সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/আদ্যিকালের গাড়ি
(পৃ. ২৭৯-২৮১)
আমার বেশ মনে আছে, ছেলেবেলায় রাস্তায় কেউ সাইকেল চড়ে গেলে, আমরা ছুটোছুটি করে দেখতে যেতাম, আর মনে করতাম ভারি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখছি। এখন কলকাতার রাস্তা দিয়ে সাইকেল, মোটরসাইকেল, নানারকম মোটর গাড়ি, ইলেকট্রিক ট্রামএই-সব কত যে যাচ্ছে তার ঠিকানাই নাই। এই-সব দেখে দেখে এখন পুরানো হয়ে গিয়েছে; এমন-কি, মাথার উপর দিয়ে এরোপ্লেন উড়ে গেলেও লোকে আর তেমন ব্যস্ত হয়ে ফিরে তাকায় না।
দু-চারশো বছর আগেকার একটা মানুষকে যদি হঠাৎ আজকালকার কোনো বড় শহরের রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া যায়, তা হলে সে যে কিরকম আশ্চর্য হয়ে যাবে, তা সহজেই বুঝতে পার; কিন্তু আমাদের মতো একালের কোনো শহুরে মানুষ যদি হঠাৎ সেই সময়কার শহরের মধ্যে গিয়ে পড়ে তা হলে তার কাছেও সেটা কম অদ্ভুত ঠেকবে না। অন্য শহরের কথা ছেড়েই দিলাম, এত যে বড়ো লণ্ডন শহর, কয়েকশত বছর আগে তার যেরকম দুরবস্থা ছিল তা শুনলে অবাক হয়ে যেতে হয়। শহরের রাস্তাগুলো ছিল উঁচু নিচু, রাত্রে বাতি জ্বলে না, গাড়ি ঘোড়ার চল নাই, চোর ডাকাতের ভয়ে লোকে সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরোতে সাহস পায় না। সে সময় শহরে দু-দশ জন বড়োলোক ছাড়া কারও গাড়ি চড়বার উপায় ছিল না।
প্রথম যারা কতগুলো ভাঙাচোরা গাড়ি জোগাড় করে সাধারণ লোকেদের জন্য ঠিকে গাড়ির ব্যবসা চালাবার চেষ্টা করেছিল, শহরের লোকেরা তো তাদের উপর চটেই গেল। টেমস নদীর মাঝিরা পর্যন্ত বলতে লাগল যে সাধারণ লোকেরা যদি গাড়ি চড়বার সুবিধা পায়, তা হলে সবাই গাড়ি চড়তে চাইবে-কেউ আর নদী দিয়ে নৌকো করে যাতায়াত করতে চাইবে না, মাঝিদের ব্যবসা মাটি হবে। এমন কি, ইংলণ্ডের রাজা প্রথম চার্লস স্বয়ং হুকুম দিলেন যে এরকম গাড়ি যেন আর বেশি তৈরি না হয়, কারণ তা হলে শহরের রাস্তাগুলো একেবারে মাটি হবে। রাস্তাটা যে মেরামত করে ভালো করা উচিত, সে খেয়াল কারো মাথায় এল না। যা হোক, রাজার নিষেধ এবং মূর্খদের গোলমাল সত্ত্বেও ঠিকে গাড়ির সুবিধা বুঝতে লোকের খুব বেশি দিন সময় লাগে নি।
‘ঠিকে গাড়ি’ বলতে যদি আজকালকার গাড়ির মতো কিছু একটা বুঝে নাও, তা হলে নিতান্তই ভুল বুঝবে! কত অদ্ভুতরকমের গাড়ি যে সে সময় দেখা যেত তা চোখে না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানো শক্ত। গাড়ির ভিতরে, বাইরে, ছাত এবং পিছনে যত লোক ঠাসা যায় এক-একটা গাড়িতে তত লোক চড়ত। গাড়িতে চড়বার জন্য রীতিমত মই লাগাতে হত। গাড়িতে স্প্রিং-ট্রিং কিছুই থাকত না, খালি একটা কাঠের ফ্রেমের উপর কয়েকটা কাঠের খোপ বসিয়ে পেরেক আর চামড়া দিয়ে এঁটে দেওয়া হত। নিতান্ত গরিব যারা, অথবা যারা শহরের বাইরে থাকত তাদের পক্ষে এরকম গাড়িও অনেক সময় জুটত না, তাদের জন্য আজকালকার গোরুর গাড়ির মতো একরকম গাড়ি তৈরি হত তার উপরে তাঁবুর মতো ছাউনী দেওয়া। আর ভিতরে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন লোককে পুরে দেওয়া যায়, এইরকম বড়ো করে গাড়ি তৈরি হত। আট-দশটা ঘোড়ায় অত্যন্ত টিমে তেতালা চালে সেই গাড়ি শহর থেকে শহরে টেনে নিয়ে যেত। আজকাল যেরকমের গাড়িকে বাস্ (Bus) বলে, একশো বছর আগে তার সৃষ্টিই হয়নি।
বাইসাইকেল জিনিসটা নিতান্তই আজকালকার। প্রথম যারা বাইসাইকেল তৈরি করেছিল, তাদের এক-একটা গাড়ির যে কি অদ্ভুত চেহারা হত যে দেখলে আমাদের হাসি পায়। কোনোটা অসম্ভবরকম উঁচু, কোনোটায় চড়তে হলে সোয়ারকে হাতল ধরে ঝুলে থাকতে হয়; কোনোটার আবার এমনি বন্দোবস্ত যে কল চালাতে হলে সোয়ারকেও সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে হয়; এইরকম খানিকক্ষণ দৌড়লে গাড়ি যখন বেশ জোরে চলতে থাকে তখন সে তার পা দুটো গুটিয়ে নেয় আর সাইকেলটা আপনি আপনি খানিক দূর পর্যন্ত গড়গড় করে চলে যায়। গাড়ির বেগ যেই কমে আসে, অমনি আবার পা ঝুলিয়ে ছুটতে হয়। এই-সমস্ত অদ্ভুত সাইকেলের কোনোটারই বিশেষ চল হয় নি। চল হবেই-বা কেন? যদি একটু আরাম করে বসে গাড়ি চড়তে না পারলাম, তা হলে গাড়ি চড়ে লাভ কি?
প্রথম যখন রেলগাড়ি চলতে আরম্ভ করে তখন নিয়ম ছিল যে গাড়ির আগে আগে একজন ঘোড়সের নিশানা নিয়ে ছুটবে আর চেঁচিয়ে সকলকে সাবধান করে দেবে। সে রেলগাড়ি যে কেমন চলত তা এর থেকেই বুঝতে পারছ। সে সময় থার্ডক্লাস গাড়িগুলোর ঢালচুলো কিছুই থাকত না। একটা মস্ত কাঠের তক্তাকে বাক্সের মতো চারিদিকে ঘেরাও করে, তার মধ্যে কতগুলো বেঞ্চি রেখে দেওয়া হত; লোকেরা তার মধ্যেই ঠাসাঠাসি করে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে বসে জায়গা করে নিতো।
খুব শৌখিন লোকেরা একেবারে নিজেদের গাড়িসুদ্ধ ট্রেনে গিয়ে চাপতেন। ষাট বৎসর আগে ফ্রাসের রাজা লুই ফিলিপ যখন ইংলণ্ডে যান তখন তার জন্যও এইরকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একখানা চমৎকার ল্যাণ্ডো গাড়ি একটা খোলা রেলগাড়ির উপর চাপিয়ে সেই ল্যাণ্ডোতে করে তাঁকে লণ্ডনে আনা হয়েছিল।
রেলগাড়ি চলবার সঙ্গে সঙ্গেই মোটর গাড়ি চালাবার চেষ্টা আরম্ভ হয়। সে-সব গাড়ি স্টীমে চালানো হত, আর তার চেহারা আজকালকার কোনোরকম মোটর গাড়ির মতো একেবারেই নয়।