সাহিত্য-চিন্তা/সার্ব্বভৌমিক প্রেম
সার্ব্বভৌমিক প্রেম
কালীনাথ বাবু কহিলেন—“অমরেন্দ্র! শুধু বক্তৃতায় .কোন ফল হইবে না। যদি দেশবাসীর প্রকৃত কল্যাণ ইচ্ছা কর, তবে প্রেম চাই; প্রেম বিশ্ববিজয়ী জানিবে। প্রেমের নিকট মস্তক অবনত করিতে, একদিন সকলেই বাধ্য হইবে।”
অমরেন্দ্র,—“মহাশয়, আমি এক্ষণ তাহা হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইতেছি; নির্জ্জনে যখন আরাধ্যা দেবীর ধ্যান করি, মা যেন প্রাণে প্রাণে প্রকাশিত হইয়া বলিতে থাকেন, আগে তোমার শত শত ভ্রাতাকে প্রীতি কর; জাতিভেদ, বর্ণভেদ, বিস্মৃত হইয়া, হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সকলকে সমভাবে প্রেমালিঙ্গনে আপনার করিয়া লও, তবেই মাতৃপূজার অধিকারী হইবে। প্রেমের নিকট স্বদেশ বিদেশ উভয়ই তুল্য। ভ্রাতার শত অপরাধ ক্ষমা করিয়া তাহাকে কল্যাণের পথে তুলিয়া লও।”
কালীনাথ বাবু—“ইহাই তো প্রকৃত মনুষ্যত্ব। এ স্থানে জাত্যাভিমান, হিংসা, বিদ্বেষের স্থান কোথায়?”
অমরেন্দ্র ভাবপূর্ণ হৃদয়ে বলিতে লাগিলেন, “পূর্ব্বে আমি দেশবাসী হইতে কেমন একটা দূরত্ব অনুভব করিতাম। আপনার পাঠ্য পুস্তকেই মনটা নিবিষ্ট ছিল; দেশবাসীর সঙ্গে বড় একটা মিশিবার অবসর পাইয়া উঠি নাই। মাতৃ-সেবায় দীক্ষিত হইবার পর হইতে আশ্চর্য্য শক্তি অনুভব করিতেছি। সকল প্রকার জাত্যাভিমান ও গর্ব্ব যেন চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া একেবারে ধূলিসাৎ হইয়াছে। এখন দেখিতে পাইতেছি, মাতৃচরণে আমি ধূলি অপেক্ষাও অধম, এবং কোটি কোটি ভ্রাতার সহিত আমি অভিন্ন। এখানে হিন্দু মুসলমান, ইংরেজ, বাঙ্গালীর সঙ্গে কোন ভেদ নাই। সকলেই আমার আপনার ভাই। আমার প্রত্যেক রক্তবিন্দু যদি তাহাদের কল্যাণার্থ অর্পিত হয়, তবেই আমার জীবন ধন্য হইবে।” অমরেন্দ্র উচ্ছসিত প্রাণে এই বলিয়া নীরব রহিলেন! তাঁহার স্বাভাবিক তেজঃপূর্ণ মুখমণ্ডল যেন কি এক মহিমামণ্ডিত আভায় দীপ্তিশালী হইয়া উঠিল।
কালীনাথ বাবু কহিলেন, “নব্য যুবকগণের যেপ্রকার কর্ত্তব্যনিষ্ঠা ও উদ্যমশীলতা, তাহাতে তাহাদের যত্নে এবং একপ্রাণতায় দেশীয় শিল্পবাণিজ্যের অভাবও কতকটা দূর হওয়ার সম্ভাবনা।”
অমরেন্দ্র,—“অনেক দেশহিতৈষী ব্যক্তি জননী জন্মভূমির কল্যাণার্থ শিল্পচর্চার জন্য ত্যাগ স্বীকার করিতেছেন। ইংরেজ গবর্ণমেণ্টেরও এ বিষয়ে বিশেষ সহানুভূতি আছে।”
কালীনাথ বাবু —“যেকোন বিষয়েই হউক কার্য্য সিদ্ধি লাভ করিতে হইলে তিতিক্ষার আবশ্যক। নব্য যুবকের উদ্দাম হৃদয়াবেগজনিত অধীরতায় অনেক সময় কার্যসিদ্ধির পক্ষে বিঘ্ন ঘটে। উন্নতিশীলতার একটা দিক্ আছে। যেমন একটি প্রাসাদ প্রস্তুত করিতে হইলে, তাহার ভিত্তিমূলের দৃঢ়তার আবশ্যক, স্থিরভাব ইষ্টক খণ্ডের উপর ইষ্টকখণ্ড স্থাপন পূর্ব্বক অতি সাবধানে সুদক্ষ শিল্পী অতি বৃহৎ অট্টালিকা প্রস্তুত করিয়া থাকেন, তেমনিই স্বদেশের হিতকল্পে কোন কার্যপ্রণালী সংগঠন করিতে হইলে, অতিশয় ধৈর্য্য ও সাবধানতার আবশ্যক এবং তাহার ভিত্তিমূলের দৃঢ়তার প্রয়োজন।
অমরেন্দ্র,—“আপনি কাহাকে ভিত্তিমূল বলেন?”
কালীনাথবাবু —“নৈতিক নিষ্ঠাই তাহার ভিত্তিমূল। কি রাজনৈতিক, কি সমাজনৈতিক, যে কোন বিষয়ে দৃষ্টিপাত কর না কেন, নৈতিক নিষ্ঠার দৃঢ়তাই উহাকে অক্ষুণ্ণ রাখে ও শক্তিসম্পন্ন করিয়া তোলে। নৈতিক নিষ্ঠার শিথিলতায় দেশের সর্ব্বপ্রকার উন্নতির প্রয়াস বালুকার উপরিস্থিত প্রাসাদের ন্যায়, ভূমিসাৎ হয়। জগতের ইতিহাসে ইহার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করা যাইতে পারে।”
অমরেন্দ্র,—“যত দূর সম্ভব নৈতিক নিষ্ঠা রক্ষা করিতে যত্ন করা হইতেছে।”
কালীনাথ বাবু,—“একটা সার্ব্বভৌমিক প্রীতির আবশ্যক। ইহা নৈতিক নিষ্ঠার আর একটা দিক্। দ্বেষ হিংসা দ্বারা কখনও দেশের মঙ্গল হইবে না। এই তো দেখ ভ্রাতায় ভ্রাতায় কেমন দলাদলি আরম্ভ হইয়াছে। সকলেই এক মায়ের সস্তান; মাতার দুঃখ দারিদ্র্য দূর করা সকলেরই জীবনের উদ্দেশ্য; তবে এ দলাদলি কেন? আর কি ভারতে দলাদলি সাজে? দেখিতেছ না, দারিদ্র্য ও অন্নাভাবে দেশ জীর্ণশীর্ণ? শিল্পবাণিজ্যের উন্নতি ভিন্ন ভারতের আর উপায় নাই। এই উন্নতির নিমিত্ত ত্রিশ কোটি ভ্রাতা ভগিনী সমস্ত হিংসা দ্বেষ বিসর্জ্জন দিয়া, সম্মিলিত হও। পরস্পরের অশ্রু পরস্পরের অশ্রুতে মিশাইয়া মায়ের চরণতলে এক হও। ভ্রাতায় ভ্রাতার বিবাদ করিয়া আর কেন জননীর বক্ষে শেলাঘাত কর?”
অমরেন্দ্র,—“দলাদলি এবং বিদ্বেষই যে সর্ব্বনাশের কারণ, তাহার আর ভূল কি? ভারতবাসীগণ এই প্রকার দলাদলি এবং সর্ব্বপ্রকার বিদ্বেষবুদ্ধি যদি ত্যাগ না করেন, তবে ভারতবর্ষের মঙ্গলের আশা বৃথা।”
কালীনাথ বাবু—“ভারতবর্ষ পুণ্য ভূমি। যুগযুগান্ত ব্যাপিয়া জগৎ ইহাকে পুণ্যের আদর্শ স্থান বলিয়া স্বীকার করিয়া আসিতেছে। সহস্র সহস্র বৎসর হইতে ভারতবর্ষ প্রীতি এবং ত্যাগের আদর্শরূপে গণ্য হইয়া রহিয়াছে। সেই ভারতবর্ষে—পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে, যদি গুপ্তহত্যা প্রভৃতি মহাপাপের স্থান হয়, ইহা অপেক্ষা আক্ষেপের বিষয় আর কিছুই নাই। গুপ্তহত্যা অতিশয় ঘৃণনীয় এবং নীচাশয়তার কার্য্য।” রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা অতিশয় নিন্দনীয়। যে ভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া ভারত আজও প্রেমবলে, পবিত্রতাবলে, সমস্ত পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠস্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে, এই সমস্ত মহাপাপের দ্বারা সেই সুদৃঢ় ভিত্তিমূল শিথিল হইয়া যাইবে। ইহা দ্বারা আমরা সভ্য জগতের সহানুভূতি হারাইব। ইংরেজদিগের মধ্যে যেসকল প্রকৃত হিতৈষী ব্যক্তি প্রাণপণে ভারতের কল্যাণ সাধনে রত, গুপ্তহত্যার পাশবিক কার্য্যদ্বারা আমরা তাঁহাদেরও সহানুভূতি হারাইব। ভারতের বিজয়রত্ন কখনও রক্তাক্ত নহে। সাম্যমৈত্রীর বৈজয়ন্তী গগনে উড্ডীন করিয়া ভারতবাসী জগৎজয় করিয়াছে। যাহারা গুপ্তহত্যারূপ মহাপাপে লিপ্ত, তাহারা দেশের প্রকৃত শত্রু। ভারতের প্রাণস্বরূপ নব্য যুবকগণ কেন এ পাপে লিপ্ত হইবেন।”
অমরেন্দ্র,—“রাজনৈতিক হত্যাকারীর মঙ্গল কোথায়? যাহাতে দেশমধ্যে এই সমস্ত মহাপাপের স্থান না হয়, সকলেই সে বিষয়ে যত্ন করিবেন, সন্দেহ নাই।”
কালীনাথ বাবু,—“পাপ ও অপবিত্রতার সঙ্গে সংগ্রামই প্রকৃত বীরত্ব। ইহা নৈতিক নিষ্ঠার একটা দিক্। জাতিবিদ্বেষরূপ ঘোরতর পাপ দেশকে ধ্বংসের পথে লইয়া চলিয়াছে। শত শত কুসংস্কার আবর্জ্জনারূপ পাপকীট সমাজবক্ষে প্রবিষ্ট হইয়া ইহার অস্থিপঞ্জর পর্য্যন্ত বিনাশ করিতেছে। তাহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। বাল্যবিবাহ দেশ হইতে নির্ব্বাসিত কর। জাতি-বিদ্বেষ দূর করিতে দৃঢ়ব্রত হও। যাহারা এ সকল পাপ আবর্জ্জনার সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহারাই প্রকৃত বীরপুরুষ।”
অমরেন্দ্র—“প্রতীচ্য প্রত্নতত্ত্ববিদদিগের মতে খ্রীষ্টের জন্মের ৬০০ শত বৎসর পূর্ব্বে ভারত যখন জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত ছিল, সেই সময় ভারতের শিল্প বাণিজ্য উন্নতির চরম সীমায় উত্থিত হইয়াছিল। ভারতের বাণিজ্যতরণীসকল অপার সমুদ্র-বক্ষ পার হইয়া দিক্দিগন্তে ধাবিত হইত। ভারতের শিল্প বাণিজ্য বলীদ্বীপ এবং অন্যান্য দেশেও প্রসারিত ছিল। শিল্পকলা এবং জ্ঞান গরিমায় ভারত যে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল, আজও ঐ সকল দেশ তাহার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। সুবর্ণ যুগে ভারতীয় আর্য্য-সভ্যতা যবদ্বীপে সংস্থাপিত হইয়াছিল, তাহা প্রমাণিত হইয়াছে।
“পুরাকালে যুবরাজ সিংহবাহু সিংহলে গমন করেন;এবং পাণ্ড্যরাজকুমারী বহু রাজকর্ম্মচারী ও কৃতদাস এবং অনেক রাজকন্যাসহ সিংহলে গমন করিয়াছিলেন।
“ভারতের বাণিজ্য-তরণীসকল কেবল ভারত মহাসাগরে নয়, অন্যান্য মহাসাগরেও বিচরণ করিত, ইহা ইংরেজ গ্রন্থকারগণ স্বীকার করিয়াছেন।
পূর্ব্বপুরুষগণের কীর্ত্তিকাহিনী আজ তাঁহাদের বংশধরের নিকট উপাখ্যানের আকার ধারণ করিয়াছে। যে সমুদ্রযাত্রা একদিন আর্য্যজাতির গৌরবের বিষয় ছিলবহু শতাব্দী পর তাঁহাদের বংশধরগণের বিকট আজ সেই সমুদ্রগমন নিষিদ্ধ! এই প্রকারে দেশবাসী কমলাকে বিদেশে নির্ব্বাসিত করিয়া ভারতের উন্নতির পথ একেবারে রুদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। হায়, ভারতের কি শোচনীয় দুর্গতি!”
কালীনাথ বাবু,—“জানিনা, কবে এ দুর্গতির অবসান হইবে। ভারতবাসীর গৃহবিচ্ছেদ, অন্ধতা এবং অপরিণামদর্শিতাই এসকল অনর্থের মূল। আজকাল অনেক সুশিক্ষিত হিন্দু যুবক সমাজের কুসংস্কার-বন্ধন ছিন্ন করিয়া সমুদ্র পথে বিদেশ গমন করিয়া থাকেন। সকলেই যদি এ দৃষ্টান্তের অনুসরণ করেন, তাহা হইলে সমাজ-নেতৃগণ তাঁহাদের বিধি ব্যবস্থার কঠোরতাও শিথিল করিতে বাধ্য হইবেন।”
অমরেন্দ্র,—“সমাজের এই সমস্ত কলঙ্ক দূর না হইলে ভারতের উন্নতি কোথায়?”
অমরেন্দ্র কিছুকাল চুপ করিয়া রহিলেন। তারপর আবার দৃঢ়তার সহিত কহিলেন,—“আমি সর্ব্বোপরি এই জাতিবিদ্বেষকে প্রাণের সহিত ঘৃণা করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইংরেজ, বাঙ্গালী, হিন্দু, খৃষ্টান সম্মিলন ভিন্ন ভারতবর্ষের কল্যাণ নাই। এইপ্রকার সার্ব্বজনীন সম্মিলন এবং প্রীতির ভিত্তির উপর জাতীয় উন্নতির সোপান প্রতিষ্ঠা করাই আমার ত্তজীবনের প্রধান ব্রত। কারণ যাহার বলে আর্যজাতি জগৎপূজ্য, তাহার মূলমন্ত্র এই সার্ব্বজনীন প্রেম। সেই প্রেমকে বাদ দিলে ভারতের আর কি অবশিষ্ট থাকে? দেশের শত শত অভাবের বিষয় চিন্তা করিয়া আমার প্রাণ আকুল হইয়া উঠিয়াছে। আমি আশা করি, বাঙ্গালী যদি সমস্ত হিংসা বিদ্বেষ দূর করিয়া প্রেমের ভিত্তির উপর দাঁড়াইতে পারেন, মাতৃ-ভূমির সমস্ত অভাবই দূর হইয়া যাইবে। ইংরেজ আমাদের পর নহেন। আমরা যদি আপনার কল্যাণ কামনা করি, তবে ইংরেজকেও ভালবাসিতে হইবে, তাহার কল্যাণ চিন্তা করিতে হইবে। কারণ জগতের এই যে অনন্ত জীব-প্রবাহ, ইহাদের প্রত্যেকের কল্যাণের উপর আপনার কল্যাণ নিহিত রহিয়াছে, ইহা অভ্রান্ত সত্য।”
কালীনাথবাবু তখন সেই নব যুবকের বিশ্বপ্রেমে উদ্দীপ্ত লাবণ্যময় মুখমণ্ডলের প্রতি সবিস্ময়ে চাহিলেন। দেখিলেন, সে উচ্ছল, প্রশাস্ত ললাট যেন বিধাতার অক্ষরচিহ্নে চিহ্নিত। শ্রদ্ধাভরে সমরেন্দ্রের করপল্লব স্বকরে গ্রহণ পূর্ব্বক গম্ভীর ভাবে কহিলেন,—
"অমরেন্দ্র তুমি ঠিক্ই বলিয়াছ। এই সার্ব্বভৌমিক প্রীতি ভিন্ন জাতীয় দুর্গতি কখনও দূর হইবে না। আজও ইংরেজের যাহা আছে, তুলনায় বাঙ্গালীর কিছুই নাই। ইংরেজের কর্তব্যনিষ্ঠা, স্বদেশ বাৎসল্য, একতা কর্ম্মে উৎসাহ কয়জন বাঙ্গালীর মধ্যে দেখা যায়? যাঁহাদের আছে, তাঁহারাও সমুদ্রে জলবিম্ববৎ। ইংরেজের এ সকল গুণ কি বাঙ্গালীর অনুকরণীয় নয়? বাঙ্গালী ১০ জনে মিলিয়া একটা কাজ করিতে পারে না।”
অমরেন্দ্র,—“দেশের সর্ব্বাঙ্গীন মঙ্গল সার্ব্বভৌমিক প্রীতির উপর নির্ভর করিতেছে। বিধর্ম্মী, বিদেশীয়দিগকেও প্রাণের সহিত প্রীতি করিতে না পারিলে, কখনও স্বদেশের গৌরব প্রতিষ্ঠা হইবে না।”[১]
- ↑ লেখিকার “অমরেন্দ্র” নামক উপন্যাস হইতে