সাহিত্য-চিন্তা/সমাজ ব্যাধি ও তাহার প্রতিকার
সমাজ-ব্যাধি ও তাহার প্রতিকার
মানবের নিয়ন্ত্রিত, পরস্পর সমঞ্জসীভূত শক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জনশ্রেণীর নাম সমাজ। ইতর প্রাণীরা একত্র বিচরণ করে, একত্র কার্য্য করিয়া থাকে; তাহারাও আহার নিদ্রা প্রভৃতি প্রাকৃতিক অলঙ্ঘ্য বিধান পরম্পরার বর্ণীভূত। কিন্তু তাহারা পরস্পর নিয়ম ও নীতি-শৃঙ্খলে আবদ্ধ নয়। তাহাদের মধ্যে বিশেষ কোন বাধ্যবাধকতা দেখিতে পাওয়া যায় না। যেখানে কোন নীতি-সূত্রের গ্রন্থি নাই, শৃঙ্খলাযুক্ত নিয়ম বন্ধন নাই, তাহা সমাজ নামের যোগ্য নহে।
ভূবিজ্ঞানবিদ্ মনীষিগণ নির্ণয় করিয়াছেন যে, অর্দ্ধকোটিরও অধিক বৎসর পূর্ব্বে (মনুষ্য জন্মের বহু পূর্ব্বে) এই শ্যামাঙ্গিনী ধরণীতে কেবল ইতর প্রাণীরই একাধিপত্য ছিল। তাহারা জলে স্থলে আপনাদের পূর্ণ-প্রভাব বিস্তার পূর্ব্বক বাস করিতেছিল। এই সুদীর্ঘকালেও তাহাদের মধ্যে জ্ঞানোন্নতির নিদর্শন এবং সমাজ-বন্ধনের কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় নাই। প্রতীচ্য পণ্ডিত মহাধীশক্তি সম্পন্ন ডারউইন্ বিবর্ত্তন শীলতার মধ্য দিয়া মনুষ্যজাতিকে বানরজাতির বংশসম্ভূত বলিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন; কিন্তু তাহা যুক্তিযুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া গ্রহণ করিতে অনেকেই অস্বীকৃত।
নিতান্ত বর্ব্বর-সভ্যতার নাম মাত্র বর্জ্জিত জাতিসমূহের মধ্যেও সমাজবন্ধন কোন না কোন আকারে দৃষ্ট হয়! তাহারা বিশেষ বিশেষ বিষয়ে নৈতিক আদর্শ রক্ষা করে, কোন কোন বর্ব্বর জাতির সত্যপ্রিয়তা সুসভ্য জাতিকেও পরাস্ত করে।
অতি প্রাচীন কাল হইতে মানবজাতি সমাজবন্ধনে আবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। বহু গবেষণা দ্বারা বৈজ্ঞানিকগণ প্রমাণ করিয়াছেন, দশ লক্ষ বৎসরেরও অধিক কাল ব্যাপিয়া মানবজাতি ফল-শস্যময়ী বসুন্ধরার অঙ্ক অলঙ্কৃত করিয়া রহিয়াছেন। তখনও মাতা ধরিত্রী উজ্জ্বল সভ্যতালোকে আলোকিত হন নাই। সেই দীর্ঘকালব্যাপী ক্রমোন্নতির পর প্রায় লক্ষ বৎসর পূর্ব্বে যদিও আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ নিতান্ত অনুন্নত অবস্থায় বাস করিতেছিলেন, তথাপি তাঁহাদের মধ্যেও যে সমাজবন্ধন বিদ্যমান ছিল তাহার নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে। পঞ্চাশ হাজার বৎসর পূর্ব্ব হইতে তাঁহারা রীতিমত বস্ত্রাদি প্রস্তুত, কৃষিকর্ম্ম ও নানাপ্রকার শিল্পকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া ধীরে ধীরে সভ্যতার সোপানে আরোহণ করিতেছিলেন।
মনুষ্যের হৃদয় সভ্যতার নির্ম্মল আলোকে যতই দীপ্ত হইতে আরম্ভ করে, সেই কিরণ-সম্পাতে সমাজগৃহের প্রতি কক্ষ হইতে ধীরে ধীরে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার অপসারিত হয় এবং তাহার প্রত্যেক স্থান উন্নত এবং মার্জ্জিত হইয়া থাকে। সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত মনুষ্যত্বের বিকাশ অবশ্যম্ভাবী।
জনসমাজের অবিরাম নিমেষ উন্মেষের মধ্যে যুগে যুগে কত প্রলয় বিপ্লব উপস্থিত হইয়া সমাজদেহ সজোরে আঘাত করিয়াছে; অপ্রতিহত কালস্রোতের নিয়ত খাত প্রতিঘাতে অনন্ত বিশ্ব-প্রকৃতির লীলা-নিকেতনে মানবসমাজের বন্ধন সূত্রগুলি কখন কখন কিয়ৎপরিমাণে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইয়াও আবার সম্মিলিত হইয়াছে; বীণা যন্ত্রের তানু লয়ের ন্যায় ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ও ভিন্ন ভিন্ন কার্য্যের সমবেত সুর একটি আরাব অপূর্ব্ব রাগে ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে।
যে নীতি-সূত্রদ্বারা সমাজ গঠিত এবং রক্ষিত সেই সূত্রসমূহের মূল কোথায়? তাহাদের কেন্দ্র কি? কোন্ মধ্য বিন্দু হইতে উৎপন্ন হইয়া শত শত নীতি ও নিয়মসূত্র মানবদেহের শিরা ধমনীর ন্যায় সমাজদেহের সর্ব্বত্র বাপ্ত ও অনুপ্রবিষ্ট হইয়া রহিয়াছে? কে ইহাদিগকে জীবনী শক্তি প্রদান করিয়া থাকে? ধর্ম্মই সমস্ত নীতিসূত্রের মধ্যবিন্দু। যুগ যুগান্তরের সহস্র বাধা বিপ্লবের মধ্যে ধর্ম্মই সমজাকে জীবিত রাখিতে সমর্থ হইয়াছে।
যাহা চিরন্তন সত্য তাহা চিরদিনই স্বতঃসিদ্ধ; যাহা নিজ আলোকে সমুজ্জ্বল, সার্ব্বভৌমিক এবং নিত্য কল্যাণময়, তাহাই ধর্ম্ম। এই ধর্ম্ম সমাজ-হর্ম্ম্যের স্তরে স্তরে নানা আকারে ও নানা পরিচ্ছদে প্রকাশিত হইয়া থাকিলেও তাহার মূল সত্যগুলি নিতান্তই সরল এবং স্বাভাবিক। এখানে দেশ কালের কোন প্রভেদ নাই— জাতিগত বর্ণগত কোন বৈষম্য নাই। ইহার প্রকৃত স্বরূপ বাহিরে নহে—ভিতরে।
যে ধর্ম্ম শুধু জাতিগত তাহা প্রকৃত ধর্ম্মের বহিরাবরণ মাত্র। যেমন হিন্দু ধর্ম্ম, বৌদ্ধ ধর্ম্ম, খৃষ্ট ধর্ম্ম ইত্যাদি। এই বহিরাররণ লইয়াই পৃথিবীতে পৃথক পৃথক সমাজ গঠিত হইয়াছে এবং ভিন্ন ভিন্ন রূপে সকল জাতিই আপনাদিগকে সাম্প্রদায়িকতার পাষাণময় প্রাচীরে ঘেরিয়া লইয়াছে ও দুর্ণিবার কলহের সৃষ্টি করিয়াছে!
যেমন শারীরিক মঙ্গলকর নিয়মসমূহ লঙ্ঘনের ফলে জীবের পঞ্চভৌতিক দেহ নানা প্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তেমনই ধর্ম্মের চির শুভকর নিয়ম ও নীতি-বিধান লঙ্ঘনের ফলে মানসিক অসংখ্য পাপ-ব্যাধির উৎপত্তি হইয়া থাকে। জনশ্রেণীর মানসিক ব্যাধিই সংক্রামক ভীষণ রোগের ন্যায় সমাজ-দেহের প্রতি শিরা ধমনীতে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে এবং উহাকে শীঘ্রই বিকৃত ও বিনাশ করিতে উদ্যত হয়।
যে সকল গুরুতর ব্যাধি বর্ত্তমান হিন্দু, সমাজ-দেহে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাকে অবসন্ন ও দুর্ব্বল করিতেছে, তাহার মধ্যে জাতি-বিদ্বেষই প্রধান। ইহা সমাজের প্রতি অঙ্গে প্রবেশ করিয়া তাহাকে একেবারে জীর্ণশীর্ণ করিয়াদিতেছে।
পৃথিবীর যে সকল জাতি সভ্যতা এবং জ্ঞানের আলোকে সকলের বরণীয় তাঁহাদের জাতীয় ইতিবৃত্ত পাঠ করিলে জানা যাইবে যে প্রথমেই তাঁহারা সংকীর্ণ তার বন্ধন ছিন্ন করিয়া ভেদ-বিদ্বেষের প্রাচীর সকল ভাঙ্গিয়া দিয়াছেন; আপনাদের অশ্রান্তগতি অব্যাহত রাখিবার জন্য সকল বাধাই দূরে সরাইয়া রাখিয়াছেন: বিশ্বের নির্মুক্ত জল, বায়ু, আলোক লাভ করিবার জন্য গৃহের সমস্ত গবাক্ষগুলি উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন।
সুবর্ণযুগের ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যায় সকল মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করিলে বুঝিতে পারা যায় যে, আর্য্যজাতি প্রেম ও আশ্চর্য্য সহানুভূতির দ্বারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সহিত কি প্রকার ঐক্য স্থাপন করিয়াছিলেন। কখনও জাতিবিদ্বেষকে সমাজের অন্তস্তলে প্রবেশ করিতে দেন নাই। পূর্ব্বকালে এখনকার মত জাতিবিদ্বেষ প্রচলিত থাকিলে দাসী-পুত্র বিদুর এবং সূত্রধর-পুত্র কর্ণ সমাজের শীর্ষস্থান অধিকার করিতে পারিতেন না। আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণের জাতীয় জীবনগ্রন্থের প্রত্যেক পৃষ্ঠা তাহাদের উদারতা এবং অভেদ নীতির জ্বলন্ত সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। বানর, ভল্লুক, রাক্ষস, নাগ প্রভৃতি নামধেয় অনার্য্য জাতিদের সঙ্গে তাঁহারা সখ্যতা স্থাপন করিয়া, বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হুইয়া, সাম্য মন্ত্রেরই কি মহিমা ঘোষণা করেন নাই?
উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মধ্যে পরস্পর নৈকট্য ও সম্মিলনের বাধা,—সংকীর্ণতার বাধা অপসারিত করিয়া দিয়া আর্য্যজাতি সর্ব্বদাই কর্ম্মক্ষেত্রে আপনাদের অপ্রতিহত গতির পরিচয় প্রদান করিতেন। একতা ও সম্প্রসারণ নীতির বলেই তাঁহারা জাতীয় দুর্জ্জয় প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তাই ভিন্ন ভিন্ন অনার্য্যশ্রেণী দ্বারাও সমাজ পরিপুষ্ট ও শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিল। অতীত ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড বিষয়গুলি দ্বারা তদানীন্তন জাতীয় জীবনের মূল উপাদান অনায়াসেই সংগ্রহ করিয়া লইতে পারা যায়। পূর্ব্বকালে বর্জ্জন-নীতি অপেক্ষা অর্জ্জন-নীতিরই সমধিক সমাদর ছিল। তাই নিম্ন জাতিসকল অনায়াসেই বিরাট আর্য্য-সমাজের অঙ্গীভূত হইয়াছিল এবং ভারতবর্ষের সীমা অতিক্রম পূর্ব্বক অন্যান্য প্রদেশেও আর্য-প্রভাব বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল।
যে সময়ে ভারতীয় রাজনৈতিক গগন উজ্জল জ্যোতিষ্কমালায় অলঙ্কৃত ছিল, প্রলয় বিপ্লবকর বৈদ্যুতিক সংঘর্ষণের ন্যায় যখন রাজন্যগণের অব্যাহত বল বিক্রম, শৌর্য্য-বীর্য্যের পরস্পর সংঘর্ষণে কুরুক্ষেত্রের সমরভূমিতে কালানল জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, কালান্তক বিষাণ নিনাদিত হইয়া সমস্ত ভারতকে স্তম্ভিত করিয়াছিল, রাজশক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার সেই পূর্ণ বিকাশের সময়েও আমরা সার্ব্বভৌমিক প্রেমের জ্বলন্ত নিদর্শন প্রত্যক্ষ করিতে সমর্থ হই। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাই তাহার এক অকাট্য প্রমাণ। সেই সময় জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম্মযোগের কেমন সামঞ্জস্য সাধিত —হইয়াছিল, গীতাগ্রন্থ তাহার সাক্ষীস্বরূপে বর্ত্তমান রহিয়াছে।
খৃষ্টের জন্মের সার্দ্ধ পঞ্চশত বৎসরেরও অধিক পূর্ব্বে যখন শাক্যসিংহ ভারতে অবতীর্ণ হইয়া সাম্য-মৈত্রীর বিজয় বৈজয়ন্তী গগনে উড্ডীন করিয়াছিলেন, তাহার প্রভা সুনীল মহাসমুদ্র অতিক্রম করিয়া দিক দিগন্তরে বিকীর্ণ হইয়াছিল। তাহার স্পর্শে তখন অভিশাপগ্রস্ত বলি-দৈত্যের ন্যায় জাতিবিদ্বেষ মৃতপ্রায় হইয়া পড়িয়াছিল। মহর্ষি ঈশার আবির্ভাবের তিন শতাব্দী পূর্ব্বে যখন দিগ্বিজয়ী বীরবর আলেক্জাণ্ডার সদর্পে বহুতর সেনানী সমভিব্যহারে ভারত-ক্ষেত্রে পদার্পণ করেন। সিদ্ধার্থ-প্রবর্ত্তিত আলোক-শিখার প্রভাব তখনও এদেশ হইতে অন্তর্হিত হয় নাই।
চারিশত বৎসর গত হইয়াছে আর একবার বঙ্গের আকাশে প্রেমের চন্দ্রকলা উদিত হইয়া সমস্ত ভারত আলোকিত করিয়াছিল। যিনি সকল জাতি,—সকল বর্ণ—সর্ব্বশ্রেণীর লোককে সমভাবে ভাই বলিয়া বক্ষে ধারণ করিয়াছিলেন; যাঁহার প্রীতির মন্ত্রে সকলে মুগ্ধ হইয়াছিল, সেই চৈতন্যদেবের নাম আজও বঙ্গের ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত, কিন্তু তাঁহার অভেদনীতি এখন কোথায়?
হিন্দুসমাজে বর্ত্তমান সময়ে আমরা কি দেখিতে পাই? ইহার উন্নতির অনেক দ্বারই কি সযত্নে রুদ্ধ করা হয় নাই? পক্ষান্তরে অবনতির উপায় সকলই অবলম্বন করা হইতেছে। সমাজের বক্ষ হইতে বাহিরে যাওয়ার শত শত পথ উন্মুক্ত রহিয়াছে, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করিবার পথ একেবারেই বন্ধ। ইহাদ্বারা যে সমাজের শক্তি ক্ষয় হইয়া যাইতেছে এবং তাহার সম্প্রসারণ ক্রমেই হ্রাস পাইতেছে, তাহাতে সন্দেহ কি? এই সকল অন্তরায় দূর না করিলে কিছুতেই সমাজের পূর্ণ বিকাশ সম্ভবপর নয়। সংকীর্ণতার গণ্ডীর মধ্যে থাকিয়া জাতীয় জীবন ধীরে ধীরে জড়ত্ব প্রাপ্ত হয়।
আজ এই ধ্বংসদশাগ্রস্ত হিন্দু সমাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে আমরা প্রথমেই জাতি-বিদ্বেষ এবং অসংখ্য কুসংস্কারের অনিষ্টকারিতা সম্যক্ উপলব্ধি করিতে পারি। কেবলই বাধা,—কেবলই অন্তঃসার শূন্য বিধিব্যবস্থা। এই সকল জটিল বিধিব্যবস্থা ও বাধা সমাজে অন্ধকারেরই সৃষ্টি করিতেছে—অনন্ত উন্নতির গতি রোধ করিয়া দিতেছে।
উচ্চশ্রেণীস্থ হিন্দুগণ নানা উপায়ে নিম্নশ্রেণীস্থ লোকদিগকে পদানত রাখিতে চেষ্টা করিতেছেন, ইহা কাহারও অবিদিত নাই। বিষম ভেদ বিদ্বেষ এবং জাত্যাভিমান পরস্পরের মধ্যে নিদারুণ ব্যবধান সৃষ্টি করিয়া দিতেছে।
প্রকৃতির রম্য নিকেতন, প্রতি পল্লীগ্রামে এবং অশ্বগজসঙ্কুল ও জনকোলাহল-মুখরিত নগরে নগরে এই জাতিবিদ্বেষ পূর্ণ মাত্রায় আপনার প্রভাব বিস্তার করিয়া রহিয়াছে। দক্ষিণ ভারতবর্ষে পারিয়া প্রভৃতি পতিত জাতির দুর্গতির বিষয় কাহার অবিদিত আছে? বাঙ্গালা দেশেও নমঃশূদ্র, প্রভৃতি নিম্ন জাতির দুর্দ্দশা দর্শন করিলে দুঃখ বোধ হয়। সমাজের এই নিম্নস্তরে—উন্নতির আলোক প্রবেশের পথে জাতিবিদ্বেষ উচ্চ পর্ব্বতের ন্যায় অবস্থিত।
ইহার ফলস্বরূপ এই নিম্ন জাতীয় ব্যক্তিদিগের অসন্তোষও বৈশাখী সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশস্থিত ঘনীভূত মেঘমালার ন্যায় ক্রমেই ঘনাইয়া উঠিতেছে এবং উচ্চশ্রেণীর সহিত সহানুভূতির সম্পর্ক দিন দিন ছিন্ন হইয়া যাইতেছে। ইহা কি দেশের পক্ষে ঘোরতর অমঙ্গলের চিহ্ন নয়? যেমন কণা কণা বালুকা সঞ্চিত হইয়া একটি দ্বীপ গঠিত এবং অসংখ্য প্রস্তর রেণু দ্বারা একটি পর্ব্বত প্রস্তুত হয়, তেমনই দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্ত সমবেত শক্তিদ্বারা জাতীয় মহাশক্তি অর্জ্জিত হইয়া থাকে। ইহা হইতে অর্দ্ধেক বাদ দিলে সমাজ ছিন্নপত্র বৃক্ষের ন্যায় নির্জীব হইয়া পড়িবে সন্দেহ নাই। মহামহীরুহ প্রকৃতিরাজ্যে অনেক কাজ করে; তৃণ সামান্য হইলেও তাহার কার্যকারিতা সামন্য নয়। স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র চণ্ডাল মিত্রকে সাদরে আলিঙ্গন করিতে এবং কিরাত জাতীয়া শবরীর আতিথ্য গ্রহণ করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হন নাই। কিন্তু যুগযুগান্তর পরে সেই ভারতের অবস্থা কি দাঁড়াইয়াছে? তাঁহাদের বংশধরগণ আজ তথাকথিত নীচ জাতির ছায়াস্পর্শেও আপনাদিগকে অশুচি বোধ করেন।
হিন্দুসমাজের বৃহত্তর অংশই নিম্নশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। জীবন-বীণার যে তারে কমলার বন্দনা-গীতি ধ্বনিত হইয়া উঠে তাহা সর্ব্বতোভাবে ইহাদেরই করধৃত। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য সমস্তই ইহাদের শরীরের রক্তে পরিপুষ্ট।
যেমন মানব দেহের কোন স্থান কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হইলে ক্রমে তাহা সর্ব্ব শরীরে ছড়াইয়া পড়ে এবং অবিলম্বে তাহাকে ধ্বংসের পথে লইয়া যায়, সেইরূপ সমাজের এই নিম্নস্তর অনুন্নত অবস্থায় থাকাতে আমাদের জাতীয় জীবনের অন্তস্তলে যে কুঠারাঘাত পড়িতেছে তাহাতে কি সংশয় আছে?
শত বাধা বিঘ্নের ভিতর হইতে, আজ সভ্যসমাজের মহাজাগরণের দিনে, বিশ্বের তন্ত্রীতে যে বিরাট উত্থানসঙ্গীত ভৈরব রাগে বাঙ্গিয়া উঠিতেছে—প্রভাত-মলয়ানিলের মঙ্গল বার্ত্তার ন্যায় তাহা ভারতবর্ষের নিতান্ত অন্ধতম কূপেও প্রবেশ লাভ করিয়াছে। তাই আজ নিম্নজাতির মধ্যে কেহ কেহ জাগ্রত হইয়া আপনাদের শোচনীয় দুর্দ্দশা দর্শন করিতে সমর্থ হইতেছেন, এবং জগতের নিকট মনুষ্যের প্রাপ্য অধিকার প্রার্থনা করিতেছেন।
যদি হিন্দুগণ আপনাদের বিনষ্ট গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করিতে যত্নবান হন—যদি জগতের নিকট বরণীয় শক্তিরূপে—যথার্থ মানুষরূপে, দাঁড়াইতে ইচ্ছুক হন তবে দেশের এই কোটি কোটি নিম্নশ্রেণীস্থ পতিত ভ্রাতাদিগের হস্ত ধরিয়া অগ্রসর হউন। তাহাদের সর্ব্বপ্রকার দুঃখ দুর্গতি, অজ্ঞানতা দূর করিতে যত্নবান হউন; সুখে দুঃখে সম্পদে বিপদে ঐকান্তিক সহানুভূতি প্রদর্শন পূর্ব্বক তাহাদিগকে গভীর প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ করুন। নতুবা কে আমাদিগকে মহাবিনাশ হইতে রক্ষা করিবে? এক পদ কর্ত্তন করিয়া অন্যপদে ভ্রমণের নিষ্ফল চেষ্টার ন্যায় আমাদের সকল উন্নতির প্রয়াস ব্যর্থ হইয়া যাইবে।
সমাজের এইরূপ সহস্র দুর্গতির মধ্যে কেবল ভারতরমণীগণই দেশের ভরসাস্থল। রমণী যদি সর্ব্বপ্রকার কুসংস্কার ও জাত্যাভিমান দূর করিয়া নিজ শিশু সন্তানদিগকে অভেদ মন্ত্রে দীক্ষিত করেন, তবে নিশ্চয়ই জাতি বিদ্বেষের ভিত্তিমূল শিথিল হইয়া পড়িবে। শিশু মাতার নিকট যে শিক্ষা প্রাপ্ত হয় পৃথিবীর কোন শিক্ষাই তাহার তুল্য নহে।
সামাজিক কল্যাণের ভিত্তিমূল দৃঢ়তর করিতে হইলে নারীকে সর্ব্বাগ্রে সুশিক্ষিতা করা চাই— জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম্মে ভূষিতা করা চাই। যেখানে নারীশক্তি নিদ্রিত, সেখানে সমাজ-ব্যাধি শয়তানের মত নানা আকারে আপনার রূপ প্রকাশ করিয়া থাকে এবং তথাকার জাতীয় উন্নতি বালুকার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদের ন্যায় ভূমিসাৎ হয়।
সুশিক্ষিতা ধার্ম্মিকা নারীদ্বারা দেশের কত মঙ্গল সাধিত হইয়াছে, পবিত্রপ্রাণা নারীসকল সমাজের সর্ব্বপ্রকার দুর্ব্বলতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিরূপ ঘোরতর সংগ্রাম করিয়া স্বদেশে কল্যাণের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, সুসভ্য জগতে তাহার দৃষ্টান্তের অভাব নাই। সমাজের যে স্তরে গুহাস্থিত চৌরের ন্যায় অন্ধকার লুক্কায়িত রহিয়াছে, নারীশক্তি জ্ঞান ও প্রেমের পবিত্রতা ও সেবার দীপশিখা করে লইয়া সেস্থান আলোকিত করিয়াছে।
আমাদের অতীত ইতিহাস নারীশক্তি এবং নারীকীর্ত্তিতে পূর্ণ। রমণী সকল দেশেই যুগে যুগে ধর্ম্মকে রক্ষা করিয়াছেন। তাঁহারা ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার আধার—ভক্তির আদর্শ। পবিত্রতার প্রতিমূর্ত্তিসমা ললনাগণ ভারতের গৃহে গৃহে দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিতা।
কাল্যাণদায়িনী জননীগণ যদি সন্তানগণকে স্বদেশের মঙ্গলমন্ত্রে—প্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন, তাহাদের সুকুমার প্রাণ কর্তব্য শিক্ষায় সুগঠিত করিতে আরম্ভ করেন,—তাহাদিগকে অভেদব্রতে উদ্বোধিত করিয়া তোলেন, তবে তাহারা নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ জীবনে আপনাদের দেশকে শত শত কুসংস্কার ও জাতিবিদ্বেষরূপ আবর্জনার হস্ত হইতে উদ্ধার করিবার জন্য যত্নশীল হইবে। শক্তিরূপিণী নারীগণ সকলেই এই ব্রত গ্রহণ করুন।