সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/প্রথম অঙ্ক/তৃতীয় গর্ভাঙ্ক

তৃতীয় গর্ভাঙ্ক

পূর্ণিয়া—সওকতজঙ্গের সভা

সওকতজঙ্গ, মীরণ, উজীর, সভাসদ্‌গণ ইত্যাদি

সকত। মীরণ, তোমার বাবাকে গিয়ে ব’লো,—কুচ পরোয়া নাই, আমি সব ঠিক করেছি, দিল্লী থেকে ফার্‌মান আনাচ্ছি। আমিই বাঙ্গ্‌লা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব,—সিরাজ কে? ও তো ফাঁকতালে নবাব হয়েছে। ও-ও আলিবর্দ্দীর নাতি, আমিও আলিবর্দ্দীর নাতি। আমি মেজো মেয়ের ছেলে, ও ছোট মেয়ের ছেলে, ও নবাবী পারে কিসে?—কি বাবা, বল্‌তে পারি কি না?
সভাসদ্‌গণ। হকই তো—হকই তো!
সকত। কেমন ঠিক বলি নি?
সভাসদ্‌গণ। ঠিকই তো—ঠিকই তো!
সকত। খবরদার—চুপ করো। আমি মীরণ চাচাকে জিজ্ঞাসা কচ্ছি।
মীরণ। হ্যাঁ—আমার পিতাও এই কথা হুজুরকে ব’লে পাঠিয়েছেন।
সকত। পিতা কে? বাবা? রেখে দাও—তোমার বাবা, আমি বাবার বাবা ব’সে।
সভাসদ্‌গণ। ঠিকই তো—ঠিকই তো।
সকত। চোপরাও—বেয়াদুবি?—মীরণ চাচার সঙ্গে বেয়াদুবি? আমি ও ভালবাসি নি।
সভাসদ্‌গণ। তাইতো হুজুর—তাইতো হুজুর!
সকত। হ্যাঁ—মীরণ চাচা রয়েছে, বেয়াদব হয়ো না। দেখ মীরণ চাচা, কথাটা কি বোঝো, তোমার বাবা তো মীরজাফর? ঠিক বল্‌ছ তো? হ্যাঁ—তোমার বাবা মীরজাফরই বটে! শোন, তারে ব’লো, ব্যাপার খানা কি জানো, আলিবর্দ্দীর তিন মেয়ে, আমি মেজো মেয়ের ছেলে, বল্‌বে আলিবর্দীর ছেলে ছিল না, সিরাজকে পুষ্যিছানা নিয়েছিলো? নিগ—আমিই বাপের বেটা, সিরাজ নয়—সিরাজ নয়—ও বাপের বেটা নয়, কি বল?
সভাসদ্‌গণ। নয়ই তো—নয়ই তো।
সকত। না চুপ—কথা কইতে দাও। শুনেছ তো বড় মাসী ঘসেটি বেগমের সঙ্গে হোসেন কুলীর ব্যাওরাটা গুনেছ তো? আর তুমি জান না, তুমি আপনার লোক, তোমার ঘরের কথা বলি, ছোট মাসী আমিনা বেগম—তিনিও—তিনিও ঐ হোসেনকুলি—ঐ হোসেনকুলি—সিরাজ তাই তারে রাস্তায় ধরে কেটে ফেল্লে! শুনেছি, আলিবর্দ্দী আর তার বেগমের টিপ্‌নি ছিলো।—তা দেখ—বেশ করেছে।
সভাসদ্‌গণ। ঠিকই তো—ঠিকই তো—
সকত। তবে আর কি মীরণ মিঞা।—তুমি আমার সুবাদে চাচা হও। আলিবর্দ্দীর বোনকে তোমার বাপ বিয়ে ক’রে নয়? দেখ বাবা—সম্পর্ক সব ঠিক আছে।
সভাসদ্‌গণ। আছেই তো—আছেই তো—
সকত। কি থাক্‌বে না, তার বাপকে থাক্‌তে হবে। মীরণ চাচা, নবাব তো আমি—কি বলো?
মীরণ। হুজুরই তো নবাব। তাই পিতা পাঠিয়ে দিলেন, সিরাজ সজ্জিত হ’য়ে আস্‌ছে, আপনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন।
সকত। আশুক, এক ফুঁয়ে ওড়াবো—বুঝেছ—বুঝেছ? কাল কি পরশু গিয়ে মুর্শিদাবাদের গদীতে বস্‌ছি। তোমার বাবাকে ব’লো, ভাল ভাল মেয়ে মানুষ আমার শ’খানিক চাই, আমি গুণে নেব, একটা কম হ’লে চল্‌বে না। আমি উজিরি তাকে দিলুম, বুঝেছ? হুঁসিয়ার হয়ে কাজ করতে ব’লো। আর সিরাজের সেই গঙ্গায় বেড়াবার নৌকাখানা আছে তো? সেখানা যেন ঠিক সাজানগোজান থাকে। সিরাজ খুব ঝানু আছে। নৌকোয় বেড়িয়ে দু’ধারই ভাল ভাল মেয়ে মানুষ দেখেছে—আর বেগম করেছে। কেমন না—খবর রাখি কি না বলো? আচ্ছা আমিও দেখ্‌বো, আগে মুর্শিদাবাদে পৌঁছুই।
মীরণ। হুজুর, সিরাজ অনেক সৈন্য নিয়ে আস্‌ছে। পিতা বিশেষ ক’রে বল্লেন, আপনি সত্বর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। বোধ হয় সিরাজ এতক্ষণ রাজমহলে এসে পড়্‌লো।
সকত। অ্যাঁ—সত্যি নাকি?
উজির। হ্যাঁ জনাব, দূত এসে সংবাদ দিয়েছে। হুজুর, সত্বর সেনানায়কদের প্রস্তুত হ’তে আজ্ঞা দেন।
সকত। হ্যাঁ ডাকো—ডাকো—ফকির দানসাকে ডাকো। সে যে বল্লে—“ফুঁয়ে উড়িয়ে দেবো।” কি হ’লো—তবে কি হলো! অ্যাঁ আমি এখন লড়াইয়ে যাই কি ক’রে বল!
উজির। হুজুর, আপনি হুকুম দেন, আপনার সেনাপতিরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, আপনার হুকুমের অপেক্ষা কচ্ছে।
সকত। আমি হুকুম দিলুম—হুকুম দিলুম, লড়্‌তে বলো, লড়্‌তে বলো।
উজির। আপনার স্বাক্ষরিত হুকুম দেন। এই বান্দা হুকুমনামা লিখে এনেছে, হুজুর সই করে দেন।
সকত। আচ্ছা—এসো বাবা এসো। ধরো হাত ধরো। যেদিকে তুমি হাত চালাবে, সেই দিকে হাত চালাবো, সেদিকে ঠিক আছি। (সওকতজঙ্গের হুস্ত ধরিয়া উজিরের সহি করিয়া লওন ও অন্য একখানি হুকুমনামা বাহির করণ) এইতো হলো, আবার কি?
উজির। ভিন্ন ভিন্ন, সেনানায়কের পত্র।
সকত। ওঃ জ্বালাতন করেছে, নবাবী কর্‌বো কখন? এসো—

(পুনরায় পূর্ব্বোক্তরূপ সহিকরণ ও অন্য আর একখানি হুকুমনামা দেখিয়া)

বাপ্ আর নয়—(সিংহাসন হইতে লাফাইয়া পড়িয়া) বাতাস করো—বাতাস করো—আর পারি না,—সরাব দে—সরাব দে। (ভৃত্যগণের ব্যস্তভাবে তথাকরণ)

দানসা ফকিরের প্রবেশ

ফকির—ফকির—বাঙ্গ্‌লার ফৌজ এসেছে, তুমি কি কচ্ছ?
দানসা। হঃ! কনে?
মীরণ। ফকির সাহেব, রাজমহলে উপস্থিত।
দানসা। হঃ! দেখো যাইয়ে— ফুইয়ে উরাইচি। দেখো বাইরে কাশিমবাজার বিগে রয় দিয়েছে। তেমন দানসা ফকির পাইচো। পুচ করে। ঐ দূতটারে—

দূতের প্রবেশ

উজির। কি সংবাদ, বাঙ্গ্‌লার ফৌজ কত দূর?
দূত। বান্দা দেখে এলো, নবাব-সৈন্য রাজমহল পরিত্যাগ ক’রে কাশিমবাজার অভিমুখে চলেছে।
দানসা। অঃ শুনে লন—শুনে লন, ফুইয়ে উরাইচি—ফুইয়ে উরাইচি।
সকত। কুচ পরোয়া নাই, (উজিরের প্রতি) ফের সই করাবে? গর্দ্দানা নেবো—কোতল কর্‌বো। বাবা দানসা, এক পেয়ালা খাও।
দানসা। হঃ আমি মুসলমান, সরাব খাবার পারি? তবে হঃ—ল্যাক্‌চে—ল্যাক্‌চে, নবাবজাদা দিলি গুণা থাক্‌বে না।
সকত। দেখ মীরণ চাচা, তোমার বাবা বল্‌ছেন—একবার মুর্শিদাবাদ যাবো, সিরাজকে তাড়িয়েই লক্ষ্ণৌয়ে সুজাউদ্দৌলার ঘাড়ে গিয়ে প’ড়ব, তারপর দিল্লী। বাদ্‌সাই পার্‌বে? বেশ পার্‌বে—খুব পার্‌বে।
মীরণ। হ্যাঁ হুজুর—হ্যাঁ হুজুর!
সকত। দেখ তোমায় বাদ্‌সাই দিয়ে আমি খোরাসানে যাবো, সেখানে একটা নূতন সহর তৈরি কর্‌বো,—বাঙ্গ্‌লার জল-হাওয়া আমার সয় না; আর দেখ এ সব বেটীদেরও আমার পছন্দ হয় না; তুমি বাদ্‌সাই পার্‌বে তো?
মীরণ। পার্‌বো বই কি, পার্‌বো বই কি!
সকত। আচ্ছা মীরণ চাচা, আমোদ করো—আমোদ করো।
সভাসদগণ। আমোদ করো—আমোদ করো।
সকত। লাও—লাও—নাচ্‌নাউলি লে আও। মীরণ চাচা, টেঁকে রেখো, কোন্ কোন্ বেটী তোমার দরকার।

নর্ত্তকীগণের প্রবেশ

গীত

রঙ্গিলা পিও পিয়ালা।
ঝননা ঝনরণ বাজে পায়েলা॥
যৌবন মাতোয়ারী, আপনি সামারি,
হাতে হাতে ধরি, খেল সারি সারি,
আকুল কুন্তল, চঞ্চল অঞ্চল,
নারী চাহিয়ে হুঁসিয়ারী ভারি;
বিরহী বিয়োগ ব্যাকুলা॥

সকতজঙ্গের ঐ সঙ্গে নৃত্য ও পতন
সভাসদগণ। আহা আহা, কি হ’লো কি হ’লো!
সকত। চোপ্ বেয়াদুবি করো না।
সকলের সকতজঙ্গকে ধরিয়া উত্তোলন
কেয়াবাৎ—কেয়াবাৎ,—বাহবা বাহবা, কেয়াবাৎ!
সকতজঙ্গকে লইয়া কয়েকজন সভাসদের প্রস্থান
উজির। তোমরা সব যাও।
দানসা। ফুইয়ে উরাইচি—ফুইয়ে উরাইচি।
সকলের প্রস্থান
উজির। সাহেব, কিছুতো বুঝ্‌লেম না, বাঙ্গলার ফৌজ ফির্‌লো কেন?
মীরণ। আমার তো কিছুই অনুমান হচ্ছে না।
উজির। আমার বোধ হয়, কলিকাতায় ইংরাজের সহিত কোনও বিবাদ হয়ে থাকবে। যদি আমার অনুমান সত্য হয়, আমাদের পক্ষে বড় শুভ। বাদসাহি সনন্দ আনা নিতান্ত প্রযোজন। নচেৎ নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে, প্রজারা আমাদের পক্ষ হবে না। কিন্তু দিল্লীতে উৎকোচ প্রদানের নিমিত্ত অর্থের প্রয়োজন। সকতজঙ্গ বাহাদুরের অপব্যয়ে তো ধনাগার শূন্য।
মীরণ। চিন্তা কি? জগংশেঠ মহাতাবচাঁদ সে অর্থ দিতে কুণ্ঠিত হবেন না। এ প্রস্তাব হয়েছিলো, পিতাও শেঠজীকে অনুরোধ করেছেন।
 উজির। আসুন আসুন মন্ত্রণা-গৃহে আসুন। এ সকল গুহ্য আন্দোলন এ স্থানে প্রয়োজন নাই।
উভয়ের প্রস্থান