সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/আকাশের বিপদ

আকাশের বিপদ

 ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ'। মানুষের যখন পালাবার পথ থাকে না তখন লোকে এইরকম বলে। কিন্তু আজকালকার লোকে আকাশ দিয়েও পালাতে জানে। তা বলে সেখানটাই কি মানুষের পক্ষে নিরাপদ? যুদ্ধের সময়ে সেটা যে খুব সুবিধার জায়গা নয় তা তোমরা জান, কিন্তু অন্য সময়ে? জলের জন্তু অনেক আছে যার ভয়ে মানুষ পালায়। ভাঙায়ও তেমনি শত্রুর অভাব নেই। কিন্তু আকাশের পাখিকেও কি মানষের ভয় করে চলা দরকার? মাঝে মাঝে দরকার বৈকি! বছর দুয়েক আগে আলপ্‌স্ পাহাড়ের কাছে এক সাহেব এরোপ্লেন করে অনেক উঁচুতে উড়ছিলেন। পরিষ্কার দিন, ঝড় বাতাসের চিহও নেই, কোথাও ভয়ের কোনো কারণ দেখা যায় না। এর মধ্যে হঠাৎ কলের ভীষণ ভন্‌ভন্ শব্দের উপর চিলের চীৎকারের মতো একটা কর্কশ শব্দ শোনা গেল-আর সেই সঙ্গে প্রকাণ্ড এক ঈগলপাখি সাহেবের মুখের উপর ডানার ঝাপটা লাগিয়ে, দুই পায়ের নখ দিয়ে তার মাংস ছিড়ে নেবার জোগাড় করে তুলল। একবার নয়, দুবার নয়, পাঁচ-সাত বার ঘুরে ঘুরে সে সাহেবকে তার রাগখানা জানিয়ে গিয়েছিল। সাহেবের গায়ের জামা থেকে সে বেশ দুই-এক খাবল কাপড়ও তুলে নিয়েছিল, গায়েও দু-চারটা আঁচড় লাগায় নি, এমন নয়।

 তারা অলিপ্‌স্ পাহাড়ের রাজবংশী ঈগল, যুগের পর যুগ আকাশের মেঘের উপর সকলের চাইতে উঁচু নীল ময়দানের হাওয়া এতদিন তারাই কেবল খেয়ে আসছে। সেখানে আর কোনো পাখিরও যাওয়ার সাধ্য নেই। কাজেই পৃথিবীর মানুষকে অতটা দুর স্পর্ধা করতে দেখে তার তো রাগ হবারই কথা।

 যুদ্ধের সময়ে কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিলেন যে দলে দলে ঈগলপাখি পুষে শত্রুর এরেপ্লেনের উপর ছেড়ে দিলে মন্দ হয় না। সেরকমের পরীক্ষাও নাকি করা হয়েছিল। যারা এরোপ্লেন চালায় তাদের চোখে মস্ত গোল চশমা থাকে। ঐরকম চশমাধারী মূর্তি গড়ে, যদি তার উপর ঈগলপাখিকে রোখ্ করতে শেখানো যায়, তা হলেই সময় বুঝে তাকে কোনো এরোপ্লেনের উপর লেলিয়ে দিলেই চলবে। কিন্তু একবার ছাড়া পেলে পর সে শত্রু মিত্র চিনবে কি করে, সেটাই হচ্ছে ভাববার কথা।

 আকাশের পথে কোনো বিপদ উপস্থিত হলে সবচাইতে মুশকিল এই যে, চট করে কোথাও পালাবার পথ থাকে না। শন্যে উঠে দু-তিন মাইল উঁচুতে উড়তে উড়তে হঠাৎ যদি বেলুন বা এরোপ্লেনে আগুন ধরে যায় তখন চট করে ডাঙায় নামবে তার আর উপায় থাকে না। জাহাজ হলেও নাহয় জলে ঝাপিয়ে পড়া যায়, হালকা শোলার কোমরবন্ধ এঁটে কোনোরকমে সঁতার কেটে পালানো যায়। জাহাজ ডুবলেও ‘লাইফবোট' ভাসিয়ে প্রাণরক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু আকাশযাত্রীর উপায় কি?

 বড়ো-বড়ো বেলুন যখন আকাশে ওঠে তখন অনেক সময় তার গায়ে গোটানো ছাতার মতো একটা প্রকাণ্ড জিনিস ঝোলানো থাকে সেটাকে বলে প্যারাসুট। হঠাৎ বিপদে পড়লে, বা চট করে নামবার দরকার হলে বেলুনবাজ তার কোমরে প্যারাসুটের দড়ি জড়িয়ে বেলুন থেকে লাফ দিয়ে পড়বে। অমনি ছাতাটা খুলে গিয়ে প্রকাণ্ড গোল হয়ে ফুলে উঠবে, আর তাতেই পড়বার চোট সামলিয়ে যাবে। কিন্তু এরোপ্লেন থেকে সেরকম ছাতা ঝুলানো সম্ভব নয়। তাতে চলবার বাধা হয় আর ছাতার দড়িদড় কোথাও কলকব্‌জায় অটকে গেলে সেও এক সাংঘাতিক বিপদ। তাই অজকাল এরোপ্লেনে ব্যবহারের জন্যে নতুনরকম প্যারাসুট তৈরি হয়েছে। সেটাকে পোশাকের মতো করে পরতে হয়। ছাতাটাকে চমৎকার ভাবে কলে পাট করে ফিতে দিয়ে কোমরের সঙ্গে বাঁধে। ফিতেগুলো আবার কতরকম কায়দামাফিক ভাঁজ করে গুটিয়ে রাখতে হয়। তার পর দরকারের সময় হাত-পা মেলে লাফ দিলেই হল।

সন্দেশ-মাঘ-ফাল্গুন, ১৩২৬