সাহিত্য-চিন্তা/আর্য্যজাতির পতনের কারণ
আর্য্যজাতির পতনের কারণ
সে কি শুভদিন! যেদিন সুদূর মধ্যএশিয়ার মরুপ্রান্তর ও নিবিড় শৈলমালা অতিক্রম করিয়া আর্য্যজাতি শস্য শ্যামলা ভারতমাতার স্নেহক্রোড় অলঙ্কৃত করেন, যেদিন মনুষ্যনামধারী শোণিতপিপাসু দ্বিপদ ও চতুষ্পদ জীব এবং বিহঙ্গকাকলী মুখরিত বনভূমি সেই পিতৃপুরুষদের পদরেণুতে পূততম হইয়া উঠিয়াছিল, সেকি শুভদিন নয়?
সেই স্মরণীয় মাহেন্দ্রক্ষণে যদিও আর্য্যগণ বিপ্লব বাত্যাতাড়নে সিন্ধুনদের নির্ম্মল সলিল আন্দোলিত করিয়াছিলেন, মধুময়ী প্রকৃতিদেবীর পুষ্পাভরণ ছিন্নবিছিন্ন হইয়াছিল, শান্তশ্যামকান্তার শোভী তরুলতা গুল্ম বিদলিত করিয়া তাহাদের করধৃত বিজয় বৈজয়ন্তী অনস্ত নীল আকাশে উড্ডীন হইয়াছিল, যদিও অরণিসম্ভূত অগ্নিশিখার ন্যায় বহুঘাত প্রতিঘাতের ও সংঘর্ষণের ফলে তাঁহাদের জাতীয় জীবনরূপ অনল স্ফুলিঙ্গ অর্জ্জিত হইয়াছিল এবং ভারতবর্ষের উর্ব্বরভূমিতে এক মহাশক্তির বীজ তাঁহারা স্বহস্তে রোপণ করিয়াছিলেন, তথাপি তাঁহারা শাস্তিরই উপাসক ছিলেন। চিরকল্যাণালয় ভগবৎ চরাণাশ্রিতা শ্রীর সহিত তাঁহারা শান্তিকে ন্যায়ের মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। অবিরাম পরিশ্রম এবং প্রাণপাত দ্বারা যে জাতীয় শক্তির হুতাশন উদ্ভূত তাহা সাম্য মৈত্রী এবং তিতিক্ষার হবিদ্বারা পবিত্রীকৃত এবং পরিবর্দ্ধিত হইয়াছিল। ইহাই তাঁহাদের উন্নতির মূল সূত্র। ইহাদ্বারাই তাঁহাদের হোমাগ্নির দীপ্ত-আলোক উজ্জ্বলতর হইয়াছিল।
আর্য্যগণ স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত থাকিলেও কল্যাণময়ী মৈত্রীই তাহাদের অনন্ত উন্নতির তীর্থযাত্রা সুগম করিয়া দিয়াছিল,—এবং কণ্টকাকীর্ণ পথকে অতি কোমল হস্তে পরিস্কৃত করিয়া অসাধ্যসাধনে রত রাখিয়াছিল। তাঁহারা জানিতেন, সাম্য ও মৈত্রী ভিন্ন সমাজশক্তিরূপ হর্ম্ম্যের ভিত্তি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। তাই তাঁহারা এক হস্তে স্বাধীনতার পতাকা এবং অপর হস্তে প্রীতির সুরভি পুষ্পমাল্য লইয়া কীর্তির মণিমণ্ডিত সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এবং আপনাদের বল অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। এই প্রীতির মন্ত্রেই তাঁহারা সহস্র সহস্র দুর্দ্ধষ অনার্য্যজাতিকে স্ববশে আনিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। নতুবা কেবল অস্ত্রবলে কখনই তাঁহারা ভারতবর্ষে একাধিপত্য স্থাপন করিতে সমর্থ হইতেন না।
উদার ধর্ম্ম ভীরুতাই তাহাদের উন্নতির প্রধান ভিত্তি ছিল। যখন তাঁহারা নির্ম্মল সৌন্দর্য্যে অপরিসীম মহাশক্তির পরিচয় পাইয়া স্তম্ভিত হইতেন, এবং তাহার পূজা করিতেন, তখনও তাঁহাদের অকপট উদার ধর্ম্ম-ভীরুতার পরিচয় পাওয়া যায়।
“হে অগ্নি আমাদিগকে কর্ম্মফল ভোগের দ্বারা সুপথে লইয়া যাও; হে দেব তুমি সমুদয় কর্ম্ম জ্ঞাত আছ। আমাদের মন হইতে কুটীল পাপ দূর কর। তোমাকে বার বার নমস্কার করি।”
আর্য্যগণ ক্রমে ক্রমে কি প্রকার সাধনার উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিয়াছিলেন, আমাদের উপনিষৎ গীতা প্রভৃতি গ্রন্থসমূহ তাহার সাক্ষীস্বরূপ বর্ত্তমান রহিয়াছে। সুরনন্দন নির্বাসিনী দিব্যাঙ্গনার ন্যায় সাম্য মৈত্রী তাঁহাদের সাধন-মন্দির আলোকিত করিয়া প্রীতির বীণার যে মধুর গীতিধ্বনি উত্থিত করিয়াছিল, তাহার প্রতিধ্বনি আজিও কালের গভীর আবরণ ভেদ করিয়া প্রকৃতির মর্ম্মে মর্ম্মে বাজিয়া উঠিতেছে।
মানবসমাজের অর্দ্ধেকই নারীশক্তি, ইহা কাহারো অবিদিত নাই। পুরুষ ও নারীশক্তি সংমিশ্রণে সমাজের পূর্ণতা সাধিত হয় একথা আর্য্যগণ যে সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন আমাদের শাস্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থগুলি তাহার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। এই নারীশক্তির বিকাশ সাধনই তাঁহাদের উন্নতির অন্যতম কারণ। গুণে জ্ঞানে শৌর্য্যে বীর্য্যে সমাজে নারীচরিত্রের কি প্রকার উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছিল উমাচিত্র তাহার উজ্জ্বলতম আদর্শ।
যেদিন হিমানিমণ্ডিত হিমাদ্রির সুশোভন-কাননে পবিত্র-সলিলা কলোনাদিনী মন্দাকিনীতীরে ব্রতধারিণী কুমারী উমা তপস্যা নিরত ছিলেন,—নিদাঘের প্রখর রবিতাপে অনলবেষ্টিতা, প্রাবৃটের অবিরলধারা সেবিতা, শীতঋতুর প্রচণ্ড শীত সহিষ্ণুতা তাহার অপূর্ব্ব তপ প্রভাব পরিবর্দ্ধিত করিয়াছিল; যেদিন সেই কুমারীমূর্ত্তি গৃহিণীপদে অভিষিক্তা, পতিপুত্র কন্যা পরিবেষ্টিতা সুগৃহিণী সু-মাতা ও পতিব্রতার আদর্শরূপে মহাযোগীর পাশে যোগিণী বেশে গভীর ধর্ম্মালোচনায় রত, জগজ্জনীরূপে জগতবাসীর হিতরত, আবার যখন সেই কল্যাণদায়িনী মাতৃমূর্ত্তি সংহারিণীবেশে সমরক্ষেত্রে অবতীর্ণা, অবিচার অত্যাচার দমনে করবাণ হস্তে অসুর দলনে নিরতা, সে দিনের কথা স্মরণ করিয়া সেই মহামহিমাময়ী নারীমূর্ত্তি মানসচক্ষে দর্শন করিয়া ভক্তিতে ভয়ে বিস্ময়ে পরিপ্লুত হই এবং তদানীন্ত আর্যসমাজের সর্ব্বাঙ্গীন বিকাশ উপলব্ধি করিতে পারি। যদি কেহ এই দেবীচিত্র কল্পনার বস্তু বলিতে চাহেন তথাপি সমাজের উচ্চ আদর্শের বাস্তবতা স্বীকার করিতে হইবে। বাস্তবের ভিত্তি ভিন্ন কখনও কল্পনা তিষ্ঠিতে পারে না। বেদেও এইরূপ শক্তিশালিনী নারীচিত্রের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। বেদের অনেক শুক্ত যে নারী-রচিত তাহা সুবিদিত। পদ্মাসনা বাণীর পুষ্পোদ্যান হইতে তাঁহারা যে সুরভি পুষ্প চয়ন করিয়া অপূর্ব্ব মাল্য রচনা করিতেন তাহার সৌরভ আজিও বিশ্ব সাহিত্যকে আমোদিত করিতেছে।
আর্য্যগণ নারীকে কি প্রকার শ্রদ্ধা ও সম্মানের চক্ষে দর্শন করিতেন অনেক স্মৃতি শাস্ত্রে তাহার প্রমাণ দর্শন করা যায়। মহর্ষি অত্রি বলিয়াছেন, “চন্দ্র গন্ধর্ব্বগণ ও অঙ্গিরা স্ত্রীদিগকে শুচিতা দান করিয়াছেন এবং অগ্নি সর্ব্বশুচিতা দান করিয়াছেন। অতএব স্ত্রী সর্ব্বদাই পবিত্র।”
স্ত্রী জাতি যে সর্ব্বদাই পবিত্রতা এবং নীতির আদর্শ প্রাণপণে রক্ষা করেন মহর্ষি পরাশরও ইহা অস্বীকার করেন নাই। তিনি বলিয়াছেন “স্ত্রীজাতি বালিকাই হউক আর বৃদ্ধাই হউক, তাহারা কদাচ অপরিত্র হয় না।”
প্রজাপতি দক্ষ ও সাধ্বী স্ত্রীকে অতিশয় উচ্চে আসন প্রদান করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, “যে স্ত্রী স্বামীর অনুকূলতাচরণ করে ও বাক্যদোষ রহিত, কার্য্য দক্ষা সতী, মিষ্টভাষিণী ও আপনা আপনি ধর্ম্ম রক্ষা করেন এবং পতিভক্তিমতি, সে স্ত্রী মনুষ্য নয় দেবতা সদৃশী।”
আর্য্যগণ যদিও অনার্যদিগকে পরাভূত করিয়াছিলেন তথাপি তাঁহারা সর্বদাই অনার্য্যদিগকে সখ্য বিবাহাদির দ্বারা প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করিতে যত্নবান হইতেন এবং তাহাদিগকে আর্য্য সমাজের অঙ্গীভূত করিয়া লইতেন এই সম্প্রসার নীতিই আর্য্যগণের উন্নতির একটী প্রধান কারণ ছিল এবং তাহাতেই তাঁহাদের শক্তি বিশ্ববিজয়িনী হইয়া উঠিয়াছিল।
অনেক স্থানে নিম্ন শ্রেণীস্থ ব্যক্তিদিগকে তাঁহারা অতি উচ্চ আসন প্রদান করিয়াছিলেন। শৌনক প্রভৃতি জগৎ পূজ্য মহর্ষিগণ মহাপণ্ডিত ও সূতপুত্র উগ্রস্রবার নিকট পুরাণ শ্রবণ করিয়াছিলেন। এমন কি শূদ্রগণ ও বেদ রচনায় অধিকারী ছিলেন।
যে আর্য্য জাতি জগতে শ্রেষ্ঠতম শক্তিরূপে পরিগণিত ছিলেন, যে ভারতবর্ষ ধরণী রাণীর মুকুটভূষণ দুলর্ভ স্পর্শ মণিরূপে শোভা পাইত, যাহার স্পর্শে বিশ্ব ভাণ্ডারের কত কত লৌহ স্বর্ণে পরিণত হইয়াছে কি প্রকারে তাহার এরূপ অধঃপতন ঘটিল? তাহার হেতু কি?
জাতি বিদ্বেষই তাহার প্রধান কারণ বলিয়া অনুমিত হয়। যখন ভারতবর্ষে ধীরে ধীরে উচ্চ ধর্ম্ম সাধনা শিথিল হইয়া আসিতেছিল যোগ, জ্ঞান ভক্তির সাধন কতকগুলি লৌকিক আচার নিয়মে পরিবর্ত্তিত হইতেছিল, সেই সময়ে জাতিবিদ্বেষ সমাজ বক্ষের অন্তস্তলে প্রবেশ করিয়া বিষ কীটের ন্যায় তাহাকে দংশন করিতে প্রবৃত্ত হইল। যে মহাপুরুষগণ নিম্ন শ্রেণীস্থ কোনও কোনও ব্যক্তিকে ব্রাহ্মণেরও শ্রেষ্ঠ আসন প্রদান করিয়াছিলেন, উত্তর কালে তাঁহাদের বংশধরগণ নিম্ন জাতীয় ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে কি প্রকার অনুশাসন প্রচলিত করিলেন তাহা স্মরণ করিতেও শরীর শিহরিয়া ওঠে।
ঋষিগণের নিকট পুরাণ পাঠক সূত পুত্র উগ্রশ্রবার বিষয় ইতিপূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে। কুরুসভায় সমাগত শ্রীকৃষ্ণ সমাজের মুকুট ভূষণ বহু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়কে উপেক্ষা করিয়া শূদ্রী-গর্ভ-সম্ভূত বিদূরকে কিরূপ সম্মানিত করিয়াছিলেন তাহা কাহারও অবিদিত নাই।
যেদিন হইতে আর্যসমাজ জাতিবিদ্বেষের লৌহপ্রাচীরে অবরুদ্ধ হইয়া কোটী কোটী নিরজাতীর ভারতসন্তান হইতে পৃথক হইয়া পড়িলেন যেদিন অহমিকার কুজ্ টিকায় প্রকৃত ধর্ম্মতত্ত্ব সমাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল সেদিন জাতীয় উন্নতির সুবিশাল দুর্গের ভিত্তিমূল—যাহা সহস্র সহস্র বৎসরের কঠোর সাধনায় গঠিত হইয়াছিল তাহা প্রবল ভূকম্পনে কম্পিত হইয়া উঠিল। আবার যেদিন নারীশক্তি উপেক্ষিত হইল নারীকে পিঞ্জরাবদ্ধ বিহঙ্গের ন্যায় অবরুদ্ধ রাখিয়া মনুষ্যের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইল, শিক্ষার পথ তাহাদের নিকট অবরুদ্ধ হইল, সেদিন ভারতের উন্নতির সমুচ্চ প্রাসাদ সকল একেবারে ভূমিসাৎ হইয়া গেল।