সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/নিশাচর

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ৩৫৫-৩৫৬)
নিশাচর

 নিশাচর বলে তাদের যারা রাত জেগে চলাফেরা করে, অর্থাৎ আহার খোঁজে। নিশাচর জন্তুদের মধ্যে একটির নাম তোমরা সকলেই বলতে পারবে, সেটি হচ্ছে 'প্যাঁচা'।

 নিশাচরেরা রাত্রে আহার করে কেন? তার নানা কারণ আছে। প্রথমত যারা শত্রুর ভয়ে দিনের আলোতে বেরতে সাহস পায় না, রাত্রে অন্ধকারে তাদের গা ঢাকা দিয়ে চলবার সুবিধা হয়। যেমন আফ্রিকার কাকাপো অথবা ‘প্যাঁচাটিয়া। এদের ডানা ছোটো বলে ভালো করে উড়তে পারে না। দিনের বেলা বেরোলেই অন্য পাখিরা ঠুকরিয়ে অস্থির করে তোলে। ইদুর জাতীয় নানারকম নিরীহ জন্তু আছে, তারাও একরকম শত্রুর ভয়ে সারাদিন লুকিয়ে থাকে, রাত্রে শিকারের খোঁজে বেরোয়।

 কোনো কোনো জন্তু আছে তাদের শরীরের গঠন এমন যে তারা দিনের আলো, রোদ বা গরম সইতে পারে না। প্যাঁচার চোখ এমন অদ্ভুত যে সে আলোর দিকে ভালো করে তাকাতেই পারে না, সহজেই চোখ ঝলসে যায়। সাপ ব্যাঙ প্রভৃতি যে-সব জন্তুর রক্ত ঠাণ্ডা, তারা রোদে বেরোলে শরীরের রস শুকিয়ে যায়। তাই তারা সারাদিন ঝোপে জঙ্গলে ছায়ার মধ্যে থাকতে চায়।

 আর একদল নিশাচর আছে, যারা রাত্রে বেরোয় ভালোরকম শিকার জোটে বলে। বাঘ সিংহ প্রভৃতি বড়ো মাংস-খোর জন্তুরা এই কারণেই অনেক সময় নিশাচর হয়। সন্ধ্যার পর নানারকম পোকামাকড় বেরোয় তাই পোকা-খোর জন্তুরাও এ সময়ই খাবার আশায় ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যার সময় যে চামচিকারা বা ‘নাকাটি’ পাখিরা ব্যস্ত হয়ে আকাশময় ছুটাছুটি করে, সেটাও তাদের ভোজের আনন্দ। ভালো করে দেখলেই বোঝা যায় যে তারা উড়তে উড়তে পোকা ফড়িং খেয়ে বেড়াচ্ছে।

 ‘লেমার বা ক্ষুদে বানরদেরও অনেকেই এই দলের মধ্যে পড়ে। তারাও রাত হলেই পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। রাত্রে আলোর কাছে টিকটিকির পোকা শিকারের উৎসাহ তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছ। রাত্রে আলো দেখে যত পোকা এসে জড়ো হয় দিনের বেলায় একসঙ্গে তত পোকা পাওয়া শক্ত। টিকটিকির ভোজটাও তাই সন্ধ্যার পরে জমে ভালো।

 নিশাচর জন্ধুদের প্রায় সকলের মধ্যেই একটি অভ্যাস দেখা যায় সেটি হচ্ছে নিঃশব্দে চলা। প্যাঁচার শরীরটি তো নেহাত ছোটো নয়, সে উড়তেও পারে বেশ; অথচ উড়বার সময় তার ডানা ঝাপটের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না। রাত্রে অন্ধকারে দেখতে হয় বলে তাদের চোখ দুটোও তেমনি করে তৈরি। প্রায়ই দেখা যায় নিশাচর জন্তুদের চোখ প্যাঁচার মতো বড়ো আর গোল-গোল হয়। সেইজন্য অনেক সময় তাদের দেখতেও অদ্ভুত দেখায়। যে-সব ক্ষুদে বানরদের কথা আগে বলছি, তাদেরও চোখ মুখ আর চলাফেরা এমন অদ্ভুত গোছের হয় যে দেখলে অনেক সময় ভয় হয়। আরেক রকম বানর আছে, তার নাম ‘টার্সীয়ের। যেদেশে এর বাড়ি সেখানকার লোকেরা একে ‘ভূত বানর’ বলে। এর সমস্ত

কপালজোড়া বড়ো-বড়ো চোখ, আর রোগী রোগা কাঠির মতো হাত-পা। গাছের আড়াল থেকে হঠাৎ উঁকি মেরেই রবারের মতো নিঃশব্দে লাফ দিয়ে আবার দশ হাত দূর থেকে উঁকি মারা—এই হচ্ছে এর চাল-চলনের ধরন। কারও কোনো অনিষ্ট করে না, কেবল পোকামাকড় খেয়ে থাকে অথচ লোকে মিছামিছি তাকে ভূতের মতো ভয় করে। তার একটা কারণ সে নিশাচর।

 আমাদের পুরাণে রাক্ষসদের নামও নিশাচর। তারাও নাকি দিনের আলোর চাইতে রাত্রের অন্ধকারটাই বেশি পছন্দ করে। আর চোর ডাকাত যারা পরের বাড়িতে সিঁদ কেটে ঘুমন্ত মানুষের সর্বনাশ করে, তাদেরও ‘শিকার’ করবার সুবিধা হয় রাত্রে। আজকালকার সভ্য মানুষ রাতকে দিন করে রাখে। রাত্রেও হাজার আলো জ্বালিয়ে দিয়ে তার কলকারখানা, রেল, স্টিমার চালাতে হয়। সুতরাং মাঝে মাঝে ভদ্র মানুষকেও কাজ কর্মের জন্য নিশাচর হতে হয়। ভোরবেলা যে খবরের কাগজটি পড়, তার জন্যে যে কত লোকের রাত জেগে খাটতে হয় তা কখনো ভেবে দেখেছ কি? আর রেলে সিটমারে ড্রাইভার গার্ড প্রভৃতি কতজনকে যে দিনের পর দিন রাতমজুরি খাটতে হয়, তারাও একরকম নিশাচর বৈকি।
সন্দেশ —মাঘ, ১৩২৫