সাহিত্য-চিন্তা/ছায়া-পথ
ছায়া-পথ
অনন্ত নীল আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ,—মরি মরি! কি অপরূপ শোভা! হাজার হাজার হীরার ঝাড় যেন ঝক্ ঝক্ করিয়া জ্বলিতেছি! উজ্জ্বলে মধুর, মধুরে মহান্! এ মহত্ত্ব ও মধুরতার সংমিশ্রণে কি এক অনির্ব্বচনীয়, অভাবনীয় মহাশক্তির বিকাশ অনুভূত হইতেছে।
যখন তামসী রজনীর কৃষ্ণছায়ায় মেদিনীর শ্যাম সুন্দর কলেবর আচ্ছাদিত হইয়া পড়ে, যখন শ্রান্ত ক্লান্ত জীবকুল বিরামদায়িনী নিদ্রার ক্রোড়ে শয়ান হইয়া,— কর্ম্মক্ষেত্রের অনন্ত শ্রম ক্লেশ বিস্মৃত হয়, সেই সময় একবার সুন্দর নীল নভোমণ্ডলের বিশ্বমোহন কান্তি অবলোকন করিলে কি আনন্দে প্রাণ পরিপূর্ণ হয়! যেন স্বর্গীয় উদ্যানে কোটি কোটি পুষ্প স্তবকে স্তবকে প্রস্ফুটিত! যেন বৈজয়ন্তপুরীর সহস্র সহস্র দ্বার উন্মুক্ত করিয়া অগণিতসুর-সুন্দরী অনিমেষ নয়নে মর্ত্যবাসীদিগকে দর্শন করিতেছেন। যেন কোন অজ্ঞাত রাজ্যের বার্তা বহন করিয়া লইয়া সেই নীরব নিস্তব্ধ নিশীথে প্রকৃতিদেবী এক মহাধ্যানে নিমগ্ন! সেই সময় অনন্ত সত্য সুন্দর .. চিদ্ঘন মাধুরী প্রাণের উপর কেমন পরিস্ফুট হইয়া উঠে।
নক্ষত্রপুঞ্জের আকৃতি, গতি, দূরত্ব প্রভৃতি নির্দ্ধারণের নিমিত্ত যুগে যুগে মনীষিগণ গভীর গবেষণায় রত রহিয়াছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁহারা সেই ভূমা মহেশ্বরের মহিমার জ্বলন্ত নিদর্শন স্বরূপ নক্ষত্রপুঞ্জের বিষয় অতি অল্পই পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হইয়াছেন।
যে সময়ে পাশ্চাত্য জগতের অনেক দেশই ঘোর তমসাচ্ছন্ন ছিল, সহস্র সহস্র বৎসর পূর্ব্বে ভারত যখন জ্ঞানের সূর্য্যকিরণে প্রদীপ্ত ছিল, সেই সময়েও ভারতে জ্যোতিষতত্ত্বের আলোচনা অল্প ছিল না। খনা প্রভৃতি অসামান্য প্রতিভাশালিনী মহিলাগণও জ্যোতির্ব্বিদ্যায় অলৌকিক পাণ্ডিত্য লাভ করিয়াছিলেন; সে সমস্ত বিষয় এ প্রবন্ধের আলোচ্য নহে।
নীরদমুক্ত নির্ম্মল আকাশে দৃষ্টিপাত করিলে, সুদূর ব্যোমপথে নক্ষত্র-বিরচিত এক কিরণময় মণ্ডল নয়নগোচর হয়। উহা নীল অসীম দীগন্তের উত্তর-পশ্চিম ব্যাপিয়া যেন দ্যুলোককে দুইভাগে বিভক্ত করিয়া মহাপথের তুল্য বিস্তৃত, এবং আলোকমালায় উদ্ভাসিত রহিয়াছে। তাহার নাম ছায়াপথ।
জ্যোতিষ্ক-বিমণ্ডিত মহামহিমাময় ব্যোমের দুর্জ্ঞেয় সরণী পরিভ্রমণ করিতে মানব-মনের সাধ্য কি? মানবের ক্ষুদ্র জ্ঞান বুদ্ধি দুর হইতেই প্রতিনিবৃত্ত হয়। এই ছায়াপথের আকৃতি সর্ব্বত্র এক প্রকার নহে। বিবিধ বিচিত্রপূর্ণ বিশ্ব-চিত্রপটের একটি অপরূপ চিত্র ছায়াপথের বৈচিত্রও সামান্য নহে। ইহা কোথাও অল্প বিস্তৃত, কোথাও অধিক বিস্তৃত কোথাও বা সামান্য রেখাবৎ। কোথাও অতিশয় উজ্জ্বল, কোথাও অনুজ্জল, অল্প আলোকবিশিষ্ট প্রতীয়মান হয়। এই সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জের আকৃতি ও বর্ণ এক প্রকার নহে। অপূর্ব্ব বিভিন্নতা সত্ত্বেও কি আশ্চর্য্য সামঞ্জস্য!
এই ছায়াপথ সম্বন্ধে নানাদেশে নানাপ্রকার গল্প প্রচলিত আছে। প্রাচীন রোমবাসীগণ উহাকে সৌরজগতের কিরণদাতা সবিতাদেবের পথ বলিয়াছেন, তাহাদের মতে এই পথ দিয়াই গ্রহরাজ সূর্য্য পূর্ব্বাচলে এবং পশ্চিমাঞ্চলে গমনাগমন করেন। প্রাচীনযুগে যে গ্রীকগণ সভ্যতা, শিল্প, বাণিজ্য বিদ্যা বুদ্ধি এবং অন্যান্য গুণ গরিমায় উন্নতির সমুচ্চ শিখরে উত্থিত হইয়াছিলেন, সে সময়ে তাঁহারাও এসম্বন্ধে কুসংস্কার বর্জ্জিত ছিলেন না। তাঁহারা ছায়াপথকে দেহমুক্ত আত্মার স্বর্গগমনের পথ বলিয়াছেন। অথবা সাধারণের মনোরঞ্জনার্থ কবির কি চমৎকার কল্পনা! কবিকল্পনার এমন মনোহর আশ্রয় ছায়াপথের ন্যায় দ্বিতীয় বস্তু আর কি আছে? সকল দেশেই প্রাচীন কবিগণ সত্যের সঙ্গে কল্পনা মিশ্রিত করিয়া যেন এক অপূর্ব্ব আমোদ অনুভব করিতেন। চীনের অধিবাসিগণ কর্তৃক ছায়াপথ মনোহর অমরাপুরীর পুণ্য সলিলাপ্রবাহিনী তরঙ্গিনীরূপে বর্ণিত হইয়াছে। এ সম্বন্ধে ভারত কাহারও পশ্চাৎবর্ত্তী নহে। ভারতবর্ষের অশিক্ষিত লোকদিগের মধ্যে এ সম্বন্ধে নানাপ্রকার কল্পিত ব্যাখ্যা শ্রবণ করা যায়। চিরকল্পনাপ্রিয় ভারতবাসিগণ এমন মাধুর্য্য ও মহিমাপূর্ণ বিষয়ে কেননা কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করিবেন?
জ্যোতিষী পণ্ডিতগণ ছায়াপথ সম্বন্ধে কি অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, এপ্রবন্ধে তাহাই কিঞ্চিৎ উল্লেখ করিব।
ছায়াপথ স্তবকে স্তবকে নক্ষত্র অথবা সূত্রগ্রথিত মুক্তা সমূহের ন্যায় নক্ষত্রের সমষ্টি ভিন্ন আর কিছুই নহে। এই নক্ষত্রগুলি স্তরে স্তরে সুসজ্জিত। কোথাও বা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, বিশৃঙ্খল ভাবে রহিয়াছে, —তাহাও স্তরে স্তরে। নৌকাপথে চলিতে চলিতে খরস্রোতা তটিনীর তীরে মৃত্তিকাস্তর দেখিতে পাওয়া যায়। একটি স্তরের উপর আর একটি স্তর কেমন সাজান রহিয়াছে। এই ছায়াপথের নক্ষত্রস্তর সেই প্রকার নহে। নীচের স্তরের নক্ষত্রগুলিও সুস্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয়, কিন্তু অনুজ্জ্বল। এই নক্ষত্রস্তরের নির্ণয় বিষয়ে ও জ্যোতিষীগণের মধ্যে মতভেদ দৃষ্ট হয়। কোন কোন স্থলে ছায়াপথের নিম্নস্তরস্থিত নক্ষত্রপুঞ্জ এত অস্পষ্ট যে ধুমপুঞ্জের ন্যায় প্রতীয়মান হয়।
এই নক্ষত্রগুলির জ্যোতি অসামান্য। অতিশয় দূরত্ব বশতঃ দূরবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারাও মানবচক্ষে ক্ষীণালোক বিশিষ্ট বলিয়া প্রতীতি জন্মে। একটি সূর্য্যের আলোক রাশিতে সমস্ত সৌরজগৎ উদভাসিত এবং রক্ষিত। জ্যোতিষ শাস্ত্র দ্বারা নিঃসংশয় রূপে প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, এ অগণিত নক্ষত্রমালার এক একটির জ্যোতিঃ মহাজ্যোতিস্মান্ সূর্য্য অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহে।
প্রত্যেকটি নক্ষত্র আকৃতিতে সূর্য্যের তুল্য বিশালকায়; কোনটি বা সূর্য্যের অপেক্ষাও বৃহত্তর হইবে! অসীম মহাব্যোম ব্যাপিয়া এই মহাজ্যোতিষ্ক সকল অবিশ্রান্ত ভ্রমণ করিতেছে! এক মহাআকর্ষণ শক্তিতে পরস্পর অনন্ত শূন্যে আকষ্ট হইয়া রহিয়াছে। এই আকর্ষণই বা কেমন? এবং তাহার স্রষ্টাই বা কি মহান! সেই অচিন্ত্য শক্তিসম্পন্ন পুরুষ বিশ্ববিধাতার অচিন্তনীয় সৃষ্টিতত্ত্বের অসীমত্ব আমরা কীটানুকীট কেমন করিয়া ধারণা করিব? চিন্তা করিতে চিন্তাশক্তি অবসন্ন হইয়া পড়ে। তিনি কোন্ উদ্দেশ্যে এই অনন্ত রবি পুঞ্জের সৃষ্টি করিয়াছেন, এবং কোন্ উদ্দেশ্যেই বা সৌরজগৎ পরিবেষ্টিত রবিস্তবক স্তর-শোভিত ছায়াপথের রচনা করিয়া আপনার মহামহিমান্বিত নীলা প্রকাশিত করিয়াছেন, তাহা কে বুঝিবে? সেই বিস্ময়কর তত্ত্বের এক কণাও মানববুদ্ধির গম্য নহে। মনুষ্যের ক্ষুদ্র বুদ্ধিপ্রসূত সামান্য দূরবীক্ষণ যন্ত্রদ্বারা সেই মহাসৃষ্টির অতি সামান্য অংশই দৃষ্টি গোচর হয়। এই মহাবিশ্বকার্য্য যাঁহার রচন। তিনি ইহাতে প্রাণরূপে প্রতিষ্ঠিত।
এই মহত্ত্বের কুল কিনার না পাইয়া হার্ব্বাট স্পেন্সার প্রমুখ অজ্ঞেয়তাবাদী প্রতীচ্য পণ্ডিতগণ মহান্ সৃষ্টিতত্ত্ব হইতে ব্রহ্মতত্ত্বকে পরিহার করিতেই চেষ্টা পাইয়াছেন। কিন্তু ভারতের পরম জ্ঞানী মহর্ষিগণ জলদগম্ভীরনাদে ঘোষণা করিয়াছিলেন,—“এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সেই মহান্ পুরুষে অবস্থিত রহিয়াছে।”
নক্ষত্রপুঞ্জ দূরত্ব বশতঃই এত ক্ষুদ্র বলিয়া প্রতীত হয়, তাহা পূর্ব্বে লিখিত হইয়াছে। নক্ষত্রগুলি পরস্পর সুদূরবর্ত্তী হইলেও যে ধরাতল হইতে এত ঘন সন্নিবিষ্ট প্রতীয়মান হয়, দুরত্বই তাহার একমাত্র কারণ। ধরণী হইতে নক্ষত্রমণ্ডলের দুরত্ব নির্ণয় করিতে যাইয়া জ্যোতিষগণ শ্রান্ত ক্লান্ত হইতেছেন। কিন্তু যুগান্তরব্যাপী অবিশ্রান্ত গবেষণার দ্বারাও আজ পর্য্যন্ত তাহাদের দূরত্ব নিঃসংশয়রূপে নিরূপিত হয় নাই। সৌরজগৎ হইতে ছায়াপথ কত দূরে অবস্থিতি করিতেছে তাহা স্থির করিতে কেহই সম্যক্ সমর্থ হন নাই।
আলোকের গতি প্রতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ আশী হাজার মাইল (১৮০০০০)। দুই জন জ্যোতিষী পণ্ডিত (ডাঃ গিল এবং ডাঃ এলকিন) লুব্ধক নামক নক্ষত্রের দূরত্ব সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে ঐ নক্ষত্র হইতে আলোকরাশি প্রতি সেকেণ্ডে ১৮০০০০ হাজার মাইল ছুটিয়া, পৃথিবীতে পঁহুছিতে ৯ বৎসর সময় অতিবাহিত হয়। এরূপ অসংখ্য নক্ষত্র রহিয়াছে যাহারা লুব্ধক হইতেও বহু সহস্র গুণ দূরে অবস্থিত। কোন কোন নক্ষত্র হইতে ধরাবাসীর নিকট আলোক পঁহুছিতে নয় হাজার বৎসর সময় অতিবাহিত হয়। তাহাদের দূরত্ব কত বিস্ময়কর তাহা কল্পনার অতীত। যে আলোক প্রতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ আশী হাজার মাইল দ্রুত ধাবিত হয়, তাহা ধরণী রাজ্যে পঁহুছিতে নয় হাজার বৎসর সময় অতিক্রম করিয়া থাকে।
. নক্ষত্রপুঞ্জ গমনশীল হইলেও অতিশয় দূরত্ব বশতঃ তাহারা স্থির বলিয়া মনে হয়।
আকাশের ইতস্ততঃ অনেক স্থানেই নক্ষত্রপুঞ্জ স্তবকে স্তবকে দৃষ্ট হয়। একবৃন্তে বহু পুষ্পের ন্যায় যেন গুচ্ছে গুচ্ছে সজ্জিত রহিয়াছে।
দূরবীক্ষণ যন্ত্রদ্বারা বহু দূরে যে অস্পষ্ট আলোক বিশিষ্ঠ নক্ষত্রপুঞ্জ দৃষ্ট হয় তাহার নাম নীহারিকা। সমুদ্র বেলাস্থিত সিকতাস্তুপের ন্যায় কত স্তরে স্তরে অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জ ধূমবৎ দৃষ্ট হইয়া থাকে। বলা বাহুল্য যে ইহারা সকলেই এক একটি জ্যোতির্ম্ময় সূর্য্য! এবং সম্ভবতঃ সকলেই এক এক সৌরজগৎ অধিকার করিয়া রহিয়াছে!
আশ্চর্য্য! আশ্চর্য! বিস্ময়ে বাক্য নিস্তব্ধ হইয়া পড়ে! হৃদয় কি এক অনির্ব্বচনীয় ভাবরসে অভিষিক্ত হইতে থাকে। সীমাশূন্য—অন্তশূন্য ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টার অসীম শক্তির বিষয় চিন্তা করিতেও আমরা সমর্থ নহি। কেবল অবনত মস্তকে ভক্তিপরিপ্লুত প্রাণে সেই মহা শক্তিময় জ্ঞানময় পুরুষকে প্রণাম করিয়া ক্বতার্থ হই। ইহাতেই আমাদের মানবজন্মের সার্থকতা।