সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/হেঁয়ালি-নাট্য

হেঁয়ালি-নাট্য

 ইংরাজিতে একরকম খেলা আছে, তাকে বলে, ‘শ্যারাড্’ (Charade)। এ খেলা দেখতে হলে এমন কয়েকটি লোক দরকার যারা অন্তত একটু-আধটু অভিনয় করতে পারে। তার পর এমন একটি কথা নিয়ে অভিনয় করতে হবে যাকে ভাগ করলে দু-তিনটা কথা হয়, যেমন Handsome (Hand ও Some বা sum) অথবা carpet (Car বা cur ও pet)! অভিনয়ের প্রথম দৃশ্যে কথার প্রথম অংশটি, দ্বিতীয় দুশ্যে দ্বিতীয় অংশটি, তৃতীয় দৃশ্যে সমস্ত কথাটি বুঝিয়ে দিতে হবে। যারা দর্শক থাকবেন তারা সব দেখেশুনে বলবেন, কোন কথাটি নিয়ে অভিনয় করা হল। যদি কোনো কথার তিনটি অংশ থাকে- যেমন হাঁস পা-তাল, তা হলে অবশ্য চারটি দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে। বাংলাতেও ‘শ্যারাড্' বা ‘হেঁয়ালি নাট্য' হতে পারে। একটা বাংলা দৃষ্টান্ত দিলে বোধ হয় কথাটা পরিষ্কার হয়। মনে করে ‘বৈঠক' কথাটা নিয়ে অভিনয় হচ্ছে।

 প্রথম দৃশ্য-'বই'। একজন লোক দিনরাত খালি বই নিয়ে ব্যস্ত, কেবলই বই পড়ছে। তার চারিদিকে রাশি রাশি বই ছড়ানো রয়েছে দেখে বন্ধুরা বিরক্ত হয়ে বলছে, “তোমার ও পোড়া বইগুলো একটু রাখ দেখি। চল একটু হাওয়া খেয়ে একবার নরুবাবুর বৈঠকে যাই।” লোকটি অগত্যা রাজি হয়ে বলল, “আচ্ছা, তোমরা এগোও, আমি এইটা শেষ করেই আসছি।”

 দ্বিতীয় দৃশ্য-“ঠক্'। একটি ছোট্ট বইয়ের দোকান, তার সামনে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক বইওয়ালাকে ভীষণ গালাগালি দিচ্ছেন। বলছেন, “চোর বাট্‌পাড় ঠক্ জোচ্চোর আগাম টাকাটা নিয়ে এখন বই দেবার বেলায় ফাঁকি দিচ্ছ।” বইওয়ালা বলে, “সে কি মশাই। কার কাছে টাকা দিলেন?” ভদ্রলোক চটেমটে খুব খানিক শাসিয়ে চলে গেলেন। এমন সময়ে সেই বই-পড়া লোকটি এসেছে। বইওয়ালা তাকে একটা বহুকালের পুরনো পুঁথি দেখাল—তার অনেক দাম। লোকটি বইখানা কিনে বলল, বইটা একটু কাগজে জড়িয়ে বেঁধে দাও তো।” বইওয়ালা “দিচ্ছি” বলে বইখানা নিয়ে তার বদলে কতগুলো বাজে বটতলার বই বেঁধে দিয়ে বলল, “এই নিন মশাই।” বই-পড়া লোকটি তখন হাঁ করে অন্য বই দেখছিল, সে কিছুই টের পেল না, বইয়ের প্যাকেট নিয়ে চলে গেল।

 তৃতীয় দৃশ্য-‘বৈঠক'। নরুবাবুর বৈঠকে বসে বন্ধুরা বলাবলি করছে, “আরে, অমুক কি আমাদের বৈঠক একেবারে ছেড়ে দিল নাকি?” একজন বললে, “না, সে আজ আসবে বলেছে।” এমন সময় বই হাতে সেই লোকটির প্রবেশ। সকলের মহা উৎসাহ। একজন বললে, “এত দেরি হল যে?” “আর ভাই, পথে একটা কেতাব কিনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল”-বলেই বইয়ের ব্যাখ্যা আর প্রশংসা। সকলে দেখতে চাইল, আর কাগজের মোড়ক খুলতেই বেরোল কতগুলো ছেড়া নোংরা বটতলার বই। ভদ্রলোক অপ্রস্তুত -সকলের হাস্যকৌতুক-ইত্যাদি।

 হেঁয়ালি অভিনয় করতে হলে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হয়।

 ১. যে দৃশ্যে যে কথার অভিনয় হচ্ছে তাতে অন্তত একবার সেই কথাটা বলা দরকার। তা বলে বার বার বেশি স্পষ্ট করে বলাটাও ঠিক নয়।

 ২. যে কথাটার অভিনয় হচ্ছে তার সঙ্গে কিছু অন্য কথা আর অবান্তর অভিনয়ও কিছু কিছু থাকা দরকার। না হলে কথাটা নেহাত সহজে ধরা পড়ে যেতে পারে।

 ৩. দৃশ্যগুলি বেশি বড়ো না হয়। ছোটো-ছোটো তিনটি দৃশ্য হলেই ভালো।

 হেঁয়ালি নাট্যের উপযোগী কথা বাংলায় অনেক আছে; যেমন-“জলপান’ ‘বন্ধন’ (বন +ধন) 'কারখানা’ ‘আকবর’ (আকবর) 'বৈকাল’ ‘যমালয়' (জমা+ লয়) ইত্যাদি।

 আর-একরকমের হেঁয়ালি অভিনয় আছে, তাকে বলে Dumb charade অর্থাৎ বোবা শ্যারাড্। সে খেলায় কথা বলে না,শুধু বায়োস্কোপের মতো হাত-পা নেড়ে কথাগুলোর অভিনয় করে।

সন্দেশ বৈশাখ, ১৩২৮