সাহিত্য-চিন্তা/প্রকৃত বন্ধুতা

প্রকৃত বন্ধুতা

 আজ বাসন্তী পূর্ণিমা। সন্ধ্যার পূর্ব্বে আশ্রমের ছাদের উপর প্রিয়নাথ একাকী উপবিষ্ট। দুই একটি শ্রান্ত বিহঙ্গম মাথার উপর দিয়া কুলায় অন্বেষণে চলিয়া গেল। ক্রমে জবা কুসুমপ্রতিম দিবাকর অস্তাচল চূড়ায় আরোহণ করিলেন। সূর্য্যাস্তের কি অপরূপ শোভা! নীলআকাশে কে যেন সোণা ঢালিয়া দিল। সে সোণালী আভায় ধরণী রঞ্জিত হইয়া উঠিল। প্রিয়নাথ অনিমেষ নয়নে অস্তগামী রবির ভুবনমোহন কান্তি দর্শন করিতে লাগিলেন।

 প্রকৃতির মহিমাময় দৃশ্য দেখিতে দেখিতে তাঁহার মানস-পটে একটি জীবন্ত চিত্র ভাসিয়া উঠিল। সেই মহাপুরুষের জটাবিলম্বিত,—বিভূতি-ভূষিত,—জ্যোতির্ম্ময় মহামহিমান্বিত মূর্ত্তি! এ মূর্ত্তি যেন তাঁহার হৃদয়কে সম্পূর্ণরূপে অধিকার করিয়া বসিয়াছে। মানস-চিত্রপটে স্মৃতির-তুলিকায় রঞ্জিত এ ছবি দেখিতে দেখিতে ক্রমে বাহ্য জগৎ বিস্তৃত হইলেন।

 তিনি ভাবিতে লাগিলেন, —“জ্ঞান-সমুদ্র মন্থন করিয়া কুলের চিহ্নও তো দেখিতে পাইতেছি না। এ যে অনন্ত, অপার। কিছুতেই প্রাণ তৃপ্ত হইতেছে না। শ্রুতিতে পাঠ করিয়াছি, ভগবান্ একমাত্র সুখস্বরূপ— আনন্দময়। তাহার একবিন্দুও পাইতেছি না কেন? দিবানিশি গভীর জ্ঞানালোচনায় আমার প্রাণ আনন্দে পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে কই? সেই পূর্ণানন্দ তবে কোথায়? তাঁহাকে কেমন করিয়া লাভ করিব? বোধ হয় নির্জ্জন গিরিকন্দরে সাধনা করিলেই সে পরমান্দস্বরূপের দর্শন লাভ হইবে। লোককোলাহলই যত অনিষ্টের মূল। জন-সমাজ ত্যাগ না করিতে পারিলে আমার সকলই বৃথা।”

 প্রিয়নাথ ভ্রান্তিবশতঃ বুঝিতে পারিলেন না যে, যোগ ও কর্ম্ম ভিন্ন সমস্ত সাধনাই নিষ্ফল। আমরা জগতের সকল মহাপুরুষগণকেই দেখিতে পাই, তাহারা জ্ঞান, ভক্তি, কর্মের সম্মিলিত ভিত্তির উপর আজীবন দণ্ডায়মান।

 প্রিয়নাথ পুনর্ব্বার ভাবিতে লাগিলেন,—“অমরেন্দ্রকে দেখিলে আমার বনে যাইতে ইচ্ছা হয় না।

 “অমরেন্দ্র—অমরেন্দ্র! কি আনন্দময় মূর্ত্তি! তাহার স্মরণেও সুখ। ঐ প্রেম-প্রস্রবণ এ সংসার-মরুতে আমার প্রাণকে শাস্তি-বারি সিঞ্চনে সিক্ত করিতেছে। কিন্তু ঈশ্বরলাভের জন্য আমি অমরেন্দ্রকেও পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইব।” এই বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন।

 এমন সময় অমরেন্দ্র সেখানে প্রবেশ করিলেন। প্রিয়নাথ এতদূর চিন্তামগ্ন ছিলেন যে, প্রিয়বন্ধুর আগমন ও জানিতে পারিলেন না।

 অমরেন্দ্র প্রিয়নাথের পার্শ্বে উপবেশন পূর্ব্বক ধীরে ধীরে তাঁহার হাত ধরিয়া ডাকিলেন— “প্রিয়নাথ।”

 অকস্মাৎ ধ্যানভঙ্গে প্রিয়নাথ কিঞ্চিৎ চমকিত হইলেন। প্রিয়স্পর্শে তাঁহার প্রাণ আনন্দিত হইল; কিন্তু কিছু আর বলিলেন না। বাহ্যিক আদর তিনি জানিতেন না।

 অমরেন্দ্র,—“প্রিয়নাথ, কি ভাবিতেছে?”

 প্রিয়নাথ,—“বেশী কিছু নয়, তাই।”

 এই অল্প সময় মধ্যেই যে দুই ঘণ্টা সময় চলিয়া গিয়াছে, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন নাই।

 অমরেন্দ্র তখন সত্যরঞ্জনের বিবাহবিষয়ক সমস্ত কথাই আদ্যোপান্ত বিস্তৃত করিলেন।

 প্রিয়নাথ এই অবসরে আপনার মনকে পৃথিবীর কার্য্যের দিকে টানিয়া লইলেন।

 অমরেন্দ্র,—“সেই পণ্ডিতদিগের সভায় উপস্থিত থাকিলে তুমি অতিশয় আনন্দ লাভ করিতে।”

 প্রিয়নাথ,—“সে আনন্দের ভাগটা তোমার বিবাহ সভায়ই পূর্ণ করিব।”

 অমরেন্দ্রের মুখমণ্ডল গম্ভীর হইল।

 প্রিয়নাথ,—“এই মাসের মধ্যেই তোমার বিবাহের দিন ধার্য্য করিতে চাই।”

 অমরেন্দ্র,—“এত ব্যস্ততা কেন?”

 প্রিয়নাথ,—“তোমার বিবাহ হইলেই আমি একটু নিশ্চিন্ত হইতে পারি।”

 অমরেন্দ্র,—“এখন কাজের কথা বল। আমেরিকা কবে যাওয়া হইবে? সেখানে যাইয়া শিল্পশিক্ষার জন্য আমার প্রাণ ব্যাকুল হইয়াছে। আর বিলম্ব করিতে পারি না।”

 প্রিয়নাথ,—“বিবাহের পর আমেরিকা যাইও।”

 অমরেন্দ্র,—“পূর্ব্বেই সেখানে যাইতে মনস্থ করিয়াছি।”

 প্রিয়নাথ,—“কালীনাথবাবু সেদিন জানিতে চাহিয়াছিলেন যে, বিবাহের দিন কবে স্থির করিতে পারিবেন। শীঘ্র বিবাহ হওয়াই তাঁহার ইচ্ছা।”

 অমরেন্দ্র,—“তা হবে না প্রিয়নাথ! আমেরিকা হইতে ফিরিয়া আসি, বিবাহ যখন হয় হইবে।”

 প্রিয়নাথ অমরেন্দ্রের প্রকৃতি জানিতেন। সুতরাং বিরুদ্ধ তর্ক নিষ্ফল জানিয়া কহিলেন,—“তোমার যাহা ইচ্ছা তাহাই হইবে।”

 অমরেন্দ্র,—“এখন তবে আমেরিকা যাত্রার দিন স্থির কর। তোমার মার সঙ্গে দেখা করিতে যাইবে না?

 প্রিয়নাথ,—“আমার আমেরিকা যাওয়া হইবে না।”

 অমরেন্দ্র,—“সেকি প্রিয়নাথ! এরই মধ্যে মত পরিবর্ত্তন?”

 প্রিয়নাথ, -“আমার যাওয়ার ইচ্ছা নাই।”

 অমরেন্দ্র,—“সেকি ভাই!”

 প্রিয়নাথ,—“কোন একটি বিশেষ ভাব আমার প্রাণে প্রবিষ্ট হইয়া আমাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিয়াছে। কিছুদিন যাবৎ তাহার প্রগাঢ়তা বুঝিতেছি।”

 অমরেন্দ্র বিস্মিত হইয়া কহিলেন,—“এমন কি কথা যে আমি জানিতে পারি না।”

 প্রিয়নাথ,—“তোমার নিকট আমার কিছুই গোপন নাই, পাছে তুমি প্রাণে বেদনা পাও, এজন্য, তোষাকে বলিতে পারিতেছি না।”

 উভয়ের করে করবদ্ধ তেমনি ভাবে রহিয়াছে। অমরেন্দ্র আভাসে পূর্ব্বেই কতকটা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। বিষণ্ণভাবে কহিলেন,—“কি কথা প্রকাশ করিয়া বল।”

 প্রিয়নাথ,—অমরেন্দ্র, প্রাণের ভাই! আমি জানি তুমি সাধারণ লোক হইতে ভিন্ন। ভগবান্ তোমাকে পতাকাচিহ্নিত করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে প্রেরণ করিয়াছেন; মায়ের চরণতলে তুমি সমস্ত আকাঙ্ক্ষাকে বলিদান করিয়া অগ্রসর হইতেছ; তাই তোমাকে বলিতে পারিতেছি। আমার আর সংসারে মন নাই। হিমালয়ের কোন নির্জ্জন অরণ্যে চলিয়া যাইতে ইচ্ছা হইতেছে।”

 এই কথায় অমরেন্দ্র নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। পরে ধীরে ধীরে কহিলেন,—“একি কথা প্রিয়নাথ!”

 প্রিয়নাথ,—“অমরেন্দ্র, আমি যাহা বলিতেছি শোন। তুমি আমেরিকা যাও; ফিরিয়া আসা পর্য্যন্ত আমি এই কলিকাতায়ই তোমার প্রতীক্ষায় বাস করিব। পরে তোমাদের দুজনের হস্ত বিবাহ-বন্ধনে সম্মিলিত করিয়া আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করিব।”

 অমরেন্দ্র বুঝিতে পারিলেন যে জীবন-পথে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম্মের সামঞ্জস্য রক্ষা না করাতেই তাঁহার এপ্রকার মতিভ্রম ঘটিয়াছে। কিয়ৎক্ষণ, মৌন অবলম্বনপূর্ব্বক বিষণ্ণ মলিন মুখে উত্তর করিলেন,—

 “প্রিয়নাথ, তোমার তুল্য পবিত্রাত্মা ব্যক্তির আবার সংসার ও বনে প্রভেদ কি? সর্ব্বত্রই তোমার সন্ন্যাস। মূলেই কেন ভুল বুঝিতেছ? নিষ্কাম কর্ম্মই কি প্রকৃত সন্ন্যাস নহে? কর্ম্মফল ত্যাগই কি যথার্থ যোগ নয়? তুমি নানাশাস্ত্রে পারদর্শী, তোমাকে আর কি বুঝাইব?”

 প্রিয়নাথ,—“কত প্রাতঃস্মরণীয় লোক সন্ন্যাস অবলম্বন করিয়াছেন।”

 অমরেন্দ্র,—“তাঁহাদের উদ্দেশ্য কর্ম্মত্যাগ নহে। ত্যাগের অর্থ কর্ম্মত্যাগ নয়;—স্বার্থত্যাগ। যাঁহারা সংসার ত্যাগ করিয়া প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছেন তাঁহারা সকলেই কর্ম্মবীর। বুদ্ধ, চৈতন্য কি কর্ম্ম ত্যাগের জন্য সন্ন্যাসী হইয়াছিলেন?—না। কর্ম্মের সফলতাই তাঁহাদের সংসার ত্যাগের উদ্দেশ্য। সেই কর্ম্মের সফলতার জন্য তাঁহারা জগৎপূজ্য। তাঁহারা যে কার্য্য করিয়াছে তাহার তুলনা নাই।”

 প্রিয়নাথ,—“নির্জ্জন ধ্যানই আমার একমাত্র শান্তি। কর্ম্মে তৃপ্তি পাই না।”

 অমরেন্দ্র,—“এই প্রকার সংসার ত্যাগ কি এক প্রকার স্বার্থপরতা নহে? জগতের কল্যাণের জন্যই ভগবান্ জীবকে সংসারে প্রেরণ করেন নতুবা সংসারে আগমনের আমাদের সার্থকতা কি? বিশেষতঃ, তোমার তুল্য পুণ্যাত্মা ব্যক্তিগণ যদি বনে গমন করেন, তবে পাপতাপপূর্ণ সংসার রক্ষা করিবে কে?”

 প্রিয়নাথ,—“নিষ্কাম কর্ম্মই যে প্রকৃত সন্ন্যাস, তাহা আমি জানি। তবু আমার মন কি এক অপূর্ণতা বহন করিতেছে। অমরেন্দ্র, মন কোন যুক্তি শুনিতে চাহে না,—হিমালয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হইয়াছে। তুমি জগতের কার্য্য কর; আমাকে বিদায় দাও!”

 অমরেন্দ্র—“প্রিয়নাথ, তুমি আমার বাহুতে শক্তি! তোমাকে হারাইলে আমার সেই শক্তিই বিনষ্ট হইবে। আমি কাহার বলে কার্য্য করিব? আমাকে কোন্ অপরাধে পরিত্যাগ করিতে চাহিয়াছ?”

 প্রিয়নাথ,—“তোমার অপরাধের জ্য নহে। আমার প্রাণ জানি না কেন সংসারে তিষ্ঠিতে চাহে না।”

 অমরেন্দ্র অশ্রুপূর্ণ নয়নে কহিলেন,—“প্রিয়নাথ তুমি আমার প্রাণস্বরূপ। তোমাকে ছাড়িয়া আমি কিছুতেই জীবনধারণ করিতে সমর্থ হইব না।”

 প্রিয়নাথ,—কিছুদিন অতীত হইলে নিশ্চয় তুমি আমাকে ভুলিতে পারিবে।”

 অমরেন্দ্র,— প্রিয়নাথের কণ্ঠ আলিঙ্গন করিয়া অশ্রুবর্ষণ করিয়া কহিলেন,—“প্রিয়নাথ, তুমি আমাকে আজ পর্যাস্তও চিনিতে পার নাই। তোমাকে হারাইলে আমার জীবন শ্মশানসদৃশ হইবে। সংসারে কিছুই তোমার তুল্য নহে। তুমি আমার কেবল বন্ধু নহ। তুমি স্নেহে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, উপদেষ্টায় গুরু মনোরঞ্জনে সুহৃদ, বিপদে পথ-প্রদর্শক; তুমি আমার অন্ধকারের আলোক। আমাকে: কখনই পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হইবে না। তুমি বনে গেলে আমি নিশ্চয়ই তোমার অনুগমন করিব। যেস্থানে তোমার বাস সেইস্থানেই আমার স্বর্গ।” অমরেন্দ্রের অশ্রুজলে প্রিয়নাথের বক্ষস্থল সিক্ত হইল।

 এ প্রকারে উভয়ে কিয়ৎক্ষণ অবস্থান করিতে লাগিলেন। পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্র নিস্তব্ধ থাকিয়া সেই দুইটি প্রেমের সুন্দর চিত্র যেন দেখিতে লাগিল। কি মনোহর নীলমণি কাঞ্চনে যোগ! নীল পদ্মে কনক-পদ্ম; মরি মরি কি অপূর্ব্ব মাধুরী।

 সেই সময় নীরব ধ্বনিতে অন্তর প্রতিধ্বনিতে করিয়া প্রিয়নাথের হৃদ‍্পদ্মে একটি বাণী সমুখিত হইল, “কর্ম্মত্যাগে কখনও প্রাণের অপূর্ণতা দূর হইবে না। ভক্তিতেই মুক্তি। জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম্মের মিলনই প্রকৃত শাস্তির পথ। ভক্তি ভিন্ন কর্ম্মত্যাগে কোন ফল নাই।”

 প্রাণের মধ্যে এ বাণী লোকে বলে বিবেক, প্রিয়নাথ বুঝিলেন, ইহা ঈশ্বরের বাক্য।

 তিনি ভাবিতে লাগিবেন,—“এখন স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, এই প্রকার কর্ম্মত্যাগ স্বার্থপরতারই নামান্তর মাত্র। বিশেষতঃ অমরেন্দ্রকে ত্যাগ করিয়া যাইতে আমি কোনমতেই সমর্থ হইব না। অমরেন্দ্র গেলে প্রফুল্ল কি বাঁচিবে? সাধের গৃহ গঠিত করিতে যাইয়া নিজেই কি তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিব? কে যেন আজ সূর্য্যাস্তের পর আমাকে জানাইয়া গেল, এই যে প্রেম ও আনন্দের মূর্ত্তি অমরেন্দ্ররূপে আমার বক্ষস্থলে রহিয়াছে তাঁহাকে ত্যাগ করিলে, আমার সমস্ত সাধনাই ব্যর্থ হইবে।”

 তখন প্রিয়নাথ অমরেন্দ্রকে বাহুপাশে আবদ্ধ করিয়া কহিলেন, —“ভাই, চিরদিন যে আমি তোমারই।[১]


  1. লেখিকার ‘অমরেন্দ্র’ নামক উপন্যাস হইতে।