সাহিত্য-চিন্তা/শ্রেষ্ঠ শিক্ষালয়

শ্রেষ্ঠ শিক্ষালয়

 অমরেন্দ্রনাথ অতি মনোযোগের সহিত প্রফুল্লকে পড়াইতে আরম্ভ করিলেন।

 অমরেন্দ্র যখন পড়াইতেন সেই বালিকাহৃদয়ে কি এক আনন্দ ধারা তাহার অজ্ঞাতসারে প্রবাহিত হইত। কোন্ দিক্ হইতে ইহা বহিয়া যাইত, সে তাহা নিজেই বুঝিতে সমর্থ হইত না।

 একদিন অমরেন্দ্র প্রফুল্লকে জ্যামিতির প্রতিজ্ঞা বুঝাইতেছেন। তিনি বলিতে লাগিলেন,—“প্রফুল্ল, এই একটা বৃত্ত; ইহার মধ্যবিন্দু হইতে কয়েকটি সরলরেখা টানিয়া লও। ইহারা পরস্পর সমান। ‘যে যে বস্তু কোন এক বস্তুর সমান, তাহারা পরস্পর সমান।’ এখন ভাল করিয়া বুঝাইতেছি।” এই বলিয়া তিনি প্রতিজ্ঞাটি ভাল করিয়া বুঝাইয়া দিয়া কহিলেন—

 “শোন প্রফুল্ল! এই প্রকার মানবজীবনের সমস্ত কার্য্যের মধ্যবিন্দু ভক্তি। আমরা যতগুলি কার্য্য করিয়া যাই, সেই ভক্তিকে স্পর্শ করিয়া কার্য্য যে-দিকেই বিস্তৃত হইয়া পড়ুক না কেন, জ্যামিতির পূর্ব্বোক্ত সরলরেখার ন্যায় তাহাদের কখনও অসামঞ্জস্য হইবে না।

 তাঁহার ছাত্রীটি এই সমস্ত কথা বুঝিতে পারিতেছে কিনা সেদিকে তাঁহার দৃষ্টি নাই। মানুষ যখন প্রকৃত জনহিতৈষণা-প্রণোদিত প্রেম ও হৃদয়াবেগ দ্বারা চালিত হয়, তখন সেই দেশ-সেবকের এ প্রকার দৃষ্টি অনেক সময়ই থাকে না। তাঁহার কথা লোকে সম্যক না বুঝিলেও তাহাতে অনেক কার্য্য হয়।

 প্রফুল্ল,—“ভক্তি কি?”

 অমরেন্দ্র.—“হৃদয়ের যে গভীর অহেতুক অনুরাগ তাহার নাম ভক্তি। প্রেম ভক্তিরই নামান্তর। আপনার পিতামাতা প্রভৃতিতে ভালবাসা ভক্তির প্রথম শিক্ষা; তারপর স্বদেশ। ভক্তি যখন আত্মীয়-স্বজন, স্বদেশ ছাড়াইয়া উচ্ছ্বসিতা কুলপ্লাবিনী তটিনীর ন্যায় অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়াইয়া পড়ে, তখনই তাহার পরিপূর্ণতা সম্পাদিত হয়। তখনই বিশ্বমোহিনী ভক্তির পূর্ণ বিকাশ ও তাহার সাফল্য লাভ হইয়া থাকে। ইহারই নাম সার্ব্বভৌমিক প্রেম। ইহা ভিন্ন জীবনের সার্থকতা কোথায়? যেমন জ্ঞানার্জ্জনের পূর্ব্বে বর্ণমালা শিক্ষার আবশ্যক সেই প্রকার বিশ্বজনীন প্রীতিলাভ করিতে হইলে, প্রথমে পিতামাতা প্রভৃতি আত্মীয় স্বজন এবং স্বদেশকে ভালবাসা চাই।”

 প্রফুল্ল সকল কথা ভাল করিয়া না বুঝিলেও, যেটুকু বুঝিতেছে তাহাই তাহার হৃদয়ে তীরের মত বিদ্ধ হইতেছে। সে কহিল—

 “কেমন করিয়া ভক্তি লাভ হয় বুঝাইয়া বলুন।”

 অমরেন্দ্র,—“শিশুর যে মায়ের প্রতি অনুরাগ তাহা কেমন করিয়া হয়? উহা স্বভাব হইতেই জন্মে। প্রথম হইতেই সে ‘মা’ ‘মা’ বলিয়া কাঁদিতে শিখে। মায়ের কোলে যাইয়া সকল ব্যথা ভুলিয়া যাইতে হইবে, ইহা শিশুকে কে শিখাইয়া দেয়? বিশ্বজননী অনন্ত প্রেমের প্রস্রবণ। তাঁহার অর্চ্চনা করিলে ভক্তি বিকশিত হয়। যিনি হিন্দুর মন্দিরে আদ্যাশক্তি রূপে পূজিতা, সকল দেশে, সকল সম্প্রদায়ে তাঁহারই অর্চ্চনা হইতেছে। সেই প্রেমের অমৃত ধারার নিকট সকল দেশ, সকলজাতি, সকল বর্ণ, তুল্য। এখানে কি মধুর সম্মিলন? প্রথমে ভক্তিভাবে স্বদেশের কল্যাণকর কার্য্যে ব্রতী হওয়া চাই।”

 প্রফুল্ল,—“স্ত্রীলোকেরা কি দেশের কাজ করিতে পারে না?”

 অমরেন্দ্র.—“পূর্ব্বেই তো নারীশক্তি জাগ্রত হওয়ার আবশ্যক। ভক্তিতেই শক্তিলাভ হয়। নারীশক্তি জাগিয়া না উঠিলে শক্তির বিকাশ অসম্ভব। এই শক্তির বিকাশ হইতেই দেশ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে।”

 প্রফুল্ল—“নারীশক্তি জাগিয়া উঠিবার উপায় কি বিশেষ করিয়া বলুন।”

 অমরেন্দ্র,— “হৃদয়মধ্যে ভক্তি লাভ করিবার যেসকল অন্তরায় আছে নারীগণ তাহা প্রথমে দূর করুন। বীজ হইতে বৃক্ষ আপনি জন্মে, আপনিই তাহাতে ফল প্রসূত হয়। এ কার্য্যভার প্রকৃতিই গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু কৃষক যদি সে অঙ্কুরোদগমের স্থানটি প্রস্তরদ্বারা চাপিয়া রাখে তবে প্রকৃতির কার্য্য বন্ধ হয়।

 প্রফুল্ল,—“বুঝিলাম না।”

 অমরেন্দ্র,—“বাহিরে যেমন প্রকৃতির কার্য্য ভিতরেও ঠিক তেমন। নারীগণ যদি আপনার প্রাণকে ঠিক স্বাভাবিকতায় প্রতিষ্ঠিত রাখেন, অর্থাৎ নানাপ্রকার হিংসা, বিদ্বেষ, বৃথা কলহ প্রভৃতি আবর্জনা হৃদয় হইতে দূর করিয়া দেন, তাহা হইলে প্রকৃতির প্রসাদে প্রীতি প্রভৃতি সদ‍্গুণ সকল আপনি বিকশিত হইয়া উঠিবে। তাহাদের সন্তানগণও নানা সৎশিক্ষায় সুশিক্ষিত হইতে থাকিবে।”

 প্রফুল্ল—“একথাটি আর একটু পরিষ্কার করিয়া বলুন।”

 অমরেন্দ্র—“সন্তানগণ বড় হইলে যে তাহার শিক্ষা আরম্ভ হয়, এমন নহে। শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন হইতে তাহার শিক্ষা আরম্ভ হয়। অনেকে মনে করেন -যে শিশুরা কিছুই বোঝে না। কিন্তু শিশুর ধারণাশক্তি অতিশয় প্রবল। সেই কোমল প্রাণে যেশিক্ষা প্রবিষ্ট হয়, তাহা একেবারে বদ্ধমূল হইয়া যায়। এজন্য মাতৃগণের কর্তব্যনিষ্ঠ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। নারীজাতির কর্তব্য যে কেবল ঘরকন্নায় আবদ্ধ থাকিবে, এমন হইতে পারে না। সমাজের প্রতি কর্তব্য, দেশের প্রতি কর্তব্য, এই প্রকার অনেক কর্ত্তব্য আছে। মাতা যদি সকলদিক্ দিয়া কর্ত্তব্য পরায়ণতা লাভ করেন, তাহা হইলে সন্তানগণ বাল্যকাল হইতে এমন কর্তব্যনিষ্ঠায় দীক্ষিত হইয়া উঠিবে যে, তাহারা জীবনের কোন সময়েই সেই কর্ত্তব্য পথ হইতে ভ্রষ্ট হইবে না। সংসর্গ, শিক্ষা ও মাতৃস্তন্য প্রকৃতিকে কিপ্রকার পরিবর্ত্তিত করে তাহার একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।

 “একবার এক বাঘিনী একটী নবজাত মনুষ্য-শিশু হরণ করিয়া লইয়া গিয়াছিল,”—

 নরেন কিঞ্চিৎ দূরে বসিয়া অঙ্ক কষিতেছিল। সে এই বাঘের গল্প শুনিয়া শ্লেট পেন্সিল ফেলিয়া অমরেন্দ্রের কাছে আসিয়া বসিল। নিতান্ত আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিল,—

“দাদা! তারপর?”

 অমরেন্দ্র,—“তারপর সেই শিশুটিকে বাঘিনী আপন স্তন্য দিয়া প্রতিপালন করিতে লাগিল। বাঘিনী-মাতা ও তাহার শিশুগণের সহিত সে মনুষ্যবালক একত্রে বর্ধিত হইতে লাগিল। বালক‍্টি ৬।৭ বৎসর পরে এক অরণ্যে বাঘিনী-মাতার আশ্রয় হইতে মনুষ্যের হস্তগত হইল।”

 নরেন,—“তারপর উহাকে কি করিল?”

 অমরেন্দ্র,—“প্রথম উহাকে একটা প্রাচীর দেওয়া বাগানে খোলা-ই রাখা হইয়াছিল। বাঘ যেমন শিকার ধরিয়া থাকে সেও সেইরূপ শিকার ধরিবার চেষ্টা করিত। একদিন সে অন্য একটি বালককে সেইভাবে হঠাৎ আক্রমণ করিল। তাহার পর হইতে উহাকে শিকল দিয়া রাখা হইত। তাহার ঠিক্ বাঘের প্রকৃতিলাভ হইয়াছিল; —সেই প্রকার তেজ, সেই প্রকার চলাফিরা আহার ও খেলা, সেইপ্রকার থাবা মারিয়া ধরা এখন দেখ, শিক্ষ। ও মাতৃস্তন্য মানুষের প্রাণে কত কার্য করিয়া থাকে।”

 নরেন ব্যস্ত হইয়া কহিল—“দাদা, তারপর সে ছেলেটির কি হইল?”

 অমরেন্দ্র—“তারপর সেই ছেলেটির প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য নানা উপায় অবলম্বন করা হইল। মনুষ্যের মত তাহার খাদ্যের বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হইল। অর্থাৎ ভাত এবং মাংস রাঁধিয়া দেওয়া হইত। কিন্তু সে খাদ্য উহার সহ্য হইল না, শীঘ্রই সে পেটের পীড়ায় মারা গেল।”

 অমরেন্দ্র বলিতে লাগিলেন—“শোন প্রফুল্ল! মনুষ্য এইপ্রকার বাঘের প্রকৃতি কোথা হইতে পাইল? ইহার একমাত্র উত্তর—মাতৃস্তন্য ও শিক্ষা হইতে। মন্দদিকে যেমন, ভালদিকেও সেইপ্রকার শিক্ষিত হইতে পারে। মাতৃস্তন্যপানের সঙ্গে সঙ্গে যেশিক্ষা মাতার নিকট হইতে মানবগণ লাভ করিয়া থাকে, তাহার শক্তি অসামান্য। আমাদের জননীগণ যদি ভক্তিতে উদ্বোধিতা হইয়া উঠেন, আমরা সে মহাউদ্বোধন মাতার নিকট হইতে লাভ করিব। আমাদের মাতৃগণের হৃদয় যদি প্রেম ভক্তিতে পূর্ণ হয়, তবে আমরা কেন না প্রেমিক ও ভক্ত হইব? ভারতের অর্দ্ধেক এই নারী-শক্তি। নারী-শক্তি চেতুনা লাভ করুক, তবেই দেশের প্রকৃত উন্নতি সাধিত হইবে। মাতৃক্রোড়ই জগতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষালয়।”[]

  1. লেখিকার “অমরেন্দ্র” নামক উপন্যাস হইতে।