সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/নাকের বাহার
(পৃ. ৩৫৩-৩৫৪)
মানুষের নাকের প্রশংসা করতে হলে তিলফুলের সঙ্গে, টিয়াপাখির ঠোঁটের সঙ্গে গরুড়ের নাকের সঙ্গে তার তুলনা করে। কেউ কেউ আবার বলেন শুনেছি, বাঁশির মতো নাক। কিন্তু মােটের উপর এ কথা বলা যায় যে, সকলের নাকেই মােটামুটি ছাঁদটি সেই একঘেয়ে রকমের। দোনলা সুড়ঙ্গের মতো। কারও নলদুটি সরু কারও বা মোটা, কারও চ্যাপটা, কারও উচু—কারও মাঝখানে ঢালু, কারও আগাগোড়াই টিপি-এইরকম সামান্য উনিশবিশ যা একটু তফাত হয়। কারও কারও নাক যদি হাতির গুঁড়ের মতো লম্বা হত কি গণ্ডারের মতো খঙ্গধারী হত, অথবা আর কোনো উদ্ভট জানোয়ারের মতাে হত, তা হলে বেশ একটু রকমারি হতে পারত। সে রকমারি যে বড়ো সামান্য নয় তাই বােঝাবার জন্য এখানে কতক গুনি জানোয়ারের চেহারা দেখানো হল। এদের প্রায় সকলকেই বোধহয় তােমরা চেন।
হাতির গুঁড়টাই যে তার নাক তােমরা নিশ্চয়ই জান। হাতির পাশেই যে জন্তুটির নাম করা যায়, তার নাম টেপির। এর নাকটিও গঁড় হতে চেয়েছিল, কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারে নি। তার পাশেই দেখ পি’পড়ে-খোরের ছবি। এরও একটা শুড় আছে কিন্তু সেটা শুধ নাক নয়, নাকমুখ দুই মিলে লম্বা হয়ে ওরকম হয়ে গেছে। কুমিরেরও ঠিক তাই। আর জীবজষর কথা উপরের ডানদিকে যে চোঙামুখ জন্তুটি দেখছ, তার পরিচয়ও তোমরা পেয়েছ ('সমুদ্রের ঘোড়া') নীচের দুরকমের ছুঁচো আছে, তার একটির বেশ স্পষ্টরকম শুঁড় গজিয়েছে, আর-একটি কেবল শুঁড়ে সন্তুষ্ট নয়, তার নাকের আগাটি হয়েছে ঠিক ফুলের মতো। এই শৌখিন ছুঁচোটির গায়ের গন্ধ কিন্তু ফুলের মতো একেবারেই নয়। তার চেয়ে জমকাল নাকের কথা যদি বলতে হয় তবে পুষ্পনাসা বাদুড়ের কথাটা নিতান্তই বলা উচিত। পর্দার পর পর্দা গোলাপফুলের পাপড়ির মতো সাজিয়ে তার উপরে যেন তিলক চন্দন একে নাকটিকে তৈরি করা হয়েছে। এত ঘটা করে নাকের বাহার ফোটাবার উদ্দেশ্যটা কি, মুখের “সৌন্দর্য বাড়ানো না শত্রুকে ভয় দেখানো তা আমি জানি না।
পুষ্পনাসার এক পাশে হাঁসচঞ্চু, তার নাকমুখ হাঁসের ঠোঁটের মতো চ্যাপটা। আর একপাশে ম্যাণ্ড্রিল বাঁদর। শুধু এই ছবি দেখে যদি বিচার কর, তবে এর উপর নিতান্তই অবিচার হবে। কারণ এর রঙটিই হচ্ছে এর আসল বাহার। টকটকে লাল নাক, তার দু-পাশে নীলরঙের ঢিব্লি, তার উপর চমৎকার কারুকার্য—যারা কলকাতায় আছি তারা চিড়িয়াখানায় গেলেই একবার স্বচক্ষে দেখে আসতে পার। ম্যানড্রিলের পাশে নাকেশ্বর বানর। এর নাক সম্বন্ধে আর বেশি কথা বলবার দরকার নেই, ছবিতেই দেখছ কেমন ছোটোখাটো বেগুনের মতো নাকটি। বাঁদরের খাঁদা নাকের দুর্নাম সকলেই করে, কিন্তু এই নাকটি খাঁদা না হলেও তাতে তার সুনাম বাড়বে কিনা সন্দেহ।
ব্যাঙ যখন হাতির উপর রাগ করে বলেছিল “বড়ো যে ডিঙোলি মোরে”—তখন হাতি তাকে “থ্যাবড়ানাকী” বলে গাল দিয়েছিল। হাতির গালটা খুব লাগসই হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ব্যাঙের বংশেও যে সকলেরই থ্যাবড়া নাক, তা নয়। এমন ব্যাঙও আছে যাদের নাকটি চড়াই পাখির ঠোঁটের মতো দিব্যি চোখালো। (নীচের লাইনের মাঝের ছবি)
কোনো কোনো জন্তু আবার শুধু নাকটাকে নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তারা নাকের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র জুড়ে বেড়ায়। গণ্ডারের খড়গটি থাকে তার নাকের উপরে। আফ্রিকায় একরকম বরাহ আছে তার নাম বাবিসা, তার নাকের দুপাশে চামড়া কুঁড়ে দুই জোড়া দাঁত শিঙের মতো উঁচু হয়ে থাকে। তলোয়ার মাছের নাকের ডগায় যে অস্ত্রটি বসানো থাকে তাতে বাস্তবিকই তলোয়ারের কাজ হয়। করাতি মাছের তলোয়ারটির গায়ে আবার করাতের মতো কাটা থাকে। বঁড়শিবাজি মাছের কথা শুনেছ—তার নাকের আগায় বাঁকা ছিপের মতো লম্বা নোলক ঝুলিয়ে রাখে। উদ্দেশ্য, অন্য মাছকে ভুলিয়ে এনে তার ঘাড় ভেঙে খাওয়া।
কোনো কোনো জন্তুর নাকটা যে কোথায় সেটা হঠাৎ খুঁজে পাওয়াই শক্ত। তিমি মাছের মাথার উপর যেখানে তার চোখ থাকবার সম্ভাবনা মনে হয় সেখানে তার নাক থাকে। কাটালো গিরগিটির গা-ভরা উবড়ো খাঁবড়ো শিঙের মতো কাঁটার ঝোপ—তার মধ্যে তার নাক মুখ চোখ অনেক সময়েই বেমালুম লুকিয়ে থাকে। আর হাতুড়িমুখো হাঙরের চেহারা তো আগাগোড়াই উলটোরকম। একটা দুমুখো হাতুড়ির মতো তার মাথা, সেই হাতুড়ির দুই মাথায় দুটি চোখ। আর নাকটা হচ্ছে হাতুড়ির মাঝামাঝি-হাতুড়ির ডাণ্ডাটা যেখানে বসানো থাকে সেইখানে।
এখন তোমরা বল, এর মধ্যে কার নাকের বাহার বেশি।