সাহিত্যে প্রগতি/হিন্দী সাহিত্যে প্রগতি

হিন্দী সাহিত্যে প্রগতি

(১)

এক্ষণে হিন্দী সাহিত্য বিষয়ে সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা করিব। বাংলা ও ভারতীয় অন্যান্য আর্য্য ভাষার ন্যায় হিন্দী ভাষাও প্রাকৃত ভাষা হইতে নিঃসৃত হইয়াছে[]। পশ্চিমে সিন্ধু দেশের পূর্ব্বভাগ থেকে বাংলার পশ্চিমভাগ পর্য্যন্ত যে সমস্ত প্রাকৃত হইতে উৎপন্ন ভাষা সমূহ লোক মধ্যে প্রচলিত আছে সেইগুলিকে আজকাল হিন্দী ভাষা বলা হয়। মধ্য যুগে আর্য্যাবর্ত্তের এই খণ্ডের ভাষাকে পণ্ডিতেরা “হিন্দী প্রাকৃত” বলিতেন, যেমন বাংলাকেও “গৌড় প্রাকৃত” বলা হইত। চতুর্দ্দশ শতাব্দীর প্রাক্কালে দিল্লীর দরবারের রাজকবি তুর্কী বংশজাত আমীর খসরৌ বলিয়া গিয়াছেন যে, হিন্দুদের একটা স্বতন্ত্র ভাষা আছে—তাহা হিন্দী[]। ইহা ফার্সী অপেক্ষা উন্নত, আর ফার্সী ভাষা যেমন আরবী ভাষার সহায়তা ছাড়া দাঁড়াইতে পারে না, হিন্দী অন্যপক্ষে একটি সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল ভাষা[]। এই খসরৌ প্রথমে হিন্দী ফার্সী মিলাইয়া কবিতা লিখিতে আরম্ভ করেন[]। আজকাল হিন্দী বলিয়া যে ভাষা লোকসমাজে ধরা হইতেছে তাহার মূল ভিত্তি হইল “খড়ি বোলী।” এ ভাষা দিল্লীর চারপাশে প্রচলিত আছে। ত্রিপাঠী বলেন, এই “খড়ি বোলী” ব্রজভাষা হইতে স্বতন্ত্র[]। আমরা দেখি যে, হিন্দী বলিয়া আজ একটি সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে এবং তাহা রাজনীতিক কলহের আবর্ত্তের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু ভাষাতত্ত্বের দিক দিয়ে দেখিলে দেখা যায় যে আর্য্যাবর্ত্তের এই বিশাল অংশে নানাপ্রকারের উপভাষা আছে। প্রাচীনকালের ভারতীয় পণ্ডিতেরা, সৌরসেনী প্রাকৃত এবং মাগধী প্রাকৃত নামে উত্তর ভারতের ভাষাকে বিভক্ত করিয়াছেন। গ্রিয়ারসন মহোদয় হিন্দীর দুইটা উপভাষা আছে বলেন: পূর্ব্বদিকের আর রাজস্থানের। আরও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করিলে এর আরও উপভাষা পাওয়া যান যথা—‘মঘাইয়া বোলী’, 'মৈথিলী’, ‘খড়ি বোলী’, ‘বঙ্গেড়ু’, ‘ব্রজভাষা’, ‘রাজস্থানী’, ‘বুন্দেলখণ্ডী’, ‘বাগেলখণ্ডী’, ‘ভোজপুরিয়া’ ইত্যাদি। আবার রাজস্থানীর ভিতরও বহু উপভাষা আছে। এই গুলির ব্যাকরণ যে এক তাও নয়। তবে হিন্দুর ভাষা—হিন্দী, আর ভারতবর্ষের বাইরের মুসলমান দেশসমূহে ভারতবাসীকে “হিন্দী” বলিয়া অভিহিত করা হয় বলিয়া “হিন্দীভাষা”[] বলিয়া একটা কথা চলিয়াছে। এই উপভাষাগুলির মধে বিহার ও যুক্তপ্রদেশের গোরক্ষপুর পর্য্যন্ত চলিত ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার সাদৃশ্য আছে[]। বাংলা ও বিহারের ভাষা মাগধী ভাষা প্রসূত[]। হয়তো বাংলার রাজনীতিক ক্ষমতা থাকিলে এই উপভাষাগুলি বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশিয়া যাইতে পারিত, কিন্তু ইতিহাসের ভাগ্য বিপর্য্যয়ে এই সব স্থানে দিল্লীর চলিত ভাষাপ্রসূত হিন্দী ও উর্দ্দু আসিয়া দখল করিয়াছে। প্রাচীনকালে এই সব স্থান ‘গৌড়-চক্রে’র অন্তর্গত ছিল[]। হয়তো সেই সময়ে বাংলা ভাষা ও এই সব স্থানের ভাষার বিশেষ প্রভেদ ছিল না। কিন্তু আজ এই খণ্ডের ছাত্রদের তথাকথিত হিন্দী সাহিত্য শিখিতে হইতেছে এবং তাহাদের মাতৃভাষা যাহাকে আজ গ্রাম্য বা ঠেঁট হিন্দী বলা হয়, তাহা মরিতে বসিয়াছে[১০]। বর্ত্তমান সময়ের হিন্দী ভাষা ও সাহিত্য অতি আধুনিক। ইহার ব্যাকরণ উর্দ্দুর সঙ্গে মেলে। এখন হিন্দী সাহিত্যিকেরা হিন্দী ভাষাকে সপ্তম বা অষ্টম সম্বৎ হইতে আরম্ভ হইয়াছে বলিয়া অনুমান করেন। আবার হয়প্রশাদ শাস্ত্রী মহোদয় নেপাল থেকে “বৌদ্ধ গান ও দোহা” বলিয়া যে তিনখানি পুস্তক আবিষ্কার করিয়া আনিয়াছিলেন, তাহা “অপভ্রংশ” ভাষাতে লিখিত বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে। হিন্দী সাহিত্যিকেরা ইহাকেও হিন্দী ভাষা ও সাহিত্যের অন্তর্গত বলিয়া দাবী করিয়াছেন[১১]। কিন্তু বাংলা ভাষাতত্ত্ববিদেরা বলেন ইহা প্রাচীন বাংলা। এ থেকে এই বুঝা যায় যে বর্ত্তমানের হিন্দী ও বাংলা ভাষা উপরের দিকে গিয়া এমন জায়গায় উপস্থিত হয় যাহাকে উভয় ভাষাই নিজের বলিয়া দাবী করিতে পারে।

এখানে হিন্দী সাহিত্যের Chauvinismএর (আক্রমণশীলতার) কিঞ্চিৎ উল্লেখ করা হইল। এই বিষয়ে লেখক নিজেকে পক্ষপাতশূন্য বলিয়া মনে করেন, কিন্তু এই হিন্দী বা উর্দ্দু বা হিন্দুস্থানী ভাষা বর্ত্তমান সময়ে ঘোর রাজনীতিক আবর্ত্তে ঘুরিতেছে। কংগ্রেস আবার একটি কল্পিত (artificial) হিন্দুস্থানী ভাষা এই খণ্ডে মাতৃভাষারূপে সৃষ্টি করিয়াছেন বলিয়া তাহা আরো ঘোরালো হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু হিন্দী ভাষার একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করিতে গেলে এই সব ব্যাপার উল্লেখ প্রয়োজন বলিয়া এই স্থানে উল্লিখিত হইল।

পাশ্চাত্য সাহিত্যের সমালোচকেরা সাহিত্যকে Romantic, Neo-Romantic, Idealist, Neo-Idealistic, Symbolist, Realist, Neo-Realist, Impressionist প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন[১২]। আবার ভিক্টর হুগো বলিয়া গিয়াছেন (তাঁর ‘ক্রময়েল’ নামক পুস্তক দ্রষ্টব্য) যে প্রত্যেক জাতির সাহিত্য উপর্য্যুপরি তিনটি ধাপ দিয়া অগ্রসর হয়, যথা: Lyric, Epic, Dramatic। এই ছিল এতদিনের সাহিত্যিক সমালোচনার সনাতন পদ্ধতি[১৩]। কিন্তু হালে Harvard বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোরোকিন[১৪] সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমস্ত বিষয়কে Ideational, Idealistic এবং Sensate এই তিনটা সামাজিক পর্য্যায়ে বিভক্ত করিয়াছেন। আর ঐতিহাসিকেরা ইতিহাসকে Heroic Age, Classical Age, Feudal Age, Bourgeoisie Age প্রভৃতি যুগে ভাগ করেন। আর আধুনিকতম সমাজতাত্ত্বিকেরাও এই এক একটি ঐতিহাসিক যুগের সংস্কৃতি ও তার বাহনসাহিত্যকে এই সব যুগে বিভক্ত করেন। সভ্যতার ক্রমোন্নতির প্রত্যেক স্তরের পরিচয় সেই সময়কার সাহিত্যের মধ্যে পাওয়া যায়। একটি অতীত জাতির ইতিহাস যেমন তার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের মধ্যে কিঞ্চিৎ পাওয়া যায়, তেমনি একটী জীবিত জাতির প্রত্যেক যুগের ইতিহাস তার তৎকালীন সাহিত্য মধ্যে প্রতিফলিত হয়। আবার মনুষ্য সমাজ একস্থানে চিরকাল দাঁড়াইয়া থাকে না। সমাজ গতিশীল (dynamic), প্রত্যেক যুগের সভ্যতার গতির দ্বারা মানব সমাজ রূপান্তরিত হইতেছে। কাজেই প্রত্যেক যুগের মানুষের মনস্তত্ব এক প্রকারের নয়। ইহা সত্য যে, রূপ ও রস নিয়াই সাহিত্য কিন্তু রূপরসও আপেক্ষিক বস্তু। যুগে যুগে মানুষের রুচি ও ধারণা বদলায়। কাজেই বিভিন্ন যুগের সাহিত্যের প্রতিপাদ্য বিভিন্ন প্রকারের হইবে। মানব সমাজ যেমন যুগে যুগে বিবর্ত্তিত হইতেছে তাহার সাহিত্যও তেমনি প্রগতিশীল হইতে বাধ্য। কাজেই সাহিত্যে প্রগতির অনুসন্ধান করিতে গেলে তাহা ‘মতলববাজের’ কাজ’ বলিয়া শেষ করা অর্ব্বাচীনের কথা হইবে। এই কথা বলিয়া আমরা হিন্দী সাহিত্যের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দ্বারা প্রগতির অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই। হিন্দী সাহিত্যে আমরা Heroic ও Classical Age-এর সন্ধান পাই না; কারণ তাহা সংস্কৃত সাহিত্যের অন্তর্গত। সত্যই স্বর্গীয় অধ্যাপক ভিণ্টারনেটস্[১৫] বলিয়াছেন যে ভারতীয় সাহিত্যের যুগ বড় লম্বা—এ বৈদিক সমাজ থেকে আরম্ভ করিয়া রবীন্দ্রনাথ পর্য্যন্ত বিস্তৃত। প্রাচীন ভারতীয় জাতির বংশধরেরা আজও ভারতখণ্ড থেকে বিলুপ্ত হয় নাই, যদিচ রাষ্ট্র ও সমাজকে নানা প্রকারের ঘূর্ণিপাকে পতিত হইতে হইয়াছে। এই জন্যেই ভারতবাসীদের প্রাচীন যুগসমূহের নিদর্শন সংস্কৃত ও প্রাকৃত সাহিত্যেই পাওয়া যায়। যখন হিন্দী ভাষা অভিব্যক্ত হইল, তখন ভারতবর্ষ সামন্ত যুগেই (Feudal Age) উপনীত হইয়াছিল। হিন্দী ভাষায় যেসব বীরগাথা আছে, তা সামন্ত যুগেরই পরিচয় প্রদান করে। এর পূর্ব্বের অপভ্রংশ ভাষাতে যেসব লেখা হইয়াছে তাহা ধর্ম্মাত্মক সাহিত্য, কিন্তু তাহাকে হিন্দী সাহিত্য বলা যায় কি না প্রশ্ন উঠিতে পারে। এখন কথা উঠিবে যে, হিন্দী ভাষার জন্মকালকে আমরা সামন্ত যুগে ফেলিব কেন? তাহা হইলে প্রশ্ন উঠিবে যে, ভারতে সামন্ত যুগ কখন আরম্ভ হয়? ডাঃ প্রমথনাথ বন্দ্যোপ্যাধ্যায় বলিয়াছেন যে, রাজপুতেরা সামন্তযুগ ভারতে আনয়ন করিয়াছিল, কিন্তু আমরা জানি না, তাঁহারা কোথা থেকে এটা পাইয়াছিলেন[১৬]। কিন্তু আজকালকার ঐতিহাসিক অনুসন্ধানকারিগণ বলিয়াছেন যে, ভারতবর্ষে সামন্ততন্ত্র অতি প্রাচীনকাল থেকে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হয়। বোধ হয়, মৌর্য্যযুগের পরে ইহা ধীরে ধীরে আরম্ভ হইয়াছিল। গুপ্তযুগকে সামন্ততান্ত্রিক যুগ বলা হয়। হর্ষবর্দ্ধনের পর হইতে উত্তর ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের স্থাপন পর্য্যন্ত সামন্ততন্ত্র জাজ্জ্বল্যমানভাবে বিরাজ করিত। কাজেই দেখা যায় যে, রাজপুতদের উত্থানের আগেই ভারতীয় সমাজের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা অভিব্যক্ত হইয়াছে। এই জন্যেই হিন্দী সাহিত্যের প্রারম্ভকাল আমরা রাজপুত শাসনকালীন সামন্ততান্ত্রিক যুগেই নির্দ্ধারিত করিলাম। এই বিচারের সমর্থন আমরা সূর্য্যকান্ত শাস্ত্রীজীর কাছ থেকে পাই। তিনি বলেন, “হিন্দী ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যের জন্ম রাজপুতানায় হইয়াছে।”[১৭] এই স্থলে কথা উঠে সামন্ততান্ত্রিক যুগের লক্ষণ কি? সর্ব্বপ্রথম লক্ষণ, যে জমির মালিকানা সত্ব রাজা হইতে ধাপে ধাপে নামিয়া প্রজাতে যায় (Sub infeudation of land), ‘স্বামিধর্ম্ম’ (Nobless oblige), স্ত্রীলোকের প্রতি সম্মান ও বীরত্ব (Chivalry), নিষ্কর জমি ভোগ করা (Fief), জমি বা অন্য কোন বিষয়ের উপস্বত্ব ভোগ করা (Benefice), বংশাভিমান ও রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা প্রভৃতি। এর মধ্যে কোন কোন লক্ষণ বৈদিক যুগ হইতে সূচিত হয় বলিয়া অনুমান করা যাইতে পারে। সমাজের এই অবস্থাগুলি যে বহু পূর্ব্বেই সংঘটিত হইয়াছিল, মহাভারতেই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ আছে। এখন বিচার্য্য এই যে, হিন্দী সাহিত্যে সামন্ত যুগের কি নিদর্শন পাই।

শ্রীযুত শুক্ল মহাশয় তাঁহার পুস্তকে ঐতিহাসিক কালানুসারে ‘আদি কাল’ (বীরগাথা কাল), ‘উত্তর মধ্য কাল’ (রীতি কাল) এবং ‘আধুনিক কাল’ (গদ্য কাল)—এইভাবে বিভক্ত করিয়াছেন। আর শ্রীরামকুমার বর্ম্মা ‘হিন্দী সাহিত্যকা আলোচনাত্মক ইতিহাস’ পুস্তকে ‘চারণ কাল’, ‘ভক্তি কাল’, ‘প্রেম কাব্য’, ‘রাম কাব্য’, ‘কৃষ্ণ কাব্য’ নামে হিন্দী সাহিত্যকে বিভক্ত করিয়াছেন। কিন্তু আমাদের সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে এই বিভাগ গ্রহণ করা চলে না। সুতরাং আমরা সর্ব্বপ্রথমে দেখিব যে, হিন্দী সাহিত্যে সামন্ততান্ত্রিক যুগের কি প্রতিবিম্ব পাই। হিন্দী সাহিত্যের প্রথম অবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক যুগের চিত্র বিশিষ্টভাবে পাওয়া যায়। বোধ হয়, ভারতীয় অন্য কোন সাহিত্যে এত সংবাদ পাওয়া যায় না। বাংলা সাহিত্যে এর অত্যন্ত অভাব। মুসলমান-তুর্কী আক্রমণের পর হইতে নানা বীরগাথা (ballad) হিন্দীতে রচিত হয়। চারণেরা রাজাদের বিজয়, শত্রুকন্যা হরণ ইত্যাদি বর্ণনা দ্বারা গাথা রচনা করতেন। ইহার মধ্যে সাহিত্যিক পুস্তকাকারে যেগুলি রচিত হইয়াছিল, তাহাকে ‘রাসো’ বলা হয়। শ্রীযুত শুক্ল ‘বিসলদেব রাসো’কে সর্ব্বপ্রথম বীর গীতি বলিয়া নির্দ্ধারিত করেন[১৮]। শুক্ল ইহার কাল নির্দ্ধারিত করেন ১২১২ সম্বৎ। এই সময়টি রাজপুতদের আধিপত্যের যুগ। এই পুস্তকে বিসলদেবের সহিত রাজমতীর বিবাহের ও কলহের বর্ণনা আছে। পরে উভয়ের মিলন হয়। বিসলদেব একজন বড় যোদ্ধা ছিলেন—কিন্তু ইহাতে সামন্ত যুগীয় রাজারাণীর প্রেম ও বিরহের কথাই আছে। উদাহরণ স্বরূপ:—

“পরণয়া চাল্যোবীসলরায়।
চৌবস্থা সহুলিয়া বোলাই।
অতিরঙ্গ স্বামী সুঁ মিল-রাতি।
বেটী রাজা ভোজকী।”

আর একখানি পুস্তকের নাম ‘খুমান রাসো’। ইহা চিতোরের রাওল খুমানের বিজয়ে লিখিত হয়। ৮১০—৯৯০ সম্বতের মধ্যে চিতোরের তিনজন খুমান রাজা হন। ইহার মধ্যে একজন খুমানের সহিত আরবদের যুদ্ধ হয় বলিয়া প্রবাদ আছে। এইসব লড়াইয়ের কথা ‘রাসো’তে আছে। এইবার আসে বিখ্যাত চন্দবরদাইয়ের ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’। ইহাতে দিল্লীর শেষ হিন্দু নরপতি পৃথ্বীরাজের বীরত্ব, প্রেম প্রভৃতির গাথা আছে। আজকালকার সমালোচকদের অভিমত যে, এই পুস্তক প্রামাণিক নয়। ইহা ইতিহাস-বিরুদ্ধ কল্পিত ঘটনা দ্বারা পরিপূর্ণ। এই পুস্তকে (রাসোতে) বর্ণিত আছে যে, পৃথ্বীরাজের সহিত সাহাবুদ্দীন ঘোরীর একটি ঘটনা দ্বারা যুদ্ধ কলহ সৃষ্টি হয়। সাহাবুদ্দীন চন্দ্ররেখা নামক একটি গক্কর কুমারীর প্রেমে আসক্ত হন। কিন্তু হুসেন নামক একজন পাঠান সর্দ্দার তার প্রণয়ী ছিল। এই ব্যাপার নিয়াই উভয়ের মধ্যে কলহ হয়। এর ফলে, এই পাঠান সর্দ্দার তার প্রণয়িনীকে নিয়া দিল্লীতে পৃথ্বীরাজের শরণাগত হন। ঘোরী পৃথ্বীরাজকে ইহাদের প্রত্যর্পণ করার জন্য লিখিয়া পাঠান। পৃথ্বীরাজ ইহা রাজধর্ম্মবিরুদ্ধ বলিয়া অস্বীকার করেন। এর ফলেই ঘোরীর পুনঃ পুনঃ ভারত আক্রমণ হয়[১৯]

ইহা ছাড়া এই রাসোতে চৌহান বংশের উৎপত্তি, পৃথ্বীরাজের জন্ম, বিষ্ণুর দশ অবতার, দিল্লীস্থিত কেল্লার কথা, বিভিন্ন রাজা ও মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ[২০] পৃথ্বীরাজের বহু বিবাহ, হোরী উৎসবের বর্ণনা, দীপ মালিকোৎসবের বর্ণনা, সংযোজিতার (বাঙ্গলায় এঁকে সংযুক্তা বলা হয়) পূর্ব্ব জন্মের কথা—তাঁর পৃথ্বীরাজকে বিবাহ করিবার পণ, দিল্লী বর্ণনা, কান্যকুব্জে সংযোজিতার জন্য যুদ্ধ, সাহাবুদ্দীনকে পুনঃ পুনঃ পরাজিত করা এবং একবার তাঁকে বন্দী করা; এরপর গজনীতে কবি চন্দের গমন এবং পৃথ্বীরাজের শব্দভেদী বাণ দ্বারা সুলতানকে হত্যা করার কথা, তারপর চান্দ পৃথ্বীরাজকে মারিয়া ফেলার কথা, পৃথ্বীরাজের পুত্র নারায়ণ সিংকে দিল্লীতে রাজ্যাভিষেকের পর তাহার বধ ও দিল্লীর পতন এবং আরো বহু ব্যাপার এই কবিতা পুস্তকে বর্ণিত আছে[২১]

(২)

ইহার পর আসে জয়ানকের “পৃথ্বীরাজ বিজয়।” এই পুস্তকের পাণ্ডুলিপি অতি খণ্ডিতভাবে আবিষ্কৃত হইয়াছে। লেখক একজন কাশ্মীরী পণ্ডিত বলিয়া অনুমিত হয়। এই পুস্তকের প্রথম সর্গে—মহাকবি বাল্মীকি, ব্যাস ও ভাসের[২২] বর্ণনা আছে।

দ্বিতীয় স্বর্গে আছে সূর্যমণ্ডল থেকে চৌহানদের আদি পুরুষের অবতরণ, অর্ণ রাজের মুসলমানদিগকে পরাজয়, পৃথ্বীরাজের জন্ম উৎসব, তাঁহার যৌবন, অনেক রাজকুমারীর তাঁহাকে বিবাহ করিবার ইচ্ছা, পৃথ্বীরাজের বীরদের শৌর্য্য বর্ণন; ঘোরীর দূতের আজমীরে আগমন, গুজরাটের রাজা ভীমদেব কর্ত্তৃক ঘোরীর পরাজয়, হর্ষোৎসাহ, পৃথ্বীরাজের নিজের চিত্রশালায় গমন, জয়ানকের পৃথ্বীরাজের দরবারে আগমন এবং সরস্বতীর নিকট হইতে এই আজ্ঞা প্রাপ্তি যে সে যেন বিষ্ণুর অবতার পৃথ্বীরাজের সেবা করে[২৩]। এই সময়কার আর একখানি পুস্তক হইতেছে ভট্টকেদারের “জয়চন্দ্র প্রকাশ।” ইহাতে কনৌজের জয়চন্দ্রের বীরগাথা বর্ণিত আছে। কিন্তু এই পুস্তকখানি এখনও দুষ্প্রাপ্য হইয়া আছে। “রাঠোরোঁকী খ্যাত” নামক পুস্তকে ইহার উল্লেখ আছে। এই প্রকারের আর একখানি বইয়ের নাম ‘জয়ময়ঙ্ক-জচন্দ্রিকা”। ইহার নামও ওই খ্যাত পুস্তকে উল্লিখিত আছে[২৪]। মধুকর নামে এক কবি এই পুস্তক লেখেন। আর একখানি বিশিষ্ট পুস্তক হইতেছে—“আলহ খণ্ড”। জনশ্রুতি বলে যে ইহা জগনিক দ্বারা (সম্বৎ ১২৬০) লিখিত একটী বীররস প্রধান গীতিকাব্য। এর কোন হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। মহোবার চন্দেল রাজা পরমালের সহিত পৃথ্বীরাজের যুদ্ধের সময় বনাফর বংশীয়[২৫] “আলহা ও উদল” নামে দুই ভাই পরমালকে সাহায্য করিয়াছিলেন। এই দুই ভ্রাতার বীরত্বগাথা উপরোক্ত পুস্তকে বর্ণিত আছে। সমগ্র উত্তর ভারতে আজও লোক মুখে ইহা গীত হয় কিন্তু এই জন্য ভাষাও বিকৃত হইয়া স্থানীয় ভাষার রূপ ধারণ করিয়াছে। লোকে বলে এই গাথা গীত হইবার সময় তাহা শুনিয়া শ্রোতারা এত উত্তেজিত হয় যে প্রায়ই মারামারি হইয়া যায়। লেখক একবার ভাগলপুরে এই গানের কিয়দংশ শুনিয়াছিলেন।

দোসাদ জাতীয় একজন লোক একটা কাংস পাত্র বাজাইয়া অতি উত্তেজনা সহকারে এই রাজপুত বীরদ্বয়ের বীরত্ব কাহিনী গাহিতেছিল এবং শ্রোতারা মুগ্ধ হইয়া তাহা শুনিতেছিল। এই গানের একটী কলি হইতেছে—

“বাতন বাতন বাত বাঢ়গৈ
হোগৈ আদমি রাঢ়।
রাঢ়কো উপর গারি চলগৈ
আগুল চলে তলোয়ার।”

আলহাখণ্ডে কনৌজ ও মহোবার শক্তির পরিচয় আছে। ইহা পুনরুক্তিদোযে পরিপূর্ণ। তত্রাচ এই পুস্তক উত্তর ভারতের সামন্ততান্ত্রিক যুগের একটা প্রকৃত নিদর্শন।

তৎপর আসে চতুর্দ্দশ শতাব্দীর “হাম্বীর রাসো”। ইহাতে রনথমবরের রাজা হামীরের গৌরব গান আছে কিন্তু ইহার একটী ও পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। কেবল ঐতিহাসিকেরা নির্দ্দেশ মাত্র দিয়াছেন[২৬]। তারপর আসে গল্লসিং ভট কর্ত্তৃক রচিত ‘বিজয় পাল রাসো’। ইহার সময় ১৩৫৫ সম্বৎ। এই পুস্তকে করোলীর রাজা বিজয় পালের যুদ্ধসমূহ ওজঃপূর্ণ ভাষায় বর্ণিত আছে। ডিঙ্গল (রাজস্থানী ভাষা) ভাষায় রচিত এই প্রকারের বহু বীরগাথা আছে কিন্তু তাহা এখনও প্রকাশিত হয় নি। চারণদের রচনা কেবল পদ্যতেই হয় নি গদ্যতেও হইয়াছে। তাঁহারা অধিকাংশ বিষয়ই রাজা ও তাঁহাদের বংশাবলীর কথা নিয়া লিখিয়াছেন। ইঁহাদের বর্ণনার বিষয় হইতেছে রাজাদের যশোগান, তাঁহাদের যুদ্ধকৌশল তাঁহাদের ধর্ম্মভীরুতা ও ঐশ্বর্য্যের পরিচয় প্রদান। নায়কের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করিবার জন্য কবি বিপক্ষীয় লোককে (হিন্দু বা মুসলমান) হীন ও নগ্ন চিত্রে অঙ্কিত করিয়াছেন। ইহাতে কবি বেশীর ভাগই কল্পনার আশ্রয় নিয়াছেন আবার এই সাহিত্যে বীররসের প্রাধান্য আছে। অবশ্য শৃঙ্গার রসও কখন কখন দৃষ্ট হয়। যুদ্ধের পর কবির উল্লিখিত বীর আমোদ প্রমোদ অথবা স্বয়ম্বরে বিবাহ করিয়াছেন।

তৎপরে বিরহ বর্ণনাও আছে। অদ্ভুত রস রৌদ্র বা বীভৎস রস ও যুদ্ধ বর্ণনাও পাওয়া যায়। আবার শত্রুর মৃত্যুর পর শত্রু নারীদের হৃদয়ে করুণার ধারা প্রবাহিত হইতেছে—এক কথায় হাস্য ও শান্ত রস ছাড়া প্রায় সব রসের সমাবেশ ইহাতে আছে।

চতুর্দ্দশ শতাব্দীর প্রারম্ভেই এই বীর গাথার রচনা ক্ষীণ হইতে থাকে। তাহার প্রধান কারণ রাজনীতিক পরিস্থিতির পরিবর্ত্তন। উত্তর ভারতে মুসলমান প্রভুত্ব সুদৃঢ় হয় এবং হিন্দু রাজারা দুর্ব্বল হইয়া পড়েন। কাজেই তাঁহাদের গৌরব বর্ণনা করিবার সামগ্রীর অভাব হয়। চারণদের রাজসভায় সম্মান প্রাপ্তির সুযোগই আর ছিল না। কাজেই কে আর বীরগাথা লিখিবে? এই সময়ে মুসলমান সার্ব্বভৌমিকত্ব বিস্তার হয়, হিন্দু সামন্ততন্ত্র পদ্ধতি ওলট পালট হইয়া যায়। মোগল যুগের আগে পর্য্যন্ত তাহার ছায়া অবশিষ্ট ছিল বটে কিন্তু মোগল শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে একটা কেন্দ্রীভূত শাসন নীতি উত্তর ভারতে প্রবর্ত্তিত হয়; গাঙ্গেয় উপত্যকায় পুরাতন পদ্ধতি সম্পূর্ণ বিপর্য্যস্ত হয়। মোগল শাসন সামন্ততান্ত্রিক বাংলাকে বিধ্বস্ত করিয়া ‘ভেতো বাঙ্গালীর’ দেশে পরিণত করে। উত্তর ভারতে লোক বিষহীন সর্পে পরিণত হয়। কেবল রাজস্থানেই সামন্ততন্ত্রের শেষ ছায়া বিরাজ করে। আর তথাকার বীর যুগের শেষ দীপ নির্ব্বাণ মেবারের রাজসিংহে ও অজিত সিংহে পরিসমাপ্তি হয়। ইহা সত্য যে ভারতীয় সমাজ আজ ও সামন্ততান্ত্রিক যুগের ছায়াতে দণ্ডায়মান আছে কিন্তু বর্ত্তমানকালে কল-কব্জার যুগ (Industrial Age) ভারতে প্রবর্ত্তিত হইয়াছে এবং তাহা সমাজকে পরিবর্ত্তিত করিতেছে।

আর রাজনীতি ক্ষেত্রে এই যুগ আকবরের সময়েই বিলুপ্ত হইয়াছে। বাংলায় চারণ ও ভাটদের বীরগাথাসমূহ প্রায় বিলুপ্তই হইয়াছে। পালরাজাদের গীতসমূহ আর বাংলায় গীত হয় না। উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জে ও উত্তর বাংলার রংপুরে তাহা কদাচিৎ শ্রুতিগোচর হয়[২৭]

আর ধর্ম্মমঙ্গল কাব্যে লাউসেনের বীরত্ব গাথার মধ্যে যদি কোন ঐতিহাসিক সত্য থাকে তাহাও হয়তো প্রাচীন শ্রুতি অবলম্বনে অষ্টাদশ শতাব্দীতে লিখিত হইয়াছে। আর বাঁকুড়া জেলাস্থিত বন বিষ্ণুপুরের রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের সহিত “চেতোবর্দ্দার” (মেদিনীপুরের বর্ত্তমান গড়বেতা নামক স্থান) জমিদার শোভাসিংহের যুদ্ধ গাথা যাহা স্থানীয় লোকমুখে “চেতোবর্দ্দার লড়াই” বলিয়া কথিত হয় এবং নোয়াখালীর “চৌধুরীর লড়াই”, ময়মনসিংহের ইশা খাঁ মসনদ আলীর বংশের লড়াইয়ের গীত প্রভৃতি, অন্নদামঙ্গলে প্রতাপাদিত্যের বীরত্ব গাথা ইত্যাদি মোগল যুগেই রচিত হইয়াছিল।

এক্ষণে আমাদের অনুসন্ধানের বস্তু এই যে এইসব ‘রাসো' গুলিকে আমরা কোন যুগের সাহিত্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিব। এই বীরগাথাগুলি সামন্ততান্ত্রিক যুগীয় সমাজের চিত্র প্রদর্শন করে। ইহাতে বীরত্ব (chivalry), স্ত্রীলোকদের প্রতি সম্মান ও প্রেম প্রদর্শন (Gallantry), আর অধস্তন পুরুষের উর্দ্ধতন পুরুষের প্রতি স্বামিধর্ম্ম (Nobless Oblige) প্রদর্শন, ক্ষত্র বৃত্তির বড়াই, নিমক হালালী (Faithfulness) প্রভৃতি বিশিষ্ট ভাব প্রদর্শিত হইয়াছে। পৃথিবীর যে সব স্থানে সামন্ততন্ত্র প্রবর্ত্তিত হইয়াছে সেই সব স্থানেই বীরগাথা সৃষ্ট হইয়াছিল। ইউরোপে সামন্ততন্ত্র যুগে স্পেন, ইতালী ও ফ্রান্স দেশে একপ্রকার বহু বীরগাথা প্রচলিত ছিল। ফ্রান্সের দক্ষিণের Troubadour-দের ও উত্তরের Trouveres Chansons ফরাসী সাহিত্যের অমূল্য রত্ন। চারণদের মধ্যে Roland-এর গাথাসমূহ আজও বিখ্যাত হইয়া আছে। সামন্ততান্ত্রিক যুগের রাজনীতিক আদর্শ তিনি এক কথায় পরিষ্কার করিয়া বলিয়াছেন—“It is the duty of the liegeman to fight for his liegelord (ভূস্বামীর হইয়া যুদ্ধ করাই প্রজার ধর্ম্ম)।” ইউরোপের Feudal যুগের আদর্শ যাকে এক কথায় Nobless Oblige-বলা হয় তাহা এই পংক্তিতে পরিস্ফুট হইয়াছে। আর ভারতে, মহাভারত তৎপরে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় আর শেষে হলদীঘাটের রণক্ষেত্রে যথায় “ঝালা স্বামিধর্ম্ম ভোলে না”—আর বাঙ্গলার শ্রীহট্টে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সেনাপতি রাধার রণক্ষেত্রে প্রভুর মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া “যথা কৃষ্ণ তথা রাধা” বলিয়া অশ্বসনে নদীতে আত্মবিসর্জ্জনের ব্যাপারসমূহ দ্বারা হিন্দু জাতির চরিত্রে Nobless Oblige-এর ভাব পরিস্ফুট হইয়াছে। হিন্দী ভাষার এই সব রাসোতে আমরা সামন্ততন্ত্র-যুগীয় পরিচয় পাই। অবশ্য হিন্দু জাতির বর্ণভেদ অনুযায়ী একটী শ্রেণীর মধ্যে এই লক্ষণটি বিকশিত হয়। আল্‌হাখণ্ডে এই নিম্নলিখিত বচনে তাহার নির্দ্দেশ পাওয়া যায়:—

“বারহ বরিসলৈ কুকর জিয়েঁ, ঔ তেরহলৈ জিয়েঁ সিয়ার।
বরিশ আঠারহ ছত্রী জিয়েঁ, আগে জীবনকে ধিক্কার।”

ইহাতে কেবল ছত্রী যুবকেরই কর্ত্তব্য নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। বর্ত্তমানকালে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এতদ্দ্বারাই রাজপুতদের পতন হয়। যদি কেহ বলেন যে, এবম্প্রকারে প্রাচীনকালে কেবল ক্ষত্রিয়েরাই লড়াই করিত তাহার উত্তর এই যে, তাহা সত্য নহে[২৮]। কৌটিল্য ও মনুতে ইহার কোন পোষকতা পাওয়া যায় না। ইহা ব্রাহ্মণ্যবাদের কল্পনা মাত্র। প্রাচীনকালে ক্ষত্রিয় অর্থে কতিপয় কুল বা Clan ছিল মাত্র[২৯]। Keith এবং Macdonnell একথা স্বীকার করিয়াছেন যে, প্রাচীনকালে সর্ব্বশ্রেণীর লোকই সৈন্য-শ্রেণীভুক্ত হইত[৩০]। অন্যপক্ষে ইউরোপে Knight-রা বিশিষ্ট পদ পাইয়া একটী শ্রেণীভুক্ত হইত বটে কিন্তু পুরোহিত ছাড়া সর্ব্বশ্রেণীর লোকেরাই সৈন্য হইত। হয়তো রাজপুতদের যুগে যুদ্ধবৃত্তি একটী বিশিষ্ট জাতির মধ্যে আবদ্ধ ছিল বলিয়া এবং এই জাতির লোকেরা শাসকরূপে বিবর্ত্তিত হওয়ায় সেই সব বংশের গুণকীর্ত্তনের জন্য এত বীরগাথা সৃষ্ট হইয়াছে। আর বাঙ্গলায় কোন বিশিষ্ট যোদ্ধৃশ্রেণী উদ্ভূত হয় নি এবং রাজা ও জমিদার বংশগুলিও সামান্য দিনের জন্য স্থায়ী হইত। হয়তো এই জন্যই বীরগাথা সাহিত্যে বিশেষভাবে বিকশিত হয়নি যদিচ ভাট বলিয়া একটা জাতি বর্ত্তমান আছে। পূর্ব্বে ইহাদের কর্ম্ম ছিল ধনী বংশের গুণকীর্ত্তন করা এবং তাহাদের কুলজি গ্রন্থ রচনা করা। বাঙ্গলায় যে সব জাতীয় লোকেরা সৈনিকের কর্ম্ম করিত তাহারা আজ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের প্রকোপে অস্পৃশ্য ও হেয়। বাঙ্গলা কবিতায় ইঁহাদের সম্বন্ধেই বলা হইয়াছে:—

“নয় কাহন বাগ্‌দী উঠে যুদ্ধে তারা যম।
সাত কাহন হাড়ি পাইক, বার কাহন ডোম!”[৩১]

অথচ আশ্চর্য্যের কথা এই যে, ধর্ম্মমঙ্গলে এবম্প্রকারের ডোম জাতির এক বীরের মুখ দিয়াই শৌর্য্যের কথা বাহির করা হইয়াছে—

“শাকার সুবর্ণ ছড়া বাপের ও ঢাল খাড়া
দিয়ে সমাচার বোলো।”
রণে অকাতর হয়ে শত্রুশির সংহারিয়ে
সম্মুখ সমরে শাকা মলো।”

আবার জনশ্রুতি এই শ্লোকের প্রতিপোষকরূপে বলে—

“আগু ডোম বাগ ডোম ঘোড়া ডোম সাজে।
ঢাল গাগর মৃগল বাজে” ...ইত্যাদি।

 যাহা হউক হিন্দী সাহিত্যে বীর গাথাগুলি জগতের সামন্ততান্ত্রিক বীরত্বসূচক সাহিত্য মধ্যে শেষ শ্রেণীর স্থান অধিকার করে। রোঁলার পাশেই চাঁন্দ বরদাইয়ের স্থান। আবার উভয়ের স্বামিভক্তির নিদর্শন প্রায় এক প্রকারেরই। Roland-র প্রভু Normandy-র Duke এবং England-এর রাজা Richard the Lion-hearted যখন Crusade যুদ্ধের পর ইংলণ্ডে প্রত্যাবর্ত্তন করেন, তখন পথিমধ্যে Austria-র Duke তাঁহাকে কয়েদ করিয়া অজ্ঞাত স্থানে রাখেন। রোঁলা দেশ বিদেশ ভ্রমণ করিয়া গানের দ্বারা অবশেষে তাঁহাকে ভিয়েনার জেলে আবিষ্কার করেন এবং তাঁর মুক্তির জন্য চেষ্টা করিয়া সফলকাম হন। আর রাসোতে বর্ণিত আছে যে, চাঁন্দ যখন শুনিলেন যে, পৃথ্বিরাজকে ঘোরী আফগানিস্থানে নিয়া গিয়া কষ্ট দিতেছেন তখন তিনি তথায় গিয়া সমস্ত কষ্টের অবসানের উপায় নির্দ্ধারণ করেন। অবশ্য এই ঘটনাও ঐতিহাসিক ঘটনা নহে। [৩২]

হিন্দী সাহিত্যের এই বীর গাথাগুলিকে আমরা প্রগতিশীল বলিতে পারি না। ইহাতে কেবল কতকগুলি রাজবংশের বীরত্ব, বৈর (blood feud) এবং বন্ধুত্ব (blood bond) প্রভৃতির নিদর্শন প্রদর্শন করে। জনসাধারণ ও গণসমূহের কোন সংবাদই ইহাতে পাওয়া যায় না। সমগ্র সমাজ কি ভাবে অবস্থিত, তাহারও কোন সংবাদ ইহাতে নাই। এই বীর গাথাগুলিতে পৃথ্বিরাজ ও জয়চন্দ্রের ঐশ্বর্য্য ও বীরত্বের কথাই আছে, কিন্তু ইহাদের পরাজয়ের পর মুসলমানেরা যে হিন্দু জাতিকে বিপর্য্যস্ত করিয়াছিল এবং ভারতের ইতিহাস চিরকালের জন্য পরিবর্ত্তিত হয় ও সমাজের তজ্জন্য কি অবস্থা হয় এইসব বিষয়ের কোন সংবাদ তাহাতে পাই না। ইহার পরিবর্ত্তে আমরা চাঁন্দে পাই পৃথ্বিরাজের ও শাহাবুদ্দীনের বৈরতার শেষ অঙ্কের চিত্র—

“সাত বাঁশ চব্বিশ গজ
উঙ্গলি অষ্ট প্রমাণ,
ইত্তেপর সুলতান হ্যায়
চুকো মাৎ চৌহান!”

অর্থাৎ শব্দভেদী বাণ দ্বারা পৃথ্বিরাজ শাহাবুদ্দীনকে মারিয়া নিজের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করিলেন।

এইজন্যই এই মধ্যযুগের সাহিত্যকে আমরা সামন্ততন্ত্র যুগের সাহিত্য বলিয়া গণ্য করিতে বাধ্য। ইহাতে প্রগতির কোন নিদর্শন পাই না অর্থাৎ ভারতীয় সমাজকে উন্নতির অবস্থায় নিয়া যাইবার সঙ্কেত ইহাতে নাই। হর্ষবর্দ্ধনের মৃত্যুর পর, বাঙ্গলার পালদের, মহারাষ্ট্রের রাষ্ট্রকূটদের এবং পশ্চিম ভারতের গুর্জ্জরপ্রতিহারদের পারস্পরিক যুদ্ধের ফলে উত্তর ভারতে একটী সাম্রাজ্য বা এক রাষ্ট্র গঠিত হওয়া অসম্ভব হইয়াছিল।

তৎপর আসে রাজপুতদের উত্থানের যুগ। তাহাদের কুলসমূহ চিরকালই খেয়ো-খেরি করিয়া মরিযাছে। এখনও হিন্দীতে বলা হয় “বার রাজপুতের তের হাঁড়ি।” আর এইসব বীরগাথা হইল তাহাদের পারস্পরিক খেয়োখেয়ির বড়াই, ইহাতে সমগ্র দেশের সংবাদ বা মঙ্গলজনক কোন নির্দ্দেশ নাই। একদল লোক আছেন, যাঁহারা বলেন রাজপুতেরা বিদেশাগত। কিন্তু লেখক মনে করেন তাহা ঠিক নয়। অবশ্য প্রমাণিত হ‍ইয়াছে যে, শক-হুন প্রভৃতি জাতিরা হিন্দু হইয়াছিল এবং হুন ও রাজপুতদের সঙ্গে বিবাহ চলিত। কিন্তু একথা ঠিক নহে যে, বিদেশাগত লোকেরাই এই সামন্ততান্ত্রিক মনোবৃত্তি ভারতে আনয়ন করিয়াছিল। বরং বলা যাইতে পারে যে ইহাদের কুলধর্ম্ম ও তৎ-প্রসূত বৈরতা প্রভৃতি প্রাচীন বৈদিক যুগের ও মহাভারতোক্ত সামাজিক অবস্থার চিত্রই প্রতিবিম্বিত করে। ইহা ঠিক কথা যে, এ বিষয়ে ভারতের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইয়াছিল; ভারত পুনরায় কৌমগত যুগের (Tribal Age) মনোবৃত্তিতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছিল। এ স্থলে তাহার নির্দ্দেশ করিবার অবসর নাই। সরোকিনের বিভাগ অনুযায়ী ইহাকে Ideational যুগের সাহিত্য বলা যাইতে পারে। আমরা ইহাকে সামন্ততান্ত্রিক যুগীয় প্রগতি-বিহীন সাহিত্য বলিয়া নির্দ্ধারিত করিব।

হিন্দী সাহিত্যিকেরা চারণ কালের পর “ফুটকল” বা বিবিধি সাহিত্যের যুগ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে ভারতে এক নূতন পরিস্থিতি সংঘটিত হয়। ভারতের সর্ব্বত্র ধর্ম্মের প্রেরণা আসে। নানা প্রকারের ধর্ম্ম সংস্কারক উত্থিত হইয়া যোগধর্ম্ম তৎপরে ভক্তিধর্ম্মের প্রচার করেন। এই সময় হইতে নব-বৈষ্ণব ধর্ম্মের উদয় হইতে আরম্ভ হয়। তদ্বারা কেহ বা নিরাকারবাদ, কেহ রাম বা কৃষ্ণের উপাসনা প্রচার করেন। এই প্রেমধর্ম্মে জাতিবাদের বিপক্ষতা, অহিংসাবাদ, হিন্দু ধর্ম্মের সার্ব্বজনীনতা, ব্রাহ্মণ্য পুরোহিতবাদের বিপক্ষতা, হিন্দু-মুসলমানের মৈত্রী স্থাপন প্রভৃতি মত প্রচার হইতে থাকে। এইসব প্রচেষ্টা দ্বারা হিন্দু সমাজে এক নূতন জাগরণ সমুপস্থিত হয়। এই প্রকারের প্রচেষ্টার ফলে ভারতের সর্ব্বভাষার একটী বিশাল ভক্তি সাহিত্যের উদয় হয়। হিন্দী সাহিত্যিকেরা বলেন, মুসলমান রাজত্বের প্রতিষ্ঠার ফলে হিন্দুর পৌরুষত্বের অন্তর্ধ্যানের পর হতাশ জাতির পক্ষে ভগবত শক্তি ও তাহার ধ্যান ছাড়া আর কোন উপায়ই ছিল না। এইজন্য কবি ভক্তিতত্ত্ব দিয়া এক নূতন রাস্তা সৃষ্টি করেন। পরে এই ভক্তিতত্ত্ব এত বাড়িয়া উঠে যে, উদার মুসলমানেরাও ইহাতে আকৃষ্ট হন।[৩৩] ইহার পরিণতি এই যে হিন্দু অস্ত্রের পরিবর্ত্তে জপমালার আশ্রয় লয়, আর নিজের লৌকিক জীবনে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা খুঁজিতে থাকে এবং নিজের সংসারিক কষ্ট থেকে মুক্তি পাইবার জন্যে ঈশ্বরের শরণ লয়, এবং নিজের শক্তির অভাবে দুষ্টের দমনের জন্য ঐশ্বরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়। এই প্রকারে বীররস শান্ত এবং শৃঙ্গার রসে পরিণত হয়।[৩৪]

এই নূতন পরিস্থিতির কোন ঐতিহাসিক অর্থনীতিক ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত না হইয়া এই স্থানে ইহা উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট যে ইতিহাস পাঠে অবগত হওয়া যায় যে যখন কোন জাতি পরাজিত হইয়া দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় তখন তাহারা ধর্ম্মের নাম করিয়া নিজেদের বাঁচাইবার চেষ্টা করে। কি রাজনীতিক ও অর্থনীতিক কারণে সে জাতির পতন হইল তাহার কারণ অনুসন্ধান না করিয়া ধর্ম্মের অভাবেই পতন হইয়াছে—এই বলিয়া ধর্ম্মের ধূয়া তুলিয়া বনিয়াদী স্বার্থের লোকেরা আসল ব্যাপারকে ঢাকিবার চেষ্টা করে। অনেক সরল লোকেরা ইহা বিশ্বাসও করেন। আবার অনেকে সংস্কাররূপে পুরাতন সমাজকে নূতন অবস্থার সহিত মিলাইবার চেষ্টা করেন। অধ্যাপক মাহাফি বলেন গ্রীস যখন ম্যাসিডোনিয়ানদের দ্বারা বিজিত হয় এবং পরে পুনরায় রোমের অধীনে আসে, তখন তাহাদের নিজের একটী বিশিষ্ট ধর্ম্মমত না থাকাতে শিক্ষিতেরা নাস্তিক হয় এবং পরে ক্রীশ্চান হইয়া যায়। অন্য পক্ষে, হিন্দুরা ধর্ম্মাশ্রয় করিয়া নিজেদের আত্মরক্ষা করে।[৩৫] পারস্য দেশেও তদ্রূপ। পারসীকেরা আরবদের দ্বারা বিজিত হইবার পর বাধ্য হইয়া আরবদের ধর্ম্মগ্রহণ করে বটে, কিন্তু ইসলামের নানা প্রকারের নূতন ব্যাখ্যা দিয়া নিজেদের মধ্য থেকে আরব প্রাধান্য দূরীভূত করিবার চেষ্টা করে। তাহারা, সূফীমতবাদ, জিন্দিকি’ ধর্ম্ম, সিয়া মত এবং বর্ত্তমান কালের ‘বাবি’ মতবাদ, ‘বাহাই’ মতবাদ বিবর্ত্তিত করিয়াছে এবং এবম্প্রকারের প্রচেষ্টা আজও চলিতেছে। এই জন্যেই অধ্যাপক পার্সিব্রাউন পারস্যকে The Land of Heresy (প্রচলিত ধর্ম্মমতের বিরুদ্ধভাবপূর্ণ দেশ) বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন। সমাজে এই প্রকারের পরিস্থিতি আশ্চর্য্যজনক নয়।[৩৬]

বর্ম্মামহোদয় এই বিবিধ সাহিত্যের যুগে গোরক্ষনাথ প্রভৃতির হঠযোগ সম্বন্ধীয় সাহিত্যকে গণনা করিয়াছেন, কিন্তু বাঙ্গলার ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, গোরক্ষনাথ অ-বাঙ্গালী হইলেও “নাথ-পন্থ” বাংলাতেই উদ্ভূত হয়। মৎসেন্দ্রনাথ বাঙ্গলার বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া কেহ কেহ বলেন। আর গোরক্ষনাথের গুরু মীননাথ বাঙ্গলার লোক ছিলেন।[৩৭] তির্ব্বতের লামা তারানাথ প্রভৃতির পুস্তকে মীননাথকে কামরূপের ধীবর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে; এবং মৎসেন্দ্রনাথকে তাঁহার পুত্র বলা হইয়াছে।[৩৮] তারানাথ বলিয়াছেন গোরক্ষনাথের গুরু ছিলেন মৎসেন্দ্রনাথ। এই ধর্ম্মের এক গুরু হাড়ীপ্পা পূর্ব্ববঙ্গের চন্দ্র বংশীয় রাজা গোপীচন্দ্রের মাতার গুরু ছিলেন, যথা: বিধবা রাণী পুত্রকে বলিতেছেন—

“হাড়ী নয় হাড়ী নয়, জাতি মহোত্তর।
যার বাহির দুয়ারে খাটে ষোলশত নফর।

লামা তারানাথের মতে সিদ্ধ জলন্ধরী হাড়ীর বেশে চাটিগ্রাম (চট্টগ্রাম) আসিয়াছিলেন। রাজা গোপীচন্দ্রের মাতা পুত্রকে তাঁহার কাছ হইতে সিদ্ধিলাভ করিতে উপদেশ দিয়াছিলেন।[৩৯] বাঙ্গলা ভাষায় “গোরক্ষ বিজয়” নামক এক পুস্তক আবিষ্কৃত হইয়াছে।[৪০] বাঙ্গলার ঐতিহাসিকেরা মীননাথ প্রভৃতির কাল অন্ততঃ খৃঃ দশম শতাব্দী বলিয়া নির্দ্ধারিত করেন। গোরক্ষ নাথের কাল একাদশ শতাব্দী। গোরক্ষনাথ ও তাঁহার শিষ্যদের দ্বারা যে সব ধর্ম্মাত্মক পুস্তক হিন্দীতে লেখা আছে সেগুলিও Ideational বিভাগের অন্তর্গত। ইহাকে আমরা প্রাচীন অতীন্দ্রিয়বাদের সাহিত্যের মধ্যে গণ্য করিব। ভারতে অতি প্রচীনকাল হইতে যোগশাস্ত্র ও তদনুযায়ী শিক্ষা চলিয়া আসিয়াছে। নবাবিষ্কৃত তথাকথিত প্রাক্‌-বৈদিক যুগের মহেন-জো-দাড়োর ধ্বংশাবশেষ মধ্যে যোগাসনে আসীন ও যোগনেত্র যুক্ত মূর্ত্তিসমূহ পাওয়া গিয়াছে। এই জন্যে অনেকে অনুমান করেন যে, যোগচর্চ্চা এদেশে অতি প্রাচীনকাল হইতেই চলিতেছে। ফলতঃ এই সাহিত্যকে আমরা প্রগতিশীল বলিতে পারি না। ইহা প্রাচীন যুগের ধারা মধ্যযুগে পুনঃ প্রচলিত করিয়াছে।

তৎপরে আসেন “আমীরখস্রৌ”। ইনি ফার্সীতে অনেক পুস্তক লিখিয়াছেন এবং “খড়িবোলী” হিন্দীতেও পদ্য লিখিয়াছেন। আবার, আরবী, ফার্সী ও খড়িবোলী (দিল্লীর আশপাসের হিন্দী উপভাষা) মিশ্রিত ভাষায়ও পদ্য লিথিয়াছেন। এই জন্য ইহাকে উর্দ্দু সাহিত্যের জন্মদাতাও বলা যাইতে পারে। কিন্তু তিনি হিন্দীতে কী লিখিয়াছেন তাহাই আমাদের অনুসন্ধানের বস্তু। বর্ম্মাজী বলেন[৪১] খস্রৌ জনসাধারণের খড়িবোলী ভাষাকে রূপ দিয়াছেন এবং এই ভাষাকেই প্রথমে কবিতায় স্থান দিয়াছেন। এই জন্য ইহাকে বর্ত্তমানের খড়িবোলীমূলক হিন্দী ভাষার আদি কবি বলা যাইতে পারে। ইনি হিন্দী সাহিত্যের বড় উপকার করিয়াছেন। খস্রৌর সাহিত্য মনোরঞ্জক ও চিত্তবিনোদনোদ্দেশে লিখিত হইয়াছে। মিশ্রিত ভাষায় লিখিত ইঁহার পদ্যের একটী উদাহরণ নিম্নে প্রদত্ত হইতেছে—

“জ হাল মিশৃকীন মকুন ত গাফুল দুয়ারে নৈনা বনায়ে বাতিয়াঁ,

* * * *
সখি, পিয়া কোজো ন দেখুঁতো কৈসে কাটুঁ অধেঁরে রাতিয়াঁ।”

ইহার হেয়ালীর একটী ছড়া:—

শ্যামবরণ কীহৈ একনারী, মাথে উপর লাগে পেয়ারী
যে মানুষ ইস্ অরথ কী খোলে, কুত্তাকিও বোলী বোলে। ”

ইহার অর্থ ভোঁ—(বাঙ্গলায় ভ্রু)

খোস্‌রৌর হিন্দী রচনা মধ্যযুগে লিখিত হইলেও এ অতীন্দ্রিয় ব্যাপার কিম্বা রাজারাজড়ার যুদ্ধে পর্য্যবসিত হয় নি। হিন্দীতে তাঁহার যে রচনা পাওয়া গিয়াছে তন্মধ্যে গভীর তত্ত্ব নিরূপণ নাই বা জীবনের উদ্দেশ্য নিয়াও কোন লেখা হয় নি। ইনি কেবল লোকের চিত্ত বিনোদনের জন্যই লিখিয়াছেন এবং হাস্যরসের সৃষ্টি করিয়াছেন। এই জন্য ইঁহার লেখার মধ্যে বস্তুতান্ত্রিকতার ছায়া আসিয়া পড়িয়াছে। এই কারণে তাঁহার রচনাকে সোরোকিনের sensate স্তরে গণ্য করা যাইতে পারে। আর ইনি জনসাধারণের ব্যাপার নিয়া লিখিয়াছেন। এঁর হিন্দী পদ্য পূর্ব্বের সাহিত্যের চেয়ে কিঞ্চিৎ প্রগতিশীল বলিতে পারি। ইহার পর শুক্ল বিদ্যাপতিকে উল্লেখ করিয়াছেন। বিদ্যাপতির বিষয়ে কিছু বলা বাংলায় নিষ্প্রয়োজন। বিদ্যাপতিকে হিন্দী সাহিত্যিকেরা তাঁহাদের মধ্যে গণ্য করেন। তাঁহাকে Idealistic স্তরে গণ্য করা যাইতে পারে। আমরা বিদ্যাপতিকে প্রগতিশীল সাহিত্য মধ্যে গণ্য করিতে পারি না। ইহা সামন্ততন্ত্রযুগীয় সাহিত্যের অন্তর্গত। বর্ম্মা, খস্‌রৌর পর মুল্লা দাউদের নাম হিন্দী সাহিত্যে আসিতে পারে বলেন।

ইনি “নূরক ঔর চান্দা কি প্রেম কথা” নামক এক পুস্তক লিথিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা আর পাওয়া যায় না। মুল্লা দাউদ আলাউদ্দিন খিলজির সমকালীন ছিলেন। এই প্রেম সাহিত্যে পরম্পরায় কুতূবন, মন্‌ঝন, মুহম্মদ জায়সী প্রভৃতি কবি প্রেম কথা লেখেন। এখন বোঝা যায় না ইঁহাদের লেখাতে আধ্যাত্মিক ও সুফি মতের প্রতিপাদ্য বস্তু ছিল কিনা। যাহা হউক, এইসব রচনা প্রগতিশীল নহে।

এর পর শুক্ল সাহিত্যে ভক্তিকাল নির্দ্ধারণ করিয়াছেন। এই ভক্তিকালের মধ্যে আবার জ্ঞানাশ্রয়ী শাখার মধ্যে তিনি কবীর, ধর্ম্মদাস, দাদুদয়াল, সুন্দরদাস, মুলুকদাসকে উল্লেখ করিয়াছেন। ঐতিহাসিকেরা বলেন রসের ভক্তিস্রোত দক্ষিণাপথ হইতে রামানন্দ উত্তরে লইয়া আসেন। এই ভক্তিস্রোত দ্বারা সগুণ ঈশ্বরবাদ প্রচলিত হয়। এই স্রোতের মধ্যে হিন্দু মুসলমানের মিলন হয়। ইঁহাদের একটী উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সমাজকে সংস্কার করিয়া উদার করা ও মুসলমানের সঙ্গে মিলন ঘটানো। এই সময় “রাম রহিম না জুদা করো ভাই” ভাব প্রচলিত হয়। এইজন্যই নামদেব বলিয়াছিলেন,—

“হিন্দু অন্ধা তুর্কৌ কানা
দুহোঁ তে জ্ঞানী সয়ানা॥
হিন্দু পূজৈ দেহরা,
মুসলমান মসিদ
নামা সোই সেবিয়া জহ দেহরা ন মসিদ॥”

এইস্থলে উল্লেখযোগ্য যে, এইসব নূতন ধর্ম্ম প্রচারকদের মধ্যে অনেকেই মুসলমান বা নীচ হিন্দু বংশীয় ছিলেন। বাংলার ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুরের ন্যায় কবীরের জাতি নিয়া বিবাদ আছে। বর্ম্মা বলেন, এ বিষয়ে যে-সব প্রমাণ আছে, তাহাতে তিনি মুসলমান ছিলেন বলিয়াই প্রমাণিত হয়। আর শ্রেষ্ঠ প্রমাণ হইতেছে গুরু নানকের “গুরু গ্রন্থ সাহেব” নামক ধর্ম্ম পুস্তক যাহাতে রবিদাসের একটী পদ উদ্ধৃত আছে। এই পদে তিনি নামদেব, কবীর ও নিজের পরিচয় দিয়াছেন। ইহাতে নামদেবকে “ছিপা” বা দর্জ্জি জাতীয় বলা হইয়াছে; কবীরকে মুসলমান বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে যাহার বংশে ঈদ বখরীদের দিনে গরু বধ করা হইত। আর রবিদাস চামার জাতীয় ছিলেন।[৪২]

কবীরের জাতি সম্বন্ধে আর একটী প্রমাণ হইতেছে তাঁহার শব নিয়া রেওয়াঁর রাজা বীরসিংহ দেব এবং বিজলী খাঁ এই উভয় শিষ্যের মধ্যে কলহ। চৈতন্যচরিতামৃতে এক বিজলী খাঁর উল্লেখ আছে। ইনি নাকি চৈতন্যের শিষ্য হইয়াছিলেন। উভয় বিজলী খাঁই ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলিয়া অনুমিত হয়। এই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের অনুসন্ধান প্রয়োজন।

কবীর কতকগুলি শ্লোকে নিজের পরিচয় দিতেছেন: যথা—

“জাতি জুলাহা নাম কবীরা
বনি বনি ফিরৌঁ উদাসী।” [৪৩]

কবীরের নির্গুণ বা নিরাকারবাদ পোষক রচনাবলী হিন্দু সাহিত্যের একটা বিশেষ অঙ্গ। কবীরের পরে আসেন ধরমদাস, শ্রীগুরু নানক, শেখ ফরিদ, রজ্জব, মুলুকদাস, দাদুদয়াল, সুন্দরদাস, রামচরণ, বীরভান, ইয়ারী সাহব, দরিয়া সাহব, বুল্লা সাহব, দুলাল সাহব, গরীব দাস, তুলসী সাহব প্রভৃতি অনেক সাধু এই মধ্য যুগে উদয় হন। এর মধ্যে কবীর যেমন মুসলমান ছিলেন, শিষ্য পরম্পরার দাদুকেও কেহ ব্রাহ্মণ, কেহ বা ধুনিয়া জাতিগত বলেন[৪৪]। দাদুর সহিত আকবরের ধর্ম্মালোচনা হইত[৪৫]। বীরভান দাদুর সমকালীন ছিলেন। ইনি ১৬০০ সম্বতে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি রবিদাসের শিষ্য ছিলেন ও “সৎনামী” সম্প্রদায় স্থাপন করেন। এই সম্প্রদায়ে জাতির বন্ধন ছিল না। সকলেই সমানরূপে খাইতেন, মূর্ত্তিপূজা করিতেন না ও পরস্পর বিবাহ করিতেন। ইঁহারা ঈশ্বর অপেক্ষা গুরুর মত বড় মনে করিতেন। এই সম্প্রদায়ের লোক বেশীর ভাগই কৃষক এবং অতি গরীব শ্রেণীর। এই সম্প্রদায় আওরঙ্গজেবের সময়ে ১৬৭২ খৃঃ তাঁহার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিল। ঐতিহাসিক কাফি খাঁ বলেন যে, ইহারা ভক্তের বেশভূষা পরিত আর কৃষি এবং ব্যবসায় করিত। সাত্ত্বিকভাবে ধন প্রাপ্তির লক্ষ্য ছিল ইহাদের। যদি কেহ অন্যায় বা অত্যাচার করিত, ইহারা তাহা সহ্য করিত না। অনেকেই অস্ত্রধারণ করিত। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভেদ করিত না[৪৬] এই সম্প্রদায়ের বিবরণ পড়িয়া মনে হয় যে, ইহারা গণশ্রেণীর (masses) লোক ছিলেন এবং ইহাদের বিদ্রোহকে কৃষকের বা গণের বিদ্রোহ বলা যাইতে পারে[৪৭]। রজ্জবঙ্গী (১৭২০ সম্বৎ) দাদু পন্থী এবং ইনি মুসলমান ছিলেন। ইনি নিজের পরিচয়ে বলিয়াছেন,—

“জো ধুনিয়াঁ তো ভী মৈঁ রাম তোমহারা।

* * *
অধম কমীন জাতি মতিহীনা...”[৪৮]

বুল্লা সাহেব (১৭৫০ সম্বৎ) যাঁর আসল নাম “বুলাকি রাম”, জাতিতে কুনবী ছিলেন। গরীবদাস (সম্বৎ ১৭৭৪) জাতিতে জাঠ ছিলেন। রামচরণ (১৭৭৫ সম্বৎ) “রামসনেহী” নত স্থাপন করেন। এই মতের সঙ্গে মুসলমান মতের অনেক ঐক্য আছে। এই মতে জাতিভেদ নাই। ইহারা মূর্ত্তিপূজার বিরোধী এবং নেমাজের মত দিনে পাঁচবার নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনা করার ব্যবস্থা আছে এই ধর্ম্মে। এইসব ভক্তিকালের “সন্ত” মতগুলির সাহিত্য পাঠে দেখা যায় যে এইগুলি নির্গুণ বা নিরাকার ঈশ্বরের পূজা প্রচার করিয়াছে; ইহারা মূর্ত্তি পূজার বিরোধী ছিল ও জাতিভেদ অস্বীকার করিত; ভক্তির দ্বারা ঈশ্বর উপাসনা করিত আর বলিত ভগবদ্ভক্তির মধ্যে সব সমান। এই সাহিত্য পড়িলে বেশ বুঝা যায় যে, ইহার মধ্যে ইসলামের প্রভাবও বিস্তার হইয়াছে,[৪৯] সন্ত মতকে মুসলমান সংস্কৃতি প্রভাবান্বিত করিয়াছে। এই ভক্তিমতে সুফী ধর্ম্মের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। বাংলায় নব বৈষ্ণব ধর্ম্মে অর্থাৎ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম্মে সুফী মতের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু তাহার পরিমাণ কত তা এখনও অনুসন্ধানের বিষয় হইয়া আছে। কোন কোন লেখক বলেন, সুফী মতই ভারতীয়দের ইসলাম গ্রহণের পথ সুগম করিয়া দেয়। আবার সুফী মতের দ্বারাই হিন্দুমুসলমান ধর্ম্ম সাধকেরা আজ পর্য্যন্ত একীভূত হয়। লেখক অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছেন, অনেক ফকীর সম্প্রদায় আছেন যাঁহারা আল্লা অপেক্ষা গুরুকে অধিক মানেন। এই বিষয়ে এই গুরুমতবাদীদের সহিত পুরাতন বৌদ্ধ সহজযানীদের মতের ঐক্য আছে। বর্ত্তমান কালের বাঙ্গলার বৈষ্ণব ও কর্ভত্তাজা সম্প্রদায় ভগবানের অপেক্ষা কর্ত্তা বা গুরুকে বেশী সম্মান দেয়। এক দল ঐতিহাসিক অনুসন্ধানকারী বলেন যে হিন্দু বৈদান্তিক মতের সহিত ইসলামের সংস্পর্শ অতি প্রাচীনকালেই হইয়াছিল। তাহার ফলে সুফী ধর্ম্মের উদ্ভব হয়। জেলালুদ্দীন রুমী তার একটা নজীর। জার্ম্মাণ প্রাচ্যভাষা বিশারদ ফন ক্রেমার তাঁহার এক পুস্তকে[৫০] বলিয়াছেন যে, স্তাম্বুলের একটী দরবেশ সম্প্রদায়গত ধর্ম্মতত্ত্বের উপদেশের এক গুপ্ত পুস্তক তাঁহার হস্তগত হয়। তাহা অনুবাদ করিয়া তিনি দেখাইয়াছেন যে, ইহা সংস্কৃত বেদান্তসারের সহিত মেলে। লেখক স্তাম্বুলে Dancing Dervish-দের নৃত্য দেখিয়াছেন। তিনি দেখেন যে, একজন দরবেশ নাক দিয়া বাঁশী বাজাইতে থাকে, আর অন্য দরবেশরা, যাঁহারা ভূমিতে উপবিষ্ট ছিলেন, বাঁশীর শব্দ শুনিয়া উঠিয়া দুই বাহু তুলিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন এবং ঢিপ ঢিপ করিয়া ভূমিতে পড়িয়া “দশা প্রাপ্ত” হইতে লাগিলেন। এই রীতির সহিত এবম্প্রকারের গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতির মিল আছে। কোথা হইতে এই সাদৃশ্য আসে তাহা অনুসন্ধানের বস্তু। চৈতন্য চরিতামৃতে অদ্বৈত গোস্বামী নিজেকে “আউল” বলিয়াছেন। আবার ‘আউলিয়া’ উপাধিধারী একজন বড় বৈষ্ণব সাধকের নামে বঙ্গীয় বৈষ্ণবদের নামের তালিকায় পাওয়া যায়[৫১]

বাঙ্গলার বৈষ্ণবদের মধ্যে আউলিয়া, সাঁই, দরবেশ প্রভৃতি সম্প্রদায়ও আছে। আবার ৭০ জনের উপর মুসলমান বৈষ্ণব কবির পদাবলীসমুহের পাণ্ডুলিপিও আবিষ্কৃত হইয়াছে[৫২]। এতদ্ব্যতীত মৌলবী ওয়াহেদ হোসেন[৫৩] মহাশয় লেখককে বলিয়াছিলেন যে, সুফীদের যোগের আসনের সহিত হিন্দুদের যোগাসনের মিল আছে। এই জন্য উভয় মতের ঘাতপ্রতিঘাত ও সংঘাতের বিষয় বিশেষভাবে অনুসন্ধানের বস্তু।

এই সন্ত সাহিত্যে আমরা দেখি যে, একদল সাধু, যাঁহাদের মধ্যে অনেকেই নীচ হিন্দু জাতীয় এবং মুসলমানবংশীয়—যাঁহারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের কঠোরতা এবং ইসলামের অনুদারতার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছেন এবং বিবদমান হিন্দুমুসলমানকে এক করিবার যত্ন করিয়াছেন এবং উদার মুসলমান সাধকেরাও সুফী মতের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়া ভ্রাতৃভাবে হিন্দুর হস্ত ধারণ করিয়াছেন। যদিও তৎকালীন রাজনীতিক্ষেত্রে উভয় জাতির লোকের বিবাদ ছিল, তত্রাচ সেই গণ্ডী ভেদ করিয়া হিন্দুমুসলমানকে সম্মিলিত করিয়া এক অখণ্ড ভারতীয় জাতিসংগঠনের প্রয়াস ইঁহারা করিয়াছিলেন। আকবর রাজনীতিক্ষেত্রে তাঁহার “দীন ইলাহি” ধর্ম্ম দ্বারা সজ্ঞানে এই প্রচেষ্টা করিয়াছিলেন[৫৪]। তিনি তাঁহার বংশকে “National Monarch”-রূপে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই যুগের বহু পরেও এই সন্তদের ভাবের প্রতিধ্বনি করিয়া গুরুগোবিন্দ সিং বলিয়াছিলেন—

“হিন্দ্ তুর্ককো ঝগড়া মিটায়ুঁ,
সারা সৃষ্টি এক বর্ণ বনায়ুঁ॥

সপ্তদের এই সব সাহিত্য পাঠে স্পষ্টই প্রতীত হয় যে তাহারা একটী বিশিষ্ট আদর্শ জনসমাজের সম্মুখে ধারণ করিয়াছিল। অবশ্য ইহাতে অতীন্দ্রিয়ভাব বর্জ্জিত হয় নি বটে, কিন্তু ইহা পারিপার্শ্বিক অবস্থাও অবহেলা করে নি। বরং সেই অবস্থানুযায়ী ব্যবস্থা হইয়াছিল। সরোকিনের বিভাগ অনুযায়ী ইহাকে Idealistic সাহিত্য বলা যাইতে পারে। ইহারই কিয়দংশ মধ্যযুগে লিখিত হইয়াছিল, তথাপি ইহা সামন্ততান্ত্রিক যুগের প্রভাব হইতে বিনির্গত হইয়া জনসাধারণ ও গণশ্রেণীর মধ্যে প্রচার হইয়াছিল। ইহার প্রভাব দ্বারা ভারতীয় সমাজ একটু ‘অগ্রসর’ স্তরে উপনীত হইয়াছিল। এই জন্য আমরা ইহাকে আগেকার অপেক্ষা প্রগতিশীল সাহিত্য বলিব।

এইবার আসে হিন্দী সাহিত্যের ভক্তিকালের প্রেমকাব্য। এই প্রেমকাব্য অনেক মুসলমান দ্বারা রচিত হইয়াছে। প্রেমকাব্যসমূহে সুফী মত প্রচার হয় আর সেই সঙ্গে হিন্দুর ধর্ম্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। এই সাহিত্যের প্রথম লেখক ছিলেন কুতুবন (সম্বৎ ১৫৫০)। ইনি শেরশাহের পিতার আশ্রিত ছিলেন। ইহাতে চন্দ্রনগরের রাজকুমার আর কাঞ্চননগরের রাজকুমারী মৃগাবতীর প্রেমকথা লিখিত আছে। এই আখ্যায়িকার মধ্যে লেখক ভগবৎ প্রেমের স্বরূপ দেখাইয়াছেন। মধ্যে মধ্যে সুফীদের রহস্যময় আধ্যাত্মিক ভাবও পাওয়া যায়। তারপর মনঝনের “মধুমালতী” পুস্তকে কনেসর রাজকুমার মনোহর আর মহারসের রাজকুমারী মধুমালতীর প্রেম বর্ণনা আছে। এই পুস্তকের প্রতিপাদ্য হইতেছে যে, মানুষের বিরহের দ্বারা ভগবৎ সাধনাই হইতেছে প্রকৃষ্ট পন্থা। ইহার পর আসেন মালিক মহম্মদ জায়সী। “পদ্মাবতী” পুস্তকের রচয়িতা ইনি। এই পুস্তক এত প্রসিদ্ধ হয় যে ইহার পাণ্ডুলিপি ফার্সী, দেবনাগরী ও কয়টি ভাষায় পাওয়া যায়।

এই পুস্তকের প্রতিপাদ্য হইতেছে যে সিংহল দ্বীপের রাজা গন্ধর্ব্বসেনের কন্যা পদ্মাবতী রূপগুণে[৫৫] অদ্বিতীয়া ছিলেন। পদ্মাবতীর হীরামন নামে এক শুকপাখী ছিল। এই পাখী রাজার ভয়ে উড়িয়া পালাইবার সময় চিতোরের এক ব্রাহ্মণের হাতে পড়ে। ব্রাহ্মণ তাহাকে রতন সেনের নিকটে নিয়া যায়। রাজা পাখীর মুখ থেকে শুনে পদ্মাবতীর রূপে গুণে ব্যাকুল হইয়া যোগী সাজিয়া বাহির হইয়া পড়েন। তৎপর কলিঙ্গ দেশ থেকে এক যোগী দলের সঙ্গে মিশিয়া জাহাজে করিয়া সিংহলে যান। আর হীরামন পাখী গিয়া পদ্মাবতীকে সকল কথা বলে। তারপর রতন সেনের মৃত্যুর পর পদ্মাবতী ও নাগবতী, সহমরণ করেন। আলাউদ্দীন যখন চিতোর পৌঁছেন তখন তিনি চিতাভষ্ম ছাড়া আর কিছুই পান নি। এই পদ্মাবতী পুস্তকই বাংলার কবি সৈয়দ আলাওল “পদ্মাবতী” নাম দিয়া অনুবাদ করিয়াছিলেন। এই ঐতিহাসিক গল্পের নামে সুফী ধর্ম্মের প্রচার করা হইয়াছে। তিনি নিজেই বলিয়াছেন:—

“তন চিতউর মন রাজা কীনহা।
হিয় সিংঘল বুধি পদমনী চিন্থা।
গুরু সুয়া জেই পঁথ দেখাওা

* * *

মায়া আলাউদ্দিন সুলতানু।”

এর পর আসে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় কবি ওসমান—ইনি “চিত্রাবলী” (১৬১৩ খৃঃ) নামে একটী পুস্তক লেখেন। ইনি নিজামউদ্দিন চিশতীর শিষ্য গোষ্ঠী ছিলেন। তাঁহার “যোগী চুঁচনখণ্ড” পুস্তকে কাবুল, বাদাকশান, সিংহল দ্বীপ প্রভৃতি দেশের বর্ণনা করেছেন। আশ্চর্য্যের কথা এই যে, যোগীর ইংলণ্ড ভ্রমণের কথাও উল্লেখ করিয়াছেন—‘বলং দ্বীপ দেখা আংরেজা...মদ বরাহ জিঞ্ছ কেরা’। কবি এই রচনায় জায়সীকে অনুসরণ করিয়াছেন। ইহার আখ্যায়িকা কল্পিত। তিনি নিজেই বলেছেন—“কথা এক মৈঁ হিত্র উপাই” এই পুস্তকে বেদান্ত ও অদ্বৈতবাদের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। তারপর আসে শেখ নবী (১৬৭৬); ইনি ‘জ্ঞান দীপ’ নামে এক আখ্যায়িকাপূর্ণ পুস্তক লেখেন। ইহাতে রাজা জ্ঞানদীপ ও রাণী দেবযানীর কথা আছে। ইহার সুফী মতের পদ্ধতি অনুযায়ী লিখিত হইয়াছে। তৎপর আসে কাশিম সাহ (১৭৮৮); ইনি ‘হংস জওয়াহির’ নামক একটা আখ্যায়িকা লেখেন। ইহাতে রাজা হংস ও রাণী জওয়াহিরের কথা আছে। তৎপর আসে নূর মহম্মদ (১৮০২ সম্বৎ)। ইনি ‘ইন্দ্রাবতী’ নামে একখানি আখ্যায়িকা কাব্য লেখেন। তাহাতে কালিঞ্জরের রাজকুমার আর আগমনপুরের রাজকন্যা ইন্দ্রাবতীর প্রেমের বর্ণনা আছে। এই গ্রন্থকে সুফী পদ্ধতির শেষ গ্রন্থ বলিয়া নির্দেশ করা হয়[৫৬]। এই সঙ্গে কতকগুলি হিন্দু কবির প্রেম কাব্যও উল্লেখযোগ্য: যথা, দামো কবির (১৫১৬) লক্ষ্মণসেন—“পদ্মাবতীকী” কথা; মোহনলাল কায়স্থের ‘রসরতন’ কাব্য (১৬৭২), কাশীরামের (কনকমঞ্জরী) (১৭১৫), হরসেবক মিশ্রের (কামরূপকী কথা) (১৮০৮ সং); প্রেমচন্দ্রের (১৮৫৩ সং) ‘চন্দ্রকলা’; মৃগেন্দ্র কবির (সং ১৯১২) ‘প্রেমপয়োনিধি’। এই হিন্দী কবিদের কাব্যগুলি বেশীর ভাগ পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক আখ্যায়িকা নিয়াই লিখিত হয়।

এই প্রেমমার্গ শাখার সাহিত্য হয় অতীন্দ্রিয়বাদ তথ্যযুক্ত গল্প, না হয় রাজারাণীর প্রেমের গল্প নিয়া রচিত। ইহাতে পারিপার্শ্বিক সমকালীন অবস্থার কোন উল্লেখ নাই। ইহারা প্রাচীনের সুরই ধরিয়া ছিল। এইজন্য আমরা এই সাহিত্যকে প্রগতিশীল সাহিত্য বলিতে পারি না। ইহা Ideational এবং আমাদের বিচারে সামন্ততান্ত্রিক যুগীয় সাহিত্য।

তৎপর আসে ঐতিহাসিকের মতে রামভক্তির শাখা। এই সাহিত্য ভক্তিমার্গের অন্তর্গত। এই সাহিত্যে তুলসীদাসের (১৫৮৯ সং) রামভক্তির পুস্তকগুলিই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। ইনি কতিপয় রামায়ণ লিখিয়াছিলেন। ইনি ‘রামচরিত মানস’ পুস্তকে লোকশিক্ষার্থ নানাভাবে উপদেশ দিয়াছেন—কেবল ব্যক্তিগতভাবে নয়, সমষ্টির শিক্ষার্থ নানা রূপকের মধ্য দিয়া সমাজহিতকর নানা উপদেশ দিয়াছেন। তাঁহার উপদেশের সারাংশগুলি এই: রাজাকে তিনি ঈশ্বরের অংশ বলিয়াছেন, যথা—

“সাধু সুজান সুশীল নৃপালা।
ঈশ অংশ ভব রাম কৃপালা”[৫৭]।”

(রাজার আশ্রমধর্ম্ম পালন প্রয়োজন)। উত্তরকাণ্ডে তুলসী রাম রাজত্বের সমাজকে বর্ণাশ্রম ধর্ম্মানুযায়ী বর্ণনা করিয়াছেন, “বরণাশ্রম নিজ নিজ ধরম, নিরত বেদপথলগ[৫৮]।”

তৎপর স্বামী অগ্রদাস (১৬৩২): তাঁর রামভক্তি বিষয়ে চারিখানি পুস্তক পাওয়া যায়। তৎপরে আসেন অগ্রদাসের শিষ্য নাভাদাসজী (১৬৫৩)। ইহাকে কেউ ডোম জাতীয় আবার কেউ বা ক্ষত্রিয় বলেন[৫৯]। ইঁহার প্রসিদ্ধ পুস্তক হইতেছে “ভক্তমাল”। এই সাহিত্যকেও আমরা প্রগতিশীল বলিতে পারি না। এই পদাবলী গ্রন্থ সাহেবে শুজরী ও মারুরাগে পাওয়া যায়।

এই সাহিত্যে অনেক বড় বড় হিন্দু লেখক উদ্ভূত হইয়াছেন, আবার কতিপয় বিখ্যাত মুসলমান কৃষ্ণভক্তির বিষয়ে কবিতা লিখিয়াছেন। আশ্চর্য্যের কথা এই পূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে যে, বাঙ্গলাতেও কৃষ্ণভক্তি অনেক মুসলমান কবিকে আকর্ষণ করিয়াছে। হিন্দীতে দিল্লীর, রসখান নামে একজন পাঠান সর্দ্দার ‘প্রেমবাটিকা’ নামে এক কবিতা লিখিয়াছিলেন। সম্ভবতঃ ইনি পাঠান সম্রাটদের আত্মীয় ছিলেন। আর একজন ছিলেন আবদুল রহিম খানখানা; ইনি আকবর সাহের অভিভাবক বৈরাম খাঁয়ের পুত্র। আরবী, ফার্সী ও সংস্কৃতে ইনি অতি পণ্ডিত ছিলেন এবং হিন্দীতে উচ্চাঙ্গের কবিতা লিখিতেন। ইঁহার সঙ্গে তুলসীদাসের বড় ভাব ছিল। ইনিই “বরঐছন্দ” সৃষ্টি করেন, পরে তুলসীদাস তাহার অনুকরণ করেন। “বরঐ নায়িকা ভেদ” নামক পুস্তক আওধী হিন্দীতে লেখা হয়। এতদ্ব্যতীত দোহাবলী বা ‘সতসই’ ‘শৃঙ্গার-সোরট’ ‘মদনাষ্টক’, ‘রাস-পঞ্জাধ্যায়ী’, পুস্তক তিনি লিখিয়াছিলেন। ইঁহার দোহাবলীর একটী নমুনা:—‘দুরদিন পরে রহিম কহ, ভুলত সব কৈ পহিচানি।’ ইঁহার কোন পুস্তক আবিষ্কৃত হয় নি। লোকের মুখে ইঁহার কবিতার প্রচার আছে।

তারপর আসেন কাদের—(জন্ম ১৬৩৫ সম্বৎ)। ইঁহার বিবিধ কবিতা প্রাপ্ত হওয়া যায়। ইঁহার দোহাবলীর একটা নমুনা—যথা—“গুণকো ন পুছৌ কৌ, ঔগুণকী বাত পুছৌ, কহা ভয়ো দৈ। কলিকাল ইষোঁ খরানো হৈ।” এর পর আসেন মুবারক (১৬৪৫ সং)—ইনিও সংস্কৃত, আরবী ও ফার্সীতে একজন বড় কবি ছিলেন। ইনি কেবল শৃঙ্গার রসের কবিতা লিখিয়াছেন। ইনি নায়িকার অঙ্গের বর্ণনা বড়ই বিস্তারিতভাবে করিয়াছেন। ইঁহার গ্রন্থের নাম:—“অলক-শতক ঔর তিল-শতক”। ইঁহার রচনার নমুনা:—

“পরী মুবারক তিয়-বদন অলক ওপ অতিহোয়
মনো চন্দ কী গোদ মে রহী নিসা সী সোয়।”

এইবার আসেন সুরদাস (১৫৪০ সং)। ইঁহার ‘সুরসাগর’ প্রধান গ্রন্থ। ইনি শৃঙ্গার ও বাৎসল্য রসের একজন অতি শ্রেষ্ঠ কবি। ইঁহার রচনার নমুনা:—(১) “কাহে কো আরি করত মোর মোহন! যোঁ তুম আঙ্গন লোটী?” (২) “মেরে নৈনা বিরহ কী বেলী বই। সীঁচত নৈন—নীরকে সজনী! মূল পতার গই।”

তারপর আসেন নন্দদাস (সং ১৬২৯)। সুরদাসের পরই ইনি কবি বলিয়া গণ্য হন। ইঁহার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক হইতেছে—“রাসপঞ্চাধ্যায়ী”। রচনার নমুনা:—“তাহী ছিন উডুরাজ উদিত রস-রাস সহায়ক। কুঙ্কুম-মণ্ডিত বদন প্রিয়া জনু নাগরী নায়ক।” কৃষ্ণ কাব্যের আর একজন বড় কবি হইতেছেন মীরাবাঈ। ইনি রাজস্থানের একজন স্ত্রী-কবি এবং উদয়পুরের মহারাণা ভোজরাজের স্ত্রী। ইঁহার কাব্যে কৃষ্ণের লীলা বর্ণনা নাই। ইনি শুধু দীনতার দ্বারা আপনার হৃদয়ের সমস্ত ভাবনাকে ভক্তিসূত্রে গাঁথিয়া শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করিয়াছিলেন। মীরা মাধুর্য্যরসের ভক্ত ছিলেন। ইনি নিজে বিরহিনী সাজিয়া আরাধ্য কৃষ্ণের প্রণয় ভিক্ষা চাহিতেন। ইনি নিজের বিষয় বলিতেছেন—

রাজা বরজৈ, রাণী বরজৈ,
বরজৈ সব পরিবারী।
কু’য়রপাটবি সোভি বরজৈ
ঔর সেহল্যা সারী॥[৬০]

নিজের উপর স্বামী গৃহের অত্যাচারের কথা বলিতেছেন,—“রাণা বিষকো প্যাল্যো ভেজ্যো পীয় মগন হোই”[৬১]। নিজের বৈরাগ্য বিষয়ে তাঁর বক্তব্য—“ছাপা তিলক বনাইয়া ত্যজিয়া সব সিঙ্গার মৈঁ তো সরনে রামকে ভল নিন্দে সংসার”[৬২]। কৃষ্ণপ্রেমাত্মক এই সাহিত্যকে আমরা পূর্ব্বের ন্যায় প্রগতিশীল বলিতে পারি না।

তারপর শুক্লের বিভাগ অনুযায়ী আমরা উত্তর-মধ্য কালে সমুপস্থিত হই। এই যুগকে তিনি রীতিকাল (১৭০০—১৯০০) বলিয়াছেন। তিনি আরও বলেন, এই যুগে হিন্দী কাব্য পূর্ণ প্রৌঢ়তা প্রাপ্ত হইল[৬৩]। এই সময়ে রস অলঙ্কার প্রভৃতি বিষয়ে অনেক কাব্য লিখিত হয়। ত্রিপাটী (১৭০০ সং) থেকে এই কালের আরম্ভ হয়। ইনি “কাব্য বিবেক”, “কবিকুল কল্পতরু” প্রভৃতি কাব্য লেখেন। এই লেখকগণ ভাবুক, সহৃদয় ও নিপুণ কবি ছিলেন। ইঁহারা কাব্য দ্বারা শাস্ত্রীয় তত্ত্ব নিরূপণ করেন। এই সাহিত্যে শৃঙ্গার রসের অনেক সুন্দর রচনা আছে। নায়িকাই এই রসের আধার হইয়াছেন। কিন্তু ইহাতে সাহিত্যে প্রবৃত্তির বিভিন্নরূপ, জীবনের বিভিন্ন চিত্র আর জগতের নানা রহস্য প্রভৃতি স্থান পায় নি। এইজন্য ইহার প্রতিপাদ্য বিষয় গণ্ডীভূত ও সঙ্কুচিত হইয়াছিল; এবং কবিদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের অভিব্যক্তির প্রকাশ পাই। ইহাতে মার্জ্জিত ভাষা, পদবিন্যাস, অলঙ্কার ব্যবহার ইত্যাদি পাওয়া যায়। কিন্তু এই সাহিত্যের প্রকৃতির বিশ্লেষণ করিলে উচ্চাঙ্গের বস্তুর অভাব দৃষ্ট হয়।[৬৪]

এ যুগে অনেক কবি উদিত হইয়াছেন। তন্মধ্যে কবি দেবের রচনার নমুনা নিম্নে দেওয়া হইতেছে:—

(১) “সুনো কৈ পরমপদ, উনো কৈ অনন্তমদ,
নুনো কৌ নদীস নদ, ইন্দিরা ঝুরৈ পরী”।
(২) “ডারদ্রুম পলনা, বিচ্ছৌনা নব পল্লবকে,
সূমন ঝঁগুলা সো হৈ তন ছবি ভারী দৈ”॥

আর একজন মুসলমান কবির নাম উল্লেখযোগ্য—অলী মূহির খাঁ। ইনি ১৭৮৩ খৃস্টাব্দে “খটমল বাইসী” নামে এক হাস্যরসের পুস্তক লেখেন। ইঁহাকে “প্রীতমজী”ও বলা হয়। উক্ত পুস্তক হইতে ইহার কবিতার উদাহরণ প্রদত্ত হইল:—

(১) “জগৎকে কারণ করণ চারৌ বেদনকে
কমলমেঁ বসে বৈ সুজান জ্ঞান ধরি কৈ।”
(২) “বিধি হরিহর, ঔর ইনতেঁ নকোঁ, তেউ
খাট পৈ ন সোব, খটমলনকোঁ ডরি কৈ॥”
(৩) “বাঘন পৈ গয়ো, দেখি বনন মেঁ রহে ছপি,
খাটকে নগর খট্‌মলকী দুহাই হৈ।”

এই যুগের আর একজন বিশেষ কবি হইতেছেন ভূষণ। ইনি এই যুগের বীররসের একজন প্রসিদ্ধ কবি (১৬৭০)। ইঁহার আসল নাম এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। চিত্রকূটের রাজা ইঁহাকে কবিভূষণ উপাধি দিয়াছিলেন। আওরঙ্গজেবের অত্যাচারে মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যখন হিন্দুর পুনঃ জাগরণ হইতে থাকে, সেই সময় স্বাধীন হিন্দু শক্তির দুইজন নেতা বুন্দেলখণ্ডের রাজা ছত্রশাল আর মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি শিবাজী, ইঁহাকে আশ্রয় ও সম্মান প্রদান করেন। এইজন্য ইনি একবার বলিয়াছিলেন—“শিবা কো বখানৌঁ কি বখানৌঁ ছত্রশাল কো।” প্রবাদ আছে, তিনি এক এক ছন্দের জন্য লাখ টাকা শিবাজীর কাছ থেকে বখশীশ পাইয়াছিলেন। ইনি বিশিষ্টভাবে বীররসের কবি ছিলেন। ইঁহার “শিবরাজভূষণ”, “শিবা বাওয়ানী” এবং “ছত্রশাল দশক” পাওয়া যায়। ইনি শিবাজীকে কৃষ্ণের সঙ্গে তুলনা করিয়াছেন। ইঁহার একটি বিখ্যাত কবিতা (শিবা বাওয়ানী) মহারাষ্ট্রীয়দের মুখে মুখে প্রচলিত আছে—

“কাশী কা কলা যাতি, মথুরা মসজিদ হোতি,
সুন্নৎ হোতি সবাকার আগর শিবাজী
মহারাজ নহি হোতা প্রকাশ।”

 ইঁহার আবিষ্কৃত কবিতার নমুনা:—

(১) “ভূষণ ভনত দিল্লীপতি দিল ধক ধক,
সুনি সুনি ধাক শিবরাজ মরদানে কী”।
(২) “বিলখি বদন বিলখত বিজৈপুর পতি
ফিরত ফিরঙ্গিন কী নারী ফরকতি হৈ

* * *
রাজা শিবরাজকে নগারন কী ধাক সুনি

কেতে বাদসাহন কী ছাতি ধরকতি হৈ॥”

লালকবি নামক এই প্রকারের আর এক কবি ছিলেন। ইনি ছত্রশালের আজ্ঞায় তাঁহার জীবনচরিত কবিতাতে বর্ণনা করেন। পুস্তকের নাম “ছত্রপ্রকাশ।” এই পুস্তকে বুন্দেল বংশের উৎপত্তি, মোগল দ্বারা এই রাজ্যের অপহরণ, অল্প সৈন্যের দ্বারা ছত্রশালের তাহা উদ্ধার, তৎপর তাহার পুনঃ পুনঃ বিজয় বর্ণনা আছে। ছত্রপ্রকাশের নমুনা,—

“চৌঁ কি চৌঁকি সবদিসি উঠেঁ, সুবা খান খুমান।
অব ধৌঁ ধাবৈ কৌনপর ছত্রশাল বলবান॥”

আর একজন কবির নাম এখানে উল্লেখযোগ্য। ইনি তৈলঙ্গী ব্রাহ্মণ বংশীয়—নাম পদ্মাকর ভট্ট। ইনি সর্ব্বপ্রিয় কবি ছিলেন। জয়পুর নরেশ ইঁহাকে “কবিরাজ শিরোমণি” উপাধি প্রদান করেন। ইনি উত্তর ভারতের অনেক বাদশাহ ও রাজার নিকট হইতে সম্মান ও উপহার পাইয়াছেন। ইঁহার অনেক পুস্তক আছে। ইনি গোয়ালিয়রে দৌলত রায় সিন্ধিয়ার সভায় সম্মান পান এবং তাঁহার প্রশংসাসূচক একটি কবিতা তথায় পড়েন। তাহার নমুনা:—

“বাঁকা নৃপ দৌলত আলীজা মহারাজ কবৌঁ
সাজি দলপকরি ফিরঙ্গীন দবায়ৈগো।
দিল্লী দহপট্টি, পাটনা হু কো ঝপট্ট করি,
কবহুঁ ক লত্তা কলকত্তা কো উড়ায়ৈ গো”।

এই সাহিত্যের মধ্যে শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিংহের নাম উল্লেখযোগ্য। (১৭২৩ সং)। ইনি হিন্দীতে কতকগুলি ভাল সাহিত্য রচনা করিয়াছিলেন। যথা, ‘সুনীতি প্রকাশ’ ‘প্রেমসুমার্গ’ ‘চণ্ডী চরিত্র’ প্রভৃতি। ‘চণ্ডী চরিত্র’ বড় ওজস্বিনী ভাষায় লেখা হইয়াছে। ইঁহার রচনার নমুনা:—

“বিদ্যাকে বিচার হৌ,
কি অদ্বৈত অবতার হৌ,
কি সুদ্ধতা কী মূর্ত্তি লৌ,
কি সিদ্ধতা কী সান হৌ”

এই সাহিত্যের মধ্যে আমরা প্রগতির কিছুই সংবাদ পাই না এবং ইহার মধ্যে ভূষণ ও লালকবি দুইজন সামন্ততান্ত্রিক রাজার বীরগাথা বর্ণনা করিয়াছেন। এই জন্য আমরা এই যুগের সাহিত্যকে সামন্ততান্ত্রিক যুগের সাহিত্য মধ্যে গণ্য করিব।

আধুনিক কালে হিন্দী গদ্য রচনার সৃষ্টি হয়। এই সময় উত্তর ভারতে ইংরাজ শাসন সংস্থাপিত হইয়াছিল। যে সব কারণে বাঙ্গলা গদ্য রচনার উৎপত্তি হয়, সেই সব কারণেই হিন্দী ভাষায় গদ্যের বিকাশ হইতে থাকে। ইংরাজ শাসনের আবশ্যকতা অনুযায়ী কলিকাতার Fort William College থেকে উর্দ্দু এবং হিন্দীতে গদ্য লিখিবার ব্যবস্থা হয়। এর আগেই “খড়িবোলিতে” সদা শূকলালের “সুখসাগর” ও ইনশাআল্লাখাঁর “রাণী কেতকীকী কহানী” নামে দুইখানি পুস্তক রচিত হয়। Fort William College-এর আশ্রয়ে লল্লু লালজী গুজরাটী খড়িবোলির গদ্যেতে “প্রেম সাগর” আর সদল মিশ্র “নসিকেতোপাখ্যান” রচনা করেন। এই পুস্তকগুলি পাঠে বুঝা যায় যে, “সুখ সাগর” হইতেছে ‘ভাগবতে’র অনুবাদ, আর ‘প্রেম সাগর’ কৃষ্ণলীলা নিয়া রচিত হইয়াছে। এই গুলি প্রাচীন গল্পকেই ভিত্তি করিয়া গঠিত হয়। সুতরাং এইগুলিকে প্রগতিশীল সাহিত্য বলা চলে না। তৎপরে আসে শ্রীরামপুরের ক্রিশ্চান মিশনারী সম্প্রদায়। ইঁহারা বাইবেল প্রভৃতি হিন্দী ভাষায় অনুবাদ করিতে থাকেন। ইঁহারা লল্লু লালজীর বিশুদ্ধ ভাষা আদর্শরূপে গ্রহণ করেন[৬৫]। তৎপর ১৮৯৪ খৃঃ আগ্রাতে মিশনারীরা School Book Society স্থাপন করেন। ইঁহারা ‘ইংলণ্ডের ইতিহাস’ আর মার্সম্যানের প্রাচীন ইতিহাসকে ‘কথা সার’ নাম দিয়া এক হিন্দী অনুবাদ করেন। তৎপর কলিকাতাতে School Book Society কতকগুলি বৈজ্ঞানিক পুস্তক হিন্দী পদ্যে প্রকাশিত করেন। ইহার পর আসে মিশনারী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত Orphan Press। ইঁহাদের ভূচরিত্র, দর্শন, জন্তু, প্রবন্ধ, ভূগোল, বিজ্ঞান প্রভৃতি পুস্তক সামন্ততন্ত্রীয় যুগের প্রভাব বিমুক্ত ও প্রগতিশীল বটে, কিন্তু ইহাতে ভারতীয় সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার চিত্র নাই। ইহাদের সেই জন্য ভারতের জাতীয় সাহিত্যের অন্তর্গত করা যায় না। ইহার পর রাজা শিবপ্রসাদের “বনারস আখবর” প্রকাশিত হয়। কিন্তু ইহা হিন্দী অক্ষরে লিখিত হইলেও ভাষায় উর্দ্দুই থাকিয়া যায়[৬৬]তারপর ১৯০৭ সং বাবু তারামোহন মিত্র ও তাঁর বন্ধুবর্গ “সুধাকর” নামক এক সংবাদপত্র বাহির করেন। এই পত্র খাঁটি হিন্দী ভাষায় লিখিত হয়। ইহাতে ভারতীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিষয় লিখিত হয়। এই প্রকারে হিন্দী ভাষায় গদ্য লেখার উৎপত্তি হয়।

ইংরাজ রাজত্ব ভারতে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইবার ফলে ভারতবর্ষ আবার প্রগতির মুখে ধাবিত হইতে থাকে। ইহার ফলে সর্ব্বপ্রদেশেই প্রগতিপন্থীয় সভা ও তদনুযায়ী পুস্তকসমূহ লিখিত হইতে থাকে। কিন্তু ইংরেজ সংস্কৃতির যে আলো ভারতে সে সময়ে প্রতিভাত হয়, তাহাও ইংলণ্ডের সামন্ততান্ত্রিক যুগের আশ্রয়েই ছিল। এই আলো আপেক্ষিকভাবে ভারতে প্রগতির আকারে প্রকাশ পাইলেও আমরা যে অর্থে প্রগতি বলি তাহার উদয় ভারতে হয় নাই। মিশনারীদের অনুবাদসমূহে অতি প্রাচীন গল্পগুলি এদেশে প্রচারিত হয়। আর যে সব দেশীয় লোকেরা নূতনভাবে পুস্তকসমূহ লিখিতে থাকেন, তাঁহারা ভারতের প্রাচীনকে হালের ভাষাতে আমদানী করেন! এইজন্য এই সব পুস্তক বাঙ্গলা বা হিন্দী বা অন্য প্রাদেশিক ভাষায় লিখিত গদ্য সাহিত্যের পুষ্টিসাধন করিয়াছিল বটে, কিন্তু ইহাকে প্রগতিপন্থার ধারার অন্তর্গত বলা যায় না। হিন্দীর গদ্য সাহিত্যের প্রথম উত্থানকালে ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র বিশেষ প্রভাবশালী লেখক ছিলেন। ইঁহাকে বর্ত্তমান হিন্দী সাহিত্যের প্রবর্ত্তক বলিয়া স্বীকার করা হয়[৬৭]। ১৯২২ সং হইতে ইনি বাংলা সাহিত্যের নূতন প্রগতির সহিত পরিচিত হন। এর ফলে ১৯২৫এ ইনি “বিদ্যাসুন্দর” নাটক অনুবাদ করেন। ইনি তিনখানি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইঁহার সময়ের অগ্রে ও পশ্চাতে যে সব অনুবাদ প্রকাশ হইত তাহা পুরাতন তত্ত্বেরই সুর ধরিয়া চলিয়াছিল। ভারতেন্দুর “বৈদিকী হিংসা” “সত্য হরিশ্চন্দ্র” “নীলদেবী” ইত্যাদি নাটকগুলি পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক তত্ত্ব নিয়াই লিখিত হয়। ইহার মধ্যে ইনি প্রথম নাটকে রাজা শিবপ্রসাদকে লক্ষ্য করিয়া খোসামুদে ও স্বার্থপর লোকদের বিপক্ষেই লিখিয়াছিলেন[৬৮]। ইঁহার লেখনীর মধ্যে কিঞ্চিৎ আপেক্ষিকভাবে প্রগতির চিহ্ন পাওয়া যায়। কিন্তু ইঁহার ‘কাশ্মীর কুসুম’, ‘বাদসাহ দর্পণ’ নামক ইতিহাসে প্রাচীন তত্ত্বের সংবাদই প্রদান করা হইয়াছে। হরিশ্চন্দ্রের জীবনকালে একটী সাহিত্যিকমণ্ডলী সৃষ্ট হয়। ইঁহাদের নাম—উপাধ্যায় পণ্ডিত বদরীনারায়ণ চৌধুরী, পণ্ডিত প্রতাপনারায়ণ মিশ্র, পণ্ডিত অম্বিকা দত্ত ব্যাস প্রভৃতি। ইঁহারা অনেক উপন্যাস ও নাটক লেখেন। এই সময়ে বহু মাসিক পত্রিকাও হিন্দীতে প্রকাশিত হয়। আবার ‘মিত্র বিলাস’ প্রভৃতি পত্রিকা সনাতন ধর্ম্মের প্রবর্ত্তক ছিল। এই সময়ে সনাতনী ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্ম এবং ধর্ম্ম ও সমাজ সংস্কারকদের প্রচারের মধ্যে এক সংঘর্ষ আসিয়া উপস্থিত হয়। তজ্জন্য সর্ব্বত্রই ভারতীয় সাহিত্যের পুষ্টি সাধন হয়। ইহার মধ্যে সংস্কারকদের রচনাকে আমরা তৎকালীন অবস্থানুযায়ী আপেক্ষিকভাবে প্রগতিশীল বলিতে পারি। তারপর “নাগরী প্রচারিণী” সভা প্রতিষ্ঠিত হয় (১৯৫০ সং)। এই সভার নিজের পত্রিকাতে সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক, দার্শনিক প্রভৃতি সর্ব্বপ্রকারের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আর ১৯৬৩ সং এই সভা “বৈজ্ঞানিক কোষ” সৃষ্টি করেন। এই বিভিন্ন আলোচনার মধ্য দিয়া আমরা প্রগতির সংবাদ পাই বটে কিন্তু এইগুলিকে ইংরেজী তত্ত্বের দেশী সংস্করণ বলিয়া হিন্দী ভাষাভাষীর নিজের সামগ্রী বলিব না।

অতঃপর আসে গদ্য সাহিত্যের দ্বিতীয় উত্থানের যুগ। এই যুগে বাঙ্গলা উপন্যাসসমূহ অবিশ্রান্ত হিন্দী ভাষায় অনূদিত হইতেছিল। এই যুগের পূর্ব্ব হইতেই বাঙ্গলা উপন্যাসসমূহ ক্রমাগত অনূদিত হইতেছিল। ইহার ফলে বাঙ্গলা ভাষার প্রভাব হিন্দীতে প্রতিফলিত হয়। অনেক হিন্দী লেখক সংস্কৃত শব্দ বাংলা ভাষা হইতে সঞ্চয় করিয়া হিন্দীতে ব্যবহার করেন[৬৯]। এই যুগে যে সব সাহিত্য রচিত হয় তন্মধ্যে বাবু রামকৃষ্ণ বর্ম্মা দ্বারা বাঙ্গলা ভাষা থেকে ‘বীর নারী’ ‘কৃষ্ণকুমারী’ ‘পদ্মাবতী’ ইত্যাদি, বাবু গোপালরাম দ্বারা ‘বভ্রূবাহন’ ইত্যাদি হিন্দীতে অনূদিত হয়। এই সঙ্গে বাবু গোপালরাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকও অনুবাদ করেন। এই সময় পুরোহিত গোপীনাথজী সেক্সপীয়ার-এর দুখানি নাটক অনুবাদ করেন। আবার লালা সীতারাম ও পণ্ডিত সত্যনারায়ণ কবিরত্ন অনেক সংস্কৃত পুস্তকও হিন্দীতে অনুবাদ করেন। এই সময়ে অনেক মৌলিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এই যুগে আবার বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, হারাণচন্দ্র রক্ষিত, শরৎবাবু, চারুচন্দ্র প্রভৃতি বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের পুস্তক অনূদিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসও অনূদিত হয়। এতদ্ব্যতীত মারাঠী এবং গুজরাঠী ভাষা থেকেও কিঞ্চিৎ পুস্তক অনূদিত হয়[৭০]। এই যুগে গল্প বা ছোট ছোট আখ্যায়িকাসমূহ অনূদিত হইয়া প্রকাশিত হইতে থাকে। ইহার মধ্যে বাবু গিরিজাকুমার ঘোষ—লালা পার্ব্বতীনন্দন নাম দিয়া অনেক ভাল গল্প লেখেন। ইহার পরই মৌলিক উপন্যাস লেখা আরম্ভ হয়। এই লেখকদের মধ্যে বাবু দেবকীনন্দন ক্ষেত্রী সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। তাঁহার পর আসেন পণ্ডিত কিশোরীলাল গোস্বামী। ইঁহার উপন্যাস সমূহে সমাজের উজ্জ্বল চিত্র, বাসনার রূপ রস প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়। এই বিষয়ে ইঁহাকে কিঞ্চিৎ প্রগতিশীল বলা যাইতে পারে, অর্থাৎ ছিলেন। ইনি নিজের সময়ের লোকের চিত্রাঙ্কন করিয়াছেন। কিন্তু ইঁহার ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি প্রাচীন রাজারাণীর কথা নিয়াই লেখা হইয়াছে এবং ইঁহার বর্ণনার মধ্যে কাল ব্যতিক্রম (anachronism) আছে। তাই এই গুলিকে সামন্ততন্ত্রীয় যুগের সাহিত্য বলিয়া পরিগণিত করিব। আর এই যুগে যে সব প্রবন্ধ প্রকাশিত হইত সেগুলির মধ্যে সব সময়ে ‘প্রগতি’ পাওয়া যায় না। অনেকগুলিতে তৎকালীন সামাজিক অবস্থা আলোচনা করিলেও রাষ্ট্রে ও সমাজে নূতন আদর্শের চিহ্ন এগুলিতে পাওয়া যায় না। এসব গুলি পুরাতন সভ্যতারই রোমন্থন করা দ্রব্য। ইহার মধ্যে পণ্ডিত মাধব প্রকাশের ‘রামলীলা’ পুস্তক প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতি পরিপন্থী। গোপাল রামের “রিদ্ধি ও সিদ্ধি” অর্থ বিষয়ক পুস্তক। বাবু বালমুকুন্দগুপ্তের ‘শিবশম্ভুকাচিট্টা’ একটি রূপাত্মক (allegorical) পুস্তক। অধ্যাপক পূর্ণ সিংহের ‘আচরণ কি সভ্যতা’ ভাবাত্মক দর্শনশাস্ত্র। ইহার ‘মজ্‌দুরী ও প্রেম’, কিঞ্চিৎ প্রগতিশীল। এই প্রবন্ধে ইনি পাদ্রী, সাধু, মৌলভী প্রভৃতির সম্বন্ধে বলিয়াছেন, “এদের চিন্তাবাসি, এদের জীবন বাসি, এদের বিশ্বাসও বাসি এবং এদের খোদাও বাসি হয়ে গেছে”[৭১]। এই শ্রেণীর আর একজন লেখক ছিলেন—বাবু গুলার রায়। ইনি বিচারাত্মক ও ভাবাত্মক রচনা সকল লিখিয়াছেন, যথা—‘কর্ত্তব্য সম্বন্ধী রোগ’, ‘নিদান ঔর চিকিৎসা’, ‘সমাজ ঔর কর্ত্তব্য পালন’ ইত্যাদি। কিন্তু এই রচনাগুলি সমালোচনাত্মক—নূতন আদর্শ ইহাতে কোথায়?

তারপর আসে তৃতীয় উত্থানের কাল—১৯৭৭ সং। এই যুগে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটকসমূহ হিন্দীতে অনূদিত হয় এবং এই সময়ে আধুনিক ঢঙ্গের কতিপয় নাটকও লিখিত হয়। যথা—জয়শঙ্কর প্রসাদের ‘জন্মেঞ্জয় কা নাগ যজ্ঞ’, ‘অজ্ঞাতশত্রু’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘স্কন্ধগুপ্ত’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এইসব নাটকে প্রাচীন সংস্কৃতি আর সামাজিক পরিস্থিতির বিষয় ভালভাবে বর্ণিত হইয়াছে। আবার ‘বরমালা’ এবং ‘দুর্গাবতী’ প্রভৃতি উপযুক্ত রঙ্গমঞ্চের নাটকও লিখিত হয়। কিন্তু এই বইগুলিতে সামন্ততন্ত্রীয় যুগের বিষয়বস্তুরই জাবর কাটা হইয়াছে। ইহাতে কোন প্রগতির নির্দ্দেশ নাই। তৎপর লক্ষ্মীনারায়ণ মিশ্র “সন্ন্যাসী” ও “রাক্ষস কা মন্দির” দুইখানি সামাজিক নাটক লেখেন। এই সঙ্গে বাবু আনন্দী প্রসাদ শ্রীবাস্তবের “অদ্ভুত” নামক এক নাটক উল্লেখযোগ্য। ইহাতে লেখক অস্পৃশ্যের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছেন। এই পুস্তকগুলিকে আপেক্ষিকভাবে প্রগতিশীল বলা যায় এতৎব্যতীত আরও অনেক কল্পনামূলক নাটক প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে হিন্দু সংস্কৃতির মর্য্যাদার বড়াই আছে। আবার কতকগুলিতে পরোক্ষভাবে হিন্দু সংস্কৃতির উপর আক্রমণও আছে এবং এই অন্যপক্ষে পণ্ডিত মাধব শুক্লের সঙ্গে অবাঞ্ছনীয় কুরুচি ও স্থান পাইয়াছে। “মহাভারত” নামক নাটকে আর্য্য সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্তি প্রকাশ করা হইয়াছে। এই প্রকারের নাটকগুলির মধ্যে কতিপয় পুরাতনের বন্ধন কাটিয়া নূতন যুগের প্রভাবের দিকে ধাবিত হইয়াছে বটে, কিন্তু সেগুলিকে নূতন যুগীয় প্রগতিপন্থী বলা যায় না; অন্যপক্ষে অন্যগুলি প্রাচীনত্বের বড়াই করিয়া প্রগতির পরিপন্থিতা করে।

তৎপর আসে পদ্যের নূতন ধারার উত্থান। ইহার লেখকদের নাম প্রথমে উল্লেখ করা হইয়াছে। এই শ্রেণীর লেখার মধ্যে প্রাচীনের গৌরব ও বর্ত্তমানের অধোগতির তুলনা করিয়া “হায় মা ভারত” বলিয়া বুক চাপড়ান ধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়[৭২]। ইংরেজ শাসন যুগে বাঙ্গলা সাহিত্যের প্রথম উত্থানের সময়ে ও এই ধ্বনি শুনিতে পাওয়া যেত। এই প্রকারের সাহিত্য দেশ ভক্তির পরিচায়ক হইলেও আমরা প্রগতির আদর্শমূলক সাহিত্য মধ্যে গণনা করিতে পারি না।

আধুনিক উপন্যাস ক্ষেত্রে বাবু কিশোরীলাল গোস্বামী ও ধনপৎ রায় (প্রেম চাঁদজীর) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এতদ্ব্যতীত আরো অনেক লেখক আছেন যাঁহাদের মধ্যে কৌশিকজী পারিবারিক ও সামাজিক ভাবপূর্ণ গল্প ও উপন্যাস লিখিয়াছেন; বাবু বৃন্দাবনলাল বর্ম্মা ‘গঢ়কুণ্ডার’ নামক সুন্দর উপন্যাস লিখিয়াছেন—যাহা পণ্ডিত উপাধ্যায়ের মতে হিন্দী সাহিত্যে সেই অভাব পূর্ণ করিয়াছে যেইরূপ Sir Walter Scottএর রচনা ইংরেজী সাহিত্যে পূর্ণ করিয়াছে[৭৩]। স্ত্রীলোক লেখিকার মধ্যে শ্রীমতী তেজরানী দীক্ষিত প্রথম মহিলা। ইঁহার পুস্তকের নাম “হৃদয়কা কাঁটা।” ‘গিরিজানন্দ শুক্লের’ শ্রম কি পীড়া’ ‘বাবু সাহেব’ ‘চাণক্য প্রভৃতি উপন্যাসে ভাবুকতা ও সাময়িকতা পাওয়া যায়।

তৎপর আসে ভাবাত্মক রচনাসমূহ। বঙ্গভাষা থেকে ‘উদ্‌ভ্রান্ত প্রেমের’ ভাব হিন্দী সাহিত্যে বিশেষ প্রতিফলিত হয়। ইহার অনুসরণ করিয়া কিছুদিন পর্য্যন্ত হিন্দী সাহিত্যে প্রেমোদ্গার প্রকাশ পাইতে থাকে[৭৪]। তৎপর রবীন্দ্রনাথের অতীন্দ্রিয়তা ও আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ লেখার প্রভাব হিন্দী সাহিত্যে পড়ে[৭৫]। ইহার ফলে হিন্দী সাহিত্যে “রহস্যবাদের” আলোচনা আরম্ভ হয়। এই প্রকার রচনার মধ্যে কৃষ্ণদাসজীর ‘সাধনা’ ও বিয়োগী হরিজীর ‘অন্তর্নাদ’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শুক্ল মহোদয় বলেন, রবীন্দ্রনাথের রহস্যবাদের প্রভাব হিন্দী সাহিত্যে এক ঝটিকা উত্থাপন করে। ইহার ফলে, শুক্ল বলেন, “না জানি কত যুবকই ‘অনন্ততে বিলীন’ হইবার আকুলতা দেখাইতে থাকে!”[৭৬] শুক্ল বলেন, হিন্দী সাহিত্য দুর্ব্বল বলিয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্ভব হয়। কিন্তু আমাদের অনুমান ইহার কারণ অন্য স্থলে নিহিত আছে। বরং ইহা বলা যাইতে পারে যে, পারিপার্শ্বিক রাষ্ট্রীয় অবস্থার জন্য নবোত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের উন্নতি বা আত্মবিকাশ করিবার সুযোগের অভাবেই অতীন্দ্রিয়বাদ, রহস্যবাদ, আধ্যাত্মিকতার দ্বারা “চোখকে মন ঠেরে” নিজেদের মনোভাবকে গোপন করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। আজকাল হিন্দীভাষায় উপন্যাসের ক্ষেত্র খুব বিস্তৃত হইয়াছে। সেইজন্য সেই উপন্যাসে নানা প্রকারের ভাব-তরঙ্গের উত্থান হইতেছে। কোন উপন্যাসে হিন্দু সংস্কৃতির আমূল পরিবর্ত্তন হইয়াছে—কোনটায় ইহার পৃষ্ঠপোষকতা করা হইয়াছে, কোনটায় হিন্দু সংস্কৃতিকে পূর্ণভাবে ধ্বংস করিতে চেষ্টা করা হইতেছে। কাহারো বিচারে পাশ্চাত্য ভাবের ছাপ পূর্ণমাত্রায় পড়িয়াছে, কেহ বা ভারতীয় ভাবের ভক্ত হইয়াছেন। এইভাবে হিন্দী সাহিত্যে নানা ভাবতরঙ্গ প্রকাশ পাইতেছে[৭৭]; এই সঙ্গে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, শৃঙ্গার রসযুক্ত অশ্লীলতাও সাহিত্যে প্রকাশ পাইতেছে। এই প্রকারের রচনাগুলির মধ্যে কতকগুলি জন (people) ও গণের (masses) বিষয় নিয়া লিখিত হইয়াছে এবং তজ্জন্য তা আপেক্ষিকভাবে প্রগতিশীল বটে, কিন্তু সেগুলির মধ্যে কোন বিশিষ্ট প্রগতিশীল আদর্শের নির্দ্দেশ না থাকায় সেইগুলিকে সামন্ততান্ত্রিক সাহিত্যের পরের যুগের বুর্জ্জোয়া সাহিত্যের অন্তর্গত বলা যায় না।

এতদ্ব্যতীত হিন্দী সাহিত্যে জীবনচরিত, ইতিহাস, ধর্ম্মশাস্ত্র, ভ্রমণ বৃত্তান্ত, অর্থশাস্ত্র, বিজ্ঞান, সমালোচনা প্রভৃতি বিষয়ে পুস্তক প্রকাশিত হইতেছে, কিন্তু এইগুলির অনেকগুলি অনুবাদ মাত্র। ইহাতে মৌলিকত্ব নাই। এক্ষণে বিচার্য্য যে, বর্ত্তমানকালের হিন্দী সাহিত্যের স্বরূপ কি প্রকারের? প্রাচীন চারণ গাথা থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্য্যন্ত হিন্দী সাহিত্যে সামন্ততান্ত্রিক যুগের ছাপ দেখিতে পাই। ইহার অর্থ এই সাহিত্যের মধ্যে রাজারাণী, প্রেম বিরহ, অতঃপর যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদিরই সংবাদ পাওয়া যায় এবং যেখানে রাজারাণীর চিত্রাঙ্কন হয় নাই সেখানে তৎপরিবর্ত্তে জমিদার ও তাহার গৃহিণীকে আনা হইয়াছে। আর এইসব নায়ক নায়িকারাও সামন্ত যুগের দৃষ্টিভঙ্গীতে জগৎকে দেখেন। এই জন্য এই প্রকারের সাহিত্যকে যথার্থ প্রগতিশীল সাহিত্য বলা চলে না। সামন্ততান্ত্রিক যুগের অবসানের পর বুর্জ্জোয়া যুগের অভ্যুত্থানের সঙ্গে যে নূতন সভ্যতার বিবর্ত্তন হয় তা তৎকালীন সাহিত্যে প্রতিভাত হয়। এই যুগে বুর্জ্জোয়া (মধ্যবিত্ত) শ্রেণী সমাজে ও রাষ্ট্রে স্বীয় আধিপত্য স্থাপন করিয়া জগৎকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখে। তখন তাহার ধারণা হয় এই জগৎটা তাহার ভোগের জন্যই সৃষ্টি হইয়াছে। এইজন্যই সে বৈপ্লবিক হয়, এইজন্যই সে সমস্ত অতীতকে মুছিয়া ফেলিয়া নূতন রাষ্ট্র ও সমাজের সৃষ্টি করে যার কেন্দ্রস্থল হয় সে নিজে। এই বুর্জ্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গী নির্দ্দেশসূচক সাহিত্যকে বুর্জোয়া সাহিত্য বলা হয়[৭৮]। এবম্প্রকারের সাহিত্য এখনও হিন্দী ভাষায় বিবর্ত্তিত হয় নি। অর্থাৎ হিন্দী সাহিত্য-ধারার মধ্যে এখনও বুর্জ্জোয়া সাহিত্যের উদয় হয় নি। অবশ্য এই ধারা ভারতের কোনও সাহিত্যেই এখন বিকাশ পায় নি। তাহার কারণ ভারতীয় সমাজে একটা বুর্জ্জোয়া শ্রেণী বিবর্ত্তিত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহা এখনও সমাজে নিজের আধিপত্য বিস্তার করিতে পারে নাই। ভারতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিশেষ কাল-ব্যতিক্রম (anachronism) হইতেছে যে ইহা এখনও সামন্ততান্ত্রিক সভ্যতার ছায়ায় আছে। রাষ্ট্রগত আদর্শ বিষয়ে হয় আমরা “রামরাজত্ব” না হয় “পাকিস্থানের” স্বপ্ন দেখি এবং সমাজকে অতি প্রাচীন পদ্ধতির মধ্যে আবদ্ধ রাখিতে চাই। এই সব কারণের জন্য ভারতীয় সাহিত্যের কোন শাখার মধ্যেই একটী যথার্থ প্রগতিশীল বুর্জ্জোয়া সাহিত্য দেখিতে পাই না। ভারতের পূর্ব্বভাগে বাঙ্গলা সাহিত্যের অনেক সুনাম শুনা যায় কিন্তু এই সাহিত্য এখনও যে জমিদার বাড়ীর ফটক পার হইয়াছে তাহা নিশ্চয়ভাবে বলা যায় না[৭৯]। অবশ্য বাঙ্গলায় একদল তরুণ সাহিত্যিকের উদয় হইয়াছে, তাঁহারা বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর অধস্তন স্তরের, অর্থাৎ গরীব মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত স্ত্রী ও পুরুষের বিষয় নিয়া লেখেন। কিন্তু তাঁহাদের লেখার মধ্যে নূতন সামাজিক আদর্শের কোন নির্দ্দেশ পাওয়া যায় না। তাঁহাদের লেখার মধ্যে বরং Morbidity পাওয়া যায়, অর্থাৎ কেবল আদিরসের বর্ণনায় তাঁহাদের লেখনী পর্য্যবসিত হইতেছে এবং Oedipus Complex-এর অনুসরণ করিয়াই তাঁহারা পরিশ্রান্ত হইতেছেন। তাঁহাদের লেখার মধ্যে একটা বিজাতীয় ভাব স্পষ্টই ধরা পড়ে। এই সাহিত্যিক ভাবধারাও হিন্দী সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত হইতেছে। হিন্দী মাসিক পত্রিকাসমূহে হাল ফ্যাসানের যুবক যুবতী সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হইতেছে যা পড়িলেই অনুমিত হইবে যে ইহা বিলাতীর নকল মাত্র। হিন্দীভাষী হিন্দু সমাজের মধ্যে এ প্রকারের সামাজিক পরিস্থিতি এখনও হয় নি। অন্যপক্ষে অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হইতেছে যাহার মধ্যে ‘জন’ ও ‘গণের’ জীবনী অঙ্কিত হইয়াছে। যথা “হংস” দশম বর্ষ দ্বিতীয় অঙ্ক—"রাধা ও রাধা”—গল্প; “সরস্বতী”[৮০] ১৯৩৬ ডিসেম্বর, “ধরণী কা রাজা” শীর্ষক কৃষক জীবনের করুণ কাহিনী; “হংস” দশম বর্ষ—৩য় অঙ্ক; “ভাগ্যতারা”—ইহা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাল ফ্যাসানের যুবক যুবতীর জীবনী অঙ্কন করার জন্য ইহাকে আপেক্ষিকভাবে প্রগতিশীল বলা যাইতে পারে কিন্তু এবম্প্রকারের প্রবন্ধ দ্বারা একটা বুর্জ্জোয়া ও একটা প্রলেটারীয় সাহিত্য সৃষ্ট হয় না। শেষে আসে প্রেমচন্দ্রজীর উপন্যাসসমুহ। তাঁহার লেখার বিপক্ষে ও স্বপক্ষে অনেক সমর্থক আছেন। পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে প্রেমচন্দ্রজী বর্ত্তমান সময়ের হিন্দী সাহিত্যের একজন বিখ্যাত লেখক ছিলেন। একজন লেখক তাঁহাকে Maxim Gorkyর সঙ্গে সমান দরের লোক বলিয়া তুলনা করিয়াছেন[৮১]। গর্কী সমাজ ও রাষ্ট্রে একটি বিশিষ্ট নির্দ্দেশ দিয়াছেন কিন্তু প্রেমচন্দ্রে তাহা পাই না। অন্যপক্ষে আর একজন সমালোচক বলিয়াছেন যে, প্রেমচন্দ্রের লেখা পড়িয়া বোধ হয় যে জায়গীরদারী সভ্যতার প্রতি কিঞ্চিৎ স্নেহ তাঁহার হৃদরে এখনও বর্ত্তমান। এই স্নেহ পুরাতন সভ্যতার ধ্বংসের বর্ণনায় প্রকাশ পায়[৮২]। আবার বর্ত্তমান যুগের সভ্যতা যাহা ‘মহাজনী সভ্যতা’ বলিয়া প্রেমচন্দ্র নামকরণ করিয়াছেন—তাহার বীভৎসতা তিনি নগ্নরূপে লোকের কাছে ধরিয়াছেন। এই জন্য ইহাকে আপেক্ষিকভাবে প্রগতিশীল বলা যাইতে পারে। প্রেমচন্দ্রজীর ‘গবন’ নামক উপন্যাস গরীব মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন উপলক্ষ্য করিয়া লিখিত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাঁহার রমানাথবাবু, মীরা, রমেনবাবুর স্ত্রী প্রভৃতি কতটা মধ্যদেশের হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি তা বিবেচনা করিবার বিষয়। অন্যপক্ষে ‘গোদান’ ঐ স্থানের কৃষক জীবনের চিত্র প্রদান করে। আধুনিক হিন্দী গল্প সাহিত্য পড়িয়া ইহাই মনে হয় যে, বাঙ্গলা ভাষায় যে অস্বাভাবিক ও বৈদেশিক ভাবপূর্ণ সাহিত্য যা কেবল ‘এডিপুস কম্‌প্লেক্স’ এর চিত্রণেই ব্যস্ত, তারই হুবহু নকল হিন্দী সাহিত্যে আমদানী করা হইতেছে। এই সব গল্প পড়িয়া পাঠক ঠাহর করিয়া উঠিতে পারেন না যে, আখ্যায়িকাটি কলিকাতার বালিগঞ্জ অঞ্চলে সংঘটিত হইতেছে কি পশ্চিমের কোন সহর বা গ্রামে। বুর্জ্জোয়া সাহিত্য এখনও ভারতে উদয় হয় নাই—হিন্দীতেও না। পক্ষান্তরে ভারতীয় সাহিত্য মধ্যে গণসমূহের আদর্শ অনুযায়ী সাম্যবাদীয় গল্প প্রকাশ পাইতেছে। তাহা যুগপৎ সামন্ততান্ত্রিক ও বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর বিপক্ষে ভাব প্রকাশ করিতেছে। অবশ্য এ ‘প্রলেটারিয়েট’ সাহিত্য ও নয়। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের বিবর্ত্তনের উপরেই ভবিষ্যতের সাহিত্য নির্ভর করিবে।

  1. Grierson—Linguistic Survey দ্রষ্টব্য।
  2. তিনি হিন্দুর ভাষা অর্থে হিন্দী ও হিন্দুবী দুই শব্দ‍ই ব্যবহার করিয়াছেন। তাঁহার “খালিকবারী” দ্রষ্টব্য।
  3. Elliot—“History of India told by her own Historians” এবং উপাধ্যায়—হিন্দীভাষা ঔর উসকে সাহিত্যকা বিকাশ, পৃঃ ৪৯ দ্রষ্টব্য।
  4. রামনরেশ ত্রিপাঠী—কবিতা কৌমুদী ৪র্থ ভাগ, উর্দ্দু, পৃঃ ২।
  5. রামনরেশ ত্রিপাঠী—কবিতা কৌমুদী ৪র্থ ভাগ, উর্দ্দু পৃঃ ১। গ্রিয়ারসন ও দ্রষ্টব্য।
  6. প্রাচীন মুসলমান লেখকেরা “জবানে হিন্দোস্তান” হিন্দী বা হিন্দুবী বলিয়া হিন্দুর ভাষার নামকরণ করেন। সূর্য্যকান্ত শাস্ত্রীর “হিন্দী সাহিত্যকা বিবেচনাত্মক ইতিহাস”, পরিশিষ্ট পৃঃ ২৬ দ্রষ্টব্য।
  7. আরা ও গোরক্ষপুর জেলার লোকদের কাছ থেকে লেখক শুনিয়াছেন যে, বাংলা ভাষা দেবনাগরীতে লিখিতে হইলে তাঁহারা বুঝিতে পারেন।
  8. পণ্ডিত হাজারীপ্রসাদ দ্বিবেদী শাস্ত্রাচার্য্য বলেন “প্রকৃত প্রস্তাবে সৌরসেনী ও মাগধী ভাষাভাষী আর্য্যদের আচার ব্যবহার এবং স্বভাব অনেক বিভিন্ন ছিল।”
    —হিন্দী সাহিত্যকা ভূমিকা পৃঃ ১৭। 
  9. “আর্য্য মঞ্জুশ্রী মূলকল্প” দ্রষ্টব্য।
  10. কয়েক বৎসর পূর্ব্বে কয়েকজন মৈথিলী ছাত্র লেখকের নিকট অনুযোগ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, তথাকার বিশ্ববিদ্যালয় তাহাদের হিন্দী ভাষা শিখিতে বাধ্য করিয়াছে ও তাহাতে তাহাদের মাতৃভাষা মৈথিলী ভুলিতে হইয়াছে। উপস্থিত তাহাদের মাতৃভাষা শিক্ষা করিবার অনুমতি প্রদান করা হইয়াছে বলিয়া শ্রুত হয়।
  11. শুক্ল—“হিন্দী সাহিত্য কা ইতিহাস”—পৃঃ ৮।
  12. K. T. Butler—“A History of the French Literature”.
  13. Sorokin—“Social and Cultural Dynamics”. Vol. I. pp. 595-96.
  14. সরোকিন এই তিনটি পর্য্যায়ের যথাক্রমে নিম্নলিখিতরূপ ব্যাখ্যা দিয়াছেন। যথা:—(১) যে সাহিত্যে অদৃশ্য জগৎ, পরীক্ষামূলক জ্ঞান ও বাহ্যেন্দ্রিয়ের অতীত বস্তু, যাহাতে শব্দ ও মূর্ত্তিসমূহ এই জগতের প্রতীক মাত্র বলিয়া আলোচিত হয়—উহা Ideational, (২) যে সাহিত্যে পরীক্ষামূলক জ্ঞান (empirical knowledge) প্রসূত অনুষ্ঠানসমূহকে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বলিয়া গ্রহণ করা হয়, উহা Sensate or Impressionist. (৩) আর এই দু’য়ের মিশ্রিত সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে Idealistic বা Mixed বলা হয়। সরোকিন পৃঃ ৫৯৫—৫৯৭।
  15. “History of Sanskrit Literature” দ্রষ্টব্য।
  16. P. N. Banerjea—“Public Administration in Ancient India”.
  17. সূর্য্যকান্ত শাস্ত্রী—“হিন্দী সাহিত্যকা বিবেচনাত্মক ইতিহাস”—পৃঃ ৩।
  18. শুক্ল—হিন্দী সাহিত্যকা ইতিহাস পৃঃ ২৪।
  19. সম্রাট সাহাজানের পাঠান সেনাপতি খাঁ জাহান লোদীর আদেশানুসারে ফার্সী ভাষায় নিয়ামৎউল্লা নামক এক ব্যক্তি আফগানদের একটি ইতিহাস রচনা করেন। Dorn ইহা ইংরেজীতে “History of the Afghans” নাম দিয়া অনুবাদ করেন। ইহাতে উল্লিখিত আছে যে, ঘোরের এক রাজবংশীয় লোকের সঙ্গে তথাকার বাজার বিবাদ হয়। ইহাতে সেই লোকটির জীবন সংশয় হওয়ার তিনি দিল্লীতে পলায়ন করিয়া এক মন্দিরে তিন বৎসর লুকাইয়া ছিলেন। ইহা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পৃথ্বীরাজের পতনের পূর্ব্বের ঘটনা। অনুমান হয়, এই ঘটনাই “রাসো”তে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। আর ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, সাহাবুদ্দীনকে গক্করেরা হত্যা করিয়াছিল। এখন উভয় কাহিনী একত্রিত করিলে অনুমান হয় “রাসো” বর্ণিত এই ঘটনার ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর “Last Days of Mughal Empire” পুস্তকে বলিয়াছেন যে, কোন গক্কর সর্দ্দার তাঁকে বলিয়াছেন যে, এই ঘটনা গক্করদের দ্বারা সংঘটিত হয় নাই। ইহা কক্কররা করিয়াছিল। গক্করেরা একটি পঞ্জাবী জাতি। পেশোয়ারের যুদ্ধে অনঙ্গ পালকে মামুদ পরাজয় করিবার পর গক্করদের জোর করিয়া মুসলমান করা হয়। কিন্তু আজ তাঁহারা বলেন যে, তাঁহারা মামুদের সঙ্গে পারস্যদেশ থেকে ভারতে আসিয়াছিলেন। লেখক অনুমান করেন যে, গক্করদের দ্বারাই খুব সম্ভবতঃ ঘোরী নিহত হইয়াছিলেন আর নিয়ামৎউল্লার ইতিহাস পাঠে এই প্রতীতী হয় যে, এই সময়ে হিন্দুর অস্পৃশতা দোষ এত প্রবল হয় নি। আবার শেখ শাদিব “বোস্তানে” বর্ণিত ঘটনা যে, সোমনাথের মন্দিরের গর্ভগৃহে তথাকার পাণ্ডারা তাঁকে এক রাত্রি রাখিয়াছিল তাহা পড়িয়া এই বিশ্বাস দৃঢ়ীভূত হয়। এখানে ইহা উল্লিখিত হইতে পারে যে, ঘোরীরা ইরাণী বংশসম্ভূত বলিয়া দাবী করিতেন। আফগানীস্থান হইতে যাঁহারাই আসেন তাঁহারাই “পাঠান” নহেন।
  20. বর্ত্তমানের সমালোচকেরা বলেন এই ‘রাসো’ আকববের দরবারে লিখিত হইয়াছিল; সেই জন্যই বোধ হয় তুর্কির বদলে ‘মোগল’ শত্রুর কথা ভূল ক্রমে এই স্থলে উল্লিখিত হয়।
  21. শ্রীরামকুমার বর্ম্মী—“হিন্দী সাহিত্যকা আলোচনাত্মক ইতিহাস” পৃঃ ৭৩-৭৬।
  22. হালে ভাসের নাটকসমূহ আবিষ্কৃত হইয়াছে বলিয়া পণ্ডিত মহলে তাঁর নাম সুপরিচিত হইয়াছে। বিদেশীয় পণ্ডিতদের মুখে একথা শুনা গিয়াছে যে ভারতবর্ষ ভাসকে কি করিয়া ভুলিয়া গিয়াছিলো। এই হিন্দী পুস্তকেই দেখা যায় যে এই পুস্তক লিখিত হইবার সময়ে ভারতীয় কবিরা ভাসকে ভোলেন নি
  23. শ্রীরামকুমার বর্ম্মা—হিন্দী সাহিত্যকা আলোচনাত্মক ইতিহাস: পৃঃ ৮৫-৮৭।
  24. শ্রীরামকুমার বর্ম্মা—হিন্দী সাহিত্যকা আলোচনাত্মক ইতিহাস: পৃঃ ১০১।
  25. K. P. Jayswal-এর মতে বনাফরেরা বুন্দেলখণ্ড নিবাসী একটি পতিত জাতি, রাজপুতেরা এদের সঙ্গে বিবাহ সম্বন্ধাদি করিতে চায় না। ইনি বলেন এরা শক প্রভূত্বকালে বানসফবস নামে হুনবংশীয় বেনারসের গভর্ণরের বংশধর। ইহা যদি সত্য হয় তাহা হইলে দেখা যায় যে, মহোবার পতনের পর ইহাদের কী সামাজিক অধঃপতন হইয়াছে।
  26. শ্রী রামকুমার বর্ম্মা—হিন্দী সাহিত্যকা আলোচনাত্মক ইতিহাস। পৃঃ ১০৬।
  27. হালে রংপুর থেকে মহীপালের গীতের কিয়দংশ আবিষ্কৃত হইয়াছে।
  28. Zimmer—“Alt indisches Leben” দ্রষ্টব্য।
  29. Fick—“Social Organisation of North-eastern India in the time of Buddha,”
  30. Vedic Index দ্রষ্টব্য।
  31. চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়—“কবিকঙ্কণ চণ্ডী” ২য় ভাগ, পৃঃ ৯৭২ দ্রষ্টব্য।
  32. আবুল ফজল এবং অন্যান্যেরা ঘোরীর মৃত্যু সম্বন্ধে হিন্দুদের সংবাদেরই পোষকতা করেন—K. K. Basu—“The Tarik-j-Mubarakshahi” ইংরেজী অনুবাদ, পৃঃ ১৩ ফুটনোট দ্রষ্টব্য।
  33. শুক্ল—হিন্দী সাহিত্যকা ইতিহাস, পৃঃ ৬৩—৬৪ দ্রষ্টব্য;
    বর্ম্মা—হিন্দী সাহিত্যকা ইতিহাস, পৃঃ ১৫-১৬ দ্রষ্টব্য।
  34. বর্ম্মা ঐ—পৃঃ ১২৬
  35. “Mahaffy: Greek Thought and Culture.”
  36. Percy Browne: “Literary History of Porsia” দ্রষ্টব্য।)
  37. শ্রী নলিনী ভট্টশালীর দ্বারা আবিষ্কৃত “মীন-চেতন” দ্রষ্টব্য।
  38. B. N. Datta: “Mystic Tales of Lama Taranatha” পৃঃ ৫৬।
  39. B. N. Datta: “Mystic Tales of Lama Taranatha” পৃঃ ২৬।
  40. দীনেশচন্দ্র সেন: “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য”।
  41. বর্ম্মা—ঐ পৃঃ ২৪২
  42. বর্ম্মা—পৃঃ ২২৭
  43. কবীর গ্রন্থাবলী—নাগ্‌রী প্রচারিণী সভা—পৃঃ ১৮১
  44. “শ্রীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন বলেন, ‘কতকগুলি প্রবল প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে যে, দাদু ছিলেন মুসলমান; আর তাঁর পূর্ব্ব নাম ছিল ‘দাউদা’,” পৃঃ ১৮—
  45. ক্ষিতিমোহন সেন—“দাদু”—উপক্রমণিকা পৃঃ ১৩।
  46. Quoted in “History of Moslem Rule” by Dr. Iswari Prasad: pp. 625-627.
  47. J. Nehru—“Glimpses of World Ilistory.” pp. 500 দ্রষ্টব্য।
  48. “দরিয়া সাহেব কী” বাণী—খৃঃ ৫৭ দ্রষ্টব্য।
  49. হাজারীপ্রসাদ দ্বিবেদী শাস্ত্রাচার্য্য—ইনি বলেন যে, সন্ত মত প্রাচীন যোগী মতেরই বংশোদ্ভব। ইসলাম প্রভাব প্রসূত নহে। —“হিন্দী সাহিত্যিকী ভূমিকা” পৃঃ ৩০ দ্রষ্টব্য।
  50. Von Kraemer—“Islamische stroifzuege.”
  51. জগবন্ধু ভদ্র —“গৌরভক্তি তরঙ্গিণী” দ্রষ্টব্য।
  52. বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রিপোর্ট। সতীশ রায় “শ্রীপদকল্পতরু” ৫ম খণ্ডে কতকগুলি এই প্রকারের কবির পদাবলী উদ্ধৃত হইয়াছে।
  53. এই বিষয়ে Wahed Hussain’s University Extension Lectures on Sufism P. 27 দ্রষ্টব্য।
  54. “আকবরনামা” দ্রষ্টব্য।
  55. টডের রাজস্থানে চিতোরের রাণী পদ্মিনীর জন্মস্থান সিংহলে বলা হইয়াছে। ভাটদের কথা অনুযায়ী কর্ণেল টড তাহা পশ্চিম ভারতেই নির্দ্দেশ করিয়াছেন, কিন্তু লণ্ডন হইতে প্রকাশিত “Rajput” নামে অধুনালুপ্ত মাসিক পত্রিকা এবং “Who are the Rajputs” নামক পুস্তকের রচয়িতা যশোরাজ সিং শিশোদিয়া লেখককে বলিয়াছিলেন যে টড ভুল করিয়াছেন। তিনি অনুসন্ধান করিয়া ইহা নির্দ্ধারণ করিয়াছেন যে, এই সিংহল ভারত মহাসাগরের Ceylon Island. তিনি Kandy-র আশে পাশে কৃষকদের মুখে যে গান শুনিয়াছেন তার অর্থ এই যে, “পদ্মাবতী যে গেল আর ফিরলো না।” আর জায়সীর পুস্তকে ইহাকে সিংহল দ্বীপের রাজকুমারী বলা হইয়াছে। ইহা যদি ঠিক হয়, তাহা হইলে বুঝা যায় যে, তখনও হিন্দুর জাতিভেদের কড়াকড়ি ছিল না এবং বৌদ্ধদেরও সঙ্গে বিবাহ চলিত।
  56. শুক্ল—পৃঃ ১১৮
  57. তুলসী গ্রন্থাবলী—১ম খণ্ড “রামচরিত মানস” পৃঃ ১৭।
  58. তুলসী গ্রন্থাবলী—১ম খণ্ড “রামচবিত মানস” পৃঃ ৪৫০
  59. শুক্ল—পৃঃ ১৪৭
  60. মীরাবাইকা শব্দাবলী—পৃঃ ৩৬।
  61. মীরাবাঈকা শব্দাবলী—পৃঃ ৫৮।
  62. মীরাবাঈকা শাব্দবলী—পৃঃ ৬০।
  63. শুক্ল—পৃঃ ২৩৯।
  64. শুক্ল—পৃঃ ২৪৩।
  65. শুক্ল—পৃঃ ৫০৩।
  66. শুক্ল—পৃঃ ৪৯৭।
  67. শুক্ল—পৃঃ ৫১৯
  68. শিবপ্রসাদ ভারতীয় গবর্ণমেণ্টপন্থী এবং স্যার সৈয়দ আমেদের সহিত মিলিত হইয়া ভারতীয় কংগ্রেসের ঘোর বিপক্ষতাচরণ করিতেন।
  69. শুক্ল—পৃঃ ৫৬১—৫৬২
  70. শুক্ল—পৃঃ৫৭২—৫৭২
  71. শুক্ল—পৃঃ ৫৯৩
  72. শুক্ল—পৃঃ ৬৩৯
  73. পণ্ডিত অযোধ্যা সিংহ উপাধ্যায়—“হিন্দী কা ভাষা ঔর ঔস্‌কে সাহিত্যকা বিকাশ” পৃঃ ৬
  74. শুক্ল—পৃঃ ৬০৭।
  75. শুক্ল—পৃঃ ৬০৭।
  76. শুক্ল—পৃঃ ৬৮৩।
  77. উপাধ্যায়—পৃঃ ৬৯৬
  78. উদাহরণস্বরূপ ফরাসী বিপ্লবের পরের ফরাসী সাহিত্য এবং আমেরিকার সংযুক্ত রাষ্ট্রের সাহিত্য।
  79. স্বর্গীয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বিপ্রদাস’ দ্রষ্টব্য।
  80. বঙ্গভাষাতেও এবম্প্রকারের প্রগতিমূলক সাহিত্য সৃষ্টি হইতে আরম্ভ হইয়াছে। শ্রীতারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি লেখকগণ তাঁহাদের অন্যতম।
  81. হংস—দশম বর্ষ ৩য় অঙ্ক ডিসেম্বর—১৯৩৬ চন্দ্রভান জোহরী দ্বারা “মৈক্সিম গর্কী ঔর উস্‌কি অমর কীর্ত্তি মা”—পৃঃ ২১৪
  82. মাধুরী—সেপ্টেম্বর পৃঃ ১৯৩৯—শ্রীরামবিলাস শর্ম্মার ‘মহাজনী সভ্যতা’ দ্রষ্টব্য।