্রন্থে ধনী চাঁদ সওদাগর ঘৃণায় বলিতেছেন:—

“যে হাতেতে পূজি আমি দেবশূল পাণি।
সে হাতে পূজিব আমি কাণি চ্যাঙ্গমুড়ি॥”

পুনঃ, ছদ্মবেশী দেবতা বেহুলাকে বলিতেছেন:

“ব্রাহ্মণ না চিন তুমি বণিক জাতির দোষে।”

(নারায়ণ দেবের “পদ্মপুরাণ")

এইসব পুস্তকে শ্রেণী-সংঘর্ষকে ধর্ম্মসংঘর্ষরূপে প্রকট করা হইয়াছে। মনসাপূজা (মনসা বাঙ্গলায় অতি প্রাচীনকাল থেকেই পূজা পাইতেছে) লোক-সাধারণ মধ্যে প্রচলিত ছিল, কিন্তু পৌরাণিক ধর্ম্মাবলম্বী অভিজাতেরা ব্রাহ্মণ্যবাদীয় ধর্ম্মাবলম্বন করিয়া সাধারণের এই ধর্ম্মকে তাচ্ছিল্য করিত, সেই জন্য মনসাদেবীও নিজের শক্তি প্রদর্শন করিবার জন্য ধনীদের প্রতিনিধি চাঁদ সওদাগরের প্রতি নির্য্যাতন আরম্ভ করেন। চাঁদও নাছোড় বন্দা, সে বলিল,

“যা করেন শিবশূল, এবার পাইলে কুল
মনসারে বধিব পরাণে!”

কিন্তু অবশেষে মনসারই জয় হয়। এই আখ্যায়িকার মধ্যে আমরা এই তথ্য পাই যে বাঙ্গলার প্রাচীন কৌমগত ধর্ম্ম (Tribal Religion বা Animistic Religion) আর্য্যভাষীদের বেদপ্রসূত ধর্ম্ম দ্বারা নিষ্পিষ্ট হইতেছিল; আর্য্য সভ্যতাপ্রাপ্ত অভিজাতেরা নিজেদের কৃষ্টি লোক সাধারণের উপর চালাইতেছিল। কাজেই এই সংঘর্ষ ধর্ম্ম-সংগ্রামরূপে “ভাসান” গ্রন্থসমূহে পাই। এইসব পাঁচালী ও গ্রন্থসমূহ মধ্যে আমরা গণশ্রেণীগুলির সংবাদ পাই। এই যুগে ব্রাহ্মণদ্বারা বাঙ্গলা সাহিত্যকে পুষ্ট করিতে দৃষ্ট হয় না। হালে, “কৃষ্ণ-কীর্ত্তন” বা (কৃষ্ণধামালী) নামে অনেক কৃষ্ণ-বিষয়ক গান আবিষ্কৃত হইয়াছে, ইহা উত্তর বঙ্গে প্রচলিত ছিল। এইগুলি জনসাধারণের মধ্যে গীত হইত। কিন্তু এইগুলি মধ্য থেকে আমরা বাঙ্গলার সামাজিক কোন সংবাদ উদ্ধার করিতে পারি না। তবে এইটুকু বোধগম্য হয় যে বৈষ্ণবধর্ম্ম বাঙ্গলায় চৈতন্যের পূর্ব্ব থেকেই ছিল। সম্ভবতঃ গণশ্রেণীর মধ্যে ইহার প্রসার হয়।

ঐতিহাসিকেরা বলেন, মুসলমান রাজারাই বাঙ্গলা সাহিত্যের স্রষ্টা। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা গৌড়-প্রাকৃত ভাষাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন। মুসলমান রাজাদের প্রচেষ্টাতেই রামায়ণ প্রভৃতি বাঙ্গলায় লিখিত হয়। কবি কৃত্তিবাস বলিয়া গিয়াছেন গৌড়ের এক হিন্দু রাজার অনুজ্ঞাতেই তিনি রামায়ণ বাঙ্গলায় লিখিতে আরম্ভ করেন। আবার সম্রাট হুসেন সাহের সভাসদ গুনরাজ খাঁ “শ্রীকৃষ্ণবিজয়” নামক গদ্যে এক বাঙ্গলা পুস্তক প্রণয়ন করেন। ইহার দেখাদেখি “রসুল-বিজয়” নামে এক পুস্তক সেখ চাঁদ নামক এক মুসলমান কবিদ্বারা লিখিত হয়। এই পুস্তক পাঠেই বোধগম্য হয়, কি প্রকারে হিন্দুকে মুসলমান করিয়া তাহাকে ‘অভারতীয়’ করা হইত। ইহাতে তৎকালের একটি চিত্র পাওয়া যায়। এই সমসাময়িক কালেই মহাভারত বিভিন্ন লোক দ্বারা বাঙ্গলা কাব্যে লিখিত হয়।

এইসব পুস্তকে আমরা তৎকালীন সামাজিক মনস্তত্ত্বের এক চিত্র পাই। কিন্তু এইসব সাহিত্য আদর্শবাদীয় ছিল, তজ্জন্য ইহারা Ideational লক্ষ্মণ যুক্ত বলিয়া গণ্য হইবে। রামায়ণ ও মহাভারতের মূলের ওজঃ ও স্পর্দ্ধা অনুবাদে নাই, স্বদেশ ও স্ববংশদ্রোহী বিভীষণ বাঙ্গলা রামায়ণে পরম বৈষ্ণব মহাপুরুষে পরিণত হইয়াছেন, বিধবা মন্দোদরী পুনরায় বিভীষণের ভার্য্যা হন; কারণ “রাজার স্ত্রীকে রাজায় নিবে, ইহা নহে অপরাধ।” এই বাক্য রামের মুখ দিয়া বাহির করা হয়। ইন্দ্রজিত মৃত্যুকালে বিভীষণকে স্বধর্ম্ম ও জ্ঞাতিদ্রোহী বলিয়া অনুযোগ করে (মাইকেলের মেঘনাধ বধেই আসল অনুবাদ প্রদত্ত হইয়াছে)। কিন্তু বাঙ্গলায় তাহা নাই। তখন হিন্দুর ঘর ঘর বিভীষণ হইতেছে, আর ভারতে বিজেতা রাজা বিজীতের রাণী ও অন্তঃপুর লুণ্ঠন অনেকদিন থেকেই করিতেছে; এইসব অনুষ্ঠান লোকের গা সওয়া ব্যাপার হইয়াছে। পুনঃ, তখন রাজত্বসমূহ কিয়ৎ দিনের জন্য সমৃদ্ধিশালীরূপে বিরাজ করিতেছে, তৎপরই বিজেতা আসিয়া তাহা ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। কীর্ত্তিবাসের রামায়ণে তাহার প্রতিবিম্ব পাই:

“লঙ্কায় আসিয়া দেখে ছিন্নভিন্ন সব।
নাহিক সে নৃত্যগীত নাহিক উৎসব।”

বাঙ্গলায় পাল ও সেন রাজাদের কীর্ত্তিচিহ্ন সমূহ বিলুপ্ত হইয়াছে, তাহাদের জনশ্রুতিও লোকে ভুলিয়াছে। রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতিতে যে করুণ সুর প্রাপ্ত হওয়া যায়, তখন বাঙ্গলার বিজীত হিন্দুর মর্ম্মবেদনার প্রতিধ্বনিই তাহাতে পরিদৃষ্ট হয়। পুনঃ, এই যুগের রাজনীতিক সামাজিকচিত্র আমরা বিজয় গুপ্তের “পদ্মাপুরাণ’ গ্রন্থে পাই। তাহাতে বিজেতৃ শাসক-শ্রেণীর অত্যাচার বর্ণিত আছে, এবং সমসাময়িক সামাজিক চিত্রও তাহাতে পাওয়া যায়। এই প্রকারের সাহিত্যকে Mixed লক্ষণযুক্ত বলা হয়। বাঙ্গলার মুসলমান যুগের বড় সাহিত্যিক সৃষ্টি হইতেছে—বৈষ্ণব সাহিত্য। ইহা চণ্ডীদাস হইতে আরম্ভ হইয়া শ্রীচৈতন্যের শিষ্যদের দ্বারা পরিপুষ্ট। উত্তর-ভারতে হিন্দুর রাজনীতিক পতনের পরই, বৈষ্ণব-সাহিত্যর আবির্ভাব হয়। পশ্চিমে হিন্দিভাষীদের মধ্যে রাজপুত বীরগাথা সমূহ “ডিঙ্গল” নামক উপভাষায় লিখিত হয়; কিন্তু হিন্দুর পতনের পর মার্জ্জিত “পিঙ্গল” ভাষায় (ব্রজ ভাষা) কৃষ্ণ-বিষয়ক ধর্ম্মসংক্রান্ত গাথা সমূহ রচিত হইতে থাকে। এতদ্বারা ব্রজভাষায় একটী মহান বৈষ্ণবসাহিত্য সৃষ্টি হয়। তদ্রূপ পূর্ব্বে, মৈথিলী ভাষায় বিদ্যাপতি শ্রীকৃষ্ণের অভাবে শ্রীমতীর বিরহ বিষয়ক পদাবলী রচনা করিতে থাকেন। সেই সময়ে বাঙ্গলায় চণ্ডীদাসও রাধার বিরহ বিষয়ে পদাবলী লিখিতে থাকেন। সমালোচকেরা বলেন, পূর্ব্বোক্ত অনেক কৃষ্ণ-কীর্ত্তনের পদসমূহ মার্জ্জিত করিয়া চণ্ডীদাস স্বীয় পদাবলীতে গ্রহণ করিয়াছেন। যাহাই হউক, মুসলমান বিজয়ের পরই আমরা উত্তর ভারতে বৈষ্ণব-সাহিত্য রচিত হইতে দেখি।

এক্ষণে কথা, এই বৈষ্ণব-সাহিত্যের স্বরূপ কি? ইহা গুপ্তসম্রাটদের যুগের, বৈষ্ণব ধর্ম্মের সাহিত্য নয়। এই সাহিত্যের তথ্য হরিবংশ ও শ্রীমদ্ভাগবতগীতার সহিত এক নয়। ইহা রাজনীতিককার দ্বারকার শ্রীকৃষ্ণকে জানে না। ইহা “চিকণ কালা, গলায় মালা, বাজে নুপুর পায়ে” (মহাজন পদাবলী) কৃষ্ণের কথাই জানে। ইহা বৃন্দাবনের বালগোপাল, যশোদানন্দন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীমতীর প্রেমিকের প্রেম বর্ণনায় পূর্ণ। এই সাহিত্যে উভয়ের প্রেম, বিচ্ছেদ ও পুনমিলনের সঙ্গীত আছে। একদল গবেষক, বলেন, এই নব-বৈষ্ণব ধর্ম্মে ও সাহিত্যে মুসলমানীয় সুফীদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সুফীতত্ত্বীয় আশক্ ও মাসুকের প্রেমকেই হিন্দু আকারে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম কাহিনীতে সমূর্ত্ত করা হইয়াছে। এই বিষয়ে যে সত্যই থাকুক, এইস্থলে আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় হইতেছে, হিন্দুর মধ্যে কেন নব-বৈষ্ণব ধর্ম্মানুযায়ী সাহিত্যের উদ্ভব হয়। উত্তরের হিন্দুর পরাধীনতার কালেই এই সাহিত্যের উদ্ভব দেখিয়া তাহার বিশ্লেষণ করিলে আমরা হিন্দুর পরাধীনতার মনোবেদনাই ইহাতে পরিস্ফুট হইতে দেখি। শ্রীমদ্ভাগবতে রাধা নাই, জয়দেবে রাধা আছে কিন্তু অন্যরূপে আছে। অন্য দিকে চণ্ডীদাস হইতে খাঁটি বাঙ্গলা সাহিত্যে আমরা ক্রন্দনরতা বিরহী রাধার আবির্ভাব হইতে দেখি। রাধার বিরহই পরাধীনতার যুগ হইতে বৈষ্ণব সাহিত্যে বড় স্থান অধিকার করে। এই সাহিত্যের প্রতিপাদ্য হইতেছে, রাধার অভিসার এবং প্রিয়ের অদর্শনে বিরহ, অবশেষে পুনমিলন। এই পদাবলীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করিলে দুই অর্থই ধরা পড়ে। হতাশ প্রেমিকা যে বিলাপ করিতেছেন, তাহা হতাশ স্বদেশ প্রেমিকের বিলাপ রূপেও গ্রহণ করিতে পারা যায়। চণ্ডীদাসে প্রেমিকা বলিতেছেন—

“সুখের লাগিয়ে এ ঘর বাঁধিনু,
অনলে পুড়িয়া গেল····
সাগর শুখাল মাণিক লুকাল
অভাগীর করম দোষে”।

এই দুঃখ হতাশ স্বদেশপ্রেমিকও করিতে পারেন। এই যুগে পরাধীনতার মনোবেদনা ধর্ম্মের ভাষায় প্রিয়জনের অদর্শনে (স্বাধীনতার বিলুপ্তি) বিরহীর (হিন্দুজাতি) মাথুরের (বিচ্ছেদ) হা-হুতাস ক্রন্দনের মধ্য দিয়া প্রকট হইয়াছে। যখন বিদ্যাপতি গাহিলেন—

“হরি কি মথুরা পুরে গেল,
আজ গোকুল শুন্য ভেল।
রোদিতি পিঞ্জরে শুকে,
ধেনু ধাবই মাথুর মুখে।
অবসোই যমুনার কুলে।
গোপগোপী নাহি বুলে!”

তখন স্বাধীনতার বিলুপ্তি কি এই বিরহের অবিদিত মনে (Unconscious mind) কার্য্য করে নাই? বিদ্যাপতির মাথুর বাঙ্গলার মহাজন পদাবলীতে আরও বিষদভাবে পরিস্ফুট হয়। সেই জন্য ৺দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় বলিয়াছেন, “বৈষ্ণবের মাথুর গান···অপর দিকে বঙ্গের তৎকালিক ইতিহাস সেই বিয়োগান্ত দৃশ্যের উপাদান যোগাইয়াছে। কত বিয়োগান্ত নাটকের সার নিংড়াইয়া যে “মাথুর” গান রচিত হইয়াছিল, তাহা বলিবার নহে। ····বিজয় সেনের (প্রথম সেনবংশীয় রাজা) প্রদ্যুম্নেশ্বরের মন্দিরের নিকটবর্ত্তী প্রমোদ উদ্যানে অভিসারিকাগণ··· যে লীলা করিয়াছিলেন, জয়দেবের চক্ষে ছিল সেই দৃশ্য। কিন্তু পরবর্ত্তী কবিগণের শ্রেষ্ঠ নায়িকার নিরাভরণা যোগিনীর বেশ··· কৃষ্ণবিরহে তিনি সর্ব্বস্ব ত্যাগিণী··· এই “সর্ব্বত্যাগিণীর নিরাভরণরূপ তখন বঙ্গের আকাশে বাতাসে খেলিতেছিল” (বৃহৎ বঙ্গ—২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৯৮—৯৯৯)।

পরাধীনতার শৃঙ্খল যে তৎকালীন হিন্দু ভাবুকের মনে জগদ্দল পাথরের চাপ বসাইয়াছিল, তাহা জয়দেবের ও চণ্ডীদাসের কল্কি অবতারের বর্ণনার পার্থক্যেই প্রকাশ পায়। যে স্থলে জয়দেব গর্জ্জন করিয়া বলিলেন, “ম্লেচ্ছ নিবহ নিধনে কলয়সি করবালং” সেই স্থলে চণ্ডীদাস গাহিলেন,

“পুন তা ত্যজিয়া, কল্কি অবতার
ধরেন মুরতি কায়া
অশ্বের উপরে, ধরি দুই করে,
সংহার অনুপ ছায়া॥”

এতদ্বারা আমরা দেখি ভাবধারা কত সঙ্কুচিত হইয়াছে। আবার, পরবর্ত্তী সাধক কবি যখন গাহিলেন,

“আজি কালি করি, দিবস গোঙইতে,
জীবন ভেল অতি ভার॥

* * *

দিবস দিবস করি, মাস বরখি গেল,
বরিখে বরিখে কত ভেল॥ ”

(জ্ঞানদাস পদাবলী)

তখন আমরা ইহাতে স্বদেশ প্রেমিকের আক্ষেপেরই প্রতিধ্বনি বলিয়া অনুমান করি। ফলতঃ বৈষ্ণব সাহিত্যে এবং সমসাময়িক সাহিত্যে তৎকালীন রাজনীতিক সামাজিক পরিস্থিতিজনিত ব্যবহারিকদুঃখ যাহা কবিদের অবিদিত মনে পুঞ্জীভূত ছিল, তাহা পদাবলীর মধ্য দিয়া প্রকাশ পাইয়াছে। এই অনুষ্ঠান জগতে নূতন নহে। পারস্যেও আরব আক্রমণের পরে সুফীবাদের উদ্ভব হয় এবং মঙ্গোল আক্রমণে পারস্য জর্জ্জরিত হইবার পর অতিন্দ্রীয়বাদী সুফী কবিদের বাহুল্য পরিদৃষ্ট হয়।

এই সঙ্গে বাঙ্গলায় চৈতন্যদেব প্রবর্ত্তিত বৈষ্ণব আন্দোলন যখন গঠনমূলক কার্য্যদ্বারা সংঘবদ্ধ হইতে লাগিল, তখন আমরা একটা নূতন সুরধ্বনিত হইতে দেখি। ভক্ত দেবকীনন্দন গাহিলেন—

“জাতির বিচার নাই বৈষ্ণব বর্ণনে···
যত যত হীনজাতি উদ্ভবে বৈষ্ণব।
সভারে বন্দিব,
সভে জগত দুর্ল্লভ”

(বৈষ্ণব বন্দনা)।

পুনঃ, দীন কৃষ্ণদাস গাহিলেন—

“ব্রাহ্মণে যবনে মিলি, করাইল কোলাকুলি,
পরতেকে দেখ একবার”।

বাঙ্গলার বৈষ্ণব সাহিত্যকে আমরা সনাতনী প্রথা মতে Idealistic এবং সোরোকিনের ভাষায় Ideational বলিয়া গণ্য করি।

এইসব সাহিত্যের মধ্য দিয়া বাঙ্গলার সমাজে চৈতন্য নিত্যানন্দের আন্দোলন কি প্রকারে খাম্বিরের (Ferment) ন্যায় কার্য্য করিয়া একটা নূতন ভাবধারার উদ্ভব করিতেছিল তাহা আমরা জানিতে পারি। পুনঃ, এই সময়কার বৈষ্ণব সাহিত্যে বাঙ্গালীত্বের গর্ব্ব (Chauvinism) লক্ষিত হয়। এখনকার বাঙ্গলা আর বৈদিক ঋষিদের গালির পাত্র নয় এবং স্মৃতির অনুজ্ঞানুযায়ী বর্জ্জনীয় নহে। এখনকার বাঙ্গলাকে “পুন্যময় স্থান” বলা হইয়াছে (‘চৈতন্য ভাগবত’); আর জৈনতীর্থঙ্কর বর্দ্ধমান মহাবীর বর্ণিত জঙ্গলপূর্ণ রাঢ় দেশ বহুদিনই অন্তর্হিত হইয়াছে। খৃঃ একাদশ শতাব্দীতে ভবদেবভট্ট বালবলভী রাঢ়কে আর্য্যাবর্ত্তের অন্তর্গত বলিয়াছেন (Inscription of Bengal Vol III), এবং সমসাময়িক শ্রীকৃষ্ণ মিশ্র অত্যুত্তম গৌড় রাষ্ট্রের অন্তর্গত রাঢ়দেশ বলিয়াছেন, (“প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক”) আর চৈতন্য ভাগবতে “রাঢ়দেশের গ্রামসব দেখিতে সুন্দর” বলিয়া বর্ণিত করা হইয়াছে। পুনঃ, “ভক্তি-রত্নাকর” নামক বৈষ্ণব পুস্তকে হিন্দুর সব দেবদেবীও ঋষি এবং অবতারেরা নবদ্বীপে আসিয়া চৈতন্যের জন্মস্থানকে প্রণতি করিয়াছেন। এই সময়ে, বর্ত্তমান বাঙ্গলার হিন্দু সমাজ গঠিত হইতেছে, লেখক এই যুগকে বাঙ্গলার সমাজের দ্বিতীয় সমীকরণকাল (Second Social Integration) বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। তাই বাঙ্গালী Chauvinism এই যুগের সাহিত্যে কিঞ্চিৎ পরিলক্ষিত হয়। এই সময়ের হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সম্পর্ক বিষয়ের একটী বিশিষ্ট সংবাদ তৎকালীন বৈষ্ণব সাহিত্যে পাওয়া যায়। কাজী যখন মুলুকপতির কাছে ঠাকুর হরিদাসের বিপক্ষে নালিশ করেন তখন মুলুকপতি বলিতেছেন:

"আমরা হিন্দুরে দেখি নাই খাই ভাত।
তাহা ছাড় হই তুমি মহাবংশ জাত॥”

(চৈতন্য ভাগবত, আদিকাণ্ড, ১৬।৭২)

এতদ্বারা দৃষ্ট হয় যে মুসলমানদের হিন্দুর সঙ্গে খাইতে আপত্তি ছিল। ইহাতে শ্রেণী লক্ষণ প্রকাশ পায়।

মুসলমান শাসনের প্রাক্কালের বৈষ্ণব সাহিত্যে উল্লেখ আছে যে, দেশের জন সাধারণ নানা প্রকারের পালা গান শ্রবণ করিয়া পুলকিত হইত। চণ্ডী ও মনসার “মঙ্গল” কাব্য ও গীতিকাসমূহ সমগ্র বাঙ্গলায় নানা কবির দ্বারা লিখিত হইয়া গীত হইত। একই মনসার মাহাত্ম্য বর্ণনাজন্য, চাঁদ সওদাগর ও তৎপুত্র লখীন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু এবং পত্নী বেহুলাদ্বারা দেবীর প্রসাদে পুনঃ জীবিত করার গল্প পশ্চিম ও পূর্ব্ববঙ্গে নানা কবির দ্বারা নানা ভাবে লিখিত হইয়াছে। ইহার পর, পূর্ব্ব-বঙ্গের নানা গীতিকামধ্যে রাজনীতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়া নানা গীতিকাব্য লিখিত হইয়াছে। বাঙ্গলার বিভিন্ন জেলায় নানা রাজনীতিক ও সামাজিক সম্বন্ধীয় কাহিনী ও কবিতা এখনও প্রচলিত আছে। বাঁকুড়া ও রঙ্গপুর জেলাদ্বয়ের এই প্রকারে বহু তথ্য অনিসন্ধিৎসুদের দ্বারা সংগৃহীত হইয়াছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সে সব আজও মুদ্রিতাকারে লোকের চক্ষুগোচর হইতে পারিতেছে না।

এই সঙ্গে ইহা বক্তব্য যে বাঙ্গলার সামন্ততান্ত্রিক যুগের গীতিকাব্য বা কবিতাসমূহ এখনও অনিসন্ধিৎসুদের কর্ণগোচর হয় নাই। নিশ্চয়ই রাজপুতনার চারণ-গাথার ন্যায় বাঙ্গলাতেও যুদ্ধ-বিগ্রহের গল্প ও গাথা রচিত হইয়াছিল। দশম বা একাদশ খৃষ্টীয় শতাব্দীর ঈশ্বর ঘোষের তাম্রলিপিই তাহার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। আজও রঙ্গপুরে মহীপালের পালাগান মুসলমান গায়কদের দ্বারা গীত হয়, আজিও ময়ূরভঞ্জে পালরাজাদের গান গীত হয়। (N. N. Vasu “Buddhism in Modern Orissa, Preface দ্রষ্টব্য)। কিন্তু সেনরাজদের সময়ের কোন পালাগান আজিও আবিষ্কৃত হয় নাই, হয়ত বা রচিতই হয় নাই। কেবল সংস্কৃত ভাষায় “বল্লাল চরিত” রচিত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল এবং শ্রীচৈতন্যের সময়ে তাহা শেষ হয় বলিয়া কথিত আছে। কিন্তু ইহার ঐতিহাসিকতা কতটা প্রামাণিক তাহা নির্দ্ধারণ করিবার কোনও উপায় নাই। ইহা সত্য যে, এই যুগে তুর্কি-আক্রমণ ও তাহাদের শাসন প্রবর্ত্তিত হওয়ায় বাঙ্গালীর শৌর্য্যবীর্য্যের কাহিনীর বড়াই করিবার অবকাশ ছিল না কিন্তু পূর্ব্ববঙ্গ ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত স্বাধীন ছিল। দনুজ মাধব (দশরথ) দেবের তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, পরের শতাব্দীর দনুজমর্দ্দন দেব ও তৎপুত্র মহেন্দ্রের টাকা বাঙ্গলার সর্ব্বত্র আবিষ্কৃত হইতেছে। এই যুগেই গৌড়ের স্বাধীন নরপতি গনেশের আবির্ভাব হয়। এই সব রাজনীতিক সুবিধা সত্ত্বেও বীরগাথা বাঙ্গলা ভাষায় রচিত হইল না ইহা বড় আশ্চর্য্যের বিষয়। হঠাৎ বাঙ্গালীর বীণা কেন নীরব হইল তাহার সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান প্রয়োজন।

এই যুগে অর্থাৎ মোগল শাসন বাঙ্গলায় প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্ব্বে বাঙ্গলায় “বীর গাথা” রচিত হইবার পরিবর্ত্তে বিভিন্ন “কুলুজী” গ্রন্থ বিরচিত হয়। ইহার সংগৃহীত পুস্তক হইতে কিঞ্চিৎ নমুনা পূর্ব্বেই উদ্ধৃত করা হইয়াছে। এইসব পুস্তক কেবল “জাতি মারা” গল্পেই পর্য্যবসিত! তদ্বারা তৎকালের ব্রাহ্মণ সমাজের ভয়াবহ অবস্থা বেশ বোধগম্য করা যায়। সকলেই ভীষণ স্পর্শদোষ ভয়ে ভীত। হিন্দুজাতির আর কোন উদ্যম নাই, কেবল কি প্রকারে “জাতি” রক্ষা করা যায় তাহার চেষ্টাতেই সমাজের লোক ব্যস্ত! এতদ্বারা একটা ভীষণ ছুঁচি বাই যেন জাতিকে পাইয়া বসিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া দেখা যায় এই ছুঁচি বাই ভারতে অন্য কোন প্রদেশে আবির্ভূত হয় নাই। বিধর্ম্মীর খাদ্যের গন্ধ শুঁকিলে বা তাহার অঙ্গের সহিত নিজ অঙ্গের স্পর্শ হইলে লোকের জাতিনাশ হয় এই বিধান হিন্দুর শাস্ত্রে নাই, হিন্দুসমাজের অন্যত্রও নাই। এই অনুষ্ঠানের ধর্ম্মের ভিত্তি যখন নাই, তখন ইহার মূল ইতিহাসের অর্থনীতিক ব্যাখ্যায় দেখিতে হইবে।

এই ব্যাপার সম্বন্ধে নবদ্বীপের এক অতি বৃদ্ধ শ্রীপাদগোস্বামী লেখকের কাছে যে আলোক সম্পাত করিয়াছেন তাহা প্রণিধান যোগ্য। তিনি বলেন, মুসলমান বাদশাহদের কাছে হইতে উৎকোচ খাইয়া অনেক ব্রাহ্মণ লোকদের জাতিচ্যুত করিয়া বেড়াইত। এই বিষয়ের প্রমাণও আছে এবং সেই বিষয়ে এক সময়ে তিনি সংবাদপত্রে লিখিয়াছিলেন বলিয়া লেখককে বলেন। কথাটা অসম্ভব নয়, অনেক ব্রাহ্মণ বাদশাহদের কাছ হইতে “লাখেরাজ” জমি ও মোগল যুগে “মদত্‌মাস” জমি প্রাপ্ত হইত। ইহা তাহাদের পাট্টাতেই প্রমাণিত হয়। ইহা আশ্চর্য্যের কথা নয় যে, পরাধীনতার যুগে একদল ধূর্ত্তলোক উৎকোচ খাইয়া অজ্ঞ লোকদের এই প্রকারে জাতি মারিত। এই যখন অবস্থা তখন, স্থানীয় বীরদের গাথা ও প্রসিদ্ধ লোকদের পালাগান রচনা করিবে কে? সামন্তেরা ভূস্বামীরা নিজেদের স্থায়িত্ব বিষয়েই সর্ব্বদা সশঙ্কিত থাকিত (সপ্তগ্রামের রাজা হিরণ্য দাস ও ঠাকুর হরিদাসের জমিদার রামচন্দ্র খানের অবস্থাই ইহার প্রমাণ)। কাজেই অস্থায়ী সামন্তের বিষয়ে পালা গান গাহিবার উদ্যম কোন স্বার্থ প্রণোদিত হইয়া লোকে করিবে? তৎপর সাধারণ গৃহস্থ জাতি রক্ষার চেষ্টাতেই ব্যস্ত। এতৎব্যতীত, একটা বড় কথা, তৎকালীন সমাজের অভিজাতেরা বৌদ্ধ কৃষ্টির সর্ব্বচিহ্ন বাঙ্গলা হইতে মুছিয়া ফেলিতে বাধ্য হন; এই বিষয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীয় ভূস্বামীও ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সহযোগে কার্য্য করিয়াছেন।

নগেনবাবু বলিয়াছেন কান্দি রাজবাটীর কারিকায় লিখিত আছে:—

“বৈদিক আচারে রাজা মহা সুখী হৈল।
বৌদ্ধাচারিগণ প্রতি নির্য্যাতন কৈল॥”

(উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ কাণ্ড)।

অন্যদিকে, স্বাধীন পূর্ব্ববঙ্গের সংবাদ কৃত্তিবাসই বলিয়া গিয়াছেন,

“পূর্ব্বেতে আছিল শ্রীদনুজ (বেদানুজ) মহারাজা।
তার পাত্র আছিল নারসিংহ ওঝা॥
দেশ যে সমস্ত ব্রাহ্মণের অধিকার।
বঙ্গভোগে ভূঞ্জে তিঁহ সুখের সংসার।

এতদ্বারাই বোধগম্য হয় যে তুর্কি আক্রমণের পর, হিন্দু জনসাধারণে কি অবস্থা হইয়াছিল। কাজেই বীরগাথা বা পালা গান কোন হৃদয় হইতে উত্থিত হইবে? তৎপর, ঐতিহাসিক অনুসন্ধানকারীরা বলেন, মানসিংহ ভেদবুদ্ধি প্রণোদিত হইয়া পশ্চিমবঙ্গের রাঢ়ী-শ্রেণীয় ব্রাহ্মণদের মোগলের বিপক্ষতাচরণকারি কায়স্থ সামন্তদের বিপক্ষে লাগান। রাঢ়ীব্রাহ্মণেরা সেই সময় হইতে বিত্তশালী শ্রেণীরূপে গণ্য হন (৺রজনী চক্রবর্তী ‘গৌড়ের ইতিহাস’ এবং ৺হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রবন্ধাবলী, ৺কালী প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মধ্য যুগের বাঙ্গলা’ দ্রষ্টব্য)। অনেক রাঢ়ী ব্রাহ্মণ জমিদার হইলেন, অনেকে ভূমিদান পাইলেন ইত্যাদি। কাজেই কবিকঙ্কন যে মানসিংহকে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ হইয়া তাঁহার পুস্তক উৎসর্গ করিবেন ইহাতে আশ্চর্য্য হইবার কিছু নাই! মানসিংহ এবং তদানীন্তন মোগল গভর্ণমেণ্ট বাঙ্গলার পূর্ব্বের অভিজাতশ্রেণী ধ্বংস করিয়া নূতন একটি তাঁবেদার অভিজাতশ্রেণী সৃষ্টি করেন এবং হিন্দীভাষী পশ্চিমের হিন্দুদের বাঙ্গলায় বাস করান, যাহাতে ভবিষ্যতে আর বিদ্রোহ না সমুত্থিত হয়। এই সব শ্রেণী সংঘর্ষের সংবাদ আমরা বাঙ্গলা সাহিত্যে পাই না। তৎকালীন হিন্দুর পরাজিত মনস্তত্ত্বই আমরা কবিকঙ্কনে ও তৎপরবর্ত্তী সাহিত্যে পাই।

অন্যদিকে কবিকঙ্কনের চণ্ডীকাব্যে পশ্চিম বাঙ্গলার তৎকালীন একটি বাস্তব (realistic) চিত্র প্রদত্ত হইয়াছে। ইহাতে নিখুঁত ভাবে পশ্চিমে বঙ্গের সামাজিক চিত্র পাওয়া যায়। ইহাতে ডিহিদার মামুদ সরিফ নামক মুসলমান রাজকর্ম্মচারীর অত্যাচার, হিন্দু জমিদার দ্বারা বিপন্ন ব্রাহ্মণকে আশ্রয় প্রদান করা, বেণে জাতির সামাজিক প্রথা, ধনীর ধনগর্ব্ব প্রসূত ধর্ম্মতত্ত্ব, ব্যবসায় উপলক্ষে ব্যবসায়ীর সিংহলে গমন, বণিকপুত্রের সিংহলের রাজকুমারীকে বিবাহ, কালকেতুর রাজধানীতে বিভিন্ন জাতির বাসস্থান, নির্দ্দেশদ্বারা হিন্দু ও মুসলমান জাতিদের চিত্র, পর্ত্তুগিস বোম্বেটেদের অত্যাচার, কারণ “রাত্রিদিন বহে যায়, হার্ম্মাদের ডরে,” ইত্যাদি অনেক বাস্তব ও অবাস্তব চিত্র প্রচত্ত হইয়াছে। এই সময়কার সমাজচিত্রের মধ্যে জমিদারের কর্ম্মচারীদের অত্যাচার কবি চণ্ডীর কাছে পশুদের আক্ষেপ মধ্য দিয়া, তৎকালের বাঙ্গলার রাজনীতিক—সামাজিকচিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন যথা: ভালুক বলিতেছে—

“নেউগি চৌধুরী নহি না রাখি তালুক”

পুনঃ দরিদ্রগণের সংবাদ কবি বারমাসই “অভাগী ফুল্লরাকরে উদরের চিন্তা” দ্বারা আমাদের জানাইয়াছেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের কথা এই যে যদিও বাঙ্গলায় সামন্ততন্ত্রের অবসান হইয়াছিল, তত্রাচ সেই প্রাচীন যুগ হইতে সংস্কৃত সাহিত্যে পণ্ডিতেরা যে খাত কাটিয়া দিয়াছেন তাহার মধ্য দিয়া কবিকঙ্কণের চণ্ডীও প্রবাহিত হয়। সেইজন্য যেমন একদিকে চণ্ডীর মহিমা বাড়াইবার জন্য কালকেতু নামক অস্পৃশ্য ব্যধকে রাজা সাজাইয়াছেন, তেমনই প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ভাবধারা নকল করিয়া রাজাধিরাজ কলিঙ্গরাজকেও খাড়া করিয়াছেন, আর কালকেতু হইয়াছেন তাঁহার সামন্ত। কিন্তু তৎকালের হিন্দুর পরাজিত মনস্তত্ব অনুসারে কালকেতুকে যুদ্ধকালে স্ত্রীর পরামর্শে প্রাণের ভয়ে ধানের মরাইয়ের মধ্যে লুক্কাইত করাইয়াছেন।

মুকুন্দরামে তৎকালীন রাজনীতিক ও সামাজিক সংঘর্ষের সংবাদ নাই বটে, কিন্তু এইকাব্যে কায়স্থ ভাঁড়ুদত্তকে যে ভাবে চিত্রিত করা হইয়াছে তদ্বারা কি ইহা প্রতীত হয় না যে তৎকালীন কায়স্থ ও ব্রাহ্মণের শ্রেণী সংঘর্ষ এবং মোগল দ্বারা কায়স্থের দুর্দ্দশাকরণ, রাঢ়ী ব্রাহ্মণ কবির অবিদিত মন থেকে তাহারই প্রতিধ্বনিরূপে এই বর্ণনা নিসৃত হইয়াছে! ইহাকে আমরা সনাতনী মতে Realist impressionist এবং সোরোকিনের মতে Sensate সাহিত্য বলিতে পারি।

মুকুন্দরামের পর, বাঙ্গলা ভাষার বড় কবি ভারতচন্দ্র। ইনি সুবেদার আলীবর্দ্দীখাঁর সমসাময়িক ব্যক্তি। ইঁহার বিদ্যাসুন্দর কাব্যে আমরা প্রাচীন সামন্ততন্ত্রের ছাপ দেখিতে পাই। ইনি তৎকালের কৃষ্ণনগরের জমিদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রিত ব্যক্তি ছিলেন, সেইজন্য মানসিংহের সহিত প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধ বর্ণনাকালে তাঁহাকে বড় করিয়া অঙ্কিত করা স্বত্বেও অনেক ঐতিহাসিক ব্যাপার গোপন করিয়া গিয়াছেন বলিয়া সন্দেহ হয়। ইহার কারণ, প্রতাপাদিত্যের পূর্ব্বতন কর্ম্মচারী ও পরে তাঁহার পতনে মানসিংহ দ্বারা পুরস্কৃত ভবানন্দ মজুমদারই কৃষ্ণনগরের জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তত্রাচ তৎকালীন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী কিঞ্চিৎ তাঁহার লেখার মধ্য দিয়া ধরা পড়ে। যুদ্ধের বর্ণনা কালে যখন তিনি বলিয়াছেন,—

“বুঝিয়া অহিত, গুরু পুরোহিত,
মিলে মানসিংহ সনে”।

তখন আমরা কায়স্থ ও ব্রাহ্মণের শ্রেণী সংঘর্ষ ও মোগল দ্বারা রাঢ়ী ব্রাহ্মণকে কায়স্থের বিপক্ষে লাগাইবার তথ্যের ইঙ্গিত পাই। এই যুদ্ধ বর্ণনার একটি বিশেষ তথ্য হইতেছে যে ইহাতে সেই যুগের হিন্দুর defeatist mentality প্রকাশিত হইয়াছে, তাই কবি বলিয়াছেন:

“পাতশাহি ঠাঠে কবে কেবা আঁটে

* * *

বিমুখী অভয়া, কে করিবে দয়া,
প্রতাপাদিত্য হারে”।

সাহিত্যমধ্যে এই যুগের লক্ষ্য করার বস্তু এই যে, এই যুগের সাহিত্যিকের এই সাহিত্যকে সনাতনী ভাষায় Realistic-impressionist এবং সোরোকিনের ভাষায় আমরা Mixed বা Idealist সাহিত্য বলিতে পারি। বাঙ্গলা ভাষায় একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য রচনা করিলেও সেই প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যিকদের ছাপমুক্ত তাহারা হইতে পারে নাই। তদানীন্তনের ব্যবহারিক বিষয়ের চিত্র তাঁহাদের কাব্যের মধ্যে ফুটিয়া উঠে নাই, তাই ভারতচন্দ্র প্রতাপাদিত্যের সহিত মোগলের যুদ্ধে “সৈন্যেরা মুচড়িয়া গোঁফে শূলশেল লোফে” বলিয়াছেন।

আর একজন সাহিত্যিক সংস্কৃতে প্রতাপাদিত্যের জীবনী রচনাকালে “চন্দ্রবাণ, বায়ুবাণ” প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছেন। এই কালের ঘনরাম চক্রবর্ত্তী তাঁহার ধর্ম্মপুরাণে লাউসেনের কীর্ত্তি গাহিতে গিয়া সংস্কৃত মহাভারতের ঢং তাহাতে ঢুকাইয়াছেন। এতদ্বারা একদিকে যেমন চিন্তা শক্তির অনুর্ব্বরতার পরিচয় প্রদান করে, অন্যদিকে সনাতন ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখিবার চেষ্টাও এই সব ব্রাহ্মণ লেখকদের মধ্যে ছিল বলিয়া অনুমান হয়। এতদ্বারা এইসব লেখকদের কাল ব্যতিক্রম (Anachronism) দোষযুক্ত হইতে দৃষ্ট হয়। ইহার অর্থ, সময়ের বস্তুতান্ত্রিকাবস্থার চিত্র না দিয়া অতীতের ভাবধারা দ্বারা তাঁহারা নিজেদের ভাব ও লেখার পুষ্টিসাধন করিয়াছেন। এতদ্বারা তাঁহাদের সাহিত্যে আমরা প্রগতির নিদর্শন পাই না। এই জন্যই জার্ম্মান সমাজতাত্ত্বিক Oswald Spengler বলিয়াছেন যে, গ্রীক, হিন্দু প্রভৃতি প্রাচীন জাতিরা space and time (জায়গা ও সময়) অগ্রাহ্য করিয়া চলিয়াছিলেন।

বাঙ্গলায় তুর্কি-মুসলমান শাসন প্রবর্ত্তিত হইবার পর থেকে বাঙ্গলায় শক্তি পূজার বাহুল্য পরিলক্ষিত হয়। ভূদেববাবু প্রভৃতি বলিয়া গিয়াছেন, “হিন্দু ধর্ম্ম গুরুরা তাঁহাদের শিষ্যদের শক্তি উপাসক হইতে উপদেশ প্রদান করিতেন”। “মার্কণ্ডেয় পুরাণ” হইতে সুরথ রাজার দুর্গা পূজার অধ্যায়টি পৃথক করিয়া “চণ্ডী” নাম দিয়া বাঙ্গলায় প্রচার করা হয়। যে সুরথ রাজার রাজধানী “কোলবিধ্বংসীরা” বিনষ্ট করিয়া দিয়াছিল, সেই রাজা মহাকোশলের কান্তারে এক ঋষির উপদেশে অকালবোধন করিয়া শক্তি পূজার দ্বারা স্বীয় রাজ্যের পুনরুদ্ধার করেন। এই পূজার উদ্দেশ্য ষড়ৈশ্বর্য্য লাভ করা—“ঘশংদেহি’ ধনং দেহি, দ্বিষোযোহি”—হইতেছে এই পূজার কাম্য। ইহা রাজসিক পূজা, এই শক্তি পূজা নাকি বাঙ্গলার হৃতরাজ্য হিন্দু অভিজাতদের অতিপ্রিয় হয়। “যা দেবী সর্ব্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা” তাহার উপাসনাদ্বারা শক্তি আহরণ করাই ছিল এই শক্তিপূজার কাম্য। ইহার জন্য কয়েকজন আগমবাগীশ দ্বারা তন্ত্র পুস্তক সমূহ সংস্কৃত ভাষায় বিরচিত হয়। এই শক্তিপূজা (শিবপূজা ইহার আনুষঙ্গিক) অভিজাতদের পূজা। কবিকঙ্কনের “চণ্ডী” এই আন্দোলনেরই ফল স্বরূপ, বাঙ্গলায় এই দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হইয়াছে।

গৌড়ের সুলতানদের সময়ে বাঙ্গালীর ভাগ্যে যদি কখন কখন শিকা ছিঁড়িত, (কারণ তুর্কি ও পাঠানের সঙ্গে ভাগাভাগি করিয়া হিন্দু বাঙ্গলা ভোগ করিত) মোগল যুগে তাহা অসম্ভব হয়। সামন্ত রাজারা কর আদায়কারী ঠিকাদারে পরিণত হইলেন। কেন্দ্রীভূত মোগল শাসন বাঙ্গলার ক্ষত্রিয় শক্তির অবসান করায়। সেই সময় হইতে সর্ব্বদিক দিয়া নৈরাশ্যপূর্ণ সুর বাঙ্গলার সাহিত্যে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। মোগল যুগে বৈষ্ণব সাহিত্য পূর্ণতালাভ করে। এই সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমানের সুর মিশিয়া যায়। এই যুগের শতাবধি মুসলমান কবির বৈষ্ণব কবিতা আজ পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত হইয়াছে। সর্ব্বত্র একই সুর, একই রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম ও বিরহের ক্রন্দন। মোগল শাসন শৃঙ্খল বাঙ্গলার হিন্দু ও মুসলমানের গলায় দৃঢ় ভাবেই বসিয়াছিল, উভয় সম্প্রদায়ের পুরাতন অভিজাতেরা বিনষ্ট প্রায়। “সীতারাম চরিত” গ্রন্থে (বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্য দ্বারা প্রণীত) উল্লিখিত আছে যে, যখন পাঠান ডাকাত বক্তার খাঁ সীতারামের কাছে “দ্বৈরথ” সমরে পরাজিত হয়, তখন সীতারাম তাহাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন সে আর লড়িতেছে। তাহাতে তিনি উত্তর করেন, “কি করিব? স্বাধীনতা গেছে, আর করিবার কি আছে!” তখন সীতারাম বলেন যদি হিন্দু ও পাঠানে এক হয়? তাহাতে তিনি প্রত্যুত্তর করেন, “তাহা হলে সবই হয়।” এই বক্তার খাঁই পরে সীতারামের প্রধান সেনাপতি হন, এবং সীতারামের রাজধানী মামুদপুরে আজও তাঁহার কবর আছে।

বাঙ্গলার যখন এই পরিস্থিতি তখন অতিন্দ্রীয়বাদ ও কৃষ্ণে সর্ব্ব সমর্পণ করার ভাব নৈরাশ্যপূর্ণ লোকের মনে স্বভাবতই জাগিয়া উঠিবে। হিন্দু কবি চণ্ডীদাস পূর্ব্বেই গাহিয়াছেন:

“ধিক রহুঁ জীবনে যে পরাধীন জীয়ে।
তাহার অধিক ধিক্ পরবশ হয়ে”।

এখন মুসলমান কবি নাসির মামুদ গাহিলেন:

“আগম নিগম বেদসার,
লীলায় করত গোষ্ঠ বিহার।
নাসির মানুদ করত আশ,
চরণে শরন দানরি”।

আর হিন্দু কবি (জ্ঞানদাস) গাহিলেন:

“সকল ছাড়িয়া মুঞি, শরণ লইনু গো;
কি করির ঘরের বসতি।···
যোগিনীর বেশে, যাব সেই দেশে,
যেখানে নিঠুর হরি”।

এক্ষণে অন্য প্রকারের সাহিত্যেও এই দশা। পূর্ব্বেই আমরা মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্রের রাজনীতিকক্ষেত্রে হতাসতার ভাব পরিলক্ষিত করিয়াছি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্য্যন্ত অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের আগে পর্য্যন্ত “পাতসাহী ঠাঠে কবে কেবা আঁটে” এই ভাব বাঙ্গালীর মনে দৃঢ়ভাবে গ্রথিত হইয়া গিয়াছিল। উদিতনারায়ণ ও সীতারামের স্বাধীনতার উদ্যম, শোভাসিংহ ও রহমৎ খাঁর সমবেত প্রচেষ্টা (ইহা সাধারণতঃ “বাগদী বিদ্রোহ” বলিয়া অভিহিত হয়) ইহার পূর্ব্বে ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। অভিজাতদের এবং গণসমূহের প্রচেষ্টা বৃথায় গিয়াছে। কাজেই পরাজিত মনোবৃত্তি ভাবুকদের অভিভূত করিয়াছে। এমন কি বৌদ্ধ যুগের কাহিনী নিয়া লেখা “ধর্ম্মমঙ্গল”ও এই মনোবৃত্তির হাত এড়াইতে পারে নাই। ঘনরাম চক্রবর্ত্তী ১৭১০ খৃষ্টাব্দে এই কাব্য রচনা করেন। বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলে, এই কাব্যে অতীত বাংলার ও তৎকালীন বাঙ্গালার অনুষ্ঠানও বাস্তবাবস্থাজনিত মনস্তত্ত্ব উভয়ই বিজড়িত রহিয়াছে। একদিকে যেমন অতীত যুগের বাঙ্গালীর বীরত্বের প্রতিধ্বনি এই পুস্তকে আছে, অন্যদিকে সৈনিকের মুখ দিয়া মৃত্যুকালে ক্রন্দনের রোলও ইহাতে ধ্বনিত হইয়াছে।

ইহাতে বর্ণিত আছে লাউসেন যখন সম্রাট ধর্ম্মপাল দ্বারা গৌড়ে আহুত হইয়া কনিষ্ঠভ্রাতার সঙ্গে পথ যাত্রা করিতেছিলেন, তখন অকস্মাৎ এক ব্যাঘ্র আসিয়া পথাবরোধ করে। সেই সময় কনিষ্ঠ পালাইয়া এক বৃক্ষারোহণ করিয়া আত্মরক্ষা করে। পরে, লাউসেন যখন ব্যাঘ্র বধ করিয়া পথ নিষ্কণ্টক করে, তখন ভাই আসিয়া বলে, আমি গৌড়ে গিয়াছিলাম তোমার সাহায্যে ফৌজ আনিবার জন্য। তাহাতে লাউসেন বলেন, “ভ্যালা মোর ভাইরে!” এতদ্বারা তৎকালীন এক ভীরু ও সেই সঙ্গে ধূর্ত্তলোকের পরিচয় প্রদান করা হইয়াছে। আর একবার, সম্রাটের আদেশে অন্যত্র গমন করিবার কালে, তাহার চিরশত্রু ও মাতুল মহামদ সৈন্য নিয়া তাহার গড়ময়নাবতী অবরোধ করে। লাউসেনের ‘কলিঙ্গা’ নামক পাটরাণী অশ্বারোহণে শত্রু বিতাড়নে কেল্লা হইতে বহির্গত হন। শত্রুরা তাঁহাকে কিছুতেই পরাজিত করিতে পারে না, অবশেষে দুর্বৃত্ত মহামদ হুকুম দিল, “মোগল ও পাঠান সৈন্য দিয়া উহাকে ঘিরিয়া ফেলিয়া বন্দী করিয়া ফেল”। মামাশ্বশুর হইয়া এই হুকুম দিল, এই ক্ষোভে তিনি “হারিকিরি” করিয়া অর্থাৎ স্বীয় হস্তে পেট কাটিয়া (‘অভিমানে হানিল জঠর') আত্মসম্মান রক্ষা করেন। তখন লাউসেনের তৃতীয় স্ত্রী “হরি পালের ঝি,” “কানাড়া সুন্দরী” অশ্বারোহণে যুদ্ধে বাহির হন। ইনি হস্তস্থিত লম্বা টাঙ্গী দ্বারা মহামদের মস্তকচ্ছেদন করিতে উদ্যত হন, এমন সময়ে পার্ব্বতী দেবী অনুরোধ করিল, “মামাশ্বশুরের প্রাণ বধ করো না।” মহামদ পরাজিত এবং লাঞ্ছিত হইয়া পলায়ন করিল।

বাঙ্গালী মেয়ের অশ্বারোহণে যুদ্ধের এই গল্প ও আত্মসম্মান রক্ষা জন্য ‘হারিকিরি’ করা মেকলে ও স্টুয়ার্ট প্রভৃতির পুস্তক পাঠ করিয়া যাঁহারা স্বীয় জাতির অতীতের ইতিহাস নির্দ্ধারণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কাছে অবিশ্বাস্য ও গেঁজেলি গল্প বলিয়া প্রতীত হইবে। কিন্তু চক্ষের perception (দৃষ্টি) না হইলে, মনে conception (ধারণা) আসিবে কোথা হইতে? আগে percept পরে তাহার concept ইহাই মনোবিজ্ঞানের বিধান। বাঙ্গলার সার্ব্বভৌমাবস্থার শৌর্য্যের কাহিনী অবলম্বনে এই পুস্তক লিখিত, তাই বীররসের সংবাদ ইহাতে আছে। তৎপর, শাকা নামক কালু ডোমের সৈনিকপুত্রের রাত্রিকালে যুদ্ধ কালীন নিহত হইবার সংবাদ আমরা এই পুস্তকে পাই। মৃত্যুকালীন শাকা ভ্রাতাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছে:—

“গলার কবচ মোর শিঙ্গাদার ধরধর,
দিও মোর যেখানে জননী।
নিশান অঙ্গুরী লয়ে ময়ুরার হাতে দিয়ে,
কয়ো তুমি হলে অনাথিনী।
শুকায় সুবর্ণ ছড়া, বাপেরে ও ঢাল খাড়া,
সমর্পিয়ে সমাচার বলো।
রণে অকাতর হয়ে, শত্রুশির সংহারিয়ে
সম্মুখে সংগ্রামে শাকা মলো।”

এই চিত্রে এক দিকে যেমন, বীরের বীরত্বের সংবাদ পাইতেছি, অন্য দিকে এই স্থানে কান্নার সুর ধ্বনিত হইতেছে। অতীত যুগের বীরত্বের গর্ব্বের সহিত অষ্টাদশ শতাব্দীর বাস্তবিকতা এই স্থলে মিশ্রিত হইয়াছে। এই জন্য মামাশ্বশুর হইয়া “মোগল পাঠান” লেলাইয়া দিল আর মৃত্যুকালীন ঘর সংসারের জন্য ক্রন্দন, উভয়েই গ্রন্থকারের রচনাকালীন সময়ের মনস্তত্ত্বের ছাপ বহন করিতেছে। ৺দীনেশ চন্দ্র সেন উপরোক্ত বাঙ্গালী সৈনিকের ক্রন্দনের সহিত মাথুরের পদের তুলনা করিয়া বলিয়াছেন, মাথুরের “ললিতা লহ কঙ্কন, বিশাখা লহ অঙ্গুরী, চিত্রা সহ নীলমনি চুড়ি” ইত্যাদি পদ মিলাইয়া পড়ুন; বাঙ্গালীর রণক্ষেত্র ও কামকুঞ্জ একযুগে একই বিয়োগান্ত দৃশ্যের অবতারণা করিয়া ছিল। এইজন্য বঙ্গ সাহিত্যময় সর্ব্বত্র একই সুরের সাড়া পাইতেছি। (বৃহৎ বঙ্গ ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৯৮-৯৯৯)।”

বাঙ্গলা ভাষায় ক্লাসিকাল সাহিত্য ব্যতীত গ্রাম্য সাহিত্য বিশেষ ভাবে প্রচলিত ছিল। সেগুলির মূল্যও কম নয়; তাহার মধ্যে অনেক স্থলে ঐতিহাসিক ও সামাজিক সংবাদ সমূহ লুক্কাইত আছে। উত্তর ভারতে যেমন পোশাকী বা সহুরে ভাষার পশ্চাতে গ্রাম্য ‘ঠেঠ’ হিন্দীতে কবিতা সমূহ মুখে মুখে প্রচলিত আছে এবং তন্মধ্যে অনেক সামাজিক সংবাদ প্রাপ্ত হওয়া যায়, বাঙ্গালায়ও তদ্রূপ। বাঙ্গলার প্রত্যেক জেলায় অনেক প্রকারের জনশ্রুতি আছে যাহা লিখিত ইতিহাসের সঙ্গে মিলে না বা তাহার দ্বারা গ্রাহ্য নয়; কিন্তু এই সব জনশ্রুতি অতীতের কিঞ্চিৎ সংবাদ বহন করিয়া আজও আসিতেছে। ঐতিহাসিক সমালোচকেরাই দেখিবেন, ইহা বিচারসহ কি না।

এই সব গ্রাম্য গীতিকার একাংশ “পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা” নামে প্রকাশিত হইয়াছে। এবং কতকগুলি গীতিকা ৺দীনেশচন্দ্র সেন দ্বারা “মৈমনসিংহ গীতিকা” নামে প্রকাশিত হইয়াছে। এইগুলি সবই মোগল যুগে রচিত হইয়াছিল বলিয়া বিবেচিত হয়। ইহার মধ্যে “দেওয়ান ইশা খাঁ”, “দেওয়ান ফিরোজ খাঁ” ও “চৌধুরীর লড়াই” গীতিকা সমূহ আমরা সামন্ততান্ত্রিকযুগীয় যুদ্ধ বিগ্রহের সংবাদ পাই। তদ্রূপ, বাঁকুড়াতে প্রচলিত “চেতোবরদার লড়াই”। ইহা গড়বেতার জমিদার শোভাসিংহ এবং বিষ্ণুপুরের রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের মধ্যে ঘটিয়াছিল। আশ্চর্য্যের কথা, যেটুকু বীরগাথার সংবাদ আমরা বাঙ্গলা ভাষায় পাইতেছি তাহা মোগলদের দ্বারা সামন্ততান্ত্রিক যুগ অবসানের পরই বিরচিত হইয়াছে। এই প্রকারে ভারতচন্দ্র দ্বারা “অন্নদামঙ্গল” কাব্যে প্রতাপাদিত্যের সহিত মানসিংহের যুদ্ধ মোগল যুগের শেষ কালেই লিখিত হইয়াছিল। ইহার কারণ কি?

বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাসে আমারা দেখি বৈষ্ণব সাহিত্য মোগল যুগের পূর্ব্ব হইতেই বিরচিত হয়। পুনঃ, বৈষ্ণব আন্দোলন একটা গণশ্রেণীয় আন্দোলনরূপ ধারণ করে। গণকে ধর্ম্ম দ্বারা জাগ্রত করিয়া তাহাদের ব্যবহারিক অবস্থার উন্নতি করাই ছিল এই আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য[]। আর, এই সাহিত্যের লেখকগণ “জনের” লোক। কাজেই সামন্ত ও জমিদারদের শৌর্য্য বীর্য্য ও কীর্ত্তিকলাপের গুণ কীর্ত্তন করিবে কি? কিন্তু অনুমিত হয় মোগল যুগের মধ্যভাগে বৈষ্ণব সাহিত্য পূর্ণতাপ্রাপ্ত হইয়াছে (“প্রেমবিলাস” সপ্তদশ শতাব্দীতে লিখিত হয়)। তখন যেসব কবি উদয় হইলেন, তাঁহারা অনেকেই জমিদারের আশ্রিত ব্যক্তি (মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র; মৈমনসিংহ গীতিকার কোন কোন কবিও এই প্রকারের ছিলেন বলিয়া অনুমিত হয়, তাঁহাদের লেখার প্রতিপাদ্য বস্তু হইতেই তাহা ধরা পড়ে)। কাজেই তাঁহারা রাজরাজড়ার ঘটনাবলী স্বীয় স্বীয় মাতৃভাষায় লিখিতে আরম্ভ করেন। ইহারই ফলে আমরা বীরগাথার কিঞ্চিৎ নিদর্শন ক্লাসিকাল ও পল্লী সাহিত্যে পাই। এই পল্লীগীতিকায় আমরা প্রচুর তৎকালীন সামাজিক সংবাদ পাই। একটিতে কবি বন্দনা কালে বলিতেছেন, “হিন্দু আর মুসলমান একই পিণ্ডর দড়ি।

কেহ বলে আল্লারসুল কেহ বলে হরি” (নূরন্নেহা ও কবরের কথা। পূর্ব্ববঙ্গগীতিকা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ, ৯৪)। পুনঃ, আর একটিতে কবি বলিতেছেন: “মক্কামদীনা বন্দুলাম কাশী গয়া থান” (পীরবাতাসী: বন্দনা পৃঃ ৩৪১)। আবার আর একটি পালাতে অত্যাচারী রাজার বিরূদ্ধে প্রজাদের সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে বিদ্রোহ করে তাহাকে হত্যা করার কথা আছে (“বীর রামায়ণের পালা,” পৃঃ ৫৩০)। পুনঃ, “কঙ্ক ও লীলা” পালা করুণ বিয়োগান্ত রসে পূর্ণ। ইহাতে দৃষ্ট হয় যে মাতৃহারা ব্রাহ্মণ বালক চণ্ডালিনী দ্বারা পালিত হয়; কিন্তু পরে তাহাকেও হারায়। এক পণ্ডিত ব্রাহ্মণ তাহা জানিতে পারিয়া তাহাকে গৃহে আনয়ন করিয়া রাখালের কর্ম্মে নিযুক্ত করেন। তিনি এতটা সামাজিক উদারতা প্রদর্শন করেন। কঙ্ক নামে এই বালক প্রত্যহ চণ্ডালিনী মাতার উদ্দেশ্যে প্রণাম করিত। কিন্তু যৌবন প্রাপ্ত হইলে এই বালক আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের কন্যা লীলার প্রেমে আসক্ত হয়। লীলাও তাহাকে বিবাহ করিতে মনস্থ করিয়াছিল, কিন্তু পিতার তাহাতে ঘোর আপত্তি। ফলে, কঙ্ক বিতাড়িত হয় কিন্তু, লীলার পীড়া হয়, তখন পিতার চৈতন্য হয়। কিন্তু তখন অতি দেরী হইয়াছে শ্মশানে লীলার পিতার ঘোর অনুতাপ হয়।

এই গীতিকায় কবি প্রদর্শন করিয়াছেন যে প্রেম সামাজিক ব্যবধান করে না, অন্যপক্ষে মানুষগড়া গণ্ডী মানবের কত ক্ষতিকর। এই প্রকারে “ফিরোজ খাঁ” গীতিতে দেওয়ান ইশা খাঁর বংশ পরিচয়, তাহার বংশধর ফিরোজ খাঁর দিল্লীর বাদশাহের বিপক্ষে যুদ্ধঘোষণা করার মনোভাব প্রকাশ, মাতা তাহা নিবৃত্তি করিবার জন্য অন্য এক মুসলমান জমিদারের কন্যার সহিত বিবাহ প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু ফিরোজের হিন্দুবংশে উৎপত্তি বলিয়া এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়; ফলে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই গীতিকাতে উল্লেখ আছে যে ইশাখাঁর সহিত কেদাররায়ের ভগ্নী বা ভাইঝী সোনামণির প্রেমপত্র বিনিময় হইবার পর শেষোক্তটি ইশা খাঁর গৃহে যাইয়া তাঁহার ধর্ম্ম পত্নী হন। “চৌধুরীর লড়াই” গীতিকায় নোয়াখালীর ভূঁইয়া বংশের খুল্লতাত ও ভ্রাতুষ্পুত্রের লড়াই, ইহাতে ভ্রাতুষ্পুত্রের পিতার বন্ধু এক মুসলমান জমিদার তাহাকে সাহায্য করেন। “মহুয়া” গীতিকায় এক ব্রাহ্মণ কন্যা বেদের ঘরে পালিত হয়, এক রাজপুত্র তাহার প্রেমে পতিত হয়, এবং উভয়ে পলায়ন করে। অবশেষে মহুয়ার বেদে ধর্ম্মপিতা রাজপুত্রকে হত্যা করে এবং প্রথমোক্ত আত্মহত্যা করে। এই চিত্রে বেদে জীবন এবং পরের কালের দাম্পত্য প্রেম ফুটিয়া উঠিয়াছে। প্রেম ধর্ম্মের ও সমাজের গণ্ডীর বাধন মানে নাই। “মলুয়া” গীতিতে এক প্রলুব্ধ কাজী দ্বারা বিবাহিতা মলুয়া হরণ বৃত্তান্ত আছে, কিন্তু যখন সে আত্মরক্ষা করিয়া স্বামী গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করে, তখন সে হয় ত্যাজ্য। শেষে সে স্বামীর প্রতি পতিনিষ্ঠার প্রেম জানাইয়া জলে ডুবিয়া মরে। এই স্থলে তৎকালীন সামাজিক অবস্থার ইঙ্গিত প্রদত্ত হইতেছে।

এই প্রকারের পল্লী গীতিকা সম্বন্ধে ৺দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় বলিয়া গিয়াছেন,—"বঙ্গসাহিত্যের সংস্কৃত চিহ্নিত যুগের উপর ব্রাহ্মণ্য প্রভুত্বের যে ছাপ পড়িয়াছে, এই পল্লী সাহিত্যে তাহার কিছুমাত্র নাই।···এত বড় সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ করিলে আমরা কয়টা নায়ক ও নায়িকার মহিমান্বিত চিত্র দেখিতে পাই?···কিন্তু পল্লী গাথার অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনার মধ্যে আমরা তদনুপাতে বহুসংখ্যক চরিত্র-চিত্রণ দেখিতে পাইতেছি, তাহাদের প্রত্যেকটা এক একটা স্বতন্ত্র গৌরবের আসনে স্থিত। চাষাদের কবিত্বশক্তি অদ্ভুত” (“হরপ্রসাদ সংবর্দ্ধন-লেখমালা” পৃঃ ১৬১-১৬২)।

মোগল যুগের এই গীতিকাসমূহে আমরা জমিদারদের যুদ্ধ বিগ্রহের কথা, কেনারামের মতন ডাকাতের ধর্ম্মবুদ্ধি উদয় হইয়া ত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার কথা, প্রজাদের হিতার্থে রাণী চন্দ্রাবতীর প্রাণ দান ও লম্পট কাজীর গল্প, অন্য পক্ষে হিন্দু ও মুসলমান জমিদারদের বন্ধুত্ব, মুসলমান কবিদের মুসলমান ও হিন্দুর আরাধ্যকে একই মনে করিয়া বন্দনা প্রভৃতি দ্বারা আমরা তৎকালের বাঙ্গালায় অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির সংবাদ পাই। এই সাহিত্য নানা শ্রেণীর লোকের কথা, এবং ইহাতে কতকটা বাস্তবিকতার উপর ও কতকটা আদর্শ ভাব বিজড়িত আছে। এই জন্য এই সাহিত্যকে আমরা Impressionist বা Idealistic Mixed লক্ষণ যুক্ত বলিয়া অভিহিত করি।

ভারতচন্দ্রের পর ইংরেজ শাসনের যুগ আরম্ভ হয়। এই যুগে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী উদ্ভূত হয়। বাঙ্গলার সর্ব্ব বিষয়ের কর্ত্তৃত্ব এই শ্রেণী দ্বারা সম্পাদিত হইতেছে। কিন্তু উপরোক্ত কালব্যতিক্রম দোষজন্য উনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালী সাহিত্যিকেরাও সামন্ততান্ত্রিক যুগের মোহ কাটাইতে পারেন নাই। তাই এই যুগের লব্ধ প্রতিষ্ঠ লেখকদের নায়কেরা কেহ হয়ত ভূস্বামী, না হয় তিনি একজন তাহার substitute জমিদার। এই যুগের লেখকেরা ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে বর্ত্তমান কালের বুর্জ্জোয়া অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক সভ্যতার মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামী বা মোগল আমলের জমিদারের স্থান আর নাই, আর আজকালকার জমিদারেরা ইংরেজের জন্য প্রজার কাছে খাজনা আদায়কারী এজেণ্ট মাত্র।

ইংরেজী যুগের একজন উচ্চশ্রেণীর সাহিত্যিক ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁহার “মেঘনাদবধ কাব্য” তাঁহাকে অমর করিয়াছে। ইহার প্রধান কারণ, বাঙ্গলা সাহিত্যে এই ভাব নূতন। এই কাব্যে ইউরোপীয় ইলিয়াডের ছাপ পড়িয়াছে; তৎপর অমিত্রাক্ষর ছন্দের ভঙ্গী; ইহাও নূতন। মেঘনাদ বধ কাব্যের শরীর মধ্যে সর্ব্ব প্রথম শ্লোক হইতে ‘সপ্তদিন লঙ্কা কাঁদিল বিষাদে’ পর্য্যন্ত ইলিয়াডের ভাবের নকল হইয়াছে। অবশ্য তাঁহার নায়ক নায়িকারা হিন্দু বেশেই অঙ্কিত হইয়াছেন। লেখকের মতে, হোমারের রাজা প্রায়াম, পুত্র হেক্টর ও তৎপত্নী আন্দ্রোমাখী অপেক্ষা মাইকেল রাবণ, ইন্দ্রজিত ও প্রমীলার চিত্র উন্নততর ভাবে আঁকিয়াছেন, অর্থাৎ হোমারের নায়কও নায়িকাদের অপেক্ষা মেঘনাদ বধ কাব্যের নায়ক ও নায়িকারা উন্নততর শ্রেণীয় লোক। এই কাব্য ইলিয়াডের হিন্দু আকারের সংস্করণ বলিয়াই এত মনোরম ও জনপ্রিয় হইয়াছে। এই সাহিত্য সম্পূর্ণভাবে Romantist এবং Ideational। তৎপরে তাঁহার ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, ‘কৃষ্ণ কুমারী নাটক’ প্রভৃতি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গল্প লইয়া লিখিত হইয়াছে। এইজন্য ইহাতে আমরা প্রগতি মূলক কিছু পাই না। এইগুলিও Romantist ও সম্পূর্ণ Ideational। ইহার পর “বুড়া শালিকের ঘাড়ে রোঁ” নাটকে এবং “একেই কি বলে সভ্যতা” নামক সামাজিক নাটকদ্বয়ে ব্যঙ্গই করা হইয়াছে, তাহাতে আমরা প্রগতির সংবাদ পাই না। তবে, শেষোক্ত সমসাময়িক একদল “অতি” শিক্ষিত যুবকদের মনস্তত্বের পরিচয় প্রদান করা হইয়াছে; এইজন্য ইহাকে Idealist এবং mixed লক্ষণ যুক্ত বলা যাইতে পারে। ইহা আধুনিক কালের চিত্র প্রদান করিয়াছে, সেইজন্য প্রগতিশীল। তদ্রূপ দীনবন্ধু মিত্রের গ্রন্থাবলীর বেশীর ভাগের theme (প্রতিপাদ্য) অপেক্ষাকৃত প্রাচীন সাহিত্যর নকলে লিখিত হইয়াছে, কেবল “সধবার একাদশী” নাটকে সমসাময়িক ধনীর পুত্রের চরিত্র অঙ্কিত হইয়াছে, এই জন্য এই পুস্তক অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল। আবার “নীল দর্পণ” বাস্তবিক ঘটনাবলীর উপর চিত্রিত। এই দুই পুস্তক Realist এবং Sensate ভাবযুক্ত। আবার বাঙ্গলার তৎকালীন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পুস্তক সমূহের সাধারণতঃ আমরা প্রগতির কোন ধারা পাই না। তবে “বিষবৃক্ষ” পুস্তকে কুন্দ নন্দিনীর বিধবা বিবাহ প্রদান করায় তাঁহার মনের তৎকালীন প্রগতির ধারা নিরীক্ষণ করি। এই পুস্তক Romantist এবং mixed বা ideal বলা যাইতে পারে।

পুনঃ, “সাম্য” নামক প্রবন্ধে তিনি ইউরোপীয় তৎকালীন চিন্তাধারার সাহিত্যের সম্যক পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। ইহাতে তিনি সোসালিষ্টদের দ্বারা ইউরোপে “প্রথম শ্রমিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন” (First International) সংস্থাপিত হইবার সংবাদ দিয়াছেন। আর দিয়াছেন ফ্রান্সের Auguste Comte দ্বারা Positivism নামক মতবাদের সংবাদ। এই মতবাদ তাঁহার সময়ে ভারতের অনেক শিক্ষিত ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করিয়াছিল। তিনিও তদ্বারা আকৃষ্ট হইয়াছিলেন বলিয়া অনুমিত হয়। এই প্রবন্ধে আমরা প্রগতির পরিচয় পাই। “কৃষকের কথা” নামক প্রবন্ধ সমূহে আমরা তাঁহার তৎকালীন Realist মনের পরিচয় পাই। কিন্তু ‘ধর্ম্মতত্ত্ব,’ ‘শ্রীকৃষ্ণ,’ ‘আনন্দমঠ’ সম্পূর্ণভাবে Ideational!

এই সময়ের ব্রাহ্ম সমাজের সাহিত্যিকদের লেখার মধ্যে কিঞ্চিৎ প্রগতির সংবাদ পাওয়া যায়। এই সমাজের সভ্যরা বেশীর ভাগই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক এবং সমাজ সংস্কার কর্ম্মে ব্রতী, সেইজন্য তাঁহাদের দ্বারা লিখিত সাহিত্য মধ্যে আমরা সামন্ততান্ত্রিক সংবাদ পাই না। তাঁহাদের প্রতিপাদ্য হইতেছে ধর্ম্ম ও সমাজ সংস্কার; কাজেই তৎকালীন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক এই সাহিত্যে স্থান পাইয়াছে। কিন্তু এই সাহিত্যে ধর্ম্ম ও সমাজ সম্পর্কীয় সংস্কারের তর্ক বিজড়িত থাকায় ইহাতে কেবল আদর্শবাদই প্রতিফলিত হইয়াছে। গণসমূহের অবস্থা বিষয়ে তাহা হইতে জ্ঞাত হওয়া যায় না এবং দেশের তৎকালীন অবস্থাও ইহাতে চিত্রিত হয় নাই! এই জন্য ইহাতে গঠনমূলক সমাজ পদ্ধতির সংবাদ নাই। এই শ্রেণীর সাহিত্যকে পুরাতন পদ্ধতিতে Idealist এবং সোরোকিনী প্রথায় mixed বলিয়া অভিহিত করা যায়।

এই যুগে নব বিবর্ত্তিত হিন্দু বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে আদর্শ ও পথ নিয়া আত্মকলহ হয়। ফলে, সংস্কার এবং সনাতনবাদীয় আখ্যার দলের তুমুল কলহ হয়। তজ্জন্য তৎসংক্রান্ত সাময়িক সাহিত্যও সৃষ্ট হয়। ব্রাহ্ম সাহিত্য এই এক পক্ষের সাক্ষ্য দেয়, কিন্তু আজ উভয় দলেরই শিক্ষা ও দীক্ষা একীভূত হওয়ায় সে কলহ আর নাই।

ইহার পর একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ছিলেন নাট্টকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তিনি অনেক বিষয়েই কবিতা, গল্প ও নাটক লিখিয়াছেন। তাঁহার লেখার প্রতিপাদ্য ছিল ধর্ম্ম, সমাজ ও স্বদেশপ্রেমমূলক রাজনীতিক নাটকসমূহ। তাঁহার দীর্ঘ জীবনে নানা ভাব তরঙ্গের ঘাত প্রতিঘাত লাগিয়া ছিল তাই আমরা তাঁহার “বুদ্ধদেব রচিত”, “চৈতন্যলীলা” “বিশ্বমঙ্গল” “শঙ্করাচার্য্য” নামক নাটকসমূহে ধর্ম্মভাব প্রণোদিত চিত্র পাই। অবশ্য অতীত যুগের সংবাদ ও মত নিয়া এই সব নাটক লিখিত হইয়াছিল, এইজন্য তাঁহার ধর্ম্মাত্মক সাহিত্যের মধ্যে আমরা প্রগতির আভাস পাই না। তৎপর, “বেল্লিকবাজার”, “প্রফুল্ল” প্রভৃতি নাটক তাঁহার সমসাময়িক কলিকাতার একদল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। ইহাতে তৎকালীন মধ্যবিত্ত শ্রেণীয় শিক্ষিত বাঙ্গালীর মনস্তত্ত্ব অঙ্কিত হইয়াছে।

তাঁহার স্বদেশপ্রেমজাত নাটকসমূহে ভারতের পতনের কারণ, হিন্দু ও মুসলমানের এক লক্ষ্য বিষয়ে অনেক কথা আছে যাহা স্বদেশ প্রেমিকের শিক্ষণীয় বস্তু। তাঁহার ‘চন্দ্রা’ নামক গল্প, “সিপাহী বিদ্রোহ” অবলম্বন করিয়া লিখিত হইয়াছে। “বলিদান” নাটকে হিন্দু সমাজের “পণপ্রথার” নির্মমম চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে। অবশ্য আমরা যাহাকে প্রগতি সাহিত্য বলি তাহা তাঁহার লেখার মধ্য দিয়া প্রতিফলিত হয় নাই। ভবিষ্যতে ভারত সংগঠন কল্পে যে কর্ম্মপদ্ধতির প্রয়োজন তাহা তাঁহার মধ্যে ফুটিয়া উঠে নাই। তখনকার শিক্ষিত ভারত “স্বাধীনতা ও হিন্দু এবং মুসলমানের ঐক্য প্রয়োজন” এই ভাবটি ভাসাভাসারূপে ধারণ করিতে মাত্র শিখিয়াছে, এবং স্বাধীনতা উপলব্ধি কল্পে প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণাজন্য অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিত। গিরিশচন্দ্রের সাহিত্যে তাহা প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। তাঁহার বহুসংখ্যক পুস্তক সর্ব্বপ্রকারের লক্ষণ বহন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয়াংশে বঙ্কিমচন্দ্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণ, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র প্রভৃতি সাহিত্যিকের দল উদয় হয়। তাঁহাদের সাহিত্য স্বজাতি ও স্বদেশপ্রেমের উদ্দীপনা কল্পে যথেষ্ট সাহায্য করে। কিন্তু প্রথমোক্ত লেখক “স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস” নামক পুস্তকে যে ঘটনামূলক চিত্র প্রদান করে তাহা বর্ণাশ্রমীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীয়; তজ্জন্য আজকালকার যুগে প্রতিক্রিয়াশীল বলিয়া গণ্য হইবে। শেষোক্তদের সাহিত্য তৎকালীন শিক্ষিত ভারতবাসীর মনস্তত্ত্বের পরিচায়ক। বিদেশের সহিত স্বদেশের তুলনা করিয়া তাঁহারা “হায় মা ভারত” বলিয়া হা হুতাস করিয়া করিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা ভবিষ্যতের জন্য একটা পথ নির্দ্দেশ করিয়া দিয়া যান নি, এইজন্য তাঁহাদের সাহিত্যকে প্রগতিশীল বলা যায় না। এই সাহিত্যগুলিকে Ideational বলিয়া নির্দ্ধারিত হয়।

এই সময়ে নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠিত “স্বদেশী মেলা”, যাহাকে সাধারণতঃ “হিন্দু মহামেলা” বলা হইত, তাহার সংস্পর্শে যে সাহিত্য গড়িয়া উঠে তাহা স্বদেশ প্রেমোদ্দীপক (‘পুরু বিক্রম নাটক,’ ‘বঙ্গাধীপ পরাজয়,’ ‘ভারত বিলাপ,’ বিবিধ স্বদেশী সঙ্গীত প্রভৃতি) হইলেও কাল্পনিক আদর্শ প্রণোদিত ছিল, এইজন্য ইহা Idealist এবং নব ধারায় ইহা Ideational লক্ষণযুক্ত বলিয়া গণ্য হয়।

এই সব সাহিত্য আলোচনা করিয়া আমরা উপলব্ধি করি যে, একটা যথার্থ প্রগতিশীল সাহিত্য যাহা সমাজের গন্তব্য পথ নির্দ্দেশ করিয়া দিবে আর তৎকালীন সমাজের চিন্তাধারা ও তৎপ্রসূত প্রচেষ্টাকে প্রকট করিবে তাহা ইহাতে পাই না। ইহা সত্য বটে, উপরোক্ত অনেক সাহিত্যিক তাঁহাদের লেখার মধ্যে সমসাময়িক চিত্র প্রদান করিয়াছেন; কিন্তু সমাজ মধ্যে কি কি শক্তি লীলা করিতেছে এবং সমাজের সম্পদ করায়ত্ত করিবার জন্য কোন শক্তি প্রয়াস পাইতেছে, ইহার আভাস বা বিশ্লেষণ আমরা এই সব সাহিত্যে পাই না। অনেকে মধ্যবিত্তশ্রেণীয় লোকদের চিত্র বা মনোবিজ্ঞান নিজেদের লেখার মধ্যে ফুটাইয়াছেন। কিন্তু এই যুগের সাহিত্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাহিত্য নহে। এই যুগের সাহিত্যিকেরা স্বদেশ প্রেমের বন্যা ছুটাইলেও তাঁহাদের দৃষ্টি ছিল অতীতে এবং সর্ব্বত্র হাহুতাসের ভাব প্রকাশ পাইয়াছে। এই সাহিত্যগুলি হয় Ideational না হয় Mixed লক্ষণ ধারণ করে।

এই যুগের পর আসে, স্বদেশী যুগের বন্যা। এই যুগে সাহিত্যে একটি নূতন ভাবধারা প্রবেশ করে। নানা প্রকারের স্বদেশী সঙ্গীত ও কবিতা এই সময়ে রচিত হয়, অতীত ইতিহাস থেকে কাহিনী নিয়া গিরীশচন্দ্র, ক্ষীরোদচন্দ্র বিদ্যাবিনোদ কতিপয় নাটক রচনা করেন। কিন্তু এইগুলি স্বদেশ প্রেমোদ্দীপক হইলেও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তু বহির্ভূত কাল্পনিক আদর্শ বিজড়িত বলিয়া Ideational লক্ষণাক্রান্ত বলিয়া পরিগণিত হইবে। কিন্তু ইহার বিকল্পে, স্বাধীনতাকামী দল দ্বারা পরিচালিত ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় অন্য সুর ধ্বনিত হইতে থাকে। এই দল থেকে অনেক গান, কবিতা, রামায়ণের স্বদেশী ব্যাখ্যার পাঠ, ৺সখারাম গনেশ দেউস্করের ‘দেশের কথা’ নামক অর্থনীতিক পুস্তক, এবং উপরোক্ত সংবাদপত্রে রাজনীতিক প্রবন্ধ সমূহ বাঙ্গলা ভাষায় নূতন স্রোত আনয়ন করে। এই দলের উদ্দেশ্য ছিল, ‘হাহুতাস’ ও ‘হায় মা ভারত’ বলিয়া ক্রন্দনের রোল বন্ধ করিয়া ওজঃ ও আশার বাণী শ্রবণ করাইবেন। এই জন্যই ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় তৎকালীন বাস্তব রাজনীতির আলোচনা হইত, এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের গঠনমূলক কর্ম্মের দিকে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হইত। অবশ্য ইহা চিন্তাক্ষেত্রে ভাব পরিবর্ত্তনকল্পেই আত্ম-নিয়োজিত করিত। এই সঙ্গে ৺দেবব্রত বসুর (পরের স্বামী প্রজ্ঞনানন্দ) স্বদেশী গানসমূহে ওজঃ এবং ভবিষ্যতের আশার কথাই ধ্বনিত হইত। প্রথম যুগের ‘ভারত বিলাপ’ ও পরের যুগের হেমচন্দ্রের ‘ভারত-সঙ্গীত’ হইতে এই সব কবিতার ইহাই বৈশিষ্ট্য। দেবব্রত বসুর ‘উঠিয়া দাঁড়াল জননী’ নামক গানে জন্মভূমির ভবিষ্যতের রূপ কল্পনা করা হইয়াছে। আর একটি গানে—

‘দে মা···অধঃবদনে কেন নীরবে বসি।
গাণ্ডীব রচে ছিলে যে হাতে মা অতীতে,
শৃঙ্খল, কিঙ্কিনীধ্বনি বাজে আজি সে হাতে।
সন্তানের শিরাতে একবিন্দু থাকিতে,
অধঃবদনে কেন নীরবে বসি।
তুল মা তুল মা আঁখি বিজলী ছুটিবে তায়,
কোটি কোটি চন্দ্র সূর্য্য খড়্গে ঝলসিয়া যায়”

ইত্যাদি বলিয়াছেন। পুনঃ, আর একটি গানে, তিনি দেশের সকলকেই মাতৃ সেবার জন্য আহ্বান করিয়াছেন:

“কে আছ দাঁড়ায়ে নীরবে,
কে আছ মায়ের মুখপানে চেয়ে।
নিজেরে ভাবিয়ে অক্ষম দুর্ব্বল,
বাড়ায়েছ মার যাতনা কেবল,

(ওরে) মাতৃকণ্ঠে যার বাজিছে শৃঙ্খল,
দুর্ব্বল সবল সেও কি ভাবিবে!
কে আছ বিদেশী পরপদ সেবী,
গোপনে মাতৃভূমি সেবক সন্ধানে।
এস শীঘ্র এস বেলা বয়ে যায়
···এনেছে উষা এসিয়ায়।
মধ্যাহ্ন গরিমা স্বাধীন ভারত
আনিবে নিশ্চয়ই আনিবে”

(দুঃখের কথা তাহার কবিতাগুলি মুদ্রিত হয় নাই বলিয়া, পরে বাজেয়াপ্ত করিয়া অনেকে নিজেদের নামে চালান)। এই সঙ্গে কবি ৺সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের, ও ৺কামিনীকুমার চক্রবর্ত্তীর গান সমুহ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আবার উপরোক্ত দলের যশোহর নিবাসী ৺ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষের কবিতাসমূহ ওজঃপূর্ণ ছিল। একটি কবিতা পুস্তকে ইনি বলিতেছেন:

“বাসন্তী চন্দ্রিমা পূর্ণ সারা ভূমণ্ডল,
আমাদের জীর্ণ গৃহে শুধু অন্ধকার

* * *

ফেলিয়াছি বীণা আর গাহিব না গান,
উচ্চে গাহিবার আজি এসেছে সময়।

* * *

রমণীর রূপগান! হায় জগদীশ,
পুড়াইয়া দেহ রূপ ভারতবালার,
সাজে কি বুভুক্ষু মাঝে প্রেমাস্নিগ্ধ তান!”

তৎপর, আর একটি কবিতা পুস্তকে ইনি বাঙ্গলার পল্লীর বর্ত্তমান অবস্থা সতেজ ভাষায় বর্ণনা করেন।

এই সঙ্গে এই দল দ্বারা উপরোক্ত স্বদেশী রামায়ণে লিখিত গানসমূহ সাধারণের স্বদেশপ্রীতি উৎপাদন করিত।

একটা গান এই:

“স্বদেশের ধূলি স্বর্ণরেণু বলি রেখ রেখ হৃদে ধ্রুবজ্ঞান”

* * *

“চিরকর্ম্মক্ষেত্র তব মাতৃভূমি, একথা কেনরে হও বিস্মরণ”

আর একটি গান:

“একবার এস ফিরে ফিরে এস গো,
একবার পূর্ব্বাকাশে মধুহাসি হাস গো।
এসেছিলে শুনি কানে কবে হায় কেবা জানে,
কখন কদাচ গানে ভাস গো।
বহুদিন হল প্রাণ, বঙ্গে শক্তি অবসান,
কখন হবে তোমার আহ্বান গান।
তথাপি শঙ্করী এস, ভগ্নহৃদয়ে বোসো,
তুমি যে শ্মশান ভালবাস গো।”

শক্তিদেবীকে লক্ষ্য করিয়া স্বদেশী রামায়ণে বিরচিত হয়, কিন্তু ইহা দুই অর্থবোধক।

এই সময়ে ৺কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদের “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে আজ” প্রভৃতি গান; ৺অশ্বিনীকুমার দত্তের ‘অগ্নিময়ী মাগো আজি ডাকি সকলে মা” প্রভৃতি গান বিরচিত হয় এবং সাধারণে গীত হয়। এই প্রকারে বাঙ্গলার হাওয়ায় নূতন সুর ভাসিতে থাকে।

এই যুগে কবি রবীন্দ্রনাথ বর্ত্তমান রাজনীতিক ব্যবস্থা বর্ণনা করিয়া নানা প্রকারের প্রবন্ধ ও কবিতা রচনা করেন। তিনি “স্বদেশী সমাজ” শীর্ষক বক্তৃতায় Parallel Government স্থাপন করিয়া স্বাধীনতার্জ্জন করার উপদেশ দেন এবং সর্ব্বশেষে তাঁহার ফেডারেশন হল স্থাপন দিবস উপলক্ষ্যে “বাঙ্গলার মাটি, বাঙ্গলার জল, পূণ্য হউক পূণ্য হউক” কবিতা বাঙ্গলার নূতন মনস্তত্ত্বের পরিচয় প্রদান করে।

এই সময়েই ১৯০৭ খৃঃ ফেডারেশন হলে জাতীয়তার প্রতীকস্বরূপ ত্রিবর্ণ রঞ্জিত “জাতীয় পতাকা” উড্ডীন করা হয়।

স্বদেশী যুগের এই যে ওজঃ পূর্ণ সাহিত্য এবং বিশেষতঃ যুগান্তর দলের উদ্দীপণা পূর্ণ সাহিত্য কোথা হইতে প্রেরণা পাইল? একই ভাষার সাহিত্য, কিন্তু রূপ ও রস বিভিন্ন হয়। সাহিত্য যে শ্রেণী লক্ষণ ধারণ করে এই যুগের সাহিত্যই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই সময়ের বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর আদর্শও পরিবর্ত্তিত হইতে থাকে। এই যুগের বুর্জ্জোয়া শ্রেণী আর ভয়ে ভীত চকিত ভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করিতেছে না। ইহা শিক্ষা, দীক্ষা ও কর্ম্মে নিজেকে ইংরেজ সমশ্রেণীর সমকক্ষ বলিয়া মনে করে। এইজন্য অনুপ্রেরণা জন্য ইহা আর বিদেশের দিকে তাকাইয়া নাই। কিন্তু যাঁহারা তখনও তদ্রূপ দৃষ্টিকোণ বিশিষ্ট ছিলেন, তাঁহাদেরই উপলক্ষ করিয়া কবি রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন—“আবেদন আর নিবেদনের থালা বহে বহে নতশির।” এইজন্য এই সময়ের একটি জন সভায় চিত্তরঞ্জন একটি ক্ষুদ্র কবিতা পাঠ করিয়াছিলেন: “বাঙ্গালীর আছে ইতিহাস···বাঙ্গালীর আছে ভবিষ্যত” (কুমারটুলীতে ১৯০৫ খৃঃ একটি স্বদেশী সভায় ইহা তিনি পাঠ করেন)।

আজকাল যুগান্তর পত্রিকা সম্বন্ধে অনেকে অনেক অলীক কথা বাহির করিতেছেন: তাঁহারা বলিতে চান যে এই দলের সব গুপ্ত কথা সম্বন্ধে তাঁহারা ওয়াকিফহাল! এমন কি কেহ কেহ যুগান্তর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা বলিয়াও নিজেকে জাহির করেন (১৯৩১ খৃঃ উত্তর কলিকাতার কংগ্রেস কার্য্যকরী সভার এক অধিবেশনে একজন ভদ্রলোক নিজেকে উকিল বলিয়া পরিচয় দিয়া লেখককে বলেন, “অমুকবাবু, আপনি আমায় চিনেন না আমি আপনাকে চিনি, আমি আর অমুক ‘যুগান্তর’ পত্রিকা প্রকাশ করি!” যাঁহার নাম এই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, তিনি তখন আঠারো বৎসরের তরুণ, যুগান্তর দলের সভ্য এবং পত্রিকা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ কার্য্য করিতেন। ইনি এখনও জীবিত আছেন)।

এসব প্রতারণা পূর্ণ কথা অনভিজ্ঞকে বঞ্চনা করিতে পারে, কিন্তু আসল কথা এই ‘যুগান্তর’ পত্রিকা জনকতক যুবকের খামখেয়াল ছিল না। ইহার পশ্চাতে ছিল বিশাল বাঙ্গালার উচ্চস্তরের বুর্জ্জোয়া ও জমিদার শ্রেণী। মহারাজা এবং জমিদার হইতে গ্রামের ক্ষুদ্র বুর্জ্জোয়া অর্থাৎ গরীব মধ্যবিত্ত শ্রেণী পর্য্যন্ত ইহার পৃষ্ঠপোষক ও সহানুভূতি সম্পন্ন ছিল।

এই বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমান পার্থক্য ছিল না, ঐতিহাসিক বারভূঁইয়াদের অন্যতম এক মুসলমান বংশীয় জমিদার লেখকের বন্ধুদের বলিতেন, “এই কাগজ ঠিক ঠিক লিখে”। পরে তিনি গোপনে লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার অভিপ্রায়ও জ্ঞাপন করেন। যুগান্তর দলের সাহিত্য ব্যক্তিগত বা ক্ষুদ্র দলগত মনস্তত্ত্বের দ্যোতক নহে।

ইহা তৎকালীন সদ্যজাগ্রত আক্রমণশীল উপরিস্তরের সামাজিক শ্রেণীর Militant মনস্তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করিত। পূর্ব্বতন যুগের সাহিত্যাপেক্ষা ইহার সুর জাতীয়তায় অর্জ্জনের পথে অগ্রসর গতির নির্দ্দেশ দেয় বলিয়া ইহা পূর্ব্বের সাহিত্যাপেক্ষা প্রগতিশীল বলিতে হইবে। ইহা রাজনীতিক্ষেত্রে বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর মনস্তত্ত্বের পরিচায়ক হইলেও ইহাকে সম্পূর্ণ বুর্জ্জোয়া সাহিত্য বলা যায় না। এই সাহিত্য Impressionist এবং এই সাহিত্য ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য তুলনামূলক বাস্তবিকতা ও আদর্শবাদ মিশ্রিত থাকায় ইহা Mixed বা Idealistic বলিয়া পরিগণিত হইবে।

ইহার পরের যুগের অর্থাৎ প্রথম জগৎব্যাপী যুদ্ধের পরের বড় সাহিত্যিক হইতেছেন শরৎচন্দ্র। ইঁহার সাহিত্যে ক্ষুদ্র বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর মনস্তত্ত্ব প্রস্ফুটিত হইয়াছে, নারী জাতির প্রতি সম্মান আছে অথচ সমাজে নারী জাতির প্রতি যে প্রাচীন সঙ্কুচিত মনোভাব তাহাও আছে। “পণ্ডিত মশায়” পুস্তকে ‘জাত-বৈষ্ণব’ নায়কের প্রথম স্ত্রীর স্বামী বাড়ী প্রত্যাগমন বিষয়ে যে মনোভাব ব্যক্ত করিয়াছিল, তাহাতেই ইহা প্রকাশ পায়। এই রমণী গ্রামের ব্রাহ্মণ কায়স্থ কন্যাদের সঙ্গে বর্দ্ধিত হইয়াছিল, পরে স্বামীর সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্ছেদ হয়। জাত-বৈষ্ণব সমাজে ‘মালসা ভোগ’ দ্বারা বিবাহের প্রথা আছে এবং ‘কণ্ঠীবদল’ দ্বারা বিধবা বিবাহ ব্যবস্থাও আছে; বিবাহ বিচ্ছেদও আছে। কিন্তু আজ এই সমাজের বুর্জ্জোয়া শ্রেণী, তথাকথিত উচ্চ জাতিদের রীতি নীতি অবলম্বন করিতেছে। পণ্ডিত মশায়ে তাই দেখিতে পাই নায়িকা স্বামী ঘরে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে অনিচ্ছুক। সে কণ্ঠিবদল ক্রিয়া সম্পাদনে অস্বীকৃত হয়; কারণ তাহার ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ঘরের সঙ্গিনীরা বলিবে, “বাগদী দুলের মত তাহার নিকে হয়ে গেল”! একবার যে বিবাহ ক্রিয়া হইয়াছিল, নায়ক তাহাই স্বীকার করিয়া নিক ইত্যাদি। এই স্থলে লেখক বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বাহিরে জাতবষ্টমের ঘরে উচ্চ শ্রেণীয় বর্ণাশ্রম পদ্ধতি আরোপ করিয়াছেন, তাই এই স্থলে সামাজিক বিসদৃশ্যতা প্রকাশ পাইয়াছে। কিন্তু এই স্থলে নায়িকার যে মনস্তত্ত্ব প্রদর্শিত হইয়াছে তাহা ক্ষুদ্র বুর্জ্জোয়া মন প্রসূত বৃত্তি, তাহাই তথাকথিত নিম্ন স্তরের জাতি সমূহ মধ্যে বিশেষ ভাবে বিরাজ করিতেছে। “চরিত্রহীন” উপন্যাসে এই সঙ্কুচিত ভাব পুনঃ প্রকাশ পাইয়াছে। কিরণময়ী দিবাকরকে লুচি ভাজিতে ভাজিতে Oscar Wildeএর Dorian Grey নামক পুস্তকে ডাক্তার যে “মহাসুখবাদ” বিষয়ে বক্তৃতা দিয়াছিলেন, তাহাই ব্যক্ত করিতেছে। সুখের সন্ধানে কিরণময়ী দেশত্যাগী হইল, কিন্তু লেখক তাহার বিধবা বিবাহ দিয়া দিতে পারিলেন না, রাস্তার পাগলিনী করিয়া শেষে তাহাকে আখ্যায়িকা হইতে বিদায় দিলেন। কিন্তু “শ্রীকান্তে” অভয়ার মুখ দিয়া লেখক যে তথ্য বাহির করিয়াছেন তাহা এই দেশের অবস্থানুযায়ী আপেক্ষিক সমাজ-বৈপ্লবিক ভাব। অন্য পক্ষে “দত্তাতে” আমরা প্রতিক্রিয়াশীলতারই পরিচয় পাই। ইহার নূতনত্ব এই, ইহাতে ইউরোপীয় ধরনের Flirtation কিঞ্চিৎ ঢুকান হইয়াছে। কিন্তু শরৎ সাহিত্যে এই আপেক্ষিক প্রগতির জন্য আমরা ইহাকে “বুর্জ্জোয়া” সাহিত্য বলিতে পারি না, কারণ বুর্জ্জোয়া মনোবৃত্তি সুলভ বিপ্লবের ধারার সন্ধান এবং বুর্জোয়া স্বার্থ-প্রণোদিত গঠনমূলক কর্ম্মের নির্দ্দেশ আমরা এই সাহিত্যে পাই না। শরৎ-সাহিত্য ক্ষুদ্র-বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর মনস্তত্বের প্রতীক বলিয়াই পূর্ব্বতন যুগের সাহিত্যাপেক্ষা প্রগতিশীল। শরৎ সাহিত্যকে আমরা পুরাতন প্রথায় Impressionist এবং নূতন সজ্ঞানুসারে Mixed অর্থাৎ Idealist বলিয়া গণ্য করি।

ইহার পর, বাঙ্গলার সাহিত্যাকাশে উদয় হন কবি কাজী নজরুল-ইসলাম। ইঁহার কবিতা দ্বারা বাঙ্গলা সাহিত্যে একটা নূতন সুর বাজিয়া উঠে। পুরাতন সাহিত্যের সঙ্কোচন ও সনাতনী ভাব এই সুর একেবারেই বিদূরিত করে। তিনি কবিতা ও প্রবন্ধ দ্বারা বাঙ্গলা সাহিত্যে নূতন ভাবধারা ও ওজঃ আনয়ন করেন। তাঁহার সাহিত্যের তিনটি যুগ আছে: প্রথমটি জাতীয়তাপূর্ণ সাহিত্য; দ্বিতীয়, সাম্যবাদীয় সাহিত্য; তৃতীয়, তৎপরবর্ত্তীকালের সাহিত্য যাহা গজল প্রভৃতি গান প্রধান সাহিত্য। তাঁহার কবিতার যৌবন জাতীয়তাবাদের কালেই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়, এবং সাম্যবাদীয় কালেই তাহা চরমে উঠে বলিয়াই বিবেচিত হয়। এই জন্য, এই দুই যুগই তাঁহার কবিত্বের পূর্ণ বিকাশ বলিয়া বিবেচিত হইবে।

কবির জাতীয়তাবাদীয় সাহিত্যের পরিচয় আমরা ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় পাই। তিনি বলিতেছেন “মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ‘জয় প্রলয়ঙ্কর’ বলে ‘ধূমকেতু’কে রথ ক’রে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হল। আমার কর্ণধার আমি। আমায় পথ দেখাবে আমার সত্য। আমার যাত্রা শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি—নমস্কার করছি আমার সত্যকে।···এই যে নিজেকে চেনা আপনার সত্যকে আপনার গুরু, পথ প্রদর্শক কাণ্ডারী বলে জানা, এটা দম্ভ নয়, অহঙ্কার নয়। এটা আত্মকে চেনার সহজ স্বীকারোক্তি।” এই উক্তির মধ্যে কবির দার্শনিকতত্ত্ব নিহিত আছে, তাঁহার কাছে নিজের উপলব্ধ তথ্যই সত্য—“আত্মানং বিদ্ধি” এই হইতেছে কাজী নজরুলের মূলমন্ত্র। পুনঃ, তিনি বলিতেছেন, এ দেশের নাড়ীতে নাড়ীতে অস্থি-মজ্জায় যে পচন ধরেছে, তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হ’লে নতুন জাত গ’ড়ে উঠ্‌বে না।···দেশের যারা শত্রু, দেশের যা—কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামী, মেকী তা সব দূর ক’রতে ‘ধূমকেতু’ হবে আগুনের সম্মার্জ্জনী! এতদ্বারা সমাজ-রাজনীতিক ক্ষেত্রে কবির অভিমত প্রকাশ পায়। আবার, তিনি বলিতেছেন, “ধূমকেতু কোন সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মানুষ-ধর্ম্ম‍ই সব চেয়ে বড় ধর্ম্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোন খানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। যার নিজের ধর্ম্মে বিশ্বাস আছে যে নিজের ধর্ম্মের সত্যকে চিনেছে সে কখনো অন্য ধর্ম্মকে ঘৃণা করতে পারে না।” এই স্থলে কবির ধর্ম্মের ও সাম্প্রদায়িক মিলনের আদর্শ তাঁহার লেখনীমুখ হইতে পরিপুষ্ট হয়। অন্যপক্ষে, “মোহর্‌রম” নামক প্রবন্ধে ভারতীয়-মুসলমানকে লক্ষ্য করিয়া যাহা বলিয়াছেন, তাহাতে উপরোক্ত মন্তব্যেরই জের চলিতেছে। তিনি মুসলমানকে বলিতেছেন, “আত্মানং বিদ্ধি”। তিনি বলিতেছেন, “ফিরে এসেছে আজ সেই মোহর্‌রম—সেই নিখিল মুসলিমের ক্রন্দন কাৎরাণীর দিন। কিন্তু সত্য করে আজ কে কেঁদেছে বলতে পার হে মুস্‌লিম, আজ তোমার চোখে অশ্রু নাই। আজ ক্রন্দন স্মৃতি তোমার উৎসবে পরিণত! তোমার অশ্রু আজ ভণ্ডামী, ক্রন্দন আজ কৃত্তিম কর্কশ চীৎকারে।··· আজ কার্‌বালার হাহাকার ঐ নিখিল নিপীড়িত মুসলিমের বুকের সাহারায়, তোমার অপমান জর্জ্জরিত অশ্রু নদীর কূলে কূলে!” এই স্থলে, সত্য জানিয়া কর্ম্ম করিবার জন্য কবি মুসলমানকে আহ্বান করিতেছেন, তাই তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন: “তোমার গর্দ্দানে গোলামীর জিঞ্জির, যে শির আল্লার আরস ছাড়া আর কোথাও নত হয় না। সেই শিরকে জোর ক’রে সেজ্’দা করাচ্ছে অত্যাচারী শক্তি,—আর তুমি করছ আজ সেই শহীদদের ধর্ম্মের জন্য স্বাধীনতার জন্য শহীদদের ‘মাতমে’র অভিনয়। আফ্‌সোস মুসলিম! আফ্‌সোস!!”

এই উভয় উক্তির মধ্য দিয়া কবিকে আমরা কিছু বুঝিতে পারি। তিনি গড্ডালিকাপ্রবাহের “জাতীয়তাবাদী নন।” এই আদর্শ বিষয়ে তাঁহার একটি বিশিষ্ট ধারণাও একসময়ে ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, “অনেকেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছেন, ‘ধূমকেতুর পথ’ কি?···নীচে মোটামুটি ‘ধূমকেতুর’ পথনির্দ্দেশ কর্‌ছি।···সর্ব্ব প্রথম, ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না। কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হ’লে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়ম কানুন বাঁধন শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে। আর এই বিদ্রোহ কর্‌তে হ’লে—সকলের আগে আপনাকে চিন্‌তে হবে”। এই স্থলে কবির জাতীয়তাবাদীর রূপের পার্শ্বে সামাজিক-বিপ্লববাদীর রূপ প্রকাশ পায়। আর সেই সঙ্গে সেই বাণী “আত্মানাং বিদ্ধি” ধ্বনিত হইতেছে। এই বাণী অনুসরণ করিয়া তিনি পুনঃ বলিতেছেন,“অনেকেই লোভের বা নামের জন্য মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু আত্ম প্রবঞ্চনা নিয়ে নেমেছিলেন বলে অন্তর থেকে সত্যের জোর পেলেন্ না, আপনি সরে পড়লেন। রবীন্দ্র অরবিন্দ ভক্তদের মধ্যেও ঐ একই প্রবঞ্চনা ফাঁকি এসে পড়েছে। এরা অন্ধ ভক্ত, চোখ ওয়ালা ভক্ত নয়, বীর-ভক্ত নয়।···এ সব অন্ধ লোক দিয়ে কোনো কাজ হবে না।···বিদ্রোহ মানে কাউকে না মানা নয়, বিদ্রোহ মানে যেটা বুঝি না সেটাকে মাথা উঁচু ক’রে “বুঝি না” বলা।···‘ধূমকেতু’র মত হচ্ছে এই যে, তোমার মন যা চায় তাই কর। ধর্ম্ম, সমাজ, রাজা, দেবতা কাউকে মেনো না।···সত্যকে জানাবার জন্য বিদ্রোহ চাই। নিজেকে শ্রদ্ধা প্রশংসার লোভ থেকে রেহাই দেওয়া চাই”। এই স্থলে, কবির রাজনীতিক—সামাজিক আদর্শ অধিকতর সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। কবি পুরাতনের অন্ধ বিশ্বাসী নন, যাহা বুঝেন না তাহার ভক্ত নন, প্রচারও করেন না। তিনি নিজেকে বুঝিবার চেষ্টা করিবার কথা বলিয়াছেন। এই বিষয়ে তাঁহার মাপকাটি হইতেছে—যুক্তি। এতদ্বারা এই স্থলে আমরা তাঁহাকে “যুক্তিবাদী” বলিতে পারি।

এর পর আসে, সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে কবির মনোভাব। “মন্দির ও মসজিদ” প্রবন্ধে কবি বলিতেছেন, “আবার হিন্দু মুসলমানী কাণ্ড বাধিয়া গিয়াছে! প্রথমে কথা কাটাকাটি। তারপর মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্ত্তনাদ করিতেছে—“বাবাগো, মাগো”!—মাতৃ পরিত্যক্ত দুটি বিভিন্ন ধর্ম্মের শিশু যেমন করিয়া একস্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে! দেখিলাম, হত আহতদের ক্রন্দনে মস্‌জিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্ব্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদী চির-কলঙ্কিত হইয়া রহিল! ভূতে পাওয়ার মত ইহাদের মন্দিরে পাইয়াছে। ইহাদের মসজিদে পাইয়াছে! ইহাদের বহু দুঃখ ভোগ করিতে হইবে।··· মানুষের পশু প্রবৃত্তির সুবিধা লইয়া ধর্ম্মমদান্ধদের নাচাইয়া কত কাপুরুষ না আজ মহাপুরুষ হইয়া গেল”!

পুনঃ, “হিন্দু-মুসলমান” প্রবন্ধে কবি বলিতেছেন, “একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিলো আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বল্‌লেন দেখ, যে ন্যাজ বাইরের তাকে কাটা যায়, কিন্তু, ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে? হিন্দু-মুসলমানের কথা মনে উঠলে আমার বারে বারে গুরুদেবের ঐ কথাটাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে, যে, এ ন্যাজ গজাল কি ক’রে? এর আদি উদ্ভব কোথায়?···আমার মনে হয় টিকিতে ও দাড়িতে।···অবতার পয়গম্বর কেউ বলেন নি আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি। আমি ক্রিশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন আমরা মানুষের জন্য এসেছি আলোর মত সকলের জন্য।” এই প্রবন্ধে কবি সাম্প্রদায়িক অশান্তির কারণ অনুসন্ধান করিতে গিয়া আবিষ্কার করিয়াছেন যে পুরোহিতবাদ বা বাহ্য ক্রিয়া কলাপ দ্বারাই মানুষে মানুষে প্রভেদ উৎপাদন করায়। এই সব ব্যাপারই বনিয়াদি স্বার্থ হইয়া উঠে।

এই সব উক্তি দ্বারা আমরা কবি নজরুলের জাতীয়তা ভাবের ও তাঁহার আদর্শের পরিচয় পাই। ইহা দ্বারা আমরা অনুভব করি যে, সাধারণভাবে যাহাকে “জাতীয়তাবাদ” বলে তাহা তাঁহার লক্ষ্য নয়। তাঁহার এই আদর্শ “ভারত ভারতবাসীর জন্য” এই বুলিতে পর্য্যবসিত হয় নাই। তাঁহার লক্ষ্য মানবের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি। এই জন্য তিনি কেবল রাজনীতিক পরিবর্ত্তন চান নাই, সমাজকেও সম্পূর্ণভাবে পরিবর্ত্তিত করিতে চাহিয়াছেন। কিন্তু এই সমাজ-বিপ্লব যে অর্থনীতিক বিপ্লব সাপেক্ষ তাহা তিনি মানস চক্ষুতে দেখিতে পান নি।

তাঁহার জাতীয়তাবাদীয় সাহিত্যের মধ্যে আমরা একটু বাঙ্গলার পূর্ব্বেকার তথাকথিত বৈপ্লবিকদের কার্য্যের ইঙ্গিত পাই। অসহযোগ আন্দোলনের বন্যায় তিনিও ভাসিয়া যান। তজ্জন্য কারাবরণও করেন। “রাজ-বন্দীর চিঠি” তাহার প্রমাণ। এই সময়কার কাল ইঙ্গিত করিয়াই তিনি বলিয়াছেন, “এই স্বাবলম্বন, এই নিজের ওপর অটুট বিশ্বাস ক’রতেই শিখাচ্ছিলেন মহাত্মা গান্ধীজি। কিন্তু আমরা তাঁর কথা বুঝলাম না, ‘আমি আছি’ এই কথা না বলে সবাই বলতে লাগলাম, ‘গান্ধীজি আছেন’! এই পরাবলম্বনই আমাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেললে। একেই বলে সব চেয়ে বড় দাসত্ব। ··· নিজে নিষ্ক্রিয় থেকে অন্য একজন মহাপুরুষকে প্রাণপণে ভক্তি ক’রলেই যদি দেশ উদ্ধার হয়ে যেত, তা হ’লে এই তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশ এতদিন পরাধীন থাকত না।”

এই উক্তি দ্বারা দৃষ্ট হয় যে, গান্ধীবাদীদের হইতে তিনি নিজেকে পৃথক করিয়া নিজের পথ বাছিয়া নিয়াছিলেন। ইহার পর, বোধ হয় তিনি কোন কোন ভূতপূর্ব্ব বৈপ্লবিকের সহিত পরিচিত হন এবং তাঁহাদের অতীত কার্য্যের কাহিনী শ্রবণ করেন। এই সময়েই ৺শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “পথের দাবী” প্রকাশিত হয়। এই সময়েরই পুস্তক হইতেছে কবির “কুহেলিকা”। এই পুস্তক অতি উচ্চ দরের সাহিত্য। এই নভেলে লেখক তথাকথিত হিন্দু সন্ত্রাসবাদী বৈপ্লবিকের সহিত মুসলমান যুবকেরও দেশপ্রেমজনিত ত্যাগের অতি উচ্চাদর্শ প্রদর্শন করিয়াছেন। “প্রমত্-দা”র নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতার জন্য জমিদার-পুত্র জাহাঙ্গীর প্রাণ বিসর্জ্জন পর্য্যন্ত করিতে দৃঢ় সঙ্কল্প ও শেষে দীপান্তর গমন, এই বর্ণনা গঙ্গা ও যমুনার মিলন ন্যায় সুমহান হইয়াছে।

এই পুস্তকে কবি ভারতবর্ষ ও জাতীয়তাবাদের প্রচলিত অর্থের ঊর্দ্ধে উঠিয়াছেন। তাই তিনি বৈপ্লবিক নেতা প্রমথের মুখ দিয়া বলিতেছেন, “আমার ভারত ও মানচিত্রের ভারতবর্ষ নয় রে অনিম! আমার ভারতবর্ষ,—ভারতের এই মূক দরিদ্র নিরন্ন পর-পদদলিত তেত্রিশ কোটী মানুষের ভারতবর্ষ। আমার ভারতবর্ষ মানুষের যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দনতীর্থ; ওরে, এ ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়—এ আমার মানুষের—মহামানুষের মহা-ভারত।” অন্যপক্ষে স্বদেশ-মন্ত্রে দীক্ষিত জমিদার-পুত্র জাহাঙ্গীর বলিতেছে, “ওগো ধরিত্রী মা, আজ হ’তে আমি তোমার ক্লেদাক্ত ধুলি-মাখা সন্তান—এই হোক আমার সব চেয়ে বড় পরিচয়”! পরে যখন প্রমথ মনঃদুখে সন্তপ্ত জাহাঙ্গীরকে সান্তনা দিবার জন্য বলিলেন, “আমাদের মন্ত্র তুমি ভুলে যাচ্ছ জাহাঙ্গীর। ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’ আমাদের ইষ্ট মন্ত্র।” জাহাঙ্গীর তখনো চিত্র-ভারত বুকে ধরিয়া উপুড় হইয়া কাঁদিতেছিল,—“শুধু তুমি, জন্মভূমি আমার, শুধু একা স্বর্গাদপি গরিয়সী,—আর কেউ নয়, আর কেউ নয়”!

ভারতবর্ষের এই ব্যাখ্যা, নিরন্ন পদ-দলিত, শোষিত লোকদেরই নিয়া যে ভারতবর্ষ, তাহা পরের যুগের কবির সাহিত্যে আরও পরিস্ফুট হয়। এই যুগে তিনি, জনকতক ভারতীয় কমুনিস্টের সংস্পর্শে আসেন। এই সময়ে কবিকে শোষিত সর্ব্বহারাদের প্রতিভূরূপে দেখিতে পাই। সেই সময়ে তাঁহার বীণায় নূতন ঝঙ্কার ধ্বনিত হয়। তাই তিনি বলিতেছেন,

“সাম্যের গান গাই—

আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।” পুনঃ, এই রূপে তিনি “কৃষাণের গান”, “ধীবরের গান”, “শ্রমিকের গান”, “সাম্যবাদের গান” “মানুষের গান”, প্রভৃতি গান তখনকার নব প্রতিষ্ঠিত “লাঙল” পত্রিকায় প্রকাশিত করেন। এই সব গানে তিনি গণ-শ্রেণীদের দুঃখের কথা, তাহাদের উপর উচ্চশ্রেণীদের শোষণের কথা ওজস্বিনী ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেন। এই সব গানগুলি আজ সারা বাঙ্গলার সম্পত্তি হইয়াছে। এতৎব্যতীত, তিনি বুর্জোয়া সমাজের মাপকাঠি দ্বারা পাপপুণ্যের বিচার করাকে ঘৃণা করিয়াই বলিয়াছেন,

“যত পাপীতাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই···
অন্যের পাপ গণিবার আগে নিজেদের পাপ গোণো।”

এই তর্ক ধরিয়াই তিনি আবার চোর ডাকাতকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন:

“কে তোমায় বলে ডাকাত বন্ধু, কে তোমায় চোর বলে?
চারিদিকে বাজে ডাকাতি ডঙ্কা, চোরেরি রাজ্য চলে।
ছোটদের সব চুরি করে আজ বড়রা হয়েছ বড়।
যারা যত বড় ডাকাত দস্যু, দাগাবাজ,
তারা তত বড় সন্ন্যাসী গুণী জাতি সঙ্ঘেতে আজ”।

এই সময়ে সাম্যের গান গাহিবার কালে তিনি গাহিয়াছেন:

“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান
যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব
সেই মানুষের মেরে পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল।

মূর্খরা সব শোনো মানুষ এনেছে গ্রন্থ;
গ্রন্থ আনে নি মানুষ কোনো।”

এই স্থলে সর্ব্ব প্রথম বাঙ্গলা ভাষার বড় কবি চণ্ডীদাসের সেই অমর বাণী “শুনহে মানুষ ভাই, সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই” তাহারই প্রতিধ্বনি পাই। চণ্ডীদাসের প্রায় ছয় শত বৎসর বাদে বাঙ্গলা সাহিত্যে আবার সেই ধ্বনি উত্থিত হয়। আর, আশ্চর্য্যের কথা, উভয় কবিই বীরভূমের মাটিতে উৎপন্ন! চণ্ডীদাসের সময়ের পর, বাঙ্গলা সাহিত্যের কত পরিবর্ত্তন সাধিত হইয়াছে; কত ভাব বন্যার স্রোত তাহাতে আসিয়াছে, কিন্তু বর্ত্তমানের গণসমূহের কবি নজরুল ইসলাম যে নূতন রূপ সাহিত্যে প্রদান করিয়াছেন তাহা অতুলনীয় ও চিরস্মরণীয় থাকিবে। নব-শিক্ষিত বুর্জোয়া সমাজের কবি,

“বাজরে সিঙ্গা বাজ এই রবে
সবাই স্বাধীন বিপুল ভবে
ভারত কেবল ঘুমায়ে রয়”

বলিয়া শিক্ষিতদের মাতাইয়াছেন; কিন্তু এই “সব” অর্থে কেবল শিক্ষিত লোক নয় ইহার বেশীর ভাগ লোকই যে ধীবর, চাষী, মজুর, দরিদ্র শ্রেণী সমূহ তাহা কবি নজরুলের বীণার ঝঙ্কারেই প্রথমে লোকদের মনে চেতনা আনিয়া দেয়। সর্ব্বহারার দল, গণশ্রেণীর দল তাঁহার নিকট চির কৃতজ্ঞ থাকিবে যে তিনি তাঁহাদের মনোবেদনা সর্ব্বপ্রথমে বীণার সুরে সকলের কর্ণগোচর করিয়াছেন।

কিন্তু কবি নজরুলের কবিতার মর্ম্ম বুঝিতে গেলে তাঁহাকে তাঁহার জাতীয়তাবাদীয় বা সাম্যবাদীয় কবিতা সমূহ দিয়া বুঝিলে চলিবে না। তিনি নিজে একজন ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতাবাদী অর্থাৎ ইউরোপীয় দর্শন শাস্ত্রের কথায় তিনি একজন Intellectual Anarchist। “নিজেকে জান” এই ধ্বনিই তাঁহার সর্ব্বপ্রকারের কবিতা মধ্য দিয়া উত্থিত হইয়াছে। এই ধ্বনিই তিনি সর্ব্বস্থানে তুর্য্যনিনাদে ঘোষিত করিয়াছেন।

শেষের কথা, তিনি একজন আশাবাদী। ভবিষ্যতের প্রতি তিনি আশান্বিত। এই আশার বাণী তিনি স্পষ্ট রূপে ছাত্রদের উল্লেখ করিয়া “ছাত্রদল” নামক কবিতায় বজ্র নির্ঘোষে প্রচার করিয়াছেন:

“কবে সে খোয়ালী পাতসাহি
সেই অতীতে আজও চাহি

* * *

ফেলিস অশ্রুজল
আমরা ধুলায় গড়িব তাজমহল।”

আমরা পুনরায় গৌরবের সৌধ নির্ম্মাণ করিব, পূর্ব্বের গরিমার কথা স্মরণ করিয়া আর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিব না, ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে আছে, তাহা আরও উজ্জলতর হইবে; এই কথাই তরুণ ছাত্রদের তিনি সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন। এতদ্বারা যাহা দার্শনিক ভাষায় optimist (আশাবাদী) বলে তিনি তাহাই।

কবি নজরুল ইসলাম বাঙ্গলা সাহিত্যে যে অমূল্য সম্পদ দান করিয়াছেন, জানি না কয়জন তাহার মর্ম্ম বুঝিয়াছেন। তিনি “হিন্দু কি মুসলমান”, একথা কে জিজ্ঞাসা করে? তিনি নিজেই এই প্রশ্নের সমাধান করিয়াছেন:

“হিন্দু না ওরা মুসলমান”? ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র”!

কবি নজরুল ইসলাম নব বাঙ্গলার তথা সমগ্র নব ভারতের আশাপ্রদানকারী কবি। তিনি অনাগতকালের কবি। তিনি শ্রেণীচ্যুত বুদ্ধিজীবি (declassed intellectual) ভারতের স্বাধীনতাকামীদের প্রতীক!

এইজন্য তাঁহার সাহিত্যে সামন্ততান্ত্রিক বা বুর্জোয়াতন্ত্রীয় ভাবধারা স্থান পায় নাই। তাঁহার সাহিত্যে প্রগতি বিশিষ্টভাবে প্রকাশ পায়। তাঁহার সাহিত্য Neo-realist ও Sensate লক্ষণযুক্ত।


মৌলবী আবদুল কাদির ও মৌলুবী রিজায়ুল করিম সম্পাদিত “কাব্যমালঞ্চ” নামক পুস্তকে একশত পনেরজন মুসলমান কবির কবিতা ও গজল সংগৃহীত করা হইয়াছে। ইহাতে পঞ্চদশ খৃঃ শতাব্দীথেকে বর্ত্তমান পর্য্যন্ত মুসলমান কবির বাঙ্গলায় লিখিত কবিতার উল্লেখ আছে।

এই মুসলমানীয় কবিদের মধ্যে ইহা দৃষ্ট হয় যে শেখ ফৈজুল্লাদের “গোরক্ষবিজয়” পুস্তক ‘নাথধর্ম্ম’ সংক্রান্ত। শেখ চাঁন্দের “রসুলবিজয়” বৈঞ্চব ভাবধারাবলম্বনে লিখিত। সৈয়দসুলতানের “জ্ঞানপ্রদীপ” যোগাচার সম্বন্ধে লিখিত। কাজী দৌলৎউজীর বাহরম খাঁর “লয়লামজনু” ফার্শী হইতে অনূদিত। কাজী দৌলতের “লোরচন্দ্রানী” এবং সৈয়দ আলাওলের “পদ্মাবতী” হিন্দীভাষা হইতে অনূদিত। তৎপর বহু মুসলমানকবি ব্রজবুলীতে বৈষ্ণবপদাবলী রচনা করিয়াছেন। ইহাঁদের কিঞ্চিৎ উল্লেখও এই পুস্তকে করা হইয়াছে। পুনঃ কারবেলার বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়া মহম্মদ রাজা “মকতুল হোসেন” প্রভৃতি রচনা করিয়াছেন। আবার, সমসের গাজীর পুঁথীতে ধর্ম্মসমন্বয়ের চেষ্টা হইয়াছে। ইহাতে হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম্মের আরাধ্য দেবেরা স্থান পাইয়াছেন।

শেষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মীর মশারফ হোসেন “বিষাদ-সিন্ধু” রচনা করেন। ইহা কারবেলা সংক্রান্ত সাহিত্য। কবি কায়কোবাদও এই যুগে ছিলেন। শেষে উদয় হন কবি নজরুল ইসলাম। এই যুগে নানা মুসলমান কবি ও লেখক বর্ত্তমান আছেন।

এই সাহিত্যমধ্যে “গোরক্ষবিজয়” হইতে “বিষাদ-সিন্ধু” পর্য্যন্ত পুস্তকগুলি ধর্ম্মসংক্রান্ত। এই সাহিত্যে প্রগতির সংবাদ নাই। এই জন্য আমরা ইহাকে সামন্ততান্ত্রিক ও Ideational বলিয়া আখ্যা প্রদান করি। নজরুলের সাহিত্যে উপনীত হইলে আমরা প্রগতির সন্ধান পাই।[]

আজকালকার অনেক লেখক মধ্যবিত্তশ্রেণীয় নায়ক ও নায়িকাকে কেন্দ্র করিয়া নভেল নাটক লিখিয়াছেন। কিন্তু কেবল মধ্য-শ্রেণীয়, নায়ক নায়িকার গল্প নিয়া একটা বুর্জোয়া সাহিত্য গড়িয়া উঠে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসী ও আমেরিকার সাহিত্যকে যেমন আমরা সম্পূর্ণরূপে বুর্জোয়া সাহিত্য বলিয়া গণ্য করিতে পারি, সেই প্রকারে সামন্ততন্ত্রীয় যুগের প্রভাব হইতে বিমুক্ত হইয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক ও তাঁহার কৃষ্টিকে কেন্দ্র করিয়া যে সাহিত্য গড়িয়া উঠে তাহাকেই বুর্জোয়া সাহিত্য বলে। রোঁমা রোলাঁর ও জোলার পুস্তক সমূহ, আমেরিকার এমারসন, হুইটিয়ার, লংফেলো, ওয়াল্ট হুইটম্যান প্রভৃতি এই সাহিত্যিক যুগের প্রতীক। সমাজ সম্পূর্ণরূপে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থোদ্দেশে চালিত হইলে সেই সমাজের সাহিত্যও নিজের নূতন খাত সৃষ্টি করে।

অবশ্য বাঙ্গালার সমাজ এখনও সম্পূর্ণ ভাবে “বুর্জোয়াত্ব” প্রাপ্ত হয় নাই, সেইজন্য আমরা একটা খাঁটি বুর্জোয়া সাহিত্য এখনও উদ্ভূত হ‍ইতে দেখিনা; কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাহিনী নিয়া যে সাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছে তাহা এখনও প্রাচীনের প্রভাব কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। বুর্জোয়া সাহিত্যে সাধারণতঃ আমরা আধুনিক লেখকের চরিত্র অঙ্কিত হইতে দেখি। তাহারা প্রাচীনের মোহ কাটাইয়া আধুনিক বৈজ্ঞানিক কৌশলে জগতের ধনসম্পদ ভোগ করিবার জন্য ব্যস্ত! এই জন্য তাহারা প্রাচীন আইন, বিধিনিষেধ, সমাজ বন্ধন ছেদ করিয়া সমাজকে নূতন ছাঁচে গড়িতে চায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমেরিকা, ফ্রান্স, কমালের তুর্কি প্রভৃতি। কিন্তু আমাদের হালের সাহিত্যে সামাজিক আবর্ত্তনের সেই সুর কোথায়?

তবে আধুনিক সময়ে এক প্রকার নূতন সাহিত্যের বিকাশ হইয়াছিল যাহা একটা বুর্জোয়া সাহিত্যের দিকে যাইতেছিল বলিয়া অনুমিত হইত। কিন্তু তাহা কেবল “এডিপুস কমপ্লেক্সের” অনুসরণ করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছে। কিন্তু এই যুগের সামাজিক ইতিহাস ইহাতে যথার্থভাবে চিত্রিত হইয়াছে কি? ইহা ১৯১৮ খৃঃ পরের ইউরোপের অবসাদের অবস্থার হুবহু নকল মাত্র!

রুশের ১৯০৫ খৃঃ বিপ্লব নিষ্ফল হওয়ায় তথাকার কর্ম্মীদের মধ্যে ভীষণ মানসিক প্রতিক্রিয়া ঘটে। তখন, নানা প্রকার যৌন সম্বন্ধীয় পুস্তক, ক্লাব প্রভৃতি তাহাদের মধ্য হইতে উদ্ভূত হয়। রাজনীতিক ও সামাজিক মুক্তি অপ্রাপ্য হওয়ায়, হতাশ বৈপ্লবিকেরা যৌন সম্বন্ধীয় মুক্তির সন্ধানে বর্হিগত হয় (Masaryk-এর Spirit of Russia দ্রষ্টব্য)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর খৃষ্টাব্দের রুশ যুবকগণ যথার্থ জীবন হইতে সম্পর্ক বিহীন হওয়ায় ব্যক্তিত্ববাদীর হতাশতার গম্ভীরতা ডস্টয়েভক্সি তাঁহার নায়কে মূর্ত্তি প্রদান করিয়াছেন। এই প্রকারের নায়কেরাই নিট্‌চের ব্যক্তিত্ববাদীয় দার্শনিক মতের লক্ষণ স্বীয় জীবনে প্রকাশ করে। রুশ সাভিনকফও এই বিফলতার প্রেরণায় বলিয়াছিলেন: “There is no morality, there is only beauty and beauty is the free development of personality, the unrestrained unfolding of all that lies within its soul” (নীতি বলিয়া কিছু নাই, কেবল সৌন্দর্য্যই আছে। আর, ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশই হইতেছে সৌন্দর্য্য, যাহা হইতেছে নিজের আত্মার অভ্যন্তরের সমস্ত জিনিসের অবাধ বিকাশ)। এই বিষয়ে ম্যাক্সিম গর্কি উপহাস করিয়া বলিয়াছেন,—আমরা ভাল করিয়াই জানি বুর্জোয়া ব্যক্তিত্বের আত্মা কি পচাদ্রব্যে ভারাক্রান্ত হইয়া আছে (Problems of Soviet Literature দ্রষ্টব্য)।

এই প্রকারের অবসাদ প্রাপ্ত বৈপ্লবিক কর্ম্মীদের দূষিত চরিত্রের নমুনা অ্যালেক্সি টলষ্টয় তাঁহার Road to Calvary নামক নভেলে কিঞ্চিত চিত্রিত করিয়া দেখাইয়াছেন।

১৯১৮খৃঃ যুদ্ধে পরাজয়ের পর, জার্ম্মাণীরও এই প্রকারের নৈতিক দশা বিকাশ পায়। গুপ্তভাবে Pornological club (যৌন সম্বন্ধীয় ক্লাব), Frei Mensch (স্বাধীন মানব) নামক যৌনসম্বন্ধীয় পত্রিকা, রাত্রিকালীন উলঙ্গ নৃত্যের স্থান প্রভৃতির উদয় হয়। পুলিশ কিছুতেই তাহা প্রতিরোধ করিতে পারে নাই। ইহারই প্রতিবাদে একপ্রকারের এক কাগজের সম্পাদক পুলিশের বড়কর্ত্তাকে সম্বোধন করিয়া লিখিয়াছিল: “অমুক অধ্যাপক, এই গতিতে আপনি বাধা দিবেন না; যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ যৌন সম্বন্ধের অবাধগতি এখন চলিতেছে।” কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ভারতে কি রুশের ১৯০৫ খৃঃ এবং জার্ম্মাণীর ১৯১৮ খৃঃ ন্যায় রাজনীতিক অবসাদ আসিয়াছিল? না ইহা বৈদেশিক অনুষ্ঠান ধার করিয়া এদেশের সাহিত্যে আরোপ করা হইয়াছিল?

পরাধীন জাতির লোক সামাজিক একত্ববোধ হারায়, তাহার সামাজিক চেতনা লোপ পায়, সে কেবল “চাচা আপন বাঁচা” নামক নীতি উদ্ভূত করিয়া দায়িত্বহীন ব্যক্তিত্বই বিকাশ করিবার চেষ্টা করে। “দশ মানেই দেশ, এবং দশে মিলেই সমাজ” এবং এই সমাজের একজন লোক বলিয়া তৎপ্রতি তাহার কর্ত্তব্য আছে এবং তাহার প্রতি সমাজেরও দায়িত্ব আছে, এই মনোভাব পরাধীন জাতি হারায় বা তাহা বিবর্ত্তিত করিতে পারে না। এই জন্য নানাপ্রকার উদ্ভট মতবাদ দ্বারা জাতীয় দুর্গতি, দৈন্য ও দুর্দ্দশা ঢাকিবার চেষ্টা করা হয়। পরাধীন জাতির মধ্যেই ব্যক্তিত্ববাদের অবাধগতির কথা শুনা যায়। এই কারণবশতই এই দেশে “সমাজের নেতৃত্ব” ও “সমাজের দায়িত্ব” প্রভৃতি তথ্য বৈদেশিক বিপ্লববাদীর কথা বলিয়া অনেকের কানে প্রতীয়মান হয়!!

এই সব কারণবশতঃ উপরোক্ত সাহিত্যকে পূর্ণভাবে বুর্জোয়া সাহিত্য বলা যায় না। এই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে বর্ত্তমান ভারতীয় রাজনীতিক পরিস্থিতিতে চরখা, খদ্দর, অহিংসা প্রভৃতি অনুষ্ঠানের অভ্যুদয় হইয়াছে এবং এই সঙ্গে অস্পৃশ্যতাবর্জ্জন আন্দোলন ও সংযোজিত হইয়াছে। অবশ্য, অস্পৃশ্যদের নিয়া একটা নভেল রচিত হইয়াছে বটে, কিন্তু এই সব আন্দোলন একটা বিশিষ্ট সাহিত্য উদ্ভব করিতে পারে নাই। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাশ্চাত্যভূভাগে রাজনীতিক অবস্থা এবং নবোত্থিত পুঁজিবাদ তৎসঙ্গে মিলিত হওয়ায় যে রাষ্ট্রিক অর্থনীতিক পরিস্থিতির উদয় হয়, তাহাতে শোষিত গণসমুহের হাহুতাসের মধ্য দিয়া পাশ্চাত্য জগতের বিভিন্নদেশে যে কুটির শিল্প ও অহিংসাবাদের আন্দোলন সৃষ্ট হয় তদ্রূপ, ভারতীয় এই আন্দোলনও পাশ্চাত্য রাসকিন, হেনরী জর্জ্জ ও টলষ্টয়ের ভাবধারা এই দেশে আনয়ন করিয়াছিল। হতাশতার প্রতীকরূপে এই আন্দোলন খৃঃ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে ভারতে আবির্ভূত হয়। সেইজন্য উল্লেখযোগ্য একটা প্রাণবন্ত সাহিত্য এই আন্দোলন সৃষ্ট করিতে পারে নাই।

একটা জাতির অধঃপতনের অবস্থায়ই কালব্যতিক্রম দ্বারা নানা প্রকার উদ্ভট উপায় অনুষ্ঠিত হয়। এই মানসিক অবস্থায় একদল জাতির ভবিষ্যতের প্রতি বিশ্বাস হারায় এবং ‘যাহা হবার তাহা হবে’ বলিয়া হা-হুতাস করিয়া দিন কাটায় বা কেবল বিদেশকে স্বর্গরাজ্য বলিয়া তাহার গুণগাণ করিয়া বেড়ায়। এই জাতীয় অবসাদকে তাহারা “আন্তর্জ্জাতিকতা” বলিয়া ঢাকা দেয়। এই প্রকারে দেশের প্রতি বিশ্বাস হারান দ্বারা দেশেরই ক্ষতি সাধিত হয়। ফ্রান্সেও খৃঃ ১৮৭০ যুদ্ধের পরাজয়ের পর, এই প্রকারের অবসাদ আসে, কিন্তু কালে তাহার প্রতিক্রিয়ায়ও আভির্ভাব হয়, কারণ কোন জাতিই কেবল “নেতি নেতি” ভাব লইয়া চিরকাল বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। Neo-Realists নামক সাহিত্যিক দল উঠিয়া এই মানসিক অবসাদের অবসান ঘটায়। তাহারা যন্ত্রতান্ত্রিক সভ্যতাপ্রসূত নূতন নগর, তাহার সঙ্ঘ, তাহার কারখানা, রেলওয়ে ষ্টেসন প্রভৃতিতে বিংশশতাব্দীর ক্ষমতা ও শক্তির বিকাশ দেখিতে পায়। এক কথায় বর্ত্তমানের নূতন জীবনের সৃষ্টি শক্তি ও তাহার সৌন্দর্য্যের সন্ধান তাহারা পায়। এতদ্বারাই তাহারা ফ্রান্সকে পুনর্জীবিত করিতে সক্ষম হয়। এক্ষণে দ্রষ্টব্য যে বাঙ্গলায় সভ্যতার বর্ত্তমান ঘাতপ্রতিঘাতে কি ভাবধারা সাহিত্য মধ্যে উদয় হইয়াছে।


বর্ত্তমান সাহিত্য মধ্যে নূতন ভাবধারার অন্বেষনার্থ তন্মধ্যে প্রবেশ করিলে দৃষ্ট হয় যে, ইহা ক্রমশঃ বিরাটাকার ধারণ করিতেছে। নানা ভাবধারা ইহার মধ্যে প্রবেশ করিতেছে, তন্মধ্যে প্রধান সুর যাহা ইহাতে বাজিয়া উঠিতেছে তাহা বর্ত্তমানের নবীন সাহিত্যিকেরা বাস্তবকে রূপ প্রদান করিবার চেষ্টা করিতেছেন। এই বিশাল সাহিত্যের সম্পূর্ণ আলোচনা এই স্থলে সম্ভব নহে, কিন্তু দুএক কথায় বর্ত্তমান সাহিত্যের গতি বিষয়ে আলোচনা এই স্থলে লিপি বদ্ধ হইল। প্রথমে ইহা প্রতীত হয় যে, নূতন সাহিত্যের বেশীর ভাগ মধ্যবিত্ত হইতে কায়িক শ্রমকারী শ্রেণী সমূহ পর্য্যন্তের জীবন যাত্রার চিত্র প্রকাশ করিয়াছে। এতদ্বারা স্পষ্টই বোধগম্য হয় যে বাঙ্গলা সাহিত্যে একটা নূতন হাওয়া বহিতেছে। এই সাহিত্য হয় ‘জন’ না হয় ‘গণ’ শ্রেণীর দৈনন্দিন জীবনের সন্ধানে নিযুক্ত আছে। এই বিষয়ে কেহ কেহ কৃতকার্য্য হইয়াছেন বলিয়া প্রতীত হয়।

এই সাহিত্যের পর্য্যালোচনা করিলে, নিম্নলিখিত ভাবধারা প্রাপ্ত হওয়া যায়: “ভূয়োদর্শন” প্রভৃতি পুস্তকে আমরা Impressionist এবং Ideational ভাব পাই। এই ধরনের সাহিত্য আদৌ প্রগতিশীল নহে।

“গড্ডালিকা” এবং “কজ্জলী” পুস্তকের গল্পগুলি Impressionist, এবং Ideational লক্ষণযুক্ত। ইহাতে প্রগতি নাই। Humour আছে কিন্তু ‘গড্ডালিকা’ ও ‘বিরিঞ্চিবাবা’ নামক গল্প দুইটি বাস্তব ঘটনার চিত্র দিয়াছে। এই দেশে প্রতিনিয়তই এই প্রকারের ধর্ম্মের নামে প্রবঞ্চনা চলিতেছে, এই গল্প দুইটি Realist এবং Sensate লক্ষণক্রান্ত। ১৯০৭ সালে কলিকাতায় এক আমেরিকান কোম্পানী ধর্ম্মের নামে বিরিঞ্চ বাবার ন্যায় জুয়াচুরীর দৃশ্য চালাইত। শেষে কয়েকজন যুবক তাহা ধরিয়া মারধর করিতে তাহারা পালায়।

“উপনিবেশ” পুস্তকে গঙ্গার ‘ব’ দ্বীপের পূর্ব্বস্থানে মগ ও ফিরিঙ্গিদের বর্ত্তমান বংশধরদের কলহ ও ভয়াবহ জীবন অঙ্কিত হইয়াছে। ইহা Neo-realistic অর্থাৎ বাস্তবকে নূতন দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা চিত্রিত করা হইয়াছে, এবং Sensate লক্ষণ যুক্ত।

“কয়লা-কুঠি” সাঁওতাল শ্রমিকদের জীবনী প্রকাশ করিয়াছে। ইহা Impressionist এবং mixed লক্ষণযুক্ত। “পাঁক” পুস্তকে শ্রমজীবির বাস্তব জীবন চিত্রিত হইয়াছে। ইহা Neo-Realist এবং mixed লক্ষণযুক্ত। “পদ্মানদীর মাঝি”তে আমরা ফরিদপুর জেলার উক্তশ্রেণীর লোকদের জীবন যাত্রার সন্ধান পাই। ইহা Realist এবং Sensate লক্ষণযুক্ত।

“নোঙরহীন নৌকায়” আমরা ভূমিশূন্য কৃষকের অবস্থা এবং হুগলীর কারখানার স্ত্রী ও পুরুষ শ্রমিকদের জীবনধারার কিঞ্চিৎ সংবাদ পাই। ইহা Neo-Realist এবং Sensate লক্ষণযুক্ত।

“একদা” জীবনের পরিবর্ত্তনের কিঞ্চিৎ বাস্তব ছাপ অঙ্কিত করেছে। ইহা Neo-realist ও mixed লক্ষণযুক্ত। “ডেটিনিউ” realist-impressionist এবং mixed লক্ষণযুক্ত!

“সহরতলী”তে একদল শ্রমজীবির জীবনের ধারা লোকচক্ষে উদ্ঘাটিত হইয়াছে, ইহা Realist এবং mixed লক্ষণযুক্ত। “ফসিল” নানা ভঙ্গীর গল্পের সমাবেশ। “রাই কমল”, “বিনোদিনী” প্রভৃতিতে জাতি বৈষ্ণবদের জীবনধারা শিক্ষিত শ্রেণীর সহিত পরিচিত করা হইয়াছে। এই গুলি impressionist এবং mixed লক্ষণযুক্ত। “বেদিনী”তে এই শ্রেণীর সংবাদ প্রদত্ত হইয়াছে। অন্যপক্ষে, ‘ধাতুদেবতা,’ ‘গণদেবতা,’ ‘কালিন্দী, ‘মরামাটি’ প্রভৃতি নভেলে আমরা সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ধ্বংসের শেষাবস্থাই চিত্রিত হইতে দেখি! এইগুলিতে বাস্তবচিত্রের কিঞ্চিৎ ছাপ আছে, এইজন্য ইহা Neo-realist এবং mixed লক্ষণযুক্ত বলিয়া বিবেচিত হয়। পুনঃ, “আদর্শ হিন্দু হোটেল” পুস্তকে গরীব শ্রমজীবীর জীবন সংগ্রামের চিত্র প্রদর্শিত হইয়াছে। ইহা Expressionist এবং mixed লক্ষণযুক্ত।

এতদ্বারা দৃষ্ট হয় যে বাঙ্গলা সাহিত্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উপস্থিত কালের গরীব-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনকে কেন্দ্র করিয়াই সৃষ্ট হইতেছে। যে শ্রেণী কার্য্যতঃ শ্রমজীবী শ্রেণীতে পরিণত হইয়াছে অথচ বংশ ও জাত্যাভিমান বশতঃ নিজের অর্থনীতিক পদ স্বীকার করিতে রাজী নয় সেই শ্রেণীরই জীবনের ‘ট্র্যাজেডি’ (বিয়োগান্তে নাটক) উদ্ঘাটনে বর্ত্তমানের সাহিত্যিকেরা রত। ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বভাববশতঃ সমাজে এই সমস্যা উপস্থিত হইয়াছে এবং এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রেরণাতেই এই সাহিত্যের উদয় হইয়াছে। প্রাচীন সাহিত্যের ভাবধারা পরিত্যাগ করিয়া বাস্তব ও তুলনামূলক চিন্তাপ্রণোদিত হইয়া এই সাহিত্য নূতন পথের অনুসন্ধান করিতেছে। কিন্তু ইহা জনের সন্ধান দিতেছে বটে তথাপি পাশ্চাত্য মাপকাটির বুর্জোয়া সাহিত্য নহে। ইহার বেশীর ভাগ স্থলে বর্ত্তমানকালের ভাঙ্গনের চিত্রই অঙ্কিত করিয়াছে। “আদর্শ হিন্দু হোটেল” ব্যতীত আশাবাদ ইহাতে দৃষ্ট হয় না। ইহা বাঙ্গলার Decadent যুগেরই আর একটা চিত্র প্রদর্শন করিয়াছে।

এই সাহিত্য পূর্ব্বের সনাতনী খাত হইতে বাহির হইতেছে বলিয়া ইহা আপেক্ষিক প্রগতিশীল বলিয়া নির্দ্ধারিত হইবে।

শেষে আসে বর্ত্তমানের সাময়িক সাহিত্য। ভীষণ রাজনীতিক, অর্থনীতিক বিভীষিকা ও দুঃর্ভিক্ষ বাঙ্গলায় যে “ঝটিকাও অশনিপাতের যুগ” সৃষ্ট করিয়াছে তাহার কথঞ্চিৎ চিত্র আমরা নিম্নলিখিত সাহিত্যে পাই। বর্ত্তমান বাঙ্গলার গরীবের সমাজ কি প্রকারে এই ঝটিকা ও অশনিপাতের দ্বারা বিপর্য্যস্ত হইয়াছে এবং হইতেছে, “অঙ্গার”, “মহামন্বন্তর”, “পদচিহ্ন” তাহা চিত্রিত করিয়াছে। গরীব মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনী কি প্রকারে দারিদ্র্যের তাড়নায় ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে এবং চরিত্র কলুষিত হইতেছে তাহা এই সকল পুস্তকে অঙ্কিত হইয়াছে। অবশ্য ইহা সমাজের ভাঙ্গনেরই চিত্র অঙ্কিত করিয়াছে, ইহাতে জীবনের নিরাশাই পরিস্ফুট হইয়াছে। পাঠক হয়ত বলিবেন ইহা কি সত্য, কিন্তু আসল সত্য আরও ভীষণ। এই শ্রেণীর সাহিত্য Neo-realistic impressionist এবং Sensate লক্ষণাকান্ত

“দুর্ভিক্ষ” নামক পুস্তক কবিতা এবং গদ্যে লিখিত। ইহা Neo-realistic এবং mixed অর্থাৎ Idealistic লক্ষণ যুক্ত।

কিন্তু এই সব সাহিত্যের মধ্যে কোন কোন পুস্তক পারস্পরিক রাজনীতিক দলাদলির কটাক্ষপাত বিমুক্ত নহে। ইহাই দুঃখের কথা।

“মানুষ” পুস্তকে দুঃখী মানুষের গল্পই লিখিত হইয়াছে। ইহ! Neo-realist এবং Sensate লক্ষণ যুক্ত।

“ভূখা-হুঁ” পুস্তকে বর্ত্তমান মহাযুদ্ধের ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলে কি করিয়া গরীব মধ্যবিত্ত শ্রেণীয় পরিবার শোচনীয়তার চরম সীমায় উপনীত হইল তাহার এক চিত্র প্রদত্ত আছে। ইহা Realistic-impressionist এবং Sensate লক্ষণ যুক্ত। ইহাতে বায়স্কোপ অভিনেতা অভিনেতৃদের জীবনীর সম্ভবপর চিত্র প্রদর্শিত হইয়াছে।

ইহাতে প্রগতিশীল সাহিত্যের সন্ধান নাই।

“উদয়গড়” পুস্তকে সেবাব্রতী তরুণ ও তরুণী দ্বারা দুর্ভিক্ষ মধ্যে কর্ম্ম প্রচেষ্টা ও স্বার্থপর ব্যবসায়ীদের দ্বারা তাহা প্রতিহত করার গল্প বর্ণিত হইয়াছে। ইহা realist-impressionist এবং mixed লক্ষণযুক্ত।

“নবান্ন” পুস্তকে বর্ত্তমান যুদ্ধকালীন কৃষকদের অন্নসমস্যার চিত্র প্রদত্ত হইয়াছে। ইহাতেও পারস্পরিক রাজনীতিক দলাদলির ইঙ্গিত আছে। ইচ্ছা Neo-realist এবং mixed লক্ষণযুক্ত। ইহাতে প্রগতির চিহ্ন আছে।

“উদয়ের পথে” নামক পুস্তকে অনাগত কর্ম্মীর সম্বর্দ্ধনা হইয়াছে। ইহাতে বাস্তব ভিত্তিতে আদর্শবাদ বিজড়িত হইয়াছে। ইহা Neo-realist এবং mixed লক্ষণ যুক্ত। ইহাতে প্রগতিশীলতার স্পষ্ট নির্দ্দেশ আছে।

“নবীন যুবক” পুস্তকে শিক্ষিত নবীন যুবকের বেকার সমস্যা এবং তাহার মনস্তত্ত্ব অঙ্কিত হইয়াছে। এই বেকার অবস্থাতেও সে সমাজ সেবার চেষ্টা করিতেছে। অন্যদিকে ধনী শিক্ষিত যুবক অল্পায়াসেই কি প্রকারে সমাজে বরেণ্য হইতেছে এবং হাততালি পাইতেছে তাহাও প্রদর্শিত হইয়াছে। এই পুস্তক পাঠে ফরাসী বিপ্লবের প্রাগসাহিত্য “ফিগারোর বিবাহ” নামক পুস্তক স্মৃতিপটে আসে। তথায়ও এই সমস্যা উদঘাটিত হইয়াছে। এই পুস্তক Neo-realist ও sensate ভাবযুক্ত। “প্রতিবিম্ব” নামক পুস্তকে লেখক নিজেই বলিয়াছেন, “মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষিত জাতীয়তাবাদী সাধারণ কর্ম্মী যুবকের মনে নবযুগের নতুন ভাবধারার প্রভাবে কি আলোড়ন সৃষ্টি হইয়াছে; ভাবপ্রবণতা ও বাস্তব বোধের দ্বন্দ্ব কিরূপ নিয়াছে; সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি কোন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করা উচিত এই নিয়ে যে দ্বিধা ও সংশয়ের ভারে সে ব্যাকুল হয়েছে···‘প্রতিবিম্ব’ তারই এক দিককে রূপ দেবার চেষ্টা”। এই পুস্তক Neo-realist ও sensate ভাবযুক্ত।

“নবীন যুবক” ও ‘প্রতিবিম্ব’ দেশের দুইটি বিভিন্ন কালের চিত্র আঁকিয়াছে। একটী আর একটীর পরিপোষক সামাজিক চিত্র। শিক্ষিত নবীনযুবক ‘ধর্ম্মাশ্রম’ প্রভৃতির দ্বারা আর্ত্তের সেবা করিতে ব্যগ্র। সে নিজের কর্ম্মজীবনের গতি খুঁজিয়া পাইতেছে না। অন্য দিকে “প্রতিবিম্ব” পুস্তকে নবীন যুবক দলবদ্ধ হইয়া একটা নূতন কর্ম্মপদ্ধতি গ্রহণ করিয়া কার্য্য করিতেছে। সে ‘পার্টির’ মধ্যে থাকিয়া ‘ট্রেনড, ডিসিপ্লিন্‌ড’ হইয়া একত্র ‘কমুনে’ বাস করিয়া কার্য্য করিতেছে। সে দেশের পরিচিত চাষী মজুরগুলোকে একবার চিনিয়া আসিতে হইবে, বলে। এই দুই পুস্তকে বাঙ্গালার তরুণের কর্ম্মের ক্রমবিকাশের পর্য্যায় চিত্রিত হইয়াছে। আজকের সমস্যা ও পরিস্থিতি কালকের নয়। সমাজের চাকা যে প্রতিনিয়তই ঘুরিতেছে, এই দুই পুস্তকে‍ই তাহা চিত্রিত হইয়াছে। সত্যই লেখক বলিয়াছেন, কিছুকাল পরে, ‘প্রতিবিম্ব’ হয়ে যাবে ‘পুরাণো ছবি’। এই সাহিত্য Symbolic এবং sensate লক্ষণযুক্ত।

এই প্রকারের নব-সাহিত্য বাঙ্গালার সাহিত্য ক্ষেত্রে একটা নূতন ধারা প্রবর্ত্তিত করিয়াছে। এই সাহিত্যে বাস্তবের ছাপ আছে এবং তাহা নূতন দৃষ্টি কোণ দ্বারা বর্ণিত হইতেছে বলিয়া, বর্ত্তমানের এই সাহিত্যকে এইস্থলে Neorealist নাম প্রদত্ত হইল। পুনঃ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে তুলনামূলক বিচার দ্বারা গ্রহণ করা হয় অর্থাৎ অযৌক্তিক ও ইন্দ্রিয়ের বহির্ভূত আদর্শের প্রচার ইহাতে নাই বলিয়া এই সাহিত্য Sensate বলিয়া গণ্য হয়। কিন্তু ইহা ‘গণসাহিত্য’ নয়। যেরূপ বুর্জোয়ার জীবনের বিবৃতিতে বুর্জায়া সাহিত্য হয় না, তদ্রূপ গণশ্রেণীর জীবনসম্বন্ধে লিখিলেই তাহা ‘গণ-সাহিত্য হয় না।

বাঙ্গলার সনাতনী অর্থাৎ অভিজাত-সাহিত্য এখন জমিদারের ও ধনীর ফটক পার হইতে পারে নাই, অবশ্য ইহাও একটা কাল-ব্যতিক্রম। পূর্ব্বেকার জন ও গণের জীবনী সম্বন্ধীয় নভেলগুলিতে জমিদার পুত্রই প্রজা বা গরীব গণশ্রেণীকে উদ্ধার করিতে অগ্রসর হইতেছেন, আর কোন কোন স্থলে তাহার সহকারী হইতেছেন মহামহোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত! যেদিন গণশ্রেণীর লোক সাহিত্যে স্বীয় সমাজের চিত্র সাহিত্যে অঙ্কন করিবে, সেই দিন একটা জীবন্ত গণ-সাহিত্য উদ্ভূত হইবে।

  1. এই পুস্তক জার্ম্মানভাষার অধ্যাপক Gruenwedel—“Edelsteinmine” নামে ভাষান্তরিত করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। পুনঃ, তাহা বর্ত্তমান লেখকের দ্বারা “Mystic Tales of Lama Taranath” নামে ইংরেজীতে ভাষান্তরিত হইরাছে।
  2. লেখকের “বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতত্ত্ব” দ্রষ্টব্য।
  3. এই পুস্তকখানি প্রেস হইতে বহির্গত হইবার অগ্রমূহুর্ত্তে “কাব্য-মালঞ্চের” সন্ধান লেখকের কাছে আসে। এইজন্য বিশষভাবে আলোচনা করা এইস্থলে সম্ভব হইল না। এই হেতু সম্পাদক মহোদয়দের কাছে গ্রন্থকার মার্জ্জনা চাহিতেছেন।