সাহিত্য-চিন্তা/সূর্য্য-মণ্ডল
সূর্য্য-মণ্ডল
সুদূর নভোমণ্ডলে তেজোময় অগ্নিময় মূর্ত্তি! কি মহিমাপূর্ণ মাধুরী! যুগে যুগে এই ভূমণ্ডলে কত পরিবর্ত্তন উপস্থিত হইল—কত বিপ্লব এবং বিবর্ত্তনের ভিতর দিয়া সভ্যতা ও বিজ্ঞানের উজ্জ্বল আলোকে মানবসমাজ উন্নতির উচ্চতর সোপানে আরোহণ করিল কিন্তু ঐ অগ্নিময় মূর্ত্তি আকাশে একই ভাব সমুদিত। এমন অলৌকিক গাম্ভীর্য্যময়ী সুষমার নিকট কাহার হৃদয় না প্রীতিভরে নত হয়? এই মহিমাময়ী মূর্ত্তি দর্শন করিয়া একদিন আর্য্যঋষি হিমানিমণ্ডিত গিরিকন্দর এবং নির্ম্মলসলিলা তটিনী প্রতিধ্বনিত করিয়া মধুর গম্ভীর কণ্ঠে গাইয়া ছিলেন:—
হিরণ্ময়েন পাত্রেন সত্যস্যপিহিতং মুখম্।
তস্থং পূষণ্ণ পাবৃণু সত্যধর্ম্মায় দৃষ্টয়ে॥১৫॥
ঈশোপনিষৎ।
“হে জগতের পোষক সূর্য্য! তোমার জ্যোতির্ম্ময় পাত্র দ্বারা সত্যের (অর্থাৎ সূর্যমণ্ডল স্থিত ব্রহ্মের) মুখ আচ্ছাদিত রহিয়াছে। সত্যধর্ম্মানুষ্টায়ীর দৃষ্টির জন্য তাহা আবরণশূন্য কর।”
ভারতের সুবর্ণযুগে জগতের বরণীয় যে আর্য্যজাতি —ভারতমাতার সুসন্তানগণ, প্রকৃতির প্রতি বস্তুতে ব্রহ্মসত্তা অবলোকন করিতেন; জলে, স্থলে, আকাশে, বৃক্ষ, লতায়, অগ্নিশিখাতে ভূমা-মহেশ্বরের পরম জ্যোতি দর্শন করিয়া—সেই দেবদেবের অর্চ্চনা করিয়া কৃতার্থ হইতেন, তাঁহারা অশেষ শক্তির আধার সূর্য্যমগুলে সত্যস্বরূপ পরমাত্মার উজ্জ্বল সত্তা কেন না প্রত্যক্ষ করিবেন?
বস্তুতঃ আনন্দদায়িনী ঊষার অঙ্কে নবোদিত রবির ভূবনমোহিনী ছবি কি সুন্দর! নীলিমাময় অনন্ত আকাশে শয়ান রক্তমূর্ত্তি দেবশিশুর মত তরুণ তপন যখন আলোক-রশ্মি বিকীর্ণ করিয়া হাসিতে থাকে তখনকার শোভা সন্দর্শন করিয়া কাহার, প্রাণ না নির্ম্মল আনন্দে,—পরিত্র ভগবদ্ভক্তিতে উছলিয়া ওঠে? প্রভাতের শুভ সমাগমে এক অজ্ঞাত, অভাবনীয় মঙ্গল আহ্বানধ্বনিতে নিতান্ত মোহসুপ্ত হৃদয়ও কি জাগরিত হয়. না!
আবার যখন দেখিতে দেখিতে সেই সহস্রাংশু প্রচণ্ড মূর্ত্তিতে মধ্যাহ্ন গগনে উদিত হইয়া ধরাতলকে সত্তাপিত করিতে থাকে, মানবগণ নানা বৈচিত্রপূর্ণ, কোলাহলময় কর্ম্মক্ষেত্রের নানা কার্য্যে ব্যাপৃত থাকে, তখন সেই মহাশক্তিশালী সূর্য্যকান্তিতে শক্তিদাতা পরম দেবের অনন্ত শক্তি কিঞ্চিৎ অনুভব করিয়া কাহার হৃদয় না কৃতজ্ঞতা রসে পূর্ণ হয়?
সারাদিন আলোক বিতরণ করিয়া সন্ধ্যাকালে সেই দিনমণি যখন অস্তগমনের উদ্যোগ করে,—যখন হেমকিরীট বিভূষিতা সন্ধ্যা শ্রান্ত ক্লান্ত জীবগণের বিশ্রামের আয়োজনে প্রবৃত্ত থাকে, সেই সময় অস্তগামী রবির শাস্ত শোভাময় মূর্ত্তি দর্শন করিয়া কোন্ ভাবুকের প্রাণ না মহাভাবে নিমগ্ন হয়, এবং সেই পরম আশ্রয়দাতার চরণে আপনা আপনি শরণাপন্ন হইয়া পড়ে?
সূর্যমণ্ডলই বিশ্বের প্রাণ এবং সকল শক্তির আধার। ভূমণ্ডলে শক্তির যে কি বিকাশ দেখিতে পাইতেছি সূর্য্য হইতেই তাহার অধিকাংশ গৃহীত হইয়াছে। মানব সভ্যতার শৈশবাবস্থায় এই সূর্য্য সম্বন্ধেও নানা দেশে কত চিত্তরঞ্জন আমোদজনক গল্প কল্পিত হইয়াছিল এবং অ্দ্যপি অশিক্ষিত সমাজে কত অদ্ভুত কাহিনী প্রচলিত রহিয়াছে। কিন্তু যুগের পর যুগ বিজ্ঞানের প্রখর উজ্জ্বল আলোক যেরূপ অপূর্ব্ব প্রভায় সমস্ত সুসভ্য দেশে বিকীর্ণ হইয়া পড়িতেছে, তাহাতে ধুম ছায়া স্বতঃই লোকের হৃদয়ক্ষেত্র হইতে অপসারিত হইয়া যাইতেছে।
আকাশের অনন্ত নক্ষত্র-পুঞ্জের মধ্যে আমাদের জীবনস্বরূপ সূর্য্যও যে একটি নক্ষত্র মাত্র, বিজ্ঞান তাহা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়াছে। বিশ্ববিধাতার এই বিরাট রহস্যময় বিশ্বযন্ত্রে অগণ্য নক্ষত্ররাজির ইয়ত্তা কে করিবে? তাহাদের বর্ণ বৈচিত্রই বা কত মনোহর! সূর্য্য তাহাদেরই একটী ভিন্ন আর কিছুই নহে। সূর্য্যমণ্ডলের আকৃতি, ধাতব সন্নিবেশ, বিভিন্ন অবস্থা, গতি প্রভৃতি আলোচনা করিতে ডাক্তার ষ্ট্রু বন্ জেনসন প্রভৃতি মনীষিগণ যেপ্রকার গবেষণার পরিচয় প্রদান করিয়াছেন তাহা নিতান্তই আশ্চর্য্যজনক। অধিকতর আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে জ্যোতিষ্কতত্ত্বের আলোচনায় অনেক ললনারত্ন পুরুষের সমকক্ষতা লাভ করিয়াছেন। মার্কিন নারী মিসেস ফ্রেমিং এবং মিস্ ক্যানেনর বিষয় অনেকেই অবগত আছেন। যদিও তাঁহারা বিদেশীয়া, আমাদের মাতৃভূমি হইতে শত শত ক্রোশ দূরে অবস্থিত তথাপি এই সমস্ত মহিলা সমগ্র নারীজাতির গৌরবস্বরূপ সন্দেহ নাই। প্রতীচ্যদেশে এবং প্রাচ্য জগতেও এরূপ অনেক মহিলা আছেন, যাঁহাদের প্রতিভা স্মরণ করিয়া প্রাণ এক সার্ব্বভৌমিক আনন্দে পরিপ্লুত হয়। এস্থলে খনা, লীলাবতী প্রভৃতি ভারতের অতীত কালের বিদুষী নারীগণ স্মৃতিপথে উদিত হইতেছেন।
ভূমণ্ডল হইতে সূর্য্যের দূরত্ব সামান্য নহে। এই দূরত্ব সম্বন্ধে জ্যোতিষিগণের মধ্যে কিঞ্চিৎ মতভেদ দৃষ্ট হয়। কেহ কেহ বলেন সূর্য ও পৃথিবীর ব্যবধানপথ নয় কোটি বিশ লক্ষ মাইল (৯২০০০০০০)। কেহ বলেন, নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল (৯৫০০০০০০), কেহ কেহ বা নয় কোটি তেত্রিশ লক্ষ মাইল বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়াছেন। যদিও নক্ষত্রপুঞ্জের তুলনায় সূর্য্যমণ্ডল দূরত্বে অনেক ন্যূন, তথাপি সূর্য্য সম্বন্ধে কোন বিষয় স্থির সিদ্ধান্ত করা সহজসাধ্য নয়।
সূর্য্যের ব্যাস প্রায় আট লক্ষ তিপ্পান্ন হাজার তিন শত আশি মাইল (৮৫৩৩৮০), পরিধি প্রায় আটাইশ লক্ষ মাইল (২৮০০০০০)। পৃথিবী হইতে রবি প্রায় তের লক্ষ বত্রিশ হাজার (১৩৩২০০০) গুণ বড়। অর্থাৎ সূর্য্য প্রায় তের লক্ষ বত্রিশ হাজার পৃথিবীর সমান। কিন্তু ইহার ওজন ভূমণ্ডল হইতে মাত্র তিন লক্ষ তেত্রিশ হাজার গুণ বেশী। যদি তুলা দণ্ডে পরিমাণ করা যায় তবে রবি ওজনে তিন লক্ষ তেত্রিশ হাজার পৃথিবীর তুল্য হইবে। রবিদেহের তারল্যই বোধ হয় তাহার ভারের অল্পতার কারণ।
পৃথিবীর ব্যাস (৪০০০) চারি হাজার মাইল, চন্দ্রের ব্যাস (১৫৮০) এক হাজার পাঁচ শত আশি ক্রোশ। কিন্তু পৃথিবীর ভার চন্দ্র অপেক্ষা ৭৮ গুণ বেশী। অর্থাৎ পৃথিবী ওজনে ৭৮টি চন্দ্রের সমান। এই হিসাবে সূর্যমণ্ডলের ভার অপেক্ষাকৃত অনেক অল্প সন্দেহ নাই।
ধন্য বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ! বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ বলেই মর্ত্তাবাসী ক্ষুদ্র মনুষ্যগণ সুন্দর ব্যোমবিহারী জ্যোতিষ্কমণ্ডল ওজন করিতে সমর্থ হইয়াছেন।
আলোক নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হইয়াছে যে ইথরপুঞ্জের স্পন্দন হইতেই আলোকের উৎপত্তি। আলোক বিরাট বিশ্বব্যাপী ইথর-তরঙ্গের খেলা মাত্র। সূর্য্য এবং নক্ষত্রপুঞ্জ সেই আলোকরাশিরই উদ্ভবস্থান— তেজোরাশির বিশাল ঘনীভূত সমষ্টি মাত্র; মহা আকর্ষণে মহাশূন্যে অবস্থিত,—বিবুর্ণিত এবং প্রধাবিত। মহাত্মা নিউটন, আকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়া জগতের বরণীয় হইয়াছেন। বর্ত্তমান যুগে বিজ্ঞান সেই আকর্ষণতত্ত্ব সম্বন্ধে কত প্রয়োজনীয় তথ্যই আবিষ্কার করিতেছেন তাহা এই প্রবন্ধের আলোচ্য নহে। জ্যোতির্ব্বিদ পণ্ডিতগণ স্থির করিয়াছেন যে সূর্য্যমণ্ডল পৃথিবীর ন্যায় কঠিন পদার্থ নহে, জলের ন্যায় তরলও নহে, অল্প গাঢ়তা বিশিষ্ট। স্বর্ণ, রৌপ্য, লৌহ, প্রভৃতি নানাবিধ দ্রবীভূত ধাতুময় পদার্থ দ্বারা ইহার প্রচণ্ড তাপবিশিষ্ট অঙ্গ গঠিত। বর্ণ বিশ্লেষযন্ত্রের সাহায্যে সুন্দর ব্যোমস্থিত মহান ভাস্কর-দেহের অনেক তত্ত্বই ক্ষুদ্র মানব-বুদ্ধির গোচরীভূত হইতেছে। এমন কোন কোন ধাতু সূর্য্য-কলেবরে আবিষ্কৃত হইয়াছে যাহা পৃথিবীতে দৃষ্ট হয় না।
সূর্য্যকে দূর হইতে রক্তবর্ণ বলিয়া প্রতীয়মান হয়; এজন্যই আর্য্য কবিগণ তাহাকে জবাকুসুম সঙ্কাশ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সূর্য্য-দেহের বর্ণ রক্তিম নহে, তাহা কৃষ্ণকান্তি বলিয়াই নির্ণীত হইয়াছে। উজ্জ্বল রশ্মিমালার জন্য কৃষ্ণবর্ণ সূর্য্যদেবকে লোহিতাঙ্গ বলিয়া ভ্রম জন্মে। রবির অঙ্গের প্রত্যেক বিন্দু হইতে সপ্তবিধ বর্ণ সমন্বিত প্রখর রশ্মিমালা উদ্ভুত হইয়া থাকে।
মার্তণ্ড অঙ্গে কতকগুলি কৃষ্ণবর্ণ কলঙ্কচিহ্ন ধরাবাসীর নয়নগোচর হয়। কখন কখন বা তাহা পরিবর্ত্তিত দৃষ্ট হইয়া থাকে। চন্দ্রকাস্তিতে যেসকল কলঙ্কচিহ্ন দর্শন করা যায় সৌরকলঙ্ক সেই প্রকার নহে। চন্দ্র পৃথিবী হইতে মাত্র (২৪০০০০) দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। সুতরাং যত সহজে চন্দ্র-দেহের তত্ত্ব সকল অবগত হওয়া যায়, বহু কোটি মাইল দূরবর্ত্তী সূর্য্যমগুলের তত্ত্ব অবগত হওয়া তত সহজ নহে। তবে কঠিন হইলেও বিজ্ঞানের দূরদর্শী সূক্ষ্ম দৃষ্টির নিকট কিছুই অবিদিত নাই।
দুই প্রকারে সূর্য্যের অঙ্গে কলঙ্ক-চিহ্ন উদ্ভুত হইয়া থাকে। প্রথমতঃ সূর্য্যাভ্যন্তরবর্ত্তী জ্বলন্ত ধাতব পদার্থের উৎক্ষেপন দ্বারা, দ্বিতীয়তঃ সূর্য্যমণ্ডলে নৈসর্গিক ঝঞ্ঝাবাত দ্বারা।
তালের রস অগ্নিতে জ্বাল দিতে দিতে ক্রমে যখন উহ! ঘনীভূত হইতে আরম্ভ করে, তখন সজোরে ফুটিতে থাকে। যেমন তাহা ফুটিয়া বেগে উৎক্ষিপ্ত হয় তেমনই সূর্য্যমণ্ডলাভ্যন্তরস্থ দ্রব ঘনীভূত ধাতব পদার্থসকল প্রচণ্ড উত্তাপে ফুটিতে থাকে এবং কখন কখন ভীষণ বেগে উৎক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে। তাহাতে ঐ সকল স্থান গভীর গহ্বরের আকার ধারণ করে। সূর্যমণ্ডলে যেসকল কলঙ্কচিহ্ন অর্থাৎ কাল কাল দাগ দর্শন করা যায়, তাহা উক্ত প্রকাণ্ড গহ্বর ভিন্ন আর কিছুই নহে। একবার এ প্রকার একটি গহ্বরের বিষয় গণনা করিয়া কোন কোন জ্যোতিষী বলিয়াছেন যে তাহার ব্যাস (৬০০০০) ষাট হাজার মাইলেরও অধিক। কিন্তু সূর্য্যদেহের তারল্য বশতঃ এ সকল গহ্বর অধিক দিন স্থায়ী হইতে দেখা যায় না, দ্রব পদার্থ দ্বারা শীঘ্রই পূর্ণ হইযা যায, আবার নুতন গহ্বরের সৃষ্টি হয়। মার্তণ্ডের মহান অগ্নিময় দেহে সতত এই প্রকার কত গহ্বরের সৃষ্টি ও বিলয় হইতেছে। সূর্য্যদেহে ঝঞ্ঝাবাত আরও আশ্চর্যজনক ও ভীষণ।
শ্যামসুন্দর ধরা রাজ্য যে বায়ুমণ্ডলে আচ্ছাদিত, তাহা যেন কদম্ব-কেশরের ন্যায়। এই অনিল প্রবাহ ভূমণ্ডলের চারিদিকে ব্যাপ্ত থাকিয়া অবিশ্রান্ত সঞ্চালিত হইতেছে। কখন কখন বা সে বায়ুপ্রবাহে ঝড় উঠিয়া বসুন্ধরাবাসী দিগকে আতঙ্কিত করিয়া থাকে; সেইরূপ এক প্রকার বাষ্পমণ্ডল সূর্য্যের চারিদিক বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। সবিতার নিজ অঙ্গীভূত ধাতব পদার্থ-সকলেরই কিয়দংশ তাহার অসহনীয় উত্তাপে বাষ্পীভূত অবস্থায় মার্তণ্ড অঙ্গের চতুর্দ্দিকে অবস্থান করিতেছে। সেই বাষ্পমণ্ডলও সময় সময় ঝড়ের মত ভীষণবেগে আন্দোলিত হইতে দেখা যায়। তাহাতে সূর্য্যের প্রায় দ্রবীভূত-দেহের কোন কোন অংশ প্রচণ্ড বেগে বহুদূরে উত্থিত হইয়া থাকে। সূর্য্যদেহস্থিত কলঙ্কচিহ্নসকলের কতকগুলি এই প্রচণ্ড বাত্যা হইতে সমুদ্ভূত। জ্যোতিষিগণ গণনা করিয়া দেখিয়াছেন যে জলস্তম্ভের ন্যায় সেই রবিদেহ হইতে উত্থিত জল অগ্নিময় দ্রবীভূত অংশ সূর্য্যমণ্ডল ছাড়াইয়া কখন কখন সহস্র সহস্র মাইল পর্য্যন্ত ছুটিয়া যায়। একবার একজন জ্যোতিষী গণনা করিয়া দেখিয়াছিলেন, এই প্রকার উত্থিত অংশ চৌত্রিশ সহস্র মাইল (৩৪০০০) পর্যন্ত ধাবিত হইয়াছিল। সেই সময় পৃথিবীবাসী মানব রবিমণ্ডলের কি অপরূপ শোভা দর্শন করিয়া মোহিত হন! আমরা সেই অগ্নিতরঙ্গের অলোকসামান্য সৌন্দর্য্যের বিষয় কল্পনায় আর কি অনুভব করিব?
পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় একবার স্বীয় মেরুদণ্ডে আবর্ত্তন করে এবং তাহাই দিন রাত্রির কারণ, ইহা সকলেই অবগত আছেন। অনেক গবেষণার পর সূর্য্যের আহ্নিক গতিও নিরুপিত হইয়াছে। এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মধ্যে— ব্রহ্মাণ্ডপতির সৃষ্ট রাজ্যে কিছুই স্থির নাই। সুদূর নীহারিকা হইতে সৌর জগৎস্থিত গ্রহ উপগ্রহগণ সমস্তই ঘুর্ণিত হইতেছে। এমন কি চক্ষুর অগোচর যে পরমাণু সমূহ—ইথারপুঞ্জ তাহাও অবিরাম স্পন্দিত হইতেছে, পরস্পর আবর্ত্তিত হইতেছে। পৃথিবীর ২৭ দিন সময়ে মার্তণ্ডদেব একবার স্বীয় মেরুদণ্ডে ঘূর্ণিত হন। কেহ কেহ ঐ ঘূর্ণনবেগ ২৫ দিন বলিয়া স্থির করিয়াছেন। বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে, সূর্য্যমণ্ডল আপনার গ্রহ উপগ্রহ সম্বলিত সৌর জগৎ লইয়া এক মহাস্বর্য্যের চতুর্দ্দিকে ভ্রাম্যমান হইতেছে।
যে মহালোক লক্ষ্য করিয়া মার্ত্তণ্ডমণ্ডল অবিরাম ছুটিয়া যাইতেছে, পৃথিবীবাসী মনুষ্যগণ তাহাকে নক্ষত্র আকারে দর্শন করিয়া থাকে। সে প্রকাণ্ড নক্ষত্রের নাম অভিজিৎ, তাহা আলোক নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হইয়াছে। মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শনি প্রভৃতি গ্রহগণ যেমন এক একটি কক্ষ অবলম্বন করিয়া নির্দ্দিষ্ট গতিতে বিমানপথে ছুটিয়া যায় সূর্য্য তেমনি আপন গ্রহ উপগ্রহ সহ একটি কক্ষপথে নির্দ্দিষ্ট গতিতে ছুটিতেছে। বহু গবেষণার পর জ্যোতিষিগণ এই সৌরগতির সময় নিরুপণ করিতে সমর্থ হইয়াছেন, কিন্তু ইহাতে বিস্তর মতভেদ দৃষ্ট হয়। সুতরাং সৌরগতির নিরুপিত কাল কতদূর অভ্রান্ত তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন। কেহ কেহ বলেন, সূর্য্য প্রতি সেকেণ্ডে তের মাইল বেগে আপন কক্ষে ধাবিত হইতেছে। কাহারও মতে ঐ ঘূর্ণনবেগ প্রতি সেকেণ্ডে ১১ মাইল।
ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র বলেন— অভিজিৎ তিনটি উজ্জ্বল তারকাযুক্ত নক্ষত্র। আকৃতি একটি বৃন্তহীন পানের ন্যায়।
কোষ্ঠী-প্রদীপ এবং শিরোমণিসিদ্ধান্তে অভিজিৎ নক্ষত্রের বর্ণনা লিখিত হইয়াছে। “অভিজিৎ নক্ষত্রের উদয় সময়ে জন্মগ্রহণ করিলে মানবগণ অতি মনোরম রূপ লাভ করে এবং সজ্জনের আদরণীয় শান্ত প্রকৃতি লাভ করে! বিশেষতঃ দেবতাতে অনুরাগ, যশঃ, গৌরব এবং বাগ্মিতা প্রভৃতি অভিজিৎ নক্ষত্রের জন্মের ফল।”
এই নক্ষত্র ভূমণ্ডলের দক্ষিণ দিকে দৃষ্ট হয়।
আধুনিক প্রতীচ্য জ্যোতিষিগণ এই নক্ষত্রের তত্ত্ব অবগত হইবার জন্য বহু গবেষণায় প্রবৃত্ত রহিয়াছেন। কিন্তু তাহার গতি প্রভৃতি সম্বন্ধে আজ পর্য্যন্ত বিশেষ কিছু জানিতে পারেন নাই।
আলোক নামক প্রবন্ধে লেখা হইয়াছে যে সূর্য্যের উত্তাপের পরিমাণ ছয় হাজার ডিগ্রিরও অধিক। এই ভীষণ কিরণরাশি সৌর রাজ্যের সমস্ত গ্রহ উপগ্রহে বিকীরণ করিতে করিতে মহাকায় মার্তণ্ড অবিশ্রান্ত ধাবিত হইতেছেন। এই সৌর জগৎস্থিত কোন কোন গ্রহে জ্যোতিষিগণ মনুষ্যের ন্যায় প্রাণীর বর্ত্তমানতার লক্ষণ উপলব্ধি করিয়াছেন। এস্থানে প্রসঙ্গ ক্রমে সৌর জগতের বিষয় কিঞ্চিৎ উল্লিখিত হইল।
সৌর রাজ্যস্থিত গ্রহ উপগ্রহের সংখ্যা দুই শতেরও অধিক বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। গ্রহগণের মধ্যে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেন্স্ ও নেপচুন এই আটটি প্রধান। এতদ্ভিন্ন আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রহ আছে।
বুধ সর্ব্বাপেক্ষা সূর্য্যের নিকটতম গ্রহ; রবিমণ্ডল হইতে তিন কোটি তিপান্ন লক্ষ নব্বই হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। বুধ ৮৮ দিনে একবার সূর্য্যমণ্ডল প্রদক্ষিণ করিয়া থাকে। পৃথিবী এবং মঙ্গলের পূর্ণাবর্ত্তন ২৪ ঘণ্টায় সম্পাদিত হয়। কিন্তু বুধ গ্রহের পূর্ণাবর্ত্তন কাল ৮৮ দিন বলিয়া নির্ণীত হইয়াছে।
শুক্র গ্রহ সূর্য্য হইতে ছয় কোটি একষট্টি লক্ষ ত্রিশ হাজার মাইল দূরে অবস্থান করিতেছে। তাহার আবর্ত্তন কাল ২৩ ঘণ্টা ২১ মিনিট মাত্র। শুক্র এবং পৃথিবী এই উভয় গ্রহের মধ্যবর্ত্তী আর কোন গ্রহ নাই। সুতরাং পৃথিবী হইতে শুক্রকে অত্যন্ত উজ্জ্বল দেখা যায়। সন্ধ্যাকালে যে সন্ধ্যাতারা এবং প্রভাত কালে প্রভাতীতারা আকাশে দর্শন করা যায় তাহা শুক্র গ্রহেরই নামান্তর মাত্র। গ্রহগণের অনেকগুলিই চন্দ্র-সম্পদে সুশোভিত। মঙ্গলগ্রহ এবং পৃথিবীর মধ্যেও অন্য কোন গ্রহের ব্যবধান নাই। পৃথিবী হইতে মঙ্গলগ্রহ চারি কোটি আশি লক্ষ মাইল দূরে অবস্থিত। কখন কখন মঙ্গলগ্রহ ইহা অপেক্ষা নিকটবর্ত্তী হয়। এই গ্রহ দেখিতে অতি সুন্দর, প্রায় দুইবৎসর সময়ে সূর্য্যকে এক বার প্রদক্ষিণ করে। শুক্র এবং মঙ্গল এই উভয় গ্রহই আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। এই দুই গ্রহই মনুষ্যের ন্যায় বুদ্ধিমান জীবের আবাসভূমি বলিয়া জ্যোতিষিগণ স্থির করিয়াছেন। শুক্র এবং মঙ্গলের রাজ্যে মেঘ, সমুদ্র, পর্ব্বত বৃক্ষাদির অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাঁহারা নাকি নিঃসন্দেহ হইয়াছেন। ঐ দুই গ্রহে যদি সত্যই কোন বুদ্ধিমান জীব বাস করে, তাহারা কি প্রকার, এবং তাহাদের আচার ব্যবহারই বা কি, বিজ্ঞান যদি তাহা জানিতে সমর্থ হন, তবে বড় আনন্দের বিষয় হইবে। এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মধ্যে এমন অনেক স্থান আছে যাহাতে পৃথিবীবাসী মনু্য্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর প্রাণী অবস্থিতি করিয়া ভগবানের করুণা অনুভব করিতেছেন।
সূর্য্যের বার্ষিক গতি কত কালে নিষ্পন্ন হয় তাহাও সম্যক্ স্থিরীকৃত হয় নাই।
একই সূর্য্যের মহা আকর্ষণে সৌর জগতস্থিত জ্যোতিষ্কগণ ব্যোমপথে ভ্রাম্যমান! বিশ্ববিধাতার মহা অচিন্তনীয় বিধান কি আশ্চর্য্য! কেহ কাহাকে স্পর্শ করিতেছে না, কেহ কাহারও অনিষ্ট করিতেছে না, অনাদিকাল ব্যাপিয়া জোতিষ্কগণ অবিরাম আপন আপন নির্দ্দিষ্ট পথে ভীষণ বেগে চলিয়া যাইতেছে। আকর্ষণে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে এমনই আকৃষ্ট রহিয়াছে যে চিন্তা করিলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। ধন্য সেই সৃষ্টিকর্ত্তা যিনি এই রবিমণ্ডল সৃষ্টি করিয়াছেন! এই প্রকার কত লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি সূর্য্য তদীয় সৃষ্ট রাজ্যে রহিয়াছে কে তাহার ইয়ত্তা করিতে পারে? তাঁহার রাজ্য মধ্যে অহর্নিশি সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় সাধিত হইতেছে, কত সূর্য্য ধ্বংস প্রাপ্ত হইতেছে, কত সূর্য্যের নূতনসৃষ্টি হইতেছে, তাহার সীমা কে করিবে? পূর্ণ হৃদয়ে সেই দেবদেবকে নমস্কার করি।