আলোক

 আলোক! তুমি নিখিলের আনন্দ, অনন্তলীলাপূর্ণ, বৈচিত্রপূর্ণ, জীবলোকের পরমসম্পদ—বিশ্বজগতের প্রাণ। এই মর্ত্যলোকে কে তোমায় আনিল বল দেখি? নিয়তিসূত্রে ভ্রাম্যমান, বিচিত্র কার্য্যকারণ-শৃঙ্খলাবদ্ধ বিরাট বিশ্বযন্ত্রে আনন্দরূপে কে তোমায় ঢালিয়া দিল, বল দেখি? যখন তুমি ভুবনমোহিনী ঊষার রত্নকিরীট বিভূষিত করিয়া অনন্ত সীমাশূন্য অতলস্পর্শ অন্ধকার পারাবার ভেদ করিয়া ধরাতলে অবতীর্ণ হও, তোমার স্বর্ণ-কিরণছটায় বসুন্ধরা রঞ্জিত হইয়া উঠে। শুভ্র অঞ্চলে কাঞ্চন ঢালিয়া দিয়া ঊষাদেবী যখন জীবের দ্বারে সমাগত হন, তাঁহার মধুর হাস্যরাশি চরাচর-বক্ষে উছলিয়া পড়ে সেই গুভমুহূর্ত্তে তোমার অমৃতস্পর্শে নিতান্ত নিরাশ প্রাণেও কি আশার সঞ্চার হয় না? নিতান্ত দুঃখতপ্তহৃদয়েও কি আনন্দের একটি রেখা অঙ্কিত হব না? তোমার নিকট ধনী দীন পাপী সাধুর ভেদ নাই। যে ব্যক্তি জগৎকর্তৃক পরিত্যক্ত— ঘুণিত, পদদলিত, তোমার স্নেহবাহু তাহার জন্যও প্রসারিত। এমন সাম্যনীতি মানবের কোথায়?

 দ্যুলোক ও ভুলোকে বরণীয়, আলোক-শিশুর প্রথম জন্ম, স্থিতি এবং অনন্তরূপে বিকাশ সম্বন্ধে নানাদেশে নানাপ্রকার অদ্ভুত রহস্যপূর্ণ গল্প রচিত হইয়াছে। ভারতের পুরাণ ইতিহাসেও এই প্রকার অদ্ভুত চলিত গল্পের অভাব নাই। গল্প ও রূপকের মনোহর আবরণে সত্যের উজ্জ্বলদেহ আচ্ছাদন করা সকলদেশেরই অতীত ইতিহাস-লেখক—বর্ত্তমান জনসমাজের পূর্ব্বপুরুষগণের— আমোদের বিষয় ছিল। সেই রূপকের আবরণ ভেদ করিয়া শুদ্ধ সত্যকে জনসমাজে প্রকাশিত করা মনীষা-সম্পন্ন ব্যক্তিগণের পক্ষেও নিতান্ত দুঃসাধ্য হইয়া পড়িয়াছে। বর্ত্তমান যুগের জ্যোতিষিগণ কল্পনার আশ্রয় ছাড়িয়া দিয়া বিজ্ঞানের সাহায্যে আলোক সম্বন্ধে যতটুকু সত্য লাভ করিয়াছেন তাহারই কিঞ্চিৎ আলোচনা এখানে করিব।

 সূর্য্যের আলোক-রশ্মি সহস্রভাগে বিভক্ত হইয়া ধরারাণীর নয়নগোচর হয়। ঐ রশ্মিসমূহ কিরণ বা অংশুনামে অভিহিত হইয়া থাকে। এ নিমিত্তই সূর্য্যের নাম সহস্র-রশ্মি বা সহস্রাংশু মানবের দেহরক্ষার উপযোগী যতপ্রকার বস্তু দেখিতে পাওয়া যায় তন্মধ্যে সূর্য্যালোকের উপকারিতা অসামান্য। সূর্য্যালোক ভিন্ন ভূমণ্ডলে আরও বহুবিধ আলোক দৃষ্ট হয়; যথা নক্ষত্রালোক, চন্দ্রালোক, তড়িতালোক, অগ্নি দ্বারা সমুৎপন্ন আলোক ইত্যাদি। উজ্জ্বল মণিসমূহ হইতে একপ্রকার আলোক নির্গত হইতে দেখা যায়। জোনাকীপোকা এবং সমুদ্রজাত কোন কোন প্রাণী হইতে একপ্রকার আলোক নিঃসৃত হয়। বিস্তৃত জলাভূমিতে, প্রান্তর মধ্যে গলিত-প্রায় কোন কোন উদ্ভিদের দেহ হইতে নিশাকালে যে এক প্রকার বাষ্প বাহির হয়, তাহাতে আমরা আলোক দেখিতে পাই। তাহা প্রকৃত আলোক না হইলেও আলোক নামেই খ্যাত।

 নিবিড় বনানীসম্ভূত দাবাগ্নির বহুদূরব্যাপী দীপ্ত আলোকরশ্মিতে এবং আগ্নেয়গিরি উদ্ভুত আলোকের কিরণছটায় অনেক দেশ দীপ্তিময় হইয়া থাকে। নীলাম্বুনিধির বিশালবক্ষেও স্থানে স্থানে বাড়বাগ্নি নামক এক প্রকার আলোকের উদ্ভব দর্শন করিয়া সাগরতীরবাসী এবং পোতারোহী মানবগণ ভয়ে ও বিস্ময়ে অভিভূত হন।

 মানবের দৃষ্টিশক্তির অগোচর সূক্ষ্ম হইতেও সূক্ষ্মতর যে ইথর-তরঙ্গ মহান্ ব্যোম ব্যাপিয়া অবস্থান করিতেছে আমাদের অধিষ্ঠানভূতা বিশাল পৃথিবী অনাদিকালে একদিন যে ইথররূপী পরমাণুপুঞ্জে বর্ত্তমান ছিল, আলোক সেই ইথর-তরঙ্গের শক্তিরই অংশ মাত্র। ইথর-তরঙ্গের এই মঙ্গলময় খেলা আলোকরূপে লোকলোচনের গোচরীভূত হইয়া থাকে। পরমাণুপুঞ্জের স্পন্দন হেতুই যে আলোকের সৃষ্টি তাহা বিজ্ঞান অনেক দিন হইল প্রমাণ করিয়াছে। পরমাণুপুঞ্জের এই স্পন্দন, ঘর্ষণ, ঘাত প্রতিঘাত, বিরাট বিশ্বের সৃষ্টি ও রক্ষণ ব্যাপারে কি প্রকার কার্যকারিতা প্রদর্শন করিতেছে, যুগের পর যুগ, দিনের পর দিন ভৌতিকজগতে কি প্রকার পরিবর্ত্তন সাধিত করিতেছে তাহা নির্দ্ধারণ করিতে জ্যোতিষিগণ সর্ব্বদাই আপনাদের অসামান্য ধীশক্তি এবং সূক্ষ্মদর্শিতার পরিচয় প্রদান করিতেছেন। নিউটন প্রভৃতি পণ্ডিতগণ আলোকতত্ত্ব সম্বন্ধে অনেকগুলি সত্য জনসমাজে প্রচার করিয়া বাস্তবিকই জগতের অশেষ কল্যাণ সাধন করিয়াছেন। সূক্ষ্ম হইতেই স্থুলের সৃষ্টি। যাহা চক্ষুর অগোচর, দূরবীক্ষণ যন্ত্রেরও অগোচর সেই সূক্ষ্মতত্ত্বের গবেষণা বিশেষ দূরূহ ও আয়াসসাধ্য সন্দেহ নাই। ইথর-তরঙ্গের শক্তি, জন ষ্টুয়ার্ট মিল প্রভৃতি মনীষিগণ অন্ধশক্তির কার্য্য বলিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু বাস্তবিকই কি তাই? নানা ভাবপূর্ণ, লীলাপূর্ণ, সৌন্দর্যপূর্ণ, সুনিয়ম ও শৃঙ্খলাবদ্ধ বিরাট বিশ্বরাজ্যের সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়কার্য্য শুধু কি অন্ধশক্তির ক্রিয়া? ইহাতে কি কোন চৈতন্যময়, মঙ্গলময় শক্তি কার্য্য করিতেছে না? সত্য সত্যই সাধকগণ প্রতি পরমাণুতে এক মহান্ চৈতন্যময় জ্ঞানময় শক্তি দর্শন করিয়া কৃতার্থ হন।

 মহাকায় সূর্য্যমণ্ডলের ভীষণ অগ্নিময়দেহ হইতে উৎপন্ন হইয়া আলোক গ্রহ, উপগ্রহ সকলের জবনীশক্তি বিধান করিতেছে এবং নানা প্রকারে তাহাদের অশেষ কল্যাণসাধন করিতেছে। মার্তণ্ডমণ্ডল হইতে আলোকমালা প্রতি সেকেণ্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল ধাবিত হইয়া ৮ মিনিট ১৮ সেকেণ্ড সময়ে ধরণীরাজ্যে পঁহুছিয়া থাকে।

 আপনার ভীষণ-দর্শন দেহস্থিত প্রচণ্ড প্রলয়রূপী অগ্নিরাশিতে অহর্নিশি দগ্ধীভূত হইয়া অংশুমালী সূর্য্য অবিরত সৌরজগতে আলোক বিকীরণ করিতেছেন। জ্যোতিষিগণ সেই প্রলয়রূপী সূর্য্যকিরণের উত্তাপ সম্বন্ধে গণনা করিয়া দেখিয়াছেন যে সূর্য্যের তাপের পরিমাণ ছয় হাজার (৬০০০) ডিগ্রিরও অধিক! কেহ কেহ বা ঠিক ছয় হাজার ডিগ্রি বলিয়াই নির্দ্ধারণ করিয়াছেন। ভূমণ্ডল হইতে লক্ষ লক্ষ গুণ বৃহত্তর, প্রকাণ্ডকায়, মার্তণ্ড দেব অনেকগুলি গ্রহ উপগ্রহে পরিবৃত হইয়া অবিশ্রান্ত ছুটিতেছেন। আপনার কক্ষপথে আবর্ত্তন করিতে করিতে ভীমবেগে (সেই ভ্রমণবেগ এক সেকেণ্ডে প্রায় ত্রয়োদশ মাইল) অভিজিৎ নামক মহালোক লক্ষ্য করিয়া ধাবিত হইতেছেন।

 রবিমণ্ডলের ভ্রমণবেগের সহিত আলোকরাশি গ্রহ উপগ্রহে বিকীর্ণ হইয়া পড়িতেছে। প্রতিদিন যে পরিমাণ আলোকরশ্মি অবিশ্রান্ত সৌরজগতে বিতরিত হইতেছে তাহার অতি সামান্য অংশই বহুধাবাস। জীবগণ লাভ করিয়া থাকেন। সূর্য্য কতকাল এই আলোক বিতরণকার্য্যে নিযুক্ত আছেন, আর কত কালই বা থাকিবেন তাহা মানব-বুদ্ধির অতীত।

 নীল, পীত, লোহিত, হরিত, অতি পাটল, বেগুণে, গাঢ় ধূমল এই সপ্তবিধ পরম রমণীয় মূল বর্ণ আলোক রশ্মিতে দৃষ্ট হয়। বর্ণ সমূহের রাসায়নিক সংমিশ্রণজন্য সূর্য্যালোককে বর্ণহীন বলিয়া প্রতীতি জন্মে। রাসায়নিক সংমিশ্রণরূপ মহাবিধানে শুধু আলোক-নিহিত বর্ণসমূহ কেন, অনেক বস্তুই সম্পূর্ণ রূপান্তর হইয়া থাকে। বিশ্বের অনস্ত মঙ্গল উদ্দেশ্যে, বিশ্ববিধাতার আদেশে প্রকৃতি এই কার্যভার (আলোক বিশ্লেষণ, সংমিশ্রণ কখন বা সম্পূর্ণ রূপান্তর করণ) গ্রহণ করিয়াছেন।

 পৃথিবীর নানাস্থানের বৈজ্ঞানিক মনীষিগণ সূর্য্যকিরণ বিশ্লেষণ কার্য্যে নিযুক্ত রহিয়াছেন। রশ্মি বিশ্লেষণ যন্ত্রের সাহায্যে তাঁহারা অতি সহজেই বর্ণ সকলের পৃথক পৃথক কার্য্যকারিতা দর্শন করিতে পারেন। এই আলোক বিশ্লেষণযন্ত্র মানব-প্রতিভার এক অভাবনীয় কীর্ত্তি। কি অতি দুরস্থিত নভোবিহারী নক্ষত্রপুঞ্জ, কি ছায়াপথবর্ত্তী নক্ষত্র, কি ততোধিক দূরবর্ত্তী ধূমপুঞ্জব নীহারিকা, কি সূর্য্যমণ্ডল এবং অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহ সকল, জ্যোতিষিগণ রশ্মি-বিশ্লেষণ যন্ত্রের সাহায্যে মর্ত্ত্যলোকে বাস করিয়াও সমস্তই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ও সুস্পষ্টভাবে অবগত হইতে সমর্থ হইয়াছেন। তাঁহারা বর্ণ-পরীক্ষায় যন্ত্রবলে জ্যোতিষ্করাজ্যের নিত্য নূতন নূতন তত্ত্ব আবিষ্কার করিতেছেন।

 ত্রিকোণ বিশিষ্ট কাচখণ্ডের সহায়তায় আমরাও মার্তণ্ড-কিরণের বর্ণসমূহ স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র অবলোকন করিতে পারি।

 সুন্দর নীলাম্বরপ্রান্তে দিগন্ত প্রসারিত রামধনুর উদয় কি মনোরম! তাহাতে পর্য্যায়ক্রমে সপ্তবিধ বর্ণের সমাবেশ কেমন নয়নের তৃপ্তিকর! প্রকৃতিদেবী যেন দিগঙ্গনাকে বিচিত্র বর্ণের রত্নভূষণে বিভূষিতা করিয়া দেন। বৃষ্টিবিন্দুসমূহে বিপরীতবর্ত্তী সূর্য্যরশ্মি প্রতিবিম্বিত হওয়াতেই রামধনুর উৎপত্তি, ইহা সকলেই অবগত আছেন। কাচখণ্ডের ন্যায় জলবিন্দুরও আলোক বিভাগ করিবার শক্তি আছে; তাহাতেই ঐ সকল বর্ণ স্বতন্ত্ররূপে লোক-নয়নের বিষয়ীভূত হইয়া থাকে। ধরণীরাজ্যে রবিকিরণ-সম্ভূত এই সপ্তবিধ মূল বর্ণের কি সুন্দর বিশ্লেষণ! বর্ণসমূহের নানারূপ রাসায়নিক সংযোগে প্রকৃতিবক্ষে অশেষপ্রকার নয়নবিনোদন বর্ণের সমুদ্ভব হইয়া থাকে। এই অতি সুন্দর বর্ণসন্নিবেশ নিবন্ধন প্রাকৃতিক চিত্রপটের যে দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়, হৃদয় একেবারে মুগ্ধ হইয়া যায়। নানা বর্ণের জলদ-বিমণ্ডিত গগনমণ্ডল, কি শ্যামল শাখা-পত্র-পল্লবে পরিশোভিত বৃক্ষলতা গুল্ম বল্লরী— কি স্তবকে স্তবকে শ্বেত, পীত, নীল, লোহিত এবং আরও নানা বর্ণের পুষ্পরাশি—যেদিকে দৃষ্টিপাত করা যায়, কি অনুভব করি। যেন শিল্পীর মঙ্গলহস্ত প্রত্যক্ষভাবে এই বর্ণসন্নিবেশ কার্য্যে নিযুক্ত রহিয়াছে। ধন্য সেই অচিন্ত্যশক্তি দেবদেবের রচনা কৌশল ও শিল্পনৈপুণ্য, সর্ব্বত্র তিনি নানা বর্ণ কেমন আশ্চর্য্যরূপে বিচিত্র করিয়া রাখিয়াছেন—প্রকৃতির ভাণ্ডার কি অপরূপ শোভা ও মাধুর্য্যের আধার করিয়া দিয়াছেন তাহা চিন্তা করিতেও হৃদয় স্তব্ধ হইয়া যায়। আলোকের বর্ণ সকল নৈসর্গিক নিয়মে কেমন বিবিধ প্রকারে নানা রঙ্গে প্রকৃতিরাজ্যে প্রতিফলিত হইয়া থাকে, তাহা ধারণা করা ক্ষুদ্র জীবের সাধ্য নয়।

 নীল, পীত, হরিত প্রভৃতি যতপ্রকার বর্ণের অপূর্ব্ব সমাবেশ অবলোকন করা যায়, তন্মধ্যে পরম মনোরম হরিৎই সর্ব্বপ্রধান; ভূমণ্ডলের সর্ব্বত্র হরিৎ বর্ণেরই প্রাধান্য দর্শন করা যায়। পরীক্ষা দ্বারা অবগত হওয়া গিয়াছে যে হরিৎবর্ণ স্বাস্থ্যের পক্ষে মহা উপকারী এবং হরিৎ ও নীলবর্ণ দৃষ্টিশক্তি রক্ষার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। জীবের কল্যাণের জন্যই পরম মঙ্গলময় পরমেশ্বর সৃষ্ট পদার্থে হরিৎ ও নীল বর্ণের আধিক্য প্রদান করিয়াছেন, সন্দেহ নাই।

 ডাক্তার ফিন্সেন্ প্রভৃতি চিকিৎসাবিজ্ঞানবিদ্ পণ্ডিতগণ আলোকচিকিৎসার বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছেন। এই অসাধারণ মনীষাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ রশ্মিবিশ্লেষণ যন্ত্রের সাহায্যে সূর্য্য-কিরণের বর্ণসমূহ স্বতন্ত্রীভূত করিয়া প্রতীচ্য জগতে চিকিৎসাশাস্ত্রে যুগান্তর আনয়ন করিয়াছেন। অনেক দুশ্চিকিৎস্য কঠিন ব্যাধি তাঁহারা আলোকচিকিৎসা দ্বারা দূর করিতে সমর্থ হইয়াছেন, কঠিন ব্যাধিতে শয্যাশায়ী, মৃত্যুর করাল গ্রাসে সম্মুন্নত কত অমূল্য জীবন আলোক-চিকিৎসা দ্বারা রক্ষা পাইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। প্রখর মার্ত্তণ্ড-রশ্মি-নিহিত, নীল, বেগুনে ও হরিত বর্ণ বিবিধ বিষাক্ত বীজ নষ্ট করিবার পক্ষে বিশেষ শক্তিসম্পন্ন। চিকিৎসা-বিজ্ঞানবিদ পণ্ডিতগণ আলোক-রশ্মি হইতে আবশ্যক মত বিভিন্ন বর্ণ সংগ্রহ করিয়া বিভিন্ন ব্যাধির চিকিৎসা কার্য্যে প্রবৃত্ত হন এবং তাহাতে আশ্চর্য্যরূপে কৃতকার্য্যতা লাভ করিয়া থাকেন। মানব বিজ্ঞানবলে প্রাকৃতিক শক্তিকে নিজ আয়ত্তাধীনে নিযুক্ত করিতেছেন। আমেরিকার জল চিকিৎসার বিষয় কাহারও অবিদিত নাই। আলোকচিকিৎসা তদপেক্ষাও বিস্ময়কর।

 ডাক্তার এরিকসিন্ অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক ওমনি প্রভৃতি মনীষিগণ বিজ্ঞানের অদ্ভুত গবেষণাবলে আলোকের কি প্রকার কার্যকারিতা মানব সমাজে প্রদর্শন করিয়াছেন তাহা চিন্তা করিলেও চমৎকৃত হইতে হয়। তাঁহারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে পাথুরিয়া কয়লা দ্বারা উৎপন্ন তাপে যেপ্রকার যন্ত্রাদি পরিচালিত হইয়া থাকে, প্রথর মার্ত্তণ্ড-কর সংগৃহীত হইলেও সেই প্রকার কার্য্য হইতে পারে; যন্ত্রসাহায্যে সূর্য্যকিরণ সংগ্রহ, করিয়া অনায়াসেই পোত প্রভৃতি পরিচালিত করিতে পারা যায়। তাঁহারা অলৌকিক প্রতিভাবলে কয়েকটি সূর্য্যকর-চালিত যন্ত্র আবিষ্কার করিয়া নিঃসংশয়ে জনসমাজে এই তথ্য প্রতিপন্ন করিয়াছেন যে, কয়েক গজ পরিমিত স্থানের রবিকর একত্র করিলে সেই শক্তিনিয়োগে একখানা অর্ণবযান অনায়াসেই পরিচালিত হইতে পারে। সমগ্র পৃথিবীতে তরণী, বাষ্পীয়ান ও অন্যান্য কল কারখানায় প্রায় আশী কোটি টন (প্রত্যেক টন প্রায় ২৭ মন) কয়লা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। বৈজ্ঞানিকগণ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে সাহারা মরুতে যেপরিমাণ সূর্য্যরশ্মি এক বৎসরে ব্যয়িত হয় তাহা সংগৃহীত হইলে সেই শক্তি, পূর্ব্বোক্ত কয়লারাশির সমতুল্য কার্যকর হইবে।

 অনেকে আশঙ্কা করেন, পৃথিবীর কয়লারাশি যেপ্রকার দ্রুত ধ্বংসের দিকে চলিয়াছে, তাহা ভবিষ্যতে যুগ যুগান্তর পরে এককালে নিঃশেষ হইবার সম্ভাবনা। কতকালে সমস্ত কয়লারাশি সম্পূর্ণ নিঃশেষ হইবে পণ্ডিতগণ তাহার গণনায় নিযুক্ত রহিয়াছেন, তখন পৃথিবীর সভ্যজগতের দশা কি হইবে? বাণিজ্য প্রভৃতি কি একেবারে লোপ হইয়া যাইবে? অনেকে এখনই ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছেন। এই চিন্তায় কিন্তু গ্রহরাজ সূর্য্য আলোকদানে কখনই কৃপন নহেন। বিজ্ঞান যেপ্রকার অপ্রতিহত প্রভাবে পৃথিবীতে দিন দিন উন্নতি লাভ করিতেছে, তাহাতে কয়লার অভাব সূর্য্যালোকেই পূর্ণ হইবে, সন্দেহ নাই।

 বৃক্ষলতা, গুল্ম ও শস্য প্রভৃতির জীবনী শক্তি বিধান সম্বন্ধে সূর্যালোকের কার্য্য প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা যায়। যে শস্য দ্বারা বিশ্বব্যাপী জীবগণের জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ হইতেছে, যে শস্যপুঞ্জ সংসারে সর্ব্বপ্রকার উন্নতি ও সুখ সমৃদ্ধির মূলীভূত, সূর্য্যালোকই তাহার প্রাণস্বরূপ।

 পানীয় জলের উপর সূর্যালোকের ক্রিয়া আশ্চর্য্যজনক। সূর্য্যালোক নানারূপ জীবাণু ধ্বংস করিয়া জল বিশুদ্ধ করে। বিবিধ প্রকার বর্ণের কাচপাত্রে পানীয় জল রাখিয়া সূর্যকিরণে উত্তপ্ত করিলে বিভিন্ন শ্রেণীর রোগ আরাম হইয়া থাকে; ইহ। প্রত্যক্ষ সত্য। আর্দ্র স্থান শুষ্ক করিয়া ম্যালেরিয়াবিষ নষ্ট করিতে সূর্য্যালোকের শক্তি অসাধারণ।

 সূর্য্যকিরণ দ্বারা চন্দ্র আলোকিত হয়, তাহাতেই আমরা হৃদয় মনের আনন্দকর এমন শোভাময় চন্দ্রিকা সম্পদের অধিকারী, এ কথা কাহার অবিদিত? সর্ব্বপ্রকার আলোকের মূল সবিতা। যিনি সবিতার সৃষ্টিকর্ত্তা তাঁহাকে শত সহস্র নমস্কার।