সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/আহ্লাদী মিনার
(পৃ. ২৭৮-২৭৯)
মানুষ যখন ঘরবাড়ি তৈরি করে, তখন যত্ন করে মাটাম ধরে দেখে, বাড়ির দেয়ালটেয়াল সব ঠিক খাড়াভাবে গাঁথা হচ্ছে কিনা। তুমি যদি কাত করে তোমার বাড়ি বানাও তবে লোকে হয় তোমাকে পাগল বলবে, নাহয় ভাববে লোকটা আনাড়ি। অনেক পুরানো বাড়ি আছে যার দেয়ালগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে, বাড়ি আর এখন খাড়া নেই,—একদিকে হেলে পড়েছে। বেশি কাত হয়ে গেলে সে বাড়ি ভেঙে ফেলতে হয়। তা না হলে সেটা কোনো দিন আপনা থেকে ঘাড়ের উপর ভেঙে পড়তে পারে।
কিন্তু ইটালির পিসা শহরে একটি প্রকাণ্ড মিনার বা স্তম্ভ আছে, সেটা এমন কাতভাবে তৈরি যে দেখলে মনে হয়,—এই বুঝি হুড়্মুড়্ করে সব আছাড় খেয়ে পড়ল। অথচ আটশো বছর ধরে সে এইরকম আহ্লাদীর মতো হেলেই আছে—তার পড়বার কোনো মতলব আছে বলে মনে হয় না। মিনারের আশেপাশে তার সমবয়সী কত যে বাড়ি ভেঙেচুরে লোপ পেয়ে গেছে, তার আর সংখ্যা নাই। ভেনিস শহরের লোকেরা একটা চমৎকার স্তম্ভ বানিয়েছিল; তাই দেখে তাদের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্যই পিসার লোকেরা এই স্তম্ভটি বানায়। ভেনিসের স্তম্ভটি কয়েক বৎসর হল ভেঙে পড়ে গেছে কিন্তু এটি এখনো বেশ চমৎকার অবস্থায় আছে—ভাঙবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এই হেলানো মিনারটির উপর থেকে মাটাম ঝোলালে দেখা যায় যে, তার চুড়োটা প্রায় তেরো ফুট হেলে পড়েছে! এমন অদ্ভুত বাঁকা স্তম্ভ বা দালান পৃথিবীর আর কোথাও নাই।
মিনারটি যখন তৈরি করতে আরম্ভ করা হয়, তখন অবশ্য তাকে খাড়া করে বানাবারই কথা ছিল; কিন্তু খানিকটা তৈরি হবার পর একদিকের মাটি বসে যাওয়ায় খাড়া দালান কাত হয়ে পড়ল। তখন কেউ কেউ বললেন, “এখানে দালান তোলা চলবে না—ভালো জমি দেখে আবার নতুন করে তৈরি করতে হবে।” কিন্তু অনেক আলোচনার পর শেষটায় স্থির হল যে, ঐরকম ট্যারচা ভাবেই স্তম্ভ তৈরি করা হবে। হরেকরকম খাড়া মিনার তো সব দেশেই আছে। কিন্তু পিসার এমন একটি স্তম্ভ হবে যেমনটি আর কোথাও নাই।” বড়ো-বড়ো রাজমিস্ত্রী সর্দারেরা বলল, “হাঁ ঐরকম কাত করেই আমরা মিনার স্তম্ভ বানিয়ে দেব।” এমন কায়দায় আগাগোড়া হিসাব করে মিনার গাঁখা হয়েছে যে তার সমস্তটা ভার স্তম্ভের ভিতর দিকেই পড়েছে। মিনারটা দেখতে যতই পড়ো পড়ো গোছের মনে হোক না কেন, বাস্তবিক পড়বার দিকে তার কোনো ঝুঁকি নাই।
মিনারটি দেখতেও অতি সুন্দর,—তার আগাগোড়া মার্বেল পাথরে ঢাকা। প্রতি বৎসর নানা দূর দেশ থেকে বহু লোকে এই স্তম্ভ দেখবার জন্য পিসা শহরে যায়। পিসা শহরটি আরো নানা কারণে প্রসিদ্ধ। এই শহরে বিজ্ঞানবীর মহাপণ্ডিত গ্যালিলিওর জন্ম হয়। সে প্রায় তিনশো বৎসর আগেকার কথা। এই গ্যালিলিওই বলেছিলেন যে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এবং তার জন্য সেকালের মূর্খ পাদরিদের হাতে তাঁকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। এই হেলানো মিনারের উপর থেকে গ্যালিলিও ‘ভারি জিনিসের পতন' সম্বন্ধে কতগুলি পরীক্ষা করেন। এখনও বিজ্ঞানের বইয়ে সেই-সমস্ত পরীক্ষার কথা আলোচনা করা হয়। সে সময়ে লোকের বিশ্বাস ছিল যে, যে জিনিস যত ভারী, শূন্যে ছেড়ে দিলে সে জিনিস তত তাড়াতাড়ি মাটিতে পড়ে। দুহাজার বৎসর আগে মহাপণ্ডিত আরিস্টটল এ কথা বলে গিয়ে ছিলেন সুতরাং সকলেই তা বিশ্বাস করত। তিনি বলেছিলেন যে একটা লোহার গোলা যদি আর একটার চাইতে দশ গুণ ভারী হয়, তা হলে দুটোকে একসঙ্গে ছেড়ে দিলে একটা আর একটার চাইতে দশ গুণ তাড়াতাড়ি মাটিতে পড়বে। গ্যালিলিও বললেন, “তা কখনোই হতে পারে না। দুটোই একসঙ্গে সমান বেগে পড়বে।” গ্যালিলিওর কথা শুনে পণ্ডিতেরা ক্ষেপে গেলেন। তারা বললেন, “লোকটার আস্পর্ধা দেখ। অ্যারিস্টট্লের মতো অত বড়ো পণ্ডিতের উপর আবার টিপ্পনী করতে চায়!” গ্যালিলিও বললেন, “অত রাগারাগিতে দরকার কি? এসো, আমি পরীক্ষা করে দেখাচ্ছি। আমার কথা হাতে-কলমে প্রমাণ করতে না পারলে তখন তোমরা যা ইচ্ছা তাই বোলো।”
তার পর একদিন গ্যালিলিও পরীক্ষা দেখবার জন্য পিসা বিদ্যালয়ের যত অধ্যাপক আর যত ছাত্র সকলের সাক্ষাতে এই আহ্লাদী মিনারের সাততলার উপর উঠলেন। সেখানে উঠে তিনি দু হাতে দুটো লোহার গোলা নিলেন—একটার ওজন আধ সের আর একটার পাঁচ সের। গোল দুটিকে তিনি ঠিক একসঙ্গে ছেড়ে দিলেন আর সকলের সামনে ঠিক একসঙ্গে তারা মার্টিতে পড়ল! গ্যালিলিও আবার বললেন, “তোমরা যে কেউ এসে পরীক্ষা করে দেখতে পার—দুটো গোলা দুরকম ওজনের হলেও ঠিক একসঙ্গে মাটিতে পড়বে।” কিন্তু মানুষের কতরকমই দুর্বুদ্ধি হয়। পণ্ডিতেরা বললেন, “এ হতভাগার কথা আমরা কেউ শুনব না! মহাপণ্ডিত অ্যারিস্টট্ল যা বলেছেন তার উপর আর কথা নেই।” পিসা শহরময় ঘোর আন্দোলন আরম্ভ হল। গ্যালিলিওর বক্তৃতায় আর তেমন ছাত্রই হয় না; যারা যায় তারাও খালি গোলমাল বাধায়, দুয়ো দুয়ো করে, আর ঠাট্টা করে হাততালি দেয়!
লোকের উৎপাতে শেষটায় গ্যালিলিওকে তার জন্মস্থান ছাড়তে হল! একটা সত্য কথা বলবার জন্য মানুষের কি শাস্তি! যা হোক, পরে তার জন্য গ্যালিলিওর সম্মান তো বাড়লই সঙ্গে সঙ্গে পিসার প্রসিদ্ধ মিনারটিও আরো প্রসিদ্ধ হয়ে উঠল।