সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/প্রথম অঙ্ক/চতুর্থ গর্ভাঙ্ক

চতুর্থ গর্ভাঙ্ক

মুর্শিদাবাদ—নবাব-অন্তঃপুরস্থ বেগম-কক্ষের সম্মুখ

লুৎফউন্নিসা

লুৎফ। নবাব এখনো আসছেন না কেন? এখনি ওয়াট্‌সের মেম আসবে। আজ তিন দিন এসে স্বামীর উদ্ধারের জন্য কাঁদাকাটি কচ্ছে, আজ মেম এলে বড় অপ্রতিভ হব।

ওয়াটস-পত্নীর প্রবেশ

ওয়াটস-পত্নী। (জানু পাতিয়া) বেগম সাব—বেগম সাব—বাঁদীর আজ্জি কি মঞ্জুর হইল? আমার জানের জান দুখ পাইল, কেমন করিয়া চব্বিশ ঘণ্টা সইবো, আমি খানাপিনা ছাড়িয়া দিয়াছে।
লুৎফ। ওঠো মেম সাহেব, কেঁদো না কেঁদো না, কেন জানু পেতে জোড় হাত কচ্ছ? আমি নবাবকে বল্‌বার অবকাশ পাইনি, নবাব বড়ই রাজকার্য্যে ব্যস্ত। আমি পরিচারিকাকে পাঠিয়েছিলেম। নবাব বলেছেন, তিনি এখনি অন্তঃপুরে আস্‌বেন। আজ নিশ্চয় তোমার স্বামীকে আমি মুক্ত কর্‌বো। তুমি সতী, সতীর মর্য্যাদা অবশ্যই রাখ্‌বো।
ওয়াটস্-পত্নী। সব হাল আপনি শোনেন।
লুৎফ। মেমসাহেব, তুমি সকলই তো বলেছ।
ওয়াটস্-পত্নী। ভাল করিয়া ওয়াকিভহাল হোন, নবাব ওজর করিলে উত্তর করিতে পারিবেন। আমার স্বামীর কোন দোষ নাই। হাল এই, নবাব কলিকাতার গভর্ণর ড্রেক সাহেবকে আজ্ঞা দেন যে, তিনি পেরিং পয়েণ্ট যাহা নির্ম্মাণ করিয়াছেন, তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিবেন, আর রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে মুর্শিদাবাদ নবাবদরবারে পাঠাইবেন। গভর্ণর ড্রেক সাহেব নবাবী আজ্ঞা নিল না। নবাব সেই রাগ করিয়া আমার স্বামী ও চেম্বার্স সাহেবকে কয়েদ দিয়েছেন। বেগমসাব, নবাবকে বুঝাইবেন যে, আমার স্বামী ও চেম্বার্স সাহেব কাশিমবাজারের কুঠির কাজে নিযুক্ত। নবাবী-আজ্ঞা ড্রেক সাহেব মানিলো না, তাহাতে আমার স্বামী কি করিতে পারেন। আমার স্বামী নবাবের অবাধ্য নন, নবাব যাহা বলিয়াছেন, তাহা করিয়াছেন। ড্রেক সাহেব কথা শুনে না, তিনি কি করিবেন।
লুৎফ। তুমি স্থির হও, তোমার স্বামী মুক্তি পাবেন। ঐ নবাব আস্‌ছেন, তুমি মাতামহীর নিকট যাও।
ওয়াটস্-পত্নীর প্রস্থান
সিরাজদ্দৌলার প্রবেশ
সিরাজ। কেন, তলব কেন? আমায় মার্জ্জনা করো, তিলার্দ্ধ অবকাশ নাই যে তোমার নিকট আসি; অনেক কার্য্য রয়েছে, এখনই দরবারে যেতে হবে।
লুৎফ। এক দণ্ডও কি দাসীর নবাবের সেবা করবার অধিকার নাই নবাবের কি মুহূর্ত্তের জন্য বিরামের সময় নাই?
সিরাজ। প্রিয়ে, নবাবী নয় প্রকৃতপক্ষে দাসত্ব। মাতামহী নিত্য দরবার-সংলগ্ন জানানা-প্রকোষ্ঠ হ’তে দরবার-কার্য্য দেখেন, তুমি তাঁর সঙ্গে থেকো, সকলই বুঝ্‌বে।
লুৎফ। বাঁদীর একটি আবেদন আছে।
সিরাজ। আবেদন! আদেশ বলো! বলো, কি হুকুম?—এই দণ্ডে সমাধা হবে।
লুৎফ। একজন বিদেশিনী রমণী, আমার নিকট আবেদন জানিয়েছে,—রাজ-রোষে তার পতি কারারুদ্ধ। দাসীর মিনতি, কৃপা ক’রে নবাব তার পতিকে পরিত্রাণ দেন। আহা! অতি কাতরা, জানু পেতে করযোড়ে তার মনের বেদনা আমায় জানিয়েছে। পতি-পরায়ণা, পতির নিমিত্ত ব্যাকুলা, নয়ন-জলে গণ্ডস্থল ভেসে গেল, সে বেদনা আমার প্রাণে বেজেছে, সে অভাগিনীর স্বামীর মুক্তি আজ্ঞা হয়।
সিরাজ। তোমার নিকট ওয়াট্‌সের বিবি এসেছিল। যখন তুমি তার প্রতি প্রসন্ন, দরবারে উপস্থিত হ’য়েই তারে মুক্তি প্রদান করবো। অনেক কার্য্য রেখে তোমার অনুরোধে অন্তঃপুরে এসেছি, এখনি দরবারে যেতে হবে। তুমি পরিচারিকা দ্বারা জানালেই আমি ওয়াটস্ ও চেম্বার্সকে মুক্তি দিতেম, এর নিমিত্ত স্বয়ং অনুনয়-বিনয় কেন?
সিরাজ-কন্যা উম্মৎ জহুরার প্রবেশ
উম্মৎ। জনাব, আপনি মায়ের মহলে আসেননি কেন? মা বলেছেন আপনার জরিমানা কর্‌বেন। আপনি কোথায় ছিলেন?
সিরাজ। এই যে মা জরিমানা দিচ্ছি। (চুম্বন)
লুৎফ। তুমি খোদাকে ডেকে নবাবকে দোওয়া করতে বল্‌লে না?
উম্মৎ। হ্যাঁ হ্যাঁ—আয়ে খোদা—জনাবকে দোওয়া করো।

উম্মৎজহুরার গীত

ডাক্‌লে তুমি অম্‌নি শোনো, অম্‌নি তুমি কাছে এসো।
আমি তোমায় ভালবাসি, তুমি আমায় ভালবাসো॥
শুনেছি দু নয়া তোমার, তুমি বলো তুমি আমার,
আমায় তুমি খেল্‌তে ডাকো, আমার কাছে কাছে থাকো,
আমি তোমায় দেখে হাসি, তুমি আমায় দেখে হাসো॥

সিরাজ। এ গান তুমি কোথায় শিখ্‌লে?
উম্মৎ। কেন জনাব, আমি আপনি শিখি। আপনি বসুন, আমার কোলে নিন। মা আসুন।
সিরাজ। আমি যে এখন যাবো?
উম্মৎ। কোথায় যাবেন? আমায় সঙ্গে নেবেন না, দেলখোসবাগে যাবেন? আমার নিয়ে চলুন, মায়ের জন্য ফুল তুলে আন্‌বো।
সিরাজ। এখন না, আমি এসে তোমায় নিয়ে যাবো।
উম্মৎ। দাঁড়ান—আমি চুমো খাই। (চুম্বন) আপনি মাকে চুমো খেলেন না?
সিরাজ। আমি আসি—আমি আসি—প্রস্থানোদ্যত
উম্মৎ। মা, জনাব তোমায় চুমো খেলেন না, তুমি জনাবের চুমো খেয়োনা। আমি নবাব-বেগমকে বলে দিগে, জনাব বড় দুষ্ট হয়েছেন।প্রস্থান
গমনোদ্যত নবাব-সম্মুখে তস্‌বির হস্তে জহরার প্রবেশ
সিরাজ। কে তুমি?
জহরা। নবাবের নিকট এই ভেট এনেছি।
সেলাম করিয়া আচ্ছাদিত তস্‌বীর প্রদান
সিরাজ। কে পাঠিয়েছেন?
জহরা। এই পত্রে প্রকাশ আছে।
সিরাজ। তোমায় কি কোথাও দেখেছি?
জহরা। আমি জনাবের নিকট পরিচিতা। ইতিপূর্ব্বে নিবেদন করেছি, আমি সর্ব্বত্রগামিনী—নবাব দর্শনাকাঙ্ক্ষিণী।
পত্র প্রদান পূর্ব্বক জহরার প্রস্থান
সিরাজ। (পত্র পাঠ করিয়া) পত্রবাহিকা কোথায়?
লুৎফ। চলে গিয়েছে।
সিরাজ। অদ্ভুত পত্র!—শোনো—(পত্র পাঠ)

 “জনাব, যদিচ দাসীর মৃত্যু রটনা হইয়াছিল, দাসী জীবিতা। সমাজ-তাড়নায় দাসী রাজপুরে উপস্থিত হইয়া নবাবসেবার অধিকার পায় নাই। প্রার্থনা, দাসীর অনুরূপ এই তস্‌বির নবাবের শয়ন-গৃহে স্থান পায়। দাসীর নাম তস্‌বিরের নিয়ে দেখুন।”

(তস্‌বিরের আবরণ খুলিয়া) একি!—“তারা”—তারাই বটে, (লুৎফউন্নিসার প্রতি) প্রিয়ে, তুমি এ তস্‌বিরবাহিকাকে কখনো দেখেছ?
লুৎফ। না প্রভু।
সিরাজ। জেনো এ শত্রু। এ পত্র জাল,—আমি জলভ্রমণকালীন রাণী ভবানীর কন্যা তারাকে দর্শন ক’রে, তাঁর প্রতি আসক্ত হই।
তার পর তাঁর মৃত্যু রটনা হয়। তারা জীবিতা থাক্‌তে পারেন, কিন্তু এ পত্র জাল। আমার পাপমতি উদ্দীপ্ত করা, এই পত্রবাহিকার উদ্দেশ্য;—হাবভাব, নয়নের কোণে তার শত্রুতা! এ বহুবেশধারিণী। যখন মাতৃষ্বসা ঘসেটীবেগমকে মতিঝিল থেকে নিয়ে আসি, তখন মাতামহীর বাঁদীর বেশে, ঘসেটীবেগমের পরিচ্ছদ বহন কর্‌তে দেখেছিলেম। আজ সে বেশ নাই, আজ তারার পত্রবাহিকা। একে কদাচ রাজ-গৃহে স্থান দিয়ো না।
সিরাজদ্দৌলার প্রস্থান
লুৎফ। বাহিকা শত্রু হয় হোক, সুন্দর তস্‌বির, শয়নাগারে নবাবের তস্‌বিরের পাশে রাখবো। দেবমূর্ত্তি নবাবের পার্শ্বে এই দেবীমূর্ত্তিই শোভা পায়।

ওয়াট্‌স্-পত্নীর পুনঃ প্রবেশ

লুৎফ। তোমার ভয় নাই, তোমার স্বামী আজই মুক্তি পাবেন। নবার উদার, তোমার স্বামীর সঙ্গী চেম্বার্সও মুক্ত হবেন।
ওয়াটস্-পত্নী। খোদা বেগমসাহেবকে দয়া করুন। এ খবরে আমার জান বাঁচ্‌লো। হামি ভাল ভেট পাঠাবে।
লুৎফ। না না—তোমাকে কিছু পাঠাতে হবে না। তুমি আশীর্ব্বাদ করো, যেন আমি পতি-সোহাগিনী হই।
ওয়াটস্-পত্নী। নবাবের কলিজা হ’য়ে, বেগমসাব বারোমাস থাক্‌বে।
লুৎফ। তুমি যাও, তোমার স্বামী দর্শন করগে।
ওয়াটস্-পত্নী। বাঁদীর এক আর্জ্জি, বাঁদী কখনো আপনাকে ভুলিবে না।
ওয়াট্‌স্-পত্নীর প্রস্থান