সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/প্রথম অঙ্ক/অষ্টম গর্ভাঙ্ক
(পৃ. ৩৯-৪৩)
কৃষ্ণ। ম’শায় আর চিঁড়েগুড় খেয়ে প্রাণ তো বাঁচে না, এ অন্ধকূপে আর কতদিন থাকবো? এইখানেই কি মৃত্যু হবে? আর তো কোন উপায় দেখিনে! পিতাকে পত্র লিখেছি, সে পত্র পাঠিয়েছে কিনা জানি নে। আজও তো আমার মুক্তির উপায় কিছু কর্লেন না।
উমি। বাবা আমি ধনে-প্রাণে গেলেম, ধনে-প্রাণে গেলেম! বাড়ী লুট ক’রে যে যা পেয়েছে হাতিয়েছে!
কৃষ্ণ। আহা আপনার পরিবারবর্গের কিছু সংবাদ পান নি?
উমি। তারা কোন রকমে পালাবে, তারা তো টাকার মত অচল নয়। সম্বৎসরের আয় নবাবের এলাকা ছাড়িয়ে, কোল্কাতায় এনে রেখেছিলুম। ওঃ পথে বসালে!
কৃষ্ণ। ম’শায়, বিজাতী ফিরিঙ্গিকে বিশ্বাস ক’রে অতি অন্যায় করেছি। যদি দিল্লীতে যেতেম কি পূর্ণিয়ায় সকতজঙ্গের আশ্রয় নিতেম, কিম্বা যদি নবাবের পায়ে-হাতে ধ'রে পড়তেম, তাহ’লে এ দুর্দ্দশা হ’তো না। পিতা বুঝ্লেন না;—নবাব ক্রোধনস্বভাব বটে, ক্রোধ হ’লে দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না, কিন্তু দেখেছি অতিশয় দোষ ক’রে গিয়ে মার্জ্জনা চাইলে, মার্জ্জনা পায়! যতই দোষ থাকুক, মেজাজ অতি উচ্চ। হায় হায়, কেন ফিরিঙ্গির আশ্রয়ে এলেম!
উমি। বাবা, আগে কে জানে বলো, যে এরা এমন ধড়িবাজ! মনে কর্তেম বাঁদুরে জাত,—ডাব চেনে না, ছোবড়া খেতে যায়; পাল্কীর ছাদে উঠে বসে, এক পয়সার সামগ্রী নিয়ে দুটো টাকা ফেলে দেয়। ব্যাটারা কত পায়ে-হাতে ধ’র্লে, বললে একটু কুঠি ক’রে দাও, আমরা এখানে ব্যবসা কর্বো।
কৃষ্ণ। ম’শায় এরা বড় চতুর। এক পয়সার সামগ্রী নিয়ে দুটো টাকা ফেলে দেয় সত্য—সামান্য টাকা খরচ ক'রে আমিরী দেখায়—কিন্তু মনে করেন কি, ব্যবসা আপনি ওদের চেয়ে জানেন? দেখুন আমাদের দেশ, আপনার নিকট ব্যবসা-বাণিজ্য শিখ্লে, ক’বছরের মধ্যে ক’টা কুঠি করেছে দেখুন! কি অপমানিতই হলেম। আমাদের সামান্য চাকরকে যেরূপ কুবচন বলি নাই, তা অপেক্ষাও অকথ্য ব’লে আমায় তিরস্কার করলে। উঃ—এত অদৃষ্টে ছিল! অতি সামান্য ব্যক্তি, উদরের জ্বালায় এ দেশে এসেছে, কিন্তু যে দুর্ব্বাক্য বল্লে, স্বয়ং নবাব এরূপ বলেন না! হায়—হায় স্বদেশীকে বিশ্বাস না করার উপযুক্ত শাস্তি পেলেম!
উমি। ব্যাটারা মনে ক’রেছে আমায় কয়েদ ক’রে আরও টাকা হাতাবে। আমি আর এক কাণাকড়িও ছাড়বো না, চিঁড়ে খেয়ে মরি, ফাঁসি দিগ—তাও কবুল্—এক কড়িও ছাড়বো না।
জনৈক পর্টুগিজ গার্ড ও একজন ফিরিঙ্গির প্রবেশ
গার্ড।বাবু—বাবু স্যালাম! সুখবর দিতি আইচি। আমার উপর গোস্যা হবেন না। মোর চাটগায়ে ঘর, মোরা পর্ত্তুগিজ! মোরা র্যাংরেজ নই, মোর উপর গোস্যা হবেন না;—কি কর্বো নুন খাইচি, পাহারা দিতে হইচে। নবাব আসতিছে, এই খবর দেলাম, মোর গর্দ্দানটা বাচান!
ফিরিঙ্গি। বাবু সাব—বাবু সাব, হামি বাঙ্গনার আদ্মি, হামি বন্দুক পাক্ড়াতে জানে না। হাম্কো পাকড় লিয়ে হাতসে বন্দুক দিলো। বাবু, হামার জান্ বাঁচাও—নবাব আতা—হাম্ লোককে কোতল করে গা।
(দূরে তোপধ্বনি)
গার্ড। ঐ শোনেন, নবাবী ফৌজ তোপ দাগ্তিছে। দই বাবু সাব মোদের জান্টা বাচাবেন।
কৃষ্ণ। নবাবী সৈন্য কোথায়?
গার্ড। ঐ পূবদিকটে আসি ঝোক্চে।
ফিরিঙ্গি। হামি আপলোককে খবর লেকে দেতা হ্যায়।
(পুনরায় তোপধ্বনি)
গার্ড। ঐ শুন্তিছেন—তোপ দাগ্তিছে? দ্যাখ্বেন বাবু দ্যাখ্বেন জানটা বাচাবেন।
ফিরিঙ্গি। Here comes bloody Holwell. বাবু, গরীবকো মনে রাখিবেন।
পর্টুগিজ গার্ড ও ফিরিঙ্গির প্রস্থান
কৃষ্ণ। বোধ হয় আমার প্রাণ বধ করতে আস্ছে। আমার মারীচের দশা, রামে মার্লেও মেরেছে, রাবণে মার্লেও মেরেছে; নবাবের হাতে পড়্লেও তো আমার নিস্তার নেই!
হল্ওয়েলের প্রবেশ
হল। উমিচাঁদ বাবু, তুমি রাখ্বে তো বাঁচ্বে নয়তো সব মারা যাবে! বাবা, কসুর হইয়াছে, ঐ কালা আদ্মিটা আপনার চুক্লি কর্লো, ড্রেক সাব সমুজতে পার্লে না, আপনাকে বহুত দুখ্ দিলো; বাবু forgive and forget! আমরা ব্যবসা করিতেছি by your help—forgive and forget—নবাব হইতে হাম্লোককো জান বাঁচাও।
উমি। সাহেব, আমি কি কর্বো? আমায় রাস্তার ভিখারী করেছো তোমার গোরায় আমার বাড়ী লুটে নিলে; আমি এই কয়েদখানায় চিঁড়ে-গুড় খাচ্ছি।
হল। আপনার যাহা গিয়াছে, East India Company তাহার double দিবে, টাকার নিমিত্ত কিছুই পরোয়া করিবেন না, হামাদের জান বাঁচান। কৃষ্ণদাস বাবু, হামাদের কসুর হইয়াছে, উমিচাদ বাবুকে বুঝাইয়া বলেন, হামাদের জান বাঁচান।
উমি। সাহেব, কি করতে হবে—বলুন।
হল। আপনার দোস্ত General মাণিকচাঁদ rampart attack করিয়াছে। তাঁহাকে একখানা পত্র লিখিয়া দেন, নবাব হামাদের সহিত peace করে। নবাব যেমন যেমন বলে, হামি লোক তেমন তেমন কর্বে।
কৃষ্ণ। যে দিকে হোক আমার প্রাণ যাবে।
হল! কৃষ্ণদাস বাবু, আপনার বাবা আপনাকে রক্ষা করিবেন। উমিচাঁদ বাবু, এই মুন্সির নিকট পত্র লিখিয়া আনিয়াছি, একঠো সই করিয়া দেন। হামি rampart হইতে পত্রটা ফিঁকে দিবে।
উমি। আচ্ছা সাহেব, দাও। দেখো সাহেব, তখন গোলমাল ক’রো না, আমার সিন্দুকে তিন লাখ টাকা ছিলো!
হল। না-না, We are Christians. হামাদের দ্বারা এমন হইতে পারে না। মিথ্যা বলিলে হামাদের ধরম্ যায়।
উমিচাঁদের সহি করণ
হল। (স্বগত) Woe me, to bend before niggers!
হল্ওয়েলের প্রস্থান
কৃষ্ণ। দেখছেন কি? কাজ গুছিয়ে চ’লে গেল। আসুন খাটিয়ায় পড়ে দুর্গানাম করি।
- ↑ পঞ্চম গর্ভাঙ্কের টীকা দেখুন।