সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/সেকালের কীর্তি
(পৃ. ২৫৮-২৫৯)
পঞ্চাশ বছর আগেকার লোকের যেরকম চালচলন ছিল তার কথা বলতে গেলে আমরা বলি ‘সেকেলে ধরন'। একালের মানুষ আমরা, এইটুকু সময়ের তফাত দেখলেই বলি 'একাল আর সেকাল'।—আর সেকালের মানুষদের ভারি একটা কৃপার চক্ষে দেখবার চেষ্টা করি। আহা! সেকালের মানুষ, তারা কিছুই দেখল না। তারা না চড়ল এরোপ্লেন, না দেখল বায়োস্কোপ, না শুনল গ্রামোফোনের গান, না খেল বিদ্যুৎ-পাখার হাওয়া, টেলিফোনের কথাবার্তা আর বিলাতের টেলিগ্রাফ এ-সব আশ্চর্য ব্যাপার কিছুই তারা জানল না; আরো আগেকার কথা ভাব, একশো দেড়শো বা দুশো বছরের কথা-তখন কোথায়-বা কলের জাহাজ কোথায়-বা রেলের গাড়ি আর কোথায়-বা সাগরজোড়া টেলিগ্রাফের তার? তখনকার মানুষ ফোটোও তোলে না, ডাকটিকিটের ব্যবহারও জানে না, এমন-কি, সাইকেলও চড়ে না। আরো খানিক পেছিয়ে দেখবে, ছাপাখানা বা খবরের কাগজেরও নাম-গন্ধ পর্যন্ত পাবে না।
দুশো বা পাঁচশো বছরে যদি এতখানি তফাত হয়, তা হলে দশ-বিশ বা পঞ্চাশ হাজার বছর আগে না জানি কেমন ছিল। সেই বুনো গোছের মানুষ, যার ঘর নাই, বাড়ি নাই, গুহার মধ্যে থাকে। যে লিখতে জানে না, পড়তে জানে না, হয়তো খালি অল্পস্বল্প কথা বলতে শিখেছে; কাপড় জামা পর্যন্ত তৈরি করতে পারে না, বড়ো জোর জানোয়ারের চামড়া বা গাছের বাকল জড়িয়ে থাকে। এমন যে মানুষ, তাকে কি আর পূর্বপুরুষ বলে কেউ খাতির করতে চায়? বল দেখি?
কিন্তু যখন ভেবে দেখি যে, ঐরকম বেচারা মানুষ, গাছ পাথর ছাড়া কোনো অস্ত্র যার সম্বল নাই, সে কি করে সেই সময়কার বড়ো-বড়ো দুর্দান্ত জন্তুগুলোকে ঠেকিয়ে রাখল, তখন তারি আশ্চর্য বোধ হয়, আর মানুষটার সম্বন্ধেও মনে একটু একটু সম্ভ্রম আসে।
ইউরোপের নানাদেশে পাহাড়ের গহ্বরের মধ্যে প্রাচীন গুহাবাসীদের নানারকম চিহ্ন পাওয়া যায়; তা থেকে সেই-সব মানুষের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য খবর পাওয়া যায়। একএকটা গুহার মধ্যে মানুষের হাড়ের সঙ্গে আরো অনেকরকম জন্তুর হাড় পাওয়া যায়। তা দেখে বোঝা যায় যে, ঐ-সব গুহার মধ্যে মানুষ ছাড়া অন্য অন্য জন্তুরাও থাকত, মানুষ এসে তাদের তাড়িয়ে গুহা দখল করেছে। আবার অনেক সময়ে হয়তো এমনও হয়েছে যে, তাদেরই অত্যাচারে মানুষকে গুহা ছেড়ে পালাতে হয়েছে।
সেকালের গুহা-ভল্লুক, খড়্গদন্ত বাঘ, লোমশ গণ্ডার, মহাশৃঙ্গী হরিণ, অতিকায় হস্তী এরাই ছিল মানুষের প্রধান সঙ্গী, শিকার ও শত্রু। পণ্ডিতেরা গুহার ভিত্ খুঁড়ে স্তরের পর স্তর মাটি পরীক্ষা করে দেখেছেন। এক-এক স্তরের এক-এক রকম ইতিহাস। খুঁড়তে খুঁড়তে কোথাও হয়তো দেখবে, এক জাগায় খালি গণ্ডারের হাড়, তার নীচের স্তরেই মানুষের তৈরি অস্ত্রশস্ত্রের চিহ্ন—অর্থাৎ সেখানে আগে মানুষ ছিল, তার পর তারা গণ্ডারের অত্যচারে পালিয়েছে। পোল্যাণ্ডের এক গুহার মধ্যে প্রায় হাজারখানেক অতি প্রকাণ্ড ভালুকের হাড় পাওয়া গিয়েছে-তার মধ্যে অনেক জন্তুই আজকাল পাওয়া যায় না।
মানুষের চিহ্নের মধ্যে কংকাল আর অস্ত্রশস্ত্রই বেশি। খুব শক্ত চক্মকি পাথরকে নানারকমে ঠুকে আর শান দিয়ে সে-সমস্ত অস্ত্র তৈরি হত। খুঁটিনাটি ঘরোয়া কাজের জন্য হাড়ের অস্ত্রও ব্যবহার করা হত। আর তা ছাড়া ভালোরকম একটা গাছের ডাল, কিম্বা অতিকায় হস্তীর পায়ের হাড় পেলেও তো বেশ একটি উঁচুদরের মুগুর তৈরি হতে পারে। ঐ সময়কার মানুষে তীর-ধনুকের ব্যবহার জানত কিনা সন্দেহ; কারণ আজ পর্যন্ত ধনুকের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নি। কাঠের জিনিস কিনা, বেশি দিন টেকে না। দু-একটা অস্ত্র দেখে মনে হয় যেন তীরের ফলক, কিন্তু সেগুলো বর্শার মুখও হতে পারে। আজকালকার বড়ো-বড়ো শিকারীদের যদি এইরকমের অস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনে বাঘ শিকার করতে বলা হয় তবে তারা যে খুব উৎসাহ প্রকাশ করবে, এমন তো বোধ হয় না; অথচ কেবল এই-সবের জোরেই গুহাবাসীরা সকলরকম সাংঘাতিক জন্তুকে শিকার করত।
সে যে মানুষ, অর্থাৎ বুদ্ধিমান জীব, ঐ অস্ত্রগুলোই তার প্রমাণ। তা ছাড়া সে যে আগুনের ব্যবহার জানত, তার প্রমাণ, গুহার মধ্যে কাঠ-কয়লা আর ছাইয়ের চিহ্ন। তাই নয়, তার আসবাবের সঙ্গে মোটা-মোটা হাড়ের ছুঁচ পাওয়া গিয়েছে, সুতরাং গুহাবাসীদের মেয়েরা তাদের চামড়ার কাপড় সেলাই করতে জানত। কি দিয়ে সেলাই করত? বোধ হয় চামড়ার কিম্বা তাঁতের ফিতে, নাহয় গাছের তন্তু দিয়ে। কে জানে, হয়তো তাদের মধ্যেও নানারকম বাহার দেওয়া পোশাকের ফ্যাশান ছিল। কিন্তু তাদের সবচাইতে বড়ো কীর্তি হচ্ছে এই যে, তারা ছবি আঁকতে পারত। সেগুলো হচ্ছে পৃথিবীর আদিম ছবি, গুহার দেওয়ালের উপর লাল মাটি আর ভূষা কালি দিয়ে আঁকা। মাঝে মাঝে দু-একটা মাটির মূর্তি আর হাড়ে পাথরে বা হাতির দাঁতের উপর নানারকম চেহারার নক্শা। প্রায় সমস্তই জানোয়ারের ছবি; হরিণ, ঘোড়া, বাইসন, হাতি এই-সব।