সাহিত্যে প্রগতি/উর্দু সাহিত্যে প্রগতি
উর্দু সাহিত্যে প্রগতি
এক্ষণে উর্দু সাহিত্য বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাক। উর্দু ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বঙ্গভাষীদের জ্ঞান কম। সাধারণতঃ লোকের বিশ্বাস যে ইহা মুসলমানের ভাষা এবং এই ভাষার সাহিত্য তাঁহাদেরই নিজস্ব সম্পত্তি। বর্ত্তমানের রাজনীতিক বিবাদ এই ধারণা আরও বদ্ধমূল করিয়াছে। কিন্তু ভারতে অনেক হিন্দু আছেন যাঁহাদের মাতৃভাষা উর্দু; অন্যপক্ষে, ভারতের বেশীরভাগ মুসলমানের মাতৃভাষা উর্দু নহে! এই জন্য, এই বিষয়ের যৎকিঞ্চিৎ ঐতিহাসিক আলোচনা এই স্থলে অপ্রাসঙ্গিক হইবে না।
ঊনবিংশ শতাব্দীতেই উর্দু ভাষা পুষ্টি লাভ করে। এই শতাব্দীর শেষাশেষি ৺অধ্যাপক মহম্মদ হুসেন আজাদ প্রথমে “আবেহায়াৎ” নামক পুস্তকে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি বিষয় লিপিবদ্ধ করিয়া প্রকাশ করেন। তিনি বলিতেছেন “ইতনী বাত হর সখস জানতা হ্যায় কি হমারী উর্দুজবান বরজ ভাষাসে নিকলী হ্যায় অউর বরজ ভাষা খাস হিন্দুস্থানী জবান হ্যায়” (পৃঃ ১)। এতদ্বারা আমরা এই সন্ধান পাই যে উর্দু, সৌরসেনী-প্রাকৃতের বর্ত্তমানের অন্যতম সন্তান “ব্রজভাষা” প্রসূত। কিন্তু রাম নরেশ ত্রিপাঠী বলেন উর্দু কখন কোন ভাষা হইতে বহির্গত হয় নাই। “হিন্দী” ভাষারই নাম উর্দু রাখা হইয়াছে; এই ভাষার নাম “মুসলমানী হিন্দী” রাখিলে নামের অধিকতর সার্থকতা হইত (কবিতা কৌমুদী ৪ ভাগ, পৃঃ ৩)। কিন্তু রামবাবু সাকসেনা[১] বলেন দিল্লী ও মীরাটের চতুষ্পার্শ্বে সৌরসেনী প্রাকৃত উদ্ভূত যে পশ্চিম বিভাগীয় হিন্দী প্রচলিত আছে উর্দু তাহারই একটী উপভাষামাত্র। উর্দু নামটি হালে প্রদত্ত হইয়াছে। দিল্লী মুসলমান বাদসাহদের রাজধানী হওয়ায় ঘটনাচক্রে এই ভাষা সাধারণের ভাষা (Lingua Franca) হইয়াছে। এই জন্য মীর আমন প্রভৃতি যখন বলেন ইহা দিল্লীর বাজারের “খিচড়ী ভাষা” তখন তাঁহারা ভুল করিয়াছেন। সাকসেনার মতে আজাদও ভুল করিয়াছেন যখন তিনি ব্রজ ভাষাকে উর্দুর জননী বলেন। বরং আর একটী পশ্চিম বিভাগীয় উপভাষা হইতেই উর্দুর উৎপত্তি হয়। এখনকার মত এই যে, পৃথ্বীরাজের সময়ে যে ভারতীয় ভাষা দিল্লী এবং তাহার চতুঃপার্শ্বে প্রচলিত ছিল, তাহার সহিত ফার্সী প্রভৃতি মিশ্রিত হইয়া উর্দুর সৃষ্টি হইয়াছে। এই ভারতীয় ভাষাটির নাম এক্ষণে “খড়ী বোলী” বলা হয়। ইহাও সৌরসেনী-প্রাকৃত প্রসূত একটা উপভাষা মাত্র। কিন্তু এই নাম পূর্ব্বেকার কোন পুস্তকে প্রাপ্ত হওয়া যায় না। ৺পদ্ম সিং শর্ম্মা[২], বলেন সাধারণের ভাষাকে মুসলমান আমীর ওমরাহেরা “ভাষা” বলিতেন, পরে দক্ষিণ হইতে ওয়ালী দিল্লীতে আসিয়া যখন সাধারণের ভাষা ও ফার্শী মিশ্রিত “দীবান” নামক সাহিত্য প্রকাশ করেন, তখন মুসলমান আমীরেরা দেখিলেন, “বাঃ এত আমাদের ঘরের ভাষায় লিখেছে!” তখন তাঁহারা ফার্শী ভাষায় কবিতা লেখার অভ্যাস ত্যাগ করিয়া এই মিশ্রিত ভাষায় লিখিতে আরম্ভ করেন। সেই সময়ে যাহা “পড়ে” ছিল তাহা “খাড়া” করা হয়! (এই বিষয়ে ‘আবেহায়াৎ’ দ্রষ্টব্য)! পণ্ডিত চন্দ্রধর শর্ম্মা গুলেরী বলেন, উর্দু রচনাতে ফার্শী ও আরবী তৎসম ও তদ্ভব শব্দ সমূহ বহিষ্কৃত করিয়া সংস্কৃত অর্থাৎ হিন্দীর তৎসম ও তদভব রাখিয়া তাহাকে হিন্দীতে রূপান্তরিত করা হইয়াছে, এই জন্য উর্দু হিন্দীর একটা বিভাগমাত্র (পদ্মসিংশর্ম্মা দ্বারা উদ্ধৃত পূঃ ৩৪-৩৫)। এই সব মতানুসারে হিন্দুস্থানী বা উর্দু “উর্দু-ই-মুয়াল্লার” (সৈনিক বাজার) থিচড়ী ভাষা নহে। এই উর্দুর পুরাতন নাম ছিল হিন্দী! এই শব্দের প্রথম সংবাদ আমরা পাই, আমীর খসরুর অভিধান—‘খালেকবারী’তে। তিনি “হিন্দী” আর “হিন্দবী” উভয় শব্দই ব্যবহার করিয়াছেন। ইহার অর্থ, ভারতীয় ভাষা।
পূর্ব্বেকার অনেক মুসলমান কবি যথা আতিশ, ইনসা, বাকর আগহ, জুরঅত, মীর, মুসাফী উর্দুকে “হিন্দী” নামে অভিহিত করিয়াছেন। এই শেষোক্তদের যুগে ফার্শী হইতে পার্থক্য দেখাইবার জন্য উর্দু কে “হিন্দী” নামে অভিহিত করা হইত। এতদ্বারা তাঁহারা বুঝাইতে চাহিতেন যে, ইহা দেশজ ভাষা, বৈদেশিক নহে। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়েরা এই ভাষাকে “Indostan” বলিত। পরে ইংরেজ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হইলে, ডাঃ গিলক্রাইষ্ট ১৭৪৮ খৃষ্টাব্দে “Hindustanee” এই নামটির সৃষ্টি করেন এবং নির্দ্ধারিত করিয়া দেন যে ইহার দুই শাখা-হিন্দী এবং উর্দু! এই সঙ্গে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ হইতে হিন্দী ব্যাকরণের সৃষ্টি করেন এবং আরবী ব্যাকরণের উপর উর্দু ব্যাকরণের ভিত্তি সংস্থাপন করেন। এই প্রকারে সাম্রাজ্যবাদীয় নীতির সার্থকতা স্বরূপ আজ আমরা “হিন্দী” ও “উর্দু” ভাষার উদ্ভব ও কলহ ভারতের ইতিহাসে প্রাপ্ত হই!
ভারতীয় হিন্দী বা হিন্দবী[৩] ভাষা কবে হইতে বিদেশীজাত শব্দসমূহ গ্রহণ করিতে আরম্ভ করে এই প্রশ্ন এক্ষণে উঠিয়াছে। অধ্যাপক আজাদ বলিয়াছেন, গোড়া হইতেই আরবী ফার্শী শব্দ সমূহ দেশজ ভাষাতে গৃহীত হইতে থাকে। তাহার প্রমাণ স্বরূপ তিনি কবি চাঁদ বরদাইএর “পৃথ্বীরাজ-রাসো” উল্লেখ করেন। আবার, তিনি ইহাও বলেন যে, তখনকার ভাষা এখনকার হিন্দীর সহিত মিলে না (পৃঃ ১৫)। কিন্তু, বর্ত্তমানের সমালোচনা ইহা প্রমাণিত করিয়াছে যে চাঁদ “ডিঙ্গল” ভাষায় আকবরের সময়ে তাঁহার কাব্য লিখিয়াছিলেন! কাজেই অনেক বিদেশী শব্দ সেই সময়ে হিন্দুদের কথ্য ভাষায় প্রবেশ করিয়াছে। তদ্রূপ, তুলসীদাসের ভাষাও আকবরের সময়ের হিন্দুদের ভাষা, ইহাতেও বৈদেশিক শব্দ অপ্রতুল নহে। তৎপর, আজাদ বলেন, খৃঃ পঞ্চদশ শতাব্দীতে কায়স্থ জাতীয় লোকেরা সিকন্দর লোদীর শাসন কালে রাজকর্ম্ম গ্রহণ করে ভাষাতে ফার্শীশব্দ সমূহ প্রবিষ্ট করায় (পৃঃ ১৬)।
ইহার পর আসে, আকবরের যুগ, তখন উভয় জাতির সম্মিলনের যুগ। আজাদ বলেন, “ওমরাহেরা জোব্বা ও দস্তা পরিধান করিতে থাকে এবং দাড়ীকে ‘খোদা হাফিজ’ (বিদায়) করিয়া দেয় এবং খারকীদার পাগড়ী মাথায় দিতে থাকে। অন্য পক্ষে হিন্দু অভিজাতেরা, রাজা এবং মহারাজেরা ইরাণী পোষাক পরিতে থাকে, ফার্শীভাষা শিক্ষা করিতে থাকে এবং “মির্জা” পদবী গ্রহণ করিতে থাকে” (পৃঃ ১৬-১৭)। আকবরের দরবারে যে হিন্দীর প্রচলন ছিল তাহার নানা প্রমাণ আছে। সর্ব্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ মিঞা তানসেনের গানসমূহ। পুনঃ, ‘আকবর নামা’ ও বদায়ুনী লিখিত পুস্তক সমূহে আকবরের বাল্যকালের একটী ঘটনা দ্বারা ইহা প্রমাণিত হয়। ঘটনাটি এই: তাঁহার যখন চৌদ্দ বৎসর বয়স, তখন তাঁহার দুধ-ভাই (Foster brother) জীঘাংসাপরায়ণ হইয়া বৃদ্ধ অর্থসচিবকে হত্যা করে। ইহাতে রাজপ্রাসাদে গোলমাল পড়িয়া যায়। এই সময়ে তিনি ঘুমাইতেছিলেন, গোলমাল শুনিয়া উঠিয়া ছাতের পাঁচিল থেকে উঁকি মারিয়া তাঁহার দুধ-ভাইকে সম্বোধন করিয়া বলেন—
“আয়—তু (ফলানা) বেচারাকো মারি কিস্তি?” কেহ কেহ বলেন, তিনি জাগিয়াই তুর্কিতে জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু ঐতিহাসিক সঠিক তথ্য এই যে, তিনি উক্ত কথাই বলিয়াছিলেন। এক্ষণে আমরা দেখি যে ইহা স্থানীয় মিশ্রিত হিন্দী ব্যতীত আর কিছু নয়! তৎপর আজাদ বলেন, “আউরঙ্গজেবকে গুজরাটের শাসনকর্ত্তা এক নূতন প্রকারের আম্র উপহার পাঠান। তিনি হিন্দী ভাষায় তাহার নামকরণ করেন।” পুনঃ, তিনি বলেন, মুসলমানেরা এই সময়ে এই দেশে বসবাস করে, এই দেশের ভাষাকে আদর করে; তাহার সাক্ষ্য আমীর খস্রৌ ও মুহম্মদ জায়সীর কবিতা। তাঁহারা এই দেশের ভাষাকে স্বীয় মাতৃ ভাষা বলিয়া গ্রহণ করেন।
পৃথ্বীরাজের পতনের আশী বৎসর পরে ভারতবর্ষে আমীর খস্রৌর জন্ম হয়। তাঁহার পিতা বল্খ সহর হইতে মঙ্গোলদের ভয়ে ভারতে পলাইয়া আসেন। তিনি তুর্কীবংশীয় ছিলেন। খস্রৌ ফার্শী আর স্থানীয় দেশজ ভাষায় কবিতা লিখেন। এক্ষণে দৃষ্ট হয়, যে দেশজ ভাষায় কবিতা তিনি লিখিয়া গিয়াছেন তাহা আজকাল কার “খড়িবোলী” হিন্দী। এইজন্য বর্ত্তমানের হিন্দী সাহিত্যিকেরা তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ যে তিনি খড়ি বোলীকে সর্ব্বপ্রথমে সাহিত্যে স্থান দেন। তাঁহার এই দেশজ ভাষা দিল্লীর আশপাশের স্থানীয় “হিন্দী”। বর্ত্তমানের কোন কোন লেখক তাঁহাকে বর্ত্তমান ভারতের সর্ব্ব প্রথম জাতীয় কবি বলিয়া অভিহিত করিতে চাহেন। কথাটা অতি সত্য। তদ্ব্যতীত, তিনি ভারতবর্ষকে যে চক্ষে দেখিয়াছেন এবং যে উচ্চে তুলিয়া ধরিয়াছেন, সেই ভাবে কেবলমাত্র বহুপূর্ব্বে, বিষ্ণুপুরাণে এবং বহুপরে বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দেমাতরং” সঙ্গীতে প্রকাশ পাইয়াছে। একটা ফার্শী কবিতায় তিনি বলিয়াছেন—
“চুঁদর চীন দিদ বুলবুল-ই বোস্তাঁরা।
(যারা চীনের পক্ষী দেখিয়া ফুলবাগানের বুলবুল দেখিয়াছে বলে)
ন দানেন্দ তুতি-ই-হিন্দুস্থান রা।
(তারা হিন্দুস্থানের তুতিপাখির সংবাদ কি জানে!)
খোরাসনী ক হিন্দি গরদেশই-ঘুল
(খোরাসানীরা বলে হিন্দুস্থানের লোকেরা বিদ্রোহী ভূত)
কসে ওয়াসৎ নিজদস তাম্বুল।
(যে জঙ্গলের ঘাস মুখে করেছে সে তাম্বুলের আস্বাদন কি জানে!)
সিয়াহ গোয়ন্দ হিন্দু হামচুঁনি অস্ত।
(ইহা সত্য যে হিন্দু কৃষ্ণ বর্ণের)
সোয়াদ-ই আজাদ-ই আলম হমী অস্ত।
(কিন্তু এই দেশ সর্ব্বদেশ হতে সেরা
বেহেস্তে ফরজ কুন ইন হিন্দুস্থান রা
অজকুজা নিসবৎ অস্ত ইন বোস্তাঁরা।
(স্বর্গের সহিত নিশ্চয়ই হিন্দুস্থানরূপ বোস্তাঁর সম্বন্ধ আছে।)
ওয়াগর আদম ওয়া তাউস্ ন আ জায়েঁ।
কুজা ইজাঁ সুসন্দে মঞ্জল আঁরায়ে”।
(তাহা না হইলে আদম এবং ময়ূর পক্ষী এই স্থলে আসিয়া
নিজেদের বাসস্থান নির্ম্মান করিত না।)[৪]
পুনঃ, তিনি বলিয়াছেন, “অজকুজা গঙ্গা-ই-হিন্দুস্থান ববদ্ দূর।
য নীল ওয়া দিজলা লফদ হস্ত মাজুর।”
(যে হিন্দুস্থানের গঙ্গা হইতে দূরে থাকে, তাহার কাছে নীল ও টাইগ্রিসনদীর জল বড় সুমিষ্ট!)
আমীর খস্রৌকে উর্দু ভাষার জনক বলা হয়, কারণ তিনি গোটাকতক গজল লিখিয়াছেন যাহাতে নানা ভাষার সংমিশ্রণ আছে, যথা:
"য হাল, মিসকিন মকুন তাগাফুল দুরায়ে নৈনা বনায়ে বতিয়াঁ।
কি তাবে, হিজরা নদারম আয়জান নলেহু কাহে লগায়ে ছাতিয়া।
সবানে হিজরা দরাজ চুঁজুল্ফ উও রোজে ওসলত চু উমর কোতাহ।
সখী পিয়া কো জো ময় ন দেখুঁ তোকৈসি কাটুঁ আন্ধেরী রাতিয়াঁ।
একায়ক অজদিল দো চসমে জাদু বসদ ফেরেবম বেবর্দ তসকিন।
কিসী পড়ী হৈ জো শুনাওয়ে পিয়ারী পিকি হমারী বাতিয়াঁ।
চু সামহ সোজাঁ চু জরহ হায়রান জমহর আঁমহ বগসতিম্ আজর।
ন নিন্দ নৈনা ন অঙ্গচৈনা ন আপ আওয়ে নভেজে পতিয়াঁ।
বেহক রোজ উহুসাল দিলবরকি দাদমারা ফরেব খসৌ।
সপিতমনকে দুরায়ে রাখুঁ জো জায় পাউঁ পিয়াকে খতিয়াঁ”।
এই গজলে আরবী, ফার্শী, ব্রজভাষা ও খড়ি বোলী এই চারিভাষার মিশ্রণ করা হইয়াছে। কিন্তু এতদ্বারা তাঁহাকে উর্দু ভাষা বা সাহিত্যের জন্মদাতা বলা চলে না। বর্ত্তমানে অধ্যাপক ব্রাউন এক দাবী উপস্থাপিত করিয়াছেন, যে পারস্যের কবি সেখ সাদিই প্রথম হিন্দুস্থানী বা উর্দু ভাষার জন্মদাতা, কারণ কতকগুলি গজলে তিনি হিন্দুস্থানী শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন (History of Persian Literature দ্রষ্টব্য!) অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাঙ্গলার কবি ভারতচন্দ্রও এই প্রকারের মিশ্রিত ভাষায় কবিতা লিখিয়াছিলেন, যথা:—
“শ্যামহিত প্রাণেশ্বর বায়দ্কে গোয়দ কবর,
কাতর দেখে আদর কর মর বোরোয় কে,
বত্তং বেদং বেদং চন্দ্রমা চু লালা চে রেমা,
ক্রোধিত পর দেও ক্ষমা মেটিমে কাছে শোয় কে,
যদি কিঞ্চিৎ ত্বং বদসি দরজানে মন আয়ৎ খোসি,
আমার হৃদয়ে বসে প্রেমকর খোশ হোয় কে,
ভূয়ো ভূয়ো রুরোদসি ইয়াদৎ নমুদা জাঁ কোশি,
আজ্ঞাকর মিলে বসি ভারত ফকীরী খোয়কে”
এই কবিতায় বাঙ্গলা, সংস্কৃত, ফার্শী ও হিন্দী শব্দসমূহ মিশ্রিত হইয়াছে। কিন্তু এতদ্বারা ভারতচন্দ্রকে একটি নূতন ভাষার স্রষ্টা বলা যায় না, বা ইহাকে “মুসলমানী বাঙ্গলা”র অন্তর্গত করা যায় না।
খস্রৌ গুটি কতক গজল মিশ্রিত ভাষায় লিখিলেও উর্দু ভাষার সৃষ্টি তখনও হয় নাই। আকবরের সময়ে তাঁহার রাজস্বসচিব টোডরমল্ল প্রত্যেক গভর্ণমেণ্ট কেরানীকে ফার্শী শিখিতে বাধ্য করান। এই সময়ে কায়স্থেরা ফার্শী শিক্ষা করিয়া তখনকার হিন্দীতে ফার্শী শব্দ প্রবেশ করাইতে থাকে। কিন্তু এতদ্বারা একটা খিচড়ী কথা ও ভাষার সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু একটা পৃথক সাহিত্যের তখনও সৃষ্টি হয় নাই। বরং এই সময় থেকে হিন্দী এত ফার্শী ও আরবী শব্দে ভারাক্রান্ত হয় যে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে রাজা শিবপ্রসাদ যখন সাধারণের ভাষা থেকে হিন্দী সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা করেন, তখন সেই “আমফাম্” ভাষা দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত হইয়া পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইলে, দৃষ্ট হয় যে তাহা ‘উর্দু’ হইয়াছে! কিন্তু, মুসলমান আমীর, ওমরাহদের মধ্যে “ভাষা” ও ফার্শী, তুর্কি প্রভৃতির সহিত একটা মিশ্রিত ভাষা কথিত হইতে থাকে। এই যে সর্ব্বত্র মিশ্রিত একটা ভাষার উদ্ভব হইতে থাকে, তাহাকে ‘রেখতা’ (Scattered) এই নাম প্রদান করা হয়। মীরজাফর জটলের লিখিত এই রেখতা ভাষার কবিতাকে মহম্মদ সাহের যুগের পূর্ব্বের রেখতার নমুনা বলা যায় (আবেহায়াৎ পৃঃ ২৩)। এই সময়ে, এই মিশ্রিত ভাষা সহরে কেবল চলিতেছিল। কখন কখন আমীররা এই ভাষাতে কবিতা লিখিতেন। কিন্তু কেহ তাহাদের সংশোধন করিয়া দিত না। তখন সকলে ফার্শীতে কারবার করিতেন। মুসলমান কবিরা বরাবর হয় ফার্শী না হয় হিন্দীতে কবিতা লিখিতেন। হিন্দীর সহিত ফার্শীর মিশ্রিত “রেখতার” প্রতি কেহ নজর দিতেন না। এমন সময়ে দক্ষিণ হইতে ওয়ালী দিল্লীতে আসিয়া তাঁহার “দীবান” প্রকাশিত করেন। তিনি এই রেখতা ভাষাতেই এই সব কবিতা লিপিবদ্ধ করেন। উত্তরের অবস্থা যেমন এই প্রকারের ছিল, দক্ষিণে মুসলমান রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় একটা মিশ্রিত ভাষা ও তাহার সাহিত্য সৃষ্টি হইতে থাকে। ইহাকে ‘দক্ষিনী’ ভাষা বলা হইত। এই সাহিত্যে হিন্দী, তামিল, মহারাষ্ট্রীয় ভাষাসমূহের সহিত ফার্শী মিশ্রিত করিয়া একটা সাহিত্য উদ্ভূত হয়। ওয়ালী সেই মিশ্রিত (রেখতা) ভাষায় দীবান লিখিয়া দিল্লীতে উদয় হন। ওয়ালীকে ‘রেখতার পিতা’ বলা হয়। তিনি (খৃঃ ১৬৬৮-১৭৪৪) দক্ষিণে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। দিল্লীর লেখকেরা তাঁহার লেখাকে নমুনা করিয়া লিখিতে আরম্ভ করে। সকলে দেখিল, যে ভাষা তাহাদের গৃহে কথিত হয়, যাহা তাহাদের মাতৃভাষা, সেই ভাষাকেই ত ওয়ালী সাহিত্য মধ্যে স্থান দিয়াছেন। এতদ্বারা ইহাতে দিল্লীতে সাড়া পড়িয়া যায়। তাঁহার ভাষায় ফার্শী শব্দ আছে কিন্তু দেশজ শব্দ বেশী। এই চলিত ভাষাকে উত্তরের লেখকেরা গ্রহণ করেন এবং এই ভাষাতে সাহিত্য সৃষ্টি করিয়া তাহার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ফার্শীকে বিতাড়িত করে। রামবাবু সাকসেনা সত্যই বলিয়াছেন যে ইহা দ্বারা বিজিতেরা বিজেতাকে পরাস্ত করে। ফার্শী তাহার স্থানচ্যুত হইয়া এখন একটা প্রাচীন ক্লাসিকাল ভাষারূপে পঠিত হয়। এই প্রকারেই বিজিত এ্যাংগ্লো-স্যাক্সনের সহিত বিজেতা নর্ম্মানদের ফরাসী ভাষা মিশ্রিত হইয়া বর্ত্তমানের ‘ইংরেজী’ ভাষা সৃষ্ট হইয়া ইংলণ্ডের রাজসভা হইতে ফরাসীকে বিতাড়িত করে।
এক্ষণে কথা উঠে উর্দু যদি আসলে হিন্দীই হয়, তাহা হইলে এই পার্থক্য কোথা হইতে আসিল। এই বিষয়ে অধ্যাপক আজাদ বলিতেছেন, দেশে অনেক মুসলমান অভিজাতবংশ বাস করিত, যাহারা তাহাদের পিতৃপুরুষের দেশ ইরাণ, আরব, তুর্কিস্থান প্রভৃতির সহিত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে নাই। তাহাদের সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ড, বিবাহাদিতে ফার্শী ভাষায় গল্পাদি কথিত হইত। বৈদেশিক চালচলন তাহাদের মধ্যে ছিল, কাজেই সেইসব ব্যক্ত করিতে তাহারা ফার্শীভাষার অলঙ্কারাদি উর্দুতে প্রয়োগ করিতে বাধ্য হন। ইহারই ফলে, ‘ভাষাকে’ ইরাণী পোষাক পরিধান করাইয়া উর্দু করা হইয়াছে (আবেহায়াৎ পৃঃ ২৯)। পুনঃ কতকগুলি হিন্দী অক্ষরও ছদ্মবেশে উর্দু অক্ষর মধ্যে স্থান পাইয়াছে।
তৎপর, বড় কথা যে, যে সব মুসলমান কবি উর্দুতে কবিতা লিখিতে লাগিলেন তাঁহারা ফার্শীতে বিশেষ পণ্ডিত। এই জন্য, নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করিবার জন্য ভাষাতে ফার্শী কবিতার সমস্ত বাক পদ্ধতি (Idioms) প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। লোকেরা ইহাতে অভ্যস্ত হইলে, পুনঃ পণ্ডিতেরা আরবী শব্দ প্রয়োগ করিতে থাকেন। আর বর্ত্তমান যুগে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিক আবর্ত্তে পড়িয়া ইকবাল প্রভৃতি লেখকেরা কোন কোন স্থলে ফার্শীর ক্রিয়াপদও উর্দুতে ব্যবহার করিতে আরম্ভ করেন। এই সঙ্গে, ঊনবিংশ শতাব্দী হইতে বিভিন্ন মুসলমান কবিরা হিন্দী বা দেশজ শব্দ সমূহ উর্দু সাহিত্য হইতে বিতাড়িত করিতে থাকেন। এই ব্যাপারের ফলেই, সৌরসেনী প্রাকৃতের অপভ্রংশ তথাকথিত ‘খড়িবোলী’ আজ ফার্শী পরিচ্ছদে হিন্দুর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া তাহার বিভীষিকা উৎপাদন করিতেছে। ইহা উত্তরের রাজনীতিক্ষেত্রে একটা Frankenstein-রূপ ধারণ করিয়াছে! কিন্তু এক্ষণে, উর্দু সাহিত্যে এই ফার্শী করণের বিপক্ষে একটা প্রতিক্রিয়া চলিতেছে। একদল লেখক উর্দুকে অযথা ফার্শীকরণের বিপক্ষে প্রতিবাদ করিতেছেন। (উপেন্দ্র অশকের “উর্দু সাহিত্যেমে নয়ী ধারা” দ্রষ্টব্য)। ইহাদের মধ্যে কবি হাফিজ জলন্ধরী, সাগর নিজামী, বকার আম্বাওলী, সংবাদপত্র “রোজানা হিন্দ” (কলিকাতা) প্রভৃতি আছেন। ইহাঁদের ভাষা এত সরল যে তাহা হিন্দীভাষী ও উর্দুভাষী উভয়েই বুঝিতে পারেন।
এক্ষণে উর্দুর যখন এই অবস্থা তখন তাহার প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থা কি? বর্ত্তমানের সাহিত্যিক হিন্দী একটা কৃত্রিম ভাষা, ইহার রূপ এখনও ঠিক হয় নাই। সাকসেনা মহোদয় বর্ত্তমানের হিন্দীকে “High Hindi” বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন (পৃঃ ২)। তিনি বলেন, ইহা উর্দু ভাষা সম্ভূত, উর্দু হইতে ফার্শী শব্দ সমূহ বিতাড়িত করিয়া তৎপরিবর্ত্তে সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ করিয়া এই ভাষা ও সাহিত্যের সৃষ্টি করা হইতেছে। পুনঃ, ইহাও রাজনীতিক সাম্প্রদায়ীক আবর্ত্তে পড়িয়া অসম্ভব ভাবে সংস্কৃত শব্দসমূহ দ্বারা ভারাক্রান্ত হইতেছে। এক কথায়, খড়িবোলীর ইরাণী পোষাক ছাড়াইয়া ধুতি পরিধান করাইয়া তাহাকে আজকালকার “হিন্দী” ভাষারূপে খাড়া করা হইয়াছে। লেখক এই বিষয়ে ঠাট্টা করিয়া বলেন, বিদ্যাসাগরী বাংলা আর উর্দুর সংমিশ্রণে বর্ত্তমানের “হিন্দী”র উদ্ভব হইয়া একদল Chauvinist দ্বারা ইহাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করিবার দাবী করা হইতেছে। তবে এই কথা আমাদের জ্ঞাতব্য যে উর্দু-হিন্দী-হিন্দুস্থানী যে রাজনীতিক আবর্ত্তেই ঘুর্ণায়মান হউক না কেন, আসলে ইহা প্রাচীন কুরুপাঞ্চালের ভাষার বংশধর।
এক্ষণে, আমাদের এই রেখতা বা উর্দু সাহিত্যে প্রগতির অনুসরণ করা যাক। খস্রৌর দুই একটা সুফী ভাবপূর্ণ গজলে আমরা প্রগতির কোন চিহ্ন পাই না। উর্দু সাহিত্যের আলোচনা করিতে গেলে এই সাহিত্যের পিতামহ ওয়ালী হইতেই আরম্ভ করিতে হইবে। অবশ্য, মধ্যযুগে দক্ষিণে যাঁহারা “দখিনী’ ভাষায় কবিতা লিখিয়াছেন তাহা এক্ষণে আবিষ্কৃত হইতেছে, কিন্তু উর্দু সাহিত্যে দখিনী প্রভাব ওয়ালী হইতেই আরম্ভ হয়। তাঁহার একটি গজলের নমুনা:
ওয়ালী “লিয়া হ্যায় সব সোঁ মোহননে তরিকা খুদনুমাইকা
চড়হা হ্যায় আরসীপর তবসে রঙ্গ হৈরত ফজাইকা।”
ওয়ালী কেবল কতকগুলি প্রেমের গান গাহিয়াছেন। তাহাতে সাময়িক বাতাবরণের কোন চিহ্ন প্রকাশ পায় নাই। এই সময়ে মহম্মদ সাহ দিল্লীর সম্রাট ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই শেষে মোগল সম্রাট। তাঁহাকে “রঙ্গীলা বাদশাহ” বলা হইত। তাঁহার দরবারে আমোদ প্রমোদের তরঙ্গ বহিতেছিল, ওয়ালী সেই বাতাবরণেরই কবি। তাহারই প্রতিধ্বনি তাঁহার কবিতাতে পাওয়া যায়। মোগল সাম্রাজ্যের পক্ষে কি ভীষণ কাল আসিতেছে, তাঁহার সময়ের সাহিত্যে তাহা প্রকাশ পায় নাই। তারপরই, মহম্মদ সাহের সময়ে বজ্রাঘাতের ন্যায় নাদির সাহের সৈন্যদল দিল্লী রক্তাপ্লুত করিয়া চলিয়া গেল। সেই দৃশ্যের নজীর আমরা সৈনিক-কবি নাজীতে পাই। তিনি মোগল সৈন্যদের দুর্গতির কথা নিম্নলিখিত কবিতায় ব্যক্ত করেছেন:
“লড়ে হুয়ে তো বরস বিস উনকো বীতে যো।
মিলে যে ধান যো লস্কর তমাম ছানা থা”।
তৎকালের হিন্দু ও মুসলমানেরা অঙ্গাঙ্গি ভাবে বাস করিতেন তাহার প্রমাণ আমরা নাজীর আর একটা গজলে পাই:
“বজীফা রাগিনীকে সুর যেঁ জাহিদ কুফ্র উহ মতপড়।
নহী তসবীহ তেরে হাথ মেঁ য়হ রাগমাল হৈঁ”।
ওয়ালীর ভাষার নকল করিয়া নাজীর সঙ্গে, হাতিম (খৃঃ ১৬৯৯-১৭৯২), খাঁআরজু (১৬৪৯-১৭৫৬), মজমুন, আব্রু প্রভৃতির উদয় হয়। ইহারা কিন্তু দেশজ ভাষার শব্দগুলি তাঁহাদের কবিতা থেকে বহিষ্কৃত করিয়া ফার্শী অলঙ্কার ও কল্পনা তাহার মধ্যে আমদানী করেন। দক্ষিনী কবিদের অপেক্ষা ইহাঁদের লেখায় ইহা বেশী দৃষ্ট হয়। হিন্দী দোহারার চিহ্ন ইহাঁদের কবিতায় প্রকাশ পায়।
উত্তর ভারতের ভূমিতে আকবর প্রস্তুত সম্মিলনের ভাব তখনও কার্য্য করিতেছে। তাই আমরা হাতিমে নিম্নলিখিত কবিতাটি পাই:
হাতিম “হর সুবে উঠ বুতোঁসে মুঝে রাম রামহৈ।
জাহিদ তেরী নমাজ কো মেরা সলামহৈ”॥
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে আমরা ইকরঙ্গ নামক কবির উদয় দেখি। ইনি উর্দু বা রেখতা এবং হিন্দী উভয় ভাষাতেই কবিতা লিখিয়া গিয়াছেন। শুনা যায় তাঁহার হিন্দী গানগুলি এখনও দিল্লীর বাইজীরা গাহিয়া থাকেন। ইনি বলিতেছেন:
ইকরঙ্গ “রৌণকে ইসলাম তেরে রু সেহৈ।
কুফ্র কা রিস্তা তেরে গেসুসে হৈ”।
অর্থাৎ ইসলামের জ্যোতি তোমার মুখে, আর কাফেরের ধর্ম্ম তোমার জুলফির কোঁকড়া চুল! ইহার অর্থ, উভয় ধর্ম্মই তোমাতে বিদ্যমান। তৎপর আসেন ফুঁগা। ইনি ভাগ্যান্বেষণের জন্য কিছুদিন আজমগড়ের রাজার কাছে ছিলেন। ফুঁগা বলেন;
ফুঁগা “আয় সেখ! আগর কুফ্র সে ইসলাম জুদা হোতা।
পস চাহিয়ে তসবিহমেঁ জুন্নার নহোতা”।
এই প্রকারে আকবরের পত্তন করা জমিতে রেখতা ভাষার যে অদৃষ্ট হউক না কেন, সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্যের কোন আভাস সাহিত্যে দৃষ্ট হয় না। তৎকালের সামাজিক মনস্তত্ত্ব এই সব গজলে প্রকাশ পায়। ইকরঙ্গই হিন্দীতে গাহিয়াছিলেন।
“নিশিদিন যো হরিকাগুণ গায়েরে,
বিগড়ী বাত বাকী সব বন জায়েরে”!
এইজন্য এই সব কবিতাকে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল বলিতে হইবে। ইহার পর, মজহর ও তাঁবা, সোজ, দরদ, সৌদা প্রভৃতি বড় কবিদের আবির্ভাব হয়। ইহাঁরা সকলেই পারসীক ভাষাতে পারদর্শী ছিলেন। তাঁহারা দেশজ শব্দগুলিকে কর্কশ, পুরাতন বলিয়া নিন্দা করিতেন, এবং পারসীক ভাষার কল্পনা, বুলবুল, গুল, কুমু, সমসদ বৃক্ষের বর্ণনা তাঁহাদের কবিতার মধ্যে প্রবেশ করান।
মজহর “হরম বেশ ছোড় রহঁ কেঁ ন বুতকদে মেঁ সেখ।
কিয়াঁ হর এককো উহ মর্তবা খুদাইকা”।
সৌদা “নরকশ অলীণ্ড সীনম আলম কা ছান মারা
মিজগাঁনে তেরে পিয়ারে অর্জুন কা বান মারা”
এই সময়ে মোগল রাজত্ব ভাঙ্গিয়াছে, মুসলমান শাসনের পতনের পর লোকেরও মন চঞ্চল হইয়াছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আফগানেরা কয়েক বার দিল্লী লুণ্ঠন করিয়াছে, মহারাষ্ট্রীয়েরা বেশীর ভাগ ভারতে নিজেদের প্রভুত্ববিস্তার করিয়াছে বা শক্তি প্রকাশ করিতেছে। ভারত আর ‘দার-উল-ইসলাম’ নহে। আর অসঙ্কোচে মুসলমান গোঁড়ামী ও ধর্ম্মান্ধতা প্রকাশের সুবিধাও নাই। মহম্মদ সাহের সময় হইতে শেষ বাহাদূর সাহের সময় পর্য্যন্ত দিল্লীর দরবারে হা-হুতাস রব প্রতিধ্বনিত হইতেছে। কবিরা ভাগ্যান্বেষণে দিল্লী ত্যাগ করিয়া হয় লক্ষ্ণৌ, না হয় আজমগড়, না হয় মুর্শিদাবাদ, না হয় হাইদারাবাদ গমন করিতেছেন। সর্ব্বত্রই ‘হায়, হায়’ শব্দ। এই সময়ে মুসলমানের মনস্তত্ত্ব কি ছিল তাহা সাহিত্যেই প্রকাশ পায়। অনেকেই সুফী ধর্ম্মের অতীন্দ্রিয়বাদে (Mysticism) আশ্রয় গ্রহণ করেন। একদল, তৎকালীন বাদসাহ, নবাবদের মন যোগাইবার জন্য নিম্নরুচির কবিতাসমূহ রচনা করিতে থাকেন। ইহাতে সুন্দর তরুণ, তাহার মুখ, জুল্ফ, গালের আঁচিল, সুন্দরীর ভ্রূ, কোমর প্রভৃতির বর্ণনা থাকে। বস্তুতঃ এই পতনের যুগের উর্দু সাহিত্য কেবল বুলবুল, গুল, চমন, গুলবদন, জনখদা (গালের আঁচিল), জুল্ফ, কোমর প্রভৃতির বর্ণনাতেই ভরপুর। ‘বেকসে বুলবুল চমসমে মস্ত হ্যায় কুএইয়ার মেঁ” (একাকী বুলবুল বাগানে কামোন্মত্ত হয়ে আছে) ইহাই সব কবিদের প্রতিপাদ্য ছিল। যাঁহাদের মাতৃভাষা উর্দু নয় তাঁহাদের কাছে শুনা যায় যে, উর্দু সাহিত্যে কেবল Joy and pleasure of life (আনন্দ ও জীবনের সুখের কথা) আছে। এই আদিরসপূর্ণ কুরুচির পরিচায়ক কবিতাগুলি একটা জাতির সমৃদ্ধির পরিচায়ক না পতনের ফলে মস্তিষ্কের বিকৃতির পরিচায়ক?
অধ্যাপক মাহাফি বলেন, হিন্দুর পতন কালে সে ধর্ম্ম আঁকড়াইয়া নিজেকে রক্ষা করিতে পারিয়াছিল, কিন্তু গ্রীক তাহার পতন কালে সেই বিষয়ে অপারগ-ছিল। (ধর্ম্মনামে বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান তাহার সমাজে বিবর্ত্তিত হয় নাই) বলিয়াই সে পরধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া নিজের পৃথক অস্তিত্বের বিসর্জ্জন দেয়। ভারতের মুসলমান তাহার পতন কালে হয় ধর্ম্মান্ধতা ও কুসংস্কার আঁকড়াইয়া থাকে, না হয় নাস্তিক হইয়া ইন্দ্রিয় ভোগের গল্পে নিমজ্জিত হয়। এই জন্যই erotic poems উর্দু সাহিত্যে এত প্রবল! হিন্দুর পতন কালে, সে ব্রজভাষায় ও গৌড়ীয় ভাষায় তাহার মর্ম্মবেদনা রাধার বিরহে ব্যক্ত করিয়াছে। তাহার হা-হুতাস রাধার মাথুরের বিরহে ঘনীভূত হইয়াছে। তাহার জীবনের সমস্ত হাহাকার রব একটী নায়িকার বিরহ বেদনাতে কেন্দ্রীভূত হইয়া পরিব্যক্ত হইয়াছে; এইসব ভাব ধর্ম্মের আকারে অভিব্যক্ত। কিন্তু মুসলমান তাহার হৃদয়ের হাহাকার নানা আদিরস ও অন্যান্য কবিতা দ্বারা ব্যক্ত করিয়াছে। তাহার মনোবেদনা একস্থলে কেন্দ্রীভূত হইয়া পরিব্যক্ত হয় নাই। ধর্ম্ম বিষয়ে ঠাট্টা, গোঁড়াদের উপর বিদ্রূপ, বিকৃত রুচি দ্বারা মনকে ভুলাইবার চেষ্টা, শেষে ইংরেজ গভর্নমেণ্টকে মানিয়া নিয়া ব্রিটিশ অধীনেই ভারত ‘দার-উল-ইসলাম’, এবং বর্ত্তমানের ‘পাকীস্থান’ পরিকল্পনা একই হাহাকার-মনস্তত্ত্বের বিভিন্নরূপ। এই প্রকারের সাহিত্য সম্বন্ধে নবাবদের মনস্তুষ্টির জন্যই কুরুচিপূর্ণ কবিতা লেখা হইত, আর পারসীক সাহিত্য হইতে Homosexual ভাব আনয়ন করা হয়—সমালোচকেরা ইহা বলিয়াই খালাস! কিন্তু পারস্যের সাহিত্য একটী গোলামের জাতিদ্বারা সৃষ্ট, এই জাতি আলেকজাণ্ডারের সময় হইতে বিদেশী দ্বারা পরাজিত, বিপর্য্যস্ত এবং নিজের ধর্ম্ম ও সভ্যতা বিসর্জ্জন দিয়া আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হয়। অন্য দিকে, কুরুচিপূর্ণ প্রেমের কবিতা এবং সুফী অতীন্দ্রিয়বাদে নিজেকে আচ্ছন্ন করিয়া প্রাণের মনোবেদনা গোপন করিয়াছে। বস্তুতঃ ঐতিহাসিকেরা বলেন, মঙ্গোলদের ভীষণ নরহত্যাও প্লাবনের পরই পারস্যে সুফী অতীন্দ্রিয়বাদের বিশেষ প্রাদুর্ভাব হয় (Arnold—Preaching of Islam দ্রষ্টব্য)। ভারতের মুসলমানরা এই গোলাম জাতির সাহিত্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ভাল করেন নাই এবং উচ্চতর ভাবও সাহিত্যে আনয়ন করিতে পারেন নাই। কিন্তু কেন এই প্রকার হইয়াছিল তাহাই অনুসন্ধানের বস্তু। বিজিত, বিপর্য্যস্ত ও পতিত উত্তরের মুসলমানের অবিদিত মনের পশ্চাতে কি মনস্তাত্ত্বিক প্রেরণা সমূহ লুক্কাইত ছিল যদ্বারা এই হাহাকার রব সাহিত্যে প্রকাশ পায় তাহা সাহিত্যেই অনুসন্ধান করিতে হইবে। এই প্রকার সাহিত্যের প্রমাণ আমরা সৌদাতে পাই:
সৌদা: “হিন্দু হৈঁ বুতপরস্ত, মুসলমান খুদা-পরস্ত।
পুজুঁ মৈঁ উস কিসিকো জো হো আশানা-পরস্ত”॥
ইনি প্রেমের পূজারী হন। পুনঃ, ইনি বলিতেছেন:
“গর হো শরাব খিলবতো মাশকে খুবরু।
জাহিদ তুঝে কসদ হৈ জো তুহো তো কেয়া করে”॥
এই স্থলে নিষ্ঠাবানকে ঠাট্টা করা হইতেছে।
এই দলের পর, ‘মীর’ মহম্মদ তকী আবির্ভূত হন। ইনি বলেন:
মীর: “পয়ম্বর হৈ, শাহ হৈ, কি দরবেশ হৈ।
সভোঁকী য়হি য়হি দরপেশ হৈ”॥
ইনি বলেন, পয়গম্বর, বাদসাহ আর দরবেশ, সকলেরই শেষে এক গতি। ইহা উচ্চ ধরনের কথা হইতে পারে বটে, কিন্তু গোঁড়ারা একথা স্বীকার করিবেন না। ইহা defeatist mentality-রই পরিচয় প্রদান করে। পুনঃ, আর একটী কবিতায় ইনি গোঁড়াদের কটাক্ষপাত করিয়াছেন:
“বুদপরস্তীকা তোই সলাম নহীঁ কহতে হৈঁ।
মাতরিদ কৌন হৈ ‘মীর’ এই সি মুসলমানী কা”।
পুনঃ, সৌজ বলিতেছেন:
সৌজ: “বুলবুল কহীঁন জাইয়ো জনহার দেখনা।
আপনে হী বন মেঁ ফুলেগী গুলজার দেখনা॥
নাজুক হৈ দিল ন ঠেস লগানা উসে কহীঁ।
গমসে ভরা হৈ ইয়ে মেরে গমখ্বার দেখনা”॥
ইনি বুলবুলকে ফুলবাগান দেখিতে বলিতেছেন এবং তাহাকে নিজের মনোবেদনা জ্ঞাপন করিতেছেন। এই সময়ের দর্দ্দ নামক কবিতে আমরা সুফী মতবাদ স্পষ্ট পাই। দর্দ্দ বলিতেছেন:
দর্দ: “বুতখানা বরহমানকা মুকরর দেখা।
কাবাকোভী শেখকো মৈঁ অকসর দেখা॥
দিল লাগানেকি সুরত ন কহীঁ দেখ হায়।
জো কুছ দেখা সো খাক পাত্থর দেখা”।
ইহাঁদের দলের পর, আনার, হাসান, জুঅরত, ইনসাউল্লা প্রভৃতির উদয় হয়। ইহাঁদের দ্বারা হিন্দী শব্দ বিতাড়ন চলিতে থাকে। ইহাঁরা বলেন[৫] এতদ্বারা ভাষাকে পরিমার্জ্জিত এবং দানাবদ্ধ করা হয় (refinement and crystallization) ইহাঁদের কবিতায় তৎকালের সময় এবং দিল্লীর কলুষিত সমাজ প্রতিবিম্বিত হয়। শারীরিক সৌন্দর্য্য বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়। জুঅরত, রঙ্গীন প্রভৃতি কবিরা নিম্নতর ইন্দ্রিয় ভোগের বিষয় প্রকাশ্য ভাবেই গাহিতে থাকেন। জুঅরত আসুক (প্রেমাস্পদ) ও মাসুকের (প্রেমী) ব্যাপার বেশ ভাল করিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন।
জঅরত গাহিতেছেন:
জুঅরত “বুলবুল শুনে না কেঁও কফসমেঁ চমনকী বাত।
আবরএ বতন কো লগে খুশবতনকী বাত॥
সরদিজে রাহে ইশকমে পর মুঁহ ন মোড়িয়ে।
পত্থর কীসী লকির হৈ যহ কোহকনকী বাত”।
ইনি খাঁচায় বদ্ধ বুলবুলকে রাস্তায় প্রেমের সহিত শির প্রদান করিতে বলিতেছেন।
ইনসাউল্লা বলিতেছেন:
ইনসাউল্লা “খেয়াল কিজিয়ে কেয়া আজ কাম মৈঁনে কিয়া।
জব উননে দো মুঝে গালী সলাম মৈনেঁ কিয়া॥
জুনুঁ য়হ আপকী দৌলত হুয়া নসীব মুঝে।
কি নংগী নামকো ছোড়া য়’ নাম মৈনেঁ কিয়া” |
ইনি বলিতেছেন, উন্মত্ততারূপ দৌলতই তাঁহার কপালে হইয়াছে।
ইত্যবসরে লক্ষ্ণৌতে একটি কবির দল উদিত হন। ইহাঁদের মধ্যে নাসিখ ও আতিস প্রসিদ্ধ হন। ইহাঁরা উর্দুভাষা হইতে বাকী হিন্দী শব্দগুলি বিতাড়িত করিয়া বিদেশ জাত শব্দের আমদানী করেন। ইহাঁদের ভাষায় লক্ষ্ণৌর কুরুচি প্রতিবিম্বিত হয়।
নাসিখ বলিতেছেন:
নাসিখ “বায়জা মসজিদ সে অব জাতে হৈ মৈখানেকো হম।
ফেঁককর জর্ফে বজুলেতে হৈঁ পৈমানে কোহম॥
বোসএ খালে জনখদাঁ সে শফা-হোগী হমেঁ।
ক্যায়া করেঙ্গে এই তবীব বসতেরে বুহদানে কো হম”॥
পুনঃ, ইনি গাহিতেছেন:
“তেরেজাতে হী হয়া রঙ্গে চমনহো জায়না।
বর্গগুল জোহৈ উয়ো বর্গে আসমান হো জায়না॥
বামপর নগেঁনা আও তুম শবে মহতাবমেঁ।
চাঁদনী পড় জায়গী মৈলা বদন হো জায় গা”॥
আবার, আতিস গাহিতেছেন:
আতিস “জামে সরাবে ইস্কমে দোনোঁ হৈ বেখবর।
বুলবুল চমনমেঁ মস্ত হৈ কুএ ইয়ারমেঁ”॥
এইসব কবিতায় erotic expressions চূড়ান্ত রূপেই বর্ণিত হইয়াছে। এইসব কবিতা তৎকালের সমাজের পতন এবং কুরুচিরই পরিচায়ক। এই গুলিতে আমরা কোন প্রগতির সন্ধান পাই না।
এই লক্ষ্ণৌ সাহিত্যে (মরসিয়া) কবিতার উদ্ভব হয়। ইহা ইমাম হাসেন ও হোসেনের মৃত্যু স্মরণার্থ শোক সূচক গীতি। ইহা খৃষ্টানদের Passion plays ন্যায়। লক্ষ্ণৌর নবাবেরা সিয়া ধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন বলিয়া, সেই ধর্ম্মগত মরসিয়ার ছাপ তদানীন্তনের সাহিত্যে বিবর্ত্তিত হয়। এই সময়ের লক্ষ্ণৌতে অনীশ ছিলেন বড় কবি। তিনি বালক, স্ত্রী, পুরুষ, যোদ্ধা, রাগ, প্রেমী এবং সেবকাদি সর্ব্বপ্রকারের মানুষের মনোভাব ব্যক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন।
অনীশ: “দিল সে তাকত বদন সে কস জাতা হৈ।
আতানহীঁ ফির করজো নফস জাতা হৈ॥
জব সাল গিরাহ হুই তো উকদ ইয়খুলা।
যা ঔর গিরহ সে যক বরস জাতা হৈ”॥
অনীশ অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল বলিয়া গণ্য হইবেন।
আর একটী গজলে জগতের ব্যবহার বর্ণনা করিয়াছেন:
“গর জিস্তমে ফাকাহো তো গম কোই না খায়।
আউর ওয়াক্ত-ই-মুসিবত মেঁ কোই পাশ না আয়ে॥
ইউঁ পিয়াস মেঁ লাকর কোই পাণি না পিলায়ে।
আউর বাদ-ই-ফণা, ফতিহা সরবৎ পী দিলায়ে”॥
এই সময়ে লক্ষ্ণৌতে দয়া শঙ্কর কৌল “নাসীম” নাম গ্রহণ করিয়া একজন হিন্দু বড় কবি হন। ইহাঁর “গুলজার-ই-নাসিন” আজও আদৃত হইতেছে। ইনি কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ ছিলেন, নবাবের কমিসেরিয়েট বিভাগে কর্ম্ম করিতেন।
মানুষ ইহ জগতে যাহা চাহে তাহা সবই ইনি পাইয়াছিলেন। তত্রাচ সময়ের হাওয়ার প্রভাবে ইঁহার কবিতাতেও বুতের প্রতি অনুরক্তি ও নৈরাশের ভাব প্রকাশ পাইয়াছে। একটি কবিতায় ইনি বলিতেছেন:
“বুতোঁকো জো দেখা গুনাহা হামারা।
খুদাই খোদাকী তামাসা হামারা॥
বুতোঁকী গলী ছোড়কর কৌন জায়ে।
য়হী সে হৈ কাবে কো সিজদা হামারা”।
এই কবিতায় ‘বুত’ শব্দ তিনি দেবপ্রতিমা এবং প্রেমাস্পদ এই দুই অর্থেই ব্যবহার করিয়াছেন। শেষে কাবাকে নমস্কার করিয়া অন্য ধর্ম্মের প্রতি হিন্দুর শ্রদ্ধার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। আর একটি গজলে নিজের মনোবেদনা জ্ঞাপন করিয়াছেন। কথিত হয় ঐ গজলটি একবার একটী বাইজী নবাব আসফকদ্দৌলার নিকট গাহিতেছিল।
নাসিম: “জব ন জীতে জী মেরে কাম আয়গা।
ক্যায়’ দুনিয়া আকিবত বখসায়গী॥
জান নিকাল জায়গী তনসৈ ইয়ে নসীম’।
গুল কো বুএ গুল হাওয়া বাতলাএগী”॥
নবাব সমজদার ব্যক্তি ছিলেন, শেষের দু’চরণের মধ্যে যে পরিবেদনার খোঁচা লুক্কায়িত ছিল, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন। সভাসদদের জিজ্ঞাসা করেন, এ কোন নাসীম? এ কি গুলজারে নাসিম? জবাব প্রদত্ত হইল, হাঁ! তিনি সভাসদের হুকুম দিলেন, যেমন করিয়া পার, ইহাকে আমার নিকট হাজির কর। তখন তিনি প্রত্যুত্তর পাইলেন—সে অনেকদিন মরিয়া গিয়াছে। এক্ষণে এই নৈরাশ্য (Pessimism)-এর ভাব নাসীমের কোথা হইতে আসিল? ইহা কি ব্যক্তিগত বা হিন্দুর জাতিগত? জগতে তাঁহার কোন অভাব ছিল না। অনুমান হয় ইহা “নকল” (Imitation) রূপ সমাজতাত্ত্বিক ধারা ধরিয়া প্রকাশ পায়। তৎকালের মুসলমানের Pessimism ছিল স্বাভাবিক। বুত, গুল প্রভৃতির অনুকরণের সহিত ইহা তাঁহার মধ্যে আসিয়াছিল। যে সব হিন্দু উর্দুতে কবি হইয়াছেন, তাঁহারা মুসলমান কবিদের হুবহু নকল করিয়া গিয়াছেন।
ইহার পর দিল্লীতে এক বড় কবির দল উত্থিত হয়; ইহাঁদের মধ্যে নাসীর, জৌক, গালীব, মোমীন এবং জাফর ছিলেন। শেষোক্ত নামটি শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহের তখল্লুস (non-de-plume)। ইঁহারা উর্দু হইতে বাকী দেশজ শব্দ সমূহ বহিষ্কৃত করিতে লাগিলেন। গালীব ও মোমীন বিদেশী শব্দ সমূহ অতি ক্ষতিজনকরূপে উর্দুতে আমদানী করেন। ইঁহাদের কবিতায় মৌলিকত্ব আছে। কিন্তু ফার্শি শব্দ প্রণালী উর্দুতে ব্যবহার করিয়া তাহা এত কঠিন করিয়া তুলিলেন যে গালীব আজও সহজ বোধ্য নয়।
ইঁহাদের মধ্যে নাজীর সুফী, তজ্জন্য পূর্ণমাত্রায় বেদান্তী ছিলেন। তিনি, হিন্দীতে অনেক ধর্ম্মবিষয়ক কবিতা লিখিয়া যান। কথিত হয়, তাঁহার মৃত্যুর পর, গোঁড়ারা তাঁহার শব সমাহিত করিতে যায় নাই। ইনি বিশেষ ভাবে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। ইনি জনতার কবি ছিলেন, ইনি কোন বাদসা বা রাজার প্রশংসা করিয়া এক পংক্তিও কবিতা লিখেন নাই।
নাজীর বলিতেছেন:
নাজীর: “ঝগড়া না করে মিল্লতে মজহব কা কোই য়াঁ।
জিস রাহমেঁ জো আন পড়ে খুস রহে হরআঁ।।
জুন্নার গলে য়া কি বগলবীচহো কুরআঁ।
আশিক তো কলন্দার হৈঁ ন হিন্দু ন মুসলমাঁ।”॥
ইনি তৎকালের প্রগতিশীল কবি ছিলেন।
আর একজন বড় কবি ছিলেন জৌক।
জৌক বলিতেছেন:
জৌক: “বীমার ইস্ককা জো ন তুঝসে হুয়া ইলাজ।
কহ এ তবীব তুহী কি ফির তেরা কেয়া ইলাজ।
রেশা সফেদ শেখে মেঁ হৈঁ জুল্মতে ফরেব।
ইস মক্র চাদনী পৈ ন করনা গুমানে সুবহ”॥
ইঁহার কবিতার মধ্যে একটা cynicism এর ভাব আছে। ইনিও প্রেমের কাহিনী গাহিয়াছেন। ইঁহাকে প্রগতিশীল কবি বলিয়া গণ্য করা যায় না।
এই দলের মোমীন একজন উচ্চদরের কবি ছিলেন। ইনি প্রেম বিষয়েই লিখিয়া গিয়াছেন।
মোমীন বলেন:
মোমীন: “জাঁয়ে ওয়াশত মেঁ সুএ সহরাকেঁ
কম নহী অপনে ঘরকী বীরানী॥
মৈ উহ সময়ায়ে বলাগত হুঁ।
জিসকে দরকা গদা হৈ খাকানী”॥
ইনি প্রগতিশীল কবি ছিলেন না।
এই দলের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন গালীব। ইনি উর্দু কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি। (১৭৯৬-১৮৬৯)। ইঁহার ভাষা এত ফার্শীতে ভরপুর যে, অনেকের কাছে তাহা সহজবোধ্য হয় না। ইনি জীবন এবং তাহার বিভিন্ন স্তরের বিষয় লিখিয়াছেন। কাব্য অলঙ্কারের সর্ব্বলক্ষণই ইঁহার কবিতার মধ্যে আছে। ইনি একজন অতীন্দ্রিয়বাদী এবং সাম্প্রদায়িক বিভিন্নতার উর্দ্ধে অবস্থিত ছিলেন। ইনি প্রাচীন পারস্যের জনশ্রুতির রাজা ফরিদুনের বংশধর বলিয়া দাবী করিতেন এবং মোগল বাদসাহ বংশেরও সহিত সম্বন্ধ ছিল। এই জন্য সিপাহী বিদ্রোহের পর, তাঁহার উপর গভর্ণমেণ্টের নজর পড়ে, তাঁহাকে অনেক কষ্টভোগ করিতে হয়। এই জন্য তাঁহার কবিতাতে দুঃখ ও অশ্রুজলের সম্মানের উপদেশ আছে। তাঁহার কবিতার বিয়োগান্ত ভাব ও অন্ধকারের মধ্যে কখন কখন আশার আলোকপাত হইয়াছে
গালী বলিতেছেন:
গালী “দে মুঝকো শিকায়তকী ইজাজতকি সিতমগার।
কুছ তুঝকো মজা ভী মেরে আজার মে আওয়ে”॥
ইহার অর্থ—হে অত্যাচারী! আমাকে নালিশ করিবার অধিকার দাও। তোমার মজার কিয়দংশও আমার কষ্টেত আসিবে!
পুনঃ, গালীব একস্থানে বলিতেছেন:
“বুলবুল কো কারয়ায়ীপর পয়দাই খন্দয়ায়ে গুল।
ইস্ক যিসকা কহতা হ্যায় খলল হ্যায় দেমাককা”।
ইহার অর্থ বুলবুলের বিষ্ঠার উপর গোলাপ ফুলের জড় গজায়। যাহাকে প্রেম বলা হয় তাহা মাথার পাগলামী মাত্র! ইহাতে Cynicismই প্রকাশ পাইয়াছে। ‘দীবান-ই-গালীব’ নামক পুস্তকের একস্থানে ইনি বলিতেছেন,
“দরদ সে মেরে হ্যায় তুঝকে বেকরারী হায় হায়।
কিয়া হুয়ি জালিম তেরে গফলত সা’রী হায় হায়”॥
তৎকালের বাতাবরণ গালীবে সম্পূর্ণভাবে প্রতিভাত হইয়াছিল। কিন্তু তিনিই প্রথম উর্দু সাহিত্য থেকে পারস্যের বোস্তান ও বুলবুলকে নির্ব্বাসিত করেন। এই বিষয়ে তিনি প্রগতিশীল ছিলেন।
গালীবের জীবদ্দশাতেই ‘সিপাহী-বিদ্রোহ’ হয় এবং ইহার প্রতিকল্পে যে অশনি ও ঝঞ্ঝাবাত উত্তর-ভারতে মুসলমান সমাজের উপর পড়ে তাহাতে তৈমুর বংশ প্রতিষ্ঠিত রাজনীতি সৌধের শেষ চিহ্ন পর্য্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া যায়। মুসলমান-উত্তর ভারতে হাহাকার পড়িয়া যায়। এই সময়কার কবি ছিলেন—দাঘ। ইনি বাদসাহের সংসারে লালিত পালিত হইয়াছিলেন, এই জন্য এই বিপ্লব তাঁহাকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করিয়াছিল। ইনি অনেকগুলি কবিতা পুস্তক রচনা করিয়া যান, সেগুলি হতাশ প্রেমেরই কথা ব্যক্ত করিয়াছে। নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার গভর্ণমেণ্টের কাছে আর্জি করিবার জন্য ইনি একবার কলিকাতায় আসেন। প্রত্যাবর্ত্তন করিবার কালে এক বাইজীর সহিত ট্রেনে আলাপ হয়। পরে, তাঁহার ‘মসনবী’ এই প্রেমীকার উদ্দেশ্যেই লিখিত হয়। ‘মসনবী’তে সর্ব্ব প্রথম দাঘ বলিতেছেন:
দাঘ: “আল্লা রহে মরতবা মেরে আজিজ উও নিয়াজ কা
গোয়া জোয়াব হ্যায় ইয়ে তেরী কিবরত নাজকা॥
আয় দাঘ কিস আফতমেঁ হুঁ কুছ বন নেহী আতি।
উও চিমতী হ্যায় মুঝসে যুদা দিল নেহী হোতা”॥
পুনঃ, ইনি একটী “দীবান” ও লিখেন।”
“বরঙ্গ বুই গুলহৈ হর নফস্ ইয়াদ আলীমেঁ।
কিয়ামত তক ফিরেগী দম নসীম সিজদম মেরা॥
সলামত মঞ্জিল মকসুদ তক আল্লা পৌচাওয়ে।
মুঝে আঁখিয়ে দেখাতা হ্যায় হরেক নকস বাদম মেরা”॥
ইহাঁর একটী পুস্তকের নাম “গুলজার দাঘ”। ইহার একস্থলে ইনি বলিতেছেন:
“দাঘ সাদ উও সরা ন দেখোগি।
গুল হজারোঁমে এক সুরত হ্যায়”॥
এই পুস্তকে নানা প্রকারের কবিতা সন্নিবেশিত আছে, তন্মধ্যে সিপাহীবিদ্রোহের সময় দিল্লীর পতন উপলক্ষে যে ‘মরসিয়া’ লিখেছেন তাহা বিশেষ প্রসিদ্ধ। ইহাতে তৎকালীন মুসলমানের মর্ম্মভেদী ক্রন্দনের রোল উত্থিত হইয়াছে। এই শোকপূর্ণ কবিতার নাম “সহর আসুব” (ভীত নগর):
“ফলক জনাব উও মালায়েক জনাব থী দিল্লী।
বেহস্ত উও খুলদসেভী ইনতিখাবথী দিল্লী।
জোয়াবকা হী কো লাজোয়াব থা দিল্লী।
মগর খেয়ালসে দেখাতো খোয়াব থী দিল্লী।
ইয়ে সহর উওথা কী ইনসান উও জানকা দিল থা।
ইয়ে সহর উও হ্যায় কী হরকদর দানকাদিল থা।
ইয়ে সহর উও হ্যায় কী হিন্দুস্থান কী দিল থা।
ইয়ে সহর উও হ্যায় কী সারে জহানকা দিল থা।
জমীনকে হাল প অব আসমান রোতা হ্যায়।
হরেক ফরাক মকীন মেঁ মকান রোতা হ্যায়।
গদা উও শাহ, জৈফ উও নওজোয়ান রোতা হ্যায়”।
দাঘ রাজনীতিক বিয়োগান্ত নাটকের কবি, তাঁহার জীবনের tragedy তাঁহার বিভিন্ন কবিতার মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই জন্য তাঁহাতে গঠনমূলক এবং প্রগতিশীল ধ্বনি উত্থিত হয় নাই। কিন্তু যে জমিতে বর্দ্ধিত হইয়াছিলেন, আকবর দ্বারা কর্ষিতভূমির শেষ চিহ্ন তাহাতে ছিল, এইজন্য তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। তিনি এক গজলের শেষাংশে বলিতেছেন:
“কিস লিয়ে আয় গাবরোঁ মুসলমানোঁ মুঝে এতনা তপাক।
কাবিলে মসজিদ ন হরগিজ, লায়েকে বুতখানা হুঁ”।
ইহার অর্থ, কেন কাফেরের সঙ্গে আমার এত ভাব, কারণ মসজীদ যাইবার উপযুক্ত আমি নই, মন্দিরে (প্রেমাস্পদের) যাইবার উপযুক্ত।
সিপাহী বিদ্রোহের অবসানের পর, একদল নূতন লেখক নূতন দৃষ্টিকোণ দ্বারা জগতের গতিকে দেখিবার জন্য উত্থিত হইলেন। ইঁহাদের মধ্যে সার সৈয়দ আহমেদ, অধ্যাপক আজাদ, গদ্যলেখক সরুর, কবি হালী, পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস লেখক অধ্যাপক সিবলী, ধর্ম্ম-সম্বন্ধীয় বিতর্কযুদ্ধ প্রবন্ধাদি লেখক চেরাগ আলী, মোহসিন-উল মুল্ক, উপদেশযুক্ত গল্পলেখক নাজির আহমেদ, ইতিহাস লেখক জাকাউল্লা প্রভৃতির উদয় হয়। ইহাঁরা গোঁড়ামীর ও সংরক্ষণশীলতার বিরূদ্ধে সংগ্রাম করিতে থাকেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংরেজী শিক্ষার প্রভাব উর্দুতে ইঁহারা বিস্তার করেন; এতদ্বারা উর্দু সাহিত্য উদার হয় এবং নূতন প্রকারের গদ্যসাহিত্য উদ্ভূত হয়।
আজাবই প্রথমে উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস (আবে হায়াৎ) লিখিয়াছিলেন। হালী স্বীয় কবিতাসমূহদ্বারা সৈয়দ আহমদের সংস্কারনীতি সমর্থন করেন এবং প্রতিক্রিয়াশীল ও কাটমোল্লাদের কষাঘাত করিয়া কলম ধরেন এই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানের একতা এবং জাতীয়তাবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। হালীর কবিতা রচনার মধ্যে ‘রুবাইত’, ‘কাতাৎ’, ‘মুসদ্দস’ ও ‘শিকোয়া’ (বিক্ষ্যভ)। তাঁহার রুবাইতের একটা কবিতাতে তিনি বলিতেছেন—
হালী:— “হিন্দু সে লড়েঁ না গেবরসে বৈর করেঁ,
সোরসে বচেঁ আউর সোর কে আওয়াজ খৈর করেঁ।
জো কহতে হেঁ ইহ কি হ্যায় জহন্নম দুনিয়া,
উও আয়েঁ আউর উম বেহস্ত কি সৈর করে”॥
এই কবিতাতে আমরা প্রগতির আওয়াজই শ্রবণ করিতে পাই। কিন্তু স্বধর্ম্মীদের আচরণে নিজের মনের তিক্ততা নিম্নলিখিত কবিতায় ব্যক্ত করিয়াছেন:
“জব এক কিহ নহো মুসলমান আখোয়া পক্কা,
হোতা নহি মোমিনকা অব ইমানপক্কা|
হম কৌম কি খৈব মাঙ্গতে হৈঁ হককে,
সুনতে হেঁ কিসি কো যব মুসলমান পাক্কা”।
বাহিরে ‘মুসলমান বেরাদারান’ বলা ও অন্তরে পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করার জন্য একজন ইরাণী কবিও বহুপূর্ব্বে নিম্নলিখিত চরণে স্বীয় বিরক্তি প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন, “মজ্দ গানী! কহ গুরবাহ সুদ জাহদ ওয়া মোমীন ওয়া মুসলমান”। (বড় খবর, যে বিড়াল তপস্বী এবং বিশ্বাসী ও মুসলমান হইয়াছে)! দেশ ও কালভেদে একবাতাবরণের মনস্তত্ত্ব পৃথক হয় না। হালীর মনের ও মতের প্রগতিশীলতার পরিচয় নিম্নলিখিত হইতে কবিতাতে প্রকাশ পেয়েছে:—
“হর বেহুনরোঁ মেঁ কাবালিয়ত কে নিসান
পোসিদা হ্যায় ওয়াসিয়োঁমে আকসার,
আরি মেঁ লবাস তরবিয়ৎসে ওয়ারনা
হ্যায় তুসও রাজই নহি সকলোনমি নহাঁ।”।
ইহার তাৎপর্য্য এই, কর্ম্ম করিবার শক্তি অশিক্ষিতের ভিতরও আছে, জঙ্গলী লোকের ভিতর মানুষ লুক্কাইত থাকে যদিচ সে শিক্ষার পোষাকে আচ্ছাদিত থাকে না; তাহা না হইলে তুস ও রাজের নাগরীকেরা (পুরাতন ইরাণের এই দুই নগর সভ্যতার কেন্দ্র ছিল) এই প্রকার পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত থাকিত না। শিক্ষার প্রশংসায় তিনি বলিতেছেন:
“আয়ে ইলম কলিদি গুনজি সাদি তো হৈ।
সরচসমাহ ন’মা উও আয়াদিতো হৈ।
আসাইসি দো জহানহৈ সায়ি মেঁ তেরে
দুনিয়া কা ওয়াসিলাহ দীনকা”॥
ইহার অর্থ, হে জ্ঞান, তুমিই সুখের ভাণ্ডারের চাবী, তুমিই সমস্ত ধনও সাহায্যের উৎপত্তি স্থল, তোমার ছায়াতেই দুই ভুবনের আনন্দ থাকে, তুমিই এই জগতের সম্পদ ও ধর্ম্ম প্রদর্শক।
রাজনীতি সম্বন্ধে পূর্ব্বেকার মুসলমানীয় প্রথার বিরুদ্ধে উপহাস করিয়া বলিয়াছেন:
“দেখো জিস সলতানতকি হালত দরহম,
সমকো কি উহাঁ হৈ বরকত কা কদম,
ইয়া তো কোই বেগমহৈ মুসিরে দৌলত,
ইয়াহৈ কোই মৌলিয়ী ওজিরে আজাম॥”
ইহার অর্থ, যখন কোন রাজত্বকে ভাঙ্গিতে দেখিতেছ, তখন বুঝিবে যে উহাতে ভগবানের আশীর্ব্বাদ আবির্ভাব হইয়াছে, বা কোন বেগম পরিচালিকা হইয়াছেন বা কোন মৌলুবী প্রধান মন্ত্রী হইয়াছেন।
ইহাঁর ‘কাতা’আট’ নামক পুস্তকে একটা কবিতায় ‘নেশন’ কাহাকে বলে এই বিষয়ে স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন:
“ইহ মানিহুয়ি জমহোর কি রায়,
উসিপর হ্যায় জহানকা ইতফাক অব,
কহ ‘নেশন’ উও জমাইয়ৎ হ্যায় কম অজকম,
জবান জিসকি হো এক আউর নসল উও মজহব,
মগর ওয়াসিত উসে বাজোঁনে দি হ্যায়,
নেহিজো রায়মে আপনে মহাবজাব,
উও ‘নেশন’ কহতে হেঁ উস ভিড় কোভি,
কহ জিসমেঁ উহদতিঁ মফকুঁ হেঁ সব
জবান উসকে নহো মফৌম উ কো
হেঁ আদমতক জুদা সবকে জাদ উও আব
হো ওয়াহদ লা সে এক উসকা খদাহো,
তো লাখো উসকে হুঁ মাবুদ আউর রব॥”
ইহার অর্থ—ইহা সকলে গ্রহণ করিয়াছে যে, একটা ‘নেশন’ বলিলে একটা লোক সংঘকে বুঝায়। তাহার একটী সাধারণ ভাষা, উৎপত্তি এবং ধর্ম্ম আছে। কিন্তু অনেকে ইহার বিস্তৃত ব্যাখ্যা করিয়া গোঁড়ামী করেন যে একটা “ভীড়” একটা নেশন যাহাদের মধ্যে সাধারণ বন্ধনের অভাব, ভাষার পার্থক্য আছে, এবং আদম পর্য্যন্ত যাহাদের পিতৃপুরুষের পার্থক্য আছে, এবং যদিও একজন একেশ্বর উপাসনা করে, আর একজন লক্ষদেবতা পূজা করে।
এইস্থলে তিনি নেশনের রাজনীতিক ব্যাখ্যার উপর ব্যঙ্গ করিয়া মূল জাতিগত এবং জাতিতত্ত্বগত একতার দ্বারা নেশনের উদ্ভব বলিয়া স্বীকার করিতেছেন। এই তর্ক জগতের বহুকালের, কিন্তু তাঁহার এই ব্যাখ্যানুসারে কোন ‘নেশন’ সংগঠিত হয় নাই।
তাঁহার ‘ইসলামের উত্থান ও পতন’ (মুসদ্দস) নামক পুস্তকে ইসলামের কি প্রকার উত্থান হইল, তাহার উন্নতি কি প্রকারে হইল এবং শেষে ভারতের মুসলমানের তৎকালীন অবস্থা বর্ণনা করিয়াছেন। এই পুস্তকে তিনি আরবদের খুব বাড়াইয়া চিত্রিত করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন এই সময়ে জগৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। ভারত ও পারস্যের তৎকালীন অবস্থা সম্বন্ধে বলিয়াছেন:
“ইধর হিন্দমেঁ হরতরফ থা অন্ধেরা
ক থা গিয়ান গুনকা লডা ইয়াঁ সে ডেরা।
ন ভগবানকা গিয়ানকা ধিয়ান থা গিয়ানোঁমে
ন নিরয়ান পর সতি থি নিরওয়ানিয়োঁমে।” (পৃঃ২৯)
“উধর থা আজমকো জহালতনে ঘেরা।”
ভারতবর্ষ বিষয়ে এই উক্তিতে কোন কোন হিন্দু আপত্তি করিয়া প্রতিবাদ স্বরূপ পুস্তক লিখিয়াছেন। যথা মুন্সী জগত কিশোর ‘হুস্ন’। কিন্তু নিরপেক্ষ ইতিহাস কি ইহার সত্যতা সমর্থন করে না? কেন এক ঝড়েই এই দুই প্রাচীন দেশ পড়িয়া যায় তাহার কারণ অনুসন্ধান করা কি প্রয়োজনীয় নহে? এই পুস্তকের শেষে আক্ষেপ করিয়া তিনি বলিয়াছেন—
“উও দীনে হজাজীকা বেবাক বেড়া।
নিশাঁ জিসকা অকসায়ে আলম মেঁ পহুঁচা॥
মজাহম হওয়া কোই খতরা ন জিসকা।
ন অম্মাঁমেঁ ঠিঠকা ন কুলজম মেঁ ঝিককা॥
কিয়ে হুয়ে সফর জিসনে সাতোঁ সমন্দর।
উহ ডুবা দহনে মেঁ গঙ্গাকে আকর॥”
ইহার অর্থ, ইসলামের নৌবাহিনী যাহার পতাকা সর্ব্বত্র উপনীত হইয়াছে, শেষে সাত সমুদ্র পার হইয়া গঙ্গার মুখে আসিয়া ডুবিয়া গেল! এই স্থলে কবি ভারতে ইসলামের অবস্থায় নৈরাশ্য প্রকাশ করেন।
এই সঙ্গে তাঁহার “সিকোয়া-ই-হিন্দ” (ভারত বিলাপ) উপরোক্ত পুস্তকের পরিপোষক (Complementary)। ইহাতে, তিনি ভারতে মুসলমানদের পূর্ব্বেকার সুখের অবস্থা এবং বর্ত্তমানের দুর্গতির কথা বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি নিম্নলিখিত কথাতেই এই পুস্তক আরম্ভ করিয়াছেন:
“রোখসত আয় হিন্দুস্তান! আয় বোস্তানে বিখজান,
রহ চলে তেরে বহুতদিন হম বিদেশী মইমান,
স’ব বুয়াঁ উও সমরকণ্ড উও দমস্ক উও ইসফাহান,
ইয়াদ কুছ জিউঁ রহা হমকো ন দিজলাহ আউর ফরাত,
তেরি গঙ্গাজলনে জবসে তরকিই কামউও জবান,
তেরি কাসি কি কাসিস নে করদিই হমসে জুদা।”
“কিম মুঁসে দি ইলজাম হাম,
ফির গয়ি সরহদ সে তেরী ফৌজি ইউনান যিসতরা,
কাস ফিরযাতে ইউঁহিদরসে তেরী নাকাম হাম,
রহতে কানি আপনি মেহনত আউর মজদূরী সে কাস,
আকে ইয়া পাতে ন জৌকি রাহত উহ আরাম হাম।”
এই স্থলে তিনি পুনঃ বলিতেছেন, “কোন মুখে আমি দোষ দিই, যেমন গ্রীক সৈন্যদল তোমার সীমানা হইতে ফিরিয়া গিয়াছিল, তেমনি আমরা যদি এই স্থল হইতে ফিরিয়া যাইতে পারিতাম! নিজের মেহনৎ মজুরী করিয়া দিন কাটাইতাম কিন্তু এই স্থলে আসিয়া পছন্দসই শান্তি পাইলাম না”।
এই দুই পুস্তকে তাঁহার defeatist mentalityর পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে। ইহাতে তৎকালের শিক্ষিত মুসলমানের মনস্তত্ত্ব প্রকাশিত হইয়াছে, সেই সময়ে তাঁহাদের মন নৈরাশ্য ও হাহাকারে পরিপূর্ণ তাই পূর্ব্ব স্মৃতি স্মরণ করিয়া এত তীব্র বেদনা মনে জাগ্রত হইয়াছে। এই পুস্তকে তিনি পূর্ব্বেকার মুসলমানদের জাঁকজমক, সামাজিক আড়ম্বরের কথা খুব উৎসাহের সহিত বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু এই সব ধুমধাম ও নবাবী চাল কি সাধারণ মুসলমানের ছিল? তাঁহাদের অবস্থার কথার কোন উল্লেখ এই সব মুসলমান লেখকদের কাছ হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায় না। সামন্ততান্ত্রিক বাদসাহ, নবাব ও ওমরাহদের ঐশ্বর্য্য ভোগ সাধারণ ও শ্রমজীবী মুসলমানের ভাগ্যে কখন হয় নাই। সেই জন্য, জনকতকের ঐশ্বর্য্যের পূর্ব্ব স্মৃতি স্মরণ পূর্ব্বক “ইসলামের অধঃপতন হইয়াছে” বলিয়া অশ্রুপাত করা, সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল মনোবৃত্তিরই পরিচায়ক।
এই স্থলে ইহাও বক্তব্য যে এই দুই পুস্তকে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে উপদেশ প্রদান করিয়াছন। তিনি এবং নবোত্থিত দল, বর্ত্তমানের শিক্ষাকে গ্রহণ করিবার জন্য আগ্রহ দেখাইতে লাগিলেন বটে, কিন্তু তাঁহারা মুসলমান সমাজকে আরবের মরুভূমিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে বলিলেন। আর বলিলেন, অতীতে মনিব ধার্ম্মিক ছিল এবং বর্ত্তমান যুগ হইতেছে পাপের যুগ। ইহার ফল একে “মনসা তায় ধুনা” হইল! সিপাহী বিদ্রোহের অবসানের পর হইল একটি খাঁটি ভারতীয়-মুসলমানের দল, যাঁহারা সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করিতে উত্থিত হইলেন। কিন্তু তাঁহারা আরবের অতীতকে আঁকড়াইবার জন্য স্বধর্ম্মীদের উপদেশ দিলেন। একেই ভারতীয় মুসলমানের স্বদেশপ্রীতি নাই—কাশীর বৈশিষ্ট তাহাকে পৃথক করে নাই, ইসলাম তাহার জাতিতাত্ত্বিক পরিবর্ত্তন ঘটাইয়া তাহাকে ভারত হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াছে—তার পর, এই উপদেশ। যাঁহারা রক্তে খাঁটি ভারতীয়, তাঁহারা নিজেদের ‘বিদেশী মইমান’ বলিতে লাগিলেন। এই জন্যই ভারতের সঙ্গে দেশজ মুসলমানের নাড়ীর যোগসূত্র আজও স্থাপিত হইল না। ইহা কথিত হয় যে, বর্ত্তমান সময়ের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সাম্যবাদী ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তি স্টালিন একবার একটী প্রাচীন গ্রীক গল্পের উদাহরণ দিয়া তাঁহার স্বদলস্থ লোকদের বলিয়াছিলেন, “Those who are not rooted in the soil will die out” (যাহারা জমিতে শিকড়বদ্ধ নহে তাহারা শুকাইয়া মরিয়া যাইবে)। এই তথ্যই ভারতীয় মুসলমানের পক্ষে খাটে, এই ব্যাপার লইয়াই ভারতীয় রাজনীতির যত গোলমাল।
পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়া হিন্দুর মধ্যে সংস্কারকের দল উত্থিত হইয়া প্রাচীন হইতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সেই radicalism সর্ব্বজন দ্বারা গৃহীত হয় নাই বটে, কিন্তু সেই প্রচণ্ড আঘাত হিন্দু সমাজকে সচেতন করিয়া দেয়। স্বামী বিবেকানন্দই ইহা স্বীকার করিয়া গিয়াছেন—Those electric shocks galvanized the sleeping Leviathan (Appeal to Young Bengal দ্রষ্টব্য)। কিন্তু মুসলমান সমাজ পুনঃ জাগরণের প্রাক্কালে শুনিলেন যে, তাঁহারা বিদেশী এবং তাঁহাদের আদর্শ আরবজাত সভ্যতা! ইহার ফলও ভারতের পক্ষে বিষময় হয়। এই জন্য, হালীর এই দুই পুস্তক এবং এই দলের মতকে আমরা প্রগতিশীল বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না। অবশ্য ভারত সম্বন্ধে হালী জাতীয়তাবাদী ছিলেন, একস্থলে তিনি বলিয়াছেন:
"রাম কে হামরাহ চড়ী রণমেঁতু।
পাণ্ডবোঁকে সাথ ভিরী বনমেঁ তু॥
আগর চাহতে হো মুল্ককী খৈর।
ন কিসী হম ওয়াতন কো সমঝো গৈর॥”
ইহার অর্থ
হে মুসলমান! তুমি রামের সঙ্গে তাহার লড়াইয়ে সহযোগী ছিলে, তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে বনে বনে ফিরিয়াছিলে, তুমি যদি দেশের ভাল চাহ তাহা হইলে স্বদেশবাসীর মন্দ চাহিও না।
এই স্থলে তিনি আবার প্রগতিশীল হইয়াছেন।
এই সময়ে উর্দুতে গদ্য পুস্তকও লিখিত হয়, ইহার পূর্ব্বেই ওয়াজিদ আলীসার সময়ে আমানতের (খৃঃ ১৮১৫-১৮৫৮) “ইন্দ্রর সভা” নামে একটী নাটক লিখিত হয়। ইহাতে স্বর্গে ইন্দ্রের সভাতে পরীদের নৃত্যগীত প্রভৃতির কথাই আছে। ইহা একটী বাদসাহ বা নবাবের দরবারের প্রতিচ্ছবি মাত্র। কিন্তু হিন্দুর “ইন্দ্র” নাম ইহাতে থাকায় অনেকে ভুল বুঝেন; হিন্দি সাহিত্যিক ভারতেন্দু ইহার পাল্টা জবাব দিবার জন্য “বান্দর সভা” নামে এক পুস্তক লেখেন! (লেখকের কোন মুসলমান বন্ধু একবার বলিয়াছিলেন, তিনি হিন্দুদের ধর্ম্ম বিষয়ে পুস্তকাদি পড়িয়াছেন যথা ‘ইন্দ্রর সভা”)! এই নাটক প্রগতিশীল নহে এই সময়ে রজ্জব আলী “সরুর” “ফিস নাই—আজাইব” নামক গা পুস্তক লেখেন। ইহাতে তুকতাক, ডাইনী প্রভৃতির গল্প এবং পতনোন্মুখ নবাব বাড়ীর গল্প লেখা হইয়াছে। লক্ষ্ণৌর সামাজিক জীবন ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু ইহা সবই কল্পনা প্রস্তুত।
এই সময় হইতে উর্দু তে নাটক লিখিত হইতে থাকে। কিন্তু ফার্শীতে নাটক না থাকায় লেখকেরা সেক্সপীয়ার প্রভৃতি ইংরেজী লেখকদের নকল করিতে থাকেন। সংস্কৃতের কোন ধার তাঁহারা ধারিলেন না। বাঙ্গলা নাটকেও এই প্রকারের বিবর্ত্তন হইয়াছে।
ইহার পর আসেন দুর্গা সহায় ‘সরুর’ (খৃঃ ১৮৭৩-১৯১০)। ইনি দুঃখ ও করুণতার চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন। ইনি ছিলেন; একজন স্বদেশপ্রেমী জাতীয়তাবাদী কবি তাঁহার “থাক-ই-ওয়াতন”, “উরুস-ই-হুবলী-ওয়াতন”; “হুসরত-ই ওয়াতন”; “ইয়াদ-ই-ওয়াতন”, “মাদার-ই-ওয়াতন” প্রসিদ্ধ। শেষোক্তটি বঙ্কিম চন্দ্রের “বন্দেমাতরম্” এর প্রতিধ্বনি বলিয়া প্রতীত হয়। নাদীরও এই সুরে “মুকদ্দস সরজমীন” (পবিত্রভূমী) এবং “মাদার-ই-হিন্দ” লেখেন। এইগুলি তৎসময়ে রাজনীতিক ও স্বদেশপ্রেমিকের মনস্তত্ত্ব ব্যক্ত করে, এই জন্য অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল বলা যায়। নাসীর আহমেদ “মিরাতুল উরুস” পুস্তকে একজন অশিক্ষিত বালিকা উচ্চশ্রেণীয় মুসলমানের সংসারে বিবাহ করিয়া কি প্রকারে পরিবর্ত্তিত হইয়াছে তাহা চিত্রিত করিয়াছেন। হিন্দু ও মুসলমান কন্যারাই ইহা পাঠে উপকৃত হন। ইহা প্রগতিশীল পুস্তক। তদ্রূপ, ‘বিনত-উম-নাস’ পুস্তকে নারী শিক্ষার উপকার প্রদর্শন করিয়াছেন। ইহাও প্রগতিশীল পুস্তক। মনোহর লাল জুটসী (খৃঃ ১৮৭৬ জন্ম) “গুলদস্তা-ই-আদাব” (ব্রিটিশ-ভারতে শিক্ষা) বিষয়ক পুস্তক লিখেন। ইনি পূর্ব্বেকার উর্দু কবিদের ভাষার তীব্র সমালোচনা করেন। দয়ানারায়ণ নিগম (জন্ম খৃঃ ১৮৮৪) “জমানা” সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং সামাজিক, রাজনীতিক, সাহিত্যিক নানা আন্দোলনের কেন্দ্র স্বরূপ। ইহাঁর লেখায় প্রগতির সন্ধান পাওয়া যায়। লালা শ্রীরাম “ঘুমখানা-ই-জয়ীদ” নামক চারিখণ্ডে (এখনও অসম্পূর্ণ) অপ্রকাশিত উর্দু কবিদের কবিতাসমূহ উদ্ধার করেন। এই সঙ্গে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের “আল-হিলাল” বিশিষ্ট ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সময়কার মুসলমান লেখকেরা লম্বা চওড়া আরবী ও ফার্শী শব্দ সমূহ উর্দুতে ব্যবহার করিতে লাগিলেন। “আল-হিলাল” ধর্ম্ম সম্বন্ধেই বিশেষ ভাবে লেখে। “আউধ পাঞ্চ” (১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে স্থাপিত, এক্ষণে বন্ধ) সজ্জদ হাইদার দ্বারা লক্ষ্ণৌতে স্থাপিত এই পত্রিকা, কংগ্রেস, হিন্দু ও মুসলমানের একতা সমর্থন করিত। এই হিসাবে ইহা প্রগতিশীল ছিল, কিন্তু স্ত্রীশিক্ষা, পাশ্চাত্য বিদ্যা এবং পর্দ্দার কড়াকড়ি উঠান বিষয়ের প্রতিপক্ষে ছিল। এই জন্য এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়াশীল। তৎপর, ঢাকার নবাব সৈয়দ মহম্মদ আজাদ (জন্ম খৃঃ ১৮৪৬) নভেলাকারে “নবাবী দরবার” নামক পুস্তকে একজন পুরাতন ধরনের অলস নবাবের দোষ ও দুর্ব্বলতার উপর কশাঘাত করিয়াছেন। এই বিষয়ে পুস্তকটি প্রগতিশীল।
তৎপর, একজন বড় গদ্য লেখক ছিলেন রতন নাথ ধর “সারসার” (খৃঃ ১৯০২ মৃত)। ইহাঁর বিখ্যাত পুস্তক হইতেছে, “ফিসানা-ই-আজাদ”; ইহা ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে লিখিত। লক্ষ্ণৌর সামাজিক জীবনের সর্ব্বাঙ্গেরই চিত্র এই পুস্তকে প্রদত্ত হইয়াছে। মহরম, চিল্লাম, আয়েসবাগের মেলা, আফিংখোর, উদ্ভট পোশাকপরা নবাব ও তাহার কাঠ শুকনা দ্বারবানের দল, ফিটনে চড়া নর্ত্তকী, ভিক্ষুক, সর্ব্ব বয়সের সুশ্রী ও বিশ্রী স্ত্রীলোক, পুলিশ, রেলওয়ে বাবু, ঠাকুর (রাজপুত), লালা যে ফার্শী শিখিয়া পানওয়ালীর কাছে তাহা ব্যবহার করিতেছে, তুর্কী ফেজধারী নূতন ঢং-এর মুসলমান, ধুতীপরা বাঙ্গালী ইত্যাদির হুবহু বর্ণনা এই পুস্তকে প্রদত্ত হইয়াছে। ইনি অপ্রাকৃতিক পরিত্যাগ করিয়া মানুষের সাধারণ জীবন বর্ণনায় অনুরক্ত ছিলেন। ইহাঁর পুস্তকে আমরা সর্ব্বশ্রেণীর লোকের সংবাদ পাই, এই জন্য ইহা অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল। পুনঃ, ধনপতরায় “প্রেমচাঁদ” “জলওয়া-ই-আইসর”, বাজার-ই-হুসন” পুস্তক সমূহে সাধারণ ব্যক্তি বিষয়ে লিখেন। ইনি সর্ব্ব প্রথম লেখক যিনি কৃষক বিষয়ে মনোযোগী হন। ইহাঁর সাহিত্য প্রগতির ছাপ বহন করে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এবং বিংশশতাব্দীর প্রথম যুগে কবি আকবর প্রকট হন। ইনি জাতীয়তাবাদী কবি।
একস্থলে ইনি বলিতেছেন:
আকবর: “কেয়া গণিমত নহীঁ য়’ আজাদী,
সাঁসলেতে হৈঁ বাত করতে হৈঁ”।
“হিন্দু মুসলমান এক হৈঁ দোনোঁ।
য়ানী য়ে দোনো এসিয়াই হৈঁ
হমওয়াতন হমজবাঁ উও হম কিস্মত।
কেঁও ন কহ দুঁ কি ভাই ভাই হৈঁ”॥
হিন্দু ও মুসলমানের মিলন কেন হয় না সেই বিষয়ে ইনি জবাব দিতেছেন—“মৌলিবী কো পুছ”। তার পর, যখন খয়ের খাঁর দল, ভারতকে ‘দার-উল-ইসলাম’ বলিতে লাগিল, তখন তিনি তাহার প্রত্যুত্তরে জবাব দেন:
“য়ে বাত গলৎ দারে ইসলাম হৈ হিন্দ।
য়ে ঝুট কি মুল্কে লছমনো রাম হৈ হিন্দ॥
হম সব হৈঁ মুতী উও খৈরখায়ে ইঙ্গলিস।
য়ুরোপকে লিয়ে বস এক গোদাম হৈ হিন্দ”॥
আবার, যাহারা স্বদেশ ভূলিয়া কেবল ইরান ও তুরাণের কথায় মসগুল হয় তাহাদের কশাঘাত করিয়া ইনি বলেন:
“পেট মসরূপ হৈ কলকীমেঁ।
দিল হৈ ইরান ঔর টর্কীমে”॥
১৯২১ খৃষ্টাব্দের অসহযোগ আন্দোলনের সময় ইনি গান্ধীজির প্রশংসা সূচক একটী কবিতা তাঁহাকে উৎসর্গ করেন। রাজনীতি ও হিন্দু-মুসলমান মিলন সম্বন্ধে ইনি প্রগতিশীল ছিলেন কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল। স্ত্রী শিক্ষা ও স্ত্রী এবং পুরুষের পাশ্চাত্য ভাবাপন্ন হওয়া বিষয়ে ইনি বিশেষ ভাবে বিপক্ষতা করিতেন এবং ব্যঙ্গ করিয়া কবিতাও লিখিয়াছেন। এক জায়গায় ইনি বলিতেছেন:
“হুস্নে-মিসপর কর নজর মজহব অগর জাতা হৈ জায়।
কদরদাঁকো নির্খ কি কেয়া বহম আকবর মাল দেখ”॥
ইনি বাঙ্গালীদের লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছেন:
“বাত বঙ্গালীকে সুন বঙ্গালিনোঁ কে বাল দেখ”!
আর এক স্থানে ইনি বলিতেছেন:
“নুক্তায়ে সুনা হৈ এক বঙ্গালীসে।
করনা হো বসর জো তুমকো খুশহালী সে।
খালী হো জগহ তো আপনে ভাইকো দিলাবে।
গুস্সা আয়তো কামলো গালী মে”॥
রুষ বিপ্লবের পর, সাময়িক পরিস্থিতি লক্ষ্য করিয়া ইনি বলিতেছেন:
“হমে কেয়া বোলশেভিক ফিরগয়া য়া রুষ আতা হৈ।
য়হাঁ তো ফিক্রে সরমাই হৈ মাহে পুস আতা হৈ”॥
অধ্যাপক আজাদ ‘আবে হায়াৎ’ পুস্তকে কি প্রকারে ‘ভাষা’ হইতে উর্দুর বিবর্ত্তন হইল এই প্রসঙ্গে ভবিষ্যৎবাণী করিয়াছিলেন যে, কালে উর্দুতে ইংরেজী শব্দ সমূহ প্রবেশ লাভ করিবে। কবি আকবরে তাহা সত্য হইয়াছে, ইনিই প্রথম উর্দুতে ইংরেজী শব্দ প্রবেশ করান। যথা:
“মুবারিক হো তুম্হী কো চাটনা ল্ড্ডুকে ফোটোকা”!
ইহাঁরই সাময়িক ছিলেন কবি মহম্মদ ইকবাল। ইনি প্রথমে হৃদয়োন্মাদক জাতীয়তাবাদী এবং স্বদেশ-প্রেমিক কবিতা ও গান সমূহ রচনা করিয়া বিখ্যাত হন; পরে সাম্প্রদায়িক ও “পাকীস্থান” পরিকল্পনার দার্শনিক হন।
ইহাঁর বিভিন্ন যুগের রচনার ও মনস্তত্ত্বের কিঞ্চিৎ নমুনা নিম্নে প্রদত্ত হইল।
‘তসইর দরদ’ কবিতার একস্থলে ইনি দেশের দুর্গতি স্মরণ করিয়া ক্রন্দন করিয়া বলেন:
ইকবাল: “রুলাতা হৈ তেরা নজ্জারা ইয়ে হিন্দোস্তাঁ মুঝকো।
কি ইবরত খেজ হৈ তেরা ফিসানা সব ফিসানোমেঁ”॥
পুনঃ, ইনি বলিতেছেন:
“ওতন কী ফিক্র কর নাঁদা মুসীবত আনেবালী হৈ
তেৱী বর্ব্বাদিয়োঁ কে মশুরে হৈঁ আসমানোঁ মেঁ॥
ন সমঝোগে তো মিট জায়েগা ইয়ে হিন্দোস্তানবালো
তুম্হারী দাস্তাঁতক ভী ন হোগী দাস্তাঁনোমেঁ”॥
তৎপর, “হিন্দোস্তান হামারা” নামক সঙ্গীতে তিনি সিংহ-গর্জ্জনে বলিয়াছেন:
“সারে জাহাঁসে আচ্ছা হিন্দোস্তাঁ হামারা।
হম বুলবুলে হৈঁ ইসকা য়হ গুলসিতাঁ হমারা॥
এ আবে রৌদে গংগা উও দিন হৈ য়াদ তুঝকো।
উতারে তেরে কিনারে জববাকারবা হমারা।
মজহব নাহি শিখাতা আপস মেঁ বৈর রখনা।
হিন্দী হৈঁ হম ওয়াতন হৈ হিন্দোস্তাঁ হমারা॥
য়ুনানী মিশ্রী রোমাঁ সব মিটগয়ে জগাঁ সে।
আবতক মগর হৈ বাকী নামো-নিশা হমারা॥
কুছ বাত হৈ কি হস্তী মিটতী নহীঁ হমারী”।
এতক্ষণ সিংহ-গর্জ্জনে স্বদেশ প্রেমের বর্ণনা চলিতেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই হতাশায় অভিভূত হইয়া তিনি আক্ষেপ করিয়া বলিলেন:
“সদিয়ো রহাহৈ দুসমন দৌরে জহাঁ হমারা।
“ইকবাল” কোই মহরম আপনা নহী জহাঁ মে।
মালুম কেয়া কিসী কো দর্দে নিহাঁ হমারা”।
তিনি দুঃখ করিয়া বলিয়াছেন, ‘আমাদের ইতিহাসের গতিতে শতাব্দী ধরিয়াই শত্রু থাকিয়া গিয়াছে। হে ইকবাল! আমার দুঃখে সান্ত্বনা দিবার কেহ নাই। কি জানি কাহার হৃদয়ে আমার জন্য দরদ আছে”। “পুনঃ, তসইর-দরদ” নামক কবিতাতে তিনি বলিয়াছেন:
“তাস্সুবনে মেরে খাক ওয়াতনমে ঘর বনায়া হ্যায়,
উও তুফান হুঁ কি ময় উস ঘরকো বিরান করকে ছোড়ুঙ্গা”।
ধর্ম্মান্ধতা বা কুসংস্কার আমার মাতৃভূমিতে বাসা বাঁধিয়াছে। আমি তুফানের ন্যায় তাহাকে ভাঙ্গিয়া দিব।
পুনঃ, তিনি বলিতেছেন:
“পরোনা একহী তসবিহমেঁ ইন বখেরে দানোঁকো।
যো মুসকিল তো উস মুসকিল কো আসান কর কে ছোডুঙ্গা।
আগর আপসমে লড়না আজকাল কি হ্যায় মুসলমানী
মুসলমানোকো। আথর না-মুসলমান করকে ছোডুঙ্গা।
দেখাদুঙ্গা জহানকো যো মেরে আখেঁসে দেখা হ্যায়।
তুঝে ভি সুরতে আয়না হয়রান করকে ছোডুঙ্গা”।
এই স্থলে ইনি বলিতেছেন, “এই বিচ্ছিন্ন ভারতবাসীদের এক সূত্রে গ্রথিত করিবার জন্য যে কষ্ট তাহা আমি স্বীকার করিব। আমি মাতৃভূমিকে জগতের আশ্চর্য্যজনক বস্তু করিয়া তুলিব।” এই স্থলে আমরা পুনঃ সিংহগর্জ্জন ও গঠনমূলক (Constructive) আশার বাণী শ্রবণ করি। এতক্ষণ তিনি স্বদেশ ও স্বজাতিকে জাগ্রত করিয়া বড় করিবার জন্য জাতীয়তার তুর্য্যনিনাদ করিতেছিলেন। এই উপলক্ষে তিনি অনেক অপ্রিয় সত্য দেশবাসীকে শ্রবণ করাইয়াছেন। “নয়া শিবালা” নামক কবিতায় তিনি হিন্দু ও মুসলমানকে উপলক্ষ করিয়া বলিয়াছেন।
“সচ কহ দুঁ ইয়ে বেরামন গরতু বুরা ন মানে
(সত্য কহি হে ব্রাহ্মণ তুমি মন্দ ভেবো না)
তেরে সনমকদোঁকী বুত হো গয়ে পুরানে।
(তোমার মন্দিরের দেবতাটি পুরাতন হইয়া গিয়াছে)
আপসমেঁ বৈর রাখনা তুনে বুতোঁসে শিখা।
(তুমি তোমার দেবতার কাছ হইতে পরস্পরের সহিত ঝগড়া করিতে শিখিয়াছ)
জঙ্গ-জদল শিখায়া ওয়াইজকো ভী খোদানে।
(মুসলমান ধর্ম্মোপদেশককে খোদা লড়াই করিতে শিখাইয়াছে)
পাত্থর কী মূর্ত্তোমেঁ তুনে সমঝা হ্যায় খুদা হায়।
(পাথরের মূর্ত্তিতে তুমি ভাবিতেছ ভগবান আছে)
থাকে ওয়াতনকা মুঝকো হরজরা দেওতা হ্যায়।
(মাতৃভূমির প্রত্যেক ধূলিকণা আমার কাছে দেবতা)
শুনি পড়ি হুয়ি মুদ্দতসে দিলকা বস্তি।
(শুনেছি অনেক দিন থেকে মন চর্চ্চাবিহীন হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে)
আঃ ইক নয়া শিবালা ইস দেশমে বনাদে”।
(আঃ এই মন-ভূমিতে একটি নূতন শিবালয় নির্ম্মাণ কর)।
এই সব কবিতায় তাঁহাকে প্রগতিশীল বলিয়া নিরীক্ষণ করা যায়। সাহিত্যের ভিতর দিয়া তিনি দেশকে জাগ্রত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন।
কিন্তু ইউরোপ পরিভ্রমণের পর থেকে তাঁহার সঙ্গীতের সুর পরিবর্ত্তিত হয়। ইউরোপ যাত্রা কালে পথে সিসিলী দ্বীপে আরবদের এক সৌধের ধ্বংসাবশেষ দর্শন করিয়া তিনি শোকাপ্লুত হইয়া এক “মরসিয়া” লিখিয়া বলিলেন:
“রোয়ে আয়ে লাখ দিলকর আয় দিদাখুন বহানা কর,
উও নজর আতা হ্যায় তহজিব হেজাজীকা মজার”।
[চক্ষুতে রক্ত বাহির করিয়া প্রাণ ভরিয়া ক্রন্দন কর, হেজাজীদের
(আরব) সভ্যতার কবর ওই দেখা যাইতেছে]।
পুনঃ, এই উপলক্ষে তিনি বলিতেছেন:
“শুনা হ্যায় কদসিয়োসে ময়নে উও সের ফির হুঁসিয়ার হোগা”।
[স্বর্গীয় দূতদের কাছ থেকে শুনেছি ওই (আরব) সিংহ পুনরায় জাগ্রত হইবে।]
শেষে তিনি বলিতেছেন:
“মরসিয়া তেরী তবাহী কা মেরী কিসমতমে থা।
ইয়ে তড়পনা আউর তড়পানা মেরী কিসমতমে থা”।
ইহার অর্থ, আমার অদৃষ্টেই ইহা নির্দ্দিষ্ট ছিল যে তোমার জন্য শোক প্রকাশ
করিয়া কবিতা লিখিব। এই যন্ত্রণা ভোগ করা এবং অপরকেও ভোগ করান আমার অদৃষ্টে ছিল!
প্যান-ইসলামবাদী হইয়া, সারাসেনদের সিসিলিতে প্রভুত্বের চিহ্ণস্বরূপ এক ধ্বংসাবশেষ দেখিয়া তিনি আকুল হন, কিন্তু ভারতে প্রাচীন ও মধ্যযুগের কত কারুকার্য্যের স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংস যে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে তাহার দিকে এই যুগে তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষিত হয় নাই! কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভব তিনি, প্রাচীন কাশ্মীরের স্থপতি কার্য্যের ধ্বংসাবশেষগুলির প্রতি তাঁহার নজর যায় নাই, পুনঃ, ভারতীয় লোক হইয়া তিনি এই কথা তেজের সহিত বলিতে পারিলেন না যে, “হিন্দুস্থানকী শের ফির হোসিয়ার হোগা!” এই তথ্য হিন্দু ও ইউরোপীয়ের নিকট অবোধ্য। যাহাই হউক, এই যুগেও তাঁহাকে আমরা নৈরাশ্যের কবিরূপে দর্শন লাভ করি। এই স্থলেও গঠনমূলক কিছু তাঁহার কাছে পাই নাই।
ইউরোপ প্রবাসকালে তিনি তথাকার শ্রমশিল্পজাত ব্যবসায়ী সভ্যতার স্বরূপ দেখিয়া বলিলেন:
“দস্তে-দৌলত আফিরীঁ কী মুজদ ইয়োঁ মিলতী রহী।
অহলে সর্বত জৈসে দেতে হৈ গরীবোঁকো জকাত।
নস্ন, কৌমীয়ত, কলীসা, সলতনত, তহজীব, রঙ্গ।
খ্বাবগী নে খুব চুন-চুনকর বনায়ে মুসকরাত।
মক্রকী চালোঁসে বাজীলে গয়া সর্মায়াদার।
মশরিকো মগরিব য়েঁ তেরে দৌরকা আগাজ হৈ॥”
ইহার অর্থ—হাতে ধন থাকার প্রশংসার কারণ এই স্থলেই প্রাপ্ত হওয়া যায়, যেমন গরীবকে জাকাত দিবার কালে প্রথমে সরবত পান করিতে দেওয়া হয়। বংশ, জাতিত্ব, গির্জা, রাজত্ব, সভ্যতা, আহ্লাদ এইসব সৃষ্টি করিয়া স্বপ্ন খুব খেলা দেখায়! কিন্তু জুয়াচুরীর চালে মূলধনীই জিতিল! পশ্চিম ও প্রাচ্যের দৌড়ের অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতার আরম্ভ হইয়াছে।
ইকবাল যখন পশ্চিম ভ্রমণ করিতে যান তখন পশ্চিমের পণ্ডিতেরা জগতের সমস্যাকে ‘পূর্ব্ব ও প্রতীচ্যের সমস্যা’ বলিয়া নির্দ্দেশ করিতেন (ফরাশী লেখক Gustave Le Bon-এর পুস্তক সমূহ, আমেরিকান Weale-এর Conflict of Colour দ্রষ্টব্য) আর ইহার সমাধানের জন্য সাম্রাজ্যবাদীমত সমূহ যথা: “Control of the Tropics”, “White Man’s Burden” ইত্যাদি সর্ব্বত্র প্রচারিত হইত। পুনঃ, এই দেশে তাহা স্কুল কলেজে পঠিত হইত এবং তাহা পাঠ করিয়া revealed truth (আপ্ত বাক্য) বলিয়া বিশ্বাস করিয়া আমরা কৃতার্থ হইতাম। এই যুগের ছাঁচ তাঁহার মনে লিখিয়াছিল তাই প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদীয়দের কথায় তিনিও বিহ্বল হইয়াছিলেন। এই স্থলেও হতাসতার আভাস আমরা পাই (বাঙ্গালার হেমচন্দ্রেও ইহার আভাস পাওয়া যায়)।
শেষে কিন্তু এই সভ্যতার আসলরূপ দেখিয়া তিনি সিংহ-গর্জ্জনে পুনঃ বলিলেন:
“দিয়ারে মগরেব কি রহনেওয়ালো খোদাকি বস্তি দোকান নেহি হ্যায়,
খিরাজসে তোম সমঝ রহে হো উও আব জোরকম আইয়ার হোগা।
তোমহারি তহজিব আপনে খন্জরসে আপহি থোদকুসি করেগী,
জো সাখ নাজক প, আসিয়ানা বনেগা নাপায়দার হোগা”॥
ইহার অর্থ—হে পশ্চিমের অধিবাসীগণ! ভগবানের রাজত্ব দোকান নয়, তুমি খাজনা খাইয়া সন্তুষ্ট আছ, কিন্তু তাহার মূল্য আজ কম প্রমাণিত হইবে। তোমার সভ্যতা আপনার অস্ত্রেই আত্মহত্যা করিবে। যে নরম ডালে বাসা বাঁধে, তাহা অস্থায়ীই হয়।
বিগত জগতব্যাপী প্রথম যুদ্ধের পর, ইকবালের গুণমুগ্ধ বন্ধুরা (নবাব জুল ফিকার খাঁ, সার আবদুল কাদের দ্রষ্টব্য) বলিলেন, তাঁহার ভবিষ্যৎবাণী সফল হইয়াছে।
অবশ্য এই স্থলে আমরা প্রগতির সংবাদ পাই না, তবে যখন তৎকালের শিক্ষিত ভারতবাসী ইউরোপের সভ্যতার বাহ্যিক চাকচিক্য দেখিয়া ভুলিতেন এবং Mid-Victorian ideologyর উপর উঠিতে পারিতেন না, তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি সত্য ধরিতে পারিয়াছিলেন। কার্ল মার্ক্স ও এঙ্গেলস যাহা বহু পূর্ব্বে বৈজ্ঞানিক প্রণালী দ্বারা সিদ্ধ করিয়াছিলেন, ইকবাল কবির দৃষ্টি দ্বারা তাহার স্বরূপ বোধগম্য করেন। এই স্থলে তাঁহার মন উচ্চস্তরে অবস্থিত ছিল বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে যদিচ এতদ্বারা প্রগতি বা গঠনমূলক কিছু আমরা পাই না। শেষে তাঁহার “প্রেমের জন্ম” নামক কবিতাটী অতীন্দ্রিয়বাদের ভিত্তিতে একটী কল্পনাপ্রসূত কবিতা:
“আভি ইমকান কি জুলমত খানে সে উভরি হি থি দুনিয়া,
মজাক জিনদেগী পোসিদাহ থা পহনায়ে আলমসে
তড়প বিজলিসে পাই হুর সে পাকেজগী পাই,
হরারত লি নফসলি মসিই-ইবনে-মরিয়মসে,
জরাসে ফের রবোবিয়ৎ সানে বেনিয়াজি লি
খরাম নাজ পায়া আফতাবোঁনে সেতারোঁ নে
চটক গুনচোনে পাই সোয়াগ পাই লাখ জরায়োঁনে”।
ইহার অর্থ—“সম্ভাবনার অন্ধকার গৃহ হইতে পৃথিবী কেবলমাত্র বহির্গত হইয়াছে, জীবনের আনন্দ এখনও বিস্তৃত জগতে লুক্কাইত আছে। বিদ্যুত থেকে চাঞ্চল্য, হুর থেকে পবিত্রতা, যীশুখৃষ্ট থেকে বিশ্বাস, ভগবান থেকে ভক্তি গৃহীত হয়! [ইহার যে মিশ্রণ হয় (মকররব) তাহার নাম—প্রেম (মহব্বত)]। (এতদ্বারা) যাহা খাড়া ছিল তাহা গোলাকার ধারণ করে: যথা তারকাবৃন্দ ও চন্দ্রাদি, ফুলের কুঁড়ি সব নূতন রঙ্গ ধরে, অসংখ্য ফুলসব সোহাগপ্রাপ্ত হয়।” এই কবিতাতে নৈরাশ্য নাই কিন্তু অতীন্দ্রিয়বাদীয় কল্পনার চূড়ান্ত আছে। ইহাতে আমরা প্রগতির চিহ্ন দেখিতে পাই না।
ইকবাল হতাশার কবি ছিলেন; ক্রন্দন করাই তাঁহার ভাগ্যে ছিল তাহা তিনি স্বয়ংই স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। গঠনমূলক কোন আদর্শ তিনি প্রদান করিয়া যাইতে পারেন নাই যদ্বারা তাঁহার দেশবাসীরা প্রগতির অভিমুখে ধাবিত হইবে। এই জন্য শেষ জীবনে তিনি প্রগতিশীল কবি ছিলেন না।
ইকবালের সঙ্গে আর একজন কাশ্মীরী বংশীয় কবির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইনি ব্রজনারায়ণ “চাকবন্ত”। ইনি লক্ষ্ণৌতে জন্মগ্রহণ করেন এবং প্রতিভাপন্ন কবিরূপে উদিত হন। ইনি ‘স্বায়ত্ত-শাসন’ এবং ‘অসহযোগ আন্দোলন’ এর সহিত সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলেন। ইঁহার “খাকে হিন্দ” নামক সুদীর্ঘ কবিতা অতি প্রসিদ্ধ।
চাকবন্ত: “ইয়ে খাকে হিন্দ তেরে আজম মেঁ কেয়া গুমান হৈ।
দরিয়ায় ফৌজ কুদরত তেরে লিয়ে রবাহৈ॥
শময়ে আদব ন থী জব য়ুনাঁ আন্জুমন মেঁ।
তাবাঁথা মহরে দানিশ ইস বাদিএ কুহন মেঁ॥
জমীনহিন্দী রূতবে মেঁ অরশ আলা হৈ।
যহ হোমরূলকী উম্মীদ কা উজালা হৈ”॥
ইহার অর্থ—হে ভারত মাতৃভূমি! তোমার মহত্বে কি সন্দেহ আছে? সমুদ্রের জীব সকল তোমার গুণগান করে। যে সময়ে গ্রীসে সভ্যতার আলোক ছিল না, তৎকালে এই প্রাচীন দেশে উচ্চজ্ঞান প্রচলিত ছিল। উচ্চ সিংহাসনই হিন্দুস্থানের পদ নির্দ্দেশ করিয়া দিয়াছে, এক্ষণে এই স্থলে হোমরূলের আশা উজ্জ্বল হইয়াছে।
এই কবিতায় আমরা প্রগতির নির্দ্দেশ পাই।
এক সময়ে ক্ষুণ্ণ হইয়া তিনি বলিয়াছিলেন:
“কৌম কী সিরাজাবন্দী কা গিলা বেকার হৈ।
তর্জে হিন্দু দেখ কর রংগে মুসলমান দেখ কর”॥
ইহার অর্থ—হিন্দুকে তর্কবাগীশ দেখিয়া এবং মুসলমানকে গাত্রবর্ণে চিহ্নিত দেখিয়া মনে হয়, ‘নেশন’কে একত্রে বন্ধন করা বিষয়ে নালিশ বৃথা!
পুনঃ, মান যশের প্রতি উপেক্ষা করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন:
“কিস ওয়াস্তে জুস্তজু করুঁ সোহরৎ কী।
একদিন খুদ চুঁড়লেগী সোহরৎ মুঝকী”।
দুঃখের কথা, তিনি অকালে মৃত্যু মুখে পতিত হওয়াতে এই সুর আর ধ্বনিত হয় না। এক্ষণে আমরা বর্ত্তমানকালে উপনীত হইয়াছি। উপস্থিত সময়ে কতকগুলি মুসলমান কবি উত্থিত হইয়াছেন যাঁহারা জাতীয়তাবাদীয় কবিতা সমূহ লিখিতেছেন। ইহাঁদের কবিতার মধ্যে প্রগতির ধ্বনি উত্থিত হইতেছে।
মৌলানা হাফিজ বলিতেছেন:
হাফিজ “আপনে মনমেঁ প্রীত বসালে,
ভুলগয়া ও ভারতওয়ালে;
প্রীত হৈ তেরী রীত!
সেখ বরহমন দোনোঁ রহজন (ডাকাইত) একসে বড়
কর এক লুটেরা,
ভারতমাতা হৈ দুখিয়ারী, দুখিয়ারে হৈঁ সব নরনারী,
তু জাগে তো দুনিয়া জাগে, জাগ উঠসব প্রেম পূজারী,
বসালে; আপনে মনমেঁ প্রীত”।
অখতর শেরাণী বলিতেছেন:
“ভারত সবকী আঁখকা তারা ভারত,
ভারত হৈ জিন্নতকা নজারা ভারত,
প্যারা প্যারা দেশ হমারা ভারত”।
“ভারত প্যারা দেশ হামারা, সবদেশী সে প্যারা হৈ,
হররত, হর ইক মৌসমইকা, কৈসা প্যারা প্যারা হৈ,
গঙ্গাজীকী প্যারী লহরে গীত সুনাতী জাতী হৈঁ,
সদিয়োঁকী তহজীব হমারী ইয়াদ দিলাতী জাতী হৈঁ,
কৃষ্ণকী বংশীমে ফুঁকী হৈ রুহ হমারী জানোঁ মেঁ,
গৌতম কী আবজ বসী হৈ, মহলো মেঁ, মৈদানো মেঁ,
চিস্তী নে জোদীথী ময়, উও অবতক হৈ পৈমানোঁ মেঁ,
ভারত প্যারা দেশ হামারা সব দেশোঁ সে প্যারা হৈ।
মজহব হো কুছ, হিন্দী হৈঁ হম, সারে ভাই ভাই হৈঁ,
ভারত নামকে আশিক হৈঁ হম ভারত কে সৌদাই হৈঁ,
ভারত প্যারা দেশ হামারা সবদেশ সে প্যারা হৈ।”
মৌলানা হামিদ আলি খাঁ ‘সরমায়দারী’ (পুঁজিবাদ) সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ লিখিয়াছেন:
“দৌলতনে কৈসী, শোরিশ (বিদ্রোহ) ক্যায়া বাদসাহী ঔ’ক্যা গদাই (ফকীরী),
ভুখোঁকী রোটী হথিয়াকে বন্দা, করতাহৈ বন্দী পরকেঁও খুদাই?
শাহী গদাই, মীরী ফকীরী, জব উঠগয়ে য়হ পর্দে রয়াই (ঝুটে)
য়হ ভী হৈ ইন্সাঁ (মানুষ), উহভী হৈ ইন্সাঁ, উহ ইসকা ভাই, য়ই উসকা ভাই।”
'এহসান' দানিশ: ইনি মজুরের ছেলেকে লক্ষ্য করিয়া লিখিয়াছেন:
"য়হ প্যারা প্যারা বাচ্চা, আখোঁ কা তারা বাচ্চা।”
বর্ত্তমানের একজন কবি হইতেছেন মৌলানা জোস মালিহাবাদী। ইনি সাহিত্যিক প্রগতি আন্দোলনের সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়াছেন। ইঁহার কবিতাতে উপস্থিত প্রগতির সুর ধ্বনিত হইতেছে। এক্ষণে ভারতীয় অন্যান্য প্রাদেশিক সাহিত্যের ন্যায় উর্দুসাহিত্যে কৃষক ও মজুর, গরীব গৃহস্থের কাহিনী সংবাদপত্র প্রভৃতিতে উত্থিত হইতেছে। উর্দুভাষীদেরও মধ্যে হিন্দু মুসলমান নির্ব্বিশেষে একদল প্রগতিশীল লেখক সমুত্থিত হইয়াছেন যাঁহারা ভারতীয় রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিকে নূতন চক্ষে দেখিতেছেন। আশা করা যায়, কালে উর্দুসাহিত্যে তাঁহারা প্রগতির একটা বিশিষ্টরূপ প্রদান করিবেন।
এইস্থলে আমরা উর্দুসাহিত্য মধ্যে যৎকিঞ্চিৎ অনুসন্ধান করিয়া উপস্থিত সময়ে উপনীত হইতেছি। প্রথমে আমরা দেখি একটি মিশ্রিত ভাষারূপে ইহা উত্থিত হয়, পরে ফার্শী, আরবী ভাষাভিজ্ঞ পণ্ডিতেরা ইহা গ্রহণ করিয়া ইহাকে ইরাণীরূপ প্রদান করেন। ইহার ফলে এই সাহিত্য মধ্যে ভারতের পক্ষে অপ্রাকৃতিক ভাব ও বস্তুসমূহ আমদানী হয়। উর্দু সাহিত্যে সমসেদুবৃক্ষ (poplar), সরো (cypress), নারগীস (Narcissus), সৌসম (Elegantine), সমবুল (spikenard), বুলবুল, বোস্তাঁ, লইলা ও মজনুঁ, ফরহাদ ও সিরিন প্রভৃতির প্রেম, রোস্তাম ও তৎপুত্র সোরাবের বীরত্ব, ইসফানডিয়ার ও আফ্রাসিয়াব নামক রাজারা, হাতেম তাই ও আটকাল প্রভৃতির সংবাদে উর্দু সাহিত্য ভরপুর হয়। ভারতের ভীমের বীরত্ব, নল ও দময়ন্তীর প্রেম, অর্জ্জুন ও বভ্রূবাহনের যুদ্ধ, ভারতীয় ফুল, বৃক্ষ ও পর্ব্বত প্রভৃতির বর্ণনা তাঁহাদের কাছে হারাম হয়। কিন্তু খৃষ্টান-আরব হাতেম তাই বদান্যতার আদর্শ হন, খৃষ্টান-আরব আটকাল বড় কবি বলিয়া গণ্য হন, অগ্নি উপাসক ইরাণী রাজা খস্রু নৌসিরবান, জামসেদ, বহরাম প্রভৃতি এবং গ্রীক দার্শনিকেরা আদরণীয় হন। শ্রীরামচন্দ্র বা শ্রীকৃষ্ণের বংশধর বলিয়া স্বীকার করিতে তাঁহারা একেবারেই রাজী নন, কিন্তু কল্পিত এবং পৌত্তলিক ইরাণী রাজা ফরিদুনের বংশধর বলিতে তাঁহাদের গর্ব্বের সীমা থাকে না। ভারতের কোকিল, ভারতের শস্য-শ্যামলা ক্ষেত্র তাঁহাদের চিত্ত আকর্ষণ করিল না, আরব ও পারস্যের মরুভূমি ও বুলবুল তাঁহাদের আদরণীয় হইল। পশ্চিমের আধীঁ এবং উত্তপ্ত ধূলীময় দেশে তাঁহারা বোস্তাঁ, গুলসানের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন। ভারতের প্রকৃতি তাঁহাদের কাছে আদরের বস্তু হইল না; কাশ্মীরের প্রাকৃতিক দৃশ্য তাঁহাদের মুগ্ধ করিল না। কিন্তু “সব বুই আ” সমরকন্দ, ইসফাহান ও দামাস্কের জন্য তাঁহারা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন, কারণ তাঁহারা “বিদেশী”! তাঁহারা নিজ বাসভূমে এতকাল প্রবাসী হইয়া আছেন। এই কারণ, অন্যদেশের সামন্তসাহী যুগের গল্প ও বর্ণনাতে উর্দু সাহিত্য ভরপুর হইয়া আছে। এইজন্য, এই অপ্রাকৃত সাহিত্যে প্রগতির সন্ধানপ্রাপ্ত হওয়া দুষ্কর। একেই একটা সম্প্রদায়ের পতনোন্মুখ কালেই এই ভাষার জন্ম হয়; তৎপর, তাহার পতনশীল কালেই ইহার পুষ্টি সাধন হয়, কাজেই সেই ভাষার সাহিত্যে অতীতের কাহিনী এবং হা হুতাস ব্যতীত অন্য কী থাকিতে পারে? এইজন্য আমরা উর্দুতে বুর্জ্জোয়া সাহিত্যের উদয় দেখি না, সামাজিক চিত্র ইহাতে বিশিষ্টভাবে প্রতিফলিত হইতে দেখি নাই; সামন্তসাহীর জের এখনও উর্দু সাহিত্যে চলিতেছে। -বাঙ্গলার কবি নজরুলের আক্ষেপ:
“কবে সে খোয়ালী পাদসাহী, সেই অতীতে আজ চাহি,
যাস মুসাফির গান গাহি, ফেলিস অশ্রুজল”।
সেদিন পর্য্যন্ত মুসলমান উর্দু সাহিত্যিকদের প্রতি ইহার প্রযোজ্য হইত। কিন্তু আশা নূতন সাহিত্যিকদের দল, যাঁহারা নূতন দৃষ্টি কোণ দ্বারা দেশকে দেখিয়া নূতন সাহিত্য সৃষ্টি করিবেন।
- ↑ R. B. Saksena “ A History of Urdu, Literature. P. 7.
- ↑ পদ্মসিংহ শর্ম্মা-“হিন্দী, উর্দু ঔর হিন্দুস্তানী।”
- ↑ পেশোয়ারের ভাষাকে এখনও “হিন্দবী” বলা হয়।
- ↑ মুসলমান ধর্ম্মমতে শয়তান ময়ূর পক্ষীরূপে আদম ও ঈভকে প্রলুব্ধ করিয়াছিল। এইজন্য আল্লার শাপে তাহারা সারংদ্বীপে (সিংহল) অবতরণ করিয়া তথায় বাস করিতে
থাকে। - ↑ R. Saxsena পৃঃ ১৫